Next
Previous
0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(১৬)

শৈলবালা এবারে ভীষণ ভয়ার্ত চোখে গোলকপতির দিকে তাকিয়ে আবার পরক্ষণে নিজের চোখদুটো তখুনি বুজে ফেলল।

যদিও এখন ওর মাথা ঘোরাটা একটু কমেছে তাও যেন ভয়ে খুব বুক ঢিপঢিপ করছে। একটু পরেই তো ওর খোঁজ পড়বে, আর সবাই এই জায়গাটা তোলপাড় করে তুলবে আর মারধোর করবে । তারপর সব শেষে ওকে বুড়োটার সাথে চিতায় উঠিয়ে ও পুড়িয়ে মেরে সতী মাহাত্ম্য প্রচার করার জন্য মুখিয়ে আছে।

মনে পড়ছে দশ কি এগারো বছর বয়সে ঋতুমতী হওয়ার পরেই তো তার বাপের বাড়িতে থাকার মেয়াদ ফোরালো। ওদের তেঁতুলতলা গ্রামে সেই ন'বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পরে নতুন সৎমার মুখে আপদবিদায়ের তাড়ায় নিশ্চিন্ত হয়ে ওঠা দরিদ্র পরিবারের সামান্য আয়োজনে হয়ে যাওয়া সেই বিয়ের ঝাপসা হয়ে আসা কিছু স্মৃতি এখনও তার মনে আছে।

তারপর শ্বশুরবাড়িতে এসেও স্বস্তি নেই। তার বদলে দীর্ঘ কিছু বছর ধরে বৃদ্ধ পতিটির সাথে এবং তার অগণিত সপত্নীদের বিনা মূল্যের দাসীবৃত্তি করাটাই যেন একটা চিরাচরিত নিয়মের মধ্যেই পড়ে গেছিল।এরমধ্যে দু'একজন মাতব্বর দেওরগোছের ছোকরারা যে একটু আধটু ব্যাভিচারের ইঙ্গিতটিও কখনো দেয়নি সেটাও যেন মুখ ফুটে নিজের বাপের বয়সী সোয়ামীটিকে মুখ ফুটে বলা বারণহয়ে রইল।

সধবার সিঁদূরে সিঁথি রাঙিয়ে থাকার বদলে এতদিন ধরে তাকে সহ্য করতে হয়েছে প্রতিপদে সে পেয়েছে ক্রমাগত সতীনকাঁটায় বিদ্ধ হওয়াটাই।

সোয়ামীর সোহাগ তো এ জন্মে জোটেনি।

আর পেটের মধ্যেও নড়েচড়ে ওঠেনি কোনও সন্তানের অস্তিত্ব। অথচ আজ তাকেই সব কিছুর পরিণামে চিতাগ্নিতে উঠতে হবে? সহমরণের এই অদ্ভূত পরিণতিটি দেখতে পাওয়ার বদলে ওর মরা মা আঁতুড়েই যদি ওকে বিষ এনে খাওয়াতে পারত তাহলে সৎমা'র কাছে বা শ্বশুরবাড়িতে এসেও বোধহয় এতটা বাড়াবাড়ি হতনা।

আজ শেষবারের মত নিজেকে যেন মরীয়া হয়ে উঠতে দেখতে একবার ইচ্ছা করছে। তবে পালিয়ে বেঁচে যাওয়া একজন অসতী 'মেয়েছেলে'র ব্যাভিচার না সতী হয়ে আগুনে জ্বলে মরতে বসা! এদুটোর মধ্যে কোনটা যে বেশী শ্রেয় সেটা ভাবতে গেলেই নিজের মাথার ভেতরটা কেবল গুলিয়ে যাচ্ছে। দুটো ঘোলাটে চোখ শেষমেশ আবার তার স্বাভাবিক বাঙ্ময় অবস্থাটি থেকে অনেকদূরে নিজের ঠিকানাটা আবার হারিয়ে ফেলবার আগে সে টের পাচ্ছিল একটি পেশীবহুল ও কবোষ্ণ বাহুবন্ধন তাকে ঘিরে রেখেছে পরম মমতায়। তখন তার কানে থেকে থেকেও আসছিল দুটি দূরাগত মহাজাগতিক শব্দের উচ্চারিত পুনরাবৃত্তি , "... চলো পালাই " !

........

আজকের সকালবেলা বেড়াতে এসে রামমোহন দেখছিলেন যে নিমতলা ঘাট সংলগ্ন এলাকাটি যেন একটা কিসের ভয়ে বেশ থমথমে হয়ে আছে। যদিও দাহকার্য্য যেমন চলার তা চলছে তবুও যেন আড়ালে সবাই তাঁর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে। যদিও মজবুত দেহী রামমোহনকে দেখে সচরাচর লোকে মান্যজ্ঞান করে থাকে, তাও আজ যেন সবাই কিসের যে একটা চাঞ্চল্যে বা ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে সেটা ঠিক বোধগম্য হলনা।

একটি খোঁড়া ভিখারী ছেলে অনেকক্ষণ তাঁর পিছনে 'ভাত খাব! ভাত খাব' বলে ঘুরছিল। ছেলেটিকে দেখে বেশ চালাকচতুর মনে হতে তিনি ওকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলেন। তারপর ছেলেটির হাতে ধরা মালসাটির বদলে তিনি ওকে কিছু বাড়তি পয়সা আর একবান্ডিল ' সংবাদ- কৌমুদী' ধরিয়ে তাকে সেগুলি ঘাটে আসা লোকেদের কাছে বিক্রয় করে আগামীকাল খাদ্যসন্ধান করতে বললেন।

অমৃতস্য পুত্রাঃ হয়ে মানুষ তার ক্ষমতার প্রতি সন্দিহান হয়ে কেবল ভিক্ষাজীবি ও পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকবে সেটা রামমোহন কখনোই যেন ঠিক মন থেকে মেনে নিতে পারেন না।

ওকে বললেন যে তিনদিন পর তিনি আবার যখন এদিকে আসবেন তখন আরও একবান্ডিল কাগজ আবার তাকে দিয়ে যাবেন।

এবারে যেন নিজের মনেই হাসলেন রামমোহন। এই কদিন আগেও এসব তাঁর সতীদাহ বিরোধী অনেক জ্বালাময়ী প্রবন্ধস্বরূপ অস্ত্রের অস্ত্রাগার ছিল, যা আজ আর কালাকালের গর্ভে হারিয়ে যেতে চাওয়া কয়েকটি নথির বেশী তাদের আর কোনও মূল্য তাঁর কাছে নেই। অগত্যা, কোচম্যানটিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে প্রফুল্লমনে তিনি মির্জাপুরের পথ ধরলেন।

.....

আজ দ্বিপ্রাহিক আহারের কিছু আগে দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্র এসে দর্পনারায়ণ ঠাকুরদের বাড়িতে আগামী পরশুদিন একজন গর্ভবতী নবোঢ়ার সাধভক্ষণের শুভ অনুষ্ঠানের জন্য সেখানে সপরিবারে রামমোহনকে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানাতে এসেছিল। এইসব পরিবারের সদস্য-সদস্যাদের সংখ্যা এতই বেশী যে এসব অনুষ্ঠান সারাবছর ধরেই লেগে থাকে।

বন্ধুবর দ্বারকানাথ এখন বৃহত্তর পিরালী-ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীর এখন একজন হর্তাকর্তা বিশেষ। এদের অন্য শাখার ঠাকুর নামাঙ্কিত পরিবারটিও পাথুরিয়াঘাটায় যথেষ্ট বর্ধিষ্ণু পরিবার হিসাবে পরিচিত।যদিও পাথুরিয়াঘাটা আর জোড়াসাঁকোর মধ্যে আক্ষরিক ভৌগলিক দূরত্ব খুব কম, তবুও ধনীক সমাজে সে-ই এখন সুপ্রতিষ্ঠিত এক নব্যধনী।

যদিও শহরে বসে বিলাস ব্যসনে ডুবে থাকার বদলে সে এখন কয়লা খনির ব্যবসার কাজে অনেকগুলি দেশীয় রাজন্যবর্গের সাথে ইংরেজ কোম্পানীর দৌত্যে নিয়মিত সহায়তা করে থাকে বলে তার এখন ব্যস্ততাটিও বেড়েছে।

তাই তার অন্যতম পুত্র দেবেন্দ্র এখন সবে কৈশোর অতিক্রমণ করছে বলে সে এখনই তার পিতার একজন যোগ্য সহকারী হিসাবে বেশ নন্দিত ।

যদিও বাল্যকাল থেকে সে রামমোহনেরও খুব প্রিয় পাত্র ছিল। এর কারণটি হল এই যে, সমবয়সের কারণে পুত্র রাধাপ্রসাদ আর দেবেন্দ্রের মধ্যে তিনি কখনই সেইভাবে ভেদাভেদ করতেন না।

রামমোহনের বাড়ির বাগানে খেলা করতে করতে সে তাঁর বিশালকায় উন্মুক্ত বক্ষদেশে কুন্ঠাবিহীন সহজতায় লাফিয়ে মজা পেত আর খিলখিল করে হেসে উঠত।

.......

যদিও আজ সে এখন ধীরে ধীরে পিতার যোগ্য প্রতিনিধি হয়ে উঠছে বলে সে এখন নানারকম সামাজিক কার্য্যেও তাকেও ঘনঘন দেখা যাচ্ছে।

দেবেন্দ্রকে আলিঙ্গন করে তিনি তাঁর জোব্বার ভিতর থেকে কয়েকটি আখরোট আর কিশমিশ বের করে দিতে দিতে বললেন সে যেন রাধাপ্রসাদের সাথে আজ এখানেই আহার করে যায় ও তাকে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে বলে।

পৌত্তলিকতার আতিশয্য তিনি এখন আর মেনে নিতে পারেননা বলে শালগ্রাম শিলার উপস্থিতিটিএ তাঁর পছন্দ নয় বলে এখন সেভাবে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়াটা এড়িয়ে চলেন।

তবে দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাড়িটিতে যেহেতু ওসবের বালাই থাকেনা বলে মাঝেমাঝে সেখানে গেলে নিজেও বেশ খুশী হন। দ্বারকানাথ যদিও প্রকাশ্যে হিন্দুয়ানী বর্জন করেনি তাও ওর মধ্যে গোঁড়ামি অনেক কম।

সতীদাহ বিরোধী অনেক জমিদারের স্বাক্ষর সে নিজে দায়িত্ব নিয়ে সংগ্রহ না করলে বেন্টিঙ্ক সাহেবের কাছে তিনি বড়ই অপ্রস্তুত হতেন।

রামমোহন এখন একটা অন্য বিষয়ে চিন্তিত।

এ দেশে মেয়েদের পুড়ে মরাটা এখন আইন করে আটকানো গেলেও এদের বেশীরভাগই অশিক্ষাজনিত কারণে দূর্বল।

এর ফলে এদের অনেকেই আত্মীয়স্বজনের কাছে ভ্রষ্টা হয়ে শেষমেশ বনিতাপল্লীতে গিয়ে উঠছে। তাই এসব দেখলে মাঝে মাঝে নিজের মনে হয় যে সতীদাহ হয়ে পুড়ে মরাটা যতটা মর্মান্তিক বিষয় এটাও তার চেয়ে কিছু কম নয়। স্বামীহীনা মেয়েদের নিরাপত্তা দেওয়ার উপায়টা বের করাই এখন বেশী দরকার।

তবে রামমোহন কি আর পারবেন, তাঁর জীবদ্দশায় আর একটি অসম ও মানবিক লড়াইতে নতুন করে নামতে?

........

কপালে অজস্র ভাঁজ থাকা সত্ত্বেও দেবেন্দ্রর কাঁধে হাত রেখে তাকে পরম যত্নে সঙ্গে করে নিয়ে তিনি ভিতরবাড়ির দিকে গেলেন। দেবেন্দ্রর মুখশ্রীতে একটা মায়াময় ও জিজ্ঞাসু মনোভাব তিনি সর্বদা দেখতে পান।

সেবার সে একটি কঠোপষনিৎের একটি সংস্কৃত পুস্তিকা নিয়ে রামমোহনের কাছে এসেছিল।

এসব জানার ক্ষেত্রে তার স্বাভাবিক জ্ঞানপিপাসা আছে সেটা তাঁকে বরাবর মুগ্ধ করে। গৃহাভ্যন্তরে রামমোহন এখন গৃহস্বামী ও রাধাপ্রসাদের পিতা। তাই এসব জটিল ন্যায় নীতি ও বিষয়ভাবনা দূরে রেখে সামনে সাজানো রোহিৎ মৎস্যের একটি অতিকায় কষায়িত মুন্ড ও পলান্ন সহযোগে তিনি পুত্র রাধাপ্রসাদ ও পুত্রপ্রতীম দেবেন্দ্রের সাথে কৌচ টেনে নিয়ে একসাথে আহারে প্রবৃত্ত হলেন।
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in






তেরো


(লেখক বিজয়ের কিশোর জীবনের কথা।)

বিজয় এম এ, বি এড পাশ।বিজয় প্রাইভেট স্কুলে পড়ায় আর টিউশন পড়ায় কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের ।তাদের সে বলে তার আত্মকথা, নদীর ধার দিয়ে নিত্য আমার আনাগোনা । গ্রীষ্মে দেখি শুকনো বালির বৈশাখী কালো রূপে আলো ঘেরা অভয় বাণী ।বর্ষায় পরিপূর্ণ গর্ভবতী নারীরূপ । এই রূপে জলবতী নদীতে অতি বড় সাঁতারু ভুলে যায় কৌশল । আমি তখন নদীর বুকে দুধসাদা ফেনা হয়ে ভাসতে ভাসতে চলি বাক্যহারা হয়ে ।

একজন বলে ওঠে, স্যার,এবার শরতে কাশ ফুলের কারসাজি । তার মাথা দোলানো দেখে আমিও দুর্গা পুজোর ঢাকী হয়ে যাই । আমার অন্তর নাচতে থাকে তালে তালে । মা তুই আসবি কবে আর, নতুন জামায় নাচে মন সবার ।

বিজয় বলে, বাহ, ভালো বলেছিস। এবার শোন, নদী এরপরে হেমন্তের বুকে ছবি এঁকে এগিয়ে যায় শীত ঋতুর আহ্বানে । লোটা কম্বল বগলে আমি রাজস্থানী সাজি । কখনও ধূতি পাঞ্জাবি পরিহিত শাল জড়ানো খাঁটি বাঙালি । মাঝে মাঝে কোট প্যান্ট পরিহিত বিদেশী সাহেবের সুন্দর সাজ । আমি সারা পৃথিবীর সাজে সজ্জিত হতে চাই শীতের আদরে ।শীতল আড়মোড়া ভাঙতেই বসন্তের বাসন্তী রঙের তালে তালে আমি রঙের ফেরিওয়ালা হয়ে যাই । সকলের অন্তরের গোপন রঙ ছড়িয়ে দেয় প্রকৃতি । এই সময়ে আমার রাধাভাব ছড়িয়ে পড়ে স্বচ্ছ অজয়ের মদনমোহনের রূপে ।তখন আমার সমস্ত শরীর মন ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে মনোদেবতার মহান চরণে .।..

বিজয় বলে চলে গল্পের মত জীবনের কথা, দূর থেকে ভেসে আসছে ভাদুগানের সুর । ছুটে গিয়ে দেখলাম জ্যোৎস্না রঙের শাড়ি জড়ানো বালিকা ভাদু বসে আছে । আর একটি পুরুষ মেয়ের সাজে ঘুরে ঘুরে কোমর নাচিয়ে গান করছে , "ভাদু আমার ছোটো ছেলে কাপড়় পর়তে জানে না" ।অবাক হয়ে গিলে যায় এই নাচের দৃশ্য অসংখ্য অপু দুর্গার বিস্মিত চোখ । ঝাপানের সময় ঝাঁপি থেকে ফণা তোলা সাপ নাচিয়ে যায় চিরকালের চেনা সুরে ঝাপান দাদা ।ঝাপান দাদা ঝাপান এলেই গান ধরতো,"আলে আলে যায় রে কেলে , জলকে করে ঘোলা । কি ক্ষণে কালিনাগ বাসরেতে ঢোকে রে, লখিন্দরের বিধি হলো বাম " । আর একজন ছাত্র বলে,গ্রামের পুরোনো পুজোবাড়ি গাজনের সময় নতুন সাজে সজ্জিত হতো । বাবা শিবের ভক্তরা ভক্তি ভরে মাথায় করে নিয়ে গিয়ে দোল পুজো বাড়িতে নামাতেন । অসংখ্য লোকের নতুন জামা কাপড়ের গন্ধে মৌ মৌ করে উঠতো সারা বাড়ি । তারপর পুজো হওয়ার পরে দোল চলে যেতো উদ্ধারণপুরের গঙ্গা য় স্নানের উদ্দেশ্যে । কিন্তু আমার মন ফাঁকা হয়ে একা হয়ে পড়তো । এই তো কিছুক্ষণ আগেই ছিলো আনন্দ ঘ্রাণ । তবু দোল চলে গেলেই মন খারাপের দল পালা করে শুনিয়ে যেতো অন্যমনস্ক কবির ট্রাম চাপা পড়ার করুণ কাহিনী । ঠিক এই সময়ে কানে ভাসতো অভুক্ত জনের কান্নার সুর । আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি বারংবার, সকলের অনুভূতি কি আমার মতো হয় ?

একজন ছাত্রী বলে,স্যার রাতে শোয়ার পরে বোলান দলের নুপুরের ঝুম ঝুম শব্দ কানে বাজতো বেশ কিছুদিন ধরে । ফাল্গুনে হোলিকার কুশ পুত্তলিকায় আগুন ধরিয়ে কি নাচ । নাচতে নাচতেই সবাই সমস্বরে বলতাম, ধূ ধূ নেড়া পোড়া, হোলিকার দেহ পোড়া ।

বিজয় বললেন,ঠিক। অশুভ শক্তিকে পুড়িয়ে শুভ শক্তির উন্মেষ । পরের দিনে রং আর আবিরে ভরে যেত আকাশের নরম গা । বাতাসের অদৃশ্য গায়ে আবিরের আনাগোনা । সে এক অনির্বচনিয় আনন্দের প্রকাশে রাধা কৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের আকুতি ।আশ্বিনের আকাশে বাতাসে বেলুনের অনিল পাঠকের রঙের খেলা । শিল্পী একমাটি, দুমাটি করে শেষে চোখ আঁকতেন পর্দার আড়ালে । আগে থেকে চোখ দেখতে নেই । আর আমার চোখ দেখার জন্য চাতুর্যের সীমা থাকতো না ।বিজয় বলে,পাঠক মশাইয়ের ফাই ফরমাশ খেটে সবার অলক্ষ্যে চোখ দেখে নিতাম একবার । সেই চোখ আজও আমার মনে এঁকে যায় জলছবি । কি যেন বলেছিলো সেই চোখ । আশ্বিন এলেই আমি প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখে বেড়াই মায়ের চোখ দেখার বাসনায় । ছোটোবেলার দেখা চোখ কোথায় কোন গভীর জলে ডুব দিয়েছে কে জানে ।দরজা পুকুরের সবুজ সর সরিয়ে পানকৌড়ি ডুব দিয়ে খুঁজে চলে আজও আমার মায়ের চোখ ।হাঁসগুলিও আমাকে সান্ত্বনা জুগিয়ে চলে জলে ডুবে ডুবে । হয়তো আমার জন্য ই ওরা অভয় নাচ দেখিয়ে চলে মনদেবতার ঈশারায় । কাশের কুঁড়ি রসদ মজুদ করছে ফোটা ফুলের সৌরভ বিতরণের । এরপরেই শুরু আনন্দে মাথা দোলানোর উৎসব । মননদীর গভীরে প্রোথিত তার আগমনী সংগীত । হাত নেড়ে বলছে, আসছে আসছে । দেবী কাশ রঙের সংকেতে তাঁর আগমনী বার্তা পাঠান যুগ যুগ ধরে ।

বিজয় বলে,আমাদের শোভন কাকা কাশ ফুল দেখলেই কারণে অকারণে গলা ছেড়ে গান গাইতেন । সেই মধুর সুরেই শোভন কাকা কাশ ফুলের শোভা বাড়িয়ে সকলের মনের সংকীর্ণ বেড়া ভেঙ্গে দিতেন ।আমরা সকলেই প্রিয়জন মরে গেলে দুঃখ পাই । কিন্তু নিজের মরণ বুঝতে পারলেও দুঃখ প্রকাশের সুযোগ পাই কি ? সেই শোভন কাকা গানে গানে কিন্তু নিজের মরণের আগেই পরিণতির কথা শোনাতেন । অঘোষিত উঁচু পর্বে নাম খোদাই হয়ে গিয়েছিলো তার । মৃৎশিল্পেও তার দক্ষতা ছিলো দেখার মতো । প্রতিমা তৈরির দায়িত্ব তার উপরেই দিয়ে নিশ্চিন্ত হতো পূজা কমিটি ।শোভন কাকা এলেই আমাদের পুজোর গন্ধ গ্রাম জুড়ে গানের সুরের সঙ্গে ভেসে বেড়াতো । তিনি ছিলেন প্রাণজুড়ানো শান্ত পালক নরম আনন্দের ফেরিওয়ালা ।তিনি মাটি হাতে মায়ের সঙ্গে মন মাতানো মন্দাক্রান্তা গাইতেন ।তার চলন বলন দেখে ভালোবেসে তাকে শোভনানন্দ বলতেন তথাকথিত গুরুবৃন্দ । তারপর ছাত্র ছাত্রী রা চলে গেল।এবার ঘরে ঢুকলো বিজয়ের বন্ধু রমেন। রমেন চা বিস্কুট খায় আর বিজয় বলে চলে গল্পকথা,তার জীবনের কথা।শিবপদ বলে, তিরিশ বছর পরে আমার মনে পড়ছে খড়ের চাল, মাটির দেওয়াল ভেদ করে সে এসেছিলো জ্যোৎস্না রঙের ফ্রকে । হাত দিতেই একরাশ মুক্ত ঝরে পরে ছিলো তার রক্ত রাঙা দেহ মাটিতে ।

আমাকে বলেছিলো সে, _পলাশ তোমার পরশ থেকে আমাকে ছিন্ন কোরোনা, আমি মরে যাবো ।

আমি বলেছিলাম আবেগে, __এসো আমার আনন্দ জীবন, আমার করবী ।

রমেন বলে,কে যে মরে আর হা পিত্যেশ করে বোঝা যায় না এই পৃথিবীতে ।

বিজয় বলে,ঠিক বলেছিস।তারপর সেদিন খড়ের চাল ফুঁড়ে জ্যোৎস্না আমার উপর উঠে বিপরীত ক্রিয়াতে হেসেছিলো নেশাতে । আমি শুধু অবাক হয়েছিলাম প্রথম সমুদ্র দেখার মতো ।তারপর জয় পরাজয়, উত্থান পতনের ঢেউ আছাড় মেরেছে জীবন সৈকতে । কোনোদিন ভেঙ্গে পরে নি মন । হঠাৎ পাওয়া জ্যোৎস্না বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেলো । না ছাড়ার প্রতিজ্ঞা র মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বয়ে বেড়ালাম তিরিশ বছর ।এখন প্রকৃতির সঙ্গে ভাব জমিয়েছি খুব ।
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in







ত্রয়োদশ পর্ব

একদিনের যুদ্ধ।

সিলেক্ট কমিটির যুদ্ধ বিভাগের তিন সদস্য রজার ড্রেক, চার্লস ম্যানিংহাম এবং রিচার্ড বেকার মিরজাফরের যোগদানের ব্যাপারে সুনিশ্চিত না হয়েও অনতিবিলম্বে যুদ্ধ শুরুর সিদ্ধান্ত জানিয়ে ক্লাইভকে চিঠি পাঠাল। কিন্তু সেই চিঠি ক্লাইভের হাতে পৌঁছোনোর আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ২৩শে জুন, ১৭৫৭ সকাল আটটায় সিরাজের দিক থেকে উড়ে এলো প্রথম গোলা। এই গোলার আঘাতে নিহত হলো একজন ইংরেজ সৈন্য এবং আহত হলো একজন। ব্রিটিশদের কাছে খবর ছিল সিরাজের সৈন্যদের কাছে কামান নেই। কিন্তু সেই খবর মিথ্যা প্রমাণ করে আমবাগানের সামনে ব্রিটিশ সৈন্যরা জড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওদিক থেকে শুরু হলো বিপুল গোলাবর্ষণ। ব্রিটিশবাহিনী তড়িঘড়ি দু’টো ছোট কামান জোগাড় করলেও তা ছিল সিরাজের কামানবাহিনীর তুলনায় অতি সামান্য। ব্রিটিশ কামানের গোলায় নবাবের কয়েকজন সৈন্য নিহত হলেও ব্রিটিশ সৈন্যদের নিহত হবার সংখ্যা ছিল তার দশগুণ। প্রথম একঘন্টার যুদ্ধ থেকে ক্লাইভের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে নবাবের সৈন্যসংখ্যা এবং যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনা ব্রিটিশদের থেকে অনেক বেশি। প্রথমত, নবাবের বাহিনীর দুই তৃতীয়াংশ সৈন্য তখনও যুদ্ধে যোগ দেয়নি। মাত্র এক তৃতীয়াংশ সৈন্যবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছে সিরাজ এবং প্রথম আধ ঘন্টায় ব্রিটিশবাহিনীর দশজন ইংরেজ সৈনিক এবং কুড়িজন সেপাই নিহত হয়েছে অর্থাৎ গড়ে প্রতিমিনিটে একজন। অনেক যুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ক্লাইভ কালবিলম্ব না করে সেনাবাহিনীকে পিছু হটার আদেশ দিল। সামনের সৈনিকদের গাছের আড়ালে থাকতে বলা হল যাতে গাছগুলোকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা যায়। অগ্রসরমান নবাবের সৈন্যদের ওপর আঘাত হানবে পিছনের সারির কামানবাহিনী। ব্রিটিশ সৈন্যদের পিছু হটতে দেখে নবাবের সৈন্যরা উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠলো। সামনে বিশাল মহিষবাহিনীকে রেখে এগিয়ে আসতে লাগলো নবাবের সৈন্যরা। গুলিবর্ষণের মাত্রা ক্রমশ বাড়তে লাগলো। কিন্তু তাতে লাভ খুব একটা হলোনা। বেশিরভাগ গুলি গাছে আটকে গেল। ব্রিটিশ সৈন্যরা গাছের আড়ালে শুয়ে রইল। বেলা এগারোটা নাগাদ ক্লাইভ সিদ্ধান্ত নিল যে আগামী দু-তিন ঘন্টা সৈন্যরা গাছের আড়ালেই থাকবে, কোনওরকম প্রতিআক্রমণে যাবে না। পিছনের দিক থেকে সীমিত কিন্তু অবিরত গোলাবর্ষণ করতে থাকবে কামানবাহিনী। দুপুর বারোটা নাগাদ ক্লাইভ পলাশি হাউস থেকে বেরিয়ে সেনাপ্রধানদের সঙ্গে পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্য কিছুদূর এগিয়ে হঠাৎ কী ভেবে আবার পলাশি হাউসে ফিরে গেল। অস্থিরচিত্ত ক্লাইভকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার আবহ ক্লাইভের নজর এড়ায় নি।দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ঘনিয়ে এল ক্লাইভের মনে। এই চরম মুহূর্তে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন বরুণদেব। শুরু হল বৃষ্টি। এইসময়ের বাংলার আবহাওয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা এবং অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও সিরাজের সেনাপ্রধানেরা কোনওরকম সাবধানতা অবলম্বন করেনি। প্রচুর পরিমাণে গোলাবারুদ জলে ভিজে নষ্ট হয়ে গেল। ক্লাইভের বাহিনীর সৈন্য এবং বন্দুকের সংখ্যা অনেক কম হলেও বৃষ্টির হাত থেকে গোলাবারুদ বাঁচানোর জন্য আগে থেকেই ব্যবস্থা নিয়েছিল ক্লাইভের সেনাপ্রধানেরা। প্রচন্ড বৃষ্টিতে আমবাগান জলে ভরে গেল আর গোলাবারুদের অভাবে নবাবের দিক থেকে গোলাবর্ষণ কমতে কমতে প্রায় থেমে গেল। কিন্তু ব্রিটিশদের দিক থেকে গোলাবর্ষণ চলতে থাকলো অবিরত।

এই পুরো সময়টা ধরে মিরজাফর, ইয়ার লতিফ এবং রাইদুর্লভের সেনাবাহিনী নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ক্লাইভ এবং সিরাজ দু’জনের মনে একই প্রশ্ন, এরা কি যুদ্ধে যোগ দিতে চায়? যদি চায় তবে কোন পক্ষে? এরা এতক্ষণ যুদ্ধে যোগ দেয়নি কেন? ক্লাইভ কোনওদিনই মিরজাফরকে বিশ্বাস করতে পারেনি। ক্লাইভের মনে আর একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল। তবে কি এই সুগভীর চক্রান্ত এবং চুক্তির খবর সিরাজের কাছে পৌঁছেছে? মিরজাফর কি শেষ মুহূর্তে সব চুক্তি অমান্য করে সিরাজের পক্ষেই যুদ্ধ করবে? মিরজাফরের পক্ষে সবই সম্ভব। তবুও আশার আলো এই যে তার পক্ষে সরাসরি যোগ না দিলেও মিরজাফর কিন্তু এখনও পর্যন্ত সিরাজের সেনাপতি হওয়া সত্ত্বেও সিরাজের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়নি। মিরজাফরের ভূমিকা এই মুহূর্তে নিরপেক্ষ। কে জানে কি অপেক্ষা করছে সামনে? দৃশ্যতই দ্বিধাগ্রস্থ ক্লাইভ। সিরাজের চিন্তিত হবার অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে। তার সন্দেহকে সত্য প্রমাণ করে প্রায় চার ঘন্টা যুদ্ধ চলার পরেও তার তিন প্রধান সেনাপতি তাদের জায়গা থেকে এতটুকু নড়েনি। ব্রিটিশ সৈন্যরা পিছু হটার সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ জোরদার করে নিশ্চিত এবং অনায়াস যুদ্ধজয়কে যারা প্রতিহত করলো তারা যে সিরাজের বিরুদ্ধতা করছে সে কথা দিনের আলোর মত স্পষ্ট। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে সিরাজ সেই সমস্ত নবাবদের মতই একজন যারা স্তাবক পরিবৃত হয়ে নিজেদের সমস্ত বিপদের থেকে দূরে রেখে সেনাপ্রধানদের হাতে যুদ্ধের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়। এইসমস্ত স্তাবকেরা যাদের মধ্যে অধিকাংশই লোভী এবং বিশ্বাসঘাতক তারা নবাবকে পরিস্থিতি সম্বন্ধে ভুল খবর দিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। বিভ্রান্তির মেঘ সরিয়ে যখন সত্য সামনে এসে উপস্থিত হয় তখন আর কিছু করার থাকে না।

গোলাবর্ষণ কমে আসছে দেখে সিরাজের দুই বিশ্বস্ত সেনাপতি মীর মদন এবং মোহনলাল সেনাবাহিনীসমেত আমবাগানের দিকে এগিয়ে চলল। ব্রিটিশদের দিক থেকে অবিরত গোলাবর্ষণে বেশ কয়েকজন সৈনিক নিহত হলেও ওরা জানে যে সংখ্যায় নবাবের সৈন্য এত বেশি যে যুদ্ধজয় অবশ্যম্ভাবী। আধুনিকতার নিরিখে ইংরেজদের অস্ত্রশস্ত্র এবং রণকৌশল এগিয়ে থাকলেও যুদ্ধে সৈন্যসংখ্যাই শেষ কথা বলে। এছাড়াও আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষিত কিছু ফরাসি সেনাপ্রধানও এই যুদ্ধে নবাবের পক্ষে সামিল হয়েছে। সিরাজের বাহিনী যত এগিয়ে আসতে থাকে ক্লাইভের কপালের ভাঁজ গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। যুদ্ধের সমীকরণ অভিজ্ঞ সেনাপতি ক্লাইভের অজানা নয়। ক্লাইভের অসহায় চোখের সামনে মীর মদন আর মোহনলাল যখন অপ্রতিরোধ্য গতিতে যুদ্ধকে অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে তখনই ঘটলো অঘটন। একটা কামানের গোলা উড়ে এসে আঘাত করল মীর মদনকে। সাঙ্ঘাতিক আহত মীর মদনকে নিয়ে আসা হলো সিরাজের তাঁবুতে। কিন্তু চিকিৎসা শুরুর আগেই সিরাজকে অন্তিম অভিবাদন জানিয়ে চিরকালের জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বিদায় নিল মীর মদন। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মত একা লড়াই চালাচ্ছে মোহনলাল। সিরাজের বিশ্বাসঘাতক তিন সেনাপতি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। মীর মদন মৃত। একা মোহনলাল যে এই যুদ্ধ জেতাতে পারবে না সে কথা না বোঝার কিছু নেই। যতটা না মীর মদনের মৃত্যুর জন্য তার চেয়ে অনেক বেশি এই তিন সেনাপতির নিষ্ক্রিয়তার জন্য অধিক শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও এই যুদ্ধ হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে মিরজাফরের কাছে দূত পাঠাল সিরাজ। যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাবার প্রস্তুতি চললেও শেষ সিদ্ধান্ত নেবার আগে শেষ চেষ্টা তো করতেই হবে। আত্মাভিমান প্রদর্শনের সময় এটা নয়। নিজের জীবনরক্ষার জন্য মাথা নত করতে এই মুহূর্তে প্রস্তুত নবাব সিরাজউদ্দৌলা। কিন্তু খবর তো পাঠানো হয়েছে অনেকক্ষণ তাহলে এত দেরি করছে কেন মিরজাফর? তবে কি অতর্কিত আক্রমণে তাকে হত্যা করার কথা ভাবছে ওরা? নাকি এই দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে আরও খানিকটা সময় নষ্ট করে দিতে চাইছে ওরা? অস্থির সিরাজ একবার ভাবলো সে নিজেই বেরিয়ে পলাশি হাউসে গিয়ে ক্লাইভের সঙ্গে কথা বলবে কিন্তু মনে হল সেটা ঠিক হবে না। এই নিরাপত্তার বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে গেলে বাঁচার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

অবশেষে মিরজাফর এল, সঙ্গে পুত্র মিরান এবং খাদিম হুসেন খানসহ অস্ত্রশস্ত্রসজ্জিত প্রচুর লোকলস্কর। সিরাজ অত্যন্ত বিনীত এবং বিনম্রভাবে মিরজাফরকে অভিবাদন জানালো। কিছুক্ষণ কথা বলার পর নিজের মাথার মুকুট মিরজাফরের সামনে নামিয়ে রেখে বললো,’ আমি আপনার প্রতি যে আচরণ করেছি তার জন্য আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত। আমাদের মধ্যে যে বৈরিতা সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য আমি দায়ী এবং সে জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমি জানি আমার পূর্বসুরী মাতামহ আলিবর্দি খান আপনার সমর্থন সবসময় পেয়েছেন এবং নানাসময় নানাভাবে তিনি আপনার প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। আমি বিশ্বাস করি যে নবাববংশের প্রতিনিধি হিসাবে এবং আমার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক মাথায় রেখে নবাব আলিবর্দি খানের কাছ যে সম্মান এবং সম্পদ আপনি পেয়েছেন তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আপনি আমার এবং রাজমুকুটের সম্মান এবং জীবন রক্ষা করবেন।‘ সিরাজের এই আবেগময় অনুরোধ মিরজাফরের মনে কোনও দাগ কাটতে পারলো না। অতীতের কথা তো মিরজাফর কবেই ভুলে গেছে এখন শুধু ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর সে। যে সুযোগের সন্ধানে এত রাত বিনিদ্র কাটিয়েছে সে সেই সুযোগ আজ তার সামনে উপস্থিত। দিনশেষের আলোয় হীরকখচিত রাজমুকুটের দিকে তাকিয়ে রইল মিরজাফর। তারপর কঠিনস্বরে বললো,’ দিন শেষ হয়ে আসছে। নতুন করে আক্রমণ করা আজ আর সম্ভব নয়। যুদ্ধরত সেনাবিহিনীকে আজকের মত যুদ্ধ বন্ধ রেখে ফিরে আসতে বলুন। কাল সকালে আমরা সমস্ত সেনাবাহিনীকে একত্রিত করে ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে নতুন করে আক্রমণ শুরু করবো।‘ সিরাজের মনের সন্দেহ আন্দাজ করে মিরজাফর বললো যে রাত্রে যাতে শত্রুপক্ষ কোনওভাবে আক্রমণ না করে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তার। সিরাজের আতঙ্ক তীব্র হতে থাকলো। সিরাজের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ দেখে রাইদুর্লভ বললো,’ যুদ্ধবন্ধের আদেশ দিয়ে আপনি মুর্শিদাবাদ ফিরে যান। বাকিটা আমরা দেখছি।‘

ওদিকে মোহনলাল এবং তার সেনাবাহিনী তখন প্রবল পরাক্রমে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর দিকে এগিয়ে চলেছে। ফরাসি সৈন্য এবং নিজের বাহিনীর মনোবল এখন তুঙ্গে। লক্ষ্যে অবিচল মোহনলাল যখন যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছে তখন তার কাছে এসে পৌঁছলো সিরাজের আদেশনামা। যে নিরাপত্তারক্ষী আদেশনামা নিয়ে এসেছিল তার হাত দিয়েই চিঠি লিখে মোহনলাল জানালো যে তারা এইমুহূর্তে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে এবং যুদ্ধ বন্ধ করা একদমই ঠিক হবে না। যা হবার আজকেই হবে। এই সুযোগ হারালে আর ফিরে পাওয়া যাবেনা। প্রবল পরাক্রমে এগিয়ে চলা সেনাবাহিনীকে থামিয়ে দিলে তাদের মনোবল ভেঙে পড়বে এবং ছত্রভঙ্গ সেনাবিহিনীকে আবার একত্রিত করা অসম্ভব হতে যাবে। সিরাজ মোহনলালের উত্তর মিরজাফরকে পড়ে শোনাল। মিরজাফর বললো,’ আমি আপনাকে যে উপদেশ দিয়েছি তা পালন করা বা না করা আপনার সিদ্ধান্ত। আপনি নবাব হিসাবে যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই করুন।‘ মিরজাফরে বরফকঠিন কন্ঠস্বর শুনে ভয়ে হিম হয়ে গেল সিরাজের মেরুদন্ড । আসন্ন মৃত্যুর আশংকায় নিজের যুদ্ধচালনার অভিজ্ঞতা এবং সাধারণ বোধবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে মোহনলালকে বারবার যুদ্ধবন্ধের আদেশ পাঠাতে থাকল সিরাজ। একেই বোধহয় বলে নিয়তি। যুদ্ধজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে রাজাদেশে বাধ্য হয়ে যুদ্ধবন্ধের হুকুম দিল মোহনলাল। হতচকিত এবং বিভ্রান্ত সেনাবাহিনী কিছু বুঝতে না পেরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকলো। তারা বিশ্বাসই করতে পারছিল না। কিন্তু বারবার মোহললালের আদেশ শুনে বন্ধ হয়ে গেল গোলাবর্ষণ। বিস্মিত ফরাসি সৈনিকেরা পিছুহটা সেনাদের বাঁচাবার জন্য গুলিবর্ষণ বন্ধ করলো না। সৈন্যদের একেবারে সামনে যে বিশাল মহিষবাহিনী এগিয়ে যাচ্ছিল তাদের উল্টোদিকে ঘোরাতে একটু বেগ পেতে হলেও তারা যখন উল্টোদিকে এগোতে শুরু করল তাদের পিছন পিছন সিরাজের সেনাবাহিনী তাঁবুর দিকে রওনা দিল। বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিদের অধীনস্থ সৈন্যবাহিনীরাও সারাক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে তাঁবুর দিকে রওনা দিল। নবাবের সেনাবাহিনীর এই অদ্ভুত পশ্চাদপসরণে অবাক হয়ে ইংরেজরা ভাবলো হয়ত মীর মদনের মৃত্যুতে অথবা ইংরেজদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের ভয়ে পিছু হটছে নবাবের বিশাল সেনাবাহিনী। পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি দেখে মেজর ক্লিপট্রিকের মনে হল এটাই প্রতিআক্রমণের উপযুক্ত সময়। এই সুযোগ হাতছাড়া করার মত বোকামি আর হয়না। দু’কোম্পানি সৈন্য আর কয়েকটা কামান নিয়ে নবাবের সৈন্যদের ধাওয়া করার অনুমতি চেয়ে পাঠাল মেজর ক্লিপট্রিক। ক্লাইভ ক্লিপট্রিককে এত কম সৈন্য নিয়ে আক্রমণের অনুমতি দিলনা। সেই সময় ক্লাইভের আদেশে কুটে তার সেনাবাহিনী নিয়ে যোগ দিল এবং ক্লাইভ নিজে এই আক্রমণে নেতৃত্বে রইলো। ফরাসিরা আপাতভাবে যুদ্ধ বন্ধ করেছে মনে হলেও তারা গোপনে আবার আক্রমণ চালানোর জন্য প্রস্তুত রইল। যুদ্ধ এখনও বাকি। মোহনলালের জামাতা বাহাদুর আলি খান তখনও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছু হটেনি। ব্রিটিশবাহিনী যখন সিরাজের তাঁবুতে এসে পৌঁছল তখন মিরজাফরের চিঠি এসে পৌঁছল ক্লাইভের কাছে। সময় তখন বিকাল পাঁচটা।

আমার সঙ্গে নবাবের দেখা হয়েছে। নবাব দৃশ্যতই ভীত এবং সন্ত্রস্ত। সে আমার কাছে লোক পাঠিয়েছিল এবং নিজের মাথার মুকুট আমার সামনে রেখে কোরানের উপর আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে যে আমি যেন আপনার পক্ষে না যাই। আপনি হয়ত জানেন এই মুহুর্তে পরিস্থিতি বদল হয়ে আপনার অনুকূলে এসেছে। মীর মদন মৃত। বক্সি হাজারি নিহত। আমি, রাইদুর্লভ এবং খান ডানদিক থেকে বামদিকে চলে এসেছি। আমরা একসাথে ওদের ধাওয়া করলে পালানো ছাড়া ওদের আর কোনও রাস্তা থাকবে না। কিন্তু তার আগে আমাদের তিনজন এবং আপনার একসাথে দেখা করার প্রয়োজন আছে। আমরা ব্যাপারটা আজ রাত্রেই শেষ করতে চাই। প্রত্যেকে চুক্তি অনুযায়ী তাদের কর্তব্য পালন করছে। নবাব কাল সকালে মুর্শিদাবাদ ফিরে যাবে বলে মনে হয়। আমরা আজ রাত্রে আক্রমণ করব। আপনি সেসময় ওখানে থাকলে নবাবকে বন্দি করতে পারবেন।

অপরদিকে সিরাজের আদেশে মোহনলাল অনিচ্ছাসত্ত্বেও যুদ্ধ বন্ধের হুকুম দিয়েছে। ফরাসিরা তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। যে সমস্ত বিশ্বাসী সেনারা লড়াই চালাচ্ছিল তারা যখন দেখলো মিরজাফর, রাইদুর্লভ এবং ইয়ার লতিফের বিশাল সেনাবাহিনী এই যুদ্ধে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে তখন তাদের মনোবল ভেঙে গেল এবং পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বুঝতে পেরে তারাও পিছু হটতে শুরু করল। আতঙ্কিত সিরাজের কাছে যখন খবর এসে পৌঁছল যে মিরজাফর পরের দিন যুদ্ধ শুরু করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও তাকে সাহায্য করা তো দূরের কথা উল্টে আরও দু’জন সেনাপতির সঙ্গে জোট বেঁধে তাকে আক্রমণের পরিকল্পনা করছে তখন যে বিশ্বাসঘাতকতার কথা সে এতদিন বিশ্বাস করেনি তা তার সামনে প্রকট হয়ে উঠলো। সিরাজ বুঝতে পারলো সব শেষ। হাজার হাজার সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাচ্ছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তাদের ধাওয়া করে তাঁবুতে এসে পৌঁছবে।আগে থেকে সবই প্রস্তুত ছিল। কালবিলম্ব না করে একটা উটের পিঠে উঠে দু’হাজার অশ্বারোহী সৈন্য সঙ্গে নিয়ে তীব্রগতিতে মুর্শিদাবাদের দিকে রওনা দিল সিরাজ। ক্লাইভ এবং তার বাহিনী যখন সিরাজের তাঁবুতে এসে পৌঁছল তখন তাঁবু জনশূন্য । ক্লাইভ বুঝতে পারলো যুদ্ধজয় সম্পন্ন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিরজাফরের আর একটা চিঠি ক্লাইভের হাতে এল। ‘ যুদ্ধজয়ের জন্য এবং পরিকল্পনার সার্থক রূপায়নের জন্য আপনাকে অভিনন্দন।আপনি ওয়াটস বা অন্য কোন অফিসারকে আমার কাছে পাঠান। আমি দীঘির ধারে অপেক্ষা করছি।‘ ক্লাইভ উত্তরে জানালো,’ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কাল সকালে দাউদপুরে আমাদের দেখা হবে। এখনও কিছু কাজ বাকি। আমাদের সুনিশ্চিত করতে হবে যে নবাবের সৈন্যরা যেন কোথাও গোপনে একত্রিত না হয়।‘

ক্লাইভ তার সেনাবিহিনীকে আদেশ দিল যে কোনভাবেই যেন নবাবের সৈন্যরা আশেপাশে জড়ো না হতে পারে। সিরাজের তাঁবুতে পরিত্যক্ত মূল্যবান জিনিসপত্র তারা অবাধে লুন্ঠন করতে পারে। এছাড়াও পরেরদিন দাউদপুরে তাদের সকলকে পুরষ্কৃত করা হবে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নবাবের পরিত্যক্ত সামগ্রী অবাধে লুঠ করতে থাকলো। পরিত্যক্ত এবং ছত্রভঙ্গ মহিষবাহিনীকে যতদূর সম্ভব একত্রিত করে তাদের পিঠে জিনিসপত্র চাপিয়ে দাউদপুরের দিকে রওনা দিল। মেজর কুটে যে এতক্ষণ সিরাজের তাঁবু অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছিল সে এখন তার বাহিনী নিয়ে নবাবের যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে আসা সৈন্যদের তাড়িয়ে নিয়ে চলল। রাত্রি যখন আরও একটু গভীর হল এবং কুটে নিশ্চিত হলো যে নবাবের সেনাবাহিনীর আর একসাথে জড়ো হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই তখন তার সৈন্যদের বিরতির নির্দেশ দিল। সবাই এখন পলাশির থেকে দশ কিলোমিটার উত্তরে দাউদপুরে এসে পৌঁছেছে। ইতিমধ্যে মেজর ক্লিপট্রিকের সৈন্যরা এসেও যোগ দিয়েছে। রাত্রি তখন আটটা।

এমনি ভাবেই হঠাৎ শেষ হয়ে গেল পলাশির যুদ্ধ। শুরু হলো ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের যা চলবে পরবর্তী প্রায় দু’শ বছর।

এত কম সময়ে এবং এত কম মৃত্যুর বিনিময়ে ব্রিটিশরা এর আগে কোনও যুদ্ধজয় করেনি বলে দাবি জানালো ক্লাইভ। ২রা জুলাই সিলেক্ট কমিটিকে লেখা ক্লাইভের রিপোর্টে বলা হয়েছে এই যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মাত্র বাইশজন নিহত এবং পঞ্চাশজন আহত হয়েছিল যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল ভারতীয়। নবাবের সেনাবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি তবে ক্লাইভের রিপোর্ট অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা আনুমানিক পাঁচশো। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা স্পষ্টতই কম করে দেখানো হয়েছে সবসময়।

যুদ্ধজয়ের পরেও একাধিকবার সিলেক্ট কমিটির সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল ক্লাইভকে। যুদ্ধজয়ের তিনদিন পর অর্থাৎ ২৬শে জুন সিলেক্ট কমিটির উদ্দেশ্যে এক চিঠিতে ক্লাইভ লেখে,’ আমি আমার চিঠির উত্তরে মিঃ ড্রেকের লেখা চিঠি পেয়েছি। বিজয় উৎসবের সময়ে এই ধরণের চিঠি অনভিপ্রেত এবং আশ্চর্যজনক। চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে যদি কোনও কারণে এই যুদ্ধে আমাদের পরাজয় হত তাহলে তার সমস্ত দোষ আমার ওপর চাপানো হতো।‘ক্লাইভ এবং সিলেক্ট কমিটির এই বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল।
5

গল্প - ময়ূরী মিত্র

Posted in






গোষ্ঠ বণিকের কাছে আমার প্রথম প্রেমশেখা ৷ বা বলতে পারেন প্রেমদেখা ৷ গোষ্ঠ বণিক আমার ছেলেবেলার পাড়া বেলগাছিয়ার এক " Very Important " মুদি ৷ যীশুর স্কুলে পড়তাম তো ৷ ফলে যে কোনো মানুষকে ভালো লাগলেই তাকে বিভিন্ন ইংরাজি adjective কিংবা সাধু বাংলা শব্দে সাজিয়ে তোলা অভ্যেস করে ফেলেছিলাম ছোট থেকেই ৷ গোষ্ঠ মুদি তখন বেলগাছিয়া বাজারের একমাত্তর দোকানদার যে কিনা চাল ডাল গোটা হলুদ গোটা জিরে আর মুগ মটরের পাশাপাশি বাচ্চাদের জন্য কটি কাচের বোয়েম রাখত -যার একটায় মৌরী লজেন্স , একটায় জেমস লজেন্স , কড়মড় হজমী -এইসব থাকত ৷ ফলে দেখার প্রথম দিন থেকেই কাঁধ পাছাহীন কালো লোকটা আমার কাছে সাতসাগরের বণিক ৷ মাছবাজারের সমান্তরাল পথ দিয়ে বণিকের কাছে যেতাম ৷ ন্যায্য ও ফাউ লজেন্স ইজেরের পকেটের মধ্যে ভরতাম ৷ তারপর ওই পথ দিয়েই গটগট করে বাজার পেরিয়ে বাড়ি ৷ মাছ বাজারের দিকে চাইতামই না ৷ গোষ্ঠ বণিকের কাছে যাবার পথটুকু যেন তীর্থ করতে করতে যেতুম রে বাপু ৷ রান্নাঘরের হলুদ লুকিয়ে ঠাকমাকে বলতাম -হলুদ ফুরিয়েছে বলবে তো আমায় ! দাও একটাকার একটা নোট দাও ৷ খুচরো মোটে দিও না ৷ বণিক মোটে খুচরো পছন্দ করে না ৷ আর পিসীদেরও এত ওর দোকানে পাঠিও নি বাপু ৷ আমার বণিক আমার হাত থেকে টাকা নিতে পছন্দ করে ৷ গোটা হলুদের সঙ্গে একমুঠ মৌরী লজেন্স ৷ সে ব্যাপারে অবশ্য বণিকের ওপর নির্ভর করতুম না ৷ খাবলা মেরে তুলতাম লজেন্স ৷ মতে না মিললে গোষ্ঠ কাঁচা গালাগাল দিত সব্বাইকে ৷ মাছবাজার থেকে চপলা উঠে এসে বলত --আ মুখপোড়া ৷ বাচ্চাটা দুটো লজেন্স বেশী নিয়েছে তো গালাগালের ছিরি দেখো ৷ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতাম -চপলার কথায় গোষ্ঠ অল্প হাসত ৷ আমার হাড় জ্বলত ৷ আমি চপলার দয়া চাইতুম না ৷ আমার বণিকের মনোযোগ
অর্জন করতে ইচ্ছে হত বারবার ৷ চপলা যতবার আমার ফাউ লজেন্সের হয়ে ঝগড়া করেছে গোষ্ঠ তত লজেন্স আমাকে দিয়েছে ৷ ঐটুকু মেয়ে তখন আমি ! তাও মনে হত যোগ্যতায় হার হচ্ছে আমার ! হ্যাগো -যোগ্য হয়ে ওঠার কামনা কি জন্ম থেকেই জীবের থাকে গো ! নিজে যে অপদার্থ -এ কারুণ্যও চলে দৌড়ে দৌড়ে ৷ জীবনভর ৷

আর তাই তো গোষ্ঠ যখন লজেন্স চপলার হুকুমে আমায় বিলিয়েছে ,চপলার ওপর রাগ বেড়েছে আমার দুগুণ -তিনগুণ ৷ ওহ এই ব্যাপার তবে ! আমার বণিক তবে ভিনদেশে নাও নিয়ে চলে যাবে ! নারী তো দেশই বটেক ৷ আর আমি ছাড়া অন্য নারী ! সে তো ভিনদেশই হল ! তাই না ? আচ্ছা ! এবার থেকে চপলাই ফ্রি জেমস পাবে ! গজরাতে গজরাতেও গোষ্ঠর কাছে আমার যাওয়া বাড়ল ৷ মাছবাজারকে পাত্তা না দেওয়াও বাড়ল ৷ গোষ্ঠ ও মাছবাজারে পৌঁছনোর দুটো রাস্তা সমান্তরাল রাখতে যথাযথ নিষ্ঠাবান হলাম৷

কন্ঠে তুলসী মালা ঝুলিয়ে মেছুনী চপলাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করল গোষ্ঠ ৷ তখন অবশ্য মাথায় বেশ অনেকটা বেড়ে গেছি ৷ লাইফ সায়েন্স বইয়ে রেচন জনন পড়তে শুরু করেছি ৷ আমারও মুখের ভাষা ছিল তেমন কুচ্ছিত ৷ বিজ্ঞান পছন্দ করতাম না বলে রেচনকে বলতাম হাগা প্রক্রিয়া আর জনন ছিল পয়দা ৷শ্রেণী বিচারে বন্ধু করিনি কখনো।বিহারীও জুটেছিল কিছু আমার সঙ্গে ৷ পয়দা - মহব্বত এসব শব্দও ঢুকছিল মগজে ৷ তখন অবশ্য আমরা ইন্দ্র বিশ্বাস রোড ছেড়ে রাস্তার এপারে অনাথনাথ দেব লেনের ভাড়াবাড়ীতে চলে এসেছি।সেখানে আবার আমাদের শোবার ঘর থেকে বাজারের রাস্তার অন্য প্রান্ত দেখা যায় ৷ শুনতে পেতাম -ওই পথ দিয়েই বণিক আর তার ঢপের বউ চপলা বিকেলে বাড়ি ফেরে ৷ common toilet এ বডিস খুলে চান সারে গোষ্ঠর বউ ৷ পারুলদি ঘর মুছতে আসত ৷ ওই বলল মাকে ৷

--কী বেলাজ বউ বৌদি ৷ গরম লাগে বলে খালি বুকে আঁচল টেনে জল ঢালবি সব্ব অঙ্গে ! গোষ্ঠ সিঁড়িঙ্গে আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সেদিন ৷ তুই চলে যা ব্যাটাছেলেদের বাথরুমে ! তা না ! সঙ্গে গোটা দুই মদ্দ নিয়ে বউয়ের চান দেখছে আর হাসছে ৷ চপলার ভ্রূক্ষেপ নেই ৷ চান শেষ হল তো গোষ্ঠর নাকে রসকলি আঁকবে !

শীতল বিকেলের রস গড়াত পারুলদির শব্দ দিয়ে ৷ সব শব্দে চপলার চান আর চান ৷ চপলার বগলে সাবান মাখা , মাথায় রিঠে দেওয়া , পায়ের গোড়ালির ময়লা তোলার সময় দুদুর ঝাঁকানি ! উফ ! পারুলদিও কি কিছু কম অসভ্য কথা বলত !

মনে আছে পারুলদি যেদিন এত ডিটেলে চপলা গোষ্ঠর কথা বলল তার পরদিনই বাবাকে বললাম --বাবা খাটটা জানলার দিকে টেনে আন তো ! আহা ওই জানলা নয় ৷ এই যে ..এই বাজারের দিকের জানলা ৷ দেখো না বাবা -এ জানলায় কেমন কাকগাছ আছে ৷

আমার বাবাও তো তখন ছেলেমানুষ ! বল তোমরা ! সে বেচারী আমার উদ্ভট সন্ধির মানে না বুঝে জিজ্ঞেস করলে --কী সব বলিস রে তুই ? কাকগাছ মানে ৷ আমি বললাম -এ গাছে ভর্তি কাক ৷ তাই কাকগাছ বলে দিয়েছি বাবা ৷

কাকগাছের জানলায় আমাদের খাট ৷ আমারও শুরু হল কাকের ডাক শুনে গোষ্ঠ চপলার প্রেমকল্পনা ৷ ভোররাতে কাক ডাকে ৷ আমি ভাবি -চপলা গোষ্ঠর জন্য ডালের বড়া ভাজছে ৷ বড়া ভাত খেয়ে গোষ্ঠ দোকান যাবে আর চপলা চট বিছিয়ে নতুন মাছ বেচবে ৷ সন্ধেতে কাক ডাকে ৷ আমি ভাবি চপলা গোষ্ঠর সরু সরু চুলের গাছিতে তেল মাখাচ্ছে ৷ গভীর রাতেও তো কাক ডাকে বল !
আরে সে না ডাকলেও রাত তো কাককে ডাকতে পারে নাকি ! তখন কী করবি রে গোষ্ঠবউ ! বরটার ওই তো রোগা শরীর ! আর তুই এত নাদুসনুদুস বউ ! ইস ! মাগো মা !

--খাটে শুয়ে আমার ছেলেমানুষ বাপ মা দুটোর ওম নিতে নিতে হেসে কুটকুট হয়ে যেতাম ! বুঝলে গ ! এ হল গে- আর কল্পনা না করতে পারার হাসি ৷ ওই তোমরা যাকে কাব্যি করে বল কল্পনাতীত ৷ এক মানুষ তুমি হাজারবার দেখো -সে কিন্তু কল্পনাতীত থেকেই যায় -থেকেই যায় ৷

তাই তো ওই কাকগাছের ডালের ফাঁক দিয়ে একদিন দেখলাম -আমার বণিক মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে ৷ সম্ভবত দোকানের ভাগ টাগ নিয়ে ঝগড়া ৷ আগের পক্ষের ছেলেগুলো বাপকে এনতার মারছিল ৷ মাকে নিয়ে দৌড়লাম ৷ ভিড় জমে গিয়েছিল ৷ সব লোক এই অবিবেচনার বিয়ের জন্য গোষ্ঠকে গালাগাল দিতে লাগল ৷ গোষ্ঠ একে রোগা তায় দাঁত ভেঙে তাকে আরো অদ্ভুত দেখাচ্ছিল ৷ চপলা ছুট্টে এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ৷ হেগো কাপড়েই আমার বণিককে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে নিচ্ছিল নিজের বুকে ... সব্বার সামনে ৷ মনে হচ্ছিল একটা কিছুর যেন স্রোত বইবে ৷ কিন্তু তেমন কিছু হল না ৷ গোষ্ঠর দড়ি লাগানো চশমাটা বড়ো যতনে আঁচলে মুছে চপলা এগিয়ে গিয়েছিল। চারিদিকে দোকানের বাটোয়ারা নিয়ে এত যে চিৎকার চলছিল , একটি কথাও কানে গেল কি চপলার ! রাতে চপলা-গোষ্ঠর ঘরে অনেক রাত অব্দি আলো দেখেছিলাম ৷ ওর ঘরের আলো কি এত সহজে নেভানো যায় রে অকম্মার দল ! একবার শুধু মনে পড়েছিল -চপল বউ আজ দশপুরুষের সামনে তার সাধের চানটা করেনি ৷

তারপর আর বছর দুই ও বাড়ি ছিলাম ৷ বাবা ঘুমেঘোরে বলে উঠতেন - কী দেখিস ? কাকগাছ ৷ নাকি গাছের আড়ালে??

মানুষ - মানুষ গো বাবা ৷ তুমি টের পাও না আমি মানুষ দেখি ! ও বাবা -- মানুষ কত্তরকম হয় গো বাবা !কাকমানুষ মানুষকাক ! আমি যে ঘুমের ঘোরে সবার নাকে মোমরঙের রসকলি কেটে যাই বাবা ৷

গোষ্ঠবণিক তুই পারিস বটে !
নিজ দেহে পুষ্টি নেই ৷
জোগাড় করেছিস জিওল মাছ ৷
0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in
(১)

এমনিতেই দুপুর। এই সময় ট্রেন একটু পাতলা। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। ঠান্ডা ঠান্ডা ভাবটা এখনো রয়েছে। প্ল্যাটফর্মে লোকজন অন্যদিনের তুলনায় কম। তবে রোদ্দুরটা বেশ আরামদায়ক। বুচন গার্ড বক্সের গায়ে হেলান দিয়ে রোদ পোহাচ্ছে।

"কিরে, এভাবে হেলান দিলি যে? কত কামালি আজ?" বলেই বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলেন সমর সমাদ্দার। শিয়ালদা মেইন লাইনের গার্ড। আজও তাঁর ডিউটি আছে। ডাউন শান্তিপুর লোকালের জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি।

বুচনের হাঁটুর নিচ থেকে দুটো পা-ই কাটা। একটু নড়ল বটে, কিন্তু আগের মতোই হেলান দিয়ে বসে রইল টায়ার কাটার উপর। যেন আস্ত একটা টায়ারের প্লেট। হাঁটু ও কোমর বেল্ট দিয়ে বাঁধা আছে সেটার সঙ্গে। ক্যাচে চলতে পারে না সে মোটেই। এটাই তার বৈতরণী, যেটা ছাড়া সে অচল। সমাদ্দার মহাশয়কে দেখেই ম্লান হাসিতে উত্তর দিল, "হয়েছে। কিন্তু বাজার খারাপ স্যার। কোথায় ভাবলাম আজ একটু…"

"দাও মারবি। তাই তো?" বলতে বলতে গিয়ে বসলেন গার্ড বক্সের উপর।

বুচন একটু লাজুক হাসল বটে, কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। বাঁ হাতটা তার ঢুকে গেল পকেটে। ত্রি-কোয়ার্টার প্যান্টের সামনে, পিছনে যতগুলো ছিল, হাতড়ালো। যা পেল রেখে দিল হেলান দেওয়া টিনের বাক্সের উপর। কয়েকটা কয়েন আওয়াজ তুলে থিতিয়ে গেল। এবার ডান হাতের পালা। ঠিক আগের মতোই হাতড়ে রেখে দিল বাক্সের উপর। সমাদ্দার মহাশয় তাকিয়ে রইলেন সেই দিকে। প্ল্যাটফর্মের দু-একজনের নজর এড়ালো না তা। তাদেরও অবসর দৃষ্টি আটকে গেল বুচনের কার্যকলাপে। সে বিষয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই বুচনের।

সমাদ্দার বাবু যেন হতাশ হলেন, "ব্যস, এই টুকুই? কী করলি তাহলে?

বিনয়ের সঙ্গে আক্ষেপ ঝরে পড়ল, "আজ একটু দেরি করে এসেছি স্যার। তাই…"

"দে… এগিয়ে দে দেখি। কত হল।"

বুচন ডান হাত দিয়ে ঠেলে দিল কয়েনগুলো। সমাদ্দার মহাশয় ঝুঁকে এলেন সামনে। গুনতে শুরু করে দিলেন। দশ টাকা, দশ টাকা করে গুছিয়ে রাখছেন বাক্সের উপর। বুচনের হাত ঢুকল আবার। তবে পকেটে নয়। কোমরের সঙ্গে আটকানো একটা পলিথিন ব্যাগে। বের করে আনল বাইরে।

সাদা প্লাস্টিকের মধ্যে তখন মুখবন্ধ হয়ে রয়েছে টেরেঙ্গার গোছা। সঙ্গে কয়েকটা চুটকিও। এটা-একটা, ওটা-একটা করে কেটে ঢেলে দিল মুখে।

"তাহলে বুচন, এখনো চালিয়ে যাচ্ছিস?" না তাকিয়ে কৌতুহল প্রকাশ করলেন সমাদ্দার বাবু। কয়েন গোনায় ব্যস্ত হয়ে রইলেন আগের মতো। বুচনের গাল ভরে গেছে টেরেঙ্গার রসে। লাল রস বেরিয়ে আসছে ঠোঁটের ফাঁক থেকে। তবুও মুখ উঁচিয়ে বলল, "বে-বেশি খা-ই-না স্যার। আগের থে-থেকে ক-কমিয়ে দিয়েছি। এ-এই ধরুন দিনে সা-ত-টা কি আটটা।"

"বাহ, খুবই কম। ক'দিন পরেই তো ছেড়ে দিবি, তাই না?" ব্যঙ্গের ঝাঁঝ বুঝতে পেরেই বুচন মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, কিন্তু কথার একটা আক্ষেপ ঝরে পড়ছে, "খোঁড়া মানুষ, কী আর করি বলুন তো? না আছে কোনো শখ, না আছে আহ্লাদ। রোজই ভাবি ছেড়ে দেব, কিন্তু সে আর হয়ে ওঠে না। বাড়িতে ফিরে ভাল লাগে না। সবাই নিজেকে নিয়ে মজে থাকে…

একটু থেমে গিয়ে আবার শুরু করল। মাথা হেঁট হয়ে গেল তার। কথা বলতে গিয়ে আটকে আটকে গেল, "বাড়িতে ভাল্লাগে না স্যার। কেমন যেন একা একা লাগে।"

টাকা গোনা বন্ধ করে দিলেন। বুচনের বিষণ্ন মুখটা দেখে প্রশ্ন করে উঠলেন সমর সমাদ্দার, "কী ব্যাপার বুচন, আজ একটু অন্য রকম লাগছে যে? বাড়িতে কিছু হয়েছে নাকি? উঁ…"

উদাস হয়ে গেল বুচন। চোখে মুখে একটা বিষাদের ছাপ। কোনো একটা কষ্ট তাকে যেন ভেতরে ভেতরে পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে। বাইরের লোককে শুনিয়ে কী করবে সে?

আজ সকালেই তা যেন আরো বেশি করে পুড়িয়ে দিল। আর পাঁচটা দিনের মতো তার মা আজ চায়ের কাপটা এনে দিতে পারেনি। প্রণতি, ছোটো ভাইয়ের বউ চা দিতে এসে ঠুকে বসিয়ে দিল তার সামনে। এই ঠুকে বসানোর কম্পনটা যেন তার বুকে বেজে উঠল। কিছু বলতে গিয়ে আটকে গেল সে। বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল অভিমানে।

দূর থেকেই তার মা'র নজরে পড়ে এসব। তুলসী তলায় জল ঢালছিলেন ঘটি করে। প্রণাম করেই কারোর দিকে না তাকিয়ে বলে উঠলেন, "হে ঠাকুর, সবই আমার কপাল। নইলে এমন দিনও দেখতে হয়? কালকে যে এসেছে সেও হেলা-ছেদ্দা করে। তুমি এর বিচার করো।"

"ঐ বুড়ি, শাপ-শাপান্ত শুরু করে দিলি তো? সকাল হয়েছে কি আমার পিছনে পড়ে গেলি?"

নিজের অপমান সহ্য করে নিচ্ছিল বুচন। সংসারে পঙ্গু, অসহায় মানুষের এসব একটু আধটু মেনে নিতে হয়। তাই নীরবে বুকটা চেপে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। কিন্তু মা'কে অপমানিত হতে দেখে মুখ খুলল, "আহ মা, তুমি একটু চুপ করে থাকতে পারো না? কি দরকার যেচে অপমানিত হওয়ার?"

ফোঁস করে উঠল প্রণতি, "আমি অপমান করেছি? সকাল না হতে হতে বুড়ি যে আমার পিছনে লেগে পড়েছে, তার বেলা? কানে তালা লাগিয়ে বসে আছ নাকি?"

কাপটা মুখে তুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আর পারল না। নামিয়ে রাখে আগের জায়গায়। "বলি, বুড়ি বুড়ি করছ কাকে? উনি তোমার শাশুড়ি মা হন। সম্মান দিয়ে কথা বলো। আর আমি কানে তালা দিয়ে বসে নেই, বুঝলে? চোখ দুটোও খোলা আছে। ভুলে যেও না তুমি এ বাড়ির বউ। নিজের সম্মান নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।"

"নইলে, কী করবে কী? মারবে? মারো… আপদ সব বসে বসে গিলবে, তাদের আবার বড়ো বড়ো কথা। ওমন সম্মানে ঝাঁটা মারি।"

বলেই ফরকি মেরেই চলে যাচ্ছিল রান্নাঘরে। কিন্তু থমকে দাঁড়াতে হল তার শাশুড়ির কথায়। ঠাকুর ঘরে ঘটি রেখে নেমে আসছিলেন বুড়ি। বউয়ের কথাগুলো কাঁটার মতো বিধল কানে। সংযম হারালেন হঠাৎ, "আমরা আপদ? বসে বসে গিলি? তুই কোথাকার পাট-রানী রে? সামান্য চা-টুকু আজ আমি ধরে এনে দিতে পারিনি। তাই ঠুকে বসিয়ে দিলি মানুষটার সামনে? তোকে দিলে খেতিস?"

"আমি কি ওর মতো ফেলনা নাকি? যার নিজের কিছু করার গতর নেই, অন্যের দয়ার উপর বেঁচে আছে, তাকে এসব একটু সহ্য করতে হবে। কারোর দয়ায় বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। আমি হলে তাই-ই করতুম।"

"বউমা? কাকে কীসব বলছ? তুমি জানো, কার দয়ায় বেঁচে আছি আমরা?"

নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলেন না। আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরলেন। তবুও বললেন, "সকাল সকাল ছেলেটার মরণ কামনা করলে? ও আছে বলেই ওর দয়ায় তোমার এত ফুটানি?"

তেড়ে এল হাত উঁচিয়ে, "ঐ ভিখিরির দয়ায়?"

"হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঐ ভিখিরির দয়ায়।"

বুচন কুঁকড়ে যাচ্ছিল অপমানে অপমানে। কাকেই বা কী বলার আছে তার? যে যাই বলুক, সত্যিটা কিন্তু তার চেয়ে আর ভালো কে জানে? অক্ষম, পঙ্গু, ভিখিরি মানুষ। তার আবার সম্মান কিসে? কী করে অন্যের সেবা-প্রার্থী হয় সে? আর কতদিন অন্যের পরিষেবা নেবে?

তার সবটাই মা করে দেয়। কিন্তু অন্য বাড়ির মেয়ে এসে এসব করবে কেন? কতদিনই করবে? সুতরাং এ সত্যের মুখোমুখি তাকে হতেই হতো। সেটা কাল না হয়ে আজ হয়েছে, এটাই তো। কিন্তু সেটাই সত্যি। ঘষে ঘষে এগিয়ে এলে পোটের কাছে।

"তুমি ঠিকই বলেছ বউমা। ভিখিরি সে আবার অন্যকে দয়া করবে কী করে? এই তো তোমাদের দয়ায় দিন কাটাই… তো-তোমার আছ বলেই আজও… থাক ওসব কথা। এটা কিন্তু ঠিকই বলেছ, ভিখিরির মরণ হওয়াই ভালো।"

"কোথায় চললি খোকা?" কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে এলেন বুচনের কাছে। ধরতে চাইলেন। কিন্তু বুচন আটকে দিল।

"থাক মা, একাই নামতে পারব। কতদিন আর অন্যের ভরসায় জীবন কাটাবো বলতো?"

বলতে বলতে নেমে এল উঠোনে। ঠাকুর ঘরের দিকে একবার মুখ ফিরিয়ে দুহাত তুলে প্রণাম করল। এগিয়ে গেল সদর দরজার কাছে। হাত বাড়িয়ে টেনে নামল টায়ার কাটাটাকে। চড়ে বসল সেটায়। বেল্টটা পেঁচিয়ে বাঁধতে গিয়ে পিছনে হাতটাই যেন পৌঁছাতে চাইছে না আজ। বুচনের মা দৌড়ে এলেন। কিন্তু বুচন কিছুতেই হাত দিতে দিল না। অন্যদিন হলে তার মাই-ই টাইট করে বেঁধে দিত। আজ দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন কিন্তু হাত দিতে পারলেন না।

রাস্তায় নামল বুচন। অন্যদিন তবু কিছু খেয়ে বেরত। আজ এই প্রথম খালি পেটে রাস্তায় বেরল। হঠাৎ বাপন দৌড়ে এল। "জ্যেঠু, ও জ্যেঠু…?" ঘুরে তাকাতে ইচ্ছে করল না বুচনের।

পিছন থেকে বাপন এসেই গলা জড়িয়ে ধরল ছোট্ট হাতে। "জ্যেঠু, আমার জন্য খাবার আনবে কিন্তু। বেশি করে। এই এত্ত খাবার। মনে থাকবে?"

গলা ছেড়ে দিয়ে হাত দিয়ে পরিমাণ দেখাচ্ছে।

গলা ভারী হয়ে আসছে বুচনের। কান্না ভেজা গলায় বলল, "ফিরলে ঠিক নিয়ে আসব বাবা।"

সকালের নরম রোদ্দুর এসে পড়েছে মাটির রাস্তায়। অন্যদিন একটা টোটো এসে নিয়ে যেত বুচনকে। আজ বেরবে না বলে, তবুও বেরল। এগিয়ে চলল মেইন রাস্তার দিকে। পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন বুচনের মা। তাঁর কানে আসছে সড়ড়ড়… সড়ড়ড়…

কিছুক্ষণ পরে ঝাপসা হয়ে গেল তাঁর চোখ। ধুলোর চাদর গায়ে মেখে এগিয়ে চলল বুচন। সকাল সকাল দরজায় দাঁড়িয়ে চোখের জলে অন্তর্যামীকে প্রণাম করলেন তিনি।


(২)

টোটোয় চেপে বসেছে বুচন। কী করবে সে এখন? নিজেকে খুব, খুব অসহায় মনে হতে লাগল হঠাৎ। কাদের জন্য সে এতদিন করে মরল? রোজ রোজ লোকের কাছে হাত পেতে চাইল? এতে কি তার একটুও লজ্জা হত না? আর পাঁচজনের মতো তার কি আত্মসম্মানবোধ নেই নাকি? আছে বলেই তো প্রথম যেদিন এই লাইনে আসে, হাত পাতে, সেদিন উপার্জন ভালো হয়নি তা নয়, হয়েছে। কিন্তু রাতে ঘুমোতে পারেনি। মানুষের করুণার দান যতবার তার হাতে ঝনঝন করে উঠেছে, ততবারই আত্মসম্মানে অন্তঃকরণ বিগলিত হয়েছে অনুতাপে অনুতাপে। পয়সার প্রতিটা ঝংকারে সে যেন শুনতে পেয়েছে, "ভিখিরি… ভিখিরি… ভি-খি-রি…"

কিন্তু কাঁচা পয়সার টান অমোঘ। যে কেউ তার পদলেহন করতে প্রস্তুত। আর তার জন্য কেউ কেউ আবার আত্মসম্মান বিকিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। বুচন তো কোন ছার ! তার আত্মসম্মান তাকে যতখানি না তাড়িয়েছে, তার থেকে বেশি উপযোগী করে তুলেছে তার যুক্তিবাদী মন। কি বা করার আছে তার? উপার্জন করা তো দূরের কথা, অন্যের গলগ্রহ হয়ে তার বেঁচে থাকার কথা। সেই কিনা উপার্জন করছে? সেই কিনা টাকা এনে তুলে দিচ্ছে মায়ের হাতে?

প্রথম যেদিন ভিক্ষে করে এনে পুরো টাকাকা তুলে দিয়েছিল মায়ের হাতে।মায়ের চোখ খিলখিল করে উঠেছিল হলুদ বাল্বের তলায়। আনন্দে তাঁর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে এসেছিল সহজেই। কোনোদিন কল্পনা করেননি যে অক্ষম, অসমর্থ, পঙ্গু ছেলেই তাঁর হাতের পাঁচ হয়ে উঠবে একদিন। টাকাগুলো বুকের কাছে চেপে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিলেন, "কোনোদিন ভালো করে খেতে দিতে পারিনি তোকে। কত লোকের লাঠি-ঝাঁটা খেয়েছিস। দুবেলা দুমুঠোর জন্য লোকে কত কী বলেছে। ঠাকুরের কাছে কত কেঁদেছি। শোনেনি…

একটু থেমে চোখের জল মুছতে মুছতে আবার বললেন, "কী কপাল দেখ আমার? শেষ পর্যন্ত তোকে ভিখিরি বানিয়ে ছাড়লুম। হা ঈশ্বর, তুমি আমাকে ক্ষমা করো ঠাকুর, ক্ষমা করো…"

বুচনের চোখ ছলছল করে উঠেছিল। সারাদিনের কষ্ট, আত্মসম্মান, অভিমান জাঁকিয়ে বসেছিল বুকে। কিন্তু তার মা'র হাহাকার, ভাই-বোনদের মুখগুলো কেমন যেন সেই ভারকে নামিয়ে দিল সহজে। ভেতরে ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করলেও, একাকীত্বের কাছে হার মানল সে। চোখের ধারাও সঙ্গী হল তার। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে তৈরি হতে লাগল ভিখিরির সত্তায়।

সেদিন বুচনকে যেন বেশি বেশি যত্ন করতে শুরু করে দিল সবাই। মা, ভাই, বোনেরাও। অন্যদিন খেতে বসার জন্য কেউই অপেক্ষা করত না। মা'র সঙ্গে খেতে বসত, সবার শেষে। খুব, খুব অসহায় লাগত তখন। অবসাদ চেপে বসছিল শরীরে শরীরে। কোনো কোনোদিন মনে হতো, "রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। করুণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে পালিয়ে বাঁচি।"

একদিন গভীর রাতে চুপিচুপি এসে বসেছিল ভোলা মোড়লের বাগানবাড়ির শান বাঁধানো চাতালে। কালো জলের দিকে তাকিয়ে বসেছিল অনেকক্ষণ। মায়ের জন্য মনটা দুর্বল হয়ে পড়ছিল ছিল বারবার। গাছ-গাছালি সেই মুহূর্তের জন্য উপাচার সাজিয়ে রেখেছে। কালো জলে তার শরীরটা ভেসে উঠলে তবেই তারা, তাদের গম্ভীর রূপ ত্যাগ করে

আনন্দ ছড়িয়ে দেবে পাতায় পাতায়, ডালে ডালে। বুচনও যেন সেই ইঙ্গিত পাচ্ছিল। তাই আর অপেক্ষা করেনি সে। গড়িয়ে পড়েছিল শেষে। পাক খেয়ে খেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। পিছন থেকে একটা পরিচিত ডাক ভেসে আসছে কানে, "ওরে থাম… থাম বলছি… থাম… খো…"

ধাপের পর ধাপ। বুচনের মাথাটা যেন ঝিঁ ঝিঁ করছে আঘাতে।

জলে পড়েছিল সে। তারপর আর তার কিছু মনে ছিল না।

সেই থেকে চোখে চোখে রাখত তার মাই-ই। কিন্তু করুণা ঝরে পড়ত সবার থেকে। আজই যেন বদলে গেল তার সবকিছু। ক'টা টাকাই যেন তাকে অনেকখানি মূল্যবান করে তুলেছে হঠাৎই। বুচনের সেটা বুঝতে বাকি থাকেনি আর। সারাদিনের পদদলিত আত্মসম্মানকে বিছানা থেকে তুলে টেনে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছিল খাবার জায়গায়। সংসারে তার যেন গুরুত্ব বেড়ে গেল ক'টা টাকায়।

সব কিছু মেনে নিলেও রাতের একাকীত্ত্বের বিছানায় হার মানল সে। চোখের জলে বালিশ ভিজল তার। হঠাৎ এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল, পুরোপুরি ভিখিরি হবার জন্যে।

"আরে এই খোকা? খোকা? ওঠ… আর কত ঘুমাবি? ওঠ রে…"

বুচন চোখ ঘষতে ঘষতে তাকিয়ে দেখে পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে আছেন তার মা।

"ওঠ দেখি। চোখ ধোও… চা হয়ে গেছে। গেলে কি খালি পেটে যাবি নাকি? মুখে কিছু না দিয়ে বাইরে যেতে নেই। এতে অমঙ্গল হয়। যাওয়ার আগে কিছু খেয়ে নে, ওঠ…"

শেষের কথাগুলোয় বুচনের অন্তরাত্মা হেসে উঠল গোপনে। অভাব, সংসারের অসচ্ছলতা, প্রিয় মানুষগুলোর একটু ভালো থাকা, হঠাৎই তার আত্মসম্মানকে টুঁটি টিপে মারল। একটা ছাপ মেরে দিল গোপনে… 'ভিখিরি'। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বুচন পা বাড়িয়ে ছিল পেশাদার ভিখিরি হতে, সকালেই।

কয়েক বছরের ভিখারি-জীবন তার। এখন রোজগার তার অনেক। বুচনের কথায়, "বাজার ভালো থাকলে দিনে সাত-আটশ তার হাতের খেল।"

তবে এ বুচনের হাতের খেল কী করে হয় জানি না, কিন্তু এ খেল মানুষের করুণার। এ খেল মানুষের সহানুভূতির। আর তার জোরেই বুচনদের দিন বলদায়। টালির চাল উঠে গেছে অনেক আগে। ছাদ উঠেছে মাথার উপর। ল্যাম্পের হলুদ আলোর জায়গায় এখন সাদা আলো। টিভি, ফ্রিজ কী নেই তাদের ঘরে?

দেখতে দেখতে দুটো বোনের বিয়ে দিয়েছে। ছোটো ভাইটাকে একটা দোকান কিনে দিয়েছে বাজারে। মুদিখানা দোকান করেছে সে। দাদা অন্ত প্রাণ তার। একদিন সেখানেও ভাঁটা পড়ে, বিয়ের মাস তিনেক পর। আখের গোছাতে শুরু করে পুচাই। সংসারের খরচ থেকেও হাত গুটায়। বলতে গেলে দেয়ই না। কত রকমের বাহানা তার। ব্যবসা ভালো নেই। ধার-দেনা ইত্যাদি।

সত্যিই সত্যিই তা একদিন প্রকাশ্যে আসে। মাঝরাত। পুচাই এল বুচনের ঘরে। সবাই ঘুমাচ্ছে। তাকে দেখে হকচকিয়ে গেল বুচন, "কি-কি হল রে? এত রাতে?"

একেবারে পা জড়িয়ে ধরার মতো, ঝাঁপিয়ে পড়ল, "দাদা, তোর পায়ে ধরি। আমাকে বাঁচা। নাতো দোকানটা আমাকে বেচে দিতে হবে।"

"আরে কেন? হয়েছেটা কি?"

"মহাজনরা আমাকে একমাস সময় দিয়েছে, ধার শোধ করার জন্য। আমি এত টাকা কোথায় পাব? না, দিতে পারলে আমি আত্ম-হত্যা করব, দেখিস।"

"এসব কী বলছিস? দেনা হল কী করে?" উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল বুচন। কিন্তু উত্তর দিতে গিয়ে চুপ করে রইল পুচাই।

"কি রে বল? চুপ করে রইলি যে?"

মাথা নিচু করে রয়েছে। বুচনের চোখে চোখ রাখতে পারল না। "দিলে দে… সে আমি কথা বলতে পারব না কিছুতেই। জোগাড় করতে না পারলে, মরব…"

"থাম, কী যা তা বলছিস? কারা পাবে? তাদের সঙ্গে কাল আমাকে একবার দেখা করিয়ে দে। এখন যা, গিয়ে শুয়ে পড়। যা…"

বিকেল হতেই বুচন দোকানে। পাওনাদার সকলেই হাজির। তাকে দেখেই চমকে ওঠে সবাই। হাত জড়ো করে তাদের কাছে মিনতি করে বুচন, "আমাকে একটু সময় দিন দয়া করে। আমি সব টাকা মিটিয়ে দেব আপনাদের।"

একজন ইতস্ততঃ করতে করতে বলে ফেললেন, "মাপ করবেন আমাকে। আপনি…"

"হ্যাঁ, আমি ওর দাদা। একটু সময় না দিলে ভাইটা আমার হয়তো…"

"না, না, আপনাকে…"

"দয়া করুন সবাই। নইলে…"

"প্ল্যাটফর্মে ভি-ভিক্ষে করতে…"

"হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছেন। আসলে আমিই ওকে দোকানটা কি…" বলতে গিয়ে আটকে গেল বুচন। এ কথা বললে যে ভাইয়ের অসম্মান হবে। তাই আবার ঘুরিয়ে বলল, "কিভাবে চলছে খোঁজও নেয়নি কোনোদিন। ও তো একাই সংসারের হাল ধরে রেখেছে। বেচারা একা আর কতদিকে টানবে বলুন তো? বোনেদের বিয়ের খরচ সব ওই করেছে। এত টাকা কোথা থেকে এল জানতে চাইনি কেউই। কোনোদিন মুখ ফুটেও বলেনি। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি টাকা কোথা থেকে এসেছে। সবই আপনাদের দয়া। নইলে এতদিন কি টাকা ফেলে রাখতেন, বলুন? ওকে একটু সময় দিন। ঠিক শোধ করে দেবে।"

সবাই উঠে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলেন সবাই। একজন বলেই ফেললেন, "শুধু আপনার দিকে তাকিয়ে ওকে সময় দিলাম। মনে থাকে যেন?"

"ধন্যবাদ আপনাদের। কথা দিচ্ছি, ও যত তাড়াতাড়ি পারে শোধ করে দেবে।"

পুচাই অবাক হয়ে তাকিয়ে শুনছিল দাদার কথা। কী বলছে এসব? সংসারের হাল কবেই বা ধরেছে সে? দেনায় দেনায় সে জেরবার? সে নাকি বোনেদের বিয়ের খরচ দিয়েছে? সে যাই হোক, এত টাকা সে দেবে কোথা থেকে? চটে গেল দাদার উপর। মুখ খিঁচিয়ে উঠল "তোর মাথার ঠিক আছে তো? এত টাকা আমি পাবো কোথায়?"

ম্লান হয়ে গেল বুচন মুখ, "ও তুই ভাবিস না। ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে। তোকে কিছু দিতে হবে না।"

প্লাটফর্মে আগের থেকে বেশি বেশি করে সময় দিত বুচন। ফেরার পথে ঘুরে যেত দোকান হয়ে। পাওনাদারদের আসাও বন্ধ হল একদিন। হাসি ফুটল পুচাইয়ের।


(৩)

ততদিনে পুচাই বাপ হয়ে গেছে। বোনেরাও এ বাড়ি মাড়ায় না খুব একটা। খুব দরকার না পড়লে এ বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষেও না কেউই। এখানে আসতে তাদের নাকি লজ্জা করে। পথে-ঘাটে তাদের নাকি মান-সম্মান যায়, বুচনের জন্য। ছোটো বোনটা সেদিন বাড়িতে এসে দু'কথা শুনিয়ে গেল মাকে।

অনেকদিন পর মেয়েকে দেখে আহ্লাদে উৎফুল্ল হয়ে উঠে ছিলেন বুচনের মা। সদর দরজার কাছে এগিয়ে গিয়েছিলেন মেয়ের জন্যে। কিন্তু তাঁকে দেখামাত্রই ঝাঁঝিয়ে উঠল তুতুল, "দাদার জ্বালায় কী আমরা কোথাও মুখ দেখাতে পারব না? শ্বশুর বাড়ির একগাদা লোকের সামনে মাথা হেঁট করে দিল একেবারে। এসে কিনা হাত পাতছে আমার কাছে?"

সব উচ্ছ্বাস মিইয়ে গেল হঠাৎ। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন মেয়ের কথা শুনে। কিন্ত ঝাঁঝ কমল না তুতলের, "ঢঙের মতো দাঁড়িয়ে রইলে যে? ডাকো ভিখিরিটাকে। ওর জন্যে আর কত অপমানিত হব? লোকজনের কাছে মুখ দেখাতে পারি না। খবরদার বলছি, এর পর যেন ও আমাদের সামনে না আসে?

ফরফর করে চলে যাচ্ছে তুতুল। পিছন থেকে তার মা ডাকতে গিয়ে যেন ডাকতে পারলেন না। কথাগুলো আটকে গেল সংকোচে, "বলি, ও তু… "

বারান্দা থেকে তাঁর কানে এল, "মা, কেন ডাকছ ওকে? শত ডাকলেও ফিরবে না ও। এই দেখো, শুধু শুধু কাঁদছ? সবই আমার বরাত মা। তুমি ঘরে যাও।"

হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন, "বেইমান কোথাকার? সব, সব বেইমান। ভগবান ওদের ক্ষমা করবে না কোনোদিন, এই বলে রাখলুম।"

"জানো তো মা, সেই তুতুল, যে দাদা দাদা করে হামলে পড়ত। যাকে কোলে নিয়ে গান না গাইলে ঘুমাতই না, সেই দেখো, আজ ভিখিরি বলে অপমান করে গেল!"

গলা ভারি হয়ে এল বুচনের। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে কোলের উপর। তবুও বলে চলল, "আবার আমার জন্য সবাই নাকি মু-মুখ দেখাতে পারে না? জানো তো মা, সেদিন পু-পুচাইও বলল, আমি যেন ওর দোকানে না যাই। এতে নাকি ওর-ও সম্মান যায়। কেন যে সেদিন পুকুর থেকে তুলে এনেছিল! ভালোই হতো যদি জলে ভেসে উঠতুম। তোমরা হয়তো একটু কাঁদতে। তারপর ভাবতে, যাই হোক আপদ তো গেল। তাই না?"

"চুপ কর তুই… চুপ কর… এই বয়সে আমি এসব নিতে পারছি না আর। কেন নিজেকে এত হেয় করছিস? তুই না থাকলে আমরা, আমরা সবাই ভেসে যেতুম।" কাঁদতে কাঁদতে কাছে এলেন বুচনের। আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে দিতে দিতে আবারও বললেন, "চল না খোকা, আমরা কোথাও চলে যাই। যেখানে এদের ছায়া পড়বে না। সেখানেও নয় তুই ভিক্ষে করবি। পারবি না বাবা?"

"কিন্তু এসব ছেড়ে, এদের ছেড়ে, কি বলছ মা?"

"ওরে ঠিকই বলছি। আমি আর কৎদিন? চোখ বুঝলে, তোকে দেখবে কে? এটা ভাবলে আমার…"

"এত ভেবো না মা। কেউ না থাকলে আমার প্ল্যাটফর্ম তো আছে। ঐ তো বাঁচিয়ে রেখেছে এতদিন। ঐ-ই বাঁচিয়ে রাখবে।"

সেই প্ল্যাটফর্মই আজ তার প্রাণ-ভ্রমরা। আপন করে নিয়েছে তাকে। ভরিয়ে দিয়েছে তার সংসার। অভাবের ফাঁক-ফোকরগুলো পূরণ করে দিয়েছে দিনে দিনে। কিন্তু চাহিদা বেড়েছে আগের থেকে। বুচনের চাহিদা? না না, ওর চাহিদা কোনোদিনই ছিল না। চাহিদা যা, সে তো ওর ভাই-বোনেদের। চাহিদা মেটাতে মেটাতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাদের। প্রাণান্ত হয়ে উঠেছিল তারা। আঁকড়ে ধরে রেখেছিল সবাইকে। আজ তারাই সরে সরে গেছে বুচনের থেকে। যাদের জন্য তার ভিখিরি হওয়া, তারাই তাকে দূর করে দিয়েছে দিনে দিনে।

আজ সকালে ছোটো ভাইয়ের বউ তা আরো স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে, অক্ষমের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই শ্রেয়। বাড়ি থেকে আজ আসার সময় সেই কথাগুলো বুকে বিঁধ ছিল ঠিকই, কিন্তু ততখানি নয়, যতখানি এখন এই প্ল্যাটফর্মে এসে হচ্ছে। যতই সে ভাবছে ততই জর্জরিত হচ্ছে। বাড়ির টান কমছে ততই। এতদিন বাড়ি ফিরত শুধু পাপন আর মায়ের জন্যে। কিন্তু সে রাস্তাটুকুও যেন ধীরে ধীরে সংকীর্ণ হয়ে উঠেছে। সব পথ যেন রুদ্ধ গেছে তার। মায়ের কথা মনে পড়তেই চোখ ঝাপসা হয়ে গেল তার।

মনটা হঠাৎ ভিন্ন সুরে গাইতে শুরু করেছে, "ঝাঁপিয়ে পড় লাইনে। সব… সব ঠিক হয়ে যাবে নিমেষেই। কারোর জন্য কষ্ট হবে না। তোর জন্য সম্মান যাবে না কারোর। তুইও শান্তি পাবি। হাত পাততে হবেনা কারোর কাছে। ঝাঁপা লাইনে…"

শরীরও যেন সায় দিচ্ছে সে কথায়। হাতও যেন নেচে উঠছে ট্রেনের আওয়াজে। জুতো দুটো গলিয়ে নিল হাতে। টায়ারের সঙ্গে আটকানো বেল্ট শক্ত করে বেঁধে নিল কোমরে। হাত ফেলল… ঘষ… ঘষ…

"কিরে কোথায় চললি? টাকাগুলো নে। আরে এই বুচন? আমার ট্রেন আসছে রে… নে ধর… এই-ই বুচন?'

ট্রেন ঢুকছে দু'নম্বরে। বুচন এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকে। এমনিতেই শীত। সারা শরীর তার ঘামছে দরদরিয়ে। সমাদ্দার বাবুর কথা যেন কানেই ঢুকছে না তার। বাঁচতে চায় সে। মরে বাঁচতে ক'জনই পারে? বুচন আজ নতুন করে বেঁচে দেখাবে। তাকে বাঁচতেই হবে।

"এই বুচন, কত ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না?" কাঁধে হাত পড়ল তার। হকচকিয়ে গেল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল গার্ডের দিকে।

"এই নে ধর… টাকাগুলো না নিয়ে চলে যাচ্ছিস যে বড়ো? ট্রেন এসে গেছে। ধর।" বলতে বলতে টাকার প্লাস্টিকটা ফেলে দিলেন তার কোলে। দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন সমাদ্দারবাবু। ঘন্টা বাজিয়ে একবার মুখ বাড়ালেন বুচনের উদ্দেশ্যে, "বাড়ি যা আজ, তোর ভাবগতিক ভালো নয়। বুঝলি?"

প্লাস্টিকের ব্যাগটা কোমরে গুঁজে নিল বুচন। চেটোর হাইই-চপ্পল দুটো নড়ে উঠল। ঘষতে ঘষতে ভিড় কাটিয়ে পঙ্গু শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলল কোম্পার্টমেন্টের কাছে। কয়েকজন মিলে তুলে নিল বুচনকে।

এই প্রথম ট্রেনে চাপল সে। চলতে শুরু করল ট্রেন। কয়েকটা মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল। মিলিয়ে গেল আবার। ঝাপসা হয়ে গেল সব।
0

গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in







‘গ্রান্ডপা, স্কুলে আমাদের সবাইকে নিউ ডায়েরী দিয়েছে।’
‘বাঃ, খুব সুন্দর তো!’
‘এখানে নেম অ্যাড্রেস সব রাইট করে নিতে বলেছে। আমি সবকিছুই রাইট করে নিলাম। শুধু ……..’
‘শুধু কি?’
‘এই পার্মানেন্ট অ্যাড্রেসের জায়গাটা ব্লাঙ্ক রেখেছি। এখানে কি লিখবো? আমাদের ছত্তিশগড়ের হোম-অ্যাড্রেস, না কি ক্যালকাটার অ্যাড্রেস?’

দাদু ক্লাস ফাইভে পড়া নাতির দিকে একটু চেয়ে রইলো। তারপর একটু হাসলো। - ‘আমাদের পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস কোনটা? দাদুভাই, সেটা তো আমিও জানি না!’‘পাপা তো বলে, আমার গ্রান্ডপা অনেক কিছু জানে!’
‘সোনাভাই, আমি জন্মে ছিলাম পূর্ব পাকিস্থানে, তখন সেটাই আমার পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস। তারপরে এলাম এপার বাংলায়, বনগাঁতে। সেখান থেকে কোলকাতা – তখন কোলকাতাই আমাদের ঠিকানা। তার পরে চাকুরী নিয়ে উড়িষ্যার ভূবনেশ্বরে। সেখান থেকে ফিরে আবার এলাম কোলকাতায়, গড়িয়াতে বাড়ি বানালাম। ভেবেছিলাম সেটাই পার্মানেন্ট। তারপরে তোর বাবার চাকুরীর সাথে সাথে আমরা গুজরাটে, আর এখন আছি ছত্তিশগড় – এটাই আমাদের অ্যাড্রেস। আসলে জানিস তো? মানুষের অ্যাড্রেস বদলাতেই থাকে – সেটাই মানুষের নিয়তি। দশ বছর বাদে কে কোথায় থাকবো, সেটাও অজানা!’
‘সে তো বুঝলাম। কিন্তু, ডায়েরীর এই জায়গাতে কিছু রাইট না করে যদি ব্লাঙ্ক রাখি? ক্লাস টিচার তো আমাকে ডাটবে!’
‘ওই জায়গাটা ফাঁকাই রেখে দে। তোর টিচারকে বলিস, লোকেদের পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস বলে কিছু হয় না।’
0

কবিতা - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in






কোন জাতির জীবনে তাকেই আমরা চরম দূর্যোগের সময় বলে থাকি যখন মামুষের মধ্যে আত্মিক বন্ধন, নীতি ও আদর্শের অভাব দেখা যায়। এমনই এক সন্ধিক্ষণে জন্নম গ্রহণ করেন ভগবান বুদ্ধ। তাঁর প্রেম ও আদর্শের বাণী প্রাণিত করেছিল সকল স্তরের মানুষকে। বুদ্ধের নীতিনির্ভর জন্মকাহিনির সংকলন যাকে বলা হয় ’জাতক’সেই মহাগ্রন্থ থেকেই নেওয়া হল তাঁর দুটি পূর্বজন্মের কাহিনি।প্রকৃতপক্ষে ‘জাতক’ হল বুদ্ধের পূর্ববর্তী জন্মের গাথা ও কাহিনির সংকলন। সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে—‘জাতক’ প্রাচীনতম গল্প সংকলন। প্রায় পাঁচশোরও অধিক গল্প আছে এতে। কিন্তু শুধু কাহিনিই নয়, এই কাহিনিগুলিতে পাওয়া যায় তৎকালীন ভারতবর্ষের সামাজিক রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার ও জীবনযাপনের চিত্র। লক্ষ্য করলে দেখা যায় কাহিনিগুলিতে পাঁচটি বিভাগ বা স্তর আছে। সূচনাপর্ব, মূলকাহিনির বর্ণনা, প্রাচীন উপকরণ, গাথা বা কাহিনিগুলির অর্থ এবং বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তার ব্যাখ্যা। কিন্তু যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল জাতক থেকে প্রাপ্ত নৈতিক শিক্ষা। শীল-অশীল, উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায় এগুলি বোধগম্য হয় সহজেই।

আসন্ন বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে ‘জাতক’ থেকে দুটি কাহিনি কবিতা বা ছন্দের আকারে বর্ণনা করার দুঃসাহস হয়েছে নিছক আনন্দের তাগিদে। পাঠকের ভালো লাগলে কৃতজ্ঞ থাকব।
‘জাতক’ কাহিনিমালা থেকে কবিতায় রূপান্তর পর্যায়ে গৃহীত হয়েছে দুটি কাহিনি —‘অশ্বজাতক’ ও ‘সুবর্ণহংসজাতক’।

.

১) মঙ্গলাশ্ব ( ‘অশ্বজাতক’ থেকে)


পুরাকালে সিন্ধুদেশে ছিল এক অশ্ব
নাম অজানেয়
শৌর্যে-বীর্যে অতি পরাক্রম, শক্তি অপরিমেয়

ক্রমে অশ্ব আসি পঁহুছিল বারাণসী ধামে
ব্রহ্মদত্ত রাজার আলয়
খ্যাতি বর্ধিত হইল তাহার মঙ্গলাশ্ব রূপে
পাইল সকলের বড়ই আদর
অকস্মাৎ একদিন সাত জন রাজা
করিল আক্রমণ বারাণসী রাজে
কহিল—যুদ্ধ কর, নতুবা দিব দখল
তোমার সাম্রাজ্যে।‘
হইল শলা-পরামর্শ মন্ত্রণাসভায়
অজানেয়-অশ্বারোহী কহিল ফুকারি--
আছে মোদের মঙ্গলাশ্ব অজানেয় নাম
যদি অনুমতি দাও রাজন্‌ পরাইতে যুদ্ধসাজ
ফেলিব ভূতলে ওই সপ্ত তরবারি’
ক্রমে ক্রমে অশ্বারোহী অজানেয়রে লয়ে
জিনিলেন ষষ্ঠরাজা, আনি দিলা ষষ্ঠ তরবারি
রাজার চরণে
ক্লান্ত, শ্রান্ত অজানেয় বুঝি আর নাহি পারে
হইবে কি তবে হার বারাণসীরাজের এক্ষণে?
ফেলি দিয়া সব ক্লান্তি, উঠিল অজানেয়
আবার পরিল যুদ্ধসাজ
দ্বিগুণ তাহার শক্তি হইল অপরিমেয়
অশ্বারোহী জিনিলেন সপ্তমরাজারে, তরবারি লয়ে রাজদরবারে
কহিলেন—প্রণতি হে রাজ!’
রক্তাক্ত দেহ, ক্লান্তিতে জরোজরো অজানেয় দাঁড়াইল আসি
রাজার সমুখে
অশ্বারোহী খুলি দিল যুদ্ধসাজ দেহ হতে তার

রাজার মঙ্গলাশ্ব ত্যাজিলেন প্রাণ হাসিমুখে
বীর বিক্রমে
শিক্ষা নিল রাজ-মন্ত্রী-মহারথীগণে
অজানেয়রূপী বোধিসত্ত্ব হতে
অগ্রে কর্মসম্পাদন তাহার পর মৃত্যুবরণ
ইহাই যথার্থ ধর্ম আপনার চিতে।




২) অথ সুবর্ণহংস কথা (‘সুবর্ণহংস জাতক’ থেকে)


ব্রহ্মদত্ত রাজা ছিল বারাণসী ধামে
ব্রাহ্মণকুমার রূপে বোধিসত্ত্ব তথায় জন্মে।
আছিল তিন কন্যা তাহার রূপ-গুণবতী
নন্দা, সুন্দরীনন্দা আর নন্দাবতী।
যথাকালে ব্রাহ্মণ বোধিসত্ত্ব গতি প্রাপ্ত হইলা
পুনরায় সুবর্ণহংস রূপে তথা জনম লইলা।
রমণীয় দেহ হংসের গাত্রে সুবর্ণ পালক খচিত
অকস্মাৎ পূর্ব স্মৃতিতে উদ্বেল হইল যে চিত।
দরিদ্র ব্রাহ্মণের ছিল দরিদ্র ব্রাহ্মণী
তিনটি কন্যা ছিল তাহার রূপেতে লাবণী।
কন্যাগুলি মাতাসহ এক্ষণে দাসীবৃত্তি করে
সুবর্ণহংস ভাবে দারিদ্র্য ঘুচাবে কিরূপে?

আছে স্বর্ণপঙ্খ মোর না জানে তাহারা
প্রতিদিন বেচিলে মুদ্রা পাইবে উহারা।
ধন পাইবে রাশি রাশি দারিদ্র্য ঘুচিবে
প্রত্যহ একটি করি যদি পালক তথা দিবে।
এত ভাবি সোনার পঙ্খ একটি করিয়া
হংস দেয় ব্রাহ্মণীরে শতেক চিন্তিয়া।
প্রতিদিন স্বর্ণপঙ্খ পাইয়া ব্রাহ্মণী
লোভে কাতর হইলা সে পাইতে সকলই।
কন্যাদের সঙ্গে মাতা করে আলোচনা
হংসের স্বর্ণপঙ্খ উৎপাটিতে বড়ই বাসনা।
একাধিক স্বর্ণমুদ্রা পাইলে একসাথে
ত্বরিতে ঘুচিবে দশা সন্দেহ নাই তাতে।
পিতার দুর্দশা ভাবি কন্যাগণ নিষেধ করিল
লোভী ব্রাহ্মণী কথা কিছু না মানিল।
অগোচরে একদিন ব্রাহ্মণী হংসেরে ধরিয়া
আছে যত স্বর্ণপঙ্খ নিল উৎপাটিয়া।
বিস্ময়ে চাহিয়া দেখে পতিত স্বর্ণপঙ্খের স্তুপে
নিমেষে পরিণত তাহা শ্বেতহংস পালকে।
হায় হায় করি রমণী হংসে লুকায়ে রাখে
হংসে রাখি জালার ভিতর উপরেতে ঢাকে।
কিয়ৎদিন পর হংসের পুনঃ পালক জন্মিল

কিন্তু তাহা শ্বেতপঙ্খ, স্বর্ণ না হইল।
সুযোগ বুঝিয়া হংস সংসার ছাড়িল
গেল কোনখানে তাহা কেহ না জানিল।
যাহা আছে তাহাতে যদি না ভরে চিত্ত
অতি লোভে ব্রাহ্মণীর দশা পাইবে নিশ্চিত।
0

কবিতা - অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়

Posted in







জীবনের বায়নাক্কা খুব।
এটা চা‌ই—ওটা চা‌ই—
আমাকে ক্লান্ত করে দেয়।

মৃত্যুর কোন চাহিদা নে‌ই।
শূন্য শ্মশানে পড়ে থাকে একা—
1

কবিতা - ঝানকু সেনগুপ্ত

Posted in







কক্ষচ্যুত হয়ে সমস্ত ভারতবর্ষের ইতিহাসে
একটি আশ্চর্য ডানা গজিয়েছে
মাটি থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে।
উড়ে যাচ্ছে, আকাশ ছাড়িয়ে দিগন্তে

সূর্য ওঠার শব্দ আর নেই!
চারিদিকে অন্ধকার।
অরাজনৈতিক কোলাহলের জট খুলতে গিয়ে
আরও প্যাঁচে জড়িয়ে পড়ছি।

কোথাও একটা নামতা পড়া হচ্ছে
পন্ডিত মশাই ঝিমোচ্ছেন
নদীতে এখন ভাটার টান বলে
নৌকার পালে হাওয়া।
দুর্জনের মতে কক্ষচ্যুত হলেও

এটাই তো উন্নয়নের ছোঁয়া!
0

কবিতা - শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in
তোমায় যদি হাতছানি দিই, এগিয়ে এসো তুমি
ফাগুন বিহন জীবন যাপন ঊষর মরুভূমি ।

তোমায় যদি ছুঁই কখনও, আমার হাত ধোরো
একলা আমি অন্ধকারে বড্ড জড়সড় ।

তোমার ঠোঁটে ঠোঁট ডোবালে, নাই বা বাধা দিলে
না নিয়ে যাক বোয়াল মাছে, ছিপ নিয়ে যাক চিলে ।

বিছন যদি বুনতে চাই, মাটিতে হোয়ো লীন
সবুজ হয়ে বাঁচতে চাই, অনেক অনেক দিন ।

তোমার চোখে স্বপ্ন দেখা সাঙ্গ হলে তারই
বৃষ্টি মেখে দিগ্‌বলাকায় হারিয়ে যেতে পারি ।

0

ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

Posted in









ডিমের চপ

হাঁসের ডিম হলেই বেশী সুস্বাদু হয়। ডিম সেদ্ধ করে দুই বা চার ভাগ করে কেটে রাখতে হবে। আলু সেদ্ধ করে, তাতে ভাজা মশলার গুঁড়ো, শুকনো লঙ্কার কুচি বা গুঁড়ো, নুন, সামান্য মিষ্টি আর বেশ পরিমান আদা বাটা দিয়ে ভালো করে মাখতে হবে। এমনভাবে মাখতে হবে যেন, কোনো ডেলা হয়ে না থাকে। এরপর, হাতে সামান্য তেল লাগিয়ে আলু মাখা থেকে লেচি কেটে তার মধ্যে, কেটে রাখা ডিমের টুকরো রেখে, ভালোভাবে সব দিক দিয়ে মুড়ে নিতে হবে। এরপর পুরো ব্যাপারটা একবার ডিমের গোলায় ডুবিয়ে ও তারপর ব্রেডক্রাম্বে গড়িয়ে নিতে হবে। এটা কিন্তু দুইবার করে করতে হবে। অর্থাৎ ডিমের গোলা-ব্রেডক্রাম্ব-আবার ডিমের গোলা-ব্রেডক্রাম্ব। এইভাবে করে দুই হাতের তালু দিয়ে আলতো চাপে চপের সুন্দর আকারে গড়ে নিতে হবে। ডুবো তেলে ভেজে নিলেই রেডি ডিমের চপ। কাসুন্দ সহযোগে পরিবেশন।


1

সম্পাদকীয়

Posted in






অনেকদিন পর্যন্ত দিনটির অস্তিত্ব সন্ধান করতে পঞ্জিকার সাহায্য নিতে হতো অথবা হালখাতায় পাওয়া বাংলা ক্যালেন্ডারের বৈশাখ মাসের এই তারিখটির তলায় দেওয়া থাকতো দিনটির বিশেষ তাৎপর্যের সূত্র। এইমাত্র।

সত্যি কথা বলতে কী, হিন্দু পুরাণের আরেক মহানায়ক কৃষ্ণের জন্মদিনটি বরং উদযাপিত হয়ে এসেছে অনেক বর্ণাঢ্যরূপে। সেই বিচারে রাম যেন ছিলেন একটু ব্রাত্য। অন্তত বঙ্গদেশে তো বটেই। সে অবশ্য প্রাক অযোধ্যাপর্বে। রাম তখনও রাজনীতির ধারালো হাতিয়ার হয়ে ওঠেননি। বড় জোর বাঙালি সমাজ ঈষৎ দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন মধুসূদন-রচিত 'মেঘনাদবধ কাব্য' নিয়ে, যেখানে মহাকাব্যের এই নায়ককে 'আপন মনের মাধুরী মিশায়ে' অন্য চেহারায় হাজির করেছিলেন বিরল গোত্রের সেই স্রষ্টা।

কিন্তু সে ছিল সম্পূর্ণ বৌদ্ধিক এক শ্রেণীবিভাজন, যা নিয়ে তর্কের তুফান উঠলেও কখনও শোনা যায়নি অস্ত্রের ঝনঝনা!

অযোধ্যাকান্ডের পর সুকুমারী ভট্টাচার্য শাণিত এক নিবন্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন, কোন রামরাজ্যের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা? সর্বতোভাবে তা কাঙ্খিত তো?

সেই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর কেটে গেছে তিনটি দশক। ভারতবাসী হিসাবে নিজেকে এর চেয়ে বিপন্ন কখনও মনে হয়েছে কি? সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবৃক্ষটি সেদিন রোপিত হয়েছিল, আজ সেটি পূর্ণবয়স্ক। প্রতিনিয়ত এটি থেকে নির্গত দূষিত বাতাস গ্রাস করে নিচ্ছে সমগ্র চরাচর। রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে হাত ধরাধরি করে সেই কলুষমণ্ডলে শোভাযাত্রায় মগ্ন।

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in







আমাদের দেশের যে রাজ্যটি আয়তনের দিক থেকে বৃহত্তম তার নাম ‘রাজস্থান’। আর, এই রাজস্থানের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর হল ‘জয়পুর’। জয়পুরকে আমরা ডাকি ‘পিঙ্ক সিটি' বা ‘গোলাপী শহর’ বলে। কেন? ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় যে, ১৮৭৬ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস এবং মহারাণী ভিক্টোরিয়ার আগমন উপলক্ষ্যে গোটা জয়পুর শহরকে ও সেখানকার বেশিরভাগ ভবন বা ইমারতগুলোকে আতিথেয়তার রং গোলাপীতে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন সেখানকার মহারাজ রাম সিং। লর্ড অ্যালবার্ট প্রথমবারের মতো জয়পুরকে ‘পিঙ্ক সিটি’ বা ‘গোলাপি শহর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। সেই থেকে জয়পুর আমাদের কাছে ‘গোলাপী শহর’ হিসেবে পরিচিত। বলা হয়, আজও এই গোলাপী ঐতিহ্যকে বজায় রাখা হয়েছে। পুরনো জয়পুরের সমস্ত বাড়ির রং আজও গোলাপী রঙের এবং নগরবাসীও আইনতভাবে এই গোলাপী রং করতে বাধ্য হয়। সে যাই হোক, এক ‘গোলাপী শহর’ যে আমাদের দেশে রয়েছে তা নিয়ে আমরা সবাই বেশ গর্বই অনুভব করে থাকি। কিন্তু, বহুদূরের দেশের একেবারে পশ্চিম প্রান্তের এই গোলাপী শহরকে কেন্দ্র করে দেশের প্রায় পূর্ব প্রান্তের বিশেষত আমাদের বাঙালিদের গর্বের পরিমাণটা বেশি থাকা উচিত। কেননা, এই জয়পুর শহরের স্থাপত্যনকশা করেছিলেন যে একজন বাংলার মানুষ তথা বাঙালি— বিদ্যাধর ভট্টাচার্য।

বিধাতা ভট্টাচার্য ১৭শ শতাব্দীর শেষভাগে ১৬৯৩ সালে এই বাংলার নৈহাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সন্তোষরাম ভট্টাচার্য। বিদ্যাধর ভট্টাচার্য সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি গণিত, জ্যোতিষ (তখন জ্যোতির্বিদ্যাকেও জ্যোতিষ বলা হত), পূর্তবিদ্যা এবং রাজনীতিতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনি সদূর রাজস্থানের আম্বার বা আমের শহরে কনিষ্ঠ নিরীক্ষক হিসেবে কাজ পেয়েছিলেন। আর এই আম্বারে কাজ করার সময়ে তিনি প্রথম জয়পুরের মহারাজের সংস্পর্শে আসেন। মহারাজা সাওয়াই (বা সোয়াই) জয় সিং (দ্বিতীয়) বিদ্যাধরকে তাঁর নানা গুণের পরিচয়লাভ করে মন্ত্রীপদে নিযুক্ত করেন। জানা যায় যে, বিদ্যাধর রাজসভায় কোষাধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করতেন। তা একসময় মরুর শহর অম্বরে জলের সঙ্কট দেখা দেয় আর তার সাথে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দেয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যা। এরফলে, মহারাজা ঠিক করলেন যে তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করা হবে অম্বর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে যে এখনকার জয়পুরে। মহারাজা বিদ্যাধরের বাস্তু ও পূর্তবিদ্যার পারদর্শীতার ব্যাপারে জেনে জয়পুর শহর নির্মাণের জন্য অনুরোধ করেন। এই জয়পুর শহরই দেশের প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যে একটি এবং এর পাশাপাশি এই শহর দেশের প্রথম পরিকল্পিত শহর। প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য, জ্যোতির্বিদ্যা, বাস্তুবিজ্ঞান এমনকি বিদেশি গণিতজ্ঞ টলেমি ও ইউক্লিডের লেখা গাণিতিক বইগুলোর ব্যাপারে বিস্তর জ্ঞান রাখতেন বিদ্যাধর। সেখান থেকে উল্লেখিত জ্ঞান ও শহর গড়ার ব্যাপারে নানান পরিকল্পনা নিয়ে মহারাজা সাওয়াই জয় সিং (দ্বিতীয়)- এর সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ১৭২৭ সালে, প্রযুক্তি ও কৌশলগত পরিকল্পনার সাথে জয়পুর শহরটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। শহরটির প্রধান প্রাসাদ ও রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ করতে চার বছর সময় লেগে গিয়েছিল। পুরো শহরটাই নির্মিত হয়েছিল ভারতীয় শিল্পকলার শিল্পশাস্ত্রের রীতি-নীতি মেনে চলে। শহরের মডেল তৈরি করার জন্য তিনি শিল্পশাস্ত্র ও বাস্তুশাস্ত্রের বিভিন্ন নীতি প্রয়োগ করেন। পৃথিবীর বৃহত্তম মানমন্দির এবং নগর প্রাসাদ নির্মাণ করার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সমস্ত স্থাপত্যবিদ্যার জ্ঞান প্রয়োগ করেন। ভারতে কর্মরত একজন সুপরিচিত প্রকৌশলী এবং স্থপতি স্যার স্যামুয়েল স্নিন্টন জ্যাকব-এর সাথে তাঁকেও জয়পুরের সিটি প্যালেসের স্থপতি হিসেবে গণ্য করা হয়। জয়পুর শহর তৈরির পাশাপাশি কোনও শহরের ক্ষেত্রে যা অপরিহার্য হয়ে ওঠে অর্থাৎ নিরাপত্তার ব্যাপারে মহারাজা জয় সিং বড়োই উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিদ্যাধরের পরামর্শ মতো তিনি একটি নব্য বা কল্পিত শহর নির্মাণ করেছিলেন কিন্তু বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা শহরের নিরাপত্তার দিকটিও ভাবা হয়। কেননা, তখন বৈদেশিক ও দেশীয় অন্যান্য প্রদেশ থেকে হামলার সম্ভাবনা থাকত। তাই, শহরের নিরাপত্তার জন্যে দৃঢ় স্থাপত্য স্থাপন করা হয়েছিল। আর, এর পাশাপাশি দৃঢ় সাতটি দরজাযুক্ত বিশাল দুর্গ প্রাচীরও বানানো হয়েছিল। আজ এই আধুনিক যুগে দেশের আন্তর্জাতিক বর্ডারও বেশ কিছু অংশে তেমন দৃঢ় নয় কিন্তু সে যুগে একটা শহর গড়ে তোলার জন্য কত কিছু ভাবা হয়েছিল। তা মোটামুটি ভাবে ১৭৩১ কি ১৭৩২ সালে শেষ হয় সহ নির্মাণের কাজ। গোটা জয়পুর শহরকে সৌরমণ্ডলের নয়টি গ্রহের প্রতীক হিসেবে নয়টি বর্গক্ষেত্রে ভাগ করা হয়। যার মধ্যে দুটি ভাগ থাকে রাজা ও রাজকীয় কাজকর্মের জন্যে আর বাকি সাতটি ভাগ থাকে স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্যে। মহারাজ দ্বিতীয় জয় সিংয়ের নামেই শহরের নামকরণ হয় জয়পুর। তাঁর এই নতুন রাজধানী জয়পুর নকশাকার বিদ্যাধরের হাত ধরে হয়ে উঠল যেন স্থাপত্য, বিজ্ঞান ও সৌন্দর্যের মিশ্রণ।

বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের প্রস্তুত করা নকশা থেকেই জয়পুর শহর নির্মাণ করা হয়। এই মহান স্থাপত্যবিদ জয়পুর শহরের চেহারা বদলে দিয়েছিলেন। সেই যুগে, জয়পুরে স্থাপত্য ছিল অত্যন্ত উন্নত, বিজ্ঞানসম্মত ও তার স্থাপত্যশৈলী ছিল গোটা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। ১৭৫১ সালে ৫৮ বছর বয়সে মারা গেলেও, এই বাঙালি স্থাপত্যবিদকে জয়পুর তো বটেই এমনকি গোটা উপমহাদেশ মনে রেখেছে ‘শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী স্থপতি’ হিসেবে। স্থাপত্যের ক্ষেত্রে দেশীয় ও প্রথাগত পদ্ধতি এবং উপকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্যাধর অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাজস্থানের জয়পুর শহরের স্থাপত্যের পাশাপাশি দেশের আধুনিক স্থাপত্যের প্রবর্তক হিসেবে তিনি সুপরিচিত হয়ে আছেন। বাংলার মানুষ তাদের এই প্রধান স্থপতি, গণিতজ্ঞ, বাস্তুশাস্ত্রী ও নগর পরিকল্পনাবিদকে একপ্রকার ভুলে গেলেও বা তাঁকে নিয়ে বিশেষ কোনও কিছু না বানালেও জয়পুর তথা রাজস্থানের সংরক্ষিত সেরা বাগানগুলোর মধ্যে একটি হল ‘বিদ্যাধর বাগান’ যা শহরের স্থপতিকারের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৯৮৮ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। জয়পুর শহরের গর্ব এই বাগানটি জয়পুরের ৮ কিলোমিটার পূর্বে জয়পুর-আগ্রা সড়কে অবস্থিত। প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্য সম্পর্কিত ‘শিল্প শাস্ত্র’ নামক গ্রন্থসমূহ বিদ্যাধর ব্যবহার করেছিলেন জয়পুর শহরের পরিকল্পনাকালে। সেই গ্রন্থসমূহ দ্বারাই বাগানটি নির্মাণ করা হয়। মনে করা হয় যে, সেসোদিয়া উদ্যানের আশেপাশে অবস্থিত ছিল বাগানের একটি দ্রাক্ষাক্ষেত্র বা আঙুরের ক্ষেত।

নৈহাটি অনেক কৃতি মানুষকে উপহার দিয়েছে যাঁদের মধ্যে আমাদের আলোচ্য দেশের অন্যতম কৃতি স্থাপত্যবিদ ও রাজস্থানের 'গোলাপী শহর' জয়পুরের নকশাকার বিদ্যাধর ভট্টাচার্য তো আছেনই আর আছেন দেশের স্বাধীনতা লড়াইয়ের মূলমন্ত্র ‘বন্দে মাতরম্'-এর রচয়িতা, বাংলার নবজাগরনের অন্যতম রূপকার, কিংবদন্তি উপন্যাসিক, গল্পকার তথা সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক, ভারততত্ত্ববিদ,চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কর্তা, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসু, জনপ্রিয় গায়ক শ্যামল মিত্র, বাংলায় ব্রাহ্ম আন্দোলনের তো বটেই এমনকি বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা কেশবচন্দ্র সেন।
0

প্রবন্ধ - বেবী সাউ

Posted in

কবিতার মধ্যে যে কবি ব্যক্তিত্বের বীজ পুঁতে দিতে পারেন, সেই কবির কবিতা পরবর্তীকালের পাঠকদের কাছে সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকে। কিন্তু তার জন্য দরকার পরে কবির অভিপ্রায়ের। কিন্তু সেই অভিপ্রায়টি কী? ব্যক্তিগত এক দর্শন এবং কাব্যভাষার এক ধারাবাহিক সন্দর্ভ ছাড়া হয়তো কোনও কবিই সময়ের কাছে তাঁর আঙুলের ছাপ রাখতে পারেন না। অনেক সময় সমসময় তাঁকে খুঁজে পায়, অনেক সময় পায় না। পরবর্তী সময়ের মানুষজন সেই কবিকে আগ্রহ ভরে পড়তে থাকেন। প্রবালকুমার বসুর কবিতা তাঁর ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তুমিই প্রথম’ থেকেই নিজস্ব এক ব্যক্তিত্ব নিয়ে আছে। দেজ্ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ২০০৭ সালে প্রকাশিত এই শ্রেষ্ঠ কবিতার পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৯-এ। শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, “ এটা খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার যে, জীবিকার জন্য অনেক সময় ব্যয় করতে হলেও প্রবাল তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই নতুন নতুন আঙ্গিকের সন্ধান করেছেন।“ এই ক্রমপরিবর্তনশীল কাব্যধারার সঙ্গেই আমরা পরিচিত হই তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা পড়তে পড়তে। “ তুমি যদি স্পর্শ করো, আমি তবে গাছ হয়ে যাব”-এর মতো পংক্তি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থেই তিনি লিখেছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থে যে প্রবালকুমার বসুকে আমরা বিস্ময়ে লক্ষ করি, তিনি নিজেকে পালটে ফেলার ব্রত যে প্রথম থেকেই নিয়েছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না, যখন আমরা পড়ি, “ আমাদের কথাগুলি এতকাল বলেছি, যা / না বলা কথারই অবশেষ”। (অবশেষ)।

প্রবালকুমার বসুর কবিতা তার পর থেকে নিয়তই বাঁক নিয়েছে নানান ভাবে। ‘ব্যক্তিগত স্মৃতিস্তম্ভের পাশে’ কবিতায় তিনি লেখেন, “ যেভাবে বেঁচে আছি এভাবে বেঁচে থাকতে থাকতে আমি একদিন ভারতবর্ষ হয়ে যাব”। এই কবিতাটি রয়েছে তার পরের কাব্যগ্রন্থ “ ব্যক্তিগত স্মৃতিস্তম্ভের পাশে” নামক কাব্যগ্রন্থে। এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের চার বছর পর। এই কাব্যগ্রন্থেই আমরা পাই এক নতুন প্রবালকুমার বসুকে, যিনি কাব্যভাষায় অনেক বেশি অভিনব। যেমন, ‘ব্যক্তিগত জীবনী’ নামক কবিতায় তিনি লেখেন, “ আমার প্রথম মৃত্যুর পর দ্বিতীয় মৃত্যু হতে সময় নিল কুড়িটি বছর।“ প্রবালকুমার বসুর কবিতা পড়তে পড়তে যেমন তাঁর সময়কে স্পষ্টুভাবে চেনা যায়, তেমন বোঝা যায় কীভাবে তিনি আত্মজৈবিনিক উপাদানকে সময়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছেন। এই কাব্যগ্রন্থে তিনি নানা ছন্দে, নানা আঙ্গিকে কথা বলেহেন। ১৯৮৯ সালে ‘স্থায়ী আবাস অস্থায়ী ঠিকানা’, ১৯৯৪ সালে ‘যাপনচিত্র’, ১৯৯৮ সালে “ ঈশ্বরের মুখ’ প্রবালকুমার বসুর কাব্যব্যক্তিত্বকে অনেক বেশি স্পষ্ট করে তোলে। একজন কবির অভিযাত্রাকে স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায় তাঁর ধারাবাহিকতা দেখলে। সমগ্র আট-এর দশক ধরে যে কবি লিখেছেন নিভৃতচারী এক ভাষায় কবিতা, তিনিই সমগ্র নয়ের দশক জুড়ে এক স্থিতপ্রজ্ঞ দার্শণিকের মতো কবিতার অন্তর্জগতে ডুব দিয়েছেন। ‘অন্ধের ঈশ্বর’, ‘পা’, ‘জানা রাস্তা’, দেয়ালচিত্র’ প্রভৃতি আশ্চর্য কবিতার সামনে নতজানু হয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। ভেবে দেখতে হবে ভুবনায়নের পর ভুবনায়িত সংস্কৃতির জোয়ারে কবি এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন। প্রযুক্তিবিদ এই কবির কাছে প্রযুক্তির বিস্ফোরণ অচেনা কিছু নয়। কিন্তু সময়টা পালটে যাচ্ছে। তার সঙ্গে সঙ্গে কবি পালটে ফেলছেন তাঁর কাব্যভাষা। কিন্তু ভিতরে রয়ে গেছে এক স্থিতপ্রজ্ঞ দ্রষ্টা।

এই ধারাবাহিকতারই অংশ হিসেবে আমরা পাই ‘ আপনাকেই ঠিক করতে হবে গন্তব্য’ যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৭ সালে। আমরা কল্পনা করে নিতে পারে, পূর্বের শ্রেষ্ঠ কবিতার সংস্করণটি এই গ্রন্থের পূর্বের কাব্যগ্রন্থগুলি নিয়েই হয়েছিল। কারণ ততদিনে চব্বিশ বছরের কাব্যজীবন তিনি অতিক্রম করে এসেছেন। পরিবর্ধিত এই শ্রেষ্ট কবিতায় তাই আমরা পেয়ে যাচ্ছি ‘ অধর্ম কথা’ (২০০৯), ‘ ভালো বলতে শিখুন’ (২০১১), ‘নির্বাচিত দূরত্ব মেনে’ (২০১৩), ‘এই যে আমি চলেছি’ (২০১৫), এবং ‘আমি তো বলতেই পারতাম (২০১৭) কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্য থেকে কবির নির্বাচিত কবিতাগুলি। আর আশ্চর্য ভাব দেখি, ১৯৮৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কথিত নিয়ত পরিবর্তনশীল কাব্যভাষার বিষয়টি ৩৪ বছরেও পরিবর্তিত হয়নি। ২০১৭ পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলিতেও প্রবালকুমার বসু অক্ষুণ্ণ রেখেছেন তাঁর চিরজায়মান কাব্যভাষা। এই পরিবর্তনশীলতাই একজন কবিকে জীবিত রাখে। ‘অভ্যাসবশত’ নামক কবিতায় যেমন তিনি লেখেন, “ ফিরে আসতে আসতে দেখি বদলে যায় বাড়ি/ রোজ কার কাছে ফিরি?” এই প্রশ্ন যেন অনুরণিত হতে থাকে শ্রেষ্ঠ কবিতার ৩৪ বছরের নির্বাচিত প্রতিটি কবিতায়। কবির রাজনৈতিক ভাবনা, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব, শিল্প এবং নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কিত ভাবনা – সমস্ত কিছুই আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। আমরা বুঝতে পারি, তাঁর কাব্যভাষা আন্তর্জাতিক আঙিনাকে স্পর্শ করে আছে। একই সঙ্গে আমরা অপেক্ষা করে থাকি শ্রেষ্ঠ কবিতার পুনরায় পরিবর্ধিত সংস্করণের জন্য। কারণ, কবি তো থেমে যাচ্ছেন না। তিনি নিজে পাল্টাচ্ছেন এবং নিজের কবিতাকেও বারবার পাল্টাচ্ছেন। কবির ব্যক্তিত্বের এই মানচিত্র এই শ্রেষ্ঠ কবিতার মধ্যে ধরা দিচ্ছে।


প্রবালকুমার বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা
দেজ পাবলিশিং
প্রচ্ছদ সৈকত সরকার
২৫০ টাকা