৯
কোপারেটিভ ইউনিয়নের তবিল-তছরূপের ঘটনাটি বড্ড সাদামাটা ঢঙের, বড্ড সরল। রোজ রোজ চারদিকে যে শত শত তছরূপ হচ্ছে তার থেকে এ একেবারে আলাদা। এর সৌন্দর্য্য এর সরলতায়। এ একেবারে বিশুদ্ধ তছরূপ; কোন প্যাঁচ নেই। এতে কোন জাল দস্তখতের গল্প নেই, না কোন জালি হিসেব, না কোন নকল বিল দেখিয়ে টাকা তোলা হয়েছে।এমন তছরূপ করতে বা ধরে ফেলতে কোন টেকনিক্যাল যোগ্যতার দরকার নেই। যা দরকার তা’হল প্রবল ইচ্ছাশক্তি।
ব্যাপারটা হচ্ছে এ’রকমঃ
কোপারেটিভ ইউনিয়নের একটা বীজগুদাম ছিল, তাতে গম ভরা। একদিন ইউনিয়নের সুপারভাইজার রামস্বরূপ দুটো ট্রাক নিয়ে ওই গুদামে এল। ট্রাকে গমের বস্তা ভরা হচ্ছিল। যারা দূর থেকে দেখছিল তারা ভাবল এ তো কোপারেটিভের নিত্যকর্ম।ট্রাক যাবে কাছের অন্য একটি বীজগুদামে মাল পৌঁছাতে। রামস্বরূপ ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসল এবং ট্রাক রওনা হল। একটু পরে বড় রাস্তা ছেড়ে একটা কাঁচা রাস্তা ধরে নিলে পাঁচ মাইল দূরে ওই বীজগোদাম। কিন্তু ট্রাক সেদিকে না ঘুরে সোজা এগিয়ে চলল। এখান থেকেই ফ্রড, ধোঁকা, বা তছরূপ আরম্ভ হল। ট্রাক সোজা শহরের গায়ে ওখানকার সব্জীমন্ডি বা ফসলের থোক বাজারে গিয়ে থামল। সেখানে ট্রাক দুটো গমের বস্তাগুলো নামিয়ে দিয়ে তবিল-তছরূপ বা ধোঁকার কথা একদম ভুলে মেরে দিল এবং পরের দিন থেকে আগের মত কয়লা-কাঠ এসব বইতে শুরু করল। এরপর রামস্বরূপের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। লোকে ধরে নিল ব্যাটা গমটম বেচে কয়েকহাজার টাকা ট্যাঁকে গুঁজে বোম্বাই-টোম্বাইয়ের দিকে কেটে পড়েছে।পুরো ঘটনাটা একটা রিপোর্টের রূপ ধরে লোক্যাল থানায় জমা হল এবং বৈদ্যজীর ভাষায়—কাঁটা ফুটেছিল, বেরিয়ে গেল।
কিন্তু ইউনিয়নের এক ডায়রেক্টর কাল শহরে গিয়ে যা দেখতে পেলেন তার সারমর্মঃ রামস্বরূপ ওই মেরে দেয়া টাকা খরচ করতে বোম্বাই নয়, স্থানীয় শহরকেই পছন্দ করেছে। ডায়রেক্টর সাহেব ওখানে কেন গেছলেন? মনে করুন, সেরেফ শহর দেখার জন্যে শহর দেখতে।ওখানে গেলে ওনার অন্যসব কাজকর্মের মধ্যে একটা কাজ বাঁধা ছিল। তা’হল কোন পার্কে যাওয়া, সেখানে গাছের ছায়ায় বসে ছোলাসেদ্ধ খাওয়া, মন দিয়ে রঙীন ফুল ও মেয়ে দেখা, এবং কোন অল্পবয়েসি ছোকরাকে দিয়ে মাথায় তেল মালিশ করানো। যখন ওনার এইসব কাজকম্ম শেষ হওয়ার মুখে তখনই ঘটনাটি ঘটে। উনি বসেছিলেন গাছের ছায়ায় একটা বেঞ্চে। আরামে চোখ বুঁজে গেছল, আর ছোঁড়াটার নরম ও পাতলা আঙুল ওনার মাথায় তিড়-তিড়-তিড় বোল বাজাচ্ছিল। ছেলেটা বেশ মজা করে ওনার চুলে তবলার কোন ত্যাড়াম্যাড়া বোল তুলছিল আর উনি চোখ বুজে আফসোস করছিলেন- হায়, তেলমালিশ যে শেষ হতে চলেছে! একবার উনি চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু এতক্ষণ মালিশ পেয়ে ঘাড়টাও দুঁদে অফিসার হয়ে গেছে। পেছনে ঘুরলোই না। অগত্যা উনি সামনে যা দেখা যাচ্ছে তাই মন দিয়ে দেখতে লাগলেন।
উনি দেখলেনঃ সামনে আরেকটি গাছ এবং তার নীচে আরেকটি বেঞ্চ। সেখানে বসে রামস্বরূপ সুপারভাইজার একটা ছোঁড়াকে দিয়ে তেল মালিশ করাচ্ছে।ওর মাথা থেকেও তিড়-তিড়-তিড় বোল উঠছে এবং দেখা করার ওর চোখ বুঁজে রয়েছে। ডায়রেক্টর এবং টাকা-মেরে-দেয়া সুপারভাইজার দুজনেই তখন পরমহংস ভাব ধারণ করে যে যার নিজস্ব দুনিয়ায় লীন। শান্তিপূর্ণ-সহাবস্থানের একেবারে আদর্শ স্থিতি।
কেউ কারও কাজে হস্তক্ষেপ করলেন না। পনের মিনিট ধরে একে অপরকে না দেখার ভান করে উত্তম প্রতিবেশির মত যে যার বেঞ্চে বসে রইলেন। তারপর আড়মোড়া ভেঙে উঠে মালিশের ছোকরাদের যথোচিত পারিশ্রমিক দিয়ে পরেরবার এখানেই দেখা করার প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে যার রাস্তায় চলে গেলেন।
শিবপালগঞ্জে ফিরে আসার সময় ডায়রেক্টর সাহেবের চৈতন্য হল যে তেলমালিশের সুখ পেতে গিয়ে উনি কোপারেটিভ মুভমেন্টের সঙ্গে বেইমানি করেছেন। মনে পড়ল -রামস্বরূপ ফেরার এবং পুলিশ ওকে খুঁজছে। রামস্বরূপকে ধরিয়ে দিলে ধোঁকাধড়ি ও তছরূপের মামলাটা আদালতে দাঁড়াত। হয়ত ওঁর নাম খবরের কাগজেও ছাপা হত।এসব ভেবে ভেবে ওঁর কষ্ট বেড়ে গেল। বিবেক জাগ্রত হয়ে ওঁকে খোঁচাতে লাগল।কাজেই গাঁয়ে ফিরে বিবেককে শান্ত করতে উনি বৈদ্যজীর দরবারে হাজির হয়ে এক পুরিয়া হিংগ্বাষ্টক চূর্ণ মুখে ঢেলে বললেন-“ আজ পার্কে একজনকে দেখলাম, একদম রামস্বরূপের মত”।
বৈদ্যজী বললেন,” হবে হয়ত; অনেক লোকের চেহারায় অমন মিল-মিশ থাকে”। ডায়রেক্টরের বোধ হল এটুকুতে বিবেক শান্ত হবেনা। উনি এদিক ওদিক দেখে বললেন,’ তখনই মনে হল, যদি রামস্বরূপই হয়?”
বৈদ্যজী ওঁর দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। উনি আবার বললেন,’ রাআমস্বরূপই ছিল। ভাবলাম শালা এখানে কী করছে? ব্যাটা মালিশ করাচ্ছিল”।
“তুমি ওখানে কী করছিলে শ্রীমান”?
“আমি ক্লান্ত হয়ে একটা গাছের ছায়ায় জিরিয়ে নিচ্ছিলাম”।
বৈদ্যজী বললেন।‘ তক্ষুণি পুলিশে খবর দেয়ার ছিল”।
ডায়রেক্টর চিন্তায় ডুবে গেলেন; তারপর বললেন,” ভেবেছিলাম রামস্বরূপ যেন বুঝতে না পারে যে ওকে দেখে ফেলেছি, তাই আর পুলিশে খবর দিইনি”।
তবিল-তছরূপের অপরাধী বোম্বাই নয়, পনের মাইল দূরের শহরে রয়েছে এবং তেলমালিশ করানোর জন্যে ওর ধড়ের উপর মুন্ডুটা এখনও টিকে আছে—এই খবরটি বৈদ্যজীকে রীতিমত চিন্তায় ফেলে দিল। ডায়রেক্টরদের মীটিং ডাকা জরুরি। তবে খবরটা উনি খালি পেটে শুনেছেন, ভাঙ সেবনের পর শোনা দরকার—তাই মীটিংযের সময় ধার্য হল সন্ধ্যেবেলা।
শনিচরের চোখে পৃথিবীতে একমাত্র মানুষ হলেন বৈদ্যজী এবং অন্তরীক্ষে একমাত্র দেবতা হলেন হনুমানজী। হনুমানজি শুধু ল্যাঙোট পরে থাকেন, তাই শনিচর শুধু আন্ডারওয়ারেই কাজ চালিয়ে নেয়।গেঞ্জি তখনই পরত যখন কোথাও সেজেগুজে যাওয়ার দরকার হত। এত গেল হনুমানজির প্রভাব। বৈদ্যজীর প্রভাবও কম নয়। তার জেরে শনিচর পথচলতি যেকোন লোককে কুকুরের মত খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠত। কিন্তু বৈদ্যজীর ঘরের কেউ, এমনকি একটা কুকুরও যদি হয়, শনিচর তার সামনে ল্যাজ নাড়াতে থাকবে। কথা হল, বৈদ্যজীর ঘরে কোন কুকুর নেই আর শনিচরেরও পেছনে ল্যাজ নেই।
যা কিছু শহরের তাতেই ওর কৌতূহল। তাই রঙ্গনাথকে নিয়েও ওর খুব উৎসাহ; রঙ্গনাথ এলেই শনিচর তার আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হল না।বৈদ্যজী গেছেন ডায়রেক্টর্সের বৈঠকে , দোরগোড়ায় শুধু দু’জন—রঙ্গনাথ এবং শনিচর। সূর্য ডুবছে, শীতের সন্ধ্যায় সবার ঘর থেকে যে ঝাঁঝালো ধোঁয়া কুন্ডলি পাকিয়ে ওঠে ছাতের উপরের আকাশকে ভারি করে তারও ব্যতিক্রম হয়নি।
রাস্তা দিয়ে কেউ খট খট করে যাচ্ছে। বিকলাঙ্গদের নিয়ে আমাদের মনে যে সাত্ত্বিক ঘৃণা জমে থাকে সেটা পিচ করে বাইরে ফেলে শনিচর বলল- ‘শালা লঙরবা (ল্যাংড়া) চলল’। কথাটা বলে ও ব্যাঙের মত লাফ মেরে বাইরের রোয়াকে এসে থ্যাবড়া মেরে বসে পড়ল।
রঙ্গনাথ আওয়াজ দিল—লঙ্গড় হো ক্যা?
ওকিছুটা এগিয়ে গেছল। ডাক শুনে থেমে পেছনে মুড়ে জবাব দিল—হাঁ বাপু; লঙ্গড়ই বটি।
-দলিলের ‘নকল’ পেলে?
রঙ্গনাথের প্রশ্নের উত্তর এল শনিচরের কাছ থেকে।
-আর নকল? ওর ভাগ্যে এবার শিকে ছিঁড়বে। সেটা কড়িকাঠ থেকে টাঙিয়ে তাতে খোঁড়া পা’ ঝুলিয়ে উনি দোল দোল দুলুনি করবেন।
এসব কথায় লঙ্গরের কোন হেলদোল নেই। ওখান থেকে চেঁচিয়ে বলল- নকল পাইনি বাপু, আজ নোটিস বোর্ডে ‘আপত্তি’ লটকেছে।
--হলটা কী? ফের ফীস কম পড়েছিল?
--ফীসটিস নয়, এবার আমার মামলার মূল কাগজে অনেক ভুল বেরিয়েছে। ঠিকানায় ভুল, আবেদনকারীর দস্তখত ভুল জায়গায়, তারিখের দুটো সংখ্যা মিশে গেছে ,একটা জায়গায় কাটাকুটি, তাতে দস্তখত নেই-এইরকম অনেকগুলো ভুল।
রঙ্গনাথ বলল, ‘এই দফতরের কর্মচারিগুলো হাড় বজ্জাত, খুঁজে খুঁজে যত্ত ফালতু আপত্তি’!
লঙ্গড় এবার এমন বক্তিমে ঝাড়ল যেন গান্ধীজি প্রার্থনাসভায় বোঝাচ্ছেন—ইংরেজকে ঘৃণা করা ঠিক নয়।
-না বাপু!দফতরের লোগগুলোর কোন দোষ নেই, ওরা তো ওদের কাজ করেছে। যত গণ্ডগোল আর্জিনবিসের আর্জি লেখায়। আসলে আজকাল বিদ্যাচর্চা লোপ পাচ্ছে।নতুন নতুন ছোকরাগুলো এসে ভুলে ভরা আর্জি বানাচ্ছে।
রঙ্গনাথের মন সায় দিল যে বিদ্যার লোপ হচ্ছে, কিন্তু লঙ্গড়ের বলা কারণটা ওর হজম হলনা। ও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু লঙ্গড় মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে জোরগলায় চেঁচিয়ে বলল- কোই বাত নহী বাপু, কাল দরখাস্তটা ঠিক করিয়ে নেব।
তারপর ও একপায়ে খটখটিয়ে এগিয়ে গেল।এসে শনিচর মাথা নেড়ে বলল,’ ‘কোত্থেকে যে যত বাঙ্গড়ু এসে এই শিবপালগঞ্জে জোটে’!
রঙ্গনাথ ওকে বোঝাল যে সবজায়গার এক হাল।এই দিল্লির কথাই ধর।
এবার ও শনিচরকে দিল্লির কিসসা শোনাতে লাগল। ভারতীয়দের বুদ্ধি যেমন ইংরেজদের জানলা দিয়ে দুনিয়ার খোঁজ পায়, তেমনই শনিচর রঙ্গনাথের জানলা দিয়ে দিল্লির খোঁজখবর নিতে লাগল। ওরা দু’জন খানিকক্ষণ এতেই মজে রইল।
আঁধার নামছে, কিন্তু এতটা ঘন হয়নি যে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ ও পশুর তফাৎ বোঝা যাবেনা। বৈদ্যজীর বৈঠকখানায় একটা লণ্ঠন টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে।সামনের রাস্তা দিয়ে তিন নবযুবক হা-হা করে হাসতে হাসতে চলে গেল।ওদের কথাবার্তায় কিছু শব্দ- যেমন ‘দুকুরবেলা’,’ফান্টুস’, ‘চকাচক’, ‘তাস’ ও ‘পয়সাকড়ি’- এমনভাবে ঘুরে ফিরে আসছিল যেন প্ল্যানিং কমিশনের মিটিংযে ‘ইভ্যালুয়েশন’,‘কোঅর্ডিনেশন’,’ডাভটেলিং’ অথবা সাহিত্যিকদের বৈঠকে ‘পরিপ্রেক্ষিত’,’জনগণ’, ‘যুগচেতনা’ বা ‘সন্দর্ভ’ ইত্যাদি শোনা যায়। ওই তিন যুবক কিছু একটা বলতে বলতে বৈঠকখানার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।শনিচর বলল- বদ্রীভাইয়া এই জানোয়ারগুলোকে কুস্তি শেখায়। বুঝুন, এসব হল বাঘের হাতে বন্দুক তুলে দেয়া। এই শালাদের ঠেলায় এখনই ভদ্দরলোকদের রাস্তায় বেরনো দায়; এরপরে কুস্তির দাঁওপ্যাঁচ শিখলে তো অন্যদের গাঁ ছেড়ে চলে যেতে হবে’।
আচমকা একটা বিচ্ছিরি রকমের অট্টহাসি -- ওই তিনজনের গলা থেকে।
সবশ্রেণীর মানুষেরই হাসি ও অট্টহাসির আলাদা আলাদা স্টাইল আছে।কফিহাউসে সমাসীন সাহিত্যিকদের হাহা শরীরের নানান জায়গা থেকে বেরোয়। কারও পেটের গভীর থেকে, তো কারও গলা বা মুখগহ্বর থেকে। ওদের মধ্যে এক-আধজন এমনও থাকে যে বসে বসে খালি ভাবে—সবাই হাসছে কেন? আবার অফিসারকুল যখন ডিনারের পরে কফিতে চুমুক দিয়ে যে হাসি হাসেন, তার জাতই আলাদা। ওই হাসির উৎসস্থল পেটের গহনে একদম নাভিমূলে। ওই হাসির ওজনের সঙ্গে সাধারণ হাসির তুলনা করা মানে ওনাদের মাইনের সঙ্গে আসল আমদানিকে দাঁড়িপাল্লার দুদিকে তোলা।রাজনীতির কারবারিদের হাসি বেরোয় মুখের থেকে মেপেজুকে। এই হাসি কেমন ফাঁপা এবং দ্বিমাত্রিক। মানে হাসির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ রয়েছে কিন্তু গভীরতা নদারদ।ব্যবসাদারেরা প্রায়শঃ হাসে না। যদি হাসে তাও এমন সূক্ষ্ম ও সাংকেতিক ভাষায় যে মনে হয় ব্যাটা ইনকাম ট্যাক্স দেয়ার ভয়ে হাসির আসল স্টক লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু এই নবযুবকদের অট্টহাসি আলাদা জাতের, এ হাসি ক্ষমতার দম্ভের। এ হাসির আওয়াজ মানুষের গলা থেকে বেরোয়, কিন্তু মনে হয় মোরগ, ভাম বা ঘোড়ার গলা থেকে আসছে।
ওই হাহা-হাহা শুনতেই শনিচর ধমকে উঠল- এখানে দাঁড়িয়ে কী ছিঁড়ছ? যাও, কেটে পড়।
ছেলেগুলো ওদের হাসির পকেট-বুক এডিশন বের করল, তারপর কেটে পড়ল।এমন সময় অন্ধকারে এক নারী লালটিনেরচজ মলিন আলোয় এলোমেলো ছায়া ফেলে ছমছম করে চলে গেল। যেতে যেতে ও বিড়বিড় করছিল যে সেদিনের ছোকরাগুলো, যাদের ও ন্যাংটোপুঁটো দেখেছে, আজ ওর সঙ্গে প্রেম করতে চায়! এইভাবে মহিলাটি গোটা পাড়ায় খবরটা চাউর করে দিল যে আজকালকার ছোকরাগুলো ওকে লাইন মারে এবং ওর এখনও লাইন মারার বয়েস রয়েছে। তারপর ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে গায়েব হয়ে গেল। শনিচর টিপ্পনি কাটল,’ ব্যাটা কানা না জানে কোত্থেকে এই কুত্তিটাকে জুটিয়েছে, যখন রাস্তা দিয়ে যায় কেউ না কেউ ঠিক ওকে আওয়াজ দেয়’।
এই গাঁয়ে ‘কানা’ বোলে তো পন্ডিত রাধেলাল। ওর একটা চোখ অন্যটির চেয়ে ছোট, তাই ‘গঁজহা’র দল ওকে কানা বলে ডাকে।
আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য হল- এক হিসেবে আমাদের সবকিছুই প্রাচীন ঐতিহ্য—কেউ বাইরে, মানে অন্য রাজ্যে, যাবে তো কথায় কথায় বিয়ে করে নেবে। অর্জুনের সঙ্গে চিত্রাংগদা আদি উপাখ্যানে তাই হয়েছিল। ভারতবর্ষের প্রবর্তক রাজা ভরতের পিতা দুষ্যন্তের সঙ্গেও তাই। যারা আজকাল ত্রিনিদাদ কি টোবাগো, বর্মা কি ব্যাংকক যাচ্ছে তাদের সঙ্গেও ঠিক ওইসব হচ্ছিল। এমনকি আমেরিকা বা ইউরোপে গেলেও একই হাল। সেই হাল হল পন্ডিত রাধেলালের। অর্থাৎ যে ব্যাটা নিজের পাড়ায় থাকতে নিজেদের সমাজের এক ইঞ্চি বাইরে বিয়ে করার কথায় ভির্মি খায়, যেই সে দেশের বাইরে পা রাখে অমনই বিয়ের ব্যাপারে কেশর ফোলানো সিংহ হয়ে ওঠে।দেবদাস নিজের পাড়ার মেয়ে পার্বতীকে বিয়ে করার হিম্মত জোটাতে পারল না, উলটে একটা গোটা প্রজন্মের জন্যে কান্নাকাটির মশলা ছেড়ে গেল। ওকে যদি একবার বিলেত পাঠিয়ে দেয়া যেত, তাহলে ও নি;সংকোচে কোন ফর্সা মেম বিয়ে করে ফেলত। দেশের বাইরে গেলে আমরা হরদম যা করি সেটা হল প্রথমেই কাউকে বিয়ে করে ফেলা এবং তারপর ভাবতে বসা যে এই বিদেশ- বিভুঁইয়ে কী করতে এসেছি যেন? লোকে বলে যে পন্ডিত রাধেলালও একবার পূবদেশে গিয়ে কিছু করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু একটা মাসও কাটল না—উনি ওই ‘কুত্তি’কে বিয়ে করে শিবপালগঞ্জে ফিরে এলেন।
একবার পূর্বাঞ্চলের কোন জেলায় একটা চিনির কলে পন্ডিত রাধেলালের চাকরি পাওয়ার জোগাড় দেখা যাচ্ছিল। চৌকিদারের চাকরি। উনি গিয়ে আরেকজন চৌকিদারের ঘরে থাকতে লাগলেন। তখন পন্ডিত রাধেলালের বিয়ে হয়নি। এদিকে ওঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল মেয়েছেলের হাতের রান্না খেতে না পাওয়া। সাথী চৌকিদারের স্ত্রী কিছুদিনের জন্যে এই সমস্যার সহজ সমাধান করে দিয়েছিলেন।রাধেলাল ওদের বাড়িতে শুতে এবং দু’বেলা খেতে লাগলেন।একটি বিশ্বপ্রসিদ্ধ প্রবাদ আছে যে নারী উদরের গলিপথ ধরে পুরুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে।ওই নারীও রাধেলালের পেটে সিঁধ কেটে শনৈঃ শনৈঃ ওর হৃদয়ের দিকে গুটি গুটি এগোতে লাগলেন। ওই মহিলার হাতের রান্না রাধেলালের এত ভাল লাগল এবং মহিলাটি নিজের হাতে ওর পেটের মধ্যে খোঁড়া সিঁধে এমন ফেঁসে গেলেন যে একমাসের মধ্যে মহিলাটিকে রাধেলাল নিজের খাবার বানাতে শিবপালগঞ্জে নিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। চলে আসার সময় আগের বাড়ি থেকে বছর-দু’বছরের ঘরে বসে খাওয়ার মত রসদও সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর চিনি মিলের এলাকার লোকজন ভাবল—রাধেলালের বন্ধু চৌকিদারটি এক্কেবারে ভোঁদাই।এদিকে শিবপালগঞ্জের লোকজন বলল—রাধেলাল হল মরদ কা বেটা! তার আগে ওই এলাকার লোকজন রাধেলালকে চিনত ‘কখনও জব্দ না হওয়া সাক্ষী’ হিসেবে, এখন চিনল ‘কখনও সুযোগ ফস্কাতে না দেওয়া মরদ’ হিসেবে। রাধেলাল এভাবে বিখ্যাত হয়ে গেল।
অবশ্যি, ওই ‘কখনও জব্দ না হওয়া সাক্ষী’ খ্যাতিটিই রাধেলালের জীবিকার পুঁজি। ও নিরক্ষর এবং সাক্ষরের আলোআঁধারিতে আদালতে দাঁড়িয়ে অম্লানবদনে “আমি লেখাপড়া শিখিনি” অথবা ‘ খালি দস্তখত করতে পারি’ গোছের কোন একটা দরকারমত বলতে পারে।কিন্তু দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনকানুনের এমন প্রখর জ্ঞান যে ও যেকোন মামলার সাক্ষী হয়ে যেকোন পক্ষের হয়ে বয়ান দিতে পারে। কোন উকিল আজ অব্দি ওকে জেরা করে জব্দ করতে পারেনি। যেভাবে যেকোন জজ তার এজলাসের যেকোন মামলার রায় দিতে পারে, যেকোন উকিল যেকোন মামলার ওকালত করতে পারে ঠিক তেমনই পন্ডিত রাধেলাল যেকোন মামলার ‘আই-উইটনেস’ হতে পারে। সংক্ষেপে, মোকদ্দমাবাজির শৃংখলে জজ, উকিল, পেশকার, মুহুরির মত রাধেলালও একটি অনিবার্য গাঁট। আর যে ইংরেজি আইনের মোটরগাড়িতে চড়ে আমরা বড় গর্বের সঙ্গে ‘রুল অফ ল’ বলে চেঁচাই, তার চাকার ‘টাইরড’ হল রাধেলাল এবং সেই সুযোগে ও আইনের শাসনের গতিকে ইচ্ছেমত এদিক-সেদিক করে। একবার যখন এজলাসে দাঁড়িয়ে ও ‘মা গঙ্গার দিব্যি, ঈশ্বরের দিব্যি-যাহা বলিব, সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না’ বলে শপথ নেয়, তখন বিরোধী পক্ষ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট অব্দি বুঝে যায় যে আর যাই হোক, ও সত্যি বলতে আসেনি। কিন্তু বুঝে হবেটা কি কচুপোড়া, ফয়সালা তো বুঝদারিতে হবেনা, আইন মোতাবেক হবে। অথচ পন্ডিত রাধেলালের জবানবন্দী শুনতে যাই মনে হোক, আইনের বিচারে একদম নিখাদ।
রাধেলালের সম্মান যেমনই হোক, ওনার প্রেয়সীর ব্যাপারে গাঁয়ের হিসেব একদম স্পষ্ট। ও স্বামীকে ছেড়ে পালিয়ে এসেছে, অতএব ‘কুত্তি’। লোকেরা ওকে আওয়াজ দিতে পারে, কারণ সবার বিশ্বাস ওর আওয়াজ খেতে ভাল লাগে। শিবপালগঞ্জের ছোঁড়াদের কপাল ভাল যে কুত্তিটাও ওদের নিরাশ করেনি।সত্যিই ওর লাইন মারা বা আওয়াজ খাওয়া খুব ভাল লাগত, তাই আওয়াজের পালা চুকলে ওর গালির ফোয়ারা ছুটত। আর গালাগাল তো ‘গঞ্জহা’দের অভিব্যক্তির সবচেয়ে জনপ্রিয় শৈলী।
শনিচর এবার রঙ্গনাথকে রাধেলালের কিসসাটা বেশ নাটকীয়ভাবে শোনাচ্ছিল।তখনই ওই তিনটে ছোঁড়ার একজন এসে বৈঠকখানার দরজায় দাঁড়িয়ে পড়ল। খালি গা’, শরীরময় আখাড়ার মাটি, ল্যাঙ্গোটের পট্টি কোমর থেকে পা’ পর্য্যন্ত হাতির শুঁড়ের মত দোলা খাচ্ছে। এদানীং শিবপালগঞ্জে যেসব ছোকরা ল্যাঙোট পরে চলাফেরা করে তাদের মধ্যে এই স্টাইলটাই বেশ জনপ্রিয়। শনিচর প্রশ্ন করল,’ কী ব্যাপার ছোটে পালোয়ান’?
পালোয়ান শরীরের জোড়গুলিতে দাদ চুলকোতে চুলকোতে বলল,” আজ বদ্রীভাইয়াকে আখাড়ায় দেখলাম না যে? কোথায় টপকেছে”?
-‘টপকাবে কেন, এদিক সেদিক কোথাও হবে’।
-‘ গেছে কোথায়’?
‘ইউনিয়নের সুপারভাইজার ট্রাকে গমের বস্তা ভরে গায়েব হয়ে গেছে। সেই নিয়ে ইউনিয়নের মিটিং চলছে। বদ্রীও ওখানেই হবে’।
পালোয়ান নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে চাতালে পিচ করে থুতু ফেলল।‘বদ্রীভাইয়া মিটিংযে বসে কি ডিম পাড়বে? সুপারভাইজার ব্যাটাকে পাকড়ে এক ধোবিপাট আছাড় দিত, তাতেই শালার দম বেরিয়ে যেত। মিটিং শিটিং করে হবেটা কী’?
রঙ্গনাথের কথাটা মনে ধরল। বলল,’তোমাদের এখানে মিটিংযে বুঝি ডিম পাড়ে’?
পালোয়ান এপাশ থেকে কোন প্রশ্ন আসবে ভাবেনি। জবাবে বলল,’ডিম পাড়বে নাতো কি বাল ছিঁড়বে? সবাই মিটিংযে বসে রাঁড়ের মত কাঁও কাঁও করবে আর আসল কামকাজের বেলায় খুঁটি জাপ্টে ধরবে’।
হিন্দিভাষার বাগধারার এই রূপের সঙ্গে রঙ্গনাথের বিশেষ পরিচয় ছিলনা। ও ভাবল, লোকজন খামোকাই আফশোস করে যে আমাদের ভাষায় মজবুত শক্তিশালী শব্দের নিতান্ত অভাব।যদি হিন্দি সাহিত্যের ছাত্রদের চারমাসের জন্যে ছোটে পালোয়ানের মত আখাড়ায় পাঠানো হয়, তাহলে কিছু ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও ওরা ওখানকার মাটির ছোঁয়ায় এ’ধরণের শব্দকোষ গড়ে তুলবে।শনিচর এবার ছোটে পালোয়ানের দিকে সম্ভ্রমের চোখে দেখে ভাল করে আড্ডা দেয়ার মতলবে ভেতরে ডেকে নিল—‘ভেতরে এস পালোয়ান’।
“বাইরে কি মাথায় বাজ পড়ছে? আমি এখানেই ফিট’। তারপর ছোটে পালোয়ান একটু আত্মীয়তা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,’ তোমার কেমন চলছে রঙ্গনাথ গুরু’?
রঙ্গনাথ নিজের ব্যাপারে ছোটে পালোয়ানের সঙ্গে বেশি কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। দু’বেলা দুধ-বাদামে সাঁটিয়ে আখড়ায় কুস্তির গল্প কফি হাউসে খুব একটা পাত্তা পায়না। কিন্তু ছোটে পালোয়ান এই নিয়ে একটা গোটা রাত কাবার করে দিতে পারে। রঙ্গনাথ বলল,’আমি তো একদম ফিট, এবার তোমার হালচাল শোনাও। সুপারভাইজার ব্যাটার হঠাৎ গম বেচে দেয়ার কি দরকার পড়ল’?
ছোটে পালোয়ান ফের তাচ্ছিল্যের সঙ্গে চাতালের উপর থুতু ফেলল, ল্যাঙোটের ঝুলন্ত পট্টি কষে বাঁধল এবং এইসব ব্যর্থ চেষ্টার মাধ্যমে এটা বোঝাতে চাইল যে ও ন্যাংটো নয়। এভাবে ও রঙ্গনাথের সমপর্যা্য়ে এসে বলল-আরে গুরু, ওর হাল হল ‘পোঁদে নেই ইন্দি, ভজরে গোবিন্দি’। লক্ষনৌ শহরে দিনরাত ফুট্টূফৈরি করে বেড়াত; বিনা মশলা কিসের ফুট্টূফৈরি, কিসের ইন্টূমিন্টু? গম বেচবে না তো কী?
--এই ফুট্টূফৈরি কী জিনিস?
পালোয়ান হেসে ফেলল।‘ফুট্টূফৈরি শোননি?ওই শালার শালা বড় মাগীবাজ। তা’ মাগীবাজি কি ছেলের হাতের মোয়া? বড় বড় মানুষের পেছন ফেটে যায়।জমুনাপুরের জমিদারী এতেই ছারখার হয়ে গেছল’।
দেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা যায় ইংরেজি ফিলিম দেখতে। ইংরেজি ডায়লগ বুঝতে পারেনা তবু মুচকি মুচকি হেসে দেখাতে চায় খুব বুঝেছে আর সিনেমাটা বেশ হাসির।অজ্ঞতা ঢাকতে রঙ্গনাথও তাই করছিল। পালোয়ান বলে চলেছে, ‘ আমি এই রামস্বরূপ সুপারভাইজারের নকশাবাজি গোড়া থেকেই বুঝে গেছলাম। বদ্রী পালোয়ানকে তখনই বলেছিলাম, ওস্তাদ, এ ব্যাটা লক্ষনৌ যায় মাগীবাজি করতে।তখন তো বদ্রী ওস্তাদেরও বিশ্বাস হয়নি।বলেছিল- বেশি টিক টিক করিস না ছোটু। শালা কাঠ খাবে তো আঙরা হাগবে।
এখন দেখ, কাঠও খাওয়া হল, আবার ট্রাকভর্তি গম উড়িয়ে নিয়ে গেল। গোড়াতে তো বৈদজী মহারাজও ধামাচাপা দিচ্ছিলেন।এখন জোয়ারের গু’ ভেসে উঠেছে তো সবাই ইউনিয়ন অফিসে বসে ফুসুর ফুসুর করছে। শুনছি, প্রস্তাব পাশ করবে। প্রস্তাব না ঘোড়ার ডিম!ফসল-গুদামের সারা ফসল তো রামস্বরূপ ফাঁক করে দিয়েছে। এখন প্রস্তাব পাশ করে ওর কি ছেঁড়া যাবে’?
রঙ্গনাথ—বদ্রীকে খামোখা বলেছিলে। তখন যদি বৈদ্যজীকে গিয়ে খুলে বলতে তাহলে উনি সেদিনই সুপারভাইজারকে ওখান থেকে সরিয়ে দিতেন।
‘আরে গুরু, আমার মুখ খুলিওনা। বৈদ্যজী তোমার মামা, আমার কী? আমার বাপ তো নয়। সত্যিটা যদি ঠূঁসে দিই তো তোমার কলজেতে গিয়ে চোট লাগবে’।
শনিচর বাধ দিল,‘ছোটু পালোয়ান, খুব যে রঙবাজি ঝাড়ছ, ভালকরে ভাঙ চড়িয়ে এসেছ মনে হচ্ছে’?
‘ বেটা, রঙবাজির কথা নয়, আমার তো একেকটা রোঁয়া জ্বলছে।সব্বার লেজ তুলে দেখ, খালি মাদী আর মাদী।বৈদ্য মহারাজের ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস না করলেই ভাল।ওর হিসেবের খাতা খুলে বসলে সমানে গরম ভাপ বে্রোতে থাকবে।সামলানো মুশকিল হবে।এই রামস্বরূপ এতদিন বৈদ্যজীর মুখে মুখ, তিনরকমের কথাবার্তা। আজ যখন দু’গাড়ি গমের বস্তা ভরে গায়েব হয়ে যেতেই দু’দিন ধরে টিলটিল করছেন!আমিও ইউনিয়নের সদস্য, বলেছিলেন মিটিনে এসে প্রস্তাবের পক্ষে হাত তুলে দিও।বললাম-আমাকে হাত-টাত তুলতে বোল না মহারাজ।একবার যদি হাত তুলি তো লোকজনের পিলে চমকে যাবে। হাঁ, ওই ব্যাটা রামস্বরূপ রোজ শহরে চসর-পসর করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথায় ওকে ধরে এনে লালবাড়িতে আটকে রাখার ব্যবস্থা হবে, তা না, প্রস্তাব পাশ কর। বদ্রী উস্তাদ রেগে কাঁই, কিন্তু করবেটা কি, নিজেরই বাপ।যদি কাপড় খুলে উরুত দেখাও তো লাজ, আবার ওটা খুলে দেখাও তো লাজ’।
এবার বৈঠকখানার সামনের দিকে লোকজনের আগমনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।চাতালে খদ্দরের ধুতিপাঞ্জাবি ও তিরছে টুপি পরা সৌম্যদর্শন বৈদ্যজী মহারাজের আবির্ভাব হল। পেছন পেছন কয়েকজন ভক্তবৃন্দ, সবার পেছনে বদ্রী পালোয়ান। দেখামাত্র ছোটে এগিয়ে এল,’ওস্তাদ, একটা জবরদস্ত ফান্টুশ মামলা।বলব বলে তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি’।
‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোগা হয়ে গেলে নাকি? মামলাটা কী ঝেড়ে কাশো’।
এভাবে শিষ্যের অভর্থনা করে গুরুশিষ্য চাতালের আরেক কোণে গিয়ে নিজেদের মধ্যে গভীর আলোচনায় ডুবে গেল।
বৈদ্যজী জনাচার-পাঁচ চ্যালাকে নিয়ে বৈঠকখানার ভেতরে গেলেন। একজন আরাম করে এমন এক লম্বা শ্বাস টানল যা ফোঁপানিতে শেষ হল।আরেকজন তক্তপোষে গুছিয়ে বসে এক লম্বা হাই তুলল যে ওটা ধীরে ধীরে বদলে গেল তীব্র সিটির আওয়াজে। বৈদ্যজীও কম যান না। উনি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে টুপি আর কুর্তা খুলে এমন কায়দায় তক্তপোষের অন্য মাথায় ছুঁড়ে ফেললেন যেন কোন বড় গায়ক লম্বা তানের শেষে সমে ফিরল। বোঝা গেল যে সবাই কোন বড় কাজ সেরে ক্লান্ত হয়ে গা’ এলিয়ে দিয়েছেন। শনিচর বলল,’মহারাজ কি খুব ক্লান্ত? তাহলে আর একবার (ভাঙের)’শরবত ছেঁকে দিই’?
বৈদ্যজী কিছু বলেননি, কিন্তু ইউনিয়নের এক ডায়রেক্টর বললেন- দ্বিতীয় নম্বর তো মিটিংয়ের মাঝখানেই হয়ে গেছ। এবার বাড়ি যাওয়ার নম্বর।
এতক্ষণ বৈদ্যজী চুপচাপ বসে অন্যদের কথা শুনছিলেন।এই ওনার অনেক পুরনো অভ্যেস। কারণ উনি অনেক আগে শিখেছিলেন—যে ব্যক্তি নিজে কম খেয়ে অন্যদের বেশি করে খাওয়ায়, নিজে কম বলে অন্যদের বেশি বলতে দেয়, সেই কম বোকা বনে অন্যদের বেশি করে বোকা বানায়।হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে বলে উঠলেন—রঙ্গনাথ, তুমি কী বল?
যেভাবে বৈদ্যজী ব্যাপারটা কী সেটা খোলসা না করে রঙ্গনাথের অভিমত জানতে চাইলেন, সেও সেই ভাবে ব্যাপারটা কী সেটা না বুঝে ও বলে উঠল—আজ্ঞে যা হয়, সেটা ভালর জন্যেই হয়।
বৈদ্যজী গোঁফের ফাঁকে মুচকি হেসে বললেন- তুমি ঠিকই বলেছ। বদ্রী গোড়ায় প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিল, শেষে ও চুপ মেরে গেল। প্রস্তাব সবার সমর্থনে পাশ হয়ে গেল। যা হল তা’ ভালর জন্যেই হল।
রঙ্গনাথের খেয়াল হল যে খামোকা নিজের রায় জাহির করে ফেলেছে। এবার ও একটু উৎসুক হয়ে জানতে চাইল—আপনারা কোন প্রস্তাব পেশ করেছিলেন?
‘আমরা প্রস্তাব- সুপারভাইজার আমাদের যে আটহাজার টাকার ক্ষতি করেছে তার ভরপাই করতে সরকার আমাদের অনুদান দিক’।
এমন যুক্তি শুনে রঙ্গনাথের মাথা ঘুরে গেল।
--‘সরকারের কী মাথাব্যথা?তছরূপ করবে আপনার সুপারভাইজার আর খেসারত দেবে সরকার’?
-‘নইলে কে দেবে?সুপারভাইজার তো গা’ঢাকা দিয়েছে।আমরা পুলিশে খবর দিয়েছি। এখন সরকারের দায়িত্ব। আমাদের হাতে কিস্যু নেই। যদি থাকত, তাহলে সুপারভাইজারকে ধরে এনে ওর থেকে গমের দাম পাইপয়সা আদায় করে ছাড়তাম। এখন যা করার সরকার করুক। হয় ওকে বন্দী করে আমাদের সামনে পেশ করুক, নয় অন্যকিছু করুক। যাই হোক, যদি সরকার চায় যে আমাদের ইউনিয়ন বেঁচে থাকুক এবং জনগণের কল্যাণ করুক তাহলে আমাদের অনুদান দিক। নইলে ইউনিয়ন পথে বসবে।আমরা আমাদের যা করবার করে দিয়েছি, এবার সরকারের পালা। ওরা কত অপদার্থ, তাও আমার ভালই জানা আছে’।
বৈদ্যজী এমন নিখুঁত যুক্তি সাজাচ্ছিলেন যে রঙ্গনাথের মাথার ঘিলু নড়ে গেল। উনি বারবার কিছু শব্দ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আওড়াচ্ছলেন, যেমন ‘সরকারের অকর্মণ্যতা’, ‘জনগণের কল্যাণ’, ‘দায়িত্ব’ ইত্যাদি। রঙ্গনাথ বুঝতে পারল যে ওর মামা পুরনো প্রজন্মের বটে, কিন্তু নতুন প্রজন্মের পছন্দের ভাষা ভালই রপ্ত করেছেন।
বদ্রী পালোয়ান ছোটে পালোয়ানের সঙ্গে পরামর্শ সেরে ফিরে এসেছে।বলল,’রামাধীনের বাড়িতে ডাকাতি হয়নি, তবে এদিক ওদিক কিছু ছিঁচকে চুরির খবর আসছে।
পালোয়ান বাবার সামনে একটু সামলে সুমলে কথা বলে। এই কথাগুলো ও এমনভাবে বলল যেন ছোটের সঙ্গে এতক্ষণ এই আলোচনাই হচ্ছিল যা বাবাকে জানিয়ে দেওয়া ওর পরম কর্তব্য।
বৈদ্যজী বললেন,‘চুরি! ডাকাতি! সর্বত্র এই খবর। দেশ রসাতলে যাচ্ছে’।
বদ্রী পালোয়ানের যেন এসব কথা কানে যায়নি।একজন হেলথ ইন্সপেক্টর যেভাবে জনসাধারণকে কলেরা নিবারণের উপায় বোঝায় তেমনই ভাবে বলল, ‘গোটা গাঁয়ে এখন খালি চুরির চর্চা। আমাদের জেগে ঘুমোতে হবে’।
শনিচর লাফিয়ে উঠে নিজের জায়গা বদলে বদ্রীকে জিজ্ঞেস করল, ‘জেগে আবার ঘুমোয় কী করে পালোয়ান’?
বদ্রী কড়াস্বরে বলল,‘টিকির টিকির করবে না তো! আজকে ইয়ার্কি-ফাজলামি ভালো লাগছে না’।
তারপর ও অন্ধকারে চাতালের কোণায় গিয়ে ছোটে পালোয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল।
0 comments: