0

গল্প - তন্ময় মুখার্জি

Posted in





রাতের শেষ ট্রেনটা প্লাটফর্ম ছাড়িয়ে সশব্দে ছুটে গেল নৈহাটি স্টেশনের দিকে। তারপর সমস্ত পরিবেশটা নিস্তব্ধ। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। সাইকেল,মোটর গাড়ির শব্দ,লোকজনের হাঁকডাক এখন আর তেমন নেই বললেই চলে। জানুয়ারী মাসের শুরু,জমিয়ে কনকনে ঠান্ডা পড়েছে বাইরে। চারতলার ফ্লাটের ব্যাল্কানিতে দাঁড়িয়ে সিগারেটের শেষাংশ টুকুর ধোঁয়া কলিজার শিরা-উপশিরায় চালান করার মতো একটা শুখটান দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিলাম। ঘন কুয়াশার চাদর সমস্ত শহরতলীর অলিগলির পথ ঘাট তার আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছে। একটা শিরশিরে ঠান্ডা বাতাস ক্রমাগত বয়ে চলেছে আমার শরীরের উপর দিয়ে। ঘরে ঢুকে এলাম। বিছানায় শুয়ে গায়ের উপর লেপ চাপিয়ে " উফফ কি আরাম "। এ এক আলাদাই অনুভূতি। বাইরের এমন যম ঠান্ডায় বদ্ধ ঘরের ভিতর লেপের তলার উষ্ণতাকে শরীরের সাথে সাথে মনের গভীর অবধি তার অনুভূতি তুলনাহীন। রাতের এইটুকু সময় যেন কানের সাথে মনেরও শান্তি,কারণ লোকজনের সোরগোল নেই, তারস্বরে বাজতে থাকা মাইকে নেতার ভাষণের তীব্রতা নেই,মোটর গাড়ির হর্ণ,সাইকেলের বেল, উৎসব অনুষ্ঠানে বাজী পটকার শব্দ নেই। উফফ সে যেন প্রকৃতির বুকে মানুষের এক দৈনন্দিন তান্ডব চলে। অথচ এই পৃথিবীর জীব জগতে আমরা মানুষরা ছাড়াও আরও কত লক্ষ জীব জন্তু বসবাস করে। তাদের সুবিধা অসুবিধার কথা কজন আমরা মনে রাখি। তারা মানুষের মতো প্রখর বুদ্ধি রাখেনা বা তারা বলতে পারেনা সেই কারণেই কি তাদের অধিকারের উপর আমাদের জোর খাটানো। আসলে আজ মানুষ যে মানুষের প্রতিই আস্থা,বিশ্বাস রাখতে পারেনা, এরাতো চুনোপুঁটি। কে রাখে কার খবর। আজকালকার দিনে খবর যত মশলাদার হবে ততই জনপ্রিয়। সেই খবরের সওদা হবে অনেক, অনেক টাকায়। ঐ যে রাতের শেষ ট্রেনটা থেকে ঘর ফিরতি মানুষটা নামলো। তার খবর কে রাখে? ঘুঙুরের শব্দটা এই শহরের এই স্টেশন চত্তরের রাস্তার ধারে ধারে উঁচু উঁচু ফ্লাট বাড়ি গুলোর বন্ধ দরজা,জানালা গুলো ভেদ করে কি নিশুতি রাতে নিজেদের বিছানায় গা এলিয়ে দেয়া বা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখা জাগ্রত মানুষ গুলোর কানে কি পৌঁছায় না? পৌঁছায়তো ঠিকই। কিন্তু এদের মধ্যে কেউ কিন্তু তার দরজা খুলে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে এসে তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেনা " দাদা আজ আপনার বিক্রি বাট্টা কেমন হল? রাতে খাবার মতো পকেটে টাকা আছেতো? আপনার ঘরের ছেলে,মেয়ে বৌয়ের রাতে খাবার জুটবেতো? হয়তো আমায় তোমরা পাগল ভাবতে পার। রাতবিরেতে এ কেমন কথা? যা ঠান্ডা পড়েছে তাতে দু পেগ মদ গিলে আমার মাতলামি করা ছাড়া এরচেয়ে আর ভালো কিছু সন্মোধন বুঝি আমায় জুটবেনা। ঐ যে শুনতে পারছেন থেকে থেকে ঘুঙুর বাজছে " ঝুনঝুন,ঝুনঝুন"। মানুষটা সারাদিন ট্রেনে,ট্রেনে ঘটি গরম বিক্রি করে এখন তার ঘরে ফিরছে। আজকের মতো মানুষটার দৈনন্দিন জীবনের লড়াই শেষ আবার আগামীকাল। হুমম ঐ যে লোকটা ধীরে,ধীরে এগিয়ে আসছে আমাদের ফ্লাটের সামনের গলিটার ভিতর তার ঘুঙুরের শব্দটা প্রতিধ্বনীত হচ্ছে। আপনি বলবেন আমি জ্ঞান দিচ্ছি। এসব কথা আমি নিজে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেইতো পারি,খামখা লেপের তলায় শুয়ে এসব জ্ঞান বিতরন যদি তখনকার দিনের মনিষীরা করতেন তাহলে এ দেশটার চিত্রপট বদলে যেত। আসলে এর আগে আমি বহুবার রাতের ঐ শেষ ট্রেনটা চলে যাওয়ার পরে ছুটে গিয়ে ছিলাম নিচতলায়। ঘরে ফেরা ঘটি গরম বিক্রেতা মধ্যবয়সী রোগাটে লোকটার কাছে। তার কাঁধে ঝোলানো টিনের বাক্সটার মধ্যে একটা ঘটিকে ঘিরে তার চারদিকে খাপে,খাপে বসানো টিনের কৌটর মধ্যে কুচিকরা পিঁয়াজ, লঙ্কা,ভুট্টার দানা,তেল,চাট মশলা,আরও কত কি। বাক্সটার সাথে বাঁধা আছে একটা জ্বলন্ত কুপী। লোকটার নাম জিজ্ঞেস করে জেনে ছিলাম রতন...রতন দাস। তার বাড়ি আমাদের কল্যানী মেইন স্টেশন থেকে প্রায় অনেকটাই সময়ের পথ,ঘোষপাড়ায়। সেখানে তার বৌ আর এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। ভদ্রলোকের বৌ বাড়ির আশেপাশের বড়ো বড়ো কয়েকটা ফ্লাটে ঝিয়ের কাজ করেন। তারা কর্তাগিন্নী দুইজনেই কাঁধে,কাঁধ মিলিয়ে নিজেদের সংসার সামলায়। ছেলে মেয়ে দুটোকে লেখা পড়া শিখিয়ে মানুষের মতো ভালো মানুষ করে গড়ে তুলতে চায় তারা। ভবিষ্যতে ওরা চাকরি পাক ছাই না পাক কিন্তু সে নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু তারা যেন ভালো মানুষ হয়ে ওঠে এটাই তাদের দুইজনের ইচ্ছে। রতন দা'র ছেলের বর্তমান বয়েস আট আর মেয়ের বয়েস পাঁচ। পড়াশোনায় দুইজনেই ভালো। বাড়ির কাছেপিঠেই কোনো এক সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করে। এসব নানান কথা বলতে বলতে রতন'দা একটুকরো খবরের কাগজ মুড়িয়ে তাতে ঘটি গরম বানিয়ে ঢেলে দিয়ে আমার হাতে দিয়ে বললো --- এই নিন বাবু।
আমি ঘটি গরম হাতে নিয়ে টাকা মিটিয়ে দিয়ে বললাম --- কতদিন এই ব্যাবসা করছ?
------ তাও বছর দশেক'তো হবেই বাবু।
------ তোমার এই ব্যাবসা কেমন চলে?
------ চলে বলতে ঐ চলে যায় বলতে পারেন।
এইসব নানান কথা বলতে বলতে মনের ভিতরের জমাট বাঁধা প্রশ্নটা করেই ফেললাম ----রাতে তোমরা কি খাও?
রতন'দা একরাশ পরিশ্রান্ত মুখে তার ঘটি গরমের স্টিলের কৌটো গুলোর মুখে সশব্দে ঢাকনা গুলোকে চেপে লাগাতে লাগাতে মুচকি হাসি হেসে বললো --- ঐ আর কি... ভাত।
বললাম ---- সারাদিন এই ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়াও?
---- হ্যাঁ,তবে যা বিক্রি বাটটা হয় সবই সন্ধ্যে বেলা। সকাল বেলা কেউ কি আর ঘটি গরম খায় বাবু। তবে ট্রেনে মোটামুটি বিক্রি হয়ে যায়। শেষ হয়ে এলে আবারও মাল কিনে পুনরায় শুরু করি। সারাদিন রাস্তাতেই কাটে।
------ কি খেয়ে কাজে বেড়িয়ে ছিলে?
কথাটা শুনে আমার দিকে এক মুহূর্ত হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল রতন'দা। প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে বললো ----- ঐ খেয়েছিলাম কিছু।
----- কি খেয়ে ছিলে শুনি?
রতন দা মাথা নিচু করে বললো ---- সকালে ঘরে চাল ছিলনা শুনে কাজে বেড়িয়ে পড়ে ছিলাম। খাওয়া হয়নি। কিছু কিনে যে খাব তারও উপায় ছিলনা। কারণ বিক্রি ছিল খুবই সামান্য। এমন হলে গিন্নী আবার মাঝে মধ্যে কোনো বাবুদের ফ্লাট থেকে তাদের বেঁচে যাওয়া ভাত,তরকারি জোগাড় করে ছেলে,মেয়েদের খাইয়ে দেয়। আজও বোধহয় তাই করেছে। তবে ও নিজে কি খেয়েছে কি খায়নি তা জানিনা। ও এখনো অভুক্ত আছে আমি জানি। ও মাঝেমধ্যেই এমনটা করে। বলে তুমি আমার সামনে বসে যতক্ষণ না খাবে ততক্ষণ আমি না খেয়ে থাকব। কি পাগল তাইনা। সারাদিন লোকের বাড়িতে অমন খাটাখাটুনি করে। অমন অভুক্ত থাকলে বড়ো কোনো রোগ হলে তার চিকিৎসা করাব তার ক্ষমতাও তো আমার নেই। সে কথা বললে সে রাগ করে। সে আমায় বড়ো ভালো বাসে বাবু আমি জানি। সারাদিনে আমারও পেটে তেমন কিছুই....।
কথাটা বলেই সে থেমে গেল। একটা পরিতৃপ্তির হাসি হেসে নিজের অভুক্ত থাকার কথাটা আড়াল করে নিল সে। আমি বললাম --- সেই কি,তুমি সারাদিন কিছু খাওনি। বাড়ি ফিরে ভাত খাবে যে,সেটা কি জোগাড় হয়েছে?
রতন'দা বা কাঁধের ঝোলা খুলে দেখিয়ে বললো --- হ্যাঁ বাবু,এই দু কিলো চাল,আর আলু কিনে বাড়ি ফিরছি।
ঘটি গরমটা মুখে চিবাতেই বুঝতে পারলাম সেটা এতোক্ষণে নরম হয়ে গেছে। খেতে খেতে বললাম --- আজ বেঁচাকেনা ভালো হয়েছে?
---- ঐ সারাদিনে এদিক,ওদিক ঘুরে টুকটাক যা হয়েছে আরকি। আর এই বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনে অফিস বাবুদের বেঁচে সব সুদ্দ তিনশো টাকা হয়েছে। হাঃ...আজকাল বাজারের যা অবস্থা,আলু আর চাল কিনতেই দেড়শো চলে গেল। আমাদের মতো গরীব মানুষদের মূল্যবৃদ্ধিটা যেন মোটা দড়ি মতো। সে যেন দিন দিন আমাদের কণ্ঠনালীত ধীরে ধীরে চেপে বসে যাচ্ছে বাবু। চারটে পেট চালাতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি।
এমন কথা গুলো শুনে বেশ আশ্চর্য হলাম। বললাম ---- তুমি কোন ক্লাস অবধি পড়াশোনা করেছ দাদা?
রতন'দা মৃদু হেসে বললেন ---- গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছিলাম। তারপর অর্থের অভাবে আর পড়ার সুযোগ পাইনি। ভেবেছিলাম মাস্টার্স ডিগ্রি করবো। অনেক স্বপ্ন ছিল,কিন্তু অর্থাভাব আর পেটেতে খিদের জ্বালা আমার সে স্বপ্নের মাঝে ব্যাড়া জাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
ক্ষানিক চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো ---- আগামীকাল একটুখানি সকাল সকাল বেরুতে হবে,আজ আসি বাবু।
রতন'দা ফিরে চলে যাচ্ছিল। কিছুটা দূর যেতেই আমি তাকে ডাকলাম --- দাদা শোনো?
দূরে দাঁড়িয়ে ঝুনঝুন,ঝুনঝুন করে দুবার ঘুঙুর বাজিয়ে পুনরায় ফিরে এলো। তারপর বললো --- হ্যাঁ বাবু বলুন।
---- তোমার ঘটি গরমের এই টিনের ঝোলাটা আমায় এক মিনিটের জন্য কাঁধে দেবে?
কথাটা শুনেই রতন'দা একটুখানি হকচকিয়ে গিয়ে ছিল। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বললো --- কেন বাবু এটা নিয়ে আপনি কি করবেন?
বললাম --- আরে দাওনা বাবা,তোমার জিনিস তুমি ফেরত পাবে। আমি নিয়ে নেবনা।
রতন'দা বললো ---- আরেঃ না না কথাটা সে নয়,আসলে এর খুব ওজন বাবু। এখন অবশ্য অনেকটাই খালি হয়ে গেছে। আপনি কাঁধে ব্যাথা পাবেন। অভ্যাস নেইতো তাই...।
আমি জোর করে ঝোলাটা তার কাঁধ থেকে নামিয়ে হাতে ধরে নিয়ে বললাম --- কিচ্ছু হবেনা, আমি শুধুমাত্র একবার কাঁধে নিয়ে দেখতে চাই।
রতন'দা আমায় আর কোনো রকম বাঁধা দিলনা। আমি সমস্ত ঝোলাটাকে রতন'দার মত কায়দা করে একটা কাঁধে তুলে নিতেই বুঝতে পারলাম মানুষটা দৈহিক কতটা পরিশ্রম করে। তার ওজন আমি রাখতে পারলাম না বললেই চলে। ঘুঙুরটা বাজাতেও হিমসিম খেয়ে গেলাম। ডান হাতে জোর পেলাম না। নিজের মনের অনুভূতির কথা ছেড়েই দিলাম। আমার মুখের আবভাব দেখে রতন'দা হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। আমার যে বেশ কষ্ট হচ্ছে সে বুঝতে পারছিল। আমায় বুঝতে না দিয়ে সে বললো --- বাবু দিন,ওদিকে ছেলে মেয়ে দুটো আমার জন্য পথ চেয়ে বসে আছে। কাল ফেরার সময় আবার একবার নেবেন না হয়। আজ আসি।
কথাটা বলে রতন'দা চলে গেল। আমি আনমনে আমার কাঁধ ঢোলতে,ঢোলতে রতন'দার চলে যাওয়ার পথের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম। মনে মনে ভাবলাম হাঃ কি সুখের জীবন কাটাচ্ছি। হয়তো এ সুখ আমার কপালে লেখা ছিল। সকাল দশটায় অফিস যাচ্ছি,বিকেল পাঁচটায় বাড়ি ফিরছি। মাস গেলে সময় মতো মোটা অঙ্কের মাইনে পাচ্ছি,তার সাথে বছরে আট দশটা ছুটিতো আছেই। কোনো চিন্তা ভাবনা নেই। মূল্য বৃদ্ধি হল কি কম হল তাতে আমার যায় আসেনা । যায় আসে এই রতন'দার মতো মানুষদের। যাদের জীবনে আছে কেবল সূর্য উদয়ের সাথে সাথেই পৃথিবীর গতিময় দৈনন্দিন জীবনের দুর্বার লড়াইয়ে অংশ গ্রহণ করা। দুটো পয়সা কোনো দিন কম হয় কোনো দিন বা বেশী। তাদের কাজে কামাই নেই,ছুটি নেই,রোগভোগ নেই,এক মুহূর্ত থেমে থাকা নেই। রাত গভীর না হলে হয়তো আরও কিছু টাকা জোগাড় করা যেতোর মতো চিন্তা,ভাবনা নিয়ে ঘরে ফেরা এই মানুষ গুলো। অভাবীর কয়েদ খানায় বন্দি থেকেও,তবুও এরা অদ্ভুত ভাবে যেন খুশি।
সপ্তাখানেক আগের কথা,রতন'দা আর কোনো সাড়াশব্দ পাইনি। ভেবেছিলাম হয়তো শরীর খারাপ। যে বোঝা টেনে সে প্রতিদিন জীবন যুদ্ধের লড়াই চালায়,অভুক্ত থেকেও মুখে রা কাটেনা তাতে সে অসুস্থ হওয়াটা স্বাভাবিক। সুস্থ হলে নিশ্চয়ই একদিন আবার দেখা হবে। কিন্তু গত পরশু তার ঘোষপাড়ার বাড়িতে খোঁজ নিতে গিয়ে যা শুনতে পেলাম তাতে আমি ক্ষনিকের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। তার স্ত্রীর কাছ থেকে শুনতে পেলাম এক নির্মম ঘটনার কথা। সপ্তা খানেক আগে রাতের শেষ ট্রেনে বাড়ি ফেরার সময় রতন'দা নাকি আগর পাড়া স্টেশনের কাছাকাছি চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে মারা যায়। তার কাঁধের ঘটি গরমের ঝোলাটা রেল লাইনের ধারে পড়ে ছিল। রেল পুলিশ তার মৃতদেহ উদ্ধার করে। কথাটা শোনার পরে মনের ভিতরের অনুভূতিটা আর প্রকাশ করতে পারবনা। রতন'দার ছেলে,মেয়ের আর বৌকে সহানুভূতি জানাবার কোনো ভাষা পেলাম না। ওরা আমায় চিনত না। রতন'দার স্ত্রী'র হাতে কিছু টাকা দিয়ে এলাম। বলে এলাম রতন'দা আমার কাছে এই টাকা গুলো পেত। প্রত্যুত্তরে ভদ্রমহিলা তেমন কিছুই বললো না। সদ্য স্বামীহারা মহিলাটি কেবল ছলছল চোখে আমার মুখের দিকে চেয়ে সামান্য হাসির রেখা টেনে হয়তো মনে মনে ভাবছিল "কে জানে? হয়তো পেতেন তার স্বামী। বুঝতে পারলাম না এই অসময় তাদের কাছে আমার দেয়া ঐ টাকা ক'টা ওদের সংসারে ক্ষনিকের জন্য কিছুটা অর্থাভাব দূর করতে পারল কি না। আমি জানি কেউ কারোর অভাব মেটাতে পারেনা। হয়তো মেটালেও তা ক্ষনিকের জন্য,কিন্তু এরপর?


বাইরে কনকনে ঠান্ডায় বদ্ধ ঘরে বিছানায় লেপের তলায় শুয়ে সেই আরামের উষ্ণতার ছোঁয়া কেন জানিনা আজ আর পেলাম না। কারণ আজ রাতের লাস্ট ট্রেনটা চলে যাওয়ার কিছু মুহূর্ত পরে দূর থেকে সেই ঘুঙরুর ঝুনঝুন ঝুনঝুন শব্দটা যেন হঠাৎই অনবরত কানে শুনতে পারছিলাম। দূর থেকে ভেসে আসছিল। ঐ যে...ঐ আসছে,হ্যাঁ ঐ আসছে রতন'দা। কান খাড়া করে শব্দটা শুনতেই নিজের কান দুটোকে যেন বিশ্বাস করাতে পারলাম না। অথচ এ একেবারে সত্যি যে সে আগের সেই দিন গুলোর মতো যেন ধীরে ধীরে আমাদের ফ্লাটের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ পরিবেশে থেকে,থেকে ঝুনঝুন,ঝুনঝুন শব্দটা পরিস্কার শুনতে পারছি এখনো। রতন'দা কি? নাকি রতন'দার মতোই অন্য কেউ,আরও একজন ঘটি গরম বিক্রেতা? ব্যাপারটা যাচাই করতেই হবে কথাটা ভাবতেই বিছানা ছেড়ে দৌড়ে গেলাম। ঘরের দরজা খুলে ফ্লাটের সিড়ি বেয়ে নেমে বাড়ির বাইরে মেইন রাস্তায় বেড়িয়ে এলাম। রাস্তার পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোয় এখনো দেখতে পেলাম একটা লোক হেঁটে চলে যাচ্ছে সোজা পথ ধরে। তার কাঁধে ঘটি গরমের টিনের ঝোলাটা। তবে তাতে জ্বলন্ত কুপীর আগুনটা দেখতে পেলাম না। ওটা কোনো মানুষ কি? নাঃ ঠিক মানুষ নয়,তাকে মানুষের একটা ছায়া মূর্তিই বলা চলে। অনেকটা দূর সে চলে গেছে। দৌড়ে গেলাম তার পিছনে। তারস্বরে চেঁচিয়ে ডেকে উঠলাম --- রতন দা...রতন দা দাঁড়াও।

লোকটা আমার ডাক শুনতে পেয়েছে বোধহয়। হ্যাঁ ঐ'তো দাঁড়িয়ে পড়েছে। বুঝতে পারছি পিছন ফিরে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল সে। একটা ঘন কুয়াশার আস্তরণে ঢাকা রতন'দার অবয়বটা। নাঃ আমার চোখের ভুল নয়,ওটা রতন'দাই ছিল। ওর দাঁড়ানোর কায়দা,ওর হাঁটাচলা,ওর আবভাব এই সপ্তাখানেক আগেও আমার কাছে বেশ পরিচিত ছিল। অস্পষ্ট হলেও আমি এখন বেশ তাকে দেখতে পাচ্ছি। ঐতো আবারও বার দুয়েক ওর হাতে ধরে থাকা ঘুঙুরটা বাজালো। ঝুনঝুন,ঝুনঝুন শব্দ করে আমায় যেন সে বুঝিয়ে দিল সে ওখানে দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষা করছে। দৌড়ে গেলাম সেদিকেই। কিন্তু কোথায় কি? কেউ কোত্থাও নেই। একি অবিশ্বাস্য ব্যাপার ! রাস্তাটা...রাস্তাটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। তাহলে সে মুহূর্তের মধ্যে গেল কোথায়? আচমকাই রাস্তাটার বহুদূর থেকে ঘুঙুরুর ঝুনঝুন,ঝুনঝুন শব্দটা শুনতে পেলাম। শব্দটা আর পাঁচটা দিনের মতো বাজতে বাজতে দূরে কোথাও বাতাসে মিলিয়ে গেল।

0 comments: