প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল
Posted in প্রবন্ধআমরা স্বপ্ন ভালোবাসি। স্বপ্ন আমাদের জাগতিক কঠিন সীমানাগুলোকে ভেঙে দেয়। যেন জলের মতো বাতাসের মতো তার গতি। অনায়াসে সে আমাদের নিয়ে যায় কালাতীত মহাক্ষণে। পরিচয় ঘটিয়ে দেয় মহতের সঙ্গে। কঠিন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে যে মহতের সঙ্গে পরিচয় হলে আমরা তাঁকে অনুধাবন করতে পারতাম না। কারণ সচেতন মনের প্রয়াস সেই অনুধাবনকে ক্রমাগত বাধা দেয়। সূর্য যেমন অনেক দূরে বলে আমরা তাকে ধারণা করতে পারি, কাছে আসলে ধরতে পারতাম না, ঠিক তেমনই মহামানবের পদসঞ্চার ওই দূরে বলে, স্বপ্নময় বলে আমরা তাঁকে একান্ত করে আন্তরিক করে পাই। সমকালের বাস্তবে আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান তাঁকে ধরতে দিত না।
ভারতবর্ষ এমনই এক মহামানবের জন্ম ও কর্মভূমি বলে আমাদের চেতনায় সেই চিহ্ন আজও বর্তমান। যতই হানাহানি, ক্ষুদ্রতা আমাদের গ্রাস করুক, কখনও কখনও সব ছাপিয়ে আমরা যেন শুনতে পাই—সব্ব জীবে সুখিতা ভবন্তু। জগতের সমস্ত প্রাণ সুখী হোক। দুঃখ যতই অনপনেয় হোক, তাকে জয় করা লক্ষ হোক।
একটি স্বপ্নই সেই মহামানবের মহৎ অস্তিত্বের আরম্ভ বলে মনে করি। এক পূর্ণিমায় নিজের শুভ্র শয্যায় শুয়ে আছেন মায়াদেবী। কোশল রাজ্যের উত্তরে এক ক্ষুদ্র ভূখণ্ড কপিলাবাস্তুর মহিষী। উন্মুক্ত জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে তাঁর শয্যায়। তিনি সবে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন। মনে একটি আনন্দের স্রোত সর্বদা অনুভব করেন। হঠাৎ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। স্বপ্নে দেখলেন চাঁদের আলোর পথ বেয়ে একটি শ্বেতশুভ্র হাতি হেলেদুলে এসে তাঁর উদরে প্রবেশ করল। তিনি তখনই জেগে উঠলেন। দেখলেন, স্বপ্নের প্রভাবে তিনি যেন একটি আনন্দধারায় আপ্লুত হচ্ছেন।
যথা সময়ে রাজদৈবজ্ঞ জানালেন, রানি একটি অসামান্য মানবের জন্ম দান করতে চলেছেন। শ্বেতশুভ্র বর্ণ অকলঙ্ক সৎ ও মহৎ এর প্রতীক। হাতি মন। এমন সুন্দর মনের এক মহামানব আসতে চলেছেন যে রাজার তা সৌভাগ্যের কারণ হবে।
স্বপ্ন সত্যি হল। রাজার ঘরে জন্মালেন যে রাজপুত্র তিনি জগতের মানুষের মনের রাজা হলেন।
আমরা সকলেই জেনেছি যে, রাজপুত্র সিদ্ধার্থ তাঁর যৌবনে তিনটি দুঃখময় দৃশ্য দেখে সংসার ছাড়েন। কিন্তু সত্যিই কি এমন সমাহিত শান্ত স্বভাবের যুবকের পক্ষে এমন ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব?
কপিলাবাস্তু ছিল কোশলের অধীনরাজ্য। যে রাজ্যের উত্তর সীমান্তে একটি ক্ষুদ্র পার্বত্য স্রোতস্বিনী, রোহিণী। এই রোহিণীর উত্তরে কোলীয় রাজ্য। কপিলাবাস্তুর শাক্য জাতি ও এই কোলীয় জাতি বিবাহসূত্রে বহুকাল পরস্পরের আত্মীয়। আত্মীয়দের মধ্যে যে স্বাভাবিক সৌহার্দ্য থাকার কথা তাও নিশ্চয় তাদের মধ্যে ছিল। কিন্তু মাঝে মাঝেই যুদ্ধ লেগে যেত রোহিণীর জল নিয়ে। কখনও কখনও সে যুদ্ধের ফলে রক্তপাতও ঘটত। ওদিকে শুদ্ধোদন তো জ্যোতিষীর গণনায় পূর্ণ আস্থা রাখেন। কুমার সিদ্ধার্থ হয় একজন সম্রাট হবেন নয়ত একজন সর্বজনমান্য সংসারত্যাগী মহাপুরুষ হবেন। এই সংসার ত্যাগ ঠেকাতে তাই রাজপ্রাসাদ ঘিরে নানা রম্য আয়োজন। এমনিই হিমালয়ের পাদদেশের সুন্দর প্রকৃতি, তারপরে রাজার নানান প্রচেষ্টা। যথা সময়ে যশোধরার সঙ্গে পরিণয়ও হল। সুখী রাজপুত্র। যেন রূপকথার গল্পের মতো। কিন্তু তাই কি? শুদ্ধোদন যে তাঁকে মাঝে মাঝেই শাক্য ও কোলীয় গোষ্ঠীর এই জল নিয়ে বিবাদ মেটাতে পাঠাতেন। সিদ্ধার্থও অতি সহজে তাদের শান্ত করতেন। মনে কিন্তু বেদনা রয়ে যেত। মানুষ কেন মানুষের সঙ্গে বিবাদ করে? কেন এই বিদ্বেষ? কেন রক্তপাত?
এক একবার তাঁর মধ্যস্থতায় কাজ হতো না। সিদ্ধার্থ কি তাহলে প্রাসাদসুখের মধ্যে থেকেও সেই কষ্টের কথা স্মরণ করতেন না? তা কখনোই সম্ভব নয়। স্মরণ হতো তাঁর। নর্তকীদের নৃত্যগীত তাঁকে সম্পূর্ণভাবে ভুলিয়ে রাখতে পারেনি নিশ্চয়। নগর পরিদর্শনে বেরোবেন ভাবী রাজা। একেবারেই শিক্ষণীয় কর্তব্য। প্রজাদের জানতে হবে। কাছে পৌঁছতে হবে। সিদ্ধার্থ তাই নগর পরিদর্শনে যেতেন। সারথি তাঁকে সুন্দর মনোহর রাজপথ দিয়ে ভ্রমণে নিয়ে যেত। তিনিও তাইই দেখতে দেখতে ভ্রমণ করতেন। কিন্তু এমন হৃদয় নিয়ে যার জন্ম তিনি কি আর দরিদ্রপল্লীর গলিতে একবারও প্রবেশ করবেন না? নিশ্চয় করবেন। নিশ্চয় বলবেন—মানবের মাঝে আমাকে নিয়ে চলো সারথি। আমি বিশ্বের সমস্ত মানবকে হৃদয়ে ধারণ করতে চাই। এই প্রাত্যহিক নগর পরিদর্শনে তিনি কখনও জরাগ্রস্ত বৃদ্ধকে দেখে থাকবেন। কিন্তু রাজপুরীতে কি বৃদ্ধ কেউ ছিলেন না? অবশ্যই ছিলেন। তবে তাঁদের পরিচর্যার জন্য পরিচারক ছিল। তাঁরা কখনও অসহায় অবস্থায় রাজপথের একধারে পড়ে থাকতেন না। তাঁর মনে সেই অসহায় বৃদ্ধের ছবি ফিরে ফিরে আসত। কখনও ব্যাধিজরজর কোনো মানুষকে বিনা চিকিৎসায় পথের ধারে দেখেছেন। রোগের জ্বালায় সে হয়ত বিকট চিৎকার করছে। তাকে দেখার কেউ নেই। তাহলে রাজপুরীতে কি কারোর অসুখ হতো না? নিশ্চয় হতো। অসুস্থ মানুষকে পুরীর চিকিৎসালয়ে রেখে যথাযথ চিকিৎসা করা হতো। সাধারণ মানুষের মতো তাঁদের কষ্ট পেতে হতো না। মৃত্যুও এমন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ এক কষ্টকল্পনা যে সিদ্ধার্থ যৌবনের আগে কখনও মৃত্যু কী তা জানেননি। বিশেষত, প্রায় জন্মমুহূর্তেই যিনি মাতৃহীন হয়েছেন। অতএব একথাই মনে হওয়া স্বাভাবিক, যে অসহায় মানুষের জীবন যন্ত্রণা তাঁকে কষ্ট দিয়েছে। রোহিণীর জল নিয়ে বিবাদ তাঁকে বেদনা দিয়েছে, হতাশ করেছে। মানুষের এত দুঃখ কেন? তবে কি এই জীবন শুধু দুঃখেই ভরা? নাকি এই জন্মই দুঃখের কারণ?
ক্রমে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। জীবন জিজ্ঞাসা তাঁকে অতিষ্ঠ করে তুলল। তিনি রাজপুত্র। তাঁর তো শুধু নিজের কথা ভাবার কথাও নয়! সর্বজনের দুঃখের মুক্তির কথাই তো তিনি ভাববেন! তখন সবে রাহুল জন্মেছেন। সদ্যজাত পুত্রকে পাশে নিয়ে যশোধরা ঘুমিয়ে আছেন। সিদ্ধার্থ সেই নিশীথ রাতের অন্ধকারে পুরী ত্যাগ করলেন। সম্ভবত সেদিন পূর্ণিমা রাত ছিল না।
রাজপরিবারের অন্তঃপুরে স্ত্রী পুত্র সুখে থাকবেন, কিন্তু জগতের মানুষের যে তাঁকে প্রয়োজন!
একটু দেখে নেওয়া যাক সেসময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি। উত্তরপূর্ব ভারত ও পূর্ব ভারত। চিরকাল যা বৈদিক ধর্মের প্রভাবমুক্ত ছিল। মুক্তচিন্তার ধারক ছিল এই ভূমি। অসংখ্য মেধাবী বিদ্বান মানুষের দর্শন এখানে প্রচলিত ছিল। সেই সব দর্শনে নাস্তিক্যবাদও প্রবলভাবে ছিল। সামাজিক ভাবে জাতিপ্রথা বর্ণাশ্রম সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠী বণিকদের সম্পদে পুষ্ট মহাজনপদগুলিতে ক্ষত্রিয় রাজা শ্রেষ্ঠীদের মান্যতা দিতে রাজী নন। তাঁরা ধনী হলেও তাঁরা সামাজিক মর্যাদায় নীচে। এদিকে সম্পন্ন রাজ্যের যা চিহ্ন, সেই ব্যভিচার, দুর্নীতি, অকারণ যুদ্ধ, ইত্যাদিতে ভারতবর্ষ যেন দীর্ণ। এমন সময় তথাগত এলেন। মানুষের আত্যন্তিক দুঃখের নিবৃত্তিই যার লক্ষ। ধনী নির্ধন, রাজা প্রজা নির্বিশেষে, মানুষের চেতনার মুক্তিই লক্ষ।
সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করে প্রথম যে গুরুর কাছে যান তিনি অরাঢ় কলাম। দুঃখমুক্তির উপায় হিসেবে গুরু তাঁকে ধ্যানের উপদেশ দেন। ক্রমে সিদ্ধার্থ দেখলেন গুরুর নির্দেশিত পথে তিনি শুধু লিঙ্গ শরীরের অস্তিত্ব থেকে উর্দ্ধে উঠছেন। সম্পূর্ণভাবে তাঁর অহং বিলুপ্ত হচ্ছেনা। ফলে,সুখ দুঃখের অনুভূতি তাঁর বিলুপ্ত হচ্ছে না। তিনি শান্তি পেলেন না। গুরু জানালেন, এর চেয়ে বেশি তাঁর আর কিছু দেওয়ার নেই। সিদ্ধার্থ বেড়িয়ে পড়লেন। এলেন সঞ্জয় বেলুঠিপুত্রের কাছে। আর একটু অগ্রসর হয়ে তিনি মনোময় শরীর থেকে মুক্ত হতে পারলেন। কিন্তু নির্বিকল্প এক সর্বব্যাপী আনন্দময় অস্তিত্ব তখনও অধরা। এবার তিনি একাই অগ্রসর হলেন। নৈরঞ্জনার তীরে তিনি কঠোর তপস্যায় রত হলেন। ইহৈব শুষ্যতু মে শরীরম। মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন। বৌদ্ধ শাস্ত্রে এই পর্যায়ের কথা বিশদে আছে। কিন্তু বুদ্ধের সময়ে সেসব লিপিবদ্ধ হয়নি। হয়েছে তাঁর মৃত্যুর বহু পরে। ফলে সেসব যে নিশ্চিত সত্য তা স্বীকার করতে মন সায় দেয় না। ঠিক কী তাঁর সাধন হয়েছিল, কেমন করে যুবক সিদ্ধার্থের রিপুগুলি পুনরায় তাঁকে ভীত করে তুলেছিল, এবং তিনি তা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, সেসব নিশ্চিত জানার উপায় নেই। তবে এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। মৃদুলক্ষণা জাতকের অংশ এটি। কাহিনী থাক, ঘটনা বলি। তথাগত তখন জেতবনে। শ্রাবস্তীর এক কুলপুত্র সংঘে প্রবেশ করেছেন। তিনি সংঘের নিয়ম অনুযায়ী ভিক্ষা করতে যান। একদিন একটি সুন্দরী রমণী তাঁকে ভিক্ষা দিতে এলে ভিক্ষু তাকে দেখে আকৃষ্ট হন। একমনে তাকে দেখতে থাকেন। ক্রমে অনুভব করেন যে তিনি কামের বশে এভাবে নারীটিকে দেখছেন। তিনি তখনই ফিরে আসেন এবং নিজের কুটীরে এসে শুয়ে থাকেন। তাঁর শরীরে তাঁর মনের সেই দাহ একটি কালিমা লেপে দিয়েছিল। বিহারের বাকি সাঙ্ঘিকরা তাঁকে দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করলে তিনি সত্যকথা বলেন। অতঃপর সকলে তাঁকে তথাগতর কাছে নিয়ে গিয়ে কথাটি ব্যক্ত করেন। আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখি, তথাগত তাঁকে বলেন, অর্হত্ত্ব অর্জনের পরও এমন হতে পারে। যে ধ্যানসিদ্ধ যোগী সেও এমন রিপুর দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। এতে লজ্জার কারণ নেই। ঘটনাটি পড়ে অবাক হয়ে ভেবেছি, মানুষের মন, তার অসহায়তা, তার অনুতাপ, এসবই তাঁকে কী অদ্ভুতভাবে স্পর্শ করত! তিনি তো ভিক্ষুর স্বভাবে দোষারোপ করেননি? বরং জানালেন, অতি বড় সিদ্ধপুরুষও রিপুতে আক্রান্ত হতে পারে। ও হল দেহের স্বভাব। ও থেকে উঠতে হবে, আর কিছুই না। অর্থাৎ, সিদ্ধার্থ নিজেও সাধনাকালে রিপুর এই আক্রমণ অনুভব করছেন। যুদ্ধ করেছেন অতিক্রম করতে। এ যে মানুষের ধর্ম!
ভারতবর্ষে বুদ্ধের আবির্ভাব একটি চিরস্মরণীয় ঐতিহাসিক সত্য। আমরা জানি, বেদ বলছেন, মানুষের উত্তরণের পথ আত্মিকে। ব্যবহারিক জীবনের নীতিপরায়ণতার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষটা যদি অন্তরে অন্তরে বিবর্তিত হতে থাকে, তার বোধ যদি ক্রমে জাগতিক থেকে আন্তরিক, এবং আত্মিকে উত্তীর্ণ হয়, তবে ব্যবহারিক জগত তার কাছে মিথ্যা। অনিত্য। নিত্যশুদ্ধবোধরূপ আত্মার সংসর্গে সে তখন উত্তম পুরুষে উন্নীত। তাই, শীলসাধনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু বুদ্ধের কাল এক অন্ধকার যুগ। তাঁর সিদ্ধি তাঁকে এক অনন্য অন্তর্দৃষ্টি দিলো। তিনি অনুভব করলেন, মানুষ যদি ব্যবহারিক জীবনে সৎ না হয়, চরিত্রে যদি উন্নত না হয় তবে সিদ্ধি তার অধরা রয়ে যাবে। যে চরিত্রে অসৎ, দুঃশীল, হত্যাকারী, অত্যাচারী, তার স্বভাবের পরিবর্তন না ঘটলে সে কখনোই আত্মিক জীবনে উত্তীর্ণ হতে পারে না। অথচ সেই সময়ের সমাজ এমন মানুষেই পূর্ণ ছিল। পূর্ব ও উত্তরপূর্বের শ্রামনিক ধর্মগুলি মূলত নীতিশিক্ষাই দান করেছে মানুষকে। কিন্তু সেসব নীতিসাধনা বা শীলসাধনা এমন কঠোর নিয়মের নিগরে বাঁধা থাকত যে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে ধর্ম বজায় রাখা অসাধ্য হতো। বুদ্ধের পিতার বয়সী বর্ধমান মহাবীরের কথা স্মরণীয়। দিগম্বর, সূর্যাস্তর পর রন্ধন নিষিদ্ধ, কারণ আগুনে পোকামাকড় মরবে, তাই ভোজনও নিষিদ্ধ, ইত্যাদি নিয়মকানুন সাধারণ মানুষের পক্ষে পালন করা সম্ভব না হওয়াতে কতিপয় সন্ন্যাসীর মধ্যেই এটি আবদ্ধ রইল।
তথাগতর ধর্ম তাই মজ্ঝিম পন্থার। সকলে যাতে অনুসরণ করতে পারে। আর কত সহজেই না ধর্মে প্রবেশ করা যায়! যে কোনো মানুষ তিনবার ত্রিশরণ মন্ত্র উচ্চারণ করলেই সে বৌদ্ধ হবে। গুরু নেই। কেউ দীক্ষিত করবেন না। মানুষটা নিজেই নিজের পথ বেছে নিতে পারবে। তথাগতর অবয়বে সিদ্ধিজনিত যে বিভা দেখা যেত তা ছাড়াও তাঁর মধ্যে জগতের মানুষকে ভালোবাসার একটি করুণাঘন দীপ্তি প্রকাশ পেতো। তিনি যখনই পথ চলতেন, তাঁকে ঘিরে চলত বহু সাধারণ মানুষ। তারা সেই সময়েই হয়তো ত্রিশরণ উচ্চারণ করতে করতে সংঘে প্রবেশ করত। জাতি বর্ণ ধনী নির্ধনের বাছবিচার ছিল না। বৌদ্ধ ধর্মের এমন অসাধারণ বিস্তৃতির এটি অন্যতম কারণ। ভেদাভেদহীন ধর্ম। পরবর্তীতে দেখতে পাবো, এক সম্রাট হিংসার পথ ছেড়ে ধর্মবিজয়ে সামিল হলেন। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় ছড়িয়ে পড়ল সদ্ধর্ম ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে। গ্রীসদেশ পর্যন্ত গতি হয়েছিল তার। এদিকে সিংহল, জাভা, সুমাত্রা, বোর্ণীও ছাড়িয়ে ক্রমে জাপান চীন মহাচীন হয়ে উত্তরে পামিরের উত্তর ভূখণ্ডে ছড়িয়ে গেল বৌদ্ধ ধর্ম। ততদিনে অবশ্য সে ধর্মের নানা বিবর্তন হয়েছে। সে ধর্মের নানা শাখাপ্রশাখা, নানা দর্শনমত হয়েছে। কিন্তু তথাগতর মূল শিক্ষার গুরুত্ব এতটুকু ম্লান হয়নি।
কী ছিল তাঁর শীলসাধনা? মুক্তির প্রথম সোপান এই শীল। “চরিত্র শব্দের অর্থই এই যাতে করে চলা যায়। শীলের দ্বারা সেই চরিত্র গড়ে ওঠে”। সহজেই তিনি বলেছেন—পাণং ন হানে। প্রাণীকে হত্যা করবে না। এটিতেও মধ্যপন্থা আছে। ভিক্ষু যখন গৃহী বৌদ্ধের গৃহে অন্নগ্রহণ করবেন তখন গৃহস্থ যা দেবেন তিনি তাই গ্রহণ করবেন। সেখানে আমিষ আহার দোষের নয়। বুদ্ধ নিজে চুন্দর দেওয়া শূকরমাংস খেয়েছিলেন। দ্বিতীয়টি বললেন—ন চাদিন্নমাদিয়ে। যা তোমাকে দেওয়া হয়নি তা নেবে না। অর্থাৎ অপরের বস্তুতে হাত দেবে না। মুসা ন ভাসে। মিথ্যা বলবে না। যে কোনো অবস্থাতেই মিথ্যা বলবে না। তাতে যদি কেউ আহত হয় তাও মিথ্যার পথে যাবে না। শুনতে সহজ হলেও এই শীল সাধনা কঠিন। আমরা অহরহ কত সাদা মিথ্যেও তো বলে থাকি! আর একটি শীল, ন চ মজ্জপো সিয়া। মদ খাবে না! আশ্চর্য হই! সেই সময়ে রাজা ও শ্রেষ্ঠীদের পানভোজন আমোদপ্রমোদের অপরিমিত আয়োজন হতো। অপরদিকে বৈদিক ধর্মে এমন কথা নেই। মদ অগ্রহণীয় তো নয়ই, এমনকি কখনও কখনও ধর্মের খাতিরেও সোমরস দেবানাং প্রিয়। তৎসত্ত্বেও শ্রেষ্ঠীদের ত্রিশরণ নেওয়া ঐতিহাসিক সত্য। এক সময় রাজার সেনাদল থেকেও জলের স্রোতের মতো মানুষ সংঘে প্রবেশ করতে শুরু করল। রাজা বিপদে পড়লেন। তথাগতর কাছে আবেদন এলো। সেই থেকে নিয়ম হল, রাজার বিনা অনুমতিতে সংঘে সৈন্যরা প্রবেশ করতে পারবে না। একবার ভেবে দেখা যাক, আধুনিক সময়ে সৈন্যরা যদি কাউকে আঘাত করতে অস্বীকার করে, রক্তপাতে পাপ ঘটবে মনে করে অস্ত্রত্যাগ করেন। অহিংসা পরম ধর্ম, এই কথা মেনে নিয়ে শীল অনুসরণ করছেন। কী হবে আমাদের ভারতবর্ষের? যে ভারতবর্ষের পতাকা অশোকচক্র লাঞ্ছিত! যে ভারত বিশ্বকে জানিয়েছে এই মহামানব আমাদের পথপ্রদর্শক!
শীলসাধনায় যে উন্নতি করে, সে ব্যক্তি মঙ্গলের পথে এগিয়েছে। বুদ্ধ নিজে বলে গিয়েছেন মঙ্গললাভ কী। মঙ্গল লাভে কী হয়। কিন্তু মঙ্গললাভই চরম লক্ষ নয়। এইখানে তিনি স্বভাবের গতিকে মোড় ফিরিয়েছেন। শীলসাধনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষটি ধ্যানের পথে তপস্যার পথে অগ্রসর হবেন। ক্রমে দেখতে পাওয়া যাবে এক শান্তিময় অনুভূতির মধ্যে তিনি যেন স্থিত। নিয়মিত শীলসাধনার মধ্যে দিয়ে মানুষটি ধ্যান ও তপস্যার মধ্যে আত্মিক জীবনে অগ্রসর হবেন। যিনি সন্তুষ্ট, যিনি অক্রোধী, যিনি সামান্যতেই তুষ্ট, তাঁর সাধনার পথ প্রশ্বস্ত। তিনি কারুর ভয়ে ভীত নন। তিনি অপরিমেয় পার্থিব সম্পদের আশায় দুঃখিত নন। তিনি প্রিয়জনের জন্য হাহাকার করেন না। কারণ এই জগতের প্রতিটি প্রাণ তাঁর কাছে প্রিয়। সেই প্রিয়ভাবনা সেই মৈত্রীভাবনা তাঁকে এক অদ্ভুত শান্ত আনন্দের সন্ধান দেয়। ক্রমে আত্মবিমোচনের পথে এগিয়ে তিনি দেখতে পান নিরুপাধি এক অদ্ভুত অস্তিত্ব তাঁর বোধকে আচ্ছন্ন করেছে। তিনি যেন সেই বোধে সম্পূর্ণ উদ্ভাসিত। এখন যদি কোনো ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করেন—ভগবান আছেন? তিনি উত্তর দেন—না। তবে কি ভগবান নেই? তিনি উত্তর দেন—জানি না। অর্থাৎ, তোমাদের কল্পনার ভগবান কে, তিনি কোথায় বাস করেন, তাঁর সঙ্গে তোমাদের সম্পর্কই বা কি, সে আমি জানি না। তবে আমি নির্বাণের কথা জানি। নির্বাণ হল সেই পরম অস্তিত্ব, যেখানে অনিত্য এই জগতের সুখ দুঃখ তোমাকে স্পর্শ করবে না। স্পর্শ করবে না পাপ বা পুণ্য। সেই পরম অস্তিত্ব একটি আনন্দঘন অনুভব।
যারা প্রশ্ন করেছিলেন তাঁদের মনে ওঠেনি, বেদে যে ব্রহ্মের কথা বলা হয়েছে, বুদ্ধ সেই নিরুপাধি ব্রহ্মের কথাই বলছেন। বেদ বলছেন, ব্রহ্ম অবাংমানসোগোচরম। ব্রহ্ম বাক্য মনের অগোচর। কিন্তু তিনি আছেন। তিনি নিরাকার, নির্গুণ। তাহলে বুদ্ধ যখন এই প্রশ্নের উত্তরে চুপ করে রইলেন, তখন কি এইই বোঝায় না যে সেই ব্রহ্মের কথাই তিনি বলছেন? এখানে ব্রহ্ম বোধস্বরূপ। কেন তাহলে আমরা তাঁকে বেদবিদ্রোহী বলব? বলব, কারণ বুদ্ধ বেদের জটিল কর্মকাণ্ড স্বীকার করতেন না। তিনি বর্ণাশ্রম প্রথার মাধ্যমে মানুষকে হেয় করে তাকে ‘দলিত’ করা স্বীকার করতেন না। কিন্তু ব্রহ্মবিদ ব্রহ্ম ইব চ। সেই অর্থে বুদ্ধ স্বয়ং সেই পরমপদ অর্জন করেছেন। সনাতনীরা তা স্বীকার করেননি। নিজেদের জন্য ব্রহ্ম বাক্য মনের অগোচর বলে পাশ কাটালেও, বুদ্ধের এই সোজা সত্য তাদের স্বীকার করতে বাধা ছিল। তাহলে যে বুদ্ধকেই স্বীকার করতে হয়!
একটি সমসাময়িক প্রসঙ্গ দিয়ে এই নিবন্ধ শেষ করব। বুদ্ধ কোনো ধর্ম প্রবর্তন করেননি। জগতের মানুষের প্রতি সদাজাগরুক করুণায় তিনি একটি মার্গ প্রদর্শন করেছেন। যা অনুসরণ করলে মানুষ মৈত্রীভাবনায় একজন সার্থক মানব হয়ে উঠতে পারে। আজও ভারতবর্ষেই অসংখ্য মানুষ (মোট জনসংখ্যার ৮৫% প্রায়) অবর্ণ, শুদ্র, অতিশুদ্র, অস্পৃশ্য, ‘দলিত’ যারা প্রতিদিন সাবর্ণ সনাতনীদের দ্বারা অত্যাচারিত নিহত ধর্ষিত হয়ে চলেছেন। পরিসংখ্যান যে কোনো সুস্থ মানুষকে হতাশায় ঠেলে দিতে পারে। আমাদের কী অদ্ভুত দ্বিচারিতা! বুদ্ধনীতি অনুসরণকারী ভারতে আমরা এখনও বর্ণাশ্রমের বড়াই করে এমন পাপে লিপ্ত হই। লজ্জিত হই না। আমাদের পাপ হয় না। অপরাধ হয় না।
তাই এখনও অসংখ্য ‘দলিত’ বর্ণাশ্রমের এই অত্যাচার, সনাতনী হিন্দুদের এই অত্যাচার থেকে বাঁচতে সংঘের শরণ নেয়। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে। মাত্র ৬% উচ্চবর্ণ হিন্দু বাকিদের শাসন করে শোষণ করে অত্যাচার করে। আমরা মেনে নিই।
শেষ পর্যন্ত তাই শাক্যসিংহের সেই কথাটির ওপরে ভরসা করব। আত্মদীপো ভব। প্রতিটি অত্যাচারিত মানুষ একদিন সেই আত্মিক বলে বলীয়ান হয়ে বিশ্বকে পথ দেখাবে। রক্তাক্ত পৃথিবীতে বুদ্ধের শান্তির বাণী আবারও আমাদের আলোর পথে নিয়ে যাবে। আমরা আলোকিত হব। পরস্পরের প্রতি মৈত্রীতে আবদ্ধ হবো।
পাঠঃ
১ বুদ্ধদেব – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২ জাতক – ঈশান চন্দ্র ঘোষ
৩ Introduction to ‘Anihilation of Caste – Dr B R Ambedkar’, by Arundhati Roy.
[সাহিত্য আর সংবাদ বুদ্ধপূর্ণিমা সংখ্যা ২০২১]
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী লেখা।
ReplyDelete