Next
Previous
0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(১৮)

লন্ডনে বসে একদা সি.জে গ্রান্ট নামের এক মাঝবয়সী সাহেব নানা ধরণের পলিটিক্যাল স্যাটায়র লিখে দলবল নিয়ে অভিনয় করতেন বেশ সুনামের সাথেই।

অবশ্য দেনার দায়ে সেই থিয়েটারের ব্যবসা উঠে যাওয়ার পরে এখন অবশ্য কিছু বছর হল তিনি হিন্দুস্তান মুলুকে এসে সরকারী পর্যবেক্ষকের পদে বহাল হয়েছেন।

আজ তিনি লাটভবনে এসে বেশ অনেকটা সময় কাটিয়ে গেলেন। আসলে উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আমন্ত্রণে প্রাতরাশ শেষ হওয়ার পরেও এখানে বসে একটা গুরুতর বিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা চলল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী লাটসাহেবের কাছে সত্বর এখানে একটি ভাল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করলে কেমন হয় সে বিষয় নিয়ে একটা বিশেষ পর্যবেক্ষণ সহ রিপোর্ট চেয়েছে। নেটিভ জমিদারদের অনেকেই এ বিষয়ে ইংরেজ কোম্পানির হস্তক্ষেপ চেয়ে তাঁদের চিঠিপত্র দিয়েছে বলে এই উদ্যোগের আকস্মিক প্রণয়ন নিয়ে কথা চলছে।

ইদানীং যদিও মাদ্রাজে এরকমের একটি চিকিৎসালয় ইঙ্গ - ফরাসী উদ্যোগে চলছে বটে, তবুও খোদ রাজধানীর বুকে একটি আধুনিক চিকিৎসালয়ের আশু প্রয়োজন।

গ্রান্ট এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেয়ে খুব উদ্বিগ্ন গলায় লর্ড বেন্টিঙ্ককে উদ্দেশ্য করে বললেন,

" ইওর হাইনেস! আপনিও এ বিষয়টি জানেন যে শহরের আদিগঙ্গার চারপাশের জনপদ বড় দুর্গম ও অস্বাস্থ্যকর। আমাশয়, কলেরা আর অজানা জ্বরের প্রকোপ তো এখানকার নিত্যদিনের সঙ্গী। "

বেন্টিঙ্ক হাসিমুখে ধূমায়িত চায়ের পেয়ালায় একটি তৃপ্তিকর চুমুক দিতে দিতে গ্রান্ট সাহেবকে বললেন যে তিনি এবিষয়ে সম্পূর্ণ অবহিত।

এমনকি তিনি সুপারিশ করলে এবিষয়ে রামকমল সেন সহ কিছু ধনী বাবু এখনি হাসপাতালের জন্য জমি দিয়ে ব্রিটিশ শাসকের সুনজরে আসতে প্রস্তুত।

তাছাড়া ডেভিড হেয়ার সাহেবেরও আজকাল নেটিভ মহলে সুসম্পর্ক থাকার জন্যে এধরণের একটি হাসপাতাল তৈরীর কাজে অন্য অনেক সুবিধারও বন্দোবস্ত হওয়াটা এখন অসম্ভব নয়।

এমনকি খোদ লন্ডনের রয়্যাল স্কুল অব মেডিসিনও এ এইকাজের বিষয়ে সবরকম সাহায্য করতেও রাজী। এখন খালি সরকারী অনুমোদনের জন্য কিছু সময় অপচয় হবে। যদিও সতীদাহ বিরোধী বিল্ এনে সরকার এখন জনরোষের চাপে পড়ে কিছুটা বিপাকে পড়ে গেছে। নেটিভরা বোধহয় এতটা উপকারী রূপে ইংরেজদের দেখতে বোধহয় এক্ষণি খুব একটা রাজি হবে কি?

.......

রামানন্দ কায়েতের দুটি বৌ বেশ কর্মপটু বলে তার একচিলতে খোড়ো ঘরেই গোলকপতিদের চারদিনের জন্য আপাতত থাকা ঠিক হল। রামানন্দ কিছুদিন হল চাষবাসের জাত ব্যবসা তাঁতের ব্যবসা ধরেছে। মহাজনের কাছ থেকে সে মোটা টাকা দাদন নিয়ে সে চারখানি তাঁতের যন্ত্র কিনে সুতি বস্ত্রের একটি মনোগ্রাহী বিপণন কেন্দ্র খুলে বসেছে। গলসী, ঝাঁপানডাঙা, মামুদপুর এমনকি খোদ বর্ধমানের হাটেও তার হাতে বোনা তসরের শাড়ি ভালো দামে বিকোচ্ছে বলে তার দু'জন বউএর কোমরে একইরকম ঝকঝকে পৈঁছা দুটি দোলে। রামানন্দের সন্তানভাগ্য মন্দ। দু'বার বিবাহ সত্ত্বেও সে এখনও নিঃসন্তান। গোলকপতির কাছে খোদ রাজবাড়ির সীলমোহর আছে দেখে তাদের ঘরে আশ্রয় দিতে রামানন্দ রায় রাজি হল। এই সুযোগে মহারাজ তেজচন্দ্রের দরবারে তার বারোমাসের কাপড় চালানের একটা সুরাহা হলে সেটা অদূর ভবিষ্যতে নেহাত মন্দ হবেনা।

রাজবাড়ির ভিতরমহলে থাকা অজস্র উমেদার ও কৃপাপ্রার্থীদের সিংহভাগও যদি তার থেকে নিয়মিত কাপড় কেনে তাও সেটা বছরে দু -চারশ সিক্কার কম হবেনা।

তাই রামানন্দের খুব ইচ্ছা যে সেহারাবাজারে তাঁতের আড়তে একখানি চালা ভাড়া করে বসার। তবে সেটা নগদ পঞ্চাশ সিক্কার বদলে হওয়া কঠিন।

আড়তদারদের বেশ অনেকেই মোটা অর্থের বিনিময় ছাড়া তাকে ভিন্ মুলুকে চট করে আর একটা নতুন মুখ হিসেবে কারবার ফেঁদে বসতে দেবেনা।

রামার বউদের মধ্যে বড় বৌ ভবানী একটু মাতৃময়ী স্বভাবের। দুই সতীনের মধ্যে একমাত্র সেই দুবার গর্ভবতী হওয়া সত্ত্বেও শেষমেশ গর্ভপাত হওয়ায় সে মরমে মরে থাকে। আর ছোটবৌটি প্রায় আড়াই বছর স্বামীসঙ্গ করেও একটিবারের জন্যেও গর্ভবতী হয়নি।

সে একটু কঠিন মনের ও কলহপ্রিয়া নারী। ভবানী তাকে বোনের মত স্নেহ করলেও সে কিছুতেই যেন খুশী হতে পারেনা।

হঠাৎ করে গোলকপতিদের এইভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসাটার বিষয়ে সে সরাসরি আপত্তি না জানালেও এঈজন অপরিচিত ঢলঢলে মুখশ্রীর শৈলবালা নামের মেয়েটিকে তার মোটেও পছন্দ হয়নি। ওর ধারণা যে গোলকপতিরা রামানন্দকে ভাল মানুষ পেয়ে কিছু একটা গোপন ও অন্যায্য কাজে কেবল ব্যবহার করতে চাইছে।

.......

দিল্লীর মুঘল সাম্রাজ্যে আকাশে ক্রমশ ঘনিয়ে এসেছে দিনবদলের পদপাত। ইংরেজ কোম্পানি আসতে আসতে তামাম হিন্দুস্তানকে দখল করে নিতে চাইছে বলে আগ্রাসন ও বিশেষ বিশেষ আইন প্রণয়নের তারা-মুদারায় এদেশে তানকর্তবের রকমারি আলাপ চালাচ্ছে।

এমনকি দিল্লির প্রবীণ মুঘল বাদশাহ দ্বিতীয় আকবরের প্রতি ইংরেজরা হঠাৎ করে বৈমাত্রেয় ভ্রাতার মত আচরণ করে সেই বৃদ্ধের জীবন প্রায় অতিষ্ঠ করে তুলেছে।

এমনকি হঠাৎ করে তারা তাঁর প্রাপ্য ভাতাটির পরিমাণ ওরা কম করে দিয়েছে বলে তিনি ইংরেজদের উপর হাড়েহাড়ে চটেছেন।

নিজামতের সুপারিশে তাই তিনি ফারসী ভাষায় লেখা সব আইনী দস্তাবেজের সহজ অনুবাদক ও ফার্সী ভাষায় সুপন্ডিত রামমোহনকে 'রাজা' উপাধি দিয়ে বিলেতে গিয়ে মহারানির রাজদরবারে বাদশাহের ভাতা বৃদ্ধির সুপারিশ করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে একটা বিরাট চিঠি পাঠিয়েছেন। আজ সকালে উঠে ব্রহ্মোপসনার ঠিক পরেই সেই এত্তালা সাথে নিয়ে শাহী দরবারের খাস্ নবিশ পেয়ারেলাল খান রামমোহনে মির্জাপুর স্ট্রীটের বাড়িতে এসে হাজির।

.....

যদিও দেওয়ানী আইনের মারপ্যাঁচে রামমোহন নিজেও পিতৃপদাঙ্ক অনুসারী ও বেশ জ্ঞানী বলে এই চিঠির অভিঘাতে তিনি আদৌ বিচলিত হননি।

তিনিও সম্মতি জানিয়ে বাদশাহের ফরমানটিকে স্বীকার করে মুচলেকা পাঠিয়ে দিয়েছেন।

এখন তাঁর ইচ্ছা যে আগামী নভেম্বরে বিলেতের পথে যাত্রা করলে শীতকালের গোড়াতেই সেখানে পৌঁছে যেতে পারবেন। তাহলে হাউসের শীতকালীন অধিবেশনে তাঁর দুটি প্রধান কাজ হবে! একটি হবে মুঘল সম্রাটের হয়ে ভাতা বৃদ্ধির ওকালতনামা জমা দেওয়া, আর অন্যটি হবে প্রিভি কাউন্সেলে সতীদাহ প্রথা রোধ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের পরেও কিছু দেশীয় শক্তির বিরোধাভাসের নথির বিপরীতে একটি প্রশ্নোত্তরের আসর সহ স্ত্রীশিক্ষার সূচনার প্রদীপটি জ্বালানো।

তবে একজন উপযুক্ত নবীন সহকারী বিনা স্ত্রীশিক্ষার বিষয়টি হঠাৎ করে এ দেশে চালু করা কঠিন। দ্বারকনাথ নীলের ব্যবসায় জর্জরিত বলে এযাত্রায় তাঁর সফরসঙ্গী হতে পারেননি। সব ব্যবস্থা ঠিক থাকলে নভেম্বরের মাঝামাঝি তিনি লিভারপুল পৌঁছবেন। তবে এখন এসবের সবটাই বড় অনিশ্চিত।
0

ধারাবাহিক- সুদীপ ঘোষাল

Posted in





পনেরো

তারপর বিজয় বলে,এরপরের দৃশ্য প্রতিমা বিসর্জন । কাছেই একটা পুকুর । রাত হলে সিদ্ধিলাভে(দামীটা না) আনন্দিত হয়ে নাচ তে নাচতে অবশেষে শেষের বাজনা বেজে উঠতো । মা তুই থাকবি কতক্ষণ, তুই যাবি বিসর্জন ।তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের বাজনা শুনতো পড়ার ঘরে বেশ কিছুদিন ধরে...কথা শুনতে শুনতে জ্যোৎস্না আমাকে জড়িয়ে ধরেছে । আমার প্রবল কামনাকে কামড়ে ধরে নীলকন্ঠ হয়ে আছি । জ্যোৎস্না বললো, জানো বিদেশে এটা কোনো ব্যাপার নয় । এসো আমরা এক হই পরম সুখে । আমি হাত ছাড়িয়ে বাইরে এলাম ।জ্যোৎস্না কি ভুলে গেছে মনে ভাসা সবুজ সর নিয়ে ,দুঃখ কে জয় করার মানসিকতায় এক ভারতবর্ষীয় যাপনে আমি ডুব দিয়েছি জীবন সমুদ্রে....। তারপর কেটে গেছে অনেকটা সময়। আমি একা থাকতেই ভালোবাসি। মাছ ছিপ দিয়ে ধরতে ভালোবাসি।

বিজয় বলে,এবার শোন ভূতের গল্প।

রমেন বলে,ছেলেমানুষী শুধু তোর। আবার ভূত দেখার বাল্যসখও আছে। অনেকে হয়তো আড়ালে হাসবেন।


(রবিবাবুর শহরে আগমন ও তার বাকি জীবনের কথা )।

রবিবাবু গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে চলে এলেন সাংসারিক বিভিন্ন চাপে।তখন তার বড় ছেলে সেভেনে পড়ে আর ছোটছেলে পড়ে ক্লাস ফোরে।শহরে এসে বাসাবাড়ি ভাড়া করলেন।স্ত্রী আলো খুব খুশি।আলাদা সংসার তিনি মন দিয়ে সাজালেন দশবছর পরে রবিবাবু শহরে জায়গা কিনে বাড়ি করলেন।ছেলেরা তখন লাভপুর কলেজে বড়ছেলে হোষ্টেলে থাকে আর ছোটছেলে কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে।

তারপর ছেলেরা দুজনেই চাকরি পেল। রবিবাবু রিটায়ার্ড করলেন স্কুল থেকে।আলো দেবি ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। রবিবাবু আলোকে দেখেন আর চুপ করে থাকেন।রবিবাবু চুপ মেরে গেলেন।ডাক্তার বলছে, মনরোগ। বাড়ির বড় ছেলে বাবাকে গল্পের বই কিনে দেন নিয়মিত।ছোটোছেলে গানের ক্যাসেট এনে দিলো। কিন্তু রবিবাবুর কোনো পরিবর্তন নেই। গল্পের বই পড়েন না। গান শোনেন না। অথচ এই রবিবাবু চিত্তরঞ্জনে একটা উচ্চ বিদ্যালয়ে অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন। পঁয়ত্রিশ বছর চাকরি জীবন তার। এই সময়ে তিনি স্কুলে যেতেন সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে। নিজের হাতে রান্না করে খেতে ভালোবাসতেন। ভোটের কাজে তিনি ছিলেন বিজ্ঞ। সকলে তার কাছেই পরামর্শ নিতে আসতেন। মহুকুমার মধ্যে তার মত গণিতজ্ঞ ছিলো না বললেই চলে। লোকে তাকে শ্রদ্ধা করতো। আর বিস্মিত হতো তার কর্মজীবনের সাফল্য দেখে।

একদিন বাড়িতে তার বড় ছেলে বললো, বাবা আজ আমরা বিরিয়ানী খাবো। তুমি রান্না করো। রবিবাবু বাজার থেকে সমস্ত কিছু জোগাড় করে এনে রান্না করে পরিবারের সকলকে বিরিয়ানী খাওয়ালেন।তিনি ছেলেদেরকে বলতেন, রান্না করা শিখে রাখবি। আগামী দিনে রান্নার লোক পাবি না। এখন হোম ডেলিভারির যুগ। ফলে পেটের সমস্যা বাড়বে। রান্না করা শিখতে পারলে খেতে পাবি নিজের মত। তা না হলে যা জুটবে তাই খেতে হবে। ছেলেরা বাবার কথামত রান্না করা শিখেছে।রবিবাবু সফলভাবে চাকরি জীবন সমাপ্ত করে যেদিন বাড়িতে এলেন বিরাট টাটা সুমো গাড়িতে চেপে,সেদিন তার উপহার রাখার জায়গা ছিলো না। বেছে বেছে তিনি একটা বিভূতিভূষণের বই রেখে দিয়েছিলেন যত্ন করে।

তার কিছুদিনের মধ্যে একটা স্কুলের পার্ট টাইম টিচারের পদে যোগদানের জন্য অনুরোধ এলো। তারা বললেন,আপনি এই এলাকার অঙ্কের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। আপনি আসুন। অনেকে উপকৃত হবে। সাম্মানিক বেশ ভালো।

রবিবাবু বললেন, এত দিন তো এইসব করেই কাটালাম। এখন বড়ছেলে শিক্ষক হয়েছে। আর আমি শিক্ষকতা করবো না। ছেলেদের বারণ আছে।

এখন রবিবাবুর বড় ছেলে রতন ভাবেন , বাবা চাকরিটা করলে বোধহয় ভালো থাকতেন। চলাফেরা হতো। শরীর ভালো থাকতো।

কিন্তু তা তো হোলো না। বাবা এখন চুপচাপ থাকেন। কারও সঙ্গে কথাও বলেন না। মন গুমরে আজ তার শরীরটা পাটকাঠির মত হয়েছে।

তারপর বিপদ তো একা আসে না। সুখের সংসারে অভিশাপ হয়ে প্রবেশ করলো কর্কট রোগ। রতনের মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়লো। রবিবাবু সেদিন স্ত্রীকে বলে ফেললে, আর নয়। বাঁচতে ইচ্ছে করছে না।

স্ত্রী আলো সব জেনে শুনেও রবিবাবুকে ধমক দিলেন, ছেলেরা থাকলো। তোমাকে দেখতে হবে। আমি তো এখন দুদিনের অতিথি।

রবিবাবু ভাবলেন, একটু কাঁদতে পারলে ভালো হতো। কিন্ত ছেলে বৌমা, নাতি নাতনিরা আছে। তারা দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই কান্নাকে ব্যাথার বিপুল পাথরে চাপা দিয়ে রাখলেন।
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৪

প্রতি বছর কার্তিক পূর্ণিমার সময় শিবপালগঞ্জের পাঁচ মাইল দূরে একটি মেলা শুরু
হয়। ওখানে একটু জঙ্গল, একটা টিলা মতন, আর তার উপরে একটি দেবী মন্দির।
আর তার চারপাশে কোন পুরনো ভাঙা বাড়ির কিছু ইঁট ছড়িয়ে আছে। জঙ্গলে করমচা,
মক্কা আর কুলের ঝোপঝাড়। চারপাশের জমি এবড়োখেবড়ো।—খরগোশ থেকে নেকড়ে
বাঘ, ভুট্টাচোর থেকে ডাকাত-- সবাই ওই জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে পারে।
আশপাশের গাঁয়ে যে মহান প্রেমের মানে দুই আত্মার মিলন, এই জঙ্গলের মধ্যে তার
রূপ দুই দেহের মিলনে সার্থক হয়। শহর থেকে কখনও কোন জোড়া ওখানে পিকনিক
করতে যায় এবং পরস্পর শারীরিক ক্রিয়া সম্পর্কিত জ্ঞানের পরিচয় দেবার পর
কখনও কখনও মন্দিরে দেবী দর্শন করে সংকুচিত দেহ এবং প্রফুল্ল মন নিয়ে
শহরে ফিরে আসে।

এ’অঞ্চলের লোকজনের ওই টিলা নিয়ে বড় গর্ব, বড় অহংকার। কেননা, ওই হল
এদের অজন্তা, ইলোরা, মহাবলীপুরম। ওদের বিশ্বাস মন্দিরটি দেবাসুর সংগ্রামের
পর দেবীর নিবাসের জন্য দেবতারা আপন হাতে বানিয়েছেন। আর টিলার নীচে
কুবেরের কোষাগার লুকোনো আছে। এইভাবে ধর্ম, অর্থ এবং ইতিহাসের দিক থেকে
দেখলে টিলার মহত্ব কম নয়।
রঙ্গনাথের প্রিয় বিষয় ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব। ভাবছিল, একবার ওই টিলার সার্ভে
করলে কেমন হয়! ওকে বলা হয়েছে যে ওই মন্দিরের মূর্তিগুলি গুপ্তযুগের এবং
মাটির ঢেলাগুলো হল মৌর্যযুগের টেরাকোটা।

এক অবধী লোককবি স্বর্গীয় পড়ীস লিখে গেছেনঃ

মেলে-ঠেলে মেঁ তো মুঁহ খোল কে সিন্নী বাঁটী,
সসুর কো দেখ কে ঘুঁঘট খীঁচা মীটর-ভর।

মেলায় হেলায় সিন্নি খাওয়ালে স্মিত মুখে,
শ্বশুরকে দেখে ঘোমটা দিয়েছ তিন গজী।

ওরা সব মেলা দেখতে যাচ্ছে। এই সময় ভারতীয় নারীত্ব তার ঢাকাঢুকির খোল থেকে
ফনফনিয়ে বেরিয়ে এসেছে। ওরা চলেছে চপল চরণে, না মাথায় ঘোমটা, না মুখে কোন
লাগাম। ওরা চেঁচাচ্ছে ফুসফুস, গলা এবং জিভ চিরে বের করছে এমন এক তীক্ষ্ণ
আওয়াজ যেটাকে শহুরে পণ্ডিত এবং আকাশবাণীর চাকুরের দল পল্লীগীতি বলে
থাকেন।
এইভাবেই ঘর থেকে বেরিয়ে মেলার পথে চলছে দলের পর দল। রূপ্পনবাবু, রঙ্গনাথ,
শনিচর ও যোগনাথ মেলা যাবার সিধে রাস্তা ছেড়ে এক সরু পাকদণ্ডী বেয়ে চলতে
লাগল।মেয়েদের বেশ ক’টি দল দেখতে দেখতে এগিয়ে গেল। তখন ছোটে পালোয়ান
বলল—“ সবাই এমন চেঁচাচ্ছে যেন ওদের বল্লম ফুঁড়ে দেওয়া হয়েছে”।

শনীচরের বক্তব্য—মেলায় যাচ্ছে তো।
মেয়ের দলের সামনে পেছনে বাচ্চা এবং মরদের দল। সবাই ধুলোর ঝড় উড়িয়ে
হড়বড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে যেন নিজেদের মধ্যে কোন প্রতিযোগিতায় মেতেছে। বলদের
গাড়িগুলোও নিজেদের মধ্যে এগিয়ে যাওয়ার যুদ্ধে মত্ত। আর এরই মধ্যে পথচারীর
দল ওদের সঙ্গে ধাক্কা না লাগিয়ে নিজেদের বাঁচিয়ে চলেছে। এর থেকে প্রমাণ হয় যে
শহরের চৌরাস্তার মোড়ে মোটরকারগুলো মুখোমুখি সংঘর্ষে টুকরো টুকরো না
হওয়ার কৃতিত্ব ট্রাফিক পুলিশের নয়, বরং মানুষের আত্মরক্ষার সহজাত
প্রবৃত্তি।

অর্থাৎ, যে প্রকৃতি পুলিশের সাহায্য ছাড়াই জঙ্গলে হিংস্র জানোয়ারের হামলা
থেকে খরগোসকে রক্ষা করে, বা শহরের রাস্তায় পথচারীদের ট্রাক-ড্রাইভারের
থেকে বাঁচিয়ে রাখে –সেই এখন মেলার যাত্রীদের বলদের গাড়ি চাপা পড়ার থেকে
রক্ষা করছে।

মেলার উত্তেজনা এখন চরমে। যদি অল ইণ্ডিয়া রেডিও এখান থেকে রানিং কমেন্ট্রি
করতো তাহলে নিশ্চয় প্রমাণ করে ছাড়ত যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সাফল্যে
লোকজন ভাল আছে, আর নেচে গেয়ে একে অন্যের সঙ্গে আনন্দ এবং ভালবাসা
ভাগাভাগি করতে করতে মেলার পথে চলেছে।

কিন্তু রঙ্গনাথ গ্রামে থাকছে প্রায় দেড় মাস ধরে। ও বুঝতে পেরেছে যে গেঞ্জি
আন্ডারওয়ার পরা শনিচর ওর হাসিমুখের জন্য বিড়লা বা ডালমিয়ার চেয়ে বড় হতে
পারে না। হাসতে পারা এমন কোন বিরল গুণ নয়। যার খাবার হজম হচ্ছে সেই হাসতে
পারে। এই তর্ক গান গাওয়ার ব্যাপারেও প্রযোজ্য।

রঙ্গনাথ মন দিয়ে মেলা এবং তার লোকজনকে দেখছিল। ওর চোখের সামনে এত
আনন্দ উত্তেজনার ভেতরের চেহারাটা বেরিয়ে এল। শীতকাল এসে গেছে, কিন্তু
কারও পরনে উলের গরম কাপড় নেই। কোন কোন বাচ্চার গায়ে দু’একটা ফাটা
সোয়েটার রয়েছে বটে, কিন্তু মহিলাদের রঙিন শস্তা সিল্কের শাড়ি আর বেশিরভাগের
খালি পা। পুরুষদের অবস্থা কী আর বলব? কথায় আছে—হিন্দুস্থানী ছেয়লা, আধা
উজলা আধা ময়লা।
হিন্দুস্থানী ফোতোবাবু যেন এক সঙ,
আধা পোশাক চকচকে, আধা ময়লা রঙ।

রঙ্গনাথ নিজেকে ভেঙচি কাটল—এসব দেখা আর এর মর্ম বোঝার চেয়ে পুরাতত্ত্ব
অধ্যয়ন অনেক সোজা। তারপর রূপ্পনবাবুর দিকে নজর ঘোরালো। রুপ্পন তো হৈচৈ
করে তিনজন সাইকেল আরোহীকে নীচে নামতে বাধ্য করলেন। ওরা ভীড় বাঁচিয়ে
গলিপথের এক কিনারে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ওদের মধ্যে যাকে দলের সর্দার মনে হচ্ছে সে মাথার ময়লা হ্যাট নামিয়ে সেটা নেড়ে
নেড়ে হাওয়া খেতে লাগল। শীত রয়েছে, কিন্তু লোকটির মাথায় ঘামের ফোঁটা। ওর
পরনে হাফপ্যান্ট, জামা আর বুকখোলা কোট। হাফপ্যান্টটা ভুঁড়ির নীচে নেমে না যায়
তার জন্য বেল্ট কষে বাঁধা হয়েছে। ফলে পেটের ক্ষেত্রফল সমান দু’ভাগে বিভক্ত
হয়ে গেছে। সর্দারের দুই সাথী ধুতি-কুর্তা-টুপিওলা অভদ্র চেহারার লোক, কিন্তু
সর্দারের সঙ্গে খুব সৌজন্য দেখিয়ে কেতাদুরস্ত ব্যবহার করছে।
“আজকে তো মেলায় চারদিকে খুব টাকা উড়ছে সাহেব”! –রূপ্পন সর্দারের সঙ্গে হেসে
হেসে আলাপ জমাতে চাইলেন। লোকটি চোখ বুঁজে মাথা নেড়ে বেশ বিজ্ঞের মত
বলল—“ বোধহয়, কিন্তু রূপ্পনবাবু, আজকাল টাকার কি কোন ভ্যালু আছে”?
রূপ্পনবাবু ওর সঙ্গে আরও কিছু কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন যার মূল বিষয় মেলার
মিষ্টি, বিশেষ করে ক্ষীরের মিঠাই। হঠাৎ লোকটি বাধা দিয়ে বলে উঠল—দাঁড়ান
রূপ্পনবাবু!

তারপর সে একজন সাথীকে তার হ্যাট, অন্যজনকে সাইকেল ধরতে বলে মোটা মোটা
ঠ্যাঙে এলোমেলো পায়ে দ্রুত পাশের অড়হরের ক্ষেতে নেমে গেল। ও খেয়াল করেনি
যে অড়হরের চারাগুলো তেমন ঘন নয় এবং কয়েকজন অড়হরের ওই ক্ষেতের মধ্য
দিয়ে পাগদণ্ডী পথে মেলায় যাচ্ছে। ও এসব পাত্তা না দিয়ে দৌড়ুতে গিয়ে আটকে
পড়ল এবং অতি কষ্টে কোট আর জামার বোতাম খুলে ভেতর থেকে পৈতে নিয়ে
টানাটানি শুরু করল। যখন পৈতেটা খুব একটা বাইরে এল না তখন একদিকে ঘাড় কাত
করে কোনরকমে খানিকটা এককানে পেঁচিয়ে নিল। তারপর হাফপ্যান্টের সঙ্গে খানিক
টানাটানি সেরে উবু হয়ে বসে অড়হরের ক্ষেতে জলসিঞ্চন করতে লাগল।
রঙ্গনাথ ততক্ষণে জেনে নিয়েছে যে হ্যাটওয়ালা ব্যক্তিটির নাম সিংহ সাহেব। উনি
এই এলাকার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর। এটাও জানা গেল যে ওনার সাইকেল ধরে
দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি জেলা বোর্ডের মেম্বার আর হ্যাট যিনি ধরে আছেন তিনি ঐ
বোর্ডেরই ট্যাক্স- কালেক্টর।

ইন্সপেক্টর সাহেব ফিরে এলে আবার অনেকক্ষণ ধরে দু’জনের কথাবার্তা চলতে
থাকল। কিন্তু এবার আর মিঠাই নয়, আলোচনার বিষয় ঘুরে গেল—জেলাবোর্ডের
চেয়ারম্যান, ইন্সপেক্টর সাহেবের রিটায়ার্মেন্ট, আর “ দিনকাল যে কত খারাপ
হয়েছে” গোছের কথায়। ওই তিনমূর্তি চলে গেলে রূপ্পনবাবু রঙ্গনাথকে ইন্সপেক্টর
সাহেবের সম্বন্ধে যা যা বললেন তার সারাংশ নীচে দেওয়া গেলঃ

বলতে গেলে লোকটি তো অনেককিছু, তার গুণ ক্রমশঃ প্রকাশ্য, কিন্তু বর্তমান
অবতারে উনি জিলাবোর্ডের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর বটেন। চাইলে উনিও অনেক কিছু
হতে পারতেন, কিন্তু স্যানিটারি ইন্সপেক্টর হওয়ার পর, হয়তো সবদিক ভেবেই,
সন্তুষ্ট হওয়াই শ্রেয় মনে করলেন। ওঁর যে অঞ্চলে পোস্টিং সেখানে শিবপালগঞ্জ
হল সবচেয়ে প্রগতিশীল, অন্য সব পিছিয়ে থাকা অনগ্রসরএলাকা। এরা জানে যদি
ওদের থেকে ওই পশ্চাদপদতা বা অনগ্রসরতা কেড়ে নেওয়া যায় তাহলে ওদের
থাকবেটা কী? এদের অধিকাংশ লোক কারও সঙ্গে দেখা হলে বেশ গর্বের সঙ্গে
বলে—সাহেব , আমি তো পিছিয়ে থাকা অঞ্চলের লোক। এই জন্যেই ওরা
ইন্সপেক্টর সাহেবকে নিয়েও গর্বিত। উনিও এই এলাকায় চল্লিশ বছর ধরে পদস্থ;
আর ওনার এই এলাকায় থাকা আজও অতটাই দরকার যতটা চল্লিশ বছর আগে ছিল।
স্যানিটারি ইন্সপেক্টরকে নানান রকমের কাজ সামলাতে হয়। ইনিও পকেটে
‘ল্যাক্টোমিটার’ নিয়ে ঘোরেন এবং রাজহংসের মত নীর-ক্ষীর, মানে জল আর দুধ,
আলাদা করে চিনতে দক্ষ। তাই ইনি যে গোয়ালে জল আর দুধে কোন ভেদাভেদ করা
হয়না, সেখানে ঠোঁট ডুবিয়ে মুক্তো তুলে আনেন। ছোঁয়াচে রোগ এবং রোগের
সংক্রমণের বিষয়ে উনি এমন বিশেষজ্ঞ যে কোথাও মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হলে
উনি কাগজ শুঁকেই বলতে পারেন যে সেটা কলেরায় হয়েছে নাকি
‘গ্যাস্ট্রোএন্ট্রাইটিস’ থেকে! আসলে সবসময়ই ওঁর উত্তর একরকম হয়। এদেশে
যেমন কেউ অনাহারে মরে না, তেমনি ছোঁয়াচে রোগেও নয়। লোক কপালে লেখা আছে
বলে মরে আর খামোকা অসুখকে দোষ দেয়! ওনার উত্তরও খানিকটা এই জাতের।
বেশ্যা, সাধু আর চাকুরিজীবিদের বয়সের আন্দাজ পাওয়া মুশকিল। কিন্তু
ইন্সপেক্টর সাহেব নিঃসংকোচে নিজের বয়সের কথা বলে বেড়ান। ওনার সঠিক বয়স
হল বাষট্টি, কাগজে লেখা উনষাট আর ওনাকে দেখলে মনে হয় পঞ্চাশের মত। উনি
সাদাসিধে পরোপকারী গোছের ঘরোয়া মানুষ। নমস্কার করে কোন প্রসংগ ছাড়াই বলে
ফেলেন—জানেন তো, আমার ভাইপোই এখন বোর্ডের চেয়ারম্যান। তারপর শুরু হয়
ওনার কোন গল্প যার মুখড়া হল “ভাইপো যখন বোর্ডের চেয়ারম্যান হল তখন আমি
বললাম ---“।

এই গল্পটি পুরো এলাকায় জল- মেশানো- দুধের মত ছড়িয়ে পড়েছিল। যে কোন
মহল্লায় গেলে শোনা যেত “ভাইপো যখন বোর্ডের চেয়ারম্যান হল তখন আমি
বললাম- বেটা, আমি অনেকদিন হুকুম চালিয়েছি , এবার আমায় রিটায়ার করার দিন।
তোমার অধীনে চাকরি করতে চাইনে। কিন্তু আজকাল পুরনো লোকদের কথা কে
শোনে! সমস্ত মেম্বার চেঁচিয়ে উঠল—এটা কোন কথা হল? ভাইপো বড়মানুষ হয়েছেন
তো চাচা কেন সাজা পাবে? দেখি তো, আপনাকে কে রিটায়ার করায়! ব্যস্‌ দুপক্ষেই
নিজের দাবিতে অনড়। গত তিনবছর ধরে আমি রিটায়ার হওয়ার দরখাস্ত করে যাচ্ছি,
কিন্তু প্রত্যেক বছর মেম্বারেরা খারিজ করে দিচ্ছে। এই কিসসা এখনও চলছে”।
এর সঙ্গে এনাকে আরেকটা নেশায় পেয়েছে। রোজ স্টেশনে গিয়ে শহর থেকে আসা
গাড়িগুলোকে মন দেখতে থাকেন। গাড়ি আসার আগে এবং গাড়ি চলে যাওয়ার পর উনি
প্ল্যাটফর্মে হাঁটাহাঁটি করতে থাকেন। এতে স্বাস্থ্য ভাল থাকে আর নিজেকে জাহির
করাও হয়।

ধরুন, স্টেশন মাস্টার ডিউটি করছে আর উনি চলতে চলতে ওনার কাছে গিয়ে চায়ের
খুরির মত দেখতে নিজের হ্যাটটি মাথায় লাগিয়ে চেয়ারে বসে পরোবেন। তারপর প্রশ্ন
করবেন, ‘বাবুজী, প্যাসেঞ্জার ট্রেন কখন আসবে”?

স্টেশন মাস্টার ওনাকে অনেকবার দেখেছে, ওর দেখতে আর কিছু বাকি নেই।

তাই রেজিস্টার থেকে চোখ না তুলে নিত্যিকর্মের মত জবাব দেয়—আধঘন্টা লেট
চলছে।

ইন্সপেক্টর খানিকক্ষণ চুপ। ফের প্রশ্ন—ছেলেমেয়েদের কী খবর?

--জী, ঈশ্বরের কৃপা!

ইনি এবার সরলভাবে প্রশ্ন করেন—আচ্ছা, আপনার ভাইপো তো আপনার সঙ্গেই
থাকত,তাই না?

--জী , ঠাকুরের কৃপায় ভাল চাকরি পেয়েছে। টিকিট কলেক্টর হয়েছে।

উনি এবার সুযোগ পেলেন। “আমার ভাইপোটাও ভাল চাকরি পেয়েছে। আগে যখন
ভলান্টিয়ার ছিল, লোকে ওকে নিয়ে কী না বলেছে! এমনটাও বলেছে যে লোফারগিরি
করে ঘুরে বেড়ায়’।

একটু পরে ইন্সপেক্টর হেসে ওঠেন। বলেন, “এখন তো আমিই ওর নীচে চাকরি
করছি। রিটায়ার হতে চাই, দিচ্ছে না”।

স্টেশন মাস্টার মন দিয়ে রেজিস্টার দেখছেন। কিন্তু উনি ছাড়বার পাত্র নন।

--তিন বছর ধরে কোনরকমে চালিয়ে যাচ্ছি। আমি চাই চাকরি ছাড়তে, ও বলে এখন

অভিজ্ঞ লোক পাওয়া মুশকিল। আপনি তো দারুণ কাজ করেছেন”।

স্টেশনমাস্টার উবাচ—বড় বড় নেতাদেরও একই দশা। ওঁরা বারবার রিটায়ার হতে
চান, কিন্তু সঙ্গের লোকজন ছাড়তেই চায় না।

উনি ফের হেসে ওঠেন। বলেন, “একদম তাই। তবে আমাকে যে আটকে রেখেছে সে
পদমর্যাদায় আমার চেয়ে অনেক উঁচু। কিন্তু নেতাদের আটকায় অনেক নীচের
লোকজন। দুটো কেসে তফাৎ এইটুকুই”। ওনার হাসি চলতেই থাকে, স্টেশনমাস্টার
রেজিস্টারের পাতা উলটে চলে।

কিছুদিন পরে ইন্সপেক্টরের মনে হল স্টেশনমাস্টার যেন নিজের কাজে বেশি
মনোযোগী হয়ে উঠেছে। উনি গিয়ে চেয়ারে বসলে পরে ও ভুরু কুঁচকে খুব মন দিয়ে
রেজিস্টারের পাতায় ডুবে যায়। কখনও কখনও একটা বড় কাগজে পেনসিল নিয়ে যোগ-
বিয়োগ-গুণ-ভাগে মত্ত থাকে।

রেজিস্টারে তো আগেও মন দিত, কিন্তু ভুরুর কুঞ্চন এবং পেন্সিল নিয়ে আঁকিবুঁকি
থেকে বোঝা যাচ্ছে যে স্টেশনমাস্টার নিজের কাজে বাজে ভাবে ফেঁসে গেছে। তারপর
প্রশ্ন-উত্তর এইভাবে চলতে থাকে—

-- আজকাল বোধহয় কাজের চাপ বেড়ে গেছে?

--হ্যাঁ।

--আর কী খবর?

--সব ভাল।

--গাড়ি কখন আসবে?

--রাইট টাইম।

-- আপনার ভাইপো তো এখন লখনৌয়ে?

--আজ্ঞে।

--আমার ভাইপো তো আজকাল—

--হুঁ।

--রিটায়ার হতে দিচ্ছে না।

--হুঁ।

--চেয়ারম্যান হয়েছে।

--হুঁ।

স্টেশনমাস্টারের ব্যবহারের অধঃপতন ইন্সপেক্টর সাহেব ভাল করে খেয়াল
করছিলেন। ব্যবহার দিন প্রতিদিন খারাপ হচ্ছিল। যেই উনি মাথায় চায়ের ভাঁড়
মার্কা হ্যাট চাপিয়ে চেয়ার টেনে বসেন অমনই ব্যাটার চোখজোড়া যেন লাফিয়ে উঠে
রেজিস্টারের পাতায় আটকে যায়। কখনও কখনও ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করলে না
শোনার ভান করে এড়িয়ে যায়। উনি ভাবেন—সরকারি চাকরি করেও যদি এত কাজ
করতে হয় তাহলে কী লাভ!

একদিন হঠাৎ ওঁর স্টেশনে গিয়ে রেলগাড়ি দেখার নেশা উপে গেল।

সেদিনও উনি রোজের মত স্টেশনে গিয়ে স্টেশনমাস্টারের সামনে চেয়ার টেনে বসে
পড়লেন। আজ ভদ্রলোক রেজিস্টারে পেন্সিল নয়, কলম দিয়ে কিছু লিখছিল। চাউনি
দেখে মনে হচ্ছিল যে আজ কাজের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও শেষ হবার মুখে।

ইন্সপেক্টর সাহেব শুরু করলেনঃ

--আজ আপনার অনেক কাজ।

--‘হ্যাঁ তো’? হঠাৎ খুব জোরে বলে উঠেছে।

উনি থতমত খেয়ে একটু থেমে গেলেন, তারপর বলতে শুরু করলেন, “প্যাসেঞ্জার

গাড়ি---“

স্টেশনমাস্টারের কলম থেমে গেল। তারপর ও ইন্সপেক্টরের দিকে কড়া চোখে বলল-

“প্যাসেঞ্জার ট্রেন পৌনে ঘণ্টা লেট, আপনার ভাইপো বোর্ডের চেয়ারম্যান। বলুন,
এরপর আর কিছু বলার আছে”?

ইন্সপেক্টর খানিকক্ষণ টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর উঠে ধীরপায়ে
বেরিয়ে গেলেন।

একজন পয়েন্টম্যান ওনাকে দেখে বলল—কী হয়েছে সাহেব?

--“ কিছু না, কিছু না। সাহেবের কাছে অনেক কাজ পড়ে আছে। আমার ভাইপোরও

ইদানীং বড় তিরিক্ষি মেজাজ। খুব কাজ, অনেক কাজ”।

আজ জোগনাথ একটি বিশেষ মতলবে রূপ্পনবাবুর সঙ্গে মেলায় এসেছে। ওর ভয়,
ওকে একা পেয়ে পুলিশ ফের জ্বালাতন না করে! আর ভালবাসা বেশি হলে ওকে
একেবারে জাপটে না ধরে!

ওরা সব মেলার সাজে সেজে বেরিয়েছে। রূপ্পনবাবু জামার কলারের নীচে একদম
নতুন কেনা রেশমি রুমাল গুঁজেছেন। সৌন্দর্য বৃদ্ধি হবে ভেবে চোখ ঢেকেছেন কালো
চশমায়। শনিচর পরেছে আন্ডারওয়ার আর হাতে বোনা সুতোর জালিদার গেঞ্জি। তবে
গেঞ্জি আর আন্ডারওয়ার অব্দি পৌঁছুতে পারেনি, দেড় ইঞ্চি আগেই থেমে গেছে।
ছোটে পালোয়ানের ল্যাংগোটের পট্টি আজ সামনের দিকে হাতির শুঁড়ের মত দুলছে না।
বরং ওটাকে পেছনের দিকে এমন কষে বেঁধেছে যে পট্টির অন্য মাথা ল্যাঙ্গট ফেঁসে
যাওয়ার মত হলেও পেছনে ছোট ল্যাজের মত লেগে রয়েছে। শুধু এই নয়, আজ ও
ভেতরে গেঞ্জি না পরে এক স্বচ্ছ কাপড়ের কুর্তা পরেছে এবং ওইরকম স্বচ্ছ এক
মার্কিনের গামছাকে লুঙ্গির মত করে পরেছে।

জোগনাথ রূপ্পনবাবুর গায়ে গায়ে লেগে চলছিল। ও হল এক রোগাপ্যাঙলা নবযুবক।
ওকে দেখলেই শিবপালগঞ্জের পুরনো লোকজন বলাবলি করত—আহা রে, একে
দেখলেই অযুধ্যা মহারাজের কথা মনে পড়ে যায়। অযোধ্যা মহারাজ ছিলেন তাঁর
সময়ের সবচেয়ে নামজাদা ঠগ। দূর-দূরান্তর থেকে লোকজন তাঁর কাছে ফন্দি-ফিকির
শিখতে আসতো। জোগনাথকে নিয়ে এখানকার লোকজনের অনেক আশা ছিল যে আবার
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে।

যে দিন গাঁয়ে চোর এল, সেদিন থেকে লোকে জোগনাথকে একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখতে
লাগল। গয়াদীনের ঘরে চুরি হবার পর জোগনাথের মনে হল ওকে যেন আগের চেয়ে
বেশি সম্মানের চোখে দেখা হচ্ছে। আমাবাগানে, যেখানে রাখালেরা কড়ি নিয়ে জুয়ো
খেলে, জোগনাথকে দেখলেই সবাই আগে গোপনে নিজেদের ট্যাঁক সামলায় , তারপর
তাকে বসতে দেয়। বাবু রামাধীনের ভাঙ খাওয়ার আসরে না জানি কত হাত বেচারা
জোগনাথের পিঠে স্নেহভরে হাত বুলিয়েছে!

ফ্ল্যাশ খেলতে গোটা শিবপালগঞ্জে জোগনাথের জুড়ি নেই।একবার তো সেরেফ
একটি ‘পেয়ারের’ জোরে ও খান্না মাস্টারের ‘ট্রেল’কে ফেলে দিতে বাধ্য করল। সেই
দিন থেকে জোগনাথের এমন রেলা হল যে ভাল ভাল খেলুড়েরা ওর হাতে তিনটে তাস
দেখলেই নিজেদের তাস দেখা ভুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। যেই প্রথম তাস
ফেলত, অমনি আদ্দেকের বেশি খেলুড়ে ঘাবড়ে গিয়ে হাতের তাস ফেলে দিত।
শোনা যায় , রাণা প্রতাপের ঘোড়া চেতক মোগল সেনার যে দিকে পৌঁছে যেত, ভীড় সরে
গিয়ে ওর রাস্তা করে দিত। মোগলের সৈন্যের পদাতিক চারহাত পায়ে দৌড়ে পলায়ন
করত। জোগনাথের তাসের চাল অনেকটা সেইরকম। যেই ওর চাল ময়দানে হাজির,
চারদিকে যোদ্ধাদের পলায়ন শুরু।

কিন্তু গয়াদীনের ঘরে চুরি হওয়ার পর হাওয়া পালটে গেল। জোগনাথকে দেখলেই
লোকে ফ্ল্যাশ খেলা কত খারাপ –সেসব বলতে শুরু করল। যে জুয়াড়ির দল আগে ওকে
দেখলেই এক হীরোর মত অভ্যর্থনা করত, আর খানাপিনা ভুলে ওর সঙ্গে খেলতে
বসে যেত, ওদের এখন ওকে দেখলে হঠাৎ জরুরি কাজের কথা মনে পড়ে, যেমন
বাজারে যাওয়া, ঘাস কাটা অথবা মোষ দোয়ানো ইত্যাদি।
এসবই জোগনাথকে মুশকিলে ফেলেছে। সেদিন দারোগাজী ওকে থানায় ডেকেছিলেন। ও
গেল বটে, তবে রূপ্পনবাবুকে সঙ্গে নিয়ে। দারোগাজী বললেন,”রূপ্পনবাবু , জনগণের
সহযোগিতা না পেলে কিছুই করা যাবে না।

তারপর উনি ভাল করে বোঝাতে লাগলেন।“ দেখুন, গয়াদীনের বাড়িতে চুরি হল, অথচ
কিছুই টের পাচ্ছি না। আপনারা সাহায্য না করলে আমি কী করতে পারি, --?”

রূপ্পনবাবু উবাচ, “আমরা পুরো সাহায্য করব। বিশ্বাস না হলে কলেজের কোন
ছোঁড়াকে গ্রেফতার করে দেখে নিন”।

দারোগা খানিকক্ষণ মৌনব্রত ধারণ করে পায়চারি করতে লাগলেন। তারপর
বললেন—এসব ব্যাপারে বিলেতের পদ্ধতি সবচেয়ে ভাল। আশি প্রতিশত অপরাধী
নিজের থেকেই অপরাধ কবুল করে নেয়। আমাদের এখানে তো---“ এই বলে উনি থেমে
গেলেন এবং জোগনাথকে এক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন। জোগনাথও কম যায় না।
তিনপাত্তির খেলায় ব্লাফ কল করার অভ্যস্ত চোখে দারোগাজীর দিকে তাকিয়ে
রইল।

জবাব দিলেন রূপ্পনবাবু। “বিলাইতী কায়দা এখানে নাই চালালেন। আশি প্রতিশত
লোক যদি নিজের মুখে অপরাধ কবুল করে নেয়, তাহলে আপনার থানার দশজন
সেপাইয়ের মধ্যে মেরেকেটে মাত্র দু’জন ডিউটি করবে। বাকি সব হাজতে থাকবে”।
এইসব কথাবার্তা, হাসি-ঠাট্টায় সময় গড়িয়ে গেল। জোগনাথকে কেন থানায় ডাকা
হল সেটা স্পষ্ট হল না। সেই কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে রূপ্পন জোগনাথকে বললেন,’
অ্যাই জোগনাথ, মরা চামচিকের মত বিচ্ছিরি মুখ করে মেলায় গেলে কী হবে? ফুর্তি
কর। দারোগা কি হায়না নাকি যে তোকে কামড়ে খাবে?”

কিন্তু ছোটে পালোয়ানের বিরক্তিভরা চেহারা। বলল,” আমার তো পাকা হিসেব—কাঠ
খেলে কয়লা হাগবে। জোগনাথ কি বৈদ্যজীকে জিজ্ঞেস করে গয়াদীনের ঘরে
ঢুকেছিল? তাহলে এখন কেন ওনাকে আঁকড়ে ধরেছে”?

জোগনাথ এর জবাবে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখনই একটা বলদে টানা গাড়ি ঘরঘরিয়ে
ওর পেছন থেকে গা-ঘেঁষে চলে গেল। রঙ্গনাথ গায়ের থেকে ধূলো ঝাড়তে লাগল। ছোটে
পালোয়ানের চোখের পলক পড়ল না। অর্জুন গীতার বাণী শুনে যে ভাব থেকে আঠারো
দিন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে ধূলো খেয়েছিলেন ছোটে পালোয়ানও প্রায় সেই ভাবে
বলদ গাড়ির ধূলো গিলে নিল। তারপর একলষেঁড়ের মত বলল—“খাঁটি বাত এবং গাধার
লাথ হজম করার লোক কমই হয়। জোগনাথকে নিয়ে গোটা গাঁয়ে যে খুসুর পুসুর চলছে
সেটা আমি এখন ভড়ভড়িয়ে বলে দিলাম, ব্যস্‌। এটা নিয়ে আর বলার কী আছে?”
শনিচর মধ্যস্থতা করতে চাইল। গ্রামসভার প্রধান নির্বাচিত হওয়ার আশায় ও
এখন থেকেই বৈদ্যজীর কায়দায় ‘শাশ্বত সত্য’ বলার অভ্যাস শুরু করেছে। --

“নিজেদের মধ্যে কুকুরের মত খেয়োখেয়ি ঠিক নয়। দুনিয়াশুদ্ধ লোক জোগনাথকে যাই
বলুক, আমরা ওকে একবার ’ভাল’ বলে দিয়েছি তো তাই সই। মরদের বাত এক, নাকি
দুই?”

ছোটে পালোয়ান নাক কুঁচকে ঘেন্নার ভঙ্গিতে বলল-“তুমি তাহলে মরদ”?

মেলার পথে দেখা হল ল্যাঙড়া বা লঙ্গড়ের সঙ্গে। রঙ্গনাথ বলল, “আরে, ও এখানেও
এসে গেছে”? ল্যাঙড়া বেচারা একটা ভুট্টা গাছের নীচে গামছা বিছিয়ে বসে একটু
আরাম করছিল আর নিজের মনে বিড়বিড় করছিল।। শনিচর বলল—লঙ্গড়ের আর কি!
যেখানে মর্জি হল, গামছা বিছিয়ে বসে পড়ল। আনন্দে মজে থাকে”।

ছোটে পালোয়ান ওর বিখ্যাত খবরের কাগজ মার্কা পোজে দাঁড়িয়ে ছিল। মানে, কাগজে
ওর এখনকার ফটো বেরলে পাঠকেরা ওর আসল চেহারাটা দেখতে পেত। যেন অসীম
সুখে মগন হয়ে আছে এইভাবে নীচের ঠোঁট ফাঁক করে দাঁতে দাঁত চেপে চোখ কুঁচকে
ওর উরূর মূল অংশ চুলকোচ্ছিল, মনে হয় লঙ্গড়ের প্রশংসায় তাতে বাধা পড়ল। তাই
ও দাঁত খিঁচিয়ে উঠল—“আনন্দে থাকে! শালা শূলের উপর চড়ে বসেছে! পরশুদিনই
তহসীলদারের সঙ্গে তুই-তোকারি করে ঝগড়া বাঁধিয়ে এসেছে। মজা কোত্থেকে পাবে?”
ওর পাশ দিয়ে এগিয়ে যাবার সময় রূপ্পন বলল—“কী গো লঙ্গড় মাস্টার! কী খবর?
তহসীলদারের অফিস থেকে দলিলের নকল পেলে”?

লঙ্গড়ের বিড়বিড়ানি বন্ধ হল। চোখের উপর হাত রেখে রোদ বাঁচিয়ে তাকাল।

রূপ্পনবাবুকে চিনতে পারল। বলল, “ কোথায় আর পেলাম বাবু? এদিকে এক পথে

নকলের দরখাস্ত সদর দফতরে পাঠিয়েছিলাম। ওদিকে ওখান থেকে মূল কাগজ
এখানে ফিরে এসেছে। ফের পনের দিনের ধাক্কা!”

শনিচর বলল,” শুনেছি তহসীলদারের সঙ্গে তুই-তোকারি করে ঝগড়া বাঁধিয়েছ?”

--“কিসের ঝগড়া বাবু? মামলাটা যখন আইন নিয়ে, সেখানে তুই-তোকারি করে কী
লাভ”? ওর ঠোঁট ফের বিড়বিড়ানির মুদ্রায় নড়তে শুরু করল।

ছোটে পালোয়ান ওর দিকে ঘেন্নার চোখে তাকাল। তারপর ঝোপ-ঝাড়ের সঙ্গে যেন
আলাপ করছে এমনি ভাবে বলল—“কথার ফুলঝুরি জ্বালিয়ে হবেটা কী? শালা,
অফিসে গিয়ে নকলনবীশকে পাঁচটা টাকা দিতে কী হয়”?

--“তুমি এসব বুঝবে না ছোটে। এটা নীতির লড়াই”। রঙ্গনাথ টিপ্পনি কাটল।

ছোটে পালোয়ান একবার নিজের বিশাল কাঁধের দিকে অনাবশ্যক দৃষ্টিপাত সেরে
বলল, “ তাই যদি হয় তো বেশ। ঘুরতে থাকো গোলকধাঁধায়”। এই বলে অন্য অনেক
যাত্রীর মত ঝোপঝাড়ের কাছে জলসত্র অভিপ্রায়ে গিয়ে দেখল আরেকটা লোক
খোলা জায়গায় অন্য কিছু করছে। পালোয়ান ওকে কষে একটা গালি দিয়ে অন্যদিকে
জায়গা খুঁজতে লাগল।

(চলবে)
1

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















১৫ পর্ব

রাজ কোষাগার লুন্ঠন এবং ধনরাশির অসমবন্টন।

যখন ধনসম্পত্তি এবং তার বন্টনের পদ্ধতি শুরু হয় তখন অনিয়ম এবং অসমবন্টন খুব স্বাভাবিক এবং সাধারণ ঘটনা। তার ওপর এই ধনসম্পত্তি যখন লুন্ঠিত ধনসম্পত্তি হয় তখন তো আর কথাই নেই। ছলে বলে কৌশলে যে যত পারে কুক্ষীগত করতে চায়। পলাশির যুদ্ধের পর লুন্ঠিত রাজকোষাগারের ক্ষেত্রেও ভিন্ন কিছু হবে এমন ভাবাটা অযৌক্তিক।

সিরাজের মৃত্যর পর প্রথম রাজকোষাগারে যারা ঢুকেছিল তারা হলো জন ওয়ালশ, ওয়াটস, দিওয়ান রামচাঁদ এবং মুন্সী ও ফারসি ভাষাবিদ নবকৃষ্ণ যিনি পরবর্তীকালে রাজা নবকৃষ্ণ দেব বলে পরিচিত হন। লোকমুখে শ্রুত তারা রাজকোষাগারে যে ধনসম্পদের সন্ধান পেয়েছিল তার পরিমাণ এইরকম- এক কোটি ছিয়াত্তর লক্ষ টাকা মূল্যের রৌপ্যমুদ্রা, বত্রিশ লক্ষ টাকা মূল্যের স্বর্ণমুদ্রা, দু’টি বড় সিন্দুকভর্তি সোনার বাট, চারটি বড় সিন্দুকভর্তি মণিমাণিক্যখচিত অলঙ্কার এবং দু’টি ছোট সিন্দুকভর্তি বিভিন্নরকমের রত্ন। লোকমুখে এও জানা যায় এটা অবশিষ্ট যেটুকু পড়েছিল সেটা। ওয়ালশ ও তার দলবল রাজকোষাগারে ঢোকার আগেই বেশিরভাগ ধনসম্পদ সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। ব্রিটিশদের এই বাঙলার ধনসম্পত্তি লুঠ করাকে তাদের ভারতবর্ষ লুন্ঠনের সূচনা হিসাবে ধরা হয়। এই অর্থের মধ্যে সাতাশ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড মিলিটারি এবং সিলেক্ট কমিটির সদস্যদের দেওয়া হয়েছিল।

রায়দুর্লভ, যার ওপর কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি তৈরি করা এবং রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল তার হিসাব অনুযায়ী রাজকোষাগারের ধনসম্পত্তির পরিমাণ ছিল মাত্র এক কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা। ২৬শে জুন ক্লাইভের বাহিনী যখন মিরজাফরের সভা শেষ করে প্রবল বৃষ্টিতে মইদাপুরে আশ্রয় নিয়েছে তখন ওয়াটস রায়দুর্লভকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করে জানিয়ে দেয় যে চুক্তিতে যে অঙ্কের উল্লেখ আছে তা যেন কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে দেওয়া হয়। যদি রাজকোষাগারে অর্থের ঘাটতি থাকে তাহলে জগৎশেঠ মাধবরাই এবং তার পরিবার যেন অগ্রিম হিসাবে ঘাটতির সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে দেয়। রায়দুর্লভ এই প্রস্তাব সম্পূর্ণ অস্বীকার করে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে জগৎশেঠের পক্ষে কোটি কোটি টাকা অগ্রিম দেওয়া সম্ভব নয়। সেই সন্ধ্যায় ওয়ালশ এবং ওয়াটস ক্লাইভের কাছে চিঠি পাঠালো।

-‘আজ নবাবের দরবারে দু’ঘন্টা কাটানোর পর আমরা যখন রায়দুর্লভের সঙ্গে বাইরে আসি তখন পথের মধ্যে রায়দুর্লভ ও তার হিন্দু সাঙ্গপাঙ্গরা আমাদের জানায় যে কোষাগারে মাত্র এক কোটি চল্লিশ লক্ষ আছে এবং জগৎশঠের পক্ষে বাকি টাকা অগ্রিম দিয়ে আমাদের চুক্তি মান্য করা সম্ভব নয়। উপযুক্ত তথ্যের অভাবে আমরা রায়দুর্লভের সঙ্গে বিতর্কে যেতে পারিনি। আমাদের প্রস্তাব আসল তথ্য জানার জন্য মোহনলালকে আমাদের সামনে হাজির করা হোক। আমরা অনেক বুঝিয়ে রায়দুর্লভের অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার সম্মতি আদায় করেছি। কিন্তু এইমুহূর্তে সে কোনও উদ্যোগ নিতে রাজি নয়। আমাদের অনুরোধ আপনি যদি উমিচাঁদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই সংক্রান্ত তথ্য জোগাড় করতে পারেন তাহলে তা টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। আমরা জানি যে রাজকোষাগার ছাড়াও অনেক গুপ্তস্থানে রাশি রাশি ধনসম্পদ গচ্ছিত আছে। এই খবর সর্বজনবিদিত।‘

আসলে ওয়াটস এবং তার বাহিনী ঐ বিশাল ধনসম্পত্তির আসল সন্ধান না পেয়ে বাইরের পরিমন্ডলেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। যখন সে বুঝতে পারে মোহনলালের কাছে অনেক খবর আছে তখন সে ক্লাইভের কাছে চিঠি লিখে মোহনলালকে তার হেফাজতে নিতে বলে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। চতুর রায়দুর্লভ জানত যে সিরাজের প্রধানমন্ত্রী মোহনলাল সিরাজের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন ছিল। মোহনলাল এতটাই ক্ষমতাবান ছিল যে অন্যান্য সেনাপতিরা এমনকি রায়দুর্লভও মাথা নিচু করে তার আসনে কপাল ঠেকিয়ে তাকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করত। মোহনলালের অগাধ ধনসম্পত্তি দেখে হিংসায়, ঘৃণায় জ্বলে যেত রায়বল্লভ। ভাগ্যচক্রে বন্দি মোহনলালকে রায়দুর্লভের হেফাজতে রাখা হয়। এই সু্যোগের সদ্ব্যবহার করে মোহনলালের সমস্ত সম্পত্তি করায়ত্ত করে তাকে হত্যা করেছিল রায়দুর্লভ। একথাও শোনা যায় কোনও গোপন জায়গায় মোহনলালকে রেখে পরে লোক পাঠিয়ে তাকে হত্যা করেছিল মিরজাফর। যাই হোক না কেন মোহনলালকে ব্রিটিশদের সামনে দাঁড় করাতে দেয়নি বিশ্বাসঘাতকেরা। ব্রিটিশদের আসল ধনসম্পত্তির সম্বন্ধে কোনও ধারণাই ছিলনা। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে আন্দাজ করা হয় যে কেবল রাজকোষাগারেই আসল সম্পত্তির পরিমাণ ছিল আট কোটি টাকার বেশি এবং যার বেশিরভাগটাই প্রাসাদের অভ্যন্তরে নারীদের শয়নকক্ষে রাখা হতো।

এই খবর চিরকাল ব্রিটিশদের অগোচরেই রয়ে গেল । তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলনা যে এই সমস্ত অর্থ এবং ধনসম্পদ রাজপ্রাসাদে প্রবেশের অধিকার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিরজাফর হস্তগত করেছিল। মিরজাফরের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তার বিশ্বস্ত অনুচর আমিন বা ওমর বেগ এবং দু’জন ব্রিটিশদের অতি বিশ্বস্ত বাঙালি কর্মচারি, রামচাঁদ এবং নবকৃষ্ণ যাদের ব্রিটিশরা নিযুক্ত করেছিল টাকা পয়সার হিসাব নিকাশের জন্য। এদের মধ্যে নবকৃষ্ণ ফারসি ভাষায় লেখা কাগজপত্রের অর্থোদ্ধারে পারদর্শী ছিল। প্রচুর ধনসম্পদ দিয়ে মিরজাফর এদের মুখ বন্ধ করেছিল। যে রামচাঁদ মাসিক মাত্র ষাট টাকার কর্মচারী ছিল সেই রামচাঁদ যখন পলাশি যুদ্ধের দশ বছর পরে দেহত্যাগ করে তখন তার জমিজমার আর্থিক মূল্য তিয়াত্তর লক্ষ টাকা। এছাড়াও তিনশ’র অধিক রুপোর এবং আশিটি সোনার কলসি, প্রায় আঠারো লক্ষ টাকা মূল্যের অন্যান্য সম্পত্তি ও কুড়ি লক্ষ টাকা মূল্যের অলঙ্কার। শোনা যায় রামচাঁদের জমিজমার আসল অর্থমূল্য তখন ছিল প্রায় এক কোটি কুড়ি লক্ষ টাকা। কিন্তু খাতায় কলমে তিয়াত্তর লক্ষ দেখানো হয়েছিল। যদিও ১৭৫৯ থেকে ১৭৬৪ সাল অবধি রামচাঁদ বাঙলার গভর্নর হেনরি ভানসিতার্তের দিওয়ান ছিলো তবুও কেবল মাসমাইনের টাকায় এত সম্পত্তি করা সম্ভব নয়। প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন ভানসিতার্ত নিজেই চাকরির শেষে মাত্র দশলক্ষ টাকা নিয়ে বাঙলা ছেড়েছিল। সুতরাং সিরাজের সম্পত্তির বেশ কিছু ভাগ যে রামচাঁদ পেয়েছিল সে কথা অবিশ্বাস করা যায় না। আরও শোনা যায় যে আরেক ষাট টাকা মাসমাইনের কর্মচারী নবকৃষ্ণ তার মায়ের শ্রাদ্ধে ন’লক্ষ টাকা খরচ করেছিল।

একই অভিযোগ শোনা যায় নর্তকি মুন্নি বেগমের নামেও। এই নর্তকি প্রথমে মিরজাফরের রক্ষিতা এবং পরবর্তীকালে প্রভাবশালী দ্বিতীয় বেগম হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। মিরজাফরের মৃত্যুর পর এই মুন্নি বেগম তার ছেলেদের মধ্যে কাউকে নবাব করার জন্য ব্রিটিশদের কাছে আর্জি জানায়। ১৮১৩ সালে তিরানব্বই বছর বয়সে দেহত্যাগ করার সময় তার সম্পত্তির পরিমাণ ছিল কয়েক কোটি। মিরজাফর মারা যাবার সময় কিছু রেখে যায়নি। ঋণভারে জর্জরিত মিরজাফর শেষ বয়সে বেতন দিতে না পারার জন্য নিজের সৈন্যবাহিনীর দ্বারা বারবার আক্রান্ত হয়েছিল এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে তার জামাই মিরকাশিম তাকে গদিচ্যুত করে। তা সত্ত্বেও মুন্নি বেগমের কাছে এত সম্পত্তি কোথা থেকে এলো?

কান্তবাবু এবং নবকৃষ্ণ দেব এই দু’জনের ব্যাপারে একটু বিশদে আলোচনা করা যেতে পারে। কান্তবাবু ছিল ওয়ারেন হেস্টিংসের খুব কাছের লোক। পলাশির যুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া অনেক গোপন নাটকের কুশীলব এই কান্তবাবু। এই কান্তবাবুর আসল নাম কৃষ্ণকান্ত নন্দী যিনি কাশিমবাজার রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা বলে পরিচিত। কান্তবাবুর বাবা ছিল ছোটখাট দোকানদার । সিল্ক, সুপারি এবং ঘুড়ির দোকান চালাত কান্তবাবুর বাবা। কাশিমবাজার ফ্যাক্টরিতে শিক্ষানবিশ হিসাবে যোগ দেয় ঘুড়ি ওড়াতে দক্ষ কান্তবাবু। তারপর ঐ ফ্যাক্টরির করণিক হয়ে হেস্টিংসের কাছাকাছি আসার সুযোগ পায়। হেস্টিংস মুর্শিদাবাদে আসে ১৭৫৩ সালে।এর তিনবছর পরেই করণিক কান্তবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ হয় ভাবী গভর্নর জেনারেল হেস্টিংসের। সিরাজ যখন কাশিমবাজার আক্রমণ করে তখন হেস্টিংসকে জেলে বন্দি করা হয়। বন্দি হেস্টিংসকে জেল থেকে পালাতে সাহায্য করে এই কান্তবাবু। প্রথমে নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রেখে তারপর নদীপথে নৌকায় গোপনে হেস্টিংসকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিল কান্তবাবু। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হেস্টিংস কান্তবাবুকে একটা চিঠি দিয়ে বলে যান যদি ভবিষ্যতে কোনদিন কান্তবাবুর সঙ্গে তার দেখা হয় তাহলে এই চিঠিটা দেখালেই সে তাকে চিনতে পারবে। কথিত আছে অনেক পরে যখন হেস্টিংস ক্ষমতায় আসে তখন অনেক লোক নিজেদের কান্তবাবু বলে পরিচয় দিয়ে হেস্টিংসের সঙ্গে দেখা করতে চায়। কিন্তু চিঠির কথা শুনে সবাই পালিয়ে যায়। পরে কান্তবাবু যখন চিঠি নিয়ে দেখা করতে চায় হেস্টিংস তাকে খাজনা আদায়ের কাজে নিযুক্ত করে। খাজনা তুলে সরাসরি হেস্টিংসের হাতে তুলে দেওয়াই ছিল তার কাজ। হিসাববহির্ভূত টাকা লেনদেনের এই সুযোগে প্রভূত অর্থের মালিক হয় হেস্টিংস এবং কান্তবাবু দু’জনেই। এই সময়েই কান্তবাবু হেস্টিংসের সহযোগী এবং বন্ধু ফ্রান্সিস সাইকসের কাছাকাছি আসে। হেস্টিংসের এই অসদুপায়ে অর্জিত বা লুন্ঠিত অ্রর্থ রক্ষা এবং হিসাবের দায়িত্ব ছিল ফ্রান্সিসের। ফ্রান্সিস দেশে ফেরার সময় তার নিজের সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ ছিল তখনকার সময়ে সাতলক্ষ পাউন্ড যার পরিমাণ আজকের দিনে সাতকোটি পাউন্ড বা সাড়ে ছ’শ কোটি টাকা। এই দুটি ঘটনা কান্তবাবুর জীবনের গতি পালটে দেয়। এই কান্তবাবু এবং নবকৃষ্ণ দেবকে ভারতবর্ষে ইউরোপিয় সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার প্রথম ভারতীয় সাহায্যকারী হিসাবে গণ্য করা হয়।

ক্লাইভ এবং হেস্টিংসের দপ্তরের একজন সামান্য অনুবাদক এবং হিসাবরক্ষক থেকে নবকৃষ্ণ কী করে কয়েক বছরের মধ্যে মহারাজ নবকৃষ্ণ দেব হয়ে শোভাবাজারের রাজপ্রাসাদ এবং বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়ে উঠলো সে কথা আজও অজানা। তবে লোকমুখে কথিত আছে নবকৃষ্ণ ছিল ক্লাইভের বিশ্বস্ত গুপ্তচর ও গোপন সংবাদবাহক যে পলাশির চক্রান্তে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই কাজের সুযোগে চতুর নবকৃষ্ণ সিরাজের গোপন ধনাগারের সন্ধান পেয়েছিল। সেই ধনাগারের সন্ধান মিরজাফর এবং নবকৃষ্ণ ছাড়া আর কেউ জানতো না। এই বিপুল ধনরাশির সন্ধান ব্রিটিশদের গোচরে আসার আগেই নবকৃষ্ণ এবং মিরজাফর নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ঐতিহাসিকেরা বলেন সিরাজের ধনাগার থেকে গোপনে লুন্ঠিত অর্থ যেমন ইংরেজদের বোকা বানিয়ে মিরজাফরকে সামনে রেখে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল নবকৃষ্ণ তেমনি আবার মিরজাফরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং পলাশি পরবর্তী সময়ে রাজপ্রাসাদে যাতায়াতের সুযোগে তার অভ্যন্তরের অনেক খবর, তাদের রীতিনীতি, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা , অন্তর্দন্দ্ব এবং সর্বোপরি অন্দরমহলের অনেক গোপন সংবাদ অনেক ঝুঁকি নিয়ে , এমনকি জীবন বাজি রেখেও ক্লাইভ আর হেস্টিংসের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছিল নবকৃষ্ণ । শান্ত, সৌম্যদর্শন নবকৃষ্ণকে দেখে বোঝাও যেত না জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই দ্বিচারিতা সে চালিয়ে গেছে অনেকদিন ধরে। দু’দিক থেকেই লুন্ঠনের ভাগ পেয়েছে সে। সঠিক না জানলেও অনুমান করা হয় যে ১৭৩২ সালে জন্ম হয়েছিল নবকৃষ্ণের। আর ঠিক সেই বছরেই জন্ম নিয়েছিল তারই ভাগ্যনির্মাতা ওয়ারেন হেস্টিংস। ক্লাইভের বয়স তখন সাত। যে গোবিন্দপুরে জন্ম হয়েছিল নবকৃষ্ণের সেই গোবিন্দপুরকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। কে জানে যে ভূমিখন্ডে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল নবকৃষ্ণ হয়তো সেই ভূমিখন্ডেই স্থাপিত হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়মের ভিত্তিপ্রস্তর। হয়তো নিয়তিনির্দেশিত ছিল এই ব্রিটিশস্তাবকতা। সেই নিয়তির ডাকেই ১৭৫০ সালে ঘটনাচক্রে অষ্টাদশবর্ষীয় দরিদ্র নবকৃষ্ণ সমবয়সী হেস্টিংসের বাংলা ও ফারসি ভাষার শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। কৃষ্ণবল্লভ যখন সিরাজের ভয়ে প্রভূত অর্থসহ ব্রিটিশদের কাছে আশ্রয়ের জন্য অনুরোধ করে তখন ড্রেক তাকে জানায় যে যদি সিরাজের দরবারের মন্ত্রী এবং সর্দারেরা তাকে নিশ্চিন্ত করে যে এই কারণে সিরাজের কাছ থেকে কোনও বাধা আসবে না তাহলে ব্রিটিশরা তাকে বিপৎকালীন আশ্রয় দিতে পারে। কৃষ্ণবল্লভের বাবা রাজবল্লভ তখন সিরাজের কারাগারে বন্দি। কিন্তু জেলে বসেই সিরাজের দরবারের কয়েকজন মন্ত্রী এবং সেনাপতির স্বাক্ষরসম্বলিত সম্মতিপত্র রাজবল্লভ ড্রেকের কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করে। এইসব মন্ত্রী সেনাপতিরা নিজেদের পথ খুলে রাখার জন্যই রাজবল্লভের প্রস্তাবে রাজি হয়। যে পত্রবাহক চিঠিটি নিয়ে আসে সে জানায় যে চিঠিটি ফারসি ভাষায় লেখা এবং চিঠিটি যেন কোনও মুসলমানের হাতে না পড়ে। ফারসি জানা হিন্দু মুন্সির খোঁজে বেরিয়ে ড্রেকের বাহিনী বড়বাজারে নবকৃষ্ণের খোঁজ পায়। নবকৃষ্ণ এসে সেই চিঠির অর্থ ব্যখ্যা করে উত্তর লিখতে সাহায্য করে নবকৃষ্ণ। পরবর্তীকালে সিরাজ যখন কলকাতা আক্রমণ করে তখন কয়েকজন ব্রিটিশ অফিসারকে নবকৃষ্ণ ডায়মন্ডহারবারে লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে এবং তাদের কাছে সে অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর পৌঁছে দিয়েছিল।এছাড়াও সিরাজ যখন দ্বিতীয়বার কলকাতা আক্রমণ করে এবং উমাচাঁদের বাগানবাড়িতে আশ্রয় নেয় তখন ক্লাইভ নবকৃষ্ণকে উপঢৌকন এবং শান্তিপ্রস্তাব নিয়ে সিরাজের কাছে পাঠায়। এই সুযোগে প্রচুর ঝুঁকি নিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর সংগ্রহ করে ক্লাইভকে দেয় নবকৃষ্ণ। এই সমস্ত খবর পরবর্তী সময়ে ক্লাইভকে অতর্কিত আক্রমণে সিরাজকে পর্যুদস্ত করতে প্রচুর সাহায্য করেছিল। এইসব কারণেই নবকৃষ্ণ ক্লাইভ এবং হেস্টিংসের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠে এবং বানিয়া হয়ে ওঠে। বানিয়া সেই শ্রেণীর ভারতীয়দের বলা হত যারা ব্রিটিশ প্রভুদের বাড়ি এবং দপ্তর দু’জায়গার কাজেই সহায়তা করতো। খাজনা আদায়ে সাহায্য করা ছাড়াও এই দেশে বাস করার জন্য প্রভুকে উপযোগী করে তোলাই এদের মূল কাজ। সেই কারণে প্রভুর বাড়িতে এবং দপ্তরে অবাধ যাতায়াত ছিল এই বানিয়াদের। প্রভুরাও তাদের অন্যায়ভাবে উপার্জিত খাজনা এবং অন্যান্য বেআইনি ব্যবাসায় অর্জিত টাকার একটা ভালো অংশ দিত এই বানিয়াদের। প্রভুর ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে এক সমান্তরাল রাজ্য চালাত এই বানিয়ারা। নবকৃষ্ণ ছিল ক্লাইভ এবং হেস্টিংসের এমনই এক বানিয়া এবং অবাধ লুন্ঠনের অন্যতম সহায়ক। ১৭৫৭ সালের শেষের দিকে পলাশির যুদ্ধজয় উপলক্ষ্যে প্রভু ক্লাইভের সম্মানে এক বিশাল দূর্গাপূজার আয়োজন করে নবকৃষ্ণ। অফুরন্ত মদ্য-মাংস সহযোগে সুবিশাল দূর্গাপূজা পালিত হয় নবকৃষ্ণের বাড়িতে।

এতবড় একটা যুদ্ধজয় এখনও পর্যন্ত কোনও ঐশ্বর্য্যের সন্ধান দিতে না পারায় ক্লাইভ রীতিমত অধৈর্য হয়ে উঠলো। চুক্তি অনুযায়ী বিশ্বাসঘাতকদের যে পরিমাণ অর্থ ক্লাইভের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল তার কিছুই পাওয়া যায়নি। সিরাজের সম্পত্তির পরিমাণ বেশি করে দেখানো এবং সেই সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য ওয়াটস এবং ওয়ালশের অভিযোগ আর তার সঙ্গে রায়দুর্লভের ঔদ্ধত্য ক্লাইভকে ক্রোধান্বিত করে তুললো। অভিযোগের জবাবে ক্লাইভ জানালো যে পরেরদিন অর্থাৎ ২৭শে জুন সে মিরজাফর এবং জগতশেঠের সঙ্গে দেখা করে এই ব্যাপারটার ফয়সালা করবে। রায়দুর্লভ কী করে বলতে পারে যে কোষাগারে সম্পত্তির পরিমাণ মাত্র এক কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা? কিন্তু আদতে যা হলো তা হচ্ছে ক্লাইভ পরেরদিন মিরজাফরের কাছে গেলনা। ২৮শে জুন বিশাল ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী কাশিমবাজারে এসে পৌঁছলো। ওয়াটস মারফৎ ক্লাইভের কাছে খবর এলো যে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ছাড়া মিরজাফরের কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। মিরজাফরের ছেলে মির মিরান, জামাই মিরকাশিম এবং রায়দুর্লভ ক্লাইভকে হত্যার পরিকল্পনা করছে। জগৎশেঠের কাছ থেকে এরকম খবরই এসেছে ওয়াটসের কাছে। জগৎশেঠের একান্ত অনুগত রঞ্জিত রায় ওয়াটসের সঙ্গে দেখা করে এই খবর দিয়েছে। সে এও জানিয়েছে যে জগৎশেঠ পরের দিন ক্লাইভের সঙ্গে দেখা করবে এবং এই কথা যেন কাকপক্ষীতেও টের না পার পায়। ক্লাইভ যেন অসুস্থতার অজুহাতে বাড়ি থেকে না বেরোয়। একথাও জানা গেছে যে সিরাজের প্রচুর ধনসম্পত্তি এবং অলঙ্কার গোপনে ভগবানগোলার উত্তর-পূর্বে গঙ্গা-পদ্মার অপর পারে গোদাগিরিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই কাজ কে করেছে তা এখনও স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। হতে পারে সিরাজ প্রাসাদ ছাড়ার আগে এই সব ধনসম্পত্তি ও অলঙ্কার পাঠিয়ে দিয়েছিল। ছেলে, জামাই আর রায়দুর্লভের সহযোগিতায় এ কাজ মিরজাফরেরও হতে পারে।

২৮শে জুন পুরোদিন ক্লাইভ কাশিমবাজারেই বসে রইলো। ষড়যন্ত্রীদের পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। ভাগ্যক্রমে জগৎশেঠের সংবাদ এবং ওয়াটসের সাবধানবাণী ঠিক সময়ে এসে গিয়েছিল। যারা সিরাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তারা ক্লাইভের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না সে কথা কে জোর দিয়ে বলতে পারে? সেদিন রাত্রে কোনও গুপ্ত খবরের ভিত্তিতে ক্লাইভ পরের দিন অর্থাৎ ২৯শে জুন মিরজাফরের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলো। তবুও সাবধানের মার নেই। কোথায় যে কী ফাঁদ পাতা আছে কে জানে? ২৯শে জুন মেজর গ্রান্টের নেতৃত্বে ১০০ সৈন্য এবং ৩০০ সেপাই নিয়ে ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ পৌঁছলো।
0

গল্প - অর্পিতা মুখোপাধ্যায়

Posted in







লোকটি নরমমতো বড়োসড়ো কিছু একটা মাড়াল। সঙ্গে সঙ্গেই অনুভব করল যে পায়ে কিছু একটা কামড়েছে। এক লাফে সামনে এগিয়ে গেল। শাপ-শাপান্ত করে গালি দিয়ে পেছনে ফিরেই দেখতে পেল একটা বিশাল বিষধর সাপ (ভাইপার বা ইয়ারারাকুসু)নিজের মধ্যে পাক খেয়ে আবার আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে।


লোকটি খুব দ্রুত নিজের পা-টা একবার দেখে নিল, যেখানে দুটো রক্তের ফোঁটা অস্বস্তিকরভাবে ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে । সে চট করে তার বেল্ট থেকে দা বার করল । বিপদ আসন্ন বুঝতে পেরেই ভাইপার নিজের কুণ্ডলীর মধ্যে মাথাটা লুকিয়ে ফেলল। আর ঠিক তখনই ধারলো দাটা বিষাক্ত সাপটির পিঠের ওপর পড়ে তার মেরুদণ্ডটা একবারে ভেঙে দিল ।


লোকটি নিচু হয়ে সাপের কামড়ে হওয়া ক্ষতটা দেখল, তারপর রক্তের বিন্দুগুলো মুছে ফেলল। সেই মুহূর্তেই বিষয়টির গুরুত্ব ভালো করে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করল। ওই বেগুনি বিন্দুদুটি থেকে ভয়ানক যন্ত্রণা শুরু হয়ে ক্রমশ তীব্রতর হয়ে সারা পায়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে সে নিজের রুমাল দিয়ে গোড়ালিটা শক্ত করে বেঁধে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খামারের দিকে রওনা হল।


পায়ের যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়তে লাগল। জায়গাটা ফুলে গিয়ে যেন ফেটে পড়ছে। দু-তিনবার বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তীক্ষ্ণ সূঁচ-বেঁধানো ব্যথা তার ক্ষতস্থান থেকে হাঁটুর কাছাকাছি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে লাগল। পা ফেলতে অসম্ভব অসুবিধে হচ্ছিল। গলার মধ্যে যেন ধাতব শুষ্কতা, তার সঙ্গে জ্বলন্ত তৃষ্ণা। তার মুখ থেকে আবার একটা বিশ্রী গালি ছিটকে বেরিয়ে এল।


শেষ পর্যন্ত সে খামারে পৌঁছোল। দু-হাত ছড়িয়ে জলকলের চাকার ওপর আছড়ে পড়ল। দংশনের দুটি বেগুনি বিন্দু তখন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল যেহেতু পুরো পা-টাই বীভৎসভাবে ফুলে উঠেছিল। তার পায়ের চামড়া ভীষণ পাতলা হয়ে গিয়েছিল ,মনে হচ্ছিল একটু চাপ পড়লেই ফেটে যেতে পারে। সে নিজের বৌকে ডাকতে চাইল কিন্তু গলা ভেঙে গিয়ে একটা গোঙানি বেরিয়ে এল। গলার ভেতরটা অতিরিক্ত শুকিয়ে গিয়ে যেন টেনে ধরেছে। মারাত্মক তৃষ্ণা তাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করল।


---দোরোতেয়া ! কোনোমতে সে ফ্যাসফ্যাসে গলায় চিৎকার করে উঠল। আমায় একটু মদ দাও!


তার বৌ একটা ভর্তি গ্লাস নিয়ে দৌড়ে এল, আর লোকটি তিন চুমুকেই শেষ করে দিল। কিন্তু সে মদের কোনো স্বাদ পেল না।


---তোমার কাছে মদ চেয়েছিলাম, জল নয় ! রেগে গিয়ে চিৎকার করল সে। আমায় মদ দাও !

---কিন্তু , এটা তো মদই পাউলিনো! তার বৌ ভয়ে ভয়ে প্রতিবাদ করল।

---না,তুমি আমায় জলই দিয়েছ ! আমি তোমায় বলছি তো, আমি মদই চাই!


তার বৌ দৌড়ে গিয়ে মদের পুরো পিপে নিয়ে ফিরে এল। লোকটি পরপর আরো দু- গ্লাস মদ পান করল, কিন্তু গলায় সে কিছুই অনুভব করল না। তার তৃষ্ণা একটুও মিটল না।


---নাঃ ; অবস্থাটা ক্রমশ আরও শোচনীয় হয়ে উঠছে ---সে নিজের পায়ের গ্যাংগ্রিনের মতো দগদগে ক্ষতস্থান দেখতে দেখতে বিড়বিড় করে বলল। রুমালের শক্ত বাঁধনের দুপাশ থেকে ফুলে ওঠা পা-টা যেন বিরাট রক্তাক্ত সসেজের মতো বেরিয়ে আসছিল ।



প্রচণ্ড ব্যথাটা ক্রমাগত চিড়িক চিড়িক করছিল বিদ্যুৎ ঝলকের মতো আর সেটা পৌঁছে গিয়েছিল কুঁচকি পর্যন্ত। ভয়াবহভাবে গলাটা পুরোপুরি শুকিয়ে যাচ্ছিল,আর সেইসঙ্গে নিঃশ্বাসটাও যেন ক্রমশ আরো বেশি উষ্ণ হয়ে উঠছিল। যখন সে উঠে বসার চেষ্টা করল তখনই আধ মিনিটের জন্যে হঠাৎ ভয়ানক দমকে বমি ছিটকে এল তার মুখ থেকে, চাকার লাঠির ওপরে কপালটা রেখে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল।


লোকটির একেবারেই মরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, তীরে নেমে এসে তাড়াতাড়ি নিজের নৌকোয় চড়ে বসল। নৌকোর পেছনে বসে পারানা নদীর কেন্দ্রে পৌঁছোনোর জন্যে সে দাঁড় বাইতে শুরু করল। সেখানে ইগাজু জলপ্রপাতের কাছাকাছি নদীর স্রোত ঘন্টায় ছয় মাইল, নদীর এই দ্রুত গতি তাকে পাঁচ ঘন্টার আগেই তাকুরু-পুকুতে পৌঁছে দেবে।


ক্রমশ ঝিমিয়ে-আসা শক্তি নিয়ে কোনোভাবে মাঝনদীতে পৌঁছোল। কিন্তু ততক্ষণে তার হাতদুটি অবশ হয়ে গিয়ে দাঁড়গুলো নৌকোর মধ্যেই হাত থেকে খসে পড়ল। আবার সে বমি করল, এবারে রক্তবমি। সে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল সূর্য ইতিমধ্যেই পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে।


উরু পর্যন্ত তার পুরো পা-টা ফুলে গিয়ে এমন বিকৃত আকার ধারণ করেছে যে প্যান্টের সেলাই ফেটে বেরিয়ে আসছিল। সে প্যান্টের সেলাই কেটে ফেলল ছুরি দিয়ে, তার পেটের নীচের অংশটা ঝুলে গিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, তার মধ্যে শিরা ফেটে গিয়ে রক্ত জমাট বেঁধে বিচ্ছিরি বড়ো বড়ো দাগ হয়ে গিয়ে অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছিল। তার মনে হল সে কিছুতেই একা তাকুরু-পুকুতে পৌঁছোতে পারবে না। সিদ্ধান্ত নিল যে তার বন্ধু আলভেস-এর সাহায্য নেবে, যদিও অনেকদিন ধরে আলভেস-এর সঙ্গে তার মোটেই সদ্ভাব ছিল না।


নদীর স্রোত এইসময় ব্রাজিলের তটবর্তী হয়ে দ্রুতগতিতে বইছিল, সে খুব সহজে নৌকো তীরে ভেড়াতে পারল । তারপর নিজেকে টেনে হিঁচড়ে ঢাল বেয়ে উঠল, পরিশ্রান্ত হয়ে বুকে ভর দিয়ে শুয়ে রইল।

---আলভেস! যত জোরে পারল সে চিৎকার করল আর বৃথাই কান পেতে রইল।

---বন্ধু আলভেস ! আমায় এইসময় তুমি ফিরিয়ে দিও না!---মাটি থেকে মাথাটা সামান্য তুলে সে আবার বলল । অরণ্যের নিস্তব্ধতার মধ্যে থেকে সামান্য ফিসফিসানিও শোনা গেল না। লোকটি আবার ঢাল বেয়ে নীচে নেমে নৌকোয় উঠল। আবার নদীর স্রোত তাকে দ্রুগতিতে ভাসিয়ে নিয়ে চলল।


পারানা নদী বয়ে চলেছে সুগভীর খাদের মধ্যে দিয়ে, যার পাড় প্রায় একশো মিটার উঁচু। অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা নদীকে চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। নদীর তীরে ঘন কালো রঙের বাসাল্ট পাথরের চাঁই , সেখান থেকেই ওপরে উঠে গেছে জঙ্গল, সেটাও ঘন কৃষ্ণবর্ণের। তার সামনে নদীর তীরে অন্তহীন করুণ ,বিষণ্ণ অরণ্যের প্রাচীর ; জলের গভীরে ফেনিল ঘূর্ণি আর নদীর ভয়ানক হিংস্র স্রোত, বিষাক্ত জলের মধ্যে অবিরাম বুদবুদ আর ফেনা। সমগ্র প্রকৃতিই যেন আক্রমণের জন্যে উদ্যত, আর তার মধ্যেই নীরব, হিমশীতল মৃত্যুর রাজত্ব। সন্ধে নামছে কিন্তু ছায়াচ্ছন্ন সৌন্দর্য আর শান্তি এক অনন্য মহিমায় নিসর্গকে আবৃত করছে ।


ইতিমধ্যেই সূর্য অস্ত গিয়েছিল । লোকটি নৌকোর গভীরে আধশোয়া, তার একটা ভয়ঙ্কর শিহরণ হল, আশ্চর্যের বিষয় সে তার

ঝুঁকে –পড়া মাথাটা ধীরে ধীরে তুলতে পারল, এবারে একটু ভালো বোধ করতে লাগল। পায়ে যন্ত্রণা প্রায় হচ্ছেই না, তৃষ্ণাও অনেক কমে গেল, তার বুকের চাপ-ধরা ভাবটা চলে যাওয়ায় সে ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে লাগল।


তার কোনো সন্দেহ রইল না যে শরীর থেকে বিষটা নেমে গেছে। সে অনেকটাই ভালো বোধ করছিল, যদিও তার হাত নাড়ানোর ক্ষমতা ছিল না, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার জন্যে সে শিশিরবিন্দুর ওপর নির্ভর করে রইল। হিসেব করে দেখল যে তিন ঘন্টার আগেই সে তাকুরু-পুকু পৌঁছে যাবে।


সে ক্রমশ সুস্থ বোধ করতে লাগল। তার তন্দ্রাচ্ছন্নতা নানান স্মৃতিতে ভরে উঠল। তার পায়ে বা পেটে কোনো অনুভূতিই ছিল না। তার বন্ধু গোয়ানা কি এখনো তাকুরু-পুকুতেই থাকে ? হয়তো তার সঙ্গে দেখা হবে তার প্রাক্তন-মনিব মিস্টার ড্যুগাল্ডের, যে সকলের কাজের দেখাশোনা করত ও কাজ বুঝে নিত।


ও কি তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে ? সূর্যাস্তের আকাশ যেন একটা সোনারঙের পর্দা খুলে দিল আর নদীও সেই রঙে রঙিন হয়ে উঠল। ইতিমধ্যেই অন্ধকারাচ্ছন্ন পারাগুয়ের তটভূমি, পাহাড়েরা গোধূলির সতেজতা নিয়ে ঝুঁকে পড়েছে নদীর ওপরে, কমলাফুল আর বুনো মধুর আচ্ছন্ন ও আবিষ্ট করা সুগন্ধ নিয়ে। একজোড়া টিয়াপাখি অনেক উঁচু দিয়ে নীরবে উড়ে গেল পারাগুয়ের দিকে।


সেখানে , অনেক নীচ দিয়ে সোনার নদীর ওপরে নৌকো ভেসে চলল তীব্র গতিতে,কখনো বা জলের সফেন ঘূর্ণির মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে। নদীর সঙ্গে যেতে যেতে প্রতি মুহূর্তে তার মনে হতে লাগল যে সে আরেকটু ভালো বোধ করছে, আর ভাবতে লাগল ঠিক কতদিন সে তার প্রাক্তন মনিবকে দেখেনি। তিন বছর ? না, হয়তো এতদিন নয়। দু-বছর নয় মাস? হয়তো। সাড়ে আট মাস? হ্যাঁ, এটাই সঠিক, সে একেবারে নিশ্চিত।


হঠাৎ সে অনুভব করল যে তার বুক পর্যন্ত বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। কী হতে পারে ? এমনকী তার নিশ্বাসটাও ...


যে কাঠ নিত মিস্টার ড্যুগাল্ডের কাছ থেকে, লোরেঞ্জো কুব্যিইয়া, তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল পুয়ের্তো এস্পেরান্সায় (প্রতীক্ষা বন্দরে) গুড ফ্রাইডেতে ...শুক্রবার ? না কি পবিত্র বৃহস্পতিবারে...


লোকটি আস্তে আস্তে তার হাতের আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিল।


---এক বৃহস্পতিবারে ...


আর নিশ্বাস নেওয়া বন্ধ করল।


...........................................................................................


ওরাসিও কিরোগা (৩১/১২/১৮৭৮ ---১৯/০২/১৯৩৭)

উরুগুয়ের খ্যাতনামা নাট্যকার , কবি এবং ছোটোগল্পকারের জন্ম উরুগুয়ের সালতোয়। অরণ্য ছিল তাঁর প্রথম প্রেম। আরণ্যক পটভূমিতে লেখা তাঁর লেখা ছোটোগল্পগুলিতে অতিপ্রাকৃত শক্তি, মানুষ ও পশুর বেঁচে-থাকার লড়াই এবং অসামান্য প্রকৃতি মিলেমিশে অপরূপ অনন্য ভুবন সৃজন করে। এডগার অ্যালান পো-র সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে তাঁর সৃষ্টিতে । পরবর্তীতে লাতিন আমেরিকার জাদু-বাস্তবতার অন্যতম পথিকৃৎ গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের রচনায় ও হুলিও কোর্তাসারের উত্তর-আধুনিক পরাবাস্তবতায় কিরোগার প্রভাব আমরা দেখতে পাই। কিরোগার কয়েকটি বিখ্যাত ছোটোগল্পের বই El Crimen del otro( অন্য কারো অপরাধ ); Cuentos de amor locura y de muerte (প্রেম,উন্মত্ততা ও মৃত্যুর গল্প); El desierto (মরুভূমি);El sillon del dolor (যন্ত্রণার চেয়ার) ইত্যাদি।

নাগরিক জীবনের পরিবর্তে তিনি বেছে নিয়েছিলেন রহস্য- রোমাঞ্চপূর্ণ আরণ্যক জীবন। সপরিবারে সেখানেই বাস করতেন তিনি। নিসর্গ , মৃত্যু, মানুষের জীবনের সংগ্রাম –এসবই তাঁর ছোটোগল্পের বিষয়। অনূদিত গল্প ‘A la deriva’ (ভেসে যাওয়া) তাঁর বিখ্যাত

ছোটোগল্পের বই Cuentos de amor locura y de muerte –এর অন্তর্গত। মৃত্যু এবং মৃত্যুকালীন আচ্ছন্নতার এক মহাকব্যিক অনুপম আখ্যান অতি স্বল্প পরিসরে তিনি তুলে ধরেছেন এই গল্পে ।



অর্পিতা মুখোপাধ্যায় (১৯৬৪) বর্তমানে গার্ডেন হাই স্কুলে বাংলার বিভাগীয় প্রধান। তার আগে শিক্ষকতা করেছেন সাউথ পয়েন্ট স্কুলে। বিশ্ব-সাহিত্য,লেখালিখি বিশেষত অনুবাদ তাঁর প্রিয় বিষয়। আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজ থেকে ফরাসিতে দিপ্লোম সুপিরিওর করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে স্প্যানিশ চর্চার সঙ্গেও যুক্ত। তাঁর অনূদিত বই বোর্খেসের আউতোবিয়োগ্রাফিয়া, লোরকার ‘রক্তের বিবাহ’ (Bodas de sangre),স্পেনের কবি ভিয়োলেতা মেদিনার ‘ভাঙা আয়না’ [ স্প্যানিশ থেকে বাংলা] , মার্গেরিত দ্যুরাসের ‘হিরশিমা মনামুর’ [ফরাসি থেকে বাংলা]। এছাড়াও বিভিন্ন প্রবন্ধ , কবিতা ও গল্পের অনুবাদ সঙ্কলিত হয়েছে নানান বই ও পত্রপত্রিকায় । ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে অনুবাদগ্রন্থের সমালোচনা ।এছাড়াও পাবলো নেরুদা, ওক্তাভিও পাস, হুয়ান রামোন হিমেনেস এবং লোরকাকে নিয়ে প্রকাশিত সংকলন গ্রন্থগুলিতে লিখেছেন প্রবন্ধ, অনুবাদ করেছেন অসংখ্য কবিতা ও প্রবন্ধ। স্প্যানিশ ভাষা ও সাহিত্য- চর্চায় নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠান লোস ইস্পানোফিলোস –এর সদস্য ।








0

গল্প - সোমা দত্ত

Posted in






ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং...মা সূর্যমন্ত্র জপ করছেন বারান্দায় পূর্বদিক লক্ষ করে। এই যে শুরু হল মোটামুটি দেড় দুঘণ্টা স্বর্গ, মর্ত্যের সব দেব দেবীকে মা জাগ্রত করেই ছাড়বেন। ছোটবেলা থেকেই মা ভীষণরকমের পূজাআচার প্রিয় মানুষ। এখন তো আরও বেড়েছে। তবে বহুদিন পরে দেশে ফিরে মায়ের এই মন্ত্রপাঠ শুনতে বেশ লাগছে সোমালির। পুরানো সব অভ্যেসই এখন প্রিয় মনে হয়। আসলে প্রায় ছ’বছর পর দেশে ফেরার আনন্দটা একটু একটু করে চেখে দেখার মতো উপভোগ করছিল সে। চাইছিল না এক আধ দিনের মধ্যে এটা ফুরিয়ে যাক। হোম সিকনেস ওর বেশ ভালো লাগে। ঘরের মেঝেতে পড়ে থেকে দুপুর রাত কাটিয়ে দিতে অদ্ভুত একটা অলস ভালোলাগা আচ্ছন্ন করে তোলে। এতগুলো দিন বোস্টনের বাদামী মাটিতে কীভাবে যে সে টিকে ছিল কে জানে! জীবনটা যেন বহু ব্যবহৃত বাইনারি নম্বরে আটকে রেখেছিল একরকম জোর করেই। প্রজেক্ট শেষ হওয়ার অপেক্ষামাত্র। দেশে ফিরে করার মতো বহু কাজ আছে। একটা অভিজ্ঞতার দরকার ছিল এই যা। ছ’বছর পর সেই পুরোন বাড়ি, রং চটা দেওয়াল, দোতলার পড়ার ঘরের টেবিলে সকালের রোদের গন্ধ, মায়ের মরিচ ফোঁড়ন দেওয়ার গন্ধ, মন্ত্রপাঠ, গীতাপাঠের আসর জমানো, বাবার খালি গলায় শ্যামাসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদ গাওয়া, উচ্চকণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করা, ঘরের দেওয়াল জোড়া দশ বছর আগের পোস্টারগুলোয় বব ডিলান, চ্যাপলিন, ধোনি সবাই জড়িয়ে ধরেছে সোমালিকে। এমনকি সকালের লুচি তরকারির হিং, ছাদের রোদে মজা আমের আচার, দুপুরে ধনেপাতা দিয়ে পাতলা মাছের ঝোল, পাড়ার বুধোদার চায়ের দোকানে জমায়েত আড্ডায় ভাঁড়ের চা সবকিছু আষ্টেপৃষ্ঠে সোমালিকে এবার চেপে ধরে প্রতিনিয়ত বলে চলেছে, যেতে নাহি দিব।

বাবার কাছে এখনো বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী পড়তে আসে। রিটায়ার করার পর বাবা বলেছিলেন যে আর টিউশন করবেন না, মাকে দেবতার আসন থেকে নড়ানো সম্ভব নয় তাই তিনি একাই ঘুরে বেড়াবেন, বইপত্র পড়বেন ইত্যাদি। কিন্তু পড়ানো থেকে পুরোপুরি বেরতে পারেননি ছাত্র ছাত্রীদের চাপে। সোমালির মনে হয় বাবা এতেই খুশি আছেন। পুরোপুরি পড়ানো ছেড়ে দিলে বাবা হয়তো এতটা ভালো থাকতেন না। মায়ের সঙ্গে বাবার জীবনশৈলীর পার্থক্য চিরকালই ছিল। ফলে বাবার শিল্পজীবনে মায়ের ভূমিকা অনুষঙ্গের হয়ে ওঠেনি কখনো, তাঁর ছিল শুধুমাত্র যোগানের ভূমিকা। তবুও তাঁদের সংসারজীবনে কোন ছেদ পড়েনি কখনো। দিব্যি দুমুখো গতিধারার জীবনে দুজনেই নিজের নিজের পরিসরে পরিতৃপ্ত। তবে বাবার উৎপটাং স্বভাবের জন্য মাকে ভুগতে হত বরাবর। বেশি বাড়াবাড়ি দেখলে গজগজ করতে করতে মা, ঠাকুরঘরে ঢুকে খিল লাগাতেন। তখন বাবা কদিন আবার নিয়মে বাধ্য ছেলের মতো। কিন্তু এবার ফিরে এসে থেকে সোমালি মাকে আগের মতো পেল না। যেন খুব গম্ভীর। বেশিরভাগ সময় চুপচাপ নয়তো বিরক্ত। সোমালির ওদেশে থাকাকালীন ভিডিও কলে যখন কথা হতো তখন মায়ের এই পরিবর্তনটা বড় বেশি বোঝা যেত না। তবে শেষের দিকে মা বারবার বলতেন তুই ফিরলে বাঁচি। আমি একা একা আর পারছি না লড়তে। সোমালি বলত কেন বাবা রয়েছে তো। যখন ছিলাম তখন তো দুজনে মিলে গলা ধরে আমাকে শাসন করতে, দুজনে এককাট্টা হয়ে আমাকে বোস্টন পাঠিয়ে ছেড়েছ। এখন আয় আয় করছ যে বড়! মা কিছু উত্তর করতেন না, হাসতেন আর বলতেন সে তো তোর ভালোর জন্যই বলেছি। এখন আমার ভালোর জন্য তোর অপেক্ষা করছি।

মায়ের সাথে বাবার খুব বেশি ঝগড়া ঝামেলা হতে কখনো দেখেনি সোমালি। কিন্তু এবার বাড়িতে ফিরে এসে পর্যন্ত দেখছে দুজনে কেমন যেন ছাড়া ছাড়া। কিরকম একটা ঠান্ডা পাহাড় যেন বেড়ে উঠেছে দুজনার মধ্যে। বিশেষ করে মা যেন ভীষণভাবে খাপছাড়া বোধ নিয়ে দিনগত পাপক্ষয় করছেন আজীবনের সংসারে। মাকে কয়েকবার প্রশ্ন করেও বিশেষ কিছু জানা গেল না। উত্তর দিলেন না, প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অন্য কথায় নিয়ে গেলেন। শুধু একদিন রাতে শোওয়ার আগে চুল বেঁধে দিতে দিতে বললেন ক’দিন থাক না, নিজেই টের পাবি তোর বাবার কীর্তি।

মা চিরকাল এভাবেই কথা বলেন। বাবা হয়তো বাজার করতে বেরিয়ে বেলা বারোটার সময় একরাশ কুচো চিংড়ি এনে হাজির করল, মা রেগে কাঁই হয়ে যেতেন। বলতেন, দেখ তোর বাবার কাণ্ড। বেলা বারোটার সময় রসিকতা বয়ে এনেছেন ব্যাগ ভরে। এবার যাও বাপে মেয়েতে নিজে কুটে, রান্না করে খাও। শেষের লাইনে একটা তীব্র টান দিয়ে ঝামটা মেরে চলে যেতেন। কিন্তু পরে আবার যথারীতি ওই চিংড়ি দিয়ে এঁচোড় রান্না করে পাত পেরে খেতেও দিতেন। কিন্তু এবার মায়ের মেজাজে সেই ঝামটা ছিল না বরং কেমন একটা হতাশা যেন। চেহারাও খুব শীর্ণ হয়েছে মায়ের, মুখে চোখে ক্লান্তি।

আর কয়েকদিন পরে সোমালি নিজেই টের পেল মায়ের হতাশার উৎসমুখ। কিন্তু শুরুতে ঠিক ঠাহর পেল না। বাবার সাথে যেন যায় না বিষয়টা কোনভাবেই। বাবার এক ছাত্রী, ঋষিতা, এম এ দ্বিতীয়বর্ষ তাকে নিয়েই যাবতীয় জল ঘোলা। বাকিদের সাথেই সে আসে। কিন্তু বাকিরা চলে যাওয়ার পরেও সে রয়ে যায় এবং বাবা ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন। সপ্তাহে তিন চারদিন আসে মেয়েটি একইভাবে। মা সেসময় পুজোর ঘরে সেঁধিয়ে যান। আগে এই পুজো আচার ইত্যাদির জন্য বরাদ্দ ছিল দু-তিন ঘণ্টা। এখন সেটা আরও বেড়েছে মায়ের। কেউ কিছু না বললেও সোমালি বুঝে যায় মা নিস্তব্ধ ইঙ্গিতে কোনদিকে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তবুও খুব কিছু বড় একটা হতাশাব্যঞ্জক ঘটনা বলে এটাকে মনে হয় না সোমালির। হয়তো কোন কারণ থাকবে। মেয়েটি খুব ভালো গান গায়। মাঝে মধ্যে ওর গান শোনা যায় ঘর থেকে। হয়ত এই গান বাজনার যোগাযোগই ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে এক ব্যক্তিগত মেধার সেতু গড়ে তুলেছে। একদিন বাবা নিজেই ডেকে আলাপ করিয়ে দিলেন মেয়েটির সঙ্গে। ঝকঝকে উজ্জ্বল চেহারার ঋষিতা। খুব ধীর, শান্ত, স্বল্পবাক। কী অপূর্ব গানের গলা। সোমালি মুগ্ধ না হয়ে পারে না। কিছুক্ষণ সাধারণ কিছু কথাবার্তা হল মেয়েটির সঙ্গে। কোথায় থাকো, কী কর ইত্যাদি। মেয়েটির মা বাবা কেউ নেই। একটি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে তবে এখন একটি লেডিস হোস্টেলে থাকে। মায়া হয় সোমালির। অনাথ আশ্রমে ছোটবেলা কাটানোর পর কেউ এত সুন্দর থাকে! সেদিন মেয়েটি খুব সুন্দর একটি জামদানি শাড়ি পরে এসেছিল। সোমালি বলল তোমার শাড়ির রং খুব সুন্দর, তোমাকে ভারি মানিয়েছে। মেয়েটি সামান্য হাসল। বাবা বলে উঠল দেখলে তুমি কিন্তু এই শাড়িটা নিতে চাইছিলে না, আমি জোর করলাম তাই নিলে। মেয়েটি ঈষৎ অপ্রস্তুত হয়ে বাবার দিকে তাকাল। যেন বলতে চাইল এসব কথা এখন কেন! বাবাও সেই কথা পড়ে ফেলল। বাবা খুব সাবলীলভাবে বলে উঠল আরে শাড়ি জামাকাপড় কেনার ব্যাপারে আমি আর সমু সবসময় একমতের। ওর মা কোনদিন আমাদের সাথে কেনাকাটায় যোগ দিত না। কেনাকাটা মানেই আমার আর সমুর জয়েন্ট ভেঞ্চার। সোমালি টের পেল সম্পর্কের যে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা বাবা অস্বীকার করতে চাইছেন না, ঋষিতা কিন্তু তাতে স্বচ্ছন্দ হতে পারছে না সোমালির উপস্থিতিতে। শুধু এটুকু বাদে অন্য আর কিছুই সোমালির তেমন খারাপ লাগল না। এমনকি বাবার ঋষিতার সাথে কেনাকাটা করতে যাওয়ার বিষয়টিও না।

এরপর মা নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলেন না সোমালির কাছে। অঝোরে ভেঙে পড়লেন কান্নায়। তোর বাবা বুড়ো বয়সের একী ভীমরতি! ইউনিভার্সিটির সব ছেলেপিলে সকলে জানে সবকিছু। সবাই হাসে। কোনো লজ্জাও নেই লোকটার। মেয়েটাকে নিয়ে সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। ঘরে এনে দরজা বন্ধ করে। ছি ছি ছি এত সম্মান নিয়ে সারাটা জীবন কলেজ পিটিয়ে শেষ বয়সে এসে এই নোংরামি। তুই এটা বন্ধ কর, কিছু একটা করে এসব বন্ধ কর মা। নাহলে আমি আর বাঁচব না। মাকে শান্ত করার চেষ্টা করে সোমালি, পারে না।

দেশে থাকা গেলেও বাড়ির ভাত আর বেশিদিন বরাদ্দ ছিল না সোমালির। বেঙ্গালুরুতে একটা ভাল কাজের সুযোগ পাওয়া গেছে। এখানেই কিছু ভালো বন্দোবস্ত হয়ে গেলে অন্তত দেশ ছেড়ে যেতে হবে না তাকে। সুতরাং কাজটা নিয়ে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু যাওয়ার আগে মা বাবার সমস্যাটার একটা সমাধান করে যেতে পারলে ভাল হত। বাবার সাথে ইতিমধ্যে অনেক আড্ডা হয়েছে। দু-এক সময় ঋষিতাও যোগ দিয়েছে তবে সেই আড্ডাগুলো বাড়ির বাইরে। ঘরে মা যদি দেখে সোমালিও এদের সাথে ভিড়েছে তবে সমস্যা আরও বেড়ে যাবে। ঋষিতাও এখন বেশ সহজ হয়ে উঠেছে তার সঙ্গে। সবথেকে বড় কথা বাবা ভীষণ উচ্ছ্বল থাকে ওর উপস্থিতিতে। একদিন রাতে ছাদে গল্প করতে করতে সোমালি সরাসরি প্রশ্ন করে বাবাকে ঋষিতার সাথে ওর সম্পর্কের বিষয়ে। বাবার কিন্তু কোন জড়তা নেই। স্পষ্ট করে বললেন, আমি ওকে বড় ভালবাসি রে। তুই নিশ্চই বুঝেছিস সেটা। আমারও স্বীকার করতে কোন লজ্জা নেই। দেখেছিস তো তুই ওকে। অমন মেয়েকে ভাল না বেসে থাকা যায় তুই বল! বাবার চোখে চোখ রাখে সোমালি। আর ও? ও বাসে তোমাকে? বাবা একটু হেসে বলে, মনে তো হয় বাসে, কিন্তু যদি নাও বাসত তাতে কী যায় আসে? আমি তো বাসি রে। বাবা, সামান্য গলা তুলল সোমালি। তুমি বলতে চাও একটা এম এ সেকেন্ড ইয়ারের মেয়ে একজন রিটায়ার্ড প্রফেসরকে ভালোবাসে! এই সম্পর্ক কোথায় নিয়ে যাবে ওকে? এটা হতে পারে? বাবা একটু এগিয়ে এসে সোমালির মাথায় হাত রাখেন, সোমালি হাতটা দ্রুত সরিয়ে দেয়। কথা ঘুরিও না বাবা। স্পষ্ট করে বল। তুমি জান তোমার এসব অদ্ভুত ধরনের খেয়াল মাকে কী অসম্ভব কষ্ট দেয়! তুমি সবসময় নিজের কথাটাই শুধু কেন ভাব বাবা! একইরকম শান্ত সুরে বাবা বলে, আমার ভগবান নেই বলে। তোর মায়ের তো ভগবান আছেন রে! বলে নির্বিকার হাসতে থাকে। ঠিক বিশ্বাস হয় না। বাবাকে আজীবন রোমান্টিক দেখেছে সোমালি কিন্তু প্রেম করতে দেখেনি। গলা ছেড়ে গান করেছেন, কবিতা পড়েছেন এখানে ওখানে ঘুরতে চলে গেছেন হঠাৎ দুমদাম কাউকে কিছু না বলে। আরও অনেক উদ্ভট জ্বালাতনে কাণ্ড করেছেন বাবা যা সোমালির মজা লেগেছে আর মা গজগজ করতে করতে ঠাকুর ঘরে ঢুকে পড়েছেন।

সোমালি আবার বলে, —কেন বাবা কেন? কী দরকার ছিল এসবের? বেশ তো ছিলে। এক কাজ কর, তোমরা দুজনেই আমার সাথে বেঙ্গালুরুতে শিফট করো। করবে তো? বাবা মাথা নেড়ে হ্যাঁ করেন। সোমালি আবার অবাক হয়। এত সহজে রাজি হয়ে গেল বাবা? তাহলে? সে আবার বলে আমি কিন্তু ইয়ার্কি করছি না। সত্যি সত্যি বলছি। বাবা বলে, আমিও তো ইয়ার্কি করছি না তোর সাথে। তুই চাইলে আমি যাব বেঙ্গালুরু তোর মাকে নিয়ে। কিন্তু তাতে তোর মায়ের সমস্যার সমাধান হবে? ঋষিতা তো যেখানেই যাই সেখানেই পৌঁছে যেতে পারবে যখন মনে হবে। ওরে একটা অনাথ মেয়ে, অত সুন্দর গান গায়, অত সুন্দর লেখে তাকে নিয়ে তোদের এত আপত্তি কেন? ও ভাল আছে, আমিও খুব ভাল আছি ওর সঙ্গে। কোনদিন যদি এমন কাউকে খুঁজে পাই যে ওকে আমার মতো ভালবাসতে পারবে তবে ওকে ওর মাধবের হাতে তুলে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হব। ততদিন ওকে তো আগলে রাখতে হবেই রে মা। —আর যদি তেমন কাউকে খুঁজে না পাওয়া যায়? বাবা আকাশের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন ঠিক পাব। দেখিস। —আর মা যে শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে যাচ্ছে তার কী হবে? ও তোর মায়ের অভ্যেস আছে আমার উৎপাত সহ্য করে চলার। কতবার ও এমন শুকাল আবার ঠিক হল। -আচ্ছা একটা কথা বল ঋষিতা আসলে দরজা বন্ধ কর কেন? হো হো করে হেসে ওঠে বাবা। তারপর থামেন, —বেশ করি। দরজা বন্ধ না করলে তোর মা মাঝে মধ্যে এসে এসে উঁকি মারে! ওভাবে গান শোনা যায় না কোন আলোচনা হয়? —এটা মাকে বলেছ কখনো? —তুই বলতে পারবি? পেরেছিলিস? যখন অভিক পড়াতে আসত তোকে ক্লাস ইলেভেনে আর তোর মা দরজার গোড়ায় গিয়ে মোড়া পেতে বসে থাকত?

সোমালির আর কিছু বলার থাকে না। শুধু বাবাকে জানায় মাকে নিয়ে যাবে ওর সঙ্গে। অন্তত কিছুদিন। একটা বদল দরকার মায়ের। মাকেও জানায় সোমালি। ঋষিতার বিষয় নিয়ে মাকে বোঝানো যাবে না। বাবার দর্শন মায়ের সংস্কারকে স্যাটিসফাই করতে পারবে না কোনদিন। সুতরাং বলে লাভ নেই। বরং সে মাকে বোঝায় বাবাকে কিছুদিন একা ছেড়ে দাও। বুঝুক একটু কত ধানে কত চাল। অন্তত তোমার অবস্থানটা তো বুঝতে দাও। সেইমতোই প্যাকিং হল জিনিসপত্র। মায়ের তো শুধু দেবী দেবতার জন্যই একটা পুরো ব্যাগ। সে ব্যাগ আবার মাটিতে রাখা যাবে নাকো। এছাড়া ওষুধের প্যাঁটরা এই ওই হাজার ফিরিস্তি। সবই গোছান হল বেশ কিছুদিন ধরে। শুধু যাবার আগের দিন মহিলা বিগড়ে বসল। তিনি যাবেন না। রাধামাধব নাকি স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছেন এ বাড়ি ছেড়ে না বেরোতে। বেরলে নাকি সংসারে ভাঙন অনিবার্য!

—বোঝ!
0

কবিতা - কুমকুম বৈদ্য

Posted in




















টুকরো টুকরো কথার মায়াজালে
লুকিয়ে ফেলি গুছিয়ে রাখার ছলে
সেসব আড়াল সরিয়ে দেবার মতো
ইচ্ছের গাছ বাড়ুক নোনতা জলে
ছায়াবাজির এই যে লাইফ বোট
একটুখানি জায়গা পাওয়ার লোভ
ডুব সাঁতারে হাতড়ে বেড়াই ডাঙ্গা
ছড়িয়ে ফেলি ছিটিয়ে দেওয়া জীবন
মিউট করা সেলেব্রেশন মোডে
0

কবিতা - শর্বরী চৌধুরী

Posted in






ফিরে ফিরে আসি এই ঘরে
যে ঘরে সংসার নেই, নেই সন্তানের পদধ্বনি, আছে শুধু কিছু বুগেনভেলিয়া !
নিভৃত রাত্রে তাদের চুম্বন করি
হাসিতে ভরে ওঠে ঘর।
গোপনে অশ্রুও মোছে হয়তো !
যেতে যেতে তাকাই সেদিকে
ফুটে ওঠে নিষ্পাপ অবয়ব তোমার।
0

কবিতা - অঞ্জন বল

Posted in






এই জগৎ নিমিলিতো কারণ এখন প্রলয় ,
অহোরাত্রি অবসানে অব্যয় পুরুষ
স্বপ্নদশা থেকে জাগ্রত হলে
জঙ্গমবীজে প্রাণসঞ্চার হয় ,
ব্রহ্মা থেকে স্থাবর পর্যন্ত একটি
অকুল পর্যটন শেষে পড়ে থাকে
বামাচারী পরিত্যক্ত কলস ।

সৃজনে নৃতাত্ত্বিক ব্যাকরণ
আর চারণের সংহিতা
ছুতমার্গের বিমূর্ত জ্ঞানবৃক্ষ ধরে বসে আছো
দেউড়ি খুলে রেখে বর্মে ঘেরা জনপদ
হে প্রাচীন নগরী --
কল্পের হাত ধরে দ্যুলোক কত কাল ?

পাপঙ্খলন হোক এবার শূদ্রের হাতে ,
স্মৃতি সংহিতা দাসত্বে বিধির বিধান
একটি আধারে জীবজ যা কিছু জন্ম গাঁথা
জননী জানে কূল কাঁথা নেই ,
বংশজ লতিকাহীন অন্ত্যজ আকাশে
আঁধার বুনেছে এতদিন অব-কাশ চাঁদ ।
0

ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

Posted in






ওটের প্যানকেক

তিনকাপ রোলড ওটস, খুব ভালো করে ধুয়ে জল ঝরিয়ে, এক কাপ উষ্ণ গরম দুধ দিয়ে প্রায় ঘণ্টাকানেক ভিজিয়ে রেখে বেটে নিতে হবে। এরপর, তিনটে ডিম, দারচিনির গুঁড়ো, সামান্য নুন আর চিনি ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। যত ফ্যাটানো হবে ততই ভালো হবে প্যানকেক। ফ্রাইং প্যান গরম করে সামান্য তেল বুলিয়ে নিয়ে প্যানকেকগুলো ভেজে নিতে হবে। মেপল সিরাপ অথবা মধু এবং যেকোনো একরকম ফল যেমন কলা, ব্লু বেরি, রাস্প বেরি, স্ট্রবেরি কিম্বা স্ক্রাম্বলড এগ দিয়ে পরিবেশন।

আমি বেকিং সোডা বা ময়দা কোনোটাই মেশাইনি। ১৮ থেকে ২০টা মতো প্যানকেক হবে এই পরিমানে।


0

সম্পাদকীয়

Posted in



বাড়ি ফেরার কথা ছিল অনেকগুলি মানুষের। হয়ে উঠলো না। চিরপ্রতীক্ষায় থেকে গেলেন তাঁদের আত্মীয়-পরিজন। কেউ গিয়েছিলেন পেশাগত কারণে, কেউবা নিছক বেড়াতে কিন্তু তাঁরা সবাই ঘরমুখো হয়েছিলেন যে ট্রেনটি চেপে, যাত্রা শুরু করার অল্পক্ষণের মধ্যেই সেটি দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়। অনেকেরই ফেরা হলো না আর।

এখনও পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট কেউই এই ভয়ংকর বিপর্যয়ের দায় স্বীকার করেননি। হাস্যকরভাবে মামলা রুজু হয়েছে যে মালগাড়িটি কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে ধাক্কা মারে, তার চালকের বিরুদ্ধে, যিনি সেদিনই প্রাণ হারান। আরও ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত তুলে ধরে এই অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে এমন একজনের অভিযোগের ভিত্তিতে, যিনি এই মুহূর্তে চিকিৎসাধীন এবং যিনি পাল্টা অভিযোগ করেছেন যে তাঁকে দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। 

এ তো কল্পনাতীত! বিশ্বের এক অন্যতম বৃহৎ রেল পরিষেবার মান ঠিক কীরকম হওয়া উচিত, সে নিয়ে ভারতবাসী হিসাবে আমাদের কোনও স্পষ্ট ধারণা আছে কি? আছে কি নির্দিষ্ট কোনও প্রত্যাশা? আমরা বরং চোখ - ধাঁধানো কিছু 'বন্দে ঘোষণা'য় যারপরনাই প্রীত। 

রাজনৈতিক প্রভুদের সাফল্য ঠিক এইখানে। যে ন্যারেটিভটি তাঁরা আমাদের গলাধঃকরণ করতে বাধ্য করেছেন, আমাদের চাহিদার সীমারেখাটি ঠিক তার সঙ্গে মানানসই। কিন্তু অতর্কিতে, বলা যায়, বিনা মেঘে বজ্রাঘাত হলো যাঁদের জীবনে, আলো নিভে গেলো বরাবরের মতো, তাঁদের পরিজনদের কী হবে? আরও কতটা পথ চললে আমরা আমাদের মানুষ বলে ভাবতে পারবো? উত্তরগর্ভ এই প্রশ্নগুলি আপাতত রইলো কিছু লাশচাপা।

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।