Next
Previous
Showing posts with label নাটক. Show all posts
0

নাটক - সরিৎ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


 নাটক


পরশপাথর
সরিৎ চট্টোপাধ্যায় 



চরিত্র: ঝিলিক, মৌ, দীপাঞ্জন, জয়, উদ্ভুটেশ্বর ডায়োজিনিস, জিলি, কস্তুরী সেন

(পর্দা খুললে দেখা যায় একটি বছর পাঁচেকের মেয়ে অডিয়েন্স রাইট ডাউন স্টেজে একটা টেবিলে বসে পা দুলিয়ে গান গাইছে।)



ঝিলিক: আমার দিন কাটে না আমার রাত কাটে না
স্মৃতিগুলো কিছুতেই পিছু হাঁটে না
আমার দিন কাটে না আমার রাত কাটে না

(মৌয়ের রাইট উইংগ দিয়ে প্রবেশ। ঝিলিককে টেবিল থেকে নামিয়ে মা মেয়ে হাত ধরাধরি করে গান গায়)

যে আলো ছড়ালো এই দুটি চোখে
সে কেন এলো না তারই আলোকে।।
তাকে না আর দেখে মন ওঠে না
স্মৃতিগুলো কিছুতেই পিছু হাঁটে না
আমার দিন কাটে না আমার রাত কাটে না

মৌ: অনেক গান হয়েছে ঝিলিক, এইবার দুধটা খেয়ে নাও। 

ঝিলিক: দুধ বাজে!

মৌ: দুধ বাজে নয়, খাও! দাদা কী সুন্দর দুধ খেয়ে নেয় দেখনি?

ঝিলিক: দাদা বাজে!

মৌ: ছিঃ, দাদা বাজে কেন রে? নাও শেষ করো এটা। এবার পড়তে বস। 

ঝিলিক: উঁহ! পড়া বাজে!

মৌ: কী সাঙ্ঘাতিক মেয়ে! পড়া বাজে! বাবার সামনে বলতে পারবি?

ঝিলিক: আজ দাদা বাবার কাছে এইসসা খাবে না ... হিহি ... এখনো ফেরেনি। 

মৌ: সত্যি তো রে! জয়টা এখনো ফিরল না! তোর বাবা তো এই এল বলে। ছেলেটার কোনো ভয়ডরও নেই ... রোজ এত বকা খায় ... (বেল বেজে ওঠে) ... দেখলি! যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয় ... আজ ওর কপালে দুঃখ আছে। ও, তুমি! আজ যে এত তাড়াতাড়ি চলে এলে?



(দীপাঞ্জনের লেফ্ট উইংগ থেকে প্রবেশ। ঝিলিক ছুটে আসে)

দীপ: তাড়াতাড়ি! কই মৌ, রোজ তো এই সময়ই ফিরি ...

ঝিলিক: বাবা, বাবা ...

দীপ: ইয়েস, মাই প্রিনসেস!

মৌ: আঃ ঝিলিক! বাবাকে একটু রেস্ট নিতে দাও। 

দীপ: আরে না না, ঠিক আছে। ইয়েস, মাই প্রিনসেস! হাই আর ইউ টুডে?

(মৌয়ের দীপাঞ্জনের অফিসের ব্যাগ হাতে রাইট উইংগ দিয়ে প্রস্থান)



ঝিলিক: আমি পুরো দুধ খেয়ে নিয়েছি! ফিনিশ!

দীপ: গুড গার্ল! কিন্তু ঢুকতেই বাবাকে আজ এত আদর? কী ব্যাপার! রাজকুমারী ঝিলিকদেবীর মুখে দুষ্টু দুষ্টু হাসি কেন?

ঝিলিক: বললে তুমি আমায় বকবে। 

দীপ: কেন বকব কেন?

ঝিলিক: আমি এখনো পড়তে বসিনি। 

দীপ: হুম! সেতো দেখতেই পাচ্ছি। পড়তে বসনি কেন?

ঝিলিক: আমার পড়তে বাজে লাগে। 

দীপ: পড়তে বাজে লাগে! কী সব্বোনাশ!

(গেলাসে জল নিয়ে মৌয়ের প্রবেশ)



মৌ: আজ রুনুমাসির ফোন এসেছিল। 

দীপ: কী বললেন? সব ভালো তো?

মৌ: এখন ভালোই আছেন। শনিবার ওঁর ওখানে যেতে বলছিলেন। যাবে?

দীপ: ওই শনি-রবি দুটোদিনই তো পাই মৌ। গেলে পরে জয়ের পুরো দিনটাই নষ্ট হবে। এমনকি টিউসানও। 

মৌ: ওই একজনই তো আছে এখনো মাথার ওপরে! কতদিন যাওয়া হয়নি বলোতো!

(মৌয়ের প্রস্থান)

দীপ: নেক্স্ট উইক ওর পরীক্ষাটা শেষ হোক মৌ, তারপর যাওয়া যাবে একদিন। তা ঝিলিকদেবী! পড়তে বাজে লাগে, তাই তো? তা কী করতে ভালো লাগে শুনি?

ঝিলিক: ফ্যাট ক্যাট স্যাট ম্যাট লুক অ্যাট ৱ্যাট প্যাটপ্যাট!

দীপ: ক্কী! কী বললি আবার বল?

ঝিলিক: ফ্যাট ক্যাট স্যাট ম্যাট লুক অ্যাট ৱ্যাট প্যাটপ্যাট!

দীপ: ফ্যাট ক্যাট স্যাট ম্যাট লুক অ্যাট ৱ্যাট প্যাটপ্যাট! এটা কী?

ঝিলিক: কবিতা। 

দীপ: কবিতা! কোথায় শিখলি?

ঝিলিক: দাদা লিখেছে। 

(মৌয়ের প্রবেশ)



দীপ: শুনছ! তোমার গুণধর ছেলে কবি হয়েছেন! আর ইনি হয়েছেন তার শিষ্যা! ওরে, কবি হলে খাবি কী? পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। ওই ঝলসানো রুটিই শুধু জুটবে কপালে। পড়াশুনা কর মা, পড়াশুনো করে ওই কৌস্তভ সেনের মতো হ দেখি। কৌস্তভ সেন! ছেলেটা মাত্র দশবছর বয়সে মাধ্যমিক পাস করল, বারো বছরে গ্র্যাজুয়েশন। ভাবা যায়! গতবছর প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে নিজেরা ডেকে নিয়ে গেছে রিসার্চ করার জন্য। ওই, ওই হলো টার্গেট! ইউ মাস্ট এইম ফর দ টপ! দ ভেরি টপ! বুঝেছিস? (ঝিলিক ঘাড় নাড়ে)

আর বুঝেছিস! আরেকজনতো আবার কবিতা লিখছেন!

মৌ: কিছু খাবে?

দীপ: না। 

মৌ: একটু চা করি?

দীপ: বললাম তো না!

মৌ: কী হয়েছে বলোতো? আজ মুড অফ? অফিসে কিছু হয়েছে? 

দীপ: কী আর হবে? সেই রেষারেষি, পলিটিক্স ..., বসের ভুরু কোঁচকান। আর ভালো লাগে না মৌ এই চাকরি করতে। এত চেষ্টা করেও সেই মিডল ম্যানেজমেন্টেই পড়ে আছি। 

মৌ: তুমি কেন এরকম ভাবো বলোতো দীপাঞ্জন? আমরা তো বেশ আছি। 

দীপ: জয় কোথায়?

ঝিলিক: দাদা এখনো ফেরেনি। 

মৌ: আঃ ঝিলিক!

দীপ: জয় এখনো ফেরেনি! পৌনে সাতটা বাজে! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! আমার পইপই করে বলা সত্ত্বেও .., মৌ, এরপর আমি যদি ওর ওপর হাত তুলি ...

মৌ: দীপাঞ্জন প্লিজ! ও এখনো ক্লাস সিক্সে পড়ে! স্কুলের পর রোজ দেড়ঘণ্টা টিউশান পড়ছে, একটু খেলবে না?

দীপ: না, খেলবে না! সময় নেই মৌ, তুমি বুঝতে পারছ না, সময় বড়ো কম। আমি ওঁকে নেক্সট ইয়ারেই আকাশের ফাউন্ডেশন কোর্সে ভর্তি করে দেব। হি হ্যাজ টু মেক ইট! হি হ্যাজ টু! প্রথমে আইআইটি, তারপর আইআইএম, আর তারপর ...

মৌ: তারপর? তারপর কী দীপাঞ্জন? তারপর ও খেলবে? গান গাইবে? আবৃত্তি করবে?

দীপ: ও হ্যাং ইওর আবৃত্তি! ঘরের ভেতর সীমাবদ্ধ হয়ে জীবন কাটাচ্ছ, জানো না তো বাইরের জগতটা কী! ইটস্ আ ডগ ইটস্ ডগ কম্পিটিশন আউট দেয়ার!

(জয় [ফুটবল হাতে], উদ্ভূটেশ্বর আর জিলির প্রবেশ)

ও বাব্বা! এটা কে? নেইমার না মেসি? তা লাটসাহেবের এতক্ষণে বাড়ি ফেরার সময় হলো? আর জিলি, তোমার পড়াশুনো নেই? এই অপগণ্ডদের সঙ্গে ফুটবল খেলছ? আর এটা কে?

জয়: আরে ওর জন্যই তো এত দেরি হয়ে গেল বাবা। কী যে সব আজগুবি কথাবার্তা বলে না!

জিলি: ওরা কালই এখানে শিফ্ট করেছে কাকু। সত্যি, কী যে মজার মজার কথা বলে কাকিমা, তুমি ভাবতেই পারবে না। 

জয়: হ্যাঁ মা। ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে কী সব বলছিল, আরে বল না জিলি ... কী যেন? হ্যাঁ, কাইনেটিক ভেলোসিটি ইন কার্ভিলিনিয়ার মোশনের কী সব ফরমুলা ... ভিসি, ইকুয়াল টু ডিওয়াই বাই ডিটি। 

দীপ: সেকি, এতো অনেক বড়ো ক্লাসের অঙ্ক!

জিলি: ওকে ওর নামটা জিজ্ঞেস করুন কাকু। 

দীপ: কী নাম তোমার বাবা?

উদ্ভুটেশ্বর: আজ্ঞে, উদ্ভূটেশ্বর ডায়োজিনিস। 

দীপ: কী!

উদ্ভুটেশ্বর: উদ্ভূটেশ্বর ডায়োজিনিস। 

মৌ: এ আবার কী নাম!

জিলি: তোমরা এর আগে কোথায় থাকতে?

উদ্ভুটেশ্বর: ইউরোপাতে। 

দীপ: ইউরোপে? ইউরোপে কোথায়? 

উদ্ভুটেশ্বর: ইউরোপ না, ইউরোপা। জুপিটার বা বৃহস্পতির চাঁদ, ইন ফ্যাক্ট দ ফোর্থ লার্জেস্ট মুন অফ জুপিটার। 

দীপ: ওয়াট!

মৌ: তার মানে তুমি বলতে চাও যে তুমি একটা এলিয়েন?

উদ্ভুটেশ্বর: ইয়েস। আমি পৃথিবীতে এসেছি এখানকার সিমপ্লিসটিক লাইফ ফর্মস্, মানে তোমাদের স্টাডি করতে। 

দীপ: আরে, এ বেশ মজার ছেলেতো! তুমি বসো বাবা, কী যেন নাম বললে? ও হ্যাঁ, উদ্ভুটেশ্বর ডায়োজিনিস। 

জিলি: তুমি কোন ক্লাসে পড়?

উদ্ভুটেশ্বর: আমাদের গ্রহে তোমাদের মতো স্কুল হয় না। 

জয়: তাহলে তোমরা পড় কোথায়?

উদ্ভুটেশ্বর: পড়ি না। 

মৌ: দীপাঞ্জন, ও কি সত্যি ওই ইউরোপা থেকে এসেছে নাকি? 

দীপ: পাগল নাকি? দাঁড়াও, এর একটা মীমাংসা করা দরকার। আচ্ছা, বলোতো বাবা উদ্ভুটেশ্বর, পৃথিবী থেকে ইউরোপার দূরত্ব কত?

উদ্ভুটেশ্বর: তোমাদের হিসেবে বাষট্টি কোটি তিরাশি লক্ষ কিলোমিটার। 

জয়: তাহলে এতদূরে এলে কী করে?

উদ্ভুটেশ্বর: আমার স্পেসশিপে। আমাকে কালকেই এখানে বিম-ডাউন করা হয়েছে। আর স্পেসশিপটা চাঁদের ওই পাশে, যেদিকটা তোমরা দেখতে পাও না, সেখানে অপেক্ষা করছে। 

মৌ: তোমার বয়স কত?

উদ্ভুটেশ্বর: তোমাদের হিসেবে একান্ন। 

জিলি: একান্ন! 

উদ্ভুটেশ্বর: আমাদের আঠেরোঘণ্টায় দিন হয় যে। 

জিলি: কাকু, ও সব ঠিক বলছে?

দীপ: তাই তো দেখছি রে জিলি। হি ইজ ফ্যাকচুয়ালি অ্যাবসোলিউটলি কারেক্ট। কিন্তু ইউরোপাতে তো জল নেই, বাতাস নেই। তাহলে তোমরা কী করে ...

উদ্ভুটেশ্বর: ভুল। জল আছে, পৃথিবীর চেয়েও বেশি, কিন্তু মাটির তলায়। ওপরে বরফ, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, মাইনাস দুশো ডিগ্রী। বাতাসও আছে, কিন্তু বাতাসে অক্সিজেন কম, আমরা অবশ্য নাইট্রোজেন ব্যবহার করি। আর এখানে তো প্রায় আটাত্তর পারসেন্ট নাইট্রোজেন। বিন্দাস!

ঝিলিক: তুমি আমাদের ভাষা শিখলে কী করে?

উদ্ভুটেশ্বর: আমার কানের ভেতর একটা ট্রান্সলিটারেটর চিপ লাগানো আছে। আর একটা আমার গলায়। আমি যে কোনো ভাষা বুঝতেও পারি, বলতেও পারি। 

জয়: বস্, দু-একটা এক্সট্রা হবে? আমার আবার এই বছর থেকেই জার্মান শুরু হয়েছে। কিস্সু বুঝতে পারি না। 

দীপ: বুঝবে কী করে? সারাদিন তো শুধু টইটই করে পাড়া বেড়ানো হচ্ছে। 

উদ্ভুটেশ্বর: Nicht spielverderber sein. Ihr freude nicht verderben. 

দীপ: তার মানে?

মৌ: Nicht spielverderber sein. ডোন্ট বি আ স্পয়েলস্পোর্ট! Ihr freude nicht verderben. ডোন্ট স্পয়েল দেয়ার হ্যাপিনেস! কী দেখছিস? দুবছর জার্মান শিখেছিলাম, বুঝেছিস?

দীপ: কী বলতে চাইছ তুমি?

উদ্ভুটেশ্বর: টলবে যখন টলবে বুড়া, ঘুচবে তোমার ধরাচূড়া, মিছেই শুধু সাহেবসুবো সাজছ হে। পিছনপানে দেখবে যখন, স্বপনগুলি খুঁজবে তখন, জীবনটাকে চোখের জলে মাজিবে হে!

জয়: হাহাহাহা! কী সব বলছে, ধুস্!

দীপ: না, দাঁড়া জয়। ও বোধহয় কিছু বলতে চাইছে ..., কী এটা? কবিতা? কার লেখা?

উদ্ভুটেশ্বর: উদ্ভুটেশ্বর ডায়োজিনিসের। 

দীপ: এর মানে? টলবে যখন টলবে বুড়া ...

উদ্ভুটেশ্বর: বুড়ো হবে তো, একদিন?

দীপ: ঘুচবে তোমার ধরাচূড়া ...

উদ্ভুটেশ্বর: এই টাকা পয়সা, বাড়ি গাড়ি, সব কি সাথে করে নিয়ে যাবে?

দীপ: টলবে যখন টলবে বুড়া, ঘুচবে তোমার ধরাচূড়া, মিছেই শুধু সাহেবসুবো সাজছ হে। পিছনপানে দেখবে যখন, স্বপনগুলি খুঁজবে তখন, জীবনটাকে চোখের জলে মাজিবে হে! না মৌ, এ তো বাচ্চা ছেলের কথা নয়!

মৌ: ওর বয়েস একান্ন দীপাঞ্জন!

দীপ: তার মানে তুমি বিশ্বাস করছ যে ও একটা এলিয়েন? ইমপসিবল! কিন্তু আমার কেন কে জানে কোথাও একটা গোলমাল লাগছে। 

উদ্ভুটেশ্বর: ইতিহাসে পাতিহাঁস, ভূগোলেতে গোল। গোল গোল গোলকধাঁধা, রুবি শুধুই বোকাহাঁদা?

জিলি: তার মানে?

উদ্ভুটেশ্বর: ডোন্ট স্টাডি!

জয়: আমরা লেখাপড়া করব না!

উদ্ভুটেশ্বর: ডোন্ট স্টাডি ... লার্ন। শুধু পড়বে না, শিখবে। যেটাকে ভালোবেসে শিখতে চাও, শুধু সেটাই শিখবে। আর যে কাজটাকে ভালোবেসে সারা জীবন করতে চাও, সেটাই করবে। 

মৌ: তোমরা সত্যিই স্কুলে পড় না? তাহলে এত কিছু শিখলে কী করে?

উদ্ভুটেশ্বর: বললাম তো, যেটা ভালো লাগে, শিখে নিই। ধরো, তোমরা গাঙ্গুরামের দোকানে গেছ। সেখানে তোমরা নিজের পছন্দের মিষ্টি কিনবে না অন্যের পছন্দের?

জয়, জিলি: নিজের!

উদ্ভুটেশ্বর: একজ্যাক্টলি! নিজের .., শুধু নিজের পছন্দের জিনিস শেখো, দেখবে সেটা কত আনন্দের। কারোকে আর বলতে হবে না, পড় পড়। তোমরা নিজের ইচ্ছেতেই পড়বে, শিখবে, জানবে। অ্যান্ড দেন ইউ উড অলওয়েজ বি হ্যাপি। 

দীপ: ওভাবে পড়ে পরীক্ষায় পাস করবে? চাকরি পাবে? ওসব ওই ইউরোপাতেই সম্ভব, পৃথিবীতে না। 

উদ্ভুটেশ্বর: তাই কী? স্টিভ জবস্, বিল গেটস্, মার্ক জুকারবার্গ, সচিন তেন্দুলকর, অ্যাব্রাহাম লিংকন এরা সবাই কিন্তু স্কুল ড্রপআউটস। এরা যে শুধু কৃতি হয়েছেন তা না, সমাজের প্রতি এঁদের অবদানটাও দেখতে হবে। আরেকজন সেই দাড়িওলা ভদ্রলোক, তোমাদেরই দেশের, নোবেল পেয়েছিলেন, তিনি তো কোনদিন স্কুলেই যাননি। আহা! কী লিখে গেছেন! মাথায় বৃহৎ জটা, ধূলায় কাদায় কটা, মলিন ছায়ার মতো ক্ষীণ কলেবর, ক্ষেপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর! 

মৌ: রবিঠাকুর!

উদ্ভুটেশ্বর: জানো, আমার তো মনে হয় পরশপাথর মানে হলো জ্ঞান, নলেজ। 

জয়: আমি রবিঠাকুরের একটা গান বাজাতে পারি। বাজাই?

(জয় কি-বোর্ডে 'পুরানো সেই দিনের কথা' দুলাইন বাজায়)

দীপ: তুই কি-বোর্ড বাজাস! এ গান তোকে কে শেখাল! ও তুমি! তাই বলি। নে, সর দেখি। 

ঝিলিক: বাবা, তুমিও বাজাতে পার?

(দীপাঞ্জন হেসে বাজিয়ে গেয়ে ওঠে। বাকিরাও গলা মেলায়। মৌ, জিলি, ঝিলিক নাচে)

দীপ: পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আয় আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।
মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়--
বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়। 
হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়--
আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়॥


জয়: বাবা, তুমি এত ভালো বাজাও আর ...

দীপ: বাজাই না কেন? ছোটোবেলায় এই গানবাজনা নিয়েই থাকতাম জানিস। কিন্তু সংসারে তো ওই দিয়ে ভাত জোটে না। একটু ভালোভাবে বাঁচতে চাইলে অনেক কিছুই ছাড়তে হয়। তারপর আরেকটু ভালোভাবে বাঁচা .., আরেকটু সুখ! কখন যে সুখের চোরাবালিতে সুর তলিয়ে গেছে বুঝতেও পারিনি রে। 

জয়: বাবা!

মৌ: তোলো ছিন্ন বীণা, বাঁধো নতুন তারে,
ভরে নাও সুর গাও জীবনেরই জয়গান ...
আগামীদিনের আলো, দুচোখে মেখে নাও
আঁধার ঘুচিয়ে দাও ভোলো অভিমান।

দীপ: সত্যি কী করছি আমরা মৌ! এইভাবে বাঁচার জন্যই কি আমরা একসাথে পথ চলা শুরু করেছিলাম? আমাদের সেই ছোট্ট গ্রামের আকাশ, আজও আমায় ডাকে, আমায় হাতছানি দিয়ে বলে, আয় দীপ, পালিয়ে আয়! ওখানে আছিস কী করে? এতটুকু বাতাস নেই, খোলা আকাশ নেই, কী করে পড়ে আছিস ওখানে?

মৌ: সত্যি দীপাঞ্জন, আমিও আর পারছি না! একান্নবর্তী পরিবারে বড়ো হয়েছি, এই ইট-কাঠের জঙ্গলে আর কিছুই ভালো লাগে না। একটা বন্ধু নেই, পাশেরবাড়িতে কারা থাকে তাও আমরা খোঁজ নিই না। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। সত্যিই আমি আর পারছি না!

(কান্নায় ভেঙে পড়ে মৌ)

উদ্ভুটেশ্বর: যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা আশঙ্কা জপিছেমৌন মন্তরে,
দিক্‌-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা--
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।

দীপ: তুই আসলে কে বলতো বাবা? এই রুক্ষ শুষ্ক সংসারে আজ ভোরের বৃষ্টির পরশমাখা এক দমকা হাওয়ার মতো ছুটে এলি? তুই কি মানুষ, না দেবতা? না সত্যিই কোনো গ্রহান্তরের জীব?

উদ্ভুটেশ্বর: আমি সে ভোলানাথ নই গো, আমি সে ভোলানাথ নই। আমার নাম .., কৌস্তভ সেন। 

দীপ: কৌস্তভ সেন! মানে সেই কৌস্তভ সেন? প্রিন্সটন স্কলার? মাই গুডনেস!



(কস্তুরী সেনের গলা ভেসে আসে দরজা দিয়ে। পরমুহূর্তে প্রবেশ)

কস্তুরী: ঋজু! ঋজু! আচ্ছা আপনারা কোনো বছর চোদ্দর ছেলেকে দেখেছেন? 

উদ্ভুটেশ্বর: মা!

কস্তুরী: একি ঋজু! তুই এখানে! আর আমি কখন থেকে তোকে খুঁজছি। 

মৌ: আপনিই কৌস্তভের মা?

কস্তুরী: কৌস্তভ! আশ্চর্য! ও নিজের পরিচয় আপনাদের জানিয়েছে? সচরাচর তো ও ..! হ্যাঁ, আমিই কৌস্তভের মা। আমার নাম কস্তুরী সেন। নমস্কার। 

মৌ: নমস্কার। আচ্ছা ওই প্রিন্সটনে ছিল, না? 

কস্তুরী: হ্যাঁ। 

দীপ: তাহলে ..? 

কস্তুরী: ছোটো থেকেই ও ওর সমসাময়িক বাচ্চাদের থেকে অন্যের তীক্ষ্ণবুদ্ধি ছিল। আর সেটা বোঝার পর থেকেই আমি ওকে নিয়ে পাগলের মতো মেতে উঠেছিলাম। ওর ক্ষমতাও ছিল সবকিছু শুষে নেওয়ার। আমিও ওঁকে নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ দিইনি। আরো, আরো পড়! আমার ছেলের ট্যালেন্ট যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয়। কোনো বাঁধা মানিনি, কারো কথা শুনিনি, এমনকি ওরও না। 

ও বলত, মা, আমার গান শুনতে ইচ্ছে করে; ইচ্ছে করে কবিতা পড়ি। আমি বলতাম, পাগল! ওসবের জন্য অনেক সময় পড়ে আছে জীবনে। পাগলামি করিস না ঋজু, তোকে অনেক ওপরে উঠতে হবে। ইউ মাস্ট রিচ দ টপ, দ টপ, দ ভেরি টপ!

প্রিন্সটনে যাওয়ার সময় ও বলল, মা, আমি ... আমি একা একা ওখানে থাকতে পারব না। প্লিজ আমায় পাঠিও না। আমি বললাম, ঋজু, একটু কষ্ট কর বাবা। তুই অন্যদের মতো নস! ইউ আর মেড ফর গ্রেট থিংগস্! 

ও চলে গেল। যাবার দিন একবারও কাঁদেনি। রোজ ফোন করতাম। ও বেশি কথা বলত না। ধীরে ধীরে ফোন ধরাও বন্ধ করে দিল। মাস চারেক পর ওখান থেকে একটা ফোন এল। বলল, ওর নাকি নার্ভাস ব্রেকডাউনের মতো কিছু একটা হয়েছে। এসে নিয়ে যান। 

আজ দেড়বছর ওকে নিয়ে এসেছি। কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারি না। ডাক্তার দেখিয়েছি, কোনো লাভ হয়নি। ওর অত সাধের বইগুলোর দিকে একবার ফিরেও তাকায় না। অসংলগ্ন কথা বলে, অদ্ভূত সব কবিতা আওড়ায়। একা ঘরে থাকলে জানা অজানা সব গানের সুর ভেসে আসে। 

ওর এই অবস্খার জন্যই পুরোনো পাড়া ছাড়তে হলো। সবাই বলতে শুরু করেছিল, ও পাগল! ওঁকে নিয়ে হাসাহাসি করত। আজ ওকে বাড়িতে না পেয়ে ভয় পেয়ে গেছিলাম। নতুন পাড়া, আর ওতো এখনো পনেরোও পেরোয়নি। 

মৌ: ও কিন্তু আজ দিদি আমাদের সাথে খুব আনন্দ করেছে। কত গল্প করেছে, আবৃত্তি করেছে। 

কস্তুরী: কী বলছেন আপনি! ঋজু আবৃত্তি করেছে?

জিলি: হ্যাঁ কাকিমা, ও আমাদের সঙ্গেই ছিল এতক্ষণ। আমাদের ওকে খুব ভালো লেগেছে। খুব মজার ছেলে। 

জয়: ও আমাদের কি বলেছে জানোতো কাকিমা? ও নাকি বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপা থেকে এখানে এসেছে! ও একটা এলিয়েন! হাহাহাহা!

জিলি: আর ওর নাম কি বলেছে জানো? উদ্ভূতেশ্বর ডায়োজিনিস!

কস্তুরী: ডায়োজিনিস! দ রেবেল গ্রীক ফিলোজফার। ঠিকই তো! ওর জগতটাই যে একদম আলাদা। ওর সমবয়স্কদের সঙ্গে তো ওর কোনদিনই মেশার বেশি সুযোগ হয়নি। ওপাড়ার বাচ্চাদের কাছে ও তো ছিল এক আজব বস্তু, হাসির খোরাক। এই প্রথম এরকম সুযোগ .., আচ্ছা, ও কী রোজ তোমাদের সাথে খেলতে আসতে পারে? 

মৌ: ওমা নিশ্চয়ই। আপনি বিশ্বাস করুন, ও আজকে যেন একটা খুশির জোয়ার নিয়ে এসেছে আমাদের এখানে। 

দীপ: কস্তুরী, আজ ও না এলে, আমিও হয়ত আমার ছেলেমেয়েদের ওই একই পথে ঠেলে দিতে থাকতাম। আর শুধু আমি কেন, হাজার হাজার মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা-মায়েরাও তাই করছে। ভবিষ্যতের কল্পিত সুখের বদলে কেড়ে নিচ্ছে ওদের বর্তমান, ওদের শৈশব। আর ওদের দোষই বা দিই কী করে? আমাদের জীবনে আর কী লক্ষ্য আছে বলুন? একটা চাকরি, কোনরকমে গ্রাসাচ্ছাদন, ব্যস! আর তার জন্য প্রয়োজন একটাই মূলধন, ওই লেখাপড়া, আর একটা চাকরি। 

কস্তুরী: হ্যাঁ, আজ বুঝেছি কতটা অবিচার, কতটা অন্যায় আমি করেছি ওর সঙ্গে। 

মৌ: ও বলেছে, ডোন্ট স্টাডি, লার্ন। ঠিকই তো, আমরা পড়ি, শিখি না। শেষে শুধু থেকে যায় কাগজে ছাপা একটা ডিগ্রী। আর হারিয়ে যায় একটা গোটা শৈশব। 

দীপ: কস্তুরী, আজ আপনার ছেলের পরশ পেয়ে আমরা যেন এক নতুন আলো দেখতে পেয়েছি। ও যেন সত্যিই সেই পরশপাথর যার ছোঁয়ায় আমরা আবার আমাদের সেই সোনার সংসারটাকে খুঁজে পেলাম। 

কস্তুরী: আমার কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস জানেন, ও যদি একটা স্বাভাবিক পরিবেশ পায়, ওর সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটায়, ও আবার ভালো হয়ে উঠবে। 

দীপ: অবশ্যই। আর তারই সঙ্গে আমাদেরও সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। 

কস্তুরী: স্যরি, আপনাদের পরিচয়টা ...

দীপ: ওহো, দেখেছেন, বলাই হয়নি। আমি দীপাঞ্জন চৌধুরী, আমার স্ত্রী মৌ, জয়, ঝিলিক, জিলি। আর এঁকে তো অবশ্যই চেনেন, শ্রীমান উদ্ভূটেশ্বর ডায়োজিনিস ওরফে কৌস্তভ, ওরফে ঋজু! আরে মৌ, ওনাকে বসতে বলো। 

মৌ: ও স্যরি, আপনি বসুন প্লিজ। 

কস্তুরি: না না, আজ আমরা আসি। আবার আসছি তো ...

দীপ: দুমিনিট, জাস্ট দুটো মিনিট বসে যান। আজ বহুকাল পরে এই যন্ত্রটায় হাত দিয়েছি। আর একটা বাজাচ্ছি। ওয়ান ফর দ রোড, ওক্কে? মৌ, বাচ্চারা, কস্তুরী, গলা মেলাতে হবে কিন্তু। আর আপনাদেরও, কেমন? ওক্কে স্টার্ট!

সবাই: কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ--
সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ॥

মম চিত্তে নৃতে নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ॥


।।যবনিকা।।



কৃতজ্ঞতা:
আমার দিন কাটে না: কথা ও সুর: সুধীন দাসগুপ্ত
পুরানো সেই দিনের কথা: কথা ও সুর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোলো ছিন্ন বীণা: কথা: স্বপ্ন চক্রবর্তী; সুর: রাহুলদেব বর্মন
যদিও সন্ধ্যা আসিছে: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মম চিত্তে, নৃতে নৃত্যে: কথা ও সুর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
1

নাটক: সৌমিত্র চক্রবর্তী

Posted in




নাটক



সাকিন 
সৌমিত্র চক্রবর্তী 


(একাঙ্ক নাটক। চরিত্র- যুবক, রামভুজ, আব্বাস, রফিক, ফরিদা, আনসারি, গনুয়া, কন্সটেবল) 

(পর্দা খুললে দেখা যাবে একটি যুবক বয়স প্রায় ত্রিশ, খালি গা ও পরনে লুঙ্গি, হাঁটু ভাঁজ করে মাটিতে বসে ঢোল/নাল বাজাচ্ছে আর ভুল সুরে গাইছে।) 

যুবক – আরে রে রে আরা হিলে-ছাপরা হিলে-বালিয়া হিলে লা…আরে রাজা, কি হইলো রে বাবুয়া? কি হইলো রে? অ্যাঁ? জোরসে বলিয়ে! উচাসে বলিয়ে! আরে জাহান্নাম কে দালাল, এত্তো হাসলিস কেনো রে বাবা? হাসির কা ভইল বা? ইয়ে লোগ বহোত ফক্কর বা আসে। কা, গলতি গানা গাইলম? কা গলতি? গোলায় মিজিক সিসটেমুয়া ঠিক না আসে? আরে বহু কা ভাতিজা, হম কা শান আসে? ফিলমুয়া কা গানা তো সিনুয়া না হইলে সিনেমে মুডুয়া আসেনা, সমঝ গইলো! আরে বহুকা ভাতিজি, ফুফা ওউর ফুফি, রাম ওউর রহিম, জানকি ওউর বজরঙ্গবালি, শুনো হামার লছমি কি মায়ী- গলত গলত সে আদমী কহইলো/সীতা হইলো সতী/গলত গলত সে দরউপোদীকি জনম নিলো পনচপতি/গলত কি কাম মনতিরি হইলে মাপ করে রাসটরপতি/ওউর গরীব ভুখা গলত করলে তিহার মে ঘুসে রামগতি/…বাজা ছা রা রা রা রা রা… মন কি গানা আপন মিউজিকে, এহি রামগতি বহুত আচ্ছা গায়। শুনা করবেন? বাহ বাহ! তব শুনেন…লুঙ্গি ড্যান্স…লুঙ্গি ড্যান্স… (হেসে ওঠে) হামলোগ দাদা ছোটামোটা গলত করি। আরে ভেইয়া দুনিয়াদারি মে কওন না গলতি করথ হ্যায়। রাবন! নাম শুনিয়েসেন রাবন কি? টিভি মে রাবন কি থোবড়া দিখায়ে দিখায়ে সড়িয়ে দিলো। তো ওহ রাবন সীতা হরণ করিয়ে গলতি করলো না? আপকি বাঙ্গাল কা খুদিরাম, দেওতা থে দেওতা। তো ওহ খুদিরাম ভি হামার মজফফরপুর মে কিনিসফোর সাহেব কো মারতে যেয়ে মেমসাব মেরে গলতি করলো না? শোচিয়ে কি গান্ধীজী নোয়াখালি গেলো দাঙ্গা বনধ কোরতে, আর ইধার, কুছ গলত আদমী গলত কোরে দেশকো ফাড়িয়ে দুভাগ। হামলোগ দাদা ছোটামোটা আদমী ছোটামোটা গলতি করি। হাঁ গলতি করি। তাথে পিত্থিবির কুছ খেতি হোয় না। মগর ইখানে যে গলত, পিলান করিয়ে হইলো? ও শালা দুটা তিনটা লোগ পিলান কোরলো। বহোত রাতে ঘর জ্বালাইলো, আদমী খুন করলো, বহিন মাঈ দের টেনে লিয়ে গেলো। ইনসান মারলো ইনসানিয়াত, ইনসানদেরই পিলানে। বাহ…বাহ…বাহ…বাহ রে বাবুয়া বাহ… এ বহোত তাজ্জব কি ইনসানিয়াত। রামভুজের ফেমিলিটার সত্যনাশ হইয়ে গেলো। অ্যাঁ-অ্যাঁ-? 


(পৃষ্ঠা-২) 

কওন রামভুজ? রামভুজ কাহার।(গম্ভীর হয়ে ধীরে ধীরে বলে) ওহি বাবুয়া খাড়া রহইছে দচ্ছিন কৌনে, ওহ জানে রামভুজ কওন ছে। কা বাবুয়া, জানথ হ্যায় কি নাহি? রামভুজ তোহার সাথী বা! হাঁ, তো রামভুজ ছুট্টি লিয়ে দেশ মে গেছিলো। রামভুজ বোলে- ঘর গইল বা। হামারা ঘর বা। জিলা পূর্ণিয়া। ঘর… রামভুজের ঘর…(বাঁশি, ট্রেনের শব্দ)… বিহার মে এক ছোটি মোটি গাঁও জানকিপুরা। ইধার কাটিহারি, উসতরফ পূর্ণিয়া। পরথম পায়দল, ওকোরবাদ বয়েল গাড়ীমে যায়। তো রামভুজ পয়দলেই চলে টিশান থেকে। 

(রামভুজ চলে। আলো কমে। প্রায়ান্ধকারে দেখা যায় রামভুজ হাত তুলে গান ধরেছে। দেহাতী বিহারী গান। সঙ্গে হাঁটার মাইম) 

রামভুজ – (উল্লাস) আররে বাবুয়া-গনুয়া-হিরদোয়া! আরে হিরদোয়াকে মাঈরে ! জলদি আ রে তু লোগ! পবন কি হাওয়াসে আগে রামভুজ আ গইলো টিরেন সে পিছে। সরকার কি টিরেন। বাবু কহইলো, শাব্বাস রামভুজ! হামি কহইলম ঠাঙ্কু-ঠাঙ্কু। আরে শহর কি ল্যাঙ্গু, আধা সাহিব আধা আদমী। দোনো মিলাইকে আলু কা ছোকা। আরে, এ গনুয়া! গনুয়া! (ঘরের কাছে আসে) আরে হে বাবা! গইল কাঁহা সব? চারোধার শুনশান। এতো বহুত মুশকিল কি বাত! বড়ী সুমিস্যা! কোই বাত না কহইছে! গনুয়া রে! এ গনুয়া! গনুয়া আ আ আ… 

(ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়। আব্বাস ঢোকে। হাতে হ্যারিকেন) 

আব্বাস – কৌন রে বেটা? (হ্যারিকেন তুলে ধরে) কৌন রে? গনুয়া কি? 

রামভুজ – (উদভ্রান্তের মত বাইরে আসে) চাচা! হামি চাচা! (বজ্রাঘাতের শব্দ) 

আব্বাস – কৌন? রামভুজ? (বজ্রপতন) 

রামভুজ – হাঁ চাচা। কা হইয়েছে চাচা? কেওয়ারি খুলা, ঘরদুয়ার শুনশান! কা ভইল চাচা? (আব্বাস চুপ করে থাকে) চাচা? 


(পৃষ্ঠা-৩) 

আব্বাস – ইখন আইলি বেটা? 

রামভুজ – হাঁ চাচা। লেকিন… 

আব্বাস – বৈঠ। বৈঠ যা য়হা, বৈঠ, ইখানে বৈঠ! 

রামভুজ – চাচা! 

আব্বাস – রামভুজ বেটা খৈনি ছে তোহার পাস? তিনরোজ সে খৈনি না মিললো। 

রামভুজ – (খৈনির কৌটো দেয়) এ লো। চাচা, লাগছে কি তুম কুছু ছুপাচ্ছ? 

আব্বাস – কা ছিপাব বেটা? তোহার কে পাস কা ছিপাব? আল্লার রহিম হোলে তো কুচ্ছু ইয়াদ না থাকতো। মগর ভুল সকথ কাঁহা? 

রামভুজ – চারো তরফ শুনশান। গাঁও মে ঘুসিয়ে ইতনা রাস্তা আইলম, লেকিন কোই নজরোয়া মে না দিখাইলো। য়হাতক কি বাল-বুতরু ভি সব খেলা না কোরছে। ওকর বাদ ঘরে আসিয়ে কোই নেহি! য়হাতক কি সব সামান… 

আব্বাস – সব লুঠ হো গইলো রে… 

রামভুজ – অ্যাঁ! কা…কব…? 

আব্বাস – কম সে কম বিশ পঁচিশ রোজ পহলে। কিতনা সুন্দর শান্ত্ গাঁও ভইল হামাদের! সুনহরা সনসার। অভাব ছে। হাঁ অভাব ছে। মগর ওকোরকে লিয়ে কোই হাঙ্গামা ছিলোনা। সব কি বিচ মিলমিশ ছিলো। অচানক কা যো ভইল… 

রামভুজ – কা ভইল? 

আব্বাস – পরথম খবর ঠো আনলো ভকত পূর্ণিয়া কা বাজার থিকে। খবর ঠো এহি ছোটা গাঁও জানকীপুরাতে ফেলাইতে জাদা সময় লাগে না। ওকোর বাদ চারধার সে এক কে বাদ এক খবর আসতে লাগলো। পুরা গাঁও এ ফুসুর ফাসুর। সব কা মন মে সন্দেহ্ কি ছায়া। এইসি হাল জানকীপুরামে পহলে কভি হুয়া নহী। 

রামভুজ – আইসুন কা খবর বাটে জো হালত আইসুন বিগর গইলো? 

আব্বাস – উত্তর মে দাঙ্গা-ফাসাদ লাগি হ্যায়। 


(পৃষ্ঠা-৪) 

রামভুজ – উত্তর মে? 

আব্বাস – হাঁ। 

রামভুজ – হায় রাম! 

আব্বাস – হাঁ, ছিয়াল্লিশ সালে ভি দাঙ্গা লেগেছিল। লেকিন উ সুমায় ভি জানকীপুরায় আইসুন হুয়া নেহী। হাজীসাহেব কহইলো, এ ধরম রচ্ছা কি লড়াই। সমুচা ইসলামী এক হো! তারিক হাজীসাহেব কো কহইলো, আপ তো টৌনে ঠাকুরজীর সাথে মিলিজুলি বেওসা কোরেন? হাজীসাহেব কো হুকুম সে তারিক কো বেধরক পিটাই হোলো। এহি মহল্লায় তোহার লেড়কা হিরদোয়া মু খুলেছিলো। সব কি সামনে ঠাকুরজী কো কহইলো, ইয়ে আপলোগোন কা নয়া ধান্দা। 

রামভুজ – হায় ভগোয়ান! হিরদোয়া কহইলো এ বাত! 

আব্বাস – (ঘাড় নাড়ে) ওকোর বাদ বাকি সব দিন উসকো তালা বন্ধ্ কোরে ঘরের অন্দরে রাখলো। 

রামভুজ – হায় মাঈয়া গে... ওকোর বাদ? 

আব্বাস – গাঁও মে পরিস্থিতি বহোত গম্ভীর হো গইলো। বাজার সে সামান লাপাতা হতে লাগলো। হাটিয়া গইলে আদমী শুখা মু খালি হাত লৌটে আসে। চারগুনা পনচ্ গুনা দাম। সব সামান টৌনে না জানে কওন লোগ মজুত করিয়ে যাচ্ছে। রোজ চৌদা পন্দ্রা কামাই জিস লোগোন কো, ওহ লোগ ঘাসপত্তা খাতে শুরু কোরলো। হাজীসাহেব কহইলো, ইসকে লিয়ে জিম্মেবার হিন্দুলোগ। আর ঠাকুরজী কহইলো, ইয়ে সবহি কর রহত হ্যায় মুসলমান লোগ। পুরা গাঁও এর আদমীলোগ বেচেইন হইয়ে উন দোনোকি বাতে শুনতে লাগলো। মগর তব তক গাঁও মে চেইন থা। কোই গোলমাল য়হা নাহি লগা থা। ইধার দোনো মহল্লা মে হরদম অনজান আদমীলোগ আসছে। আউর আসছে নয়া খবর। আজ খুন হুয়া দশ, কাল বিশ, পরশো পচাশ। 

রামভুজ – ইয়ে সব সচ চাচা? 

আব্বাস – কেইসে জানথ হাম বেটা সচ কি ঝুঠ? হম বুড়া আদমী গাঁও সে তো জাদা দূর নাহি যানে সকথ হ্যায়। 

রামভুজ– কওন লোগ মরছিলো? 


(পৃষ্ঠা-৫) 

আব্বাস – নাহি জানথ বেটা। সব হি আপনা আপনা পাল্লা ভারী করনে কি কৌশিস মে লগ গইলো। মগর ইতনা তো জরুর পতা চলা কি হাওয়া দিনদিন গরম হয়ে উঠছে। মামুলি আদমীলোগো কি মু ডরকে মারে সাদা হয়ে যাচ্ছিলো। ফিরভি একটা আশা ছিলো। হাঁ, আশা ছিলো। অগর কিসি প্রকার ঝামেলাঠো খতম হইয়ে যায়। লেকিন নাহ! নাহি হুয়া। 

রামভুজ – নাহি হুয়া? 

আব্বাস – নাহ! বিশ পচিশ রোজ পহলে কি এক রাত। ওহ রাতমে ঠান্ডি গিরলো থোড়া জাদা। হামি জলদি জলদি রাতকি খানা খেইয়ে শুয়ে গইয়েছিলম। উধার নওজোয়ান লোগো কো লিয়ে তুহার মহল্লা মে ঠাকুরজী আউর হামার মহল্লা মে হাজীসাহেব মিটিন করছিলো। কওন জানথ যো… 

(বলতে বলতে তন্ময় হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে যায়। যেন দৃশ্য গুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। রামভুজ অস্থির হয়ে তাকে ধরে ঝাঁকুনি দেয়।) 

রামভুজ - ওকোর বাদ? ওকোর কে বাদ কি হইলো? চাচা ওকোর বাদ...? 

আব্বাস – (চমকে ওঠে) অ্যাঁ-হাঁ-হাঁ- ওকোর বাদ নিদ টুটলো ভারী রাতমে এক ভয়ানক আওয়াজ সে। জলদি উঠিয়ে দেখি পছিম ধারে আকাশ লালে লাল। 

রামভুজ – হায় ভগোয়ান! হামার গনুয়া? হিরদোয়া? 

আব্বাস – হিরদোয়া কো তালা বন্ধ কোরে রাখিয়েছিলো ঠাকুরজীকি চেলালোগ, আউর তালা তোড়ে তলবার সে কাটিয়ে ফেললো হাজীসাহেবকি চেলালোগ। 

রামভুজ – (কথাটা বুঝতে সময় লাগে। বোবার মত পিছিয়ে আসে। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ওঠে) না-না-নাহি চাচা! না-আ-আ-আ- এইসি মাৎ বোলিহো চাচা, মাৎ বোলিহো! হিরদোয়া ছোটা লেড়কা। ওহ কুছ বুঝেনা, কুচ্ছু জানেনা। মাৎ বোলিহো চাচা! আইসুন মাৎ বোলিহো! (কান্নায় ভেঙে পড়ে) 

আব্বাস - (রামভুজের কাছে এগিয়ে আসে। মাথায় হাত রাখে।) বেটা ধীরজ রাখ। 

রামভুজ – (একটু সামলে নিয়ে বলে) যেখন উর জনম হোল, ওকোর মাঈয়া মরতে মরতে বেঁচে গেলো। হামি তেখন বাঙ্গালের কারখানায় কামে লেগে আছি। ছোটা মোটা মজদূর। দোরকার মাফিক 


(পৃষ্ঠা-৬) 

ছুট্টি পাইনা। যেখন ছুট্টি পেইয়ে ঘরে আইলম, তেখন উর উমর সাত মাহিনা। শাস্ত্রীজী কহইলো, রামভুজ, রাজা বেটা জনম লিয়া হ্যায় তেরা ঘরমে। বহোত বড়া আদমী বনেগা (কান্না)। চাচা, হামি উসকে লিয়ে নয়া কামিজ আনলম। নয়া কিতাবের পয়সা আনলম। বহোত তকলিফ কোরে সাত্তু খেইয়ে, লিট্টি খেইয়ে পোয়সা জমালম। চাচা, ইখন ও সব সামানের কি হোবে? রূপিয়া পোয়সা গুলা লিয়ে হামি কি কোরবো চাচা (কান্না)। চাচা! বোল সকথ হ্যায়, হামি গরীব দুখী আদমী, কিসিকো কভি কোই চ্ছেতি কোরিনি। ফিরভি কেন আইসুন হোলো? 

আব্বাস – বেটা! 

রামভুজ – হিরদোয়া তো ছোটা লেড়কা, উর কেন আইসুন হোলো? চাচা, কোই বোলতে পারে উর কি দোষ? 

আব্বাস – (রামভুজের মাথায় হাত দেয়) দোষ! গুণাহ্! গুণাহ্ তো জানকীপুরামে নব্বে জনারই ছিলোনা বেটা। ফিরভি তাদের মোরতে হোলো। ছোড়তে হোলো ঘরবাড়ি। সবকো লোটা কম্বল যো কুছ পেলো, সব বাহারের আদমীরা লুঠ কোরে নিলো। 

(রামভুজ কেঁদে চলে) 

আব্বাস – গুণাহ্ হিরদোয়ারও ছিলোনা, ছিলোনা আনোয়ারেরও। ফিরভি ও দোনোকো হি… 

রামভুজ – আনোয়ার…! 

আব্বাস – আগে দেখতে গিয়েছিলো কি কা ভইল। সারারাত আউর ফিরলো না। সবেরে যেখন দেখা মিললো, তেখন ধর আউর মুন্ডি দুধার। রামভুজ, হামার আউর কোই নাহিরে! ওহি এক বেটাই ছিলো। এহি উমরে হামি কি কাম কোরবো? কি খাব? রিলিফ কেম্পসে ছোড়ে দিয়েছে তিনরোজ। গাঁওমে ফিরে দেখি সব ইন্দারায় লাশ ভরতি। পানি সড়িয়ে গেছে। খানা নাহি। পানি নাহি। গোটা পাও শুনশান। হামি তো কিসিকো পাস কোই গুণাহ্ কোরিনি। ফিরভি কিসলিয়ে হামার আইসুন হোলো বেটা? কিসলিয়ে? 

(দুজন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে) 

রামভুজ – (একটু সামলে নিয়ে) আর গনুয়া? 

আব্বাস – গনুয়া কে সাথ হামার ভেট হয়েছিলো পূরণিয়ার নজদিকে মাধেপুরা রিলিফ কেম্পে। ওহ আকেলা ছিলো। গোদ মে উর বাচ্চাঠো। 


(পৃষ্ঠা-৭) 

রামভুজ – আর বাকীসব? লছিমা? হিরদোয়ার মা? বাকীসব…? 

(মঞ্চে দৃশ্যান্তর। সেই প্রথম দেখা যুবককে দেখা যায়।) 

যুবক – বাকীসব? আররে বাবুয়া! মেরে লাল! মেরে চুনচুন-চুনমুন-টুনটন-পুনপুনুয়ারে! বাকীর মানে কি আসে? হামার দেশে- বাকী মানে নগদ বাকী/ বাকী মানে জন্ সাধারণ/ দুখে মরে বাকী সব লোগ/ সুখে থাকে বাস পঞ্চ্জন/ বাকীকে মারে দুনিয়া হিলথ হ্যায়/ বাকী মে বিকে হৈ ইনসান/ ভুখ-বিমারি-দাঙ্গা-ফসাদ/ টেটাসবালা ছোড়কে মরে/ বাকী হিন্দুস্তান। বাবুয়া! আব্বাস কৈসুন বোলবে বলিয়ে তো? কি বাকীসব কুথায় গেলো? হো সকে কি রাস্তামে ভুখা মোরেছে। হো সকে তালাশ কোরলে কোই রান্ডিখানামে লছিমাকো মিলতে পারে। হো সকে কুইয়া সে যো লাশ উঠছে, হামাদের এহি শও ক্রোড় আদমীর দেশে এক দুজন হারাইয়ে গেলে, লাপাতা হোলে, কি ফরক পড়ে? কা ফরক পড়ে ওহি হাজীসাহেব আউর ঠাকুরজী দের যো লোগ কানোকান জহর ঢালিয়ে বেড়ায়? বিচ বিচমে হিরদোয়া আউর আনোয়ারলোগ (দীর্ঘশ্বাস পড়ে)… আরে আরে…আরে রে রে রে বাবুয়া… দেখিয়েছেন, হামি ভি দোকুমেন্টারি ফিলিমের মাফিক বহুত ভারী ভারী বাত বোলে দিলম। আসলিয়ত মে ওহি রামভুজ আউর আব্বাস স্রিফ ইয়ে নৌটংকির কোই নকলি আদমী না আসে। সব আসলি আদমী…সব…! তো দাদ্দা, হাপনাদের বাঙ্গালে একঠো বাত আসে। যিতখেন শ্বাস তিতখেন আশ। তো জারী করো তালাশ… কোথায় আসে লছিমা ইয়া গনুয়ার বাস… শুরু হো যা তালাশ… চলো পায়দল কাটিহার সে পূরণিয়া চালিশ মিল রাস্তা… বিচোবিচ মাধেপুরা রিলিফ কেম্প। সরকার কি তরফ সে দাঙ্গা সে বাঁচে হুয়ে আদমীকো কবুতর কে সামনে গেঁহু- কুত্তাকে সামনে একটুকরা রোটি- পায়দল চলতে চলতে থোকে গেলম… থোকে যেয়ে পেয়ে গেলম কেম্পের সামনে এক পেড়। কোই হ্যায় হো… তালাশ জারী… জানতে হো কোই খবর… কাঁহা হ্যায় গনুয়া ইয়া উসকো বেটা?... কোই হ্যায় … কোই হ্যায় হো… 

(ধীরে যুবকের গলা মিলিয়ে যায়। দৃশ্যান্তর। ডাউনস্টেজের মাঝখানে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত কাঁটাতারের বেড়া। আপরাইটে একটা চারপাই। ধীরে আলো জ্বলে। আস্তে আস্তে ঢোকে রফিক। বছর পঁয়ত্রিশ/চল্লিশ বয়স। লুঙ্গি, গেঞ্জি পরনে। ধীরে ধীরে এসে ডাউনলেফটে বসে। দূরের একটি গাছ দেখতে থাকে। মৃদু পায়ে রফিকের বউ ফরিদা আসে। উগ্ররঙের ময়লা ছাপা শাড়ী। রফিকের গায়ে হাত দেয়। রফিক চমকে ওঠে।) 

রফিক – কে-কে হো? ও ফরিদা! এ ফরিদা আ, বৈঠ ইধার। দেখ দেখ হামাদের ঘরের নজদিকে একঠো কড়াইয়া পেড় আছে। ঠিক ওইসুন একঠো কড়াইয়া পেড় দেখ। 


(পৃষ্ঠা-৮) 

(দুজনে তাকিয়ে থাকে। উল্টোদিক থেকে সিআরপিএফের এক কনস্টেবল ঢোকে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে।) 

কনস্টেবল - ...হাম না যাইবে শ্বশুরঘর মে হে বাবা... হাম না যাইবে শ্বশুরঘর মে হে হে... (একই লাইন দুতিন বার গায়। পকেট থেকে খৈনির কৌটো বার করে খৈনি তৈরি করতে থাকে। জোরে ঢেকুর তোলে।) আহহ... আজ খানাঠো জবরদস্ত হইলো। এহি করোজ বেশ শান্তি আছে। হাঙ্গামা হুজ্জোত না হোয়ে আইসুন রহে তো বাঁচা যায়। সো না, আজ জামুনগড় দৌড়ো তো কাল মিনুইয়া, পরশো ফির আউর এক জাগা। আরে ছি ছি, এ শালা সিআরপির নোকরি শালা জানবারেও যেন না কোরে। (গজগজ করতে করতে মুখে খৈনি দিতে গিয়ে দেখে রফিক কখন যেন গেট খুলে বাইরে যেতে চাইছে। সে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে-) ...এ শালা ভুচ্চরকে ছৌয়া রফিকোয়া! কাঁহা যাওথর হো? রুখ-রুখ-রুখ যা! 

রফিক – (ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে) মালিক... থোরা ওহি কড়াইয়া পেরঠোর নজদিকে যাব। 

কনস্টেবল – চুপ শালা! ওখানে যেয়ে তুহার মরা লেড়কার ইয়েতে বাতি জ্বালাবি? চুপচাপ থাক এহি জাগায়। বাহার যানা একদম বনধ। শালা বাহারে যেয়ে ফির কোনো ঝুটঝামেলা পাকাবি, আউর জবাব দিতে হোবে হামাদের। একদম বাহার যাবিনা। 

রফিক – জী মালিক! 

কনস্টেবল – হাঁ, আইসুন বাত শুননা। (চারপাইতে শোবার চেষ্টা করে, কিন্তু ছোটো চারপাইতে শুতে পারেনা। কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টার পরে উঠে বসে। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে গেছে) ধূর শালা এ ভুচ্চরকে ছৌয়া চারপাইতে শালা শুতল ভি নাহি সকথ। এত্তো ভারী খানা হোয়ে গেলো। থোড়াসুন না শুতলে মুশকিল। নাহ্ ... উধারেই যেতে হোবে। এ শালা ভুচ্চরকে ছৌয়া রফিকোয়া! একদম বাহার যাবিনা। (উইংসের দিকে তাকিয়ে জোরে বলে) এ আব্বাসচাচা হো! থোড়াসুন দেখনা হো! কুচ্ছু গড়বড় হোলে হাঁক মারবে। হামি উধারেই আছি। 

(কনস্টেবল চলে যায়। নেপথ্য থেকে আব্বাসের গলা ভেসে আসে -হাঁ বেটা। কথার ফাঁকে ফরিদা কখন যেন উঠে চলে গেছে। রফিক আবার বেড়ার ধারে এসে বসে। এইসময় বেড়ার ওধারে একজন লোক গুটিশুটি পায়ে এসে দাঁড়ায়। পরনে হাঁটু পর্যন্ত ছেঁড়া ধুলিধুসরিত ধুতি, খালি গা। মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। ওকে দেখে রফিক চমকে ওঠে।) 

রফিক – কে? কে হো? 

লোকটা – হাম… 


(পৃষ্ঠা-৯) 

রফিক – কাঁহাসে আওথ ভেইয়া? নাম কেয়া? 

লোকটা – গনুয়া। আসছি জানকীপুরা থেকে। 

রফিক – জানকীপুরা? সে কেত্ত দূর হোবে? 

গনুয়া – লগভগ তিশ-পয়তিশ মিল দূর। 

রফিক – কাঁহা যাইবো অব ভেইয়া? 

গনুয়া – টৌনে যাব। পূরণিয়া। 

রফিক – তা টৌনে তো… 

(কথা শেষ হয় না। তার আগেই গনুয়ার কোলে ন্যাকড়ায় পুঁটলির মত জড়ানো শিশু তীব্র স্বরে কেঁদে ওঠে) 

গনুয়া – এ বেটা…এ বেটা…চুপ যা, চুপ যা। এ বেটা লছিয়া চুপ যা বেটা। চুপ যা… 

(কান্না থামেনা। গনুয়া অসহায়ের মত থামানোর চেষ্টা করে যায়। বাইরে থেকে পূর্বোক্ত কনস্টেবলের হুংকার ভেসে আসে।সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটার কান্না থেমে যায়।) 

কনস্টেবল – আরে কৌন হ্যায় রে? কৌন চিল্লাতা? (মঞ্চে ঢোকে) কৌন চিল্লাতা হ্যায় অ্যাঁ ? (গনুয়াকে দেখে) আরে কে হ্যায় তু? ইখানে কি করছিস? 

গনুয়া – (সন্ত্রস্ত) জী…জী…হাম… 

কনস্টেবল – আরে ভুচ্চরকে ছৌয়া, কৌন হাম? সবহি তো হাম। ম্যায় ভি হাম। ইয়ে রফিকোয়া ভি হাম। ফির তু ভি হাম। আরে লেকিন তু কৌন হাম? 

গনুয়া – জী...হাম...গনুয়া... 

কনস্টেবল – অ্যাঁ! গনুয়া! মানে হিন্দু? 

গনুয়া – জী...জী... 

কনস্টেবল – আরে সর্বনাশ হো গয়া। কিরপা কর রামজী। তু শালা কাঁহাসে আওথ? 

গনুয়া – জী জানকীপুরা সে। 


(পৃষ্ঠা – ১০) 

কনস্টেবল – জানকীপুরা? কওন জানকীপুরা? রঘুবীরগড়-ভুরঘাট-জানকীপুরা? 

গনুয়া – জী...জী... 

কনস্টেবল – আরে সর্বনাশ! হুয়া তো সব শালা ভুচ্চরকা ছৌয়া বদমাশ লোকের বাস! ছে সাত রোজ পহলে দাঙ্গা হোয়ে গেল! কমসে কম পচাশ ষাট আদমী মরলো! 

গনুয়া – জী...জী... 

কনস্টেবল – আরে শালে, তু একে হিন্দু, ওকোর বাদ ফির জানকীপুরামে ঘর। তু ইখানে কা করছিস? ই মুসলমানকে রিলিফ কেম্প। জানথ হ্যায় কি নাহি? 

গনুয়া – (বিভ্রান্ত) জী...জী... 

কনস্টেবল – আরে শালে জী জী কে বাচ্চে, ভুচ্চর কে ছৌয়া। কৌন মতলবে আসলিস ইখানে? অ্যাঁ? ঠিক সে বোল? দাঙ্গা ফাসাদের মতলব আছে?কা শোধ লিতে আসলিস? 

গনুয়া – জী জী মালিক... নেহি মালিক! নেহী মালিক! 

কনস্টেবল – আরে শালে! যেত উল্টাপুল্টা বাত বোলে! এ তোহার হাথ মে কি আছে? বোমা আছে কি? দেখা-দেখা! হেনে আ! (গনুয়া ভয়ে ভয়ে বেড়ার কাছে আসে। কনস্টেবল বাচ্চার ঢাকা তুলে দেখে) – আরে ইয়ে তো বাচ্চা আছে! কিসকা বাচ্চা? শালা বাচ্চা চুরাইলি কি? কিসকা বাচ্চা বোল শালে! নেহিতো এইসা ডান্ডা লগাইবো... বোল শালে কিসকা বাচ্চা চুরাইলি? 

গনুয়া – জী... জী মালিক নেহি মালিক! চুরায়া নেহি মালিক! সচ বোলছি। 

কনস্টেবল – চুরায়া নেহি? তো কিসকা বাচ্চা? তুহার? 

গনুয়া – জী মালিক। লেড়কা। 

কনস্টেবল – হুমম...তো ইত্তা ছোটা বাচ্চা কো লিয়ে কুথায় যাবি? ইসকা মা কুথায়? 

গনুয়া – নাহি জানথ হ্যায় মালিক! 

কনস্টেবল – নাহি জানথ? নাহি জানথ মানে? আরে বুরবক কাহিকা, ভুচ্চর কা ছৌয়া, ইসকা মা কুথায় নাহি জানথ তো পয়দা করলিস কোখোন? 


(পৃষ্ঠা – ১১) 

গনুয়া – মালিক, গাঁও সে দাঙ্গা কা সময় বাহার থেকে আদমী এলো। হামার ভাতিজা কে কাটলো। ইসকা মা লছিমা কো উঠায়ে লিয়ে গেলো। হামি কোইরকম এহি বাচ্চাঠোকো লিয়ে পিছেবালা খিড়কি দিয়ে ভেগে জান বচাইয়েছি। 

কনস্টেবল – হুমম... তো ফির ঘর লৌটে নাহি গয়া? 

গনুয়া – গয়া থা মালিক। মগর লছিমা আউর নাহি লৌটে এলো। ভাতিজার লাশঠোকে জ্বালাইলম। ফির এহি রাস্তা পাকড়লম। যাব টৌনে। 

কনস্টেবল – কাহে? গাঁও এর বাকী আদমী...? 

গনুয়া - কোই নেই মালিক। গোটে গাঁও শুনশান। সিরিফ বিচ বিচ মে পুলিশগাড়ী যাচ্ছে। 

কনস্টেবল – (গলার স্বর নরম হয়ে আসে) হুমম... তুকে ইখানে তো রাখা যাবে না। ইঠো মুসলমান কো রিলিফ কেম্প। হিন্দুকো কেম্প হইলো কাটিহার মে। মগর সে তো ইক্কেবারে উলটা রাস্তা। 

গনুয়া – না মালিক, হামি রহতে আসিনি। ধূপের বহোত তেজ। শোঁ বাচ্চাঠোকে লিয়ে এলম। থোড়া এহি কড়াইয়া পেড়ঠোর নিচে বসবো। ধূপ থোড়া বহোত ঘটলেই চলে যাব। 

কনস্টেবল – ওহ... আচ্ছা। ঠিক হ্যায় বৈঠ। লেকিন কোই ঝামেলা পাকাইবি না। এহি কেম্পের নজদিকে কোই বাহারের আদমীকো আসতে দিবার হুকুম নাহি বা। ধূপ ঘটলেই চলে যাবি। 

গনুয়া – জী মালিক। দুফারের বাদেই চলে যাব। 

কনস্টেবল – ওহ, যেত্তো ঝামেলা। থোড়া যে আরাম করব, উসকা কোই উপায় নাহি। এ শালা ভুচ্চর কে ছৌয়া রফিকোয়া, উর সাথে গুজুর গুজুর ফুসুর ফাসুর কোরবি না। 

রফিক – জী মালিক। 

কনস্টেবল – হাঁ, আইসুন বাত শুননা। শালা যেত্তো ঝামেলা পাকাইবে, আউর জবাব দিতে হোবে হামাকে। 

(গজগজ করতে করতে চলে যায়) 

রফিক – এ ভেইয়া! 

গনুয়া – অ্যাঁ ! 


(পৃষ্ঠা – ১২) 

রফিক – দেখো মজা। পুলিশ আসার সাথ সাথ বাচ্চাঠো রোনা থামাইয়ে চুপচাপ। এহি বাচ্চাঠো ভি জেনিয়ে গেছে দুনিয়া মে বেঁচে রহতে গেলে পুলিশকো ডরাতেই হোবে। ( নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ওঠে।) 

গনুয়া – (ক্লান্ত স্বরে) হাঁ। একগো বাত পুছবো ভেইয়া? 

রফিক – হাঁ হাঁ, জরুর... 

গনুয়া – তুম কৌন গাঁওমে রহত হো? 

রফিক – নওসেরগঞ্জ। 

গনুয়া – বহোত দূর? 

রফিক – নাহি নাহি। নজদিগেই হ্যায় হামনিকা গাঁও। জাদা সে জাদা এক ডেড় মিল দূর। 

গনুয়া – এতনা নজদিগে তুমহাদের গাঁও, তব আপনা ঘর ছেড়ে তাম্বুতে আছো কেনো? 

রফিক – সব উপরবালাকি খেল। তুম কুচ্ছো নাহি জানথ? 

গনুয়া – নাহি ভেইয়া। 

রফিক – কুচ্ছু শুনা কোরোনি? 

গনুয়া – (কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে) শুনা কি ইধার ভি দাঙ্গা হোয়েছিলো। বহুত আদমী মোরে গেছে। বহুত ঘর জ্বলে গেছে... 

(হঠাৎ এক তীব্র আক্রোশের চীৎকারে দুজনেই ঘাড় ঘোরায়। ফরিদা আর একটি কমবয়সী যুবক আনসারি এসে দাঁড়িয়েছে। সে চিৎকার করে বলে-) 

আনসারি – মর গিয়া নেহী। জান সে মার দিয়া। আট দশগো গাঁও কো জ্বালা কর মিট্টিমে বরাবর কর দিয়া। হমলোগোন কা গাঁও, হামলোগোন কা আদমী। 

রফিক – আরে! আনসারি তু! 

আনসারি – ওহি আদমীঠোর সাথে কি বকরবকর কোরছিস? বনধ কর বকোয়াস! উঠে আয়! 


(পৃষ্ঠা – ১৩) 

রফিক – এ আনসারি! উসকা কা কসুর? উসকো ভি তো সোব কুছ চলিয়ে গিয়েছে হাঙ্গামাতে। গরীব দুখী আদমী। কওন দূরের গাঁও সে তিশ পয়তিশ মিল পয়দল চোলতে চোলতে আসছে বহোত… 

আনসারি – চুপ হো যা তু। এ শালেকো কোই কসুর নেহি অ্যাঁ? উসকা জাতভাই লোগ হামাদের গাঁও জ্বালাইছে, হামাদের আদমীকো মেরেছে। 

রফিক – কওন কসুর কোরলো আউর কিসকা উপর তু গুসসা কোরছিস? নেহি এ ঠিক নেহি। 

আনসারি – চুপ হো যা শালে কাফের কি ভোকিল! 

(সেই আগের দেখা আব্বাস ঢোকে। তার আচরণ প্রায় অভিভাবকের মতো।) 

আব্বাস – কা হুয়া হ্যায় রফিক? গোলমাল কিসের? 

রফিক – আব্বাসচাচা, পহলে হামার বাত শুনেন। 

আব্বাস – ঠিক হ্যায়, বোল… 

আনসারি – নেহি হামি পহলে বোলবো… 

আব্বাস – (হাত তুলে থামায় আনসারি কে) বোল বেটা। (হঠাৎ গনুয়ার দিকে নজর পড়ে) আরে গনুয়া তু! 

রফিক – হাপনি ইকে পহচানছেন চাচা? 

আব্বাস – একহি গাঁও এর আদমী হামলোগ। বচপনসে হামার লেড়কার সাথে খেলে বড়া হোয়েছে। 

গনুয়া – আনোয়ার ভি ইখানে আছে চাচা? 

আব্বাস – আনোয়ার… 

আনসারি – দেখিয়ে চাচা, দেখিয়ে। আপহি গাওয়া। এ শালারা আপকি বেটা আনোয়ার কো মেরেছে, ঘর জ্বালিয়েছে, আউর রফিক… 

আব্বাস – আঃ! আনসারি! কি আলতুফালতু বকোয়াস করছিস? 

রফিক – দেখিয়ে চাচা, তোখোন থেকে আনসারি উল্টাপুল্টা কহইছে। কহইছে কি হামাদের নওসেরগঞ্জে যেত্তো আদমী মোরেছে, ঘর জ্বলেছে, সব কসুর নাকি গনুয়ার। 


(পৃষ্ঠা – ১৪) 

আনসারি – শও বার উসকা কসুর। হাজার দফে উসকা কসুর। তু শালা কাফের কি দোস্ত... 

রফিক – দেখ আনসারি... 

আব্বাস – এ ঠহর যা। কি শুরু কোরিয়েছিস দুজনায়? গনুয়ার কোই কসুর নাহি। এক আদমী কসুর কোরেছে বোলে আউর এক আদমীর গোলা কেটে ফেলতে হোবে? এ কেইসুন বাত? 

আনসারি – না চাচা এইসা বোললে... 

আব্বাস – তু যা ইখান থেকে। ঝামেলা উমেলা মাত কর। যা। 

(কনস্টেবল ঢোকে। প্রচন্ড বিরক্ত।) 

কনস্টেবল – কেয়া হুয়া রে? ইতনা হাল্লাগুল্লা কিসের অ্যাঁ? দিনটা দিলে চৌপাট কোরে। আরে এ শালা ভুচ্চর কে ছৌয়া আনসারি, তু জরুর ইখানে ভি কোই ঝামেলা পাকাইয়েছিস? শালা হর সময় হর জাগায় ঝামেলা। আব দেগা বেড়ি লাগিয়ে। নেহি তো কেম্প সে ভাগিয়ে দেব। ফোট্ শালে ঝামেলাবাজ আদমী হামলোগ রাখতে পারবো না। শালা তুলোগ ঝামেলা পাকাবি, ভুচ্চর কে ছৌয়া কাহিকা আউর জবাব দিতে হোবে হামাদের। 

আব্বাস – আরে নেহি নেহি সিপাইজী, ওইসা ঝামেলা কুছু হুয়া নাহি। আপ নিদ যাইয়ে আরামসে। সো রোকোম কুছু হোলে আপকো বুলাবো। 

কনস্টেবল – ওহ আচ্ছা। আপ চাচা আছেন বোলে বহুত শান্তি আছে। নেহি তো এ শালে লোগ... ঠিক হ্যায় থোড়া দেখবেন যেন ঝনঝাট উনঝাট না হোয়। 

আব্বাস – হাঁ হাঁ দেখবো। 

কনস্টেবল – হামি আছি জেগেই। শালা ভুচ্চর কে ছৌয়া মুখেই বোলছি নিদ। নিদ যেতে সকছি কাঁহা? যেইসুন জুটেছে সোব! (চলে যায়) 

আব্বাস – চল বেটা, চল। আউর ঝামেলা মাৎ বাড়া। চল... 

(আব্বাস ও আনসারি চলে যায়। ফরিদা এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার বসে পড়ে।) 

রফিক – মনে দুখ গুসসা রেখো না ভেইয়া। দাঙ্গা মে আদমী মোরেছে। গাঁও জ্বলেছে। সোব ফেলে তাম্বুতে এসে সিপাইদের পাহারায় রহতে হোচ্ছে। তাই কিসিকো দিমাগের ঠিক নেই। 


(পৃষ্ঠা – ১৫) 

গনুয়া – দুখ! নাহি ভেইয়া পরথম থোড়া বহোত এহসাস হোতো। আব... নেহি ভেইয়া নেহি, হামলোগ বহুত ছোটা মোটা আদমী। দুখ গুসসা কোরে কি কোরবো! আউর ধূপের তেজ কোমলেই তো চোলে যাব। ই সোব বাদমে খেয়াল হি রহবে না। 

রফিক – দেখো তো ক্যায়া হুজ্জত হোয়ে গেল! 

গনুয়া – আচ্ছা ভেইয়া, একগো বাত পুছবো? 

রফিক – হাঁ হাঁ, জরুর, বোলো- 

গনুয়া – ইখানে তুমলোগ কওন কওন আছে? 

রফিক – হামি আউর হামারা বিবি ফরিদা। ( হাত তুলে দেখায়) দাঙ্গার সুমায় ডরে উর বুলি বনধ হোয়ে গেলো। হামাদের তো ইখন আউর কুছু নাহি, যো দিয়ে ডাগটর উগটর দেখাবো। 

গনুয়া – তুমলোগোন কা লেড়কা বাচ্চা না আছে? 

রফিক – (দূরের দিকে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে বলে) থা- সবহি থা। হরিয়ালি খেত ছিলো, সুনহরা সনসার ছিলো, মোকামে আমন ছিলো, আউর ছিলো হামার আউর ফরিদার একলৌতা বেটা। বহোত শখ কোরে নাম রাখিয়েছিলাম সিকান্দার। (বিড়বিড় করে) সিকান্দার! বুড়াপা তে সাথ দিবে, জানাজা তে কান্ধা দিবে, ভরি জওয়ানিতে ঘরে টুকটুকে বিবি আনবে। বহোত সাধ ছিলো। হাঙ্গামার রাতে উকে বাহারে খাটিয়া তে শুতিয়ে হামলোগ মিয়া বিবি ঘরের অন্দরে খানা খাচ্ছিলম। হামার লেড়কার মুন্ডিঠো কেটে তিরশুলের ডগায় গেঁথে উরা লিয়ে গেলো। আউর ঘরে আগ লাগিয়ে দেহ ঠো সিখানে ছুঁড়ে দিলো। হামলোগ পিছনে কেবারি খুলে ভাগলম। তারপর থেকেই ফরিদা… (ফরিদা দুর্বোধ্য আওয়াজ করে কেঁদে ওঠে) …নেহি-নেহি ফরিদা, নেহি… সামহাল যো…সামহাল যো… 

(রফিক ফরিদা কে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়) 

গনুয়া – হামাকে মাফ কোরে দাও ভেইয়া। 

রফিক – (একটু সামলে নিয়ে) কেন? তুমি ফির কি কোরলে? 

গনুয়া – কুচ্ছু নাহি বুঝে তুমাদের ঘাও দিয়ে ফেললাম। 

রফিক – (ক্লিষ্ট হাসে) এ আউর কি ঘাও? তুহু কে তো ভি আচ্ছা চোট লাগলো। ছোড়ো উ বাত… 


(পৃষ্ঠা – ১৬) 

(হঠাৎ বাচ্চাটা আবার তীব্র স্বরে কেঁদে ওঠে) 

গনুয়া – নেহি এ লছিয়া, নেহি রে! মাৎ রো, মাৎ রো। আচ্ছা লেড়কা হামার চুপ যা। (কান্না কিছুতেই থামেনা। এবার গনুয়া রেগে ওঠে) শালে জানোয়ার কি বাচ্চা! মা কা মাফিক মরলি না কেনো? হামি বাঁচতম। খালি চিল্লায়! হামার কাছে চিল্লিয়ে কি লাভ? দেবো গলা দেবে খতম কোরে। বিলকুল চুপ হোয়ে যাবি। 

রফিক – (উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে) আরে আরে, বৈঠো ভাইয়া, বৈঠো। ইত্তো গুসসা কোরলে চলে? উর কি কোনো হুঁশ আছে? কি হইয়েছে তুহার লেড়কার? 

গনুয়া – (হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে) ভুখ ভেইয়া, ভুখ। ক রোজ আটা গুলে খাইয়ে রেখেছিলাম। আটা ফুরালে রামদানা সিজা, লিট্টি, ঘাটোগুড়া পানিতে গুলে খিলায়েছি। ইখন আউর ও ভি নেহি। হামি ভগোয়ান কো রোজ বোলি, হে ভগোয়ান! বাচ্চাঠোর লিয়ে হামার ছাতিমে সিরিফ এক বুঁদ দুধ দাও। কা করে? লেড়কা ঠো হামার ভুখায় মোরে যাবে। 

(অসহায় ভাবে কাঁদতে থাকে। ফরিদা এতক্ষণ চুপ করে দেখে যাচ্ছিল। এবার উঠে এসে রফিক কে ডেকে একপাশে নিয়ে গিয়ে ইশারায় কিছু বলে। রফিক অবাক হয়ে একবার স্ত্রীর দিকে একবার গনুয়ার দিকে তাকাতে তাকাতে এসে গনুয়া কে বলে) 

রফিক – ভেইয়া, তুমহার লেড়কা কো একবার দাও তো! 

গনুয়া – অ্যাঁ! কেনো? 

রফিক – কি হোলো? দোও, ঘাবড়াও মৎ। তুহার লেড়কা কো হামরা ছিনায়ে লিব না। বহুত রোতা হ্যায় ইয়ে লেড়কা। ইমন কাঁদলে সিনা ফেটে যাবে। 

গনুয়া – কুছু খিলাবে? 

রফিক – (হাসে) খিলাবে নয়, পিলাবে। ইত্তা ছোটা বাচ্চাকো কোই কুছহু খিলায় ? দোও... 

(হতভম্ব গনুয়া তারকাঁটার বেড়ার ওপর দিয়ে রফিকের হাতে পুঁটলি শুদ্ধ বাচ্চাকে দেয়। রফিক তাকে ফরিদার হাতে দেয়। ফরিদা দর্শকের দিকে পেছন করে বসে। আভাসে বোঝা যায় যে, সে শিশুটিকে স্তন্যপান করাচ্ছে।) 


(পৃষ্ঠা – ১৭) 

গনুয়া – ভেইয়া...ভেইয়া...তুমলোগ দেওতা আছে...তুহারা আদমী না দেওতা আছে ভেইয়া... (গলা রুদ্ধ হয়ে আসে।) 

রফিক – আরে নেহি নেহি। গরীব আদমী গরীব আদমী কে লিয়ে ইত্তোটুক যদি না কোরে, তব আউর কে কোরবে বোলো? দুসরা তরফ ফরিদার সিনাতে আজ লিয়ে সাতরোজের দুধ জমে আছে। উ আউর কি কামে লাগবে বোলো? তুমহার বেটাকো পিলাবে তো উর জান বাঁচবে। আজ রাতভোর বেফিকির। যার লিয়ে জমা খানা সো পেলোনা তো কি হোলো? আউর এক বেটা তো পেলো। 

গনুয়া – বেটা? 

রফিক – (হাসে) দুনিয়ার সোব ঔরত আউর বুতরু দের সম্বন্ধ্ কি জানো? মা বেটার সম্পরক্ । গোলমাল যিতনাহি পাকাও, কিসিকো তাগদ নাহি এহি সম্বন্ধ্ কো টুকরা কোরতে পারে। (গনুয়ার হাত ধরে) ভেইয়া! বেটাকো সবসময় নজদিগে রাখবে। আঁখের সামনে রাখবে, তব হামাদের মত তুমহাকে পছতাতে হোবে না। (কন্ঠরুদ্ধ হয়ে আসে) 

(ফরিদার স্তন্যপান করানোর সঙ্গে সঙ্গে শিশুটির কান্না থেমে গেছিল। সে হাত তুলে ইশারায় রফিককে ডাকে। রফিক যায়, সে রফিকের হাতে শিশুটিকে দেয়। রফিক আবার কাঁটাতারের বেড়ার ওপর দিয়ে বাচ্চাশুদ্ধ পুঁটলি গনুয়ার হাতে দেয়) 

গনুয়া – (আবেগপ্লুত স্বরে বলে) বহিনজী তুমি হামার লেড়কার জান বচাইলে। তুহার ভালাই হোবে, বহোত ভালাই। 

রফিক – ও কুচ্ছু না। বাচ্চাঠো আঁখের সামনে মোরে যাবে! ওহ কভি হো সকথ? কভি নেহি। যাও ভেইয়া। ধূপের তেজ বহোত কমে গেছে। পূরণিয়া টৌন য়হা সে চার পাঁচ মিল দূর। ইখন চলনা শুরু কোরলে সূরজ ডুবার পহলেই পহুচে যাবে। উখানে কোই থাকে তুহার? জান পহেচান আদমী? ইয়া রিস্তেদার? 

গনুয়া – (আস্তে আস্তে চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ায়) গাঁওবালা পহেচানা আদমী হ্যায় এক। উসকো ডেরামে হি উঠবো। 

রফিক – তব যাও ভেইয়া। আউর দের কোরোনা। ক রোজ পহলেই হাঙ্গামা হোয়ে গেল। চারধারে কেত্তো রকম খারাব আদমী ঘুরে বেড়াচ্ছে ইখনো। 

গনুয়া – হাঁ, যাই। 


(পৃষ্ঠা – ১৮) 

(গনুয়া চলে যেতে থাকে। এমন সময় বাচ্চাটা আবার তীব্রস্বরে কেঁদে ওঠে। গনুয়া তাকে ভোলানোর চেষ্টা করতে থাকে। ইতিমধ্যে ফরিদা রফিককে ধরে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে সে আর্তস্বরে চিৎকার করতে করতে বেড়ার ধারে ছুটে যায়।) 

ফরিদা – বাচুয়া রে! এ বাচুয়া হামার! মাৎ রো বাচুয়া! (কান্নায় ভেঙে পড়ে) 

(রফিক হতবাক অবস্থা কাটিয়ে এগিয়ে আসে) 

রফিক – ফরিদা! এ ফরিদা! তুর বোলি আসছে! তু কথা বোলছিস! তুর বোলি ফির ফিরে আসছে রে ফরিদা! 

(ফরিদা রফিককে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। পায়ে পায়ে গনুয়া এগিয়ে আসে।) 

গনুয়া – বহিনজী! 

(ফরিদা চোখ তোলে। গনুয়া ধীরে ধীরে বাচ্চাটাকে এগিয়ে দেয়। ফরিদা প্রায় ছিনিয়ে নেয় বাচ্চাটাকে এবং দুজনের কান্নাই বন্ধ হয়ে যায়।) 

ফরিদা – বাচুয়া...এ বাচুয়া হামার!(ফের স্তন্যপান করাতে থাকে) 

রফিক – ভেইয়া... তুম... 

গনুয়া – কোথায় যাব, কি কোরবো নাহি জানথ হ্যায়। ভেইয়া হামার আপনাহি কোই সাকিন নাহি, উসকা সাকিন হামি কাঁহা সে জুটাব? কি খিলাবো? কি পিলাবো? উসসে আচ্ছা হামার লছুয়ার ঠিকানা তুমহাদের কাছে লিখা থাক। কমসেকম উর জান তো বাঁচবে। 

রফিক – রহতে পারবে তুম উসকো ছোড়কর? 

গনুয়া – হামার লছুয়ার মায়ের দরকার, বাপের নয়। যেখুন ইচ্ছা হোবে এসে তুমহাদের কাছে দেখে যাব। (চলে যেতে থাকে। কিছুটা দূরে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে ঘুরে বলে) যেত্তোদিন বেঁচে আছি, তুমহাদের বাত ইয়াদ রহবে। 

(ধীরে ধীরে গনুয়া বেড়িয়ে যায়। একদৃষ্টে সেদিকে রফিক ও ফরিদা তাকিয়ে থাকে। দূর থেকে একটা দেহাতি মা ও সন্তান সম্পর্কের গান ভেসে আসে। আলো কমে আসে। রফিক অদৃশ্য হয়ে যায়। ছোট্ট একটা স্বপ্নিল বৃত্তের মধ্যে ফরিদা নৃত্যের ভঙ্গিমায় বাচ্চাটার সঙ্গে খেলা করতে থাকে।)