Next
Previous
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in








কুড়ি

রিমির পাশের বাড়িতে রাজু আর রাজুর বউ প্রজ্ঞা থাকে।রিমি না থাকলেই বিপিন প্রজ্ঞার কাছে যায়,কথা বলে।বিপিন গান করে,"গোলেমালে, গোলেমালে পিরীত কোরো না"। প্রজ্ঞা বলে,খুব তো সাহস দেখাও।বিয়ের আগে তো কিছু বলতে পারো নি। এখন তো আমি পরের বউ গো।বিপিন বলে,অপরজনা এখন আমার আপনজন হয়ে বসে আছে।বিপিন অতীতের কথা বলে প্রজ্ঞাকে,যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। ১৯৮০ সালের কথা এগুলি।এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।

বিপিন বলে,এবার আসি কবিতার কথায়। নব্বই দশকের বাংলা কবিতার যে প্রধান বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ ছান্দিক কাঠামোর মধ্যে থেকে বিষয় ভিত্তিক কবিতা লেখা, বা বলা যায় ভাবপ্রধান বাংলা কবিতার এক প্রবর্ধন, তা শূন্য দশকে এসে বেশ খানিকটা বদলে যায়। আমরা লক্ষ্য করি লিরিক প্রধান বাংলা কবিতার শরীরে কোথাও একটা অস্বস্তি সূচিত হয়েছে। হয়ত নব্বই দশকের লেখা থেকে নিজেদের আলাদা করার তাগিদ থেকেই এই উত্তর। হয়ত সত্তর দশকের ছায়ায় লালিত বাংলা কবিতার পাঠাভ্যাস থেকে নিজেদের আলাদা করার এক সচেতন প্রচেষ্টা। যেখানে নব্বই দশকের সংকলন করতে গিয়ে সম্পাদক সে দশকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখেন প্রেম এর সঙ্গে এটিএম এর অন্ত্যমিল, সেখানে শূন্য দশকের সম্পাদককে ঘাঁটতে হবে নির্মাণের ইতিহাস। যেখানে নব্বই দশকের কবি খুঁজে বেড়িয়েছেন গল্প বলার ছান্দিক দক্ষতা, সেখানে শূন্য দশকের কবি খুঁজেছেন ভাষা প্রকরণ। হয়ত এর পিছনে কাজ করেছে এক গভীর সত্য যে কবিতা আর জনপ্রিয় হয় না। কবি আর চটুল মনোরঞ্জন করবেন না। আর এই কাজে শূন্য দশক অনেকাংশই তাদের শিকড় পেয়েছে আশির দশকের নতুন কবিতা আন্দোলনে।

এছাড়া বাঙালীর দুর্গাপুজে এক ভালোলাগার দলিল।ঘুরে ঘুরে সারারাত কলকাতার ঠাকুর দেখা আর খাওয়াদাওয়া, ধুনুচি নাচের স্মৃতি জড়িয়ে বেঁচে থাকুক অমলিন স্মৃতি।কুমোরপাড়ার খ্যাতি ছিল হাঁড়ি কলসি ও অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য বাসনপত্র তৈরির জন্যই। এখানকার পুরনো অধিবাসীদের কথায় জানা যায়, বিশ শতকের গোড়ার দিকেও নাকি এখানে কিছু মাটির হাঁড়ি-কলসি নির্মাতার দেখা পাওয়া যেত। প্রথমে হাঁড়ি-কলসি, তার পরে ঘর সাজাবার পুতুল এবং একটা সময়ের পরে, যখন দুর্গাপুজো ক্রমে আমজনতার উৎসবে পরিণত হল, তখন থেকে ছোট্ট সেই কুমোর পাড়া রূপান্তরিত হয়ে উঠতে লাগল প্রতিমা নির্মাণের প্রধানতম কেন্দ্র,কুমোরটুলিতে।

বাসস্টপেজেই অতনুর বাড়ি।সে বলে, রাত বাড়লে বাসস্ট্যান্ড একটা আমোদের জায়গা হয়ে যায়। অন্ধকারে শুয়ে থাকা কিশোরী থেকে বুড়ি ভিখারির পাশে শুয়ে পড়ে মাতালের দল। তারা তো জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি খায় না। শুধু একগ্রাস ভাত জোগাড় করতেই তাদের দিন কেটে যায়। তারপর রাতচড়াদের বাজার। কেউ ওদের মালিক নয়। বাজারি মাল দরিয়া মে ঢাল। ঠিক এই পদ্ধতিতে পৃথিবীর আলো দেখেছিল অতনু। কে তার বাপ সে জানে না। আর জন্মদাত্রী ফেলে দিয়েছিল বাসের ছাদে। সেখানে শকুনের মত ওৎ পেতে থাকে হায়েনার মত ভয়ংকর অমানুষের দল। তারা অনাথ ছেলেমেয়েদের নিয়ে বড় করে। বড় হলে চুরি বা ভিক্ষা করে তারা যে টাকা আয় করে তার বৃহৎ অংশ নিয়ে নেয় হায়েনার দল। না খেতে পাওয়ার প্রবাহ চলতেই থাকে। এর থেকে মুক্তি পায় না অনাথ শিশুরা।

অতনু এখন বেশ স্মার্ট, বুদ্ধিমান। সে নিজের চেষ্টায় মেকানিকের কাজ শিখে নিয়েছে। মাথা উঁচু করে চলা ছেলেদের সকলেই সমীহ করে।

অতনু চুরি করে না, ভিক্ষাও করে না। সে বলে, হাত পা আছে। খেটে খাব। আর তোদের যা পাওনা মিটিয়ে দেব। সে বলে হায়েনার দলকে, বেশি ঘাঁটালে আমাকে, দেব শালা খালাস করে। আমার বাঁধন শক্ত বে। ওসব মাস্তানী তোর পকেটে রেখে দে।

যতই হোক শয়তানদের সাহস কিন্তু বেশি হয় না। অতনু একটা দল করেছে ছেলে মেয়েদের। সে বলে, শালা, কোন শালা রাতে খারাপ কাজ করতে এলে একসঙ্গে আ্যটাক করব। ওদের দৌড় বেশিদূর নয়। অতনু থাকতে আর অনাথের দল বাড়াতে দেব না বাসস্টপে। এই এলাকা এখন নতুন প্রজন্মের। ওরা আমাদের বড় করেছে তাই ওদের পাওনাটুকু দেব।

হায়েনার দল সাবধান হয়ে গেছে। এখন আর অনাথ বাচ্চা কম পায় এইস্থানে। অতনুর বিরুদ্ধে কাজ করে ওরা অনেকবার ঠকেছে।অতনুর দলবল দেখে ওরা অন্য জায়গায় ডেরা বাঁধে।

অতনু সকলকে নিজের পরিবারের সদস্যের মত দেখে।

এই পরিবারের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সুনীতা। সে পাশের পাড়ায় থাকে। অতনু তার আদর্শ। কিন্তু অতনুর বংশ পরিচয় নেই। তা না থাক তবু সে সমাজসেবী।

অতনু দেখেছে মারামারি বা লড়াই করে জেতার থেকে ভালবাসার জোর বেশি। ভালোবেসে কথা বললে শয়তানও বশ হয়ে যায়। এখন সে একদম আনন্দে থাকে। এলাকার লোকজন তাকে ভালবাসে।

সুনীতা ভাবে, অতনুদা এত বড় মন পেল কোথা থেকে।

সকলের উপকারে ছুটে যায় অতনু। হাসপাতাল,শ্মশান যেখানে যার প্রয়োজন প্রথমেই ডাকে তাকে। সুনীতা ভাবে, সে কি অতনুর প্রেমে পড়েছে। সবসময় অতনুকে দেখতে পায় খাতায়, জলে, দেওয়ালে, আয়নায়। তবু অতনুকে বলতে সাহস হয় না। যদি রেগে যায়। যা ব্যক্তিত্ব ছেলেটার, শ্রদ্ধা হয়। সুনীতা সবসময় এখন এইসব ভাবে।

অতনু বলে তার বন্ধুকে, আমি তো অনাথ, বেজন্মা। ভদ্র সমাজে আমার স্থান হবে না। আমি কি চিরদিন এই বাসস্টপেজেই থেকে যাব?

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in










১৮ (১) 

“ অনেকদিন আগের কথা। এক ছিলেন নবাব সাহেব, আর তাঁর ছিল এক শাহজাদা, বাপের সুপুত্তুর।

“ ভাল হল তোমরা পঞ্চায়েতের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছ। সেই প্রসঙ্গেই আমার এই কিসসা মনে পড়ল। ছোটে পালোয়ান সরপঞ্চকে মুখের উপর চ্যালেঞ্জ করেছে—বেশ করেছে। পঞ্চায়েত আদালতের বিচার ছোটেলালের মত লোকের জন্যে নয়। ও হল বড়মাপের মানুষ। এত বড় পালোয়ান! তায় আমাদের কলেজ কমিটির মেম্বার। ওখানকার বিচার তো গেঁয়ো লোকদের জন্য। কানাকড়ি দাম নেই এসব বিচারের। কোড়িল্যা মার্কা বিচার। হেঁ—হেঁ –হেঁ, কোড়িল্যা কাকে বলে জানো? রুক্ষ উষর জমিতে আপনা থেকেই জন্মায়। গ্রীষ্মকালে দেখে থাকবে—সাদা সাদা ফুল।

“আরে তুমি হলে শহুরে বাবু, এসব কী করে দেখবে? এই পঞ্চায়েতী আদালত? ওরা ওই কোড়িল্যা-ছাপ রায় দেয়। আর ওই সরপঞ্চ? সবাইকে কিছু একটা ফালতু গুরুগম্ভীর লেকচার দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। কিন্তু এবার পালা পড়েছিল ছোটে পালোয়ানের সাথে—একেবারে কুপোকাত! ও যেমন বুনো ওল, ছোটে তেমনি বাঘা তেঁতুল! ----

“কুসহরপ্রসাদকে আগেই বলেছিলাম-- পঞ্চায়েতী আদালতে যেওনা। শুনলে তো! এখন মাথায় ঢুকেছে। সরপঞ্চ চার-পাঁচটা কাঁচাপাকা শুনিয়ে দিতেই সব শুধরে গেল। ওখানেই ছোটেলালজীর সঙ্গে মিটমাট করে নিল।

“ ঠিকই হল, বাপ-বেটার মধ্যে কীসের আকচা-আকচি?

যা বলছিলাম, ওঁর ছিল এক শাহজাদা। কার? নবাব সাহেবের। হ্যাঁ, হ্যা; ওই কিসসাটাই তো বলছি। একবার ওর হল খুব অসুখ। জ্বর কিছুতেই নামছে না। কয় মাস ধরে ভুগছে; অনেক দামি দামি ওষুধ, বড় বড় কবিরাজ, হাকিম, ডাক্তার। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। কোটি কোটি টাকা নর্দমার জলের মত খরচ হচ্ছে, কিন্তু শাহজাদার হাল যে কে সেই।

“নবাব সাহেব মাথা চাপড়াচ্ছেন। চারদিকে ডঙ্কা বাজানো হল—কেউ এসে আদ্দেক সম্পত্তি নিক, শাহজাদিকে বিয়ে করুক,--কিন্তু শাহজাদাকে সারিয়ে তুলুক! এবার দূর দূর থেকে হাকিমের দল এলেন। অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু শাহজাদা চোখ মেললেন না।

“শেষে এলেন এক বুড়ো হাকিম। শাহজাদাকে দেখে বললেন, ‘আদ্দেক সম্পত্তি ও শাহজাদীতে আমার লোভ নেই, ভোগ-বিলাসে রুচি নেই। যদি আমার একটা দরখাস্ত মঞ্জুর করেন তো শাহজাদাকে সারিয়ে তোলার দায়িত্ব আমার। কিন্তু দরখাস্ত গোপনে পেশ করব’।

“তো নবাবের হুকুমে দরবার খালি হয়ে গেল। হাকিম বললেন, ‘বন্দাপরবর! দাসের প্রতি আপনার অনেক কৃপা। এবার বেগমকে এখানে আসতে হবে। যা জিজ্ঞেস করব তার জবাবে সত্যি কথা বলতে হবে।‘

“নবাব সাহেবও সেখান থেকে চলে গেলেন। বেগম সাহেবার দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে হাকিম বললেন, ‘যদি শাহজাদার প্রাণ বাঁচাতে চান তো সত্যি কথা বলুন। শাহজাদা আসলে কার সন্তান? কার ঔরসে জন্ম’?

“বেগমা সাহিবা কাঁদতে লাগলেন। বললেন, ‘কাউকে বলবেন না! একসময় মহলে কাজ করত এক ভিস্তি, শাহজাদা তার ছেলে। তরতাজা জোয়ান, গ্রাম থেকে নতুন নতুন এসেছিল, তারপর কী করে যে কী হয়ে গেল তা’ জানিনা’।

“এটা শোনামাত্র হাকিম বললেন, ‘শুক্রিয়া! আর কিছু বলতে হবে না’। চুটকি বাজিয়ে বললেন, ’কথায় কথায় বুঝে গেছি শাহজাদা কীভাবে সারবেন’।

“তারপর হাকিম সাহেব আগের সব ওষুধ ফেলে দিলেন। কত দামি দামি দ্রব্যের অনুপান! হীরেমোতি, সোনাচাঁদি! কত রকমের অদ্ভুত সব আরক! সব নর্দমায় বয়ে গেল। তারপর উনি শাহজাদার চোখে জলের ছিঁটে দিয়ে বললেন, ‘আবে উঠ! ভিস্তির ব্যাটা! উঠে পড়’।

“ব্যস্‌, শাহজাদা চমকে উঠে চোখ খুললেন। তারপর হাকিম গেলেন মাঠে। সেখান থেকে কয়েকটা কৌড়িল্যার চারা উপড়ে এনে জলের ছিটিয়ে পিষে শাহজাদাকে গিলিয়ে দিলেন। তিনদিন নিয়মিত কৌড়িল্যার রস খেয়ে শাহজাদা চাঙ্গা!”

এই কিসস্যাটি বৈদ্যজীর দরবারে বসে শোনাচ্ছিলেন -প্রিন্সিপাল। মুখ্য শ্রোতা -রঙ্গনাথ। মুখ্য বিষয়—পঞ্চায়তী আদালত। গল্পের প্রেরণাশক্তি—ভাঙের শরবত।

উনি বলছিলেন, ‘তো রঙ্গনাথ বাবু, এই হল কৌড়িল্যামার্কা ন্যায়বিচার। দেহাতিদের এরকমই ধরে নেওয়া হয়—যত্ত নীচু জাতের লোকজন! ওদের আর কী চাই? চলে এসো পঞ্চায়তী আদালতে আর কৌড়িল্যামার্কা ন্যায়বিচার পেয়ে বাড়ি যাও!

“আর যারা বড় মানুষ, রঈস-টইস, হাকিম-হুকাম, উঁচু জাতের লোকজন। ওদের চাই দামি বিচার। ঘাস কাটার সরপঞ্চ নয়, মোটা চশমা পরা ইংরেজের মতন ইংরেজিবলা জজসাহেব। বড় মানুষদের জন্য রয়েছে জেলার বড় বড় আদালত, যেমনটি চাই তেমন।

“ওদের চেয়েও বড়দের জন্য রয়েছে অনেকগুলো হাইকোর্ট। সবচেয়ে উঁচু জাতের জন্য সুপ্রীম কোর্ট। কেউ একবার বাঁকাচোখে তাকিয়ে দেখুক তো! তাতেই সোজা দিল্লি গিয়ে রিট পিটিশন লাগিয়ে দেয়া হয়।

“কৌড়িল্যামার্কা আদালত আর যত নীচু জাতের লোক! ওখানে যদি একবার ফেঁসে যায় তো ধরে নাও বসা অবস্থা থেকে উঠে সোজা দাঁড়াতে পারবে না। এক দানা খাবারের জন্য ভিক্ষে করে বেড়াবে।

“হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট—এসবের শখ কী সবাইকে পোষায়? এক-একজন উকিলের পেছনে একশটা বেশ্যা পোষার খরচ!

“তাই গেঁয়ো লোকজনের জন্যে কৌড়িল্যা-মার্কা ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা। না হিং-লবঙ্গ, না ফিটকরি! তাতেও রঙ চোখা! এক দাগ খেয়ে দেখ, জ্বর নেমে যাবে। আমাদের দেশের কানুন একদম পাকা, --যেমন লোক, তার তেমনই আদালত”।

হঠাৎ উনি হিন্দি ছেড়ে অবধী বোলিতে চলে গেলেন। ‘যেমন পশু, তেমনি করে বাঁধা’।


গাঁয়ের বাইরে এক লম্বা চওড়া ময়দান যা ধীরে ধীরে ঊষরভূমি হয়ে গেছে। আজ একগাছি ঘাসও গজায় না। দেখলেই মনে হবে -আচার্য বিনোবা ভাবেকে ভূদান দেবার জন্য একেবারে আদর্শ জমি। আসলে তাই হয়েছিল। বছর দুই আগে এটাকে ভূদান-আন্দোলনে দিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে ওটা ফিরতি দান হয়ে গ্রামসভার অধিকারে এল। গ্রামসভা আবার ওটা প্রধানকে দান করে দিল।

প্রধান এটাকে কয়েক ভাগ করে নিজের আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবকে দিল। তারপর একটু আধটু টুকরো যা বেঁচে ছিল সেগুলো বাজারের কেনাবেচার নিয়ম মেনে কিছু গরীব ও ভূমিহীনকে “দান” করে দিল। পরে জানা গেল যে গরীব এবং ভূমিহীনকে দেয়া জমির টুকরোগুলো আসলে ওই ময়দানের অংশ নয়, বরং অন্য কোন কৃষকের জমির অংশ। সুতরাং এটা নিয়ে মোকদ্দমা শুরু হল, এখনও চলছে, ভরসা আছে—পরেও চলতেই থাকবে।

যাই হোক, ভূদান-যজ্ঞের ধোঁয়া এখনও ময়দানের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে। ওখানে খেত তৈরি হয়ে গেছে। তার প্রমাণ বলতে প্রতি পদে একএকটা আল বাঁধা হয়েছে, তার উপর বিছিয়ে দেয়া বাবলা গাছের কাঁটাওলা ডাল। সার-জল-বীজ বিনা স্রেফ ইচ্ছাশক্তির জোরে, গত বছর থেকে নাকি ভাল করে চাষ শুরু হয়েছে। আর স্রেফ পাটিগণিতের জোরে এটা প্রমাণ করা গেছে যে গ্রামসভায় গত বছর-- আগের সব বছরের থেকে – অনেক বেশি অন্ন উৎপাদন হয়েছে।

গাঁয়ের পশুর পাল কখনও কখনও ওই ময়দানকে নিজেদের চরে খাবার স্থান ভেবে পুরনো অভ্যাসে এদিকে চলে আসে। কিন্তু তারপরেই চাষিদের মধ্যে গালাগালি, মারপিট, পঞ্চায়েতের খোঁয়াড়, থানাপুলিশ, কোর্ট-কাচারি সব শুরু হত। তাই ধীরে ধীরে ওদিকে পশুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেল।

ময়দান আজকাল নিঃশব্দ নীরব। আশাবাদী কেউ যদি ওদিকে পা ফেলে তবে তার মনে হবে যে এই নীরবতার মধ্যেই প্রগতির শঙ্খ বেজে উঠল বলে!

ময়দানের এক কোণে বন-সংরক্ষণ, বৃক্ষারোপণ এসব শুরু হয়েছিল। যোজনা সফল হল কি বিফল—সেটা বিতর্কের বিষয়। চোখে পড়ে যে নালা কাটা হয়েছে আর শোনা যায় যে ওখানে বাবলা গাছের বীজ বোনা হয়েছে। এটাও শোনা যায় যে এই ‘গঁজহা’ লোকগুলো যদি অমন ‘গঁজহা’ নাহয়ে আশপাশের গাঁয়ের মত উদ্যোগী পুরুষসিংহ হত তাহলে এই উষর মরুতেও এতদিনে বাবলা গাছের বন গজিয়ে উঠত।

কিন্তু মাটি ভালো নয়, তাই নালার পাশে বাবলা গাছ গজালো না, কিন্তু পুরো যোজনা থেকে শিবপালগঞ্জের লোকেদের একটা লাভ হল। নালাগুলো ওদের সার্বজনিক শৌচালয় হয়ে গেল। এই ধরণের সরকারী স্কীম বানানো হয়েছিল বন নির্মাণের জন্য, এখন হয়ে গেল ঘরোয়া কাজের।

ময়দানের অন্য কোণে শূন্যতাকে ধর্ষণ করার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশাল বটগাছ। তারপাশে একটি কুয়ো। ওই কুয়োর বাঁধানো পাড়ে রঙ্গনাথ বসে আছে। হিন্দুস্তানের লেখাপড়া জানা লোকেদের মাঝে মাঝে একটা অসুখ হয়, তার নাম ‘ক্রাইসিস অফ কনশান্স’—বিবেকের দংশন! কোন কোন ডাক্তার এর মধ্যে ‘ক্রাইসিস অফ ফেথ’ বা বিশ্বাসের সংকট নামক অন্য একটা অসুখের লক্ষণও কষ্ট করে খুঁজে পান।

এইসব অসুখ সাধারণতঃ শিক্ষিত লোকের মধ্যেও তাদেরই হয় যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী মনে করে। মজার ব্যাপার হল এরা কেউ বুদ্ধির ভরসায় বাঁচে না, বরং আহার-নিদ্রা-ভয়-মৈথুনের মাধ্যমেই বাঁচে। (কারণ, শুধু বুদ্ধির ভরসায় বাঁচা অসম্ভব)।

এই অসুখের রোগী মানসিক চিন্তা এবং অবসাদে ভোগে, লম্বা লম্বা লেকচার ঝাড়ে এবং চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তর্ক করে। নিজেকে --বুদ্ধিজীবী হয়েছে তাই অসুস্থ, এবং অসুস্থ হয়েছে সুতরাং বুদ্ধিজীবী-- বলে প্রমাণ করত চায়। শেষে এই অসুখ নিরাময় হয় কফি হাউসের বিতর্কে, চঞ্চল মেয়েদের বাহুবন্ধনে, সরকারি চাকরি পেয়ে, কখনও কখনও আত্মহত্যায়।

কলেজে ম্যানেজারের নির্বাচন দেখার দিন থেকে রঙ্গনাথের মনে ওই অসুখের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিল। ওর মামা বৈদ্যজীকে দেখামাত্র ওর মনে সেদিনের এক দৃশ্য ভেসে ওঠে—প্রিন্সিপাল সাহেব শূলে বেঁধা শুয়োরের মতন চিঁচিঁ করতে করতে কলেজের গেট থেকে বেরোচ্ছেন আর জয়ধ্বনি করছেন। ওর মনে হল বৈদ্যজীর সঙ্গে থাকতে থাকতে ও যেন কোন ডাকাত দলের সদস্য হয়ে গেছে। যখন প্রিন্সিপাল সাহেব দাঁত বের করে ওকে কোন রগরগে কিসসা শোনাতে থাকেন---ওনার ভাণ্ডারে এমন কিসসা অগুনতি—তখন ওর মনে হয় এই লোকটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠে কারও গলা টিপে দিতে পারে।

শহরে থাকলে এখন ও কফি হাউসে বন্ধুদের সামনে বসে এই নির্বাচন নিয়ে একটা লম্বাচওড়া লেকচার ঝাড়ত। বলত—কীভাবে দেশি পিস্তলের জোরে ছংগামল ইন্টার কলেজের ম্যানেজারি কব্জা করা হল। আর টেবিল চাপড়ে বলত যে মুলুকে ছোট ছোট জায়গায় ছোট ছোট ক্ষমতা হাতিয়ে নিতে এমন সব করা হয়, সেখানে বড় বড় ক্ষমতা লাভের জন্য কী না হতে পারে!

তারপর ঠিক বা ভুলে ভরা দু-চারটে ইংরেজি কোটেশন আউড়ে কফির কাপ খালি করার পর শান্তি পেত এই ভেবে যে ও একজন খাঁটি বুদ্ধিজীবী, এবং চারটে অকম্মার ঢেঁকির সামনে গণতন্ত্রের পক্ষে এক জ্বালাময়ী বক্তিমে ঝেড়ে ধরে নিত যে এবার ও ভেতরের জমে থাকা উষ্মা বের করে নিজের ‘ক্রাইসিস অফ ফেথ’কে ধামাচাপা দিতে পেরেছে।

কিন্তু এটা তো শহর নয়, নেহাত পাড়া -গাঁ, এখানে রূপ্পনবাবুর ভাষায়, নিজের বাপকেও বিশ্বাস নেই। এছাড়া , শনিচরের ভাষায়, এখানে কাটা আঙুলে পেচ্ছাপ করার মতও কেউ নেই। তাই রঙ্গনাথ এখানে নিজের মানসিক অসুখ থেকে রেহাই পেল না। ওর মাথায় দিনরাত একটা জিনিসই ঘুরছে----ও কোন ডাকাত দলে ফেঁসে গেছে। ডাকাতগুলো হামলা করে কলেজ লুট করেছে। এবার অন্য কোথাও আচমকা হামলা করার তালে আছে। ওর শরীরমন চাইছে বৈদ্যজীকে গালি দিতে আর তার চেয়েও বেশি উসখুস করছে কার সামনে বিশ্বাস করে গালি দেয়া যায়?

এমন বন্ধু আর কে আছে? খান্না মাস্টারের পেটে কথা থাকে না। ওর সামনে বললে পরের দিন গোটা গাঁও জেনে যাবে যে বৈদ্যজীর ভাগ্নে নিজের মামাকে গালি দেয়! দেখে নাও, আজকালকার লেখাপড়া জানা ছেলেগুলোক-- ভদ্রতা শেখেনি। হ্যাঁ, মালবীয় মাস্টারের কাছে বলা যেতে পারে। ও দলবাজিতে যুক্ত হলেও বড্ড সাদাসিধে। ওর সামনে গাল দিয়ে মজা নেই। বাকি রইল কে? রূপ্পনবাবু?

রঙ্গনাথের রূপ্পনবাবুর উপর খানিক ভরসা ছিল। কারণ, ওমাঝে মাঝে প্রিন্সিপালকে গাল দিয়ে বলত—কলেজের দুর্ভাগ্য! ওনার অভিযোগ—প্রিন্সিপাল লেখাপড়ায় গবেট, কিন্তু দুনিয়াদারিতে মহা ওস্তাদ! পাক্কা ছকবাজ! বাবাকে এমন ফাঁদে ফেলেছে যে সব কাজ ওই ব্যাটার ইচ্ছেতে হলেও বাবা ভাবে বাবার কথায় হচ্ছে। ব্যাটা খান্না মাস্টারের সঙ্গে খুব বাড়াবাড়ি করেছে। মানছি, খান্না মহাবেকুব। কিন্তু ওকে এত বেশি অপমান করা ঠিক নয়। আমার বাবার কাঁধে বন্দুক রেখে এক ব্যাটা বেকুব অন্য বেকুবকে মেরে দেয়া? এটা অনুচিত।

আজ ওই বটবৃক্ষের ছায়ায় কুয়োর পাড়ে বসে রঙ্গনাথ প্রশান্ত চিত্তে এক লম্বা শ্বাস টানল। অনেক দিন পরে আজ ওর সেই অসুখ ওকে বিচলিত করছে না। হল কি,আজ ও হিম্মত জুটিয়ে রূপ্পনবাবুর কাছে নিজের আত্মসংকট নিয়ে খোলাখুলি কথা বলল। স্পষ্ট করে বলল যে মামাজীর এমনটা করা ঠিক হয়নি। আগ্নেয়াস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ম্যানেজারি হাসিল করলেন বটে, কিন্তু চারদিকে অপযশ তো রটেছে!

রূপ্পনবাবু ওনার ‘ধর -তক্তা- মার- পেরেক’ ভঙ্গিতে বললেন—‘দেখ দাদা, এসব তো পলিটিক্স। এটা তো কিছুই নয়। এ’লাইনে অনেক বড় বড় বদমাইশি হয়। পিতাজি যে পথে এগিয়ে চলেছেন তাতে আরও কিছু করতে হতে পারে। দুশমনকে –সে যেই হোক—চিৎ করতে হয়। না পারলে উনি নিজেই চিৎ হবেন, তারপর বসে বসে কবরেজি পুরিয়া বানাতে থাকবেন। কেউ ফিরেও তাকাবে না।

‘তবে কলেজটাকে অনেক শোধরাতে হবে। প্রিন্সিপাল ব্যাটা মহা হারামী। সারাদিন দলবাজি, সারাদিন কিচকিচ। খান্না মাস্টারও একনম্বরের গর্দভ, কিন্তু হারামী নয়। শালার প্রিন্সিপাল ওকে অনেক অপমান করেছে, নীচে নামিয়েছে। এবার ওকে টেনে তুলতে হবে। আমি পিতাজীর সঙ্গেও কথা বলেছি। কিন্তু উনি প্রিন্সিপালকে খাটো করতে চান না।

‘ভেবেছি , কিছুদিন বাবাকে কিছু না বলে খান্না মাস্টারকে একটু হাওয়া দেব। তাতেই প্রিন্সিপাল চিতপটাং হবে। ও শ্যালক ফুলে ঢোল হয়েছে। এখন ওর ফাটার সময়। একবার ব্যাটা চিৎ হলে বাবাও টের পাবেন ব্যাটা কত তালেবর---‘!

এইসব শুনে রঙ্গনাথ বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে নিঃশ্বাস টানল। এটা তো বোঝা গেছে যে রঙ্গনাথ এই বিষয়ে রূপ্পনবাবুর সঙ্গে কথা বলতে পারে। এটাও স্পষ্ট হল যে রূপ্পনবাবুর সামনে ও খান্না মাস্টারের জন্য সহানুভূতি দেখাতে পারে, যে পড়ে গেছে তাকে টেনে তুলতে পারে, যে ফুলে গেছে তাকে ফাটিয়ে দিতে পারে। সোজা কথায়, অন্যায়ের সামনে মুখোমুখি দাঁড়াতে না পারলেও চোরাগোপ্তা ভাবে লড়াই করে ফের সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ওর থেকে প্রায় এক ফার্লং দূরে রূপ্পনবাবু একটা গাছের পেছনে অনেকক্ষণ ধরে বসে থেকে পেটের ভেতরের গণ্ডগোল সাফ করছিলেন। এভাবে নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার সার্বজনিক সমাধান করে যখন উঠে দাঁড়ালেন তখন রঙ্গনাথও কুয়োর পাড়ে উঠে দাঁড়ালো। রূপ্পনবাবু ওর দিকে আসছিলেন না, তাই রঙ্গনাথই ওনার দিকে এগিয়ে গেল।

(চলবে)

0

গল্প - মনোজ কর

Posted in








পর্ব ২০

বণিকের মানদণ্ড দেখ দিল রাজদণ্ডরূপে

(সময়ানুক্রমিক সংক্ষিপ্ত বিবরণী)-প্রথম অংশ

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন হয়েছিল বাঙলাতেই। এশিয়াতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসার ষাট শতাংশ উপকরণই ছিল বাঙলার। ভারতবর্ষে কোম্পানির ব্যবসা ত্বরান্বিত হতে থাকল যখন আওরঙ্গজেব ১৬৯০ সালে বার্ষিক তিনহাজার টাকার বিনিময়ে কোম্পানিকে নিঃশুল্ক ব্যবসার অনুমতি দিল। ১৬৯৬ সালে কলকাতায় দূর্গ নির্মানের অনুমতি এবং তার দু’বছর পরে কলিকাতা, সূতানুটি এবং গোবিন্দপুর গ্রামের জমিদারি কোম্পানিকে লিখে দিল মোগলসম্রাট আওরঙ্গজেব। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সাময়িকভাবে কিছু সমস্যা দেখা দিলেও ১৭১৭ সালে সম্রাট ফাররুক্সিয়ার আবার নিঃশুল্ক ব্যবসার এবং কলকাতার নিকটবর্তী আটত্রিশটি গ্রামের জমিদারির অনুমতি দিল কোম্পানিকে।সেই সঙ্গে নবাবের ট্যাঁকশাল ব্যবহারের অনুমতি পেল কোম্পানি। কিন্তু অনতিবলম্বেই এই অনুমতি নিয়ে কোম্পানির বিবাদ শুরু হলো বাঙলার নবাব মুর্শিদকুলি খানের সঙ্গে। কোম্পানির আধিকারিকেরা কোম্পানির ব্যবসার বাইরে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসাও চালাত। এই ব্যক্তিগত ব্যবসাগুলিকে নিঃশুল্ক ব্যবসার বাইরে রাখার জন্য কড়া আইন প্রবর্তন করলো মুর্শিদকুলি। কোম্পানি আধিকারিকরা কিন্তু নানা ছলছুতোয় নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসাগুলির থেকে কর ফাঁকি দিতে থাকলো। ক্রুদ্ধ মুর্শিদকুলি আটত্রিশটি গ্রামের জমিদারি এবং ট্যাঁকশালের ব্যবহার সম্পর্কিত আদেশনামা প্রত্যাহার করে নিল। ১৭১৭ সাল থেকেই বাঙলার নবাব এবং কোম্পানির মধ্যে বৈরিতার সূত্রপাত।

১৭৪০ সালে অস্ট্রিয়া উত্তরাধিকার যুদ্ধের ফলস্বরূপ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। বাঙলার নতুন নবাব আলিবর্দি খান ব্রিটিশ এবং ফরাসি উভয়পক্ষকেই কড়া নিয়ন্ত্রনে রাখে এবং কোনওরকম যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু দাক্ষিনাত্যে ফরাসিদের বিজয়লাভ ব্রিটিশদের বাঙলার ফরাসিদের প্রতি সন্দিহান করে তোলে। যদি কোনওভাবে ফরাসিদের হাতে ব্রিটিশরা আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে আলিবর্দি কতটা তাদের সাহায্য করতে পারবে সে ব্যাপারেও অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকতে থাকে ব্রিটিশরা। এছাড়াও ব্যবসার ক্ষেত্রে এশিয়ার ব্যবসায়ীদের সাহচর্যে ফরাসিদের ব্যবসাও বৃদ্ধি পেতে থাকায় কোম্পানির ব্যবসাও বেশ বড়রকমের ধাক্কা খেয়েছে। সব মিলিয়ে ফরাসিদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উত্থানে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ১৭৫৫ সালে নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করে কলকাতা দূর্গকে আরও শক্তিশালী করার জন্য খনন এবং নির্মাণের কাজ শুরু করে ব্রিটিশরা। এমনকি নবাবের দরবার থেকে বহিষ্কৃত এবং পলাতক লোকেদেরও কলকাতায় নিরাপদ আশ্রয় দিতে থাকে ব্রিটিশরা। বাঙলার নবাবের সঙ্গে বিরোধ চরম আকার নেয় যখন ১৭৫৬ সালে সিরাজদ্দৌল্লা নবাবের আসনে বসে। সিরাজ কোম্পানি আধিকারিকদের ব্যক্তিগত ব্যবসাকে নিঃশুল্ক ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য নতুন করে আদেশ জারি করে। সিরাজের সঙ্গে বিরোধিতা চরম পর্যায়ে পৌঁছোয় মূলতঃ দু’টি কারণে প্রথমত রাজস্ব আত্মসাৎ করার দায়ে অভিযুক্ত কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয়দান এবং দ্বিতীয়ত নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করে দূর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করা। এই দু’টিকেই রাজদ্রোহিতার সামিল বলে ঘোষণা করে সিরাজ। সিরাজের সাবধাবাণীতে কর্ণপাত না করার শাস্তি হিসাবে সিরাজ কাশিমবাজারে কোম্পানির ফ্যাক্টরি দখল করে নেয়। সিরাজের ক্ষমতা সম্পর্কে গভর্নর ডেকের ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে ২০শে জুন সিরাজ কলকাতা দখল করে নেয়।

এই সঙ্কটের হাত থেকে ব্রিটিশদের রক্ষা করতে মাদ্রাজ থেকে বিশাল সৈন্যসমভিব্যাহারে কলকাতায় এসে পৌঁছোয় রবার্ট ক্লাইভ। ব্রিটিশদের ভয় ছিল যে সিরাজ ফরাসিদের সহায়তায় তাদের ব্যবসার ক্ষতি করতে পারে এবং ফরাসিদের সঙ্গে মিলে তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে। তাই কোনওরকম ঝুঁকি না নিয়ে রবার্ট ক্লাইভ আক্রমণের রাস্তা বেছে নেয় এবং হুগলি ও চন্দননগর ফরাসিদের কাছ থেকে দখল করে নেয়। আবদালির নেতৃত্বে আফগান আক্রমণের আশঙ্কায় সিরাজ ব্রিটিশদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে মীমাংসা প্রক্রিয়া শুরু করতে চাইলে ক্লাইভ তা প্রত্যাখ্যান করে এবং যুদ্ধের পথেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কোম্পানির আধিকারিকেরা কোনওভাবেই কমবয়সী সিরাজের অত্যাচারের কাছে মাথা নত করে নিজেদের ব্যবসা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সঙ্গে আপস করতে রাজি হলোনা। এছাড়াও নবাবের দরবারে সিরাজের বিরুদ্ধে একটা শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। সিরাজের ঔদ্ধত্য এবং অপমানজনক ব্যবহারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে বেশ কিছু ব্যবসায়ী এবং জমিদার ক্লাইভের সঙ্গে হাত মেলালো। এদের মধ্যে প্রধান ছিল জগতশেঠ মোহতাব রাই, স্বরূপচাঁদ, রাজা জানকিরাম, রাইদুর্লভ, রাজা রামনারায়ণ, রাজা মাণিকচাঁদ প্রমুখ। তাছাড়া অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ী ব্রিটিশদের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসায় নিযুক্ত ছিল এবং অনেকে ব্যবসার জন্য ব্রিটিশ জলযান ব্যবহার করতো। এরা সকলেও ব্রিটিশদের পক্ষে ছিল। জগতশঠের কথামতো সিরাজের জায়গায় তার অন্যতম সেনাধিপতি মিরজাফরকে নবাব করার পরিকল্পনা করে চক্রান্ত দানা বেঁধে উঠলো। নবাবের দরবারে চক্রান্ত আগে থেকেই চলছিল যার সদ্ব্যবহার করেছিল ব্রিটিশরা না ব্রিটিশরাই এই ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল সে প্রশ্ন অবান্তর। এই ষড়যন্ত্রের ফলস্বরূপ ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশির যুদ্ধে ক্লাইভের হাতে পরাজিত হলো সিরাজ। পলায়নরত সিরাজকে বন্দি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো এবং ব্রিটিশদের হাতের পুতুল মিরজাফরকে নবাবের আসনে বসালো ক্লাইভ। এখানেই শুরু হলো ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক উত্থানের ইতিহাস।

এরপরে শুরু হলো বহু আলোচিত ‘পলাশি পরবর্তী লুন্ঠন’ । যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই তখনকার হিসাবে ২,৭৫,০০০ পাউন্ড ভাগ করে দেওয়া হলো জল এবং স্থলবাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০সালের মধ্যে কোম্পানি মিরজাফরের কাছ থেকে আদায় করলো তখনকার হিসাবে আড়াই কোটি টাকা। ক্লাইভ ব্যক্তিগতভাবে মিরজাফরের কাছ থেকে যে ভূখন্ডের জায়গিরদারি পেয়েছিল তার মূল্য তখনকার হিসাবে প্রায় ৩৫০০০ পাউন্ড। কোম্পানি তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে বেশ বড় রদবদল নিয়ে এলো। ১৭৫৭ সালের আগে কোম্পানি বাঙলায় ব্যবসা করার জন্য দেশ থেকে বুলিয়ন আমদানি করতো। পলাশি যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শুধু বুলিয়ন আমদানি বন্ধ হলো না , তার পরিবর্তে বাঙলা থেকে চিনে এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে বুলিয়ন রপ্তানি শুরু হলো। ব্রিটিশরা এর ফলে অন্যান্য ইউরোপিয়নদের থেকে বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছে গেল। অন্যদিকে পলাশি যুদ্ধের পর কোম্পানি আধিকারিকদের সৌভাগ্যের দরজা খুলে গেল। প্রজাদের ওপর সরাসরি নিপীড়ন ছাড়াও নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় কোম্পানিকে প্রদত্ত কর সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধার অপব্যবহার করে টাকার পাহাড় গড়ে তুললো। কিছুদিনের মধ্যেই মিরজাফরের পক্ষে কোম্পানির ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাহিদা মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়লো। ১৭৬০ সালের অক্টোবর মাসে মিরজাফরকে সরিয়ে মসনদে বসানো হলো তার জামাতা মিরকাসিমকে। অল্পদিনের মধ্যেই আবার দ্বন্দ্বের শুরু হলো কোম্পানিকে দেওয়া করছাড়ের সুযোগের ব্যক্তিগত ব্যবসায় যথেচ্ছ অপব্যবহারকে কেন্দ্র করে। উপায় না দেখে মিরকাসিম করপ্রথা বিলোপ করে দিল যাতে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও সমান সুযোগ পায়। ব্রিটিশরা নবাবের এই স্বাধীন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারলো না। ফলস্বরূপ মিরকাসিমকে সরিয়ে আবার মিরজাফরকে নবাবের আসনে বসানো হলো।

১৭৬৩ সালের ডিসেম্বরে মিরকাসিম বাঙলা থেকে পালিয়ে মোগলসম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম এবং অবধের রাজা সুজাউদ্দৌল্লার সঙ্গে জোট বাঁধলো। যুবরাজ দ্বিতীয় শাহ আলম পূর্ব ভারতে স্বাধীন সাম্রাজ্য গড়ার লক্ষ্যে ১৭৫৮ সালে দিল্লী ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৭৫৯ সালের ডিসেম্বরে পিতার হত্যার সংবাদ পেয়ে সে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে এবং সুজাউদ্দৌল্লাকে নিজের উজির হিসাবে নিযুক্ত করে। মিরকাসিম যখন বাঙলা থেকে পালিয়ে তার কাছে আশ্রয় চায় তখন দীর্ঘ আলোচনার পর তারা যৌথভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহমত হয়। সুজাউদ্দৌল্লা বিহারের রাজত্ব, রাজকোষের পূর্ণ অধিকার এবং যুদ্ধজয়ের পর নগদ তিন কোটি টাকার শর্তে যুদ্ধে যোগদান করতে রাজি হয়। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে এই তিনজনের জোট ব্রিটিশদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে ব্রিটিশরা পরাজিত সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের সঙ্গে কারারুদ্ধ করে। যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে মুক্তিলাভের পরিবর্তে ১৭৬৫ সালে এলাহাবাদ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যাতে সম্রাট বাঙলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দিওয়ানি ব্রিটিশদের লিখে দেয়। এই চুক্তির বলে ব্রিটিশরা বাঙলা, বিহার এবং উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করে। মুর্শিদাবাদের দরবারে ব্রিটিশরা এসে গেল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এবং ১৭৭২ সালে বাঙলায় পরোক্ষভাবে কোম্পানিরাজ চালু হয়ে গেল। এলাহাবাদ চুক্তির শর্তানুযায়ী সুজাউদ্দৌল্লা এবং ব্রিটিশরা নিজ নিজ সাম্রাজ্যরক্ষার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলো এবং সম্মানের সঙ্গে মুক্তিলাভের বিনিময়ে সুজাউদ্দৌল্লা ব্রিটিশদের ৫০ লক্ষ টাকা নজরানা দিল। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অবধের দরবারে একজন ব্রিটিশ প্রতিনিধি নিযুক্ত হলো এবং কোম্পানি অবধে নিঃশুল্ক ব্যবসার অধিকার লাভ করলো। চুক্তির এই বিশেষ শর্তের কারণেই পরবর্তীকালে অবধ সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে।

১৭৬৫ সালে পূর্ব ভারত কোম্পানির সম্পূর্ণ অধিকারে আসে এবং দক্ষিণ ভারতে ব্রিটিশ আগ্রাসনের প্রস্তুতি শুরু হয়। ব্রিটেন-ফ্রান্স বিরোধ এই আগ্রাসনে অণুঘটকের কাজ করে। ইউরোপিয়ানদের মধ্যে ফরাসিরা সবার শেষে ভারতে আসে এবং সর্বপ্রথম এই উপমহাদেশে নিজেদের শাসন কায়েম করার পরিকল্পনা শুরু করে। ফরাসিদের মূল কেন্দ্র পন্ডিচেরিতে স্থাপিত হয় ১৬৭৪ সালে। ডুপ্লেইক্সের গভর্নর জেনারেল থাকার সময় ফরাসিরা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৭৩১ সালে ডুপ্লেইক্স প্রথমে চন্দননগরের গভর্নর হয়। দশ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে ফরাসি ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। ডুপ্লেইক্স কাজপাগল লোক ছিল। যদিও ভারতবর্ষকে সে ঘৃণার চোখেই দেখতো তবুও এই সুযোগে নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসা থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ডুপ্লেইক্স। ১৭৪২ সালে পন্ডিচেরির দায়িত্ব পায় ডুপ্লেইক্স। কালবিলম্ব না করে ডুপ্লেইক্স নিজের ব্যবসা এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপকে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে চলে। ডুপ্লেইক্সই প্রথম ইউরোপিয়ন রাজনীতিক যে ভারতীয় শাসকদের অন্তর্কলহকে ব্যবহার করে নিজের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বিস্তার করে। পরবর্তীকালে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশরাও একই পথ অনুসরণ করে নিজেদের প্রতিপত্তি কায়েম করে।১৯৭০ সালে ইউরোপে অস্ট্রিয়ান উত্তরাধিকার যুদ্ধ ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। সেই বিভেদের প্রভাব ভারতবর্ষেও এসে পৌঁছোয়। বাঙলায় এই বিভেদকে কড়া হাতে দমন করে আলিবর্দি খান। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে মরিশাস থেকে আগত নৌসেনা ফরাসিদের হাত শক্ত করে এবং ফরাসিরা মাদ্রাজে ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ চালায়। ব্রিটিশরা ফরাসিদের হাতে মাদ্রাজ সমর্পণ করে এবং কর্ণাটকের নবাবের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করে। নবাব ফরাসিদের আক্রমণের জন্য সৈন্য পাঠায় কিন্তু সেই সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। কিন্তু এই সময়ে ডুপ্লেইক্স এবং মরিশাস থেকে আগত অ্যাডমিরাল লা বোরদোনেয়ার্সের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ হয় এবং বোরদোনেয়র্স ব্রিটিশদের হাতে মাদ্রাজ সমর্পণ করে মরিশাস ফিরে যায়। ১৭৪৬ সালে ডুপ্লেইক্স আবার মাদ্রাজ আক্রমণ করে এবং দক্ষিণ পন্ডিচেরিতে ব্রিটিশ অধিকৃত সেন্ট ডেভিড ফোর্ট দখল করে নেয়। ইতিমধ্যে আইক্স লা চ্যাপেল চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ এবং ফরাসি বৈরিতার সমাপ্তি ঘটে। চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশরা ভারতে তাদের ফরাসিদের হাতে হারানো অধিকার ফিরে পায় এবং উত্তর আমেরিকায় ফরাসিরা তাদের ব্রিটিশদের হাতে হারানো অধিকার ফিরে পায়। যুদ্ধ আর আগে এগোতে পারেনা।

ভারতবর্ষে সিংহাসন দখলের জন্য পারিবারিক বিবাদ সর্বজনবিদিত। সেই বিবাদের কারণেই ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিবাদ বাড়তে থাকে দক্ষিণ ভারতে। কর্ণাটক এবং হায়দ্রাবাদে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিবাদের সুযোগ নিয়ে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করে নেয় ফরাসি গভর্নর জেনারেল ডুপ্লেইক্স। কর্ণাটকে চন্দা সাহিব এবং হায়দ্রাবাদে মুজফফর জংকে রাজা হবার লড়াইতে সমর্থন করে ফরাসিরা। ব্রিটিশরা সমর্থন করে এদের বিরোধি নাসির জং এবং মহম্মদ আলিকে। ফরাসি সমর্থিত দু’জনেই বিজয়ী হয় এবং নাসির জং-এর মৃত্যু হওয়ায় হায়দ্রাবাদের নতুন নিজাম হয় মুজফফর জং। মুজফফর ফরাসিদের মাসুলিপটম এবং আরও বেশ কয়েকটি গ্রামের জায়গির দান করে। এমনকি নিজের দরবারেও ফরাসি প্রতিনিধির জন্য একটি আসন নির্দিষ্ট করে দেয়। অবশ্য মুজফফর জংও বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেনি। ১৭৫১ সালের ফেব্রয়ারিতে মুজফফর মারা যায় এবং সালাবত জং নতুন নিজাম হয়। আতঙ্কিত ব্রিটিশদের সহায়তার জন্য কলকাতা থেকে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী কর্ণাটক এসে পৌঁছোয় এবং ১৭৫২ সালের শুরু হয় দ্বিতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধ। ব্রিটিশরা জয়ী হয় এবং মহম্মদ আলি কর্ণাটকের সিংহাসনে বসে। ডুপ্লেইক্স দক্ষিণ ভারত পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাতে চায় কিন্তু প্রচুর অর্থনৈতিক লোকসানের কারণে ফরাসি সরকার ডুপ্লেইক্সকে যুদ্ধ বন্ধ করে দেশে ফিরে যেতে বলে । ১৭৫৪ সালে ডুপ্লেইক্স দেশে ফিরে যায়। নতুন গভর্নর জেনারেল হয় চার্লস গডেহিউ। গডেহিউ ১৭৫৪ সালেই ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং মুজফফর প্রদত্ত জায়গির এবং রাজদরবারের আসন নিজেদের জন্য সংরক্ষণ করে।

১৭৫৬ সালে ইউরোপে সপ্তবর্ষীয় যুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতবর্ষে আবার ব্রিটিশ ফরাসি বিরোধ শুরু হয় এবং তৃতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। ফরাসিদের আর্থিক দুর্বলতার কারণে সৈন্যদের বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ফরাসি সরকার উপায়ান্তর না দেখে কাউন্ট ডি লালির নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী পাঠায় ভারতবর্ষে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফরাসিরা একের পর এক জায়গা হারাতে থাকে ব্রিটিশদের হাতে। প্রথমে হাতছাড়া হয় চন্দননগর। বাসিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় লালিকে সাহায্যের জন্য কিন্তু নর্দান সরকারের অন্তর্গত বিস্তীর্ণ অঞ্চল, মাসুলিপটম, ইয়ানাম এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা ফরাসিদের হাত থেকে দখল করে নেয় ব্রিটিশরা।১৭৬০ সালের জানুয়ারিতে তৃতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ওয়ান্ডুইশ যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজয়ের অব্যবহিত পরেই ব্রিটিশরা পন্ডিচেরি দখল করে। মালাবার উপত্যকার মাহে এবং কর্ণাটকের জিঞ্জি ও থিয়াগড়ের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই ফরাসিদের পায়ের তলার মাটি বরাবরের মত সরে যায়।

ফরাসিদের পরাজয়ের মূল কারণগুলি হল, প্রথমত কাউন্ট ডি লালির ঔদ্ধত্য এবং অসংযত আচরণ যে কারণে পন্ডিচেরির অন্যান্য ফরাসি আধিকারিকারেরা লালির থেকে দূরে সরে যায় এবং কার্যত নিষ্ক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। দ্বিতীয়ত প্রচন্ড অর্থাভাবের কারণে সামরিক ব্যবস্থার চূড়ান্ত বিপর্যয়। তৃতীয়ত বাসিকে দক্ষিণ ভারত থেকে সরিয়ে নেওয়ার ভুল সিদ্ধান্ত এবং সর্বোপরি সদ্য যুদ্ধজয়ী ব্রিটিশ নৌবাহিনীর দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। ১৭৬৩ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত হয় প্যারিস চুক্তি এবং সেই চুক্তি অনুসারে ফরাসিরা ১৭৪৯ সালের আগে নির্মিত সমস্ত কারখানা এবং অন্যান্য সম্পত্তি ফেরত পায়। শুধুমাত্র চন্দননগরের দূর্গনির্মাণ সংক্রান্ত কোনও রকম কাজের অধিকার ফরাসিদের দেওয়া হলোনা। ক্ষমতার এই নতুন বন্টনের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ ব্রিটিশ কোম্পানির অগ্রগতি ঘটতে থাকলো অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এবং ভারতবর্ষ থেকে ফরাসি কোম্পানি ১৭৬৯ সালে সম্পূর্ণভাবে অবলুপ্ত হয়ে গেল। ব্রিটিশরাই কার্যত কর্ণাটকের আধিপত্য লাভ করলো যদিও প্যারিস চুক্তির শর্তানুযায়ী নবাবকেই তার সমস্ত সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হল। নবাবের জীবদ্দশায় ব্রিটিশরা তাকে নবাবের স্বীকৃতি ও প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত না করলেও ১৮০১ সালে তার মৃত্যুর পরে তার সাম্রাজ্য ব্রিটিশরা দখল করে নিল এবং নবাবের উত্তরাধিকারীদের জন্য ভাতা ব্যবস্থা চালু হল। হায়দ্রাবাদের নিজাম শক্তিশালী প্রতিবেশীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে বাধ্য হল এবং তার পরিবর্তে নর্দার্ন সরকারের অধিকার ব্রিটিশদের দান করে দিল। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর শক্তি যেহেতু ভারতবর্ষের অন্য সমস্ত প্রদেশের মিলিত শক্তির চেয়ে অনেক বেশি ছিল সেইজন্য ভারতবর্ষে ক্ষমতার ভারসাম্য ব্রিটিশদের দিকেই ঝুঁকে রইলো।

অষ্টাদশ শতকে ভারতবর্ষের প্রদেশগুলি ছিল পারষ্পরিক দন্দ্বে বিদীর্ণ। প্রদেশগুলি রাজস্ব বৃদ্ধি করার জন্য একে অপরের অঞ্চল অধিকার করার জন্য সবসময়ে যুদ্ধে মেতে থাকতো। সমস্ত প্রদেশ একত্রিত হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একেবারেই সম্ভব ছিল না। বরঞ্চ পার্শ্ববর্তী প্রদেশকে দখল করার জন্য অনেকেই কোম্পানির দ্বারস্থ হত। ব্যবসায়িক স্বার্থ ছাড়াও প্রদেশগুলির মধ্যেকার এই পারষ্পরিক বৈরিতা ব্রিটিশদের সুযোগ করে দিল ভারতবর্ষের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার।
0

গল্প - অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Posted in






আজ পয়লা এপ্রিল। আজ থেকেই শুরু করব খেলাটা। আমার বেডসাইড টেবিলে একটা স্বচ্ছ কাঁচের শিশি। শিশির মধ্যে একই রকম দেখতে তিরিশটা ক্যাপসুল। রাত বারোটায় প্রতিদিন শুতে যাওয়ার আগে একটা করে ক্যাপসুল খাব। তারপর টেবিলেই রাখা ডেস্ক-ক্যালেন্ডারে সেই তারিখের পাশে একটা টিক দিয়ে শুয়ে পড়ব। খেলাটায় একটা সাসপেন্স আছে। কতগুলো তারিখে টিক পড়বে তা অনিশ্চিত। একটা মাত্র পড়তে পারে আবার তিরিশটাও পড়তে পারে। তবে ক্যালেন্ডারের এই পাতাটা ওলটাতে হবে না কোনোদিনই। পয়লা মে আমাকে দেখতে হবে না সেটা নিশ্চিত। এই তিরিশটার মধ্যে ঊনত্রিশটা ভিটামিন ক্যাপসুল হলেও একটার খোলে ভরা আছে পটাসিয়াম সায়ানাইড।

***

ইন্ডিয়ান সায়েন্স অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটে সিনিয়ার সায়েন্টিস্ট হিসাবে কাজ করছি আজ প্রায় পনের বছর হয়ে গেল। তার আগে এখানেই জুনিয়ার সায়েন্টিস্ট পদে ছিলাম পাঁচ বছর। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার বছরখানেক পর আমাকে সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মন্ত্রকের প্রধান সচিব পদে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আমি সেই পদ নিতে অস্বীকার করে আমার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সরকার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে বিশেষ বেতনক্রম দিয়ে আমাকে এই পদেই রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটা প্রায় তিন বছর আগের কথা। বিশেষ বেতনক্রম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার আমকে একটি বিশেষ প্রোজেক্টের দায়িত্বও অর্পণ করে। চূড়ান্ত গোপনীয় প্রোজেক্ট। তিন মাস অন্তর এই প্রোজেক্টের প্রোগ্রেস রিপোর্ট বিভাগীয় মন্ত্রীর হাতে আমাকে নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে হবে। কাজ শুরুর আগে এই গবেষণায় আমার সহকারী হিসাবে একজন জুনিয়ার বিজ্ঞানীকে নিযুক্ত করেছে সরকার। নিয়ম অনুসারে ইউপিএসসি একটি ইন্টারভিউ বোর্ড গঠন করেছিল ঠিকই। কিন্তু বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে সেই পদে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই করার সম্পূর্ণ অধিকার ও দায়িত্ব আমাকেই দেওয়া হয়েছিল। কোনো সন্দেহ নেই আমিই পছন্দ করেছিলাম মধুমিতাকে। সে অক্সফোর্ডের ডক্টরেট। অবশ্য সে ছাড়া আরও দুজন প্রার্থী বিষয়ের উপর যাবতীয় প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিয়েছিল। কিন্তু কোঁকড়ানো চুলের মেয়েটির হাই-পাওয়ার চশমার পিছনে বুদ্ধিদীপ্ত দুই চোখের আত্মবিশ্বাসী চাহনিই শেষ পর্যন্ত পার্থক্যটা গড়ে দিল। কাজ শুরু হওয়ার পর উপলব্ধি করেছিলাম আমার প্রার্থী-নির্বাচন নির্ভুল। মধুমিতা মেধাবী, পরিশ্রমী, দায়িত্ববান এবং বিষয়ের উপর যথেষ্ট দখল আছে তার। আমি ভাবতেই পারিনি সে আমার বিশ্বাসভঙ্গ করতে পারে।

***

আমি নিজেও বুঝি আর পাঁচজন মানুষের সঙ্গে আমার মিলের চাইতে অমিল অনেক বেশি। আমি অমিশুক, সামাজিকতায় স্বচ্ছন্দ নই, এবং কোনো ঘনিষ্ঠ বা আন্তরিক সম্পর্কে ঢুকে পড়ায় আমার স্বাভাবিক অনীহা আছে। আমার বাল্য ও কিশোরকাল অত্যন্ত অবহেলায় কেটেছে বলেই হয়তো আমার চরিত্রটা এমনই গড়ে উঠেছে। অত্যন্ত ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে অনাগ্রহী কাকার পরিবারে আশ্রয় জুটেছিল। সেখানে দুবেলা খাওয়ার বিনিময়ে সংসারের বহুরকম কাজ করতে হত। আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ রাখতে বাড়ির কাছে একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন কাকা। ভাগ্য ভালো, মেধা আর ইচ্ছের জোরে পড়াশুনাটা অব্যাহত ছিল। হায়ার সেকেন্ডারিতে অসাধারণ রেজাল্ট করার পর আমাকে আর ভাবতে হয়নি। কাকার বাড়ি ছেড়ে ছাত্রাবাসে উঠেছিলাম। সেখানে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একজন স্বাভাবিক তরুণের মতো হয়ে উঠতে পারলাম না। পড়াশোনার জগতে একা একা কাটানোই আমার নিয়তি হয়ে উঠল। একজন সাধারণ মানুষের মতো বিয়ে-থা, সংসার ইত্যাদির চিন্তা কোনোদিনই আমার মনে ঠাঁই পায়নি। এই করেই প্রৌঢ়ত্বে প্রায় পৌঁছে গেলাম। আগামী পয়লা মে পঁয়তাল্লিশে পা দেওয়ার কথা। সেদিন আমার এই প্রোজেক্টের কাজের সময়সীমাও অতিক্রান্ত হবে। আর ঠিক তিরিশ দিন বাকি আছে সেই দিনটি আসতে। সে-পর্যন্ত যেতে পারলে জন্মদিনই হতে পারে আমার মৃত্যুদিন। কিন্তু সেই সম্ভাবনা তিরিশের মধ্যে মাত্র এক।

***

এই ইন্সটিটিউটে মধুমিতার যোগদান করার দিন থেকেই আমি প্রোজেক্টের কাজ শুরু করেছিলাম। এর জন্যে বিশেষভাবে তৈরি ল্যাবরেটরিটি ইন্সটিটিউট-চত্বরের এক প্রান্তে অবস্থিত। এখানে আমরা দুজন ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের একজন সিনিয়ার ইনস্পেকটরকে এই পরীক্ষাগারের সুরক্ষা-ব্যবস্থা তদারকি করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। আমার থাকার জন্য পরীক্ষাগারের লাগোয়া দুই-ঘর বিশিষ্ট একটি আবাসও আছে। খাবারের ব্যবস্থা ইন্সটিটিউটের ক্যান্টিনে।

প্রথম বছরটা প্রায় শেষ হয়েছিল গবেষণার কাজে নিমগ্ন থেকে। আমার স্বভাব অনুযায়ী মধুমিতার সঙ্গে সম্পর্কটা কাজের স্তরেই আটকে ছিল। মধুমিতা চেষ্টা করেও আমার নিরাসক্তির বর্মে আঁচড় কাটতে পারেনি। আমি তার কাজে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলাম কিন্তু সে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তোলার উপক্রম করলেই আমার দীর্ঘকালীন অভ্যাসে রপ্ত করা উদাসীন চাহনিটি ঝুলিয়ে দিতাম চোখে।

আমার রক্ষণ আলগা হতে শুরু করল ঠিক দশ মাসের মাথায় যখন অপ্রত্যাশিত অল্প সময়ে প্রোজেক্টের প্রথম ধাপে সফলতা এসে গেল। এই ধাপে আমার লক্ষ্য ছিল মানুষের জেনোমে এমপ্যাথি বা সহমর্মিতার জিনগুলিকে শনাক্ত করা। পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষই ‘অপর’ একজনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, ব্যথাযন্ত্রণাইত্যাদি নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারে। তার জন্যে যে-জিনগুলি দায়ি সেগুলিই হল এমপ্যাথির জিন। এগুলো শনাক্ত করা খুব সহজ কাজ ছিল না। আমার অবশ্য একটা সুবিধে ছিল যে আমার পুরনো কাজের সূত্রেই আমি নিশ্চিত ছিলাম এই জিনগুলো কেবলমাত্র মস্তিস্কের নিওরন-কোষেই অবস্থান করে। ফলে আমার অনুসন্ধানের কাজটা একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও আমার ধারণা ছিল প্রোজেক্টের সিংহভাগ সময় নেবে এই শনাক্তকরণ। দ্বিতীয় ধাপের কাজটা তুলনায় সহজ। এই ধাপে এমপ্যাথির জিনে মিউটেশন ঘটিয়ে সেগুলোকে স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে হবে। এটা সহজ, কারণ মাইক্রোইভোলিউশন ন্যাচারাল সিলেকশনের একটা অঙ্গ, যার ফলে কোনো কোনো কার্যক্ষম জিন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, আবার উলটোটাও ঘটে থাকে। অর্থাৎ, যেটা স্বাভাবিকভাবে এবং দীর্ঘ সময়ান্তরে ঘটে সেটা আমাকে কৃত্রিমভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করতে হবে।

যেদিন এই শনাক্তকরণ নিঃসংশয়ে প্রতিষ্ঠিত হল, সেদিন আনন্দের আতিশয্যে আমি বোধহয় খানিকটা লঘুচিত্ত হয়ে পড়েছিলাম। সেই সুযোগে মধুমিতা আমার কাছে একটা প্রস্তাব রেখেছিল। বলেছিল, - এই সাফল্যটা আমাদের সেলিব্রেট করা উচিত স্যার।

সেদিনই সম্ভবত প্রথম আমি সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে মধুমিতাকে লক্ষ করলাম। তার দৃষ্টিতে একটা সহজ আন্তরিকতা ছিল, সে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। চশমা খোলার জন্যেই কি না জানি না, তার চোখের পাতা ভারী, দৃষ্টি গভীর। সহসা তার মুখটিকে আকর্ষণীয় মনে হল আমার। উদার হয়ে বললাম, - বেশ, কী করতে চাও বলো।

সে বলল, - কাল কোনো কাজ নয়, আমাদের অনেক ছুটি পাওনা হয়ে গেছে। ক্যান্টিনে খেতে খেতে আপনার জিভে নিশ্চয়ই কড়া পড়ে গেছে। কাল বাড়ি থেকে আমাদের দুজনের জন্য একটা স্পেশাল ডিশ বানিয়ে এনে একসঙ্গে বসে খাব। আর সারাদিন গল্প করব। কাজের কথা কিন্তু নয় স্যার। সেটা বাদ দিয়ে আমাদের দুজনের যা ইচ্ছে হবে সেসব নিয়েই কথা হবে।

আমার অস্বস্তি হলেও আপত্তি জানাতে পারলাম না।

***

সেই শুরু। আস্তে আস্তে দেখা গেল প্রতি সপ্তাহে একটা দিন তার বাড়ির রান্না-করা খাবার নিয়ে এসে একসঙ্গে খাওয়াটা রুটিন করে ফেলেছে মধুমিতা। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত কথাবার্তার আদানপ্রদান খুবই সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগল। একদিন সে দুম করে জিজ্ঞেস করে বসল, - আপনি বিয়ে করেননি কেন স্যার?

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা ছিল না। আমি চুপ করে বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলাম। সেই অবসরে আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টুকটাক প্রশ্ন করে যাচ্ছিল মধুমিতা। আমি আনমনা হয়ে উত্তর দিয়ে চলেছিলাম। পরে বুঝলাম আমার ছেলেবেলা থেকে শুরু করে এ-পর্যন্ত আমার জীবনকাহিনির পুরোটাই জেনে নিল সে। আমার বিয়ে না করা নিয়ে আর কোনোদিন কোনো প্রশ্ন সে করেনি। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে মধুমিতার ব্যক্তিজীবন নিয়ে আমারও একটা আগ্রহ জন্মাচ্ছিল। জানতে চাওয়ার ব্যাপারে আমি সংকোচহীন হতে পারিনি ঠিকই কিন্তু মধুমিতা যেন টের পেয়ে গিয়েছিল আমার আগ্রহটা। ফলে ধীরে ধীরে জেনে গেলাম তার মা-বাবা কর্মসূত্রে ইউ কে-তে আছেন দীর্ঘকাল। মধুমিতার স্কুলশিক্ষা কলকাতায় হস্টেলে থেকে সমাপ্ত হলেও গ্র্যাজুয়েসন, মাস্টার্স এবং ডক্টরেট ডিগ্রি সে অক্সফোর্ড থেকে করেছে। কিন্তু তারপরেই সে মা-বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এদেশে চলে এসে কর্মজীবন শুরু করে আজ থেকে বছর ছয়েক আগে। এখানে সে পৈতৃক ফ্ল্যাটে একাই থাকে। একদিন বলল, - আপনি তো বাইরে বেরনই না। চব্বিশ ঘণ্টা কাজ আর পড়াশোনা নিয়ে থাকতে একঘেয়ে লাগে না? একদিন চলুন না আমার ফ্ল্যাটে?

আমি বললাম, - তুমি একা থাকো – যাওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না।

মধুমিতা কৌতুকের সুরে বলল, - একা থাকি না স্যার। সঙ্গে থাকে একজন। তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। চলুন না –

একটি যুবতী মেয়ের প্রাইভেট লাইফ নিয়ে কৌতূহল হওয়া ঠিক নয় কিন্তু অন্যায্যভাবে সেটাই জেগে উঠল মনে।

একদিন সে নিয়ে গেল তার ফ্ল্যাটে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তার সেই ‘একজন’-কে। পাঁচ-ছ’ বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে। ঢলোঢলো মুখে মায়াভরা চোখ নিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সেই মেয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, - কে?

একচোখ হাসি নিয়ে মধুমিতা বলল, - আমার মেয়ে।

--তুমি বিবাহিতা – বলোনি তো –

--মা হতে গেলে বিবাহিত হতেই হবে স্যার?

--না – মানে – আমি কথা খুঁজে গেলাম না।

মাধুমিতার ফ্ল্যাটে একজন সাহায্যকারীও আছেন। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা। চব্বিশ ঘণ্টাই থাকেন। মধুমিতা জানাল তিনি প্রশিক্ষিত পালিকা। মেয়ের দেখাশোনা করাই তাঁর প্রধান কাজ। চুক্তির বাইরে গিয়ে গৃহকর্মের কাজেও সাহায্য করেন। মেয়ের সঙ্গে স্কুলে যাতায়াত তাঁকেই করতে হয় বেশির ভাগ সময়।

সেদিন তার বাড়িতে দুপুরের খাওয়া শেষে তার মা হওয়ার গল্প শোনাল মধুমিতা। অক্সফোর্ডের পড়াশুনা শেষ করে মা-বাবার সঙ্গে এক মাসের ছুটিতে দেশে এসেছিল মধুমিতা। ওখানে কয়েকটা কাজের অফার ছিল। ফিরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এমনটাই ঠিক ছিল। এখানে থাকতে একদিন পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সুন্দরবন ঘুরতে গিয়েছিল মধুমিতা। একটা লঞ্চ ভাড়া করে তিনদিনের ভ্রমণ। সেই লঞ্চে চালকের সহযোগীদের মধ্যে তার বউও ছিল। বউ-এর কোলে তিন-চার মাসের একটা বাচ্চা। মধুমিতা লক্ষ করল বয়স্ক চালকের যুবতী বউটি প্রায়ই বাচ্চাটাকে ইঞ্জিন ঘরের মেঝেতে শুইয়ে রেখে অন্য একজন তরুণ সহযোগীর সঙ্গে হাসিগল্পে মজে থাকছে। বাচ্চাটা তারস্বরে কেঁদেই চলেছে, কোনো হুঁশ নেই বউটার। বাচ্চাটার কান্না মধুমিতার বুকে এসে বিঁধতে লাগল। থাকতে না পেরে বউটাকে গিয়ে ধরল, - তোমার বাচ্চা কাঁদছে, শুনতে পাচ্ছো না?

বউটা বলল, - আমার বাচ্চা কেনে হবে, ননদটা বিয়োতে গিয়ে মরেচে, তার সোয়ামিটাও খ্যাপাপাগলা। কেউ দায়িত্ব নিলনিকো – আমার ইনি সাধু সেজে মেয়েটাকে আমার ঘাড়ে চাইপ্পে দিল। আমার নিজেরই তিনটা আছে। সেগুলাকে ঘরে থুয়ে এসচি, এই কচিটার ভার কে লেবে? খিদার জ্বালায় কেন্দে মচ্চে, কত আর দুধ গুলে খাওয়াই!আমার মাই তো শুককে গেছে।

বাচ্চাটার কান্না মধুমিতার বুকে স্থায়ী হয়ে গেল। ফেরার সময় চালকের সঙ্গে কথা বলে তার ফোন নম্বর নিয়ে এসেছিল। কলকাতায় ফিরেই একজন অ্যাডভোকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করল। দত্তক নেওয়ার আইনকানুন বুঝে নিয়ে চালককে সব জানাল। এদিকে লন্ডনে ফেরার সময় এসে গিয়েছিল। মধুমিতা গেল না। এই নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে তিন দিন ধরে বাদানুবাদ চলল। মধুমিতা সংকল্প থেকে নড়ল না। তাঁরা ফিরে যাওয়ার পর দত্তক দলিল তৈরি হল। নির্দিষ্ট দিনে চালক মেয়েটাকে নিয়ে একাই এসেছিল। রেজিস্ট্রি হওয়ার পর লোকটির চোখে জল। বলল, - আমার অভাগী বুনের আত্মাটা শান্তি পাইল মা। একটা সোন্দর জীবন অনাথ মেয়েটার কপালে লেখা হয়ে গেল।

একটা বিখ্যাত পালিকা কেন্দ্রের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করেছিল মধুমিতা। এই ভদ্রমহিলা সেদিন থেকেই বাচ্চাটির দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন।

***

প্রোজেক্টের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ বেশ উৎসাহের সঙ্গে শুরু করেছিলাম। একের পর এক উৎসেচকের ব্যবহার এবং ডিএনএ-এর বেস বদল করতে করতে এগিয়ে চলেছিলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম এই পদ্ধতিতেই জিন ফ্রিকোয়েন্সির এমন পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব যাতে উদ্দিষ্ট জিনগুলি স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় হবে। বছরখানেকের মধ্যেই আংশিক সফলতা এল। এমপ্যাথির জিন নিষ্ক্রিয় হল কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সেগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠল। আমি বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা চালিয়েও নিস্ক্রিয়তাকে স্থায়ী করতে পারছিলাম না। দিনের পর দিন একই ফল পেতে পেতে আমার মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধল। ভালো করে খতিয়ে দেখে মনে হল, নিষ্ক্রিয় জিনের সক্রিয় হয়ে ওঠা স্বাভাবিক নয়, কেউ যেন এদের উপর রিভার্স পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করছে। একটু ভাবতেই যেন ইলেকট্রিক শক লাগল মাথায়! মধুমিতা ছাড়া আর কারোর পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। তবে কি মধুমিতাই! কিন্তু কেন?

নিমেষেই মনে পড়ে গেল মধুমিতা একদিন কথাপ্রসঙ্গে বলেছিল, - এই প্রোজেক্টের পিছনে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে ভেবেছেন স্যার? সহমর্মিতাহীন মানুষ মানে তো ভয়ংকর এক জীব। তাদের বুদ্ধি থাকবে, দক্ষতা থাকবে অথচ মানবিক বোধ থাকবে না। যে কোনও ধরনের পৈশাচিক কাজে তাদের ব্যবহার করতে পারবে সরকার। ধরুন এদের নিয়ে কোনো গুপ্ত বাহিনী গঠন করল সরকার। তারপর সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের সব ধরনের প্রতিবাদ, বিক্ষোভে এদের ব্যবহার করতে লাগল।

আমি বলেছিলাম, - এসব তো রাজনীতির কথা। আমরা বিজ্ঞানী, প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করাই আমাদের একমাত্র কাজ।

তর্ক না বাড়িয়ে চুপ করে গিয়েছিল মধুমিতা। প্রসঙ্গ পালটে অন্য কথায় ঢুকে পড়েছিল। এই মুহূর্তে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। মধুমিতা আগেভাগেই আমাকে সন্দেহপরায়ণ করে তুলতে চায়নি। তাহলে তাকে গবেষণা থেকে ছেঁটে দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

প্রোজেক্টের সময়সীমা শেষ হতে দুটো মাসও বাকি নেই। মধুমিতাকে ছেঁটে দিয়ে নতুন করে আরম্ভ করার সুযোগ মিলছে না। আমার ক্যারিয়ারে এর আগে কোনোদিন ব্যর্থতার মুখ দেখতে হয়নি। সরকারের অগাধ আস্থা ছিল আমার উপর। সেটা তো গেলই, সেই সঙ্গে বিজ্ঞানী হিসাবে আমার বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে। এতখানি বিশ্বাসঘাতকতা করল মধুমিতা! নিমেষে সব রক্ত যেন মাথায় উঠে গেল আমার। রাগে উন্মত্ত হয়ে উঠলাম। দ্রুত পায়ে ল্যাব থেকে বেরিয়ে অফিস ঘরে ঢুকলাম। মধুমিতা তার চেয়ারে বসে কিছু একটা করছিল। আমি তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিলাম, তারপর ডান আর বাঁ হাত দিয়ে সপাটে চড় কষাতে লাগলাম তার দুই গালে।

কতক্ষণ পরে থেমেছিলাম জানি না। মধুমিতা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি, যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে এক চুলও সরেনি। আমি থামার পর ধীরে ধীরে বসল চেয়ারে। তার রক্তলাল দুই গাল বেয়ে ঝরে চলল অশ্রুধারা। তার ভেজা চোখ তখনও নিবদ্ধ আমারই দু-চোখে। জানি না সহসা কী দেখলাম সেই দৃষ্টিতে, তীক্ষ্ণ কিছু একটা এসে বিঁধে গেল আমার বুকে। আর আমার মন জুড়ে অনুভবের পরিব্যক্তি ঘটে চলল। আমি মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে মধুমিতার কোলে মুখ গুঁজে দিলাম।

***

সেদিনের পর মধুমিতা আর আসেনি। ক্যুরিয়ার মারফৎ তার পদত্যাগপত্র আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেটা আজ অব্দি আমার ড্রয়ারেই পড়ে আছে। ইতিমধ্যে ঠাণ্ডা মাথায় আমি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। ল্যাবে উপাদান ছিলই। পটাসিয়াম সায়ানাইড তৈরি করতে সময় লাগেনি। দোকান থেকে পঞ্চাশটা ক্যাপসুলের একটা শিশি কিনলাম। ল্যাবে গিয়ে কুড়িটা ক্যাপসুল বের করে বাস্কেটে ফেলে দিয়ে একটা ক্যাপসুলের খোল খুলে সেটা খালি করে তার মধ্যে পটাসিয়াম সায়ানাইড ভরে নিলাম। শিশির বাকি ঊনত্রিশটা ক্যাপসুলের সঙ্গে সেটা মিশিয়ে বিছানার পাশের টেবিলে রেখেছি। বিজ্ঞানী হিসেবে আমি অনির্দেশ্য তত্ত্বে বিশ্বাসী। মৃত্যু নিশ্চিত করেছি বলে তার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করার অধিকার আমার নেই।

আজ পয়লা এপ্রিল। বেশ কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা হয়েছে। ফাঁকা মগজ, শরীরময় আলস্য। মোবাইল বেজে উঠল। হাতে নিয়ে দেখি এখানের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা ইনস্পেকটর। বললেন, - মধুমিতা ম্যাডাম এসেছেন, কিন্তু সঙ্গে একটি ছোটো মেয়ে। কোনো অসুবিধে নেই তো স্যার?

অবাক হওয়ার উদ্যমও বুঝি অবশিষ্ট নেই আমার। একটি পরেই মধুমিতা তার মেয়েকে নিয়ে ঢুকল। আমি তাদের শোয়ার ঘরে নিয়ে এসেই বসালাম। নিচু হয়ে মেয়ের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। মধুমিতা বলল, - সরি স্যার।

কেন দুঃখপ্রকাশ জানতে চাইলাম না। মধুমিতা বলল, - সেকেন্ড ফেজের কাজ নতুন করে শুরু করেছেন তো স্যার। আমার মনে হয় বাকি এই এক মাসেই আপনি লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারবেন।

মধুমিতা সোফায়। মেয়েটি আমার গা ঘেঁষে বিছানায় বসেছে। আমি তার চুলে হাত ডুবিয়ে বললাম, - মন্ত্রকে আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নেওয়াও অসম্ভব হবে না, কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত বদল করেছি মধুমিতা। তোমার মতো আমিও পদত্যাগপত্র লিখে রেখেছি। দুটো চিঠি একসঙ্গেই অফিসের ড্রয়ারে রাখা আছে। দুটোর স্বাক্ষর একই তারিখের। আমি দৈবাৎ ভুলে গেলে তুমি মন্ত্রকের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিও।

মধুমিতার চোখে যেন একটা চমক দেখলাম। তারপরেই তার চঞ্চল দৃষ্টি সারা ঘরে ঘুরতে লাগল। এই প্রথম এই ঘরে ঢুকেছে সে। তাই কি খুঁটিয়ে দেখছে? একটু পরে সোফা আর বিছানার মাঝখানে রাখা টেবিলে তার দৃষ্টি স্থির হল। সামান্য অস্বস্তি বোধ করলাম আমি। সে একটু ঝুঁকে ক্যাপসুলের শিশিটা খুঁটিয়ে দেখল। বলল, - রোজ খান?

উত্তর দিতে গিয়ে একটু থমকালাম। সামলে নিয়ে বললাম, - মাঝে মাঝে।

কয়েক মিনিট নীরবতা। মধুমিতার মেয়ে একটা মোটা বই খুঁজে বের করেছে। রঙিন ছবিওলা অ্যানাটমির বই। একমনে পাতা উলটে উলটে ছবি দেখে চলেছে। খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে। হঠাৎ মধুমিতা উঠে দাঁড়াল। বলল, - একবার ল্যাবে যেতে পারি স্যার?

আমি হাসলাম, - যাও না – স্যাবোটেজ করার কোনো সুযোগ তো আর নেই।

কোনো কথা না বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল মধুমিতা। তখনই আমার মাথায় একটা দুশ্চিন্তা ঢুকল। ক্যাপসুলের কাজ করে আসার পর থেকে আর তো যাইনি ল্যাবে। সব এলোমেলো পড়ে আছে। বাস্কেটে অতগুলো ক্যাপসুল - কেসিএন তৈরির কোনো ক্লু ছেড়ে আসিনি তো?

বোধহয় মিনিট পনেরো পরে ফিরে এল মধুমিতা। সোফায় বসে খানিক আনমনা স্বরে বলল, - আপনার কোনোদিন কোনো মেজর অপারেশন হয়েছে স্যার?

--হঠাৎ এই প্রশ্ন?

--না, অচেতন থেকে চেতনায় ফেরার কথা ভাবছিলাম। একটা অপূর্ব অভিজ্ঞতা!

--তুমি কী অর্থে বলছো?

মধুমিতা কেমন যেন একটা হাসল। বলল, -- না না, অন্য কিছু নয়। মেজর অপারেশনের আগের অ্যানেস্থেসিয়ার কথাই বলছি। আমার হয়েছিল। লন্ডনে। তখন মাস্টার্স করছি। য়ুফেরেক্টমি, সিস্টের জন্য ওভারি বাদ দিতে হল। দুটোই।

আমি হতভম্ব। যতোটা না এই নিদারুণ সংবাদে, তার চেয়ে বেশি সেটা জানানোর সময় বাছার জন্য। কোনো একটা কার্যকারণ সম্পর্কের হদিশ হাতড়াচ্ছিলাম। তখনই সোফা থেকে উঠে এল মধুমিতা। যেন ছোঁ মেরে ক্যাপসুলের শিশিটা তুলে নিল হাতে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শিশি হাতে ঘরের লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে গেল। একটু পরেই ফ্লাশ টানার শব্দ পেলাম। চোখের সামনে দ্বিতীয় অন্তর্ঘাতটি ঘটাল মধুমিতা।

***

বারটা বাজল বোধহয়। ইংরাজি ‘বোকা দিবস’ অস্তে গেল। পয়লা মে যে আমার জন্মদিন সে-খবরটাও মধুমিতার জানা। এই মুহূর্তে সে সোফায় আধশোয়া। তার মেয়ে আমার কোলে মাথা রেখে বহুক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি মধুমিতা এবং আমার মাঝখানে থাকা টেবিলের শূন্যজায়গাটার দিকে তাকিয়ে মধুমিতার চূড়ান্ত অন্তর্ঘাতের প্রতীক্ষা করছি।


সৃষ্টির একুশ শতক, মার্চ ২০২১
0

গল্প - গান্ধর্বিকা ভট্টাচার্য

Posted in







কে? কে ওখানে?

হাল্কা সুতির পর্দার ওপারে কার যেন অবয়ব দেখা যাচ্ছে। রামেসিস একটু খাড়া হয়ে উঠে বসল।

কে?…তিয়ে! তিয়ে তুমি এসেছ? সত্যি? দূরে দাঁড়িয়ে কেন? আমার কাছে এস।

বয়সের সাথে বোধহয় মানুষের বুদ্ধিও ভোঁতা হয়ে যায়। নাহলে রামেসিস কখনও তিয়ের গায়ের সুগন্ধি চিনতে না পারে!

কি হল তিয়ে, কাছে আসবে না?

তিয়ে যেন একটু ইতস্তত করছে। তারপর ধীরে ধীরে পর্দা ঠেলে বেরিয়ে এল। যেন নববধূটি।

রামেসিস নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে। আজও তিয়ের রূপ তাকে পাগল করে দেয়। সেই কাজলটানা মদির চোখ, পাটে বসা সূর্যের চেয়েও লাল ঠোঁট, গোলকধাঁধার মতো রহস্যময় হাসি...

কি এক দুঃখ হঠাৎ তীর হয়ে তার বুকে বিঁধে যায়।

তুমি আর আমার কাছে আস না কেন, তিয়ে?

তিয়ে ধীরে ধীরে রামেসিসের কাছে এসে দাঁড়াল। আবার সেই রহস্যের চেয়েও গভীর হাসি – যা সহজ উত্তরকেও গোলমাল পাকিয়ে দেয়।

“তুমি জান না কেন আসি না?”

রামেসিস তিয়ের হাত দুটো টেনে একেবারে নিজের কোলের কাছে বসিয়ে নিল।

“জান তিয়ে, তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম পদ্মপুকুরের ধারে…পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছিল তোমার মুখের ওপর, সন্ধের হাওয়া তোমার চুলের সুগন্ধ সারা বাগানে ছড়িয়ে দিয়েছিল...আমার মনে হয়েছিল তোমার চেয়ে সুন্দর এই পৃথিবীতে কেউ নেই!”

তিয়ের চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল।

“সত্যি? আমি এত সুন্দর? কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তো আইসিস আর তিয়িতির নাম লেখা হবে বলে শুনছি।”

রামেসিস তিয়েকে নিজের হাতের মধ্যে জড়িয়ে নেয়। ইয়ামোসে যেমন করে হাতে সাপ জড়িয়ে খেলা দেখায়।

“তুমি সাধারণ গৃহবধূ নও তিয়ে। তুমি রাজার স্ত্রী। এইসব কথা কি তোমার মুখে মানায়? আইসিসকে আমার বিয়ে করতে হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। আর তিয়িতি আমার বোন, তাকে তো স্বীকৃতি দিতেই হবে। সেসব তো প্রেমের বিয়ে নয়, তুমি সেকথা ভালোভাবেই জান।”

“তোমার অন্তঃপুরে কি শুধু আমরা তিনজনেই আছি?”

রামেসিস হেসে ফেলে। আজও মেয়েটার ছেলেমানুষী গেল না।

“আরো অনেকে আছে। কিন্তু তুমি আমার নেফারতারি। নেফারতারি তার স্বামীর সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী ছিল, জান তো? আমিও তোমার চোখে চাঁদ সূর্য উঠতে দেখি!”

তিয়ে এদিক ওদিক চোখ ঘোরাল।

“কই, নেফারতারির মতো আমার কোন মন্দির তো এখানে দেখছি না। আমাকে দেবী হাথরের প্রতিমূর্তি বলে আঁকা কোন ছবিও দেখছি না।”

“যার নামে আমার নামকরণ হয়েছিল, সেই রামেসিসও কি নিজের রাজধানীতে নেফারতারিকে স্বীকৃতি দিতে পেরেছিলেন? তাই তো মরুভূমি পেরিয়ে অতদূর যেতে হয়েছিল মন্দির বানানোর জন্য।”

তিয়ির চোখে ছায়া নেমে আসে।

“আমাদের ছেলেও তো শুনলাম রাজা হবে না।”

রামেসিসের হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে আসে।

“নিয়ম অনুযায়ী আমার বড় ছেলেই রাজা হবে। এ নিয়ে তুমি আর জেদ ক'র না।”

“বড় ছেলে, তাই রাজা হবে, না তিয়িতির ছেলে তাই রাজা হবে?”

“এসব ঈর্ষা মনে পুষে রেখে তুমি কি পাচ্ছ, তিয়ে? দিন দিন তোমার আর আমার মধ্যের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। পেন্তাওয়ারেতকে আমিও ভালোবাসি। সে আমারও ছেলে। কিন্তু ঐতিহ্য আর যোগ্যতা, দু'দিক থেকেই এই রাজ্য রামেসিসকেই যুবরাজ বলে দাবি করছে।”

তিয়ে রামেসিসের হাতের ওপর আঙুল বোলায়।

“তোমার আর আমার মধ্যের সব সমস্যা ওই সিংহাসনকে ঘিরে। তুমি আমার ছেলেকে যুবরাজ ঘোষণা করে দাও, আমি আবার আগের মতো তোমার কাছে ফিরে আসব। তুমি চাও না, আমি আবার আসি?”

“চাই…খুব চাই…”

কিন্তু…

“তুমি জান না তুমি কি চাইছ, তিয়ে। সিংহাসন চেয়ে তুমি পেন্তাওয়ারেতের জন্যে সুখের চাবিকাঠি কিনছ না।”

আমি রাজ্য অধিকার করে নিয়েছি, কিন্তু তোমাকে সুখের চাবিকাঠি দিয়ে যেতে পারব না...

হঠাৎ করে তিয়ের মুখটা পালটে গিয়ে বাবার মুখ হয়ে যায়। কিভাবে তা সম্ভব হল তা নিয়ে রামেসিস প্রশ্ন করে না। বরং ভাবে, কতদিন বাবাকে দেখেনি! তিরিশ বছরের ওপর তো বটেই।

“চারিদিকে শত্রুরা থাবা মেরে বসে আছে। রাজ্যের মানুষ যুদ্ধে যুদ্ধে জর্জরিত। বাড়িঘর ছেড়ে সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে আছে। এই সময়টা সিংহাসন কেড়ে নেওয়ার পক্ষে প্রশস্ত, সিংহাসন ধরে রাখার পক্ষে নয়। পারবে তুমি, নিজের পুরুষকার দিয়ে পরিস্থিতির গতি বদলে দিতে?”

“পেরেছি।”

নিজের গলা শুনে রামেসিসের কেমন অসঙ্গতি বোধ হয়। তারপর বুঝতে পারে। বাবা যখন মৃত্যুশয্যায় এই কথাগুলো বলেছিল তখন তা শুনেছিল তরুণ রামেসিস। আজ বর্ষিয়ান রামেসিস তার জবাব দিচ্ছে – যার যুদ্ধ জেতা বলিষ্ঠ হাত এখন কুঁচকে গেছে, দাড়িতে পাক ধরেছে, পেটের ডানদিকে চিনচিনে ব্যথা। রাজবৈদ্য গোপনে জানিয়েছে, রাজার দিন এখন হাতে গোনা মাত্র।

সেতনাখতে সামনে রাখা মদের পাত্র তুলে নিলেন। ঈষৎ ভুরু নাচিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,

“বটে? পেরেছ? তা কিভাবে পারলে?”

রামেসিস সামান্য ঝুঁকে বসল। এটা বাবার মৃত্যুশয্যা নয়। বরং দু'জন রাজা মুখোমুখি দুটো আরামকেদারায় বসে আছে, শুধুই খোশগল্প হচ্ছে।

“তুমি মারা যাওয়ার পরে রাজ্য জুড়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ছিল।”

সেতনাখতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

“রাজ্য দখল করেছিলাম শুধু। শাসন করার সময় পাইনি।”

“সেই জন্যই তো প্রথম কিছু বছর যুদ্ধ, বাণিজ্য, সবকিছু মুলতবি রেখে রাজ্যে ঐক্য আনার আর সেনাকে মজবুত করার কাজে লেগে পড়ি। পাঁচ বছর বাদে যখন লিবিয়ার শত্রুরা আক্রমণ করে, আমাদের সেনা তখন প্রস্তুত। সহজেই তাদের হারিয়ে দেয়। সেখান থেকে শুরু।”

সেতনাখতের মুখে কৌতুক ঝিলিক দিল।

“ওহো! লিবিয়ার ওরা আবার হেরে বাড়ি গেল বুঝি? জান নিশ্চয়ই, রাজা মারনেপ্টাহের সময়েও একই ব্যাপার হয়েছিল।”

রামেসিসের সামনেও ভেল্কির মতো মদের পাত্র এসে গেছে। সে চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিল।

“সে তো কিছুই না। আসল বিপদ ঘটল যখন সমুদ্র মানবরা আক্রমণ করল।”

“সমুদ্র মানব? কারা তারা?”

“পেলেসেত, দেনিয়েন, শারদানা, মেশোয়েশ – অসভ্য বর্বর জাতি সব। শুনেছি অনেক বড় বড় সভ্যতাকে নষ্ট করতে করতেই আসছিল। রাজ্যে এসে প্রথমে তারা স্থলপথে আক্রমণ করেছিল। জাহির যুদ্ধে তাদের হারিয়ে দিই। তখন তারা জলপথে আক্রমণ করে।”

“সেকি! আমাদের নৌবাহিনী তো খুবই দুর্বল! তুমি কি তাদেরও মজবুত করেছ?”

রামেসিস মাথা নেড়ে 'না' বলল।

“সেই সুযোগ পাই নি। আক্রমণের কথা জানতে পেরেই রাজ্যের সব জাহাজকে হুকুম দিলাম নীলনদের মোহনার মুখে চলে যেতে। সেনা না পৌঁছনো অবধি কেউ যেন জায়গা থেকে না নড়ে। জাহাজের পেছনে তীরন্দাজদের দাঁড় করিয়ে দিলাম। শত্রুর জাহাজ আসামাত্র তীরন্দাজরা নির্মম আক্রমণ শুরু করল। শত্রুপক্ষ তীরের জবাব দিতে ব্যস্ত এমন সময়ে আমাদের নৌসেনা ওদের জাহাজে উঠে পড়ে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু করে দিল। ওরা পালানোর পথ পেল না।”

“সাবাশ! এতো ঐতিহাসিক বিজয়!”

রামেসিস মনে মনে সম্মতি জানায়। আবার মদে চুমুক দেয়।

“লিবিয়ার নির্লজ্জগুলো আরেকবার আক্রমণ করেছিল, আবার গোহারান হেরে ফেরত গেছে। তারপর থেকে সীমান্ত সুরক্ষিতই রয়েছে।”

সেতনাখতে নাকের ডগাটা চুলকে নিলেন। রামেসিসের মনে পড়ল, কোন অপ্রিয় প্রসঙ্গ তোলার আগে এটা করা বাবার অভ্যেস ছিল।

“তা, রাজ্যের লোকজন এসব ঘটনার ব্যাপারে কি মনে করে?”

“যুদ্ধ হলে স্বাভাবিকভাবেই ভাণ্ডারে টান পড়ে। সবাই তাই নিয়ে খুশী হয় না। বিশেষ করে যুদ্ধ যখন নিজের সীমান্তে হয় তখন ক্ষয়ক্ষতির আকড় লুকিয়ে রাখা একটু মুশকিল হয়ে যায়। তার ওপর ভালো শস্য না হওয়ার দরুন সেত মা'আত হের ইমেনতি ওয়াসেতের কবর খননকারী আর চিত্রশিল্পীদের মাইনে আর খাবার পৌঁছাতে কিছু দেরি হয়েছিল।”

“তাই নিয়ে তারা বিদ্রোহ শুরু করে?”

“বিদ্রোহ ঠিক নয়, কর্মবিরতি বলতে পার। মন্দিরের সামনে ধর্না দিয়েছিল বলে শুনেছি।”

“কর্মবিরতি? ধর্না? এমন অদ্ভুত কথা জীবনে শুনিনি!”

“সব খবর আমার কানেও আসেনি। আমার মন্ত্রীরাই সামলে নিয়েছে।”

“এখন পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হয়েছে?”

রামেসিস আরামকেদারায় হেলে বসল।

“সমস্যা এখনো চলছে। কিন্তু পুন্তের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রেখেছি। তিমনার খনি থেকে প্রচুর পরিমাণ তামা আনিয়েছি। সাইনাই থেকে দামী পাথর এসেছে।”

“আর মন্দির? নতুন স্থাপত্য কিছু বানিয়েছ?”

“আমার জন্য 'তৃতীয় রামেসিসের কোটি বছরের আবাসন, চিরকালের জন্য আমুন ভগবানের রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত' বানিয়েছি। তাছাড়া রাজ্যের অনেক মন্দিরে জমি দান করেছি, সোনার মূর্তি বসিয়েছি।”

“তার মানে আমি রাজ্যকে যে অবস্থায় রেখে গেছিলাম তুমি তার আমূল পরিবর্তন করে ফেলেছ। তোমার ছেলের জন্য সুরক্ষিত, শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি রেখে যাচ্ছ, যা আমি তোমার জন্য করে যেতে পারিনি।”

রামেসিস গালের ওপর হাত বুলিয়ে নিল।

“জানিনা, বাবা। রামেসিস বার বছর বয়স থেকেই যুবরাজ হয়েছে। অনেক কাজ শিখেও উঠেছে। কিন্তু রাজা হওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। মোটে একুশ বছর বয়স ছেলেটার। ও কি পারবে সামলাতে?”

“আলবাত পারবে!” সেতনাখতে হাঁটুতে চাপড় মেরে বলেন। “একুশ বছর বয়সে জানার আগ্রহ থাকে, শেখার আগ্রহ থাকে। রাজার ভূমিকা পালন করতে করতে অভিজ্ঞতা আপনেই এসে যাবে। কিন্তু তুমি…”

দেখতে দেখতে সেতনাখতের মুখ এক দিব্য আভায় ভরে উঠল।

“তুমি যেভাবে আমার বংশে গরিমা এনেছ, যেভাবে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছ, তার জন্য ইতিহাস তোমাকে চিরকাল মনে রাখবে। আমার আশির্বাদ আর মা'আতের কৃপায় তুমি অনন্তকাল আমুনের রাজ্যে বাস কর।”

“সত্যি? সত্যি বলছ?”

কিন্তু সেতনাখতে ততক্ষণে মিলিয়ে গেছেন। তাঁর জায়গায় রাখা আছে তুলাদণ্ড। তার একদিকে মা'আতের পালক। অন্যদিক ফাঁকা। রামেসিসের হৃৎপিণ্ড সেখানে রেখে যাচাই করা হবে। সামনে আনুবিস দাঁড়িয়ে৷ আর কিছু দূরে হোরাস।

এ তো শেষের বিচার…

“রামেসিস,” আনুবিস গম্ভীর গলায় ডাক দেন, “তুমি কি পেরেছ রাজা হিসেবে সফল হতে? মা'আতকে ধরে রাখতে পেরেছ? তুমি দেশের রাজা – অন্য সব পরিচয়ের থেকে এটাই কি তোমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হয়েছে?”

রামেসিস ভুরু কুঁচকে চিন্তা করে। চোখের সামনে এক এক করে ছবি ভাসতে থাকে – সমুদ্র মানবদের বিরুদ্ধে লড়াই, লিবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই, রামেসিসকে যুবরাজ ঘোষণা করা, দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের বরখাস্ত করা, মন্দির বানানো…

তারপর হঠাৎ করে সব মুছে গিয়ে তিয়ের মুখটা ভেসে ওঠে।

“তোমার বাবার প্রশংসার এখানে কোন জায়গা নেই,” আনুবিস কঠোর স্বরে বলে চলেন, “তোমার নিজের হৃদয়কে যাচাই করে দেখ, তুলাদণ্ডে ফেললে তার কি পরিণতি হবে।”

রামেসিস তিয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিষ্পলক।

প্রিয়তমা স্ত্রী তিয়ে…আমার নেফারতারি…

কিন্তু…

রামেসিস আর তিয়ের মধ্যে যোজনব্যাপী দূরত্ব তৈরী করা সেই 'কিন্তু'…

আমাকে ক্ষমা কর তিয়ে, শুধু তোমার স্বামী হয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমাকে যতই ভালোবাসি না কেন, রাজার কর্তব্যকে অবহেলা করে তোমার অন্যায় আবদার মানতে পারব না।

“এটাই কি তোমার সিদ্ধান্ত?” আনুবিস প্রশ্ন করেন।

“…হ্যাঁ…”

পর্দার আড়ালে টুংটাং আওয়াজ ওঠে। ঘরের মধ্যে পদ্মের সুগন্ধ ফেলে রেখে তিয়ের অবয়ব মিলিয়ে যায়। শুধু তেরচা করে আসা চাঁদের আলো রামেসিসের বন্ধ চোখের ওপর আলতো করে আঙুল বোলায়।

রাত আরো গভীর হলে ধারাল অস্ত্র হাতে আততায়ীর দল রাজার ঘরে ঢুকে আসে। রাজা তখন আরামের বিছানায় অঘোরে ঘুমিয়ে। মুখে প্রশান্তির হাসি।

****

সেদিন সন্ধেবেলায় গুপ্তচর এসেছিল। রামেসিস তখন রাজ্যের করব্যবস্থা দেখতে মগ্ন। গুপ্তচরকে দেখে ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কি সংবাদ?

গুপ্তচর কয়েক পা এগিয়ে এল। গলা নীচু করে বলল,

“সংবাদ ভালো নয়, মহারাজ। রানী তিয়ে তাঁর ছেলে রাজপুত্র পেন্তাওয়ারেতকে রাজা করার জন্য চক্রান্ত করছেন। রাজপ্রাসাদেরই কয়েকজন সদস্য চক্রান্তের মধ্যে আছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।”

“কেমন চক্রান্ত?”

গুপ্তচর গলা আরো নামিয়ে আনল।

“মহারাজের প্রাণ সংশয় হতে পারে।”

“কবে?”

“সে খবর এখনো পাইনি। সম্ভবত কিছু ঠিক হয়নি এখনো।”

“বুঝলাম।”

রামেসিস চোখ বন্ধ করে বসে রইল।

তিয়ে? শেষটায় তিয়ে আমাকে মারতে চায়?

সেটা অবশ্য বিষ্ময়কর নয়। খুব ঈর্ষা, খুব অভিমান তার। আর উচ্চাকাঙ্ক্ষাও খুব। নিজেই কতবার বলেছে পেন্তাওয়ারেতকে রাজা করার কথা। রামেসিস প্রত্যেকবার হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু… এবার তো মহা ফ্যাসাদ হল।

“ইহজগতের দুঃখ আর আপনাকে বেশীদিন ভোগ করতে হবে না।”

রাজবৈদ্যের বলা কথাগুলো রামেসিসের কানে বাজতে থাকে।

কারা চায় না আমার পরে রামেসিস রাজা হয়? যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে রাজভাণ্ডার খালি হয়ে যাচ্ছে বলে যারা অনুযোগ করছে তারা? নাকি তাদের অন্য কোন দাবি আছে? তাদের বিরুদ্ধে, বিশেষতঃ তিয়ে আর পেন্তাওয়ারেতের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় হওয়ার আগেই যদি আমার দিন ফুরিয়ে যায়?

তাহলে আমার মৃত্যুর পরে গৃহবিবাদ লেগে যাবে। রামেসিসের বিরুদ্ধে পেন্তাওয়ারেতকে সদস্য খাড়া করে চক্রান্ত চলতে থাকবে। আমার অন্য ছেলেরাও সুযোগ বুঝে দাঁও মারার চেষ্টা করবে। রামেসিসের মাত্র একুশ বছর বয়স। এই বয়সে রাজার দায়িত্ব বুঝে নিতেই ওর সময় চলে যাবে। তার ওপর গৃহবিবাদ সামলানো ওর দ্বারা সম্ভব হবে না। আর এসব খবর বাইরে গেলে শেয়াল কুকুরের দলের থাবা মারতে ছুটে আসতে সময় লাগবে না। আমার সারা জীবনের চেষ্টায় রাজ্যে যে শান্তি, যে সুরক্ষা এনেছি, এক মূহুর্তে তা নষ্ট হয়ে যাবে।

টুকরো টুকরো ছবি পরপর বসে গালিচা বনে যায়। রামেসিসের মাথায় সমাধানটা স্পষ্ট হয়।

নাঃ, আমাকে তিয়ের চক্রান্তেই মরতে হবে। আর তিয়ে আর পেন্তাওয়ারেতকে আমার সঙ্গে মরতে হবে। রাজদ্রোহের দায়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড পেতে হবে। গুপ্তচরের খবর এতক্ষণে রামেসিসের কাছেও পৌঁছে গেছে। কাল আমার মৃতদেহ পাওয়া গেলে রামেসিস অনুসন্ধান শুরু করতে পারবে। উত্তরাধিকারের লড়াই তখন খুনের মামলায় রূপান্তরিত হবে। চক্রান্তকারীরা হয়ে যাবে রাজদ্রোহী। তবেই রামেসিসের হাতে সুরক্ষিত রাজ্য তুলে দিতে পারব। আমার পূর্বপুরুষদের কাছে মুখ দেখাতে পারব। বলতে পারব, নিজের পুরুষকার দিয়ে ভাগ্যের প্রতিকুলতাকে জয় করতে পেরেছি।

রামেসিস যখন চোখ খুলল ঘর তখন খালি। গুপ্তচর রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে প্রধান পরিচারক পেবেক্কামেনকে ডেকে পাঠাল।

তিয়ে যদি সত্যিই আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে থাকে, তাহলে আমার প্রধান পরিচারককে দলে না নিয়ে তার উপায় নেই। একটা হিসেবের খেলা খেলে দেখি, কি হয়।

“মহারাজ ডেকেছেন?” মার্জিত দূরত্বে দাঁড়িয়ে পেবেক্কামেন মাথা নোয়াল।

“হ্যাঁ। আজ আমার রাতের খাবারের পরে তুমি মদের ব্যবস্থা করবে।”

“যথা আজ্ঞা।”

“সে মদ যেন এমন হয় যে হাজার ডাকাডাকিতেও আমার সারারাত ঘুম না ভাঙে।”

মূহুর্তের জন্যে পরিচারকের মুখের অভিব্যক্তি কি পালটে গেল, না তা শুধুই রাজার কল্পনা?

“অবশ্যই, মহারাজ।”

“যাও, প্রস্তুতি শুরু কর।”

পেবেক্কামেন চলে গেলে রাজা মিটিমিটি হাসে। সুখের চাবিকাঠি পরপারের সম্পত্তি। এই পৃথিবী শুধুই দুঃখ ভোগ করার জন্য। একদিন চলে যেতে হবে সবাইকেই।

কিন্তু রাজার চাল চেলে যাওয়ার মতো সৌভাগ্য হয় ক'জনের?



· হারেম চক্রান্ত : প্রাচীন মিশরের রাজা তৃতীয় রামেসিসের স্ত্রী তিয়ে এবং রাজার হারেম এবং প্রাসাদের কিছু সদস্য মিলে রাজাকে হত্যা করেন, তিয়ের ছেলে পেন্তাওয়ারেতকে রাজা করার জন্য। কিন্তু চক্রান্তকারীরা ধরা পড়ে যান, এবং অধিকাংশই মৃত্যুদণ্ড পান। তৃতীয় রামেসিসের হত্যার পর তাঁর ছেলে চতুর্থ রামেসিসই রাজা হন।
0

গল্প - বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়

Posted in






সে বালিকা না কিশোরী সে নিজেই জানে না। অট্টালিকার প্রাচুর্য তাকে টানে না। কিন্তু এই হর্ম্যের রহস্য তাকে আকর্ষণ করে।কেন করে সে বোঝেনা।
এই যে পাখিটি বারান্দায় উড়ে এসে জুড়ে বসল তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয়... তার গায়ে এত রঙের বাহার।সে এগিয়ে যায়।তার কৌতুহল আন্তরিক। পাখি তাকে বিশ্বাস করেনা।সে একটা বিচিত্র শব্দ করে উড়ে যায়। সকালের অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। উদ্যান পরিপাটি। তার চোখে মুখে মৃদু আনন্দ ও বিস্ময়।সে এখন কী করে? প্রত্যেক নারী কি এই সংশয়ে ভোগে? সদ্য বালিকার সব প্রশ্নের উত্তর হয়না।
সে নিজের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়। তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে নিজের কক্ষে দর্পণে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।তার চোখ এতো গভীর আর টানা টানা? ভুরু আর চোখের পাতা এতো সুন্দর?এতো দীর্ঘ আর কালো তার চুলের ঐশ্বর্য?সে এখনই ৫ ফুট ৫, আরও লম্বা হবে?,,,তার আঙুল, তার নখ,তার কটিদেশ, তার পায়ের গড়ন এ সব কবে হল? কীভাবে হল?সে রঙ লাগায় না। তবু তার ওষ্ঠ, তার হাত ও পায়ের নখগুলো এতো উজ্জ্বল।সদ্য অঙ্কুরোদগম হয়েছে তার। ব্যথা লাগে কোথাও তবু সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই সামান্য উদ্ভাসিত মুকুলের দিকে।যেন এক মহা সমারোহে প্রকৃতির মতো সেও বেড়ে উঠছে। শুধু সেই অদৃশ্য জায়ফলটিকে সে চেনেনা।
তার একটাই অভাব যে তার কোনো অভাব নেই।
স্নানের ঘর থেকে পরিচ্ছন্ন হয়ে আসার পর সে‌ কিছুক্ষণের জন্য একাকীত্ব হারিয়ে ফেলবে। এটাই এ বাড়ির নিয়ম। প্রাতরাশ টেবিলে সাজিয়ে রাখা টাটকা ফল,ফলের রস,দুধ, ডিমের পোচ, ওটস ইত্যাদির মধ্যে সে পছন্দ মতো খাবার বেছে নিতে পারে। সেই স্বাধীনতা সে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে দুবছর আগে।
তার মা একজন গরিষ্ঠ সমাজ কর্মী.. ব্যস্ত মানুষ।
তার বাবা এই উপনগরীর সম্মানীয় আইনজীবী।সে একমাত্র সন্তান। পৈতৃক সূত্রে অর্জিত এই সুরম্য অট্টালিকা রক্ষা করতে লোকবল ও অর্থ লাগে।যা তাদের আছে।
সে এখানকার সবচেয়ে অভিজাত বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে।
গাড়িতে করে ইস্কুলে যাওয়া আসার ফাঁকে সে দেখতে পায় পায়ে হেঁটে, সাইকেল রিক্সায় , ভ্যানে চেপে মেয়েরা ইস্কুলে যায়। তাদের বিনুনির মধ্যে খেলা করে হালকা রোদ্দুর,পাশ থেকে উড়ে আসে পতঙ্গের মৃদু গুঞ্জন।দূর থেকে এসব দেখতে ভালোই লাগে।
এই বালিকার কোনো নাম নেই? অবশ্যই আছে। নামে কি আসে যায়?

তার ক্লাসে মহিমা নামে একটি বালিকা আছে। তথাকথিত সুন্দরী নয়। কিন্তু পড়াশোনায় তুখোড়।সে অবলীলায় প্রথম হয় পরীক্ষায়.. অবহেলায় সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।
মহিমার সঙ্গে তার সহজ সম্পর্ক। অথচ কোথায় একটা দূরত্ব আছে।
0

কবিতা - অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়

Posted in






হায়েনার দল হরিণীটিকে পেছন থেকে খাচ্ছিল।
তখনও বেঁচে ছিল সে—
জানান দিচ্ছিল তার অসহায় পা ছোঁড়া।

দূর থেকে চিতাকে আসতে দেখে
অনাগত ভ্রূণ চিরে বার করে নিয়ে পালাল হায়েনা।

তারপর চিতা
লাল লাল নরম মাংস দ্রুততার সঙ্গে ছিঁড়ে খেতে লাগল।

আমি পৃথিবীর কাছে এর চেয়ে বেশী কিছু আশা করেছিলাম।

যে গর্ভ থেকে জন্ম,
যে গর্ভ থেকে সৃষ্টি,
যে গর্ভকে ঈশ্বর বলি—
সে‌ই হিরণ্যগর্ভের শিরায় শিরায় শুধু আদিমতা!

আমি কার কাছে ন্যায় ভিক্ষা করব?
0

কবিতা - কুমকুম বৈদ্য

Posted in






ভলিউম যত বাড়ছে মাথার শব্দকোষে
হারিয়ে যাচ্ছে কথার মানে মুদ্রাদোষে
কথা যে সব দেওয়াই ছিল অনুচ্চারে
ভুলিয়ে দিচ্ছে ঝুলিয়ে রাখা অনুস্বারে
হারিয়ে গেলেও কথার মালা খুঁজতে নেই
ফুরিয়ে গেলে কথার কবর খুঁড়তে নেই
0

কবিতা - সুস্মিতা মজুমদার

Posted in






ক্রমশ জটিল হচ্ছে দিন
আবার ইতিহাস ফুঁড়ে যেন জেগে উঠেছে গুহামানবের দল ।
দুচোখ জুড়ে রয়েছে তাদের কাঁচা মাংসের উল্লাস,
মানুষ যখন সভ্যতার চাপে
এগিয়ে চলেছে দিন প্রতিদিন
কিছু মানুষের জিহ্বায় লেগে আছে
এখনো রক্তের স্বাদ ।
সময় যেন কিছু মানুষকে পৌছেঁ দিয়েছে সেই অন্ধকার পাথুরে সভ্যতায়
যেখানে মানুষ ক্ষুধার্ত, নেশাগ্রস্ত, হতাশাগ্রস্ত ।
ক্রমশ আবছা হতে হতে ঘণ কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে
কথোপকথনের অসমাণ সিঁড়িপথ।
সামনে এসে দাঁড়ায় কিছু উন্মাদ মানুষ
তীক্ষ্ম দহনে তাঁরা চেঁচাচ্ছে
সবকিছু থাক তাদের ইচ্ছেমতো ।
অস্থির মাতাল হাওয়ায় করে চলেছে
জাতের নামে বজ্জাতি
সমস্ত হাড়ের ভিতর আধশোয়া ঘৃণার দল !
আর্তনাদ শুনবে না কেউ
অগোচরে রক্তপাত শুধু
হৃৎপিন্ড জুড়ে নিঃশর্ত সমপর্ণে।
0

কবিতা - আশীষ কুমার বিশ্বাস

Posted in







একটা কবিতা
তাঁর ভালো লাগা , মন্দ লাগা ।

তারপর প্রিন্টিং প্রেস
অচেনা প্রচ্ছদ
তাঁর জন্ম , লিটিল ম্যাগজিন ।

একটা যুদ্ধ জয়
প্রকাশিত কবিতা
বার বার তাঁর ওপর চোখ বোলানো ।

মনে কবি হওয়ার শখ জাগে
রবীন্দ্রনাথ , জীবনানন্দ , নজরুল , সুকান্ত
মনের গভীরে সুপ্ত বাসনা ।

আবার কলম-কাগজ , নির্জনে চিন্তা
ভাবনার গোড়ায় শিকড় গজানো ।

অক্ষরে অক্ষরে , শব্দে শব্দে
নতুন লাইন ।
আরো একটা কবিতার জন্ম ।

ঠিক এই ভাবেই - আরো একটা
কিম্বা অন্য ভাবে
আরো একটা ।



0

ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

Posted in







এগ পরিজ

উপকরণ ::

রোলড ওটস ১/২ কাপ
ডিম ৪টি
পেঁয়াজ কুচি ১ টেবিল চামচ
কড়াইশুঁটি ১/২ টেবিল চামচ
গাজরের টুকরো ১ টেবিল চামচ
কাঁচালঙ্কা ২টি
অলিভ অয়েল ১ টেবিল চামচ
নুন স্বাদ মতো
একচিমটি দারচিনি গুঁড়ো



পদ্ধতি::

প্রথমে রোলড ওটস বেশ কয়েকবার ঠান্ডা জলে ধুয়ে, শাদা জল ফেলে নিতে হবে। এক চিমটি গুঁড়ো দারচিনি দিয়ে সেদ্ধ বসাতে হবে। ফুটে উঠলে তাতে একে একে গাজর ও কড়াইশুঁটি দিয়ে একটু ফুটিয়ে ঢাকা দিয়ে আঁচ বন্ধ করে চুলার ওপর বসিয়ে রাখতে হবে।

ফ্রাইং প‍্যানে অলিভঅয়েল দিয়ে একটু গরম হতে হতে ডিমের গোলা ঢেলে দিতে হবে। নিয়মিত খাওয়া হলে, ডিম কিন্তু দুটি গোটা এবং দুটির শাদা অংশ নিয়ে বানাতে হবে। যদি হঠাৎ কখনও বানানো হয় তখন চারটি ডিম গোটাই ব‍্যবহার করা যেতে পারে। ডিমের গোলায় নুন দিতে হবে। ডিমের গোলাটি নাড়িয়ে স্ক্রাম্বলড্ এগ বানাতে হবে। একটু টেনে এলে পেঁয়াজ ও কাঁচালঙ্কা কুচি দিয়ে রান্না করতে হবে। এরপর ওই সেদ্ধ করা ওটস ডিমের প‍্যানে ঢেলে হাল্কা হাতে মিশিয়ে নিলেই তৈরী হয়ে যাবে এগ পরিজ।

অলিভ অয়েল কিন্তু পুরো গরম হওয়া অবধি অপেক্ষা করার দরকার পড়ে না। যদি ওটস সেদ্ধতে জল থাকে সেটা সহ দিয়ে জল টানিয়ে নেওয়া যেতে পারে বা মাঢ় ঝরানোর মতো ঝরিয়ে নিয়েও ডিমের সাথে মেশানো যেতে পারে। গোলমরিচ গুঁড়ো ছড়িয়ে পরিবেশন করা যেতে পারে। নুন কিন্তু একটু কমের দিকে রাখাই ভালো, তাই শুধু ডিমের গোলায় ডিম দিলেই যথেষ্ট। ঝাল বেশী পছন্দ হলে কাঁচালঙ্কার পরিমান বাড়িয়ে নিতে হবে। পরিবেশনের সময়ে এক টুকরো মাখন দেওয়া যেতে পারে। তবে নিয়মিত এগ পরিজ খেলে মাখন না দেওয়াই শ্রেয়।
0

সম্পাদকীয়

Posted in



































'বহির্বিমুখিতা' বা 'আত্মমগ্নতা' কি অসুখ? নাকি ব্যক্তিত্বের একটা ধরন? অজ্ঞতাবশে যে ধরনটি বুঝতে ভুল হয়ে যেতে পারে আমাদের। এমন ভ্রান্তি শিক্ষাক্ষেত্রে ঘটলে তাকে কোনওভাবে ছাড় দেওয়া যায় কি? অমার্জনীয় কাজ তাহলে আর কাকে বলা হবে? 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্ম শুধু তো কতিপয় খাঁচার তোতাপাখি তৈরি করা নয়! চারপাশকে চিনতে এবং আতশকাচের তলায় জরিপ করতে শেখানোই তো ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষিত করে তোলা। তাদের মূল্যবোধের বুনিয়াদি গঠন তো নির্মিত হয় শিক্ষাক্ষেত্রের আবহেই। যে মূল্যবোধ সহজেই চিহ্নিত করতে পারে একটি ব্যাধি আর স্বতন্ত্র এক ব্যক্তিত্বের মাঝবরাবর অবস্থান করা সূক্ষ, প্রায় অদৃশ্য একটি রেখাকে। তা যদি না হত, গরিষ্ঠের স্থুল বিচারে অনেক কালজয়ী প্রতিভাই হয়ে যেতেন ব্রাত্য। কারণ তাঁরা আর পাঁচজনের মত ছিলেন না। 

তবুও তাঁদের সৃষ্টির সামনে নতমস্তকে দাঁড়াতে হয় আমাদের। এটাই স্বাভাবিক। তাই অটিজম-এর দোহাই দিয়ে যখন একটি বিদ্যালয় একটি ছাত্রকে দলবদ্ধ ভ্রমণ থেকে বাদ দিতে চায়, শরীরে রক্তস্রোত দ্বিগুণ বেগে বইতে শুরু করে।

সুস্থ থাকুন। দায়বদ্ধ থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর!