0

সম্পাদকীয়

Posted in





চোদ্দ লক্ষ তিরিশ হাজার। না, এটি কোনও টাকার অঙ্ক নয়। সম্প্রতি একটি বই প্রকাশের প্রথমদিন বিক্রির সংখ্যা। গ্রন্থটির নাম 'স্পেয়ার' । ব্রিটেনের রাজকুমার হ্যারির লেখা এই আত্মজৈবনিক রচনার ছত্রে ছত্রে রাজপরিবারের ভাঙন আর অন্ধকারের কাহিনি, ভেঙে দিয়েছে যেকোনও একটি বই বিক্রির একদিনের সর্বকালীন রেকর্ড।

বই কেন বিক্রি হয়?

এর উত্তর বিবিধ। লেখার বিষয়, গ্রন্থটির অঙ্গসৌষ্ঠভ, পাঠককুলে লেখকের চাহিদা - এরকম অনেক কিছু নির্ধারণ করে ব্যবসার চালচিত্রটি। কিন্তু একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বিষয়টি যদি হয় মুচমুচে, মুখরোচক, প্রকাশকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ার আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়।

সত্যিই কি তাই? তাহলে তো পর্নগ্রাফি ছাপলেই হয়! 

মানুষের মৌলিক সংগ্রাম, তথাকথিত আপন ভাগ্যকে টপকে যাওয়ার সুতীব্র ইচ্ছার যে গাথা লিখিত হয়েছিল চারশো বছরেরও আগে, সার্ভেন্তেস-এর সেই 'দন কাহটি' এখনও পর্যন্ত পাঁচশো মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। হ্যাঁ, পাঁচশো মিলিয়ন। ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের বাইরে এটাও চিরকালীন রেকর্ড। 

আসন্ন আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় থিম দেশ 'স্পেন'। সার্ভেন্তেস-এর জন্মস্থান।

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - প্রদোষ ভট্টাচার্য্য

Posted in






গানে কোনো পূর্বসুরীর গায়কীর প্রভাব নেই, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবমাধুর্যে সরস অথচ স্বকীয় ব্যক্তিত্বের দীপ্তিতে উজ্জ্বল – এমন কোনো শিল্পীর গানের উদাহরণ দিতে হলে সুমিত্রা সেনের হাসি-খুশী মাখা নম্র রূপটিই মনে ভাসে। অনাড়ম্বর স্বভাবের ছায়া পড়ে ওঁর গানে। তাই সে গানে শিল্পীর বক্তব্যও স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। সকল সঙ্গীত অল্পবিস্তর জানা থাকলেও রবীন্দ্রসঙ্গীতেই যেন ওঁর মনটা খুঁজে পায় তার এক্সপ্রেসন।

(সন্ধ্যা সেন, সুরের আগুন, ২য় খণ্ড পৃঃ ১৯৯)

প্রথম বাক্যেই শিল্পীর অনন্যতা ধরে ফেলেছেন সন্ধ্যা সেন। সত্যিই তো, সুমিত্রার সমসাময়িক মহিলা রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পীদের প্রায় প্রত্যেকেই দুটি ধারার একটির অনুগামী। যেমন, পূর্বা দামের গান শুনলে মনে পড়বে সুচিত্রা মিত্রের কথা, নীলিমা সেন মনে করাবেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিন্তু সুমিত্রাকে এই দুই শিবিরের কোনটিতেই ফেলা যায় কি?

সম্ভবত পঞ্চাশের দশকে সুমিত্রা সেনের সঙ্গীতজীবন শুরু হয়। প্রথম রেকর্ড ছিল দু’খানি নজরুলগীতির – ‘বেদনার বেদীতলে’ ও ‘গোঠের রাখাল’ –তারপর কিছু পল্লীগীতি। প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের ডিস্ক ‘ওগো সাঁওতালী ছেলে’ এবং ‘দিনের পরে দিন যে গেল’। রবীন্দ্রশতবর্ষে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে তাঁর কণ্ঠে আলাদা ৭৮ গতির রেকর্ড বেরোয় – ‘মেঘ ছায়ে সজল বায়ে’ আর ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ’। সত্তরের দশকে কিছু গান তিনি এমন ভাবে তাঁর আপন করে নেন যে অন্য প্রথিতযশা শিল্পী সে গান গাইলেও সাধারণ শ্রোতার কাছে তা তেমন গ্রহণযোগ্যতা পেতে ব্যর্থ হয়। উদাহরণ ১৯৭৩ সালে তরুণ মজুমদার পরিচালিত শ্রীমান পৃথ্বীরাজ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ‘সখী, ভাবনা কাহারে বলে’।

ত্রিবেণী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে সুমিত্রা সেন তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত-শিক্ষিকা সত্তার ছাপও রেখে গেছেন, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। সন্ধ্যা সেন লিপিবদ্ধ করেছেন ‘সুরের আকাশ’, ‘মেঘের পরে মেঘ’, ‘দিনদিনান্তের গান’ প্রমুখ নৃত্যনাট্যের কথা, যেখানে ‘পাশাপাশি উচ্চাঙ্গ ও রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করে একটির ওপর আর একটির প্রভাব’ দেখানো হয়েছে। সুমিত্রা সেন বলেছেন এই অনুষ্ঠানগুলি ছিল কিছু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিশারদের রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি অবজ্ঞার জবাব। সুমিত্রার ভাষায়, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত কনভেনশন-বর্জিত উদ্ভট কোনো বস্তু নয় অথবা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে এর দূরত্বের সম্পর্কও নয়।’ (সন্ধ্যা সেন, পৃঃ ২০১)

এবার বলব এই শিল্পী-শিক্ষিকার সঙ্গে আমার নিজের যোগাযোগের কথা।

গান শুনতে আর গাইতে ভালোবাসতাম ছোটবেলা থেকেই, এ কথা আমাকে নিয়ে মা-বাবার স্মৃতিচারণায় লেখা আছে। ১৯৭২ সালে আমার ভাগ্যে দেবদর্শন ঘটলো যুগপৎ দেশের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী এবং ঋষি অরবিন্দের জন্মশতবার্ষিকী উৎসব উপলক্ষে কলকাতার শ্রীঅরবিন্দ ভবনে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সময়। এক সন্ধ্যায় সঙ্গীত পরিবেশন করতে এলেন সুচিত্রা মিত্রের পর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

সে সময়ে বাবা কর্মরত ছিলেন খিদিরপুরে অবস্থিত Voltas সংস্থায়। আমার সঙ্গীতপ্রীতি দেখে তিনি গানের জন্য গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করলেন বেতারে যুববাণী কেন্দ্রের শিল্পী জগৎবন্ধু মোদককে। ভাগ্য সুপ্রসন্নঃ গুরু ছিলেন শিষ্যের মতোই হেমন্তভক্ত!

এই সময়ে বাবার এক অবাঙালী সহকর্মী ঘটনাচক্রে দমদমে গ্রামোফোন কোম্পানির গিয়ে শুনে এলেন, তখন পশ্চিমবঙ্গে নিত্য আপদ, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের অন্ধকারে, স্টুডিওতে এক সুমধুর মহিলাকণ্ঠ; কণ্ঠের অধিকারিণী শ্রীমতী সুমিত্রা সেন।

১৯৭৩-এর গোড়ায় রবীন্দ্র সদনে এক প্রভাতে গেলাম সঙ্গীতানুষ্ঠানে, সঙ্গে দিল্লী থেকে আগত আমার এক হেমন্তভক্ত কাকীমা। শিল্পীরা ছিলেনঃ প্রথমে সুমিত্রা সেন, তারপর অনুপ ঘোষাল, এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। শ্রীমতী সেন শুরু করলেন ‘তোমার দ্বারে কেন আসি’ দিয়ে। এরপরে দেখেছি, একাধিক রবীন্দ্রসঙ্গীতানুষ্ঠানে তিনি ঐ গানটি দিয়েই আরম্ভ করতেন।


হেমন্তভক্ত হিসেবে তখন বাড়ীতে বেতার জগৎ পত্রিকা আনিয়ে আমি নিয়মিত গান শুনতে ব্যস্ত। রবীন্দ্রজয়ন্তীর ধারেকাছে শিল্পীরা তখন বেতারে গাইতেন তাঁদের প্রকাশিত বা প্রকাশিতব্য গান। এই উপলক্ষেই একদিন শুনলাম সুমিত্রা সেনের কণ্ঠে মুগ্ধ করা এই গানটিঃ ‘আর নাইরে বেলা, নামল ছায়া ধরণীতে’।


অনেক পরে, আশির দশকের গোড়ায় এই একই গান শুনব আমার ঈশ্বরের কণ্ঠে, কিন্তু, নির্দ্বিধায় বলছি, যিনি কিছুদিন পরে আমার সঙ্গীতশিক্ষা-জীবনে সরস্বতী-রূপে আবির্ভূতা হবেন, তাঁর উপস্থাপনার পাশে স্বয়ং ঈশ্বরও ম্লান! নিজেরাই শুনে বিচার করুনঃ


১৯৭৩ হলো সেই বছর যে বছরে আমি জীবনের প্রথম ‘পাবলিক’ পরীক্ষা দেব – আই-এস-সি। অতএব সঙ্গীতশিক্ষায় সাময়িক ছেদ পড়লো। নভেম্বরে পরীক্ষা শেষ হবার পর ডিসেম্বর/জানুয়ারিতে গেলাম চন্দননগর বেড়াতে, কারণ সেখানে আমার দাদা মহকুমা শাসক বা এস-ডি-ও পদে নিযুক্ত। সেখানে তখন ফরাসী নাট্যকার মলিয়েরের বিভিন্ন নাটকের বাংলা রূপান্তর অভিনীত হচ্ছে। এসবের মাঝখানে একদিন দেখি বাংলা কাগজে বিজ্ঞাপনঃ কলকাতার রবীন্দ্র সদনে শ্যামা নৃত্যনাট্য, বড়-বড় করে লেখা, কণ্ঠে হেমন্ত মুখোঃ। কিন্তু, আমার কাছে বাড়তি প্রাপ্তি শ্যামার গানে সুমিত্রা সেন! সহৃদয় দাদা কলকাতায় ফেরার ব্যবস্থা করে দিলেন। অনুষ্ঠান চলাকালীন উইংসের ধারে গায়ক-গায়িকাদের মধ্যে দৃশ্যমান ছিলেন একমাত্র হেমন্ত, কিন্তু ‘প্রেমের জোয়ারে’ সুমিত্রার সঙ্গে দ্বৈত গাইবার সময় শেষে তিনি হঠাৎ ‘ভাসাবে দোঁহারে’ গেয়েই ছেড়ে দিলেন, সুমিত্রার একক কণ্ঠে শোনা গেল ‘বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও দাও’!

আমি স্থির করেছিলাম, অনুষ্ঠানের শেষে সুমিত্রাদির সঙ্গে দেখা করব। স্টেজের পেছনে গিয়ে তাঁর অটোগ্রাফ নিলাম, আর ভয়ে-ভয়ে বললাম, “আপনার কাছে গান শিখতে চাই।” তিনি বললেন, “বেশ তো, ফোন ক’রো।” এখন লুপ্ত, কিন্তু সে সময়ে নতুন কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করার মুখ্য উপায়, টেলিফোন ডাইরেক্টরি, খুলে দেখলাম, ‘সুমিত্রা সেন’ নামে দু’জন আছেন। গায়িকার নিবাস রাইফেল রেঞ্জ রোডে, তাঁর কাছ থেকে জেনে রেখেছিলাম। ফোন ধরলেন তাঁর স্বামী। আমার ইচ্ছে ছিল ওঁর নিজস্ব সংস্থা ত্রিবেণীতে যোগ দেবার, কিন্তু তার ক্লাস হতো উত্তর কলকাতায় বাদুড়বাগান লেনে। আমাদের মধ্য কলকাতার রাসেল স্ট্রীট নিবাস থেকে রাসবিহারী অ্যাভেনিউয়ের বাণীচক্রই সুবিধের।

অবশেষে এলো কাঙ্খিত দিন! দেশপ্রিয় পার্ক সংলগ্ন প্রিয়া সিনেমার পাশে মূল বাণীচক্রে নয়, সুমিত্রাদি বলে দিয়েছিলেন যে তিনি ক্লাস নেন গড়িয়াহাটের কাছে রমণী চ্যাটার্জী রোডের শাখায়। একটি ঘরে তবলচি রথীন নাথকে নিয়ে হারমোনিয়াম সহ বসেছিলেন তিনি। বললেন, ‘দেখি কেমন গাইতে পার।” কিছুতেই মনে করতে পারছি না কোন গানটি গেয়েছিলাম। শুনে সুমিত্রাদি শেখাতে রাজী হলেন বটে, কিন্তু একটু মুখ নীচু করে বললেন, “তুমি তো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নকল করছো, নিজের মতো করে কিন্তু গাইতে হবে!” এই হেমন্ত-অনুকরণের একটি মুখ্য (বদ) বৈশিষ্ট্য হলো মুখ যথেষ্ট হাঁ না করা – যে দোষ হেমন্তর নিজের গায়কীতে একেবারেই নেই! এরপর থেকেই গান শেখানোর সময় যখন সুমিত্রাদির গাওয়া অনুসরণ করে গাইছি, উনি মাঝে-মাঝেই আমার মুখের সামনে হাত এনে ফাঁক করে ইঙ্গিত করতেন যে দাঁত চেপে গাওয়া হচ্ছে।

সুমিত্রাদির কাছে শেখা প্রথম গান আমারই নির্বাচিত (এবং হেমন্তকণ্ঠে শোনা) ‘আমার আর হবে না দেরি’। মনে আছে, বাড়ীতে আমাদের অখণ্ড গীতবিতান ছিল না, আর মা’র কেনা তিন খণ্ডের প্রথম খণ্ডে গানের শেষ লাইন ছাপা ছিলঃ ‘এখন আর হবে না দেরি’! পরের দিন আমি সেইমতো গাইতেই সুমিত্রাদি ভুরু কুঁচকে বললেন, “ ‘এখন’ এলো কোত্থেকে? সব সময় ‘আমার’ গাইবে।” অখণ্ড গীতবিতান এবং স্বরবিতান-এও তাইই আছে!

ক্লাস হতো সম্ভবত প্রতি শনিবার। এক শনিবার আসার আগেই আমার সর্দি হয়ে গলা বসে গেল। সেই অবস্থাতেই গুরু-মা সমীপে হাজির হলাম। আজ কি আর কোন গান তুলতে পারব? তবুও আরাধ্যার সঙ্গে তো খানিকটা সময় কাটবে! ঘাবড়ে গেলাম দেখে যে সুমিত্রাদি বললেন, “আজ আবার একটা গান তোলাব!” আমি কোনরকমে চিঁচিঁ করে বললাম, “কিন্তু গলা যে উঠবে না!” তা সত্বেও দিদি গান ধরলেন, ‘লুকালে ব’লেই খুঁজে বাহির করা’। কি নিখুঁত নির্বাচন! আমার অবস্থা দেখেই বুঝে নিয়েছিলেন অন্তরা আর আভোগে ঠিক কতটা গলা উঠবে!

এরপর, তাঁর নিজের পছন্দের গান বলে শিখিয়েছিলেন ‘যখন তুমি বাঁধছিলে তার, সে যে বিষম ব্যথা’। বাণীচক্রের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে একক গাইবার জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন এই গানটি আর আমার নিজের পছন্দ করে শেখা ‘বাহিরে ভুল হানবে যখন, অন্তরে ভুল ভাঙবে কি’।

এবার দিদি সুযোগ করে দিলেন রবীন্দ্র সদনে ত্রিবেণীর অনুষ্ঠানে সমবেত কণ্ঠে গাইবার। অনুষ্ঠানটির নাম ছিল ‘ওগো বিদেশিনী’। রবীন্দ্রনাথের যে সব গানে বিদেশী প্রভাব আছে বা সরাসরি বিদেশী সুর ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলি নিয়ে গীতি আলেখ্য। ভাষ্যপাঠ করেছিলেন প্রদীপ ঘোষ, আর একক কণ্ঠে ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় আর সুমিত্রাদি স্বয়ং। ত্রিবেণী শিল্পীগোষ্ঠীর সম্ভবত দু’জনের একক কণ্ঠ শোনা গিয়েছিলঃ দিদির বড় মেয়ে ইন্দ্রাণী সেন এবং শক্তিব্রত দাসের।

পরের অনুষ্ঠান ছিল তাসের দেশ নৃত্যনাট্য। রাজকুমারের ভূমিকায় সাধন গুহ, কণ্ঠে দেবব্রত বিশ্বাস ও অশোকতরু বন্দোপাধ্যায়। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে নৃত্যে ছিলেন পলি গুহ, এবং কণ্ঠে সুমিত্রাদি, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রাণী সেন, প্রভাত ভঞ্জ, এবং শক্তিব্রত দাস। সমবেত কণ্ঠে বাকী আমরা।

এছাড়া, সুমিত্রাদির পরিচালনায় আকাশবাণীতে ত্রিবেণীর পক্ষ থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনায় অংশ নিয়েছি অন্তত দু’বার। এই সুযোগে বেশ কিছু নতুন গান তোলা হয়ে গিয়েছিলঃ ‘ডাকিল মোরে জাগার সাথী’, ‘অকারণে অকালে মোর পড়ল যখন ডাক’, ‘ডাকব না, ডাকব না, অমন করে বাইরে থেকে’, ‘আজি যত তারা তব আকাশে’ ইত্যাদি।

গান শেখার সময় কমে আসছিল। এবার কলেজে ভর্তি হবার পালা। সুমিত্রাদিকে বিদায় সম্ভাষণ করে ওঁর কাছে শেষ গান নিজেই নির্বাচন করে শিখেছিলামঃ

পথিক আমি এসেছিলেম তোমার বকুলতলে।
পথ আমারে ডাক দিয়েছে, এখন যাব চলে।
ভরা যূথীর পাতায় ঢেকে আমার বেদন গেলেম রেখে –
কোন ফাগুনে মিলবে সে যে তোমার বেদনাতে!

কিছুদিন আগে সুরলোকে পাড়ি দিয়েছেন আমার জীবনে সরস্বতীর রূপধারিণী প্রথম গুরু-মা। ঠিক এর পরেই কলেজ জীবনে পাব দ্বিতীয় সরস্বতীকেঃ অধ্যাপিকা কাজল সেনগুপ্ত। সে আরেক ইতিহাস।

সবশেষে একটি আবেদন রাখব। সুমিত্রা সেন প্রধানত রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিল্পী এবং শিক্ষিকা হিসেবেই প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন এবং খ্যাত আছেন। কিন্তু, রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও তিনি অন্য অনেকরকম গান গেয়েছেন। এই প্রতিবেদনেই উল্লেখ আছে যে তাঁর প্রথম রেকর্ড নজরুলগীতির। সন্ধ্যা সেনকে তিনি তাঁর পল্লীগীতির রেকর্ডের কথাও বলেছেন। এছাড়া বেতারে তাঁর কণ্ঠে শুনেছি সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান। সেই বেতারেই বিশিষ্ট শিল্পীদের নিয়ে সমবেত কণ্ঠে প্রচারিত হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রলালের ‘যে দিন সুনীল জলধি হইতে’। এক-একজন কয়েকটি নির্বাচিত পংক্তি একক কণ্ঠে গেয়েছিলেন। সুমিত্রা সেনের কণ্ঠে ছিল, যতদূর মনে পড়ে ‘ললাটে গরিমা, বিমল হাস্যে অমল কমল-আনন দীপ্ত’ লাইনটি। বাণীচক্রে একদিন শুনেছিলাম হারমোনিয়াম বাজিয়ে নিজের মনে গাইছেন অতুলপ্রসাদের ‘কী আর চাহিব বল’। পরে সংবাদপত্রে পড়েছিলাম যে কোন এক অনুষ্ঠানে তিনি অতুলপ্রসাদী গান পরিবেশন করেছিলেন। বাকী রইল ত্রিবেণী গোষ্ঠীর কিছু ব্যতিক্রমী সঙ্গীতালেখ্য। ক্যাসেটে ‘অন্য আমি’ নাম দিয়ে কিছু থিমভিত্তিক রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংকলন শুনে ভাল লেগেছিল। আর সত্তরের দশকে সমালোচকদের প্রভূত প্রশংসা কুড়োয় ‘মেঘদূত’, যেখানে কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথের সহাবস্থান ঘটেছিল। স্বয়ং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে এই প্রচেষ্টা রেকর্ডে সংরক্ষণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

এগুলি কি উদ্ধার করা সম্ভব? তাহলে প্রয়াত শিল্পী-শিক্ষাগুরুমায়ের কর্মের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা ব্যক্ত করা হবে।

2 comments:

0

প্রবন্ধ - সৌভিক দে

Posted in






কালের অধিষ্ঠাত্রী কালী। কালের কলন করেন তাই তাঁর এই নাম। তিনি হরপ্পা সভ্যতায় পূজিত নিশা। তিনি বৈদিকদের কালরাত্রি। তিনিই বৈদিকদের ভীতি মিশ্রিত রাত্রিসূক্তের কেন্দ্রে। তিনি ঘোর অমানিশা রাত্রির অধিষ্ঠাত্রী, কার্তিকী অমাবস্যায় এজন্য তিনি পূজিত হন। কালী নামের উল্লেখ অবশ্য প্রথম পাই বেদে। অবশ্য সম্পূর্ণ অন্যভাবে– "কালী করালি মনজবা চ ধুম্রাক্ষী স্ফুলিঙ্গিনী লোলজিহ্বা"। মানে তখন হোমের শিখাকে কালী নামে ডাকা হত। এই শিখার তলায় পড়ে থাকত সাদা রঙের ছাই। যখন হিন্দু ধর্মে তন্ত্রের ভাব প্রবল হল, তখন এই শিখাকে উলঙ্গ দেবী হিসেবে কল্পনা করা হল, আর নিচের ছাইকে ভষ্ম মাখা শিবরূপে। প্রথমে কালীর দুই হাত ছিল। বিষ্ণুশর্মা যখন পঞ্চতন্ত্র লিখলেন তখন কালীর রমরমা দেখে ঠাট্টা করে বিষ্ণুর সাথে মিলিয়ে তিনি কালীকেও চতুর্ভুজ বলে উল্লেখ করেন। সেই থেকে মায়ের চারটি হাত। সব রঙ এসে কালো রঙে মেশে, এজন্য তিনি কালো রঙের দ্বারা প্রকাশিত হন। মার্কেণ্ডেয় পুরাণে কালীর জন্মকথা আছে। ক্রোধান্বিত চণ্ডীর তৃতীয় নয়ন থেকে বেরিয়ে এল ঘোর কৃষ্ণবর্ণের এক ভয়ঙ্করী দেবী। তারই নাম কালী। রক্তবীজের সেনাপতি চণ্ড ও মুণ্ডের মাথা কেটে হাতে ঝুলিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সেই কালরূপী কালী। দেবী চণ্ডী সন্তুষ্ট হয়ে কালীর নাম দিল চামুণ্ডা। কালীর হাতে যে নরমুণ্ডটি ঝোলে সেটা এই চণ্ড অথবা মুণ্ডর। এই কাহিনি থেকে জানা যাচ্ছে কালীর পরবর্তী রূপ চামুণ্ডা, কিন্তু পুরাতাত্ত্বিকদের মতে কালীর পূর্ব রূপ চামুণ্ডা।

প্রত্নসাক্ষ্য অনুসারে কালী নয়, চামুণ্ডাই প্রাচীন। পাল সেন আমলের প্রচুর চামুণ্ডামূর্তি বাংলার অনেক স্থানে মিলেছে। বর্ধমানে কেতুগ্রামের অট্টহাসের দ্বিভূজা চামুণ্ডামূর্তি ভয়াল রূপের। খিদের চোটে শরীরের হাড় কঙ্কাল যেন বেরিয়ে আসছে। দ্বিভুজা দেবী উবু হয়ে বসে আছে। অধরে রহস্যময় হাসির ঝিলিক। মূর্তিটি বর্তমানে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। এটি পালযুগের মূর্তি। বর্ধমানের কাঞ্চননগরের চামুণ্ডামূর্তিটি অসাধারণ সুন্দর। দেবী লোলজিহ্বা। চক্ষু কোটরাগত। গলায় মুণ্ডমালা। অষ্টভূজা। ডানদিকের দুহাতে ত্রিশূল, অসি, নরমুণ্ড। বামদিকের দুটি হা্তে নরমুণ্ড, পরশু ও একহাতের অনামিকা কামড়ে ধরেছে দেবী। পদতলে শায়িত শব। দেবী নৃত্যরত, নতকুচ, শরীরের শিরা উপশিরা দৃশ্যমান। মন্তেশ্বরের বা দিগনগরের চামুণ্ডামূর্তি দুটিও অসাধারণ।

সমগ্র দিনাজপুর থেকে আবিষ্কৃত হয় অগণিত পাল যুগের চামুণ্ডা মূর্তি। এখান থেকে কিছু নৃত্যরতা চামুণ্ডা মূর্তিও পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয় এই অঞ্চলে চামুণ্ডার মুখা পুজোর বহুলাংশে প্রচলিত। বর্তমানে কালী পুজোর সময় জিভ যুক্ত জীর্ণ শরীরের চামুণ্ডা মূর্তির পুজো হতে দেখা যায়। দক্ষিণ কলকাতার চেতলা অঞ্চলে আয়োজিত চামুণ্ডা কালী, আদি চামুণ্ডা, রক্ত চামুণ্ডা নামক এই সব দেবীর পুজোয় মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে পাল ও সেন যুগের চামুণ্ডার প্রভাব অবশ্যই আছে। এমন পুজো চেতলার সন্নিকটে অবস্থিত দুর্গাপুর ব্রিজের নিকটও আয়োজিত হয়। তাছাড়া বেহালা, ভবানীপুর হরিশ পার্ক, সিঁথির মোড় অঞ্চলেও এমন সার্বজনীন বা পারিবারিক চামুণ্ডা পুজো হয়। ভবিষ্যতে এই মূর্তিগুলোও হয়তো চামুণ্ডা নিয়ে গবেষণা বা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে উপস্থিত হবে। তবে চামুণ্ডার রকমফেরের মধ্যে একটি জনপ্রিয় ঐতিহাসিক রূপ হল চর্চিকা বা চর্চা। শব্দটির অর্থ ভয় দেখানো। অর্থাৎ যে দেবী ভয়ঙ্করী। পালযুগে জনপ্রিয় দেবী ছিল চর্চিকা। সিয়ান শিলালেখে এ বিষয়ে উল্লেখ্য তথ্যাদি মেলে। সুকুমার সেনের মতে, "এই চামুণ্ডা-চর্চিকাদেবী থেকেই আধুনিক কালীর উদ্ভব হয়েছে"।

মুর্শিদাবাদ জেলার সালার থানার শিমুলিয়া গ্রাম। এক অতি প্রাচীন জনপদ। প্রাচীন নাম সোমালিয়া। দ্বাদশ শতকের বল্লাল সেনের নৈহাটি তাম্রশাসনে গ্রামটি মুদ্রিত হয়ে আছে সোমালিয়া নামে। এ গ্রামেই জন্মেছিলেন প্রাকচৈতন্যযুগের মহাভারত অনুবাদক কবি রামচন্দ্র খান। এই গ্রামেই রয়েছে পালযুগের একটি অপূর্ব বিরল ব্যতিক্রমী চামুণ্ডা-চর্চিকার প্রস্তরমূর্তি। সালার রেল স্টেশন থেকে নেমে বাস বা রিক্সা, ভটভটি ভ্যানে করে শিমুলেতে অনায়াসে পৌঁছানো যাবে। অঞ্চলটার চারিদিকে শুধু ইতিহাসের হাতছানি। দেখতে পাবেন একাধিক প্রাচীন বিষ্ণুবিগ্রহ ও হাল আমলে গড়ে ওঠা বড় বড় মন্দির। এদের মাধ্যমেই আপনি হয়তো একসময় পৌঁছে যাবেন প্রাচীন সোমালি গ্রামে। কারণ, এইগ্রামেই রয়েছে বিরল চামুণ্ডা-চর্চামূর্তিটি। এই সব মূর্তি আমার স্বচক্ষে দেখা। সে সময় আমার ক্যামেরা-মোবাইল ছিল না– তাই মূর্তিগুলির বর্ণনা লিখে রাখলেও, কোনও ছবি তুলে রাখা সম্ভব হয়নি।

গঠনের দিক থেকে ভারী অদ্ভুত। উচ্চতায় প্রায় দেড় ফুট। চওড়া দশ ইঞ্চি। খানিকটা ভগ্ন হলেও অপূর্ব সৌন্দর্যময়। নীচে শায়িত শিব। সামান্য কাত হয়ে যেন শুয়ে আছে। দেবী ঈষৎ কটি হেলিয়ে সমপাদস্থানিক ভঙ্গিমায় দণ্ডায়মান। দু পাশে দেবীর দুই সহচর-সহচরী। ডানদিকে নিঃসন্দেহে পুরুষ। বাম হাঁটুর ওপর এক হাত রেখে অপর হাতে অস্ত্র নিয়ে প্রদর্শিত। বামদিকের মূর্তিটি যতদূর সম্ভব সহচরী। মাথায় জটামুকুট কিংবা পাগড়ি পরা। চর্চিকা অষ্টভুজা। ডানদিকের চার হাতের ঊর্ধ্ব হস্তে অভয় মুদ্রা, মারণাস্ত্র, নরমুণ্ড আর এক হাত দিয়ে সে নরমাংস চিবিয়ে খাচ্ছে। বামদিকের চার হাতের ঊর্ধ্বহস্তটি ডান হাতের মতোই। নরমুণ্ডধরা এবং একটি দীর্ঘ গদা ধরে আছে। ডান ও বামদিকের দুটি হাত দিয়েই সে নরমাংস গোগ্রাসে খাচ্ছে। হাড়কঙ্কালসার দেহ। উদরে বৃশ্চিক চিহ্ন। মুখমণ্ডলে পুরুষালি ভাব। দেবী ত্রিনয়নী। মাথায় সর্পমুকুট। দেহের তুলনায় কান দুটি দীর্ঘ। পরেছে কুণ্ডল। একচালিতে দেবীমূর্তি খোদিত। পাদপীঠে পদ্ম নেই। চালির দুদিকে কোনও বিদ্যাধর বা বিদ্যাধরী নেই। নেই চালির শীর্ষবিন্দুতে কীর্তিমুখ। পরিবর্তে ডানা মেলা শকুনি। অভিনব মূর্তি পরিকল্পনা। জৈন বা বৌদ্ধরা যে চামুণ্ডা বা চর্চা পুজো করতেন তা ছিল সম্পূর্ণ অহিংস রীতির। কে জানে এই চর্চিকা হয়তো তাঁদের পূজিত দেবীমূর্তি।

পালযুগে চর্চা অন্যতম জনপ্রিয় দেবী– একাদশ শতাব্দীর নয় পালের রাজত্বকালে মূর্তিশিবের বানগড় তাম্রলেখে "ওং নমশ্চর্চ্চিকায়ৈ" বলে প্রশস্তি উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, দেবী চর্চিকা বা চর্চা যেন জগৎকে রক্ষা করে। লেখে চর্চাদেবী সম্পর্কে দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মেলে। দেবী চর্চা খাদ্যের অভাবে আকুল হয়ে শুষ্ক তনু ধারণ করেছে এবং নরমুণ্ডের মালা পরে জগৎ রক্ষা করছে। এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় চামুণ্ডার সঙ্গে চর্চার মৌলিক পার্থক্য আছে। অর্থাৎ চামুণ্ডার মতো হাড়কঙ্কালসার শরীর হলেও দেবী কালীর মতো তার গলায় থাকে নরমুণ্ডের মালা। সিয়ান শিলালিপি থেকে জানা যায় নবম শতকের অন্যতম পালবংশীয় রাজা মহেন্দ্র পাল ছিলেন চর্চিকাদেবীর একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি সুবিশাল প্রস্তরমন্দিরে দেবী চর্চিকার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজা নয় পাল পরবর্তীকালে এই মন্দিরে একটি শিলাবলভী ও সোপান নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।

বজ্রবারহী বা চর্চা বা চামুণ্ডা চর্চা শুধু প্রস্তরমূর্তিতে নয়, টেরাকোটা মন্দির ফলকেও স্থান পেয়েছে। বীরভূম, দাঁইহাট,গুপ্তিপাড়াতে এমন ফলক আমি নিজে দেখেছি। সঙ্গের ছবিতে রইলো বীরভূম জেলার ঘুরিষা অঞ্চলে অবস্থিত টেরাকোটার রঘুনাথ মন্দির-গোত্রের দেবী চামুণ্ডার রিলিফ ভাস্কর্য। বাংলার জনপ্রিয়তম দেবী কালীর প্রকৃত ঐতিহাসিক উৎস সন্ধান করতে হলে চর্চা ও চামুণ্ডা– এই দুই দেবীর সম্পর্কে পড়াশোনা করা খুব জরুরি। হয়তো এই ইতিহাসের সূত্র ধরেই মা কালীর সম্পর্কে আরও তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হতে পারে। চিত্তাকর্ষক বিষয় হল, পালযুগের বাংলায় বৌদ্ধদের মধ্যেও কালী পূজিত হতেন এবং মা কালীর বর্তমান মূর্তিরূপের পেছনে বৌদ্ধ তন্ত্রেরও অবদান আছে। বৌদ্ধদের মহাযান সাধনায় এবং বজ্রযান তন্ত্রে কালিকার উল্লেখ আছে। কালিকা হলেন মহাকালের পূর্ব দক্ষিণ দিকের অধিষ্ঠাত্রী। কালিকা কৃষ্ণবর্ণা, দ্বিভুজা, নগ্নিকা। এঁর হাতে কর্ত্রি ও নরকপাল (বিকল্পে নরদেহ)। মুক্তকেশী এই দেবী মুণ্ডমালা ধারণ করেন এবং দন্তব্যাদান করে থাকেন। ইনি ত্রিলোচনা, প্রত্যালীঢ়পদা ও শবারূঢ়া।

মধ্যযুগের বাঙালির তন্ত্রের জগতে কালীর গুরুত্ব সর্বাধিক। তন্ত্রের সমস্ত সাধনক্রমের ধারাকে কালীতত্ত্বের সমুদ্রে সমন্বিত করার যে উদ্যোগ পালযুগের শেষার্ধে আরম্ভ হয়েছিল; তার চরম রূপায়ণ ঘটে মধ্যযুগে। ভৈরবীতন্ত্রে বলা হয়েছে :

"দক্ষিণকালিকা দেবী সারাৎসারতরা পরা।
বিশেষত কলিযুগে তৎ সমা দেবতা নহি।।
কলৌ কালী নান্যদেবতা নাস্তি কলৌ যুগে।
একৈব কালী সারসর্ব্বস্ব কলৌ যুগে কীর্তিত।।"

সমস্ত আরাধ্যাগনেরও পরম সারাৎসারতমা হলেন শ্রীমদ্দক্ষিণকালী। বিশেষত কলিযুগে তার মতো কৃপাময়ী এবং তৎক্ষণাৎ সিদ্ধিপ্রদায়িনী কোনো দেবতা নাই। কলিযুগে একমাত্র কালী ভিন্ন কোনো গতি নাই। কলিতে কালী ভিন্ন আর অন্য কোনো মুক্তিপ্রদ দেবতা নাই, একা কালীই কলিযুগের সারসর্ব্বস্বরূপে কীর্তিত হয়েছেন। বজ্রযানে কালীর আদিরূপের আভাস থাকলেও তার বর্তমান রূপটি সহজ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে সেনযুগ এবং তার পরবর্তী সময়েই পরিপূর্ণ বিকশিত হয়। দক্ষিণাকালী, বামাকালী, রক্ষাকালী, শ্মশানকালী, নির্বাণকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী প্রমুখ অগণিত রূপভেদ এই সময় সুপ্রচলিত হয়ে ওঠে। আবার সাধনমার্গ অনুযায়ী তাঁর বিদ্যারাজ্ঞী রূপের বিশদ ধারণাও এই সময়ের তন্ত্রে বিশদে বর্ণিত। আবার কাশ্মীরের তন্ত্রধারা থেকেও কালীর বেশ কয়েকটি রূপ এই সময় কালীকুলে গৃহীত হয়; যাঁদের বিশদ উল্লেখ অভিনবগুপ্তের তন্ত্রালোকে পাওয়া যায়।

মধ্যযুগ বাঙালির জাতীয় জীবনের ক্রান্তিকাল। অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহিঃশত্রুর সাথে নিয়ত সংঘর্ষরত বাঙালির কাছে এই সময় মাতৃকার ভয়ঙ্করী ভয়হারিণী রিপুদলনী রূপটিই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। যেহেতু সহজ আন্দোলনের সময়ে উড্ডিয়ানে প্রবর্তিত সাধনক্রমে আরাধিতা মাতৃকাগণের সাধারণ বৈশিষ্ট্যই এইটি; তাই অক্ষোভ্যকুলের মাতৃরূপই নানা বিবর্তনের মাধ্যমে এই সময় তন্ত্রের প্রধান অন্বিষ্ট বিষয়। এই কারণেই মধ্যযুগের তন্ত্রে কালীর মধ্যে অবলীলায় মিশে গেছেন চর্চিকা, নৈরাত্মা, পর্ণশবরী, বজ্রযোগিনী, বজ্রবর্ণিনী, বুদ্ধডাকিনী। মহাকাল কিছুটা রূপান্তরিত হয়ে আজও আছেন। কুল্লা, কুরুকুল্লা প্রমুখ কালীর পঞ্চদশ নিত্যার অন্তর্গত হয়েছেন। এমনকি সুদূর অতীতের পক্ষীমাতৃকার স্মৃতিবাহী বলাকিনী মাতৃকাও কালীর দ্বাদশ নিত্যা রূপে পরিগণিত হয়েছেন। তাঁদের সকলেরই রূপ একান্তভাবেই উড্ডিয়ানে প্রবর্তিত সাধনক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁরা সবাই নীলবর্ণা, খড়্গধারিণী, মুণ্ডমালিনী, অট্টহাস্যরতা, দিগম্বরী। বজ্রযানের স্মৃতি হিসেবে মাতৃকার মণ্ডলে ডাকিনী, যোগিনী, যক্ষ, বটুক, বেতালদের উপাসনাও অব্যাহত থেকে যায় মধ্যযুগে। অন্যদিকে বজ্রযোগিনীর সাধনক্রমই আবার ছিন্নমস্তা প্রচণ্ডচণ্ডিকার সাধনমার্গ নির্মাণ করেছে। দুইপাশে ডাকিনী ও বর্ণিনীকে নিয়ে মিলনরত যুগলের উপর নৃত্যরতা মাতৃকার যে রূপটি নাঢ়া নাঢ়ীর দ্বৈতরহিতা মাতৃকার তত্ত্বের মূল ভাবনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল; সেই রূপটিই আজও ছিন্নমস্তার সাধকগণ ধ্যান করেন। আজও তন্ত্রের ধারায় কালী তারা ও ছিন্নমস্তা এই তিন মাতৃকাই সর্বাধিক জনপ্রিয়।

মধ্যযুগের তন্ত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল দশমহাবিদ্যার সাধনক্রমের উত্থান। দশমহাবিদ্যার ধারণা সেনযুগ থেকেই জনপ্রিয় হচ্ছিল। মধ্যযুগে তার চরম সমৃদ্ধি ঘটে। কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামুখী, মাতঙ্গী ও কমলার উপাসনা আজকের তন্ত্রের সিংহভাগ অধিকার করে আছে। এর মধ্যে বগলামুখী, ছিন্নমস্তা প্রমুখের সাধনক্রম বেশ প্রাচীন। এঁদের কিছু নাম যেমন তন্ত্রের আদিরূপের ইঙ্গিত দেয় (বগলামুখী>বকের মতো মুখ, পক্ষীমাতৃকার স্মৃতিবাহী); অন্যদিকে ব্রহ্মযামল, রুদ্রযামল প্রভৃতিতে উল্লিখিত কয়েকটি স্তব ও কবচ খুব সম্ভবত মাৎস্যন্যায়ের অরাজক অবস্থার স্মৃতি বহন করে। তবে শ্রীকুল ও কালীকুলের বিভিন্ন ধারা থেকে এই দশজন মহাবিদ্যার একত্র সমাবেশ সেনযুগ ও তার পরবর্তী সময়ের তন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য। এবং এই দশমহাবিদ্যার মধ্যেও কালীই সর্বাগ্রগণ্য রূপে পূজিত হয়েছেন।

মধ্যযুগের কালীসাধনার একটি দুঃখজনক বৈশিষ্ট্য হল গুহ্যাচারের প্রাবল্য। উৎকৃষ্ট সাধনদর্শন যখন মুষ্টিমেয় সাধক পরম্পরার কুক্ষিগত হয়ে যায়; তখনই গণধর্ম বিনষ্ট হয়। জাতীয় জীবন শিকড়বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আজ যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি তন্ত্রের বিষয়ে মারাত্মক অজ্ঞতা পোষণ করেন; মাতৃকার উপাসনার চিন্তায় ভক্তির থেকে ভয় বেশি পান; তার কারণ– এই গুহ্যাচারের প্রাদুর্ভাব। কিছু অপ্রয়োজনীয় কঠোর নিয়মের শৃঙ্খলে সহজ ধর্মভাবনাকে আবদ্ধ করার ফলেই তন্ত্রের সাথে সমাজের বৃহত্তর অংশের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। আর দীর্ঘদিন সমাজবিচ্ছিন্নতার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম অনাচার ও কদাচারের প্রাবল্য। পালযুগের আগে মাৎস্যন্যায়ের সময়ে কামাচার অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। পালযুগে মহেন্দ্রপালের মৃত্যুর পর থেকে মহীপালের সময়ের আগে পর্যন্ত বজ্রযানে অধঃপতনের বীজ প্রবেশ করেছিল। নাঢ়া নাঢ়ীর নেতৃত্বে সিদ্ধাচার্যগণের সহজ আন্দোলন তার অবসান ঘটিয়েছিল। কিন্তু সেনযুগের পর থেকে একটিও শাক্ত গণ আন্দোলন ঘটেনি।

মধ্যযুগের তন্ত্রে সার্বজনীন বন্দনার পরিবর্তে গুরুত্ব পেয়েছে রহস্যপূজা। মাতৃকার সাধনক্রমের মধুরতার পরিবর্তে প্রতিটি সাধনক্রম কতটা ভয়ানক; সামান্যতম ত্রুটিতেও কি ভয়ঙ্কর সর্বনাশ নেমে আসতে পারে; তার ঢক্কানিনাদ এই সময়ের অধিকাংশ তন্ত্রশাস্ত্রের একটি ধ্রুব বৈশিষ্ট্য। এর বিষময় পরিণাম এই হয়েছে যে ভারতের প্রধানতম মাতৃকা উপাসক মহাজাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আজ মাতৃ-পুজোর রীতি ও গুরুত্ব বিষয়ে কিছুই জানেন না। আজও যে তন্ত্রের দেবীগণকে অতি সহজেই অপশক্তি বলে অপপ্রচার করে দেওয়া যায়; তন্ত্রের নামে অযোগ্য সাধকরা যথেচ্ছ কদাচার করতে পারে; তার জন্য প্রধান দোষী শাক্তধর্মের এই অপ্রয়োজনীয় গুহ্যাচার। আজও শাক্তধর্মের এই সুমহান ধারাটি কয়েকটি সাধক পরম্পরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে।

সাকার উপাসনার সকল বিগ্রহের মধ্যে কালীমূর্তি আমার সর্বাধিক প্রিয়। কালী আমার অন্যতম প্রশান্তির আশ্রয়। তিনি আমায় শূণ্যরূপে পূর্ণকে খুঁজে ফেরার ডাক দিয়েছেন। যতবার এই নিরাবরণ, নিরাভরণ প্রতিমার দিকে তাকাই, বড় বেশি করে মনে পড়ে মানুষের কি অসম্ভব প্রচেষ্টা সেই শূণ্যতারও অতীত অনন্তকে চেখে দেখার। এই মৃত্যুরূপা প্রতিমা দক্ষিণ করে যেই কাম্যবস্তু বিলিয়ে চলেছেন, বাম করে তাকেই খণ্ডন করছেন অবলীলায়। এ বৈপরীত্য নয়। এ পূর্ণতা। কালী নিশাময়ী। কালী ঘোর তমিশ্রার আড়ালে থাকা সেই শক্তি, যাঁর কাছে পৌঁছে চাইবার কিছু থাকে না। সেই অনিরুদ্ধ পথে একে একে খসে পড়েছে সমস্ত আকাঙ্ক্ষা। 'কে তুমি' থেকে ততক্ষণে পৌঁছানো গেছে 'কে আমি'র ভূমিতে। বিশ্বরতি এসে ঠেকেছে আত্মরতিতে। আদপে কালীর রতি দুইয়ের নয়। একেরই উল্লাস। তিনি তো স্বেচ্ছাচারীণী। স্ব ইচ্ছায় বিচরণ করছেন সেই ভূমায় যেখানে স্ব-বই কিছুই নেই।

কালের খেলার অনেক অনেক আগে যা জেগে ছিল একা, মায়াবিম্বে তাই খণ্ডিত হয়ে গেছে টুকরো টুকরো সময়ে। সেই অজানা সময়ের কিনারে বসে মা আমার গেঁথে চলেছেন বিনি সুতোর মালা। ইচ্ছার মালা। যে ইচ্ছা ধীরে রূপ নেবে ক্রিয়ায় আর পরিণতি পাবে জ্ঞানে। আমার মূঢ়বুদ্ধিতে যে ধৃষ্টতা দেখালাম, একনায়িকা তা কৌতুকে উড়িয়ে দেবেন আর গুণীজন নিতান্ত অভাজন ভেবেই ক্ষমা করবেন এমন প্রার্থনা করি। দেবী কালীকে আমাদের এই বাংলা যেভাবে আপন করে নিয়েছে, তা ভারতের আর অন্য কোনো রাজ্য করতে পারেনি। বাংলার কোণায় কোণায় ছড়িয়ে আছে ছোট বড় অসংখ্য কালী মন্দির। তা গুনে শেষ করা যাবে না। পুজাের সংখ্যার দিক দিয়ে কালী কিন্তু দুর্গাকে হাসতে হাসতে দশ গোল দেবেন। বিভিন্ন জায়গায় কালীর কত বিচিত্র সব নাম, বিচিত্র সব রূপ! অনেক জায়গাতেই কালীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা ধরণের শিহরণ জাগানো কিংবদন্তি।

তন্ত্র অনুসারে, কালী দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত দশজন প্রধান তান্ত্রিক দেবীর প্রথম। শাক্ত মতে, কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। ব্রহ্মযামল নামক তন্ত্রগ্রন্থের মতে, কালী বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কালীর সংহার আর সৃষ্টির কনসেপ্ট অবশ্য আরও একটু পরে আসে। এ অবশ্য নতুন কিছু না। জরাথুস্ট্র তাঁর ধর্মে সাদা ও কালো– সোজা কথায়, সৃষ্টি আর সংহারের দুই দেবতার কথা বলেছিলেন– আহুর মাজদা ও অহ্রিমান। ইহুদীদের ক্ষেত্রে সেটি জিহোবা ও স্যাটান। এই দ্বন্দ্ব গোটা বিশ্বকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কালীর ক্ষেত্রে অবশ্য এই দুই রূপ এক দেহে। অবশ্য তার ভ্যারাইটি আছে। ভদ্রকালী মূলতঃ কল্যাণ করেন, আর চামুন্ডা যেমন ধ্বংস। এর মাঝে আরও ছয় রকম আছে– দক্ষিণা কালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্রীকালী, শ্মশানকালী ও মহাকালী।

আমরা ‘কথামৃত’তে পাই– শ্রীরামকৃষ্ণদেব মা কালী নিয়ে কেশবচন্দ্র সেনকে বলছেন, “তিনি নানা ভাবে লীলা করেছেন।... যখন সৃষ্টি হয় নাই, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, পৃথিবী ছিল না, নিবিড় আঁধার, তখন কেবল মা নিরাকারা মহাকালী... মহাকালের সঙ্গে বিরাজ করছে। শ্যামাকালী অনেকটা কোমল ভাব... বরাভয়দায়িনী। গৃহস্তবাড়িতে তাঁরই পুজো হয়। যখন মহামারী, দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি হয়... রক্ষাকালীর পুজো করতে হয়। শ্মশানকালীর সংহারমূর্তি। শব, শিবা, ডাকিনী, যোগিনী মধ্যে শ্মশানের উপর থাকেন। রুধিরধারা, গলায় মুণ্ডমালা, কটিতে নরহস্তের কোমরবন্ধ। যখন জগৎ নাশ হয়, মহাপ্রলয় হয়, তখন মা সৃষ্টির বীজ কুড়িয়ে রাখেন। গিন্নির কাছে যেমন একটা ন্যাতা-ক্যাতার হাঁড়ি থাকে, আর সেই হাঁড়িতে গিন্নি পাঁচ রকম জিনিস তুলে রাখে।... মা ব্রহ্মময়ী সৃষ্টি-নাশের পর ওইরকম সব বীজ কুড়িয়ে রাখেন।” বীজ ধ্বংস হলেই একটি গাছের জন্ম হয়। ধ্বংসের মধ্যেই আছে সৃষ্টির অনুপম সৌন্দর্য।

তন্ত্র মতে, দেবী কালীর বেশ অপ্রচলিত একটি রূপ শ্রীকালী। গুণ ও কর্ম অনুসারে তন্ত্র দেবীর এই রূপের বর্ণনা করে। বলা হয়, এই শ্রীকালী দারূক নামের অসুরকে বধ করেছিলেন। তন্ত্র আরও জানায়, শিবের শরীরে প্রবেশ করায় তাঁর কণ্ঠে আটকে থাকা বিষের প্রভাবে এই দেবীর সর্বাঙ্গ কালো হয়ে যায়। শিবের মতো এই দেবীও ত্রিশূল ধারণ করে থাকেন এবং তাঁরও অলঙ্কার সাপ। এই শ্রীকালী যেমন অশুভ শক্তির বিনাশ করেন, তেমনই আবার ভক্তদের রক্ষাও করেন বিপদ থেকে। সিদ্ধকালী বা সিদ্ধেশ্বরী কালীর সম্মুখে সাধারণত সাধকরা সাধনা করেন। দেবীর বাম হাতের খড়্গের সমান্তরালে শবরূপে শায়িত শিবের মাথা থাকে। ঠিক এমনটাই দেখতে কলকাতার ঠনঠনিয়ার কালী। জরাসন্ধ পূজিত আদি গুহ্যকালী কেমন দেখতে ছিলেন, তা জানার অসম্ভব কৌতূহল কোনওদিনই মিটবে না। বীরভূমের আকালিপুর যে মাতৃমূর্তি দেখি, তা মধ্যযুগের শেষে নির্মিত মূর্তি। সেই গুহ্যকালী মা সর্পের উপর বিরাজিতা। দেবী দ্বিভুজা, সর্প-উপবিত-ধারিণী। তাঁর মস্তকে সর্পের সহস্র ফনাযুক্ত মুকুট। কলকাতার মুক্তরাম বাবু স্ট্রিটের গুহ্যকালী মার আবার আঠারোটি অস্ত্র শোভিত হাত বর্তমান। অষ্টম থেকে দশম শতকে পালযুগে পূর্ব ভারতে গুহ্যকালী অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন, এই সময় থেকেই তাঁর উপাসনার ইতিহাস লিপিবদ্ধ। গুহ্যকালীর আট হাত, কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে চুয়ান্ন হাতও হতে পারে। এছাড়া নেপালের শিল্পকলা নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে দেখেছি, দশ মুখযুক্ত গুহ্যকালীও হয়। চিত্তাকর্ষক বিষয় হল– তাঁর মুখগুলি পিরামিডের মত উপর থেকে নিচে চারটি স্তরে বিন্যস্ত, অন্যান্য বহু-মুখী পৌরাণিক দৈব চরিত্রের মত সব মুখগুলি একটি রেখায় একই স্তরে পাশাপাশি নেই। গুহ্যকালীর দশটি আননের সবগুলি মানবীয় নয়, পশু পাখিও দ্রষ্টব্য। শুনেছি, এই গুহ্যকালীর সাধনা অতীব কঠিন।

কালী মায়ের মূর্তিতে দক্ষিণপদ আগে প্রসারিত থাকলে অথবা শবরূপী শিবের বুকের ওপরে থাকলে সে মূর্তি দক্ষিণাকালী এবং বামপদ এই ভঙ্গিতে থাকলে সেই মূর্তি বামাকালী বলে খ্যাত হয়। মায়ের দক্ষিণপদ সম্মুখে থাকলে বলা হয় দক্ষিণদিকের অধিপতি যম মায়ের ভয়ে পালিয়ে যান, অর্থাৎ মা তাঁর সন্তানদের মৃত্যুভয় নিবারণ করেন। দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর বিগ্রহটিকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। জনমানসে এই কালী মূর্তির বিপুল গ্রহণযোগ্যতা। বামদিকে পা সম্মুখে সম্প্রসারিত থাকলে মা সমস্ত বাম/বিপরীত/বিভ্রান্তি নিরসন করেন, বিপরীত দশা থেকে সন্তানদের রক্ষা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সব সিদ্ধেশ্বরী কালীই বামা কালী; কিন্তু সব বামা কালী সিদ্ধেশ্বরী কালী নয়। কিন্তু এর বাইরেও সমগ্র বাংলা জুড়ে বহু রকমের কালী মূর্তির সন্ধান মেলে। সে-সব অতি জাগ্রত ও নিত্যপূজিত।

বৃহৎ তন্ত্রসারঃ প্রণেতা কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মহাশয় দক্ষিণাকালিকার ধ্যানে স্পষ্টতঃ উল্লেখ করেছেন— "মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম্"। কিন্তু সেই রূপ বহুল প্রচারিত নয়। এই দেবী কোথাও "বিদ্যারাজ্ঞী", তো কোথাও "শবশিবা কালী" নামে পরিচিত। নদীয়ায় রয়েছে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র সেবিত জগৎজননী বিদ্যারাজ্ঞীর মূর্তি। রাস-উৎসবে শবশিবা মায়ের যে রূপটি দু-তিনটি সার্বজনীন পুজোয় আমরা দেখতে পাই, তা এঁনার থেকেই অনুপ্রাণিত। এছাড়া এমন সার্বজনীন পুজো শান্তিপুর, দাঁইহাট ও কলকাতার চেতলা অঞ্চলেও আয়োজিত হয়। কৌলসাধক শ্রী শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব আরাধিতা শ্রীশ্রী সর্বমঙ্গলা কালীমাতার মন্দির হাওড়ার বাকসাড়ায় অবস্থিত। নাম সর্বমঙ্গলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি শবশিবা কালী। বেলমুড়ির আনন্দময়ীতলাতেও বিদ্যারাজ্ঞী দেবীর মন্দির আজও বর্তমান।

বিদ্যারাজ্ঞী কালীবিগ্রহের চরণলগ্ন শ্বেতবর্ণ পুরুষমূর্তিটিকে আমরা শবরূপ সদাশিব বলে থাকি। যদ্যপি এই শ্বেতবর্ণ শবরূপসদাশিব শৈব দর্শনের সদাশিব নয়। এনার ধ্যান মন্ত্রও পৃথক। শবরূপসদাশিবের ধ্যান মন্ত্রটি খেয়াল করলে, দেখতে পাই— শুরুতেই বলা হচ্ছে "শুদ্ধস্ফটিকসঙ্কাশং মহাকাল ত্রিলোচনাম"। অর্থাৎ, এই শ্বেতবর্ণ মহাপ্রেত শবরূপশিব শুদ্ধ স্ফটিকের ন্যায় বর্নোজ্জ্বল এবং ইনি ত্রিলোচন মহাকাল। ধ্যানের মধ্য অংশে দেখতে রয়েছে— "কালীপাদ ব্যবস্থিতম"। এর অর্থ, ইনি কালিকার চরণে স্থিত। আবার ঐ ধ্যান মন্ত্রের শেষে দেখা যায়— সেখানে বলা হচ্ছে "দেব্যাবাহনমুত্তমম্"। অর্থাৎ, এই মহাপ্রেত শবরূপী শিব কালীর উত্তম বাহন। এই কারণেই মা কালী শববাহনা, মায়ের বাহন মড়া বা শব।

আবার তন্ত্রে দেখতে পাই বলা হচ্ছে— "সপ্তপ্রেতপর্যাঙ্কে শবহৃচ্ছিবা শ্বেতরূপ মহাকাল হৃদয়াম্বোজনিবাসিনি"। যার অর্থ, সপ্তপ্রেতের উপর শবরূপ এবং শ্বেতরূপ মহাকালের হৃদয়ে শ্রীশ্রী মা দক্ষিণকালী চরণ স্থাপন করে কৃষ্ণ-ধুম্রবর্ণ শ্রীমন্মহাকালভৈরবের সহিত বিপরীত রতিতে স্থিতা থাকেন। অর্থাৎ, একটি বিষয় পরিষ্কার যে এক মহাকালই দ্বিবিধরূপে কালীমূর্তিতে বর্তমান। প্রথম মূর্তিটির মূল মূর্তির রঙ ঘোর ধুম্রবর্ণ। সেটি মায়ের সঙ্গে রতিতে সংযুক্ত এবং অপর মূর্তিতে ঐ মহাকালই নিজেকে শ্বেতবর্ণ যুক্ত সদাশিব বা শবশিব রূপে প্রকাশিত করেছেন কালিকার চরণের তলায় (দেব্যাবাহন রূপে)। মায়ের বাহন এই শবরূপ সদাশিব সাক্ষাৎ মহাকাল ভৈরবেরই একটি স্বরূপ।

মা কালীর পীঠ-পুজোয় পরাশক্তি, পরাপরাশক্তি, অপরাশক্তি ত্রয়ের উর্দ্ধে এই শবরূপ সদাশিব মহাকাল শায়িত। ইনি সত্ত্বগুণের প্রতীক— তাই শুক্লবর্ণ। ইনিই সূর্যস্বরূপ প্রকাশমান— তাই শুদ্ধস্ফটিক সাদৃশ্য। সূর্যও তাই স্ফটিক শিলায় পূজ্য। জগতের আত্মাস্বরূপ বা প্রণব স্বরূপ এই সূর্যের অনন্ত রশ্মি হতে পারে। কিন্তু সকল রশ্মির উৎস শুক্ল বর্ণ বা শুক্লরশ্মি। সূর্য বস্তুত এই শুক্লবর্ণ তেজশক্তি/তেজরশ্মির পুঞ্জিভূত অবস্থা। তাই মধ্যগগন স্থিত সূর্য শুক্লবর্ণ। কিন্তু এই পরমতত্ত্বস্বরূপ শুক্লবর্ণকেও অতিক্রম করে আছেন বর্ণাতীত তত্ত্ব অখণ্ড শুদ্ধাতিশুদ্ধ মহাশক্তি কালী। সমস্ত বর্ণের অতীত বলে এবং খণ্ডাভাসহীন অখণ্ড বলে ইনি ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ। তাই একাক্ষর মন্ত্রের ধ্যানে শুদ্ধস্ফটিক সাদৃশ্য শ্বেতবর্ণ শবরূপী সদাশিবস্বরূপ মহাকালের উপর বর্ণাতীতা কৃষ্ণবর্ণা কালী সরাসরি কখনো বাম কখনো দক্ষিণ চরণ অগ্রে বিন্যস্ত করে দণ্ডায়মান।

নিচ থেকে দেখলে— সূর্যস্বরূপ প্রকাশমান শুক্লবর্ণ শবরূপ সদাশিব মহাকাল যেন এর ভিত্তি। তদুপরি না ঘোর কালো না শুভ্র শুক্ল, তথাপি ঘোর ধূম্রবর্ণ মহাকাল বিরাজিত এবং তার উর্ধে বর্ণাতীতা কৃষ্ণবর্ণা কালী অধিষ্টিতা। উপর থেকে দেখলে— প্রথমে গুনাতীতা-বর্ণাতীতা কালী। তারপর আসে নির্গুণ-ধূম্রবর্ণ মহাকাল এবং তার নিচে আছে শুদ্ধসত্ত্বময় শুক্লবর্ণ শবরূপ সদাশিব মহাদেব (তিনি মহাকালেরই আরেক রূপ)। তিনটি স্তর, তিন ভাবে স্থিত। এই তিন মূর্তি দিয়ে সগুন-নির্গুণাতীতা এবং সকল বর্ণাতীতা ঘোর কৃষ্ণবর্ণা কালীমূর্তি প্রকাশিত। অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা এটাই আজকের কালী মূর্তির আদিরূপ।

হুগলী জেলার খানাকুলের রাধানগর গ্রামের শ্মশান ভূমিতে ত্রিকোণাকৃতি মন্দিরে মা কালী মহাকাল রুপী বিষ্ণু এবং পদ্মযোনি ব্রহ্মার উপর উপবিষ্ট। দেবী রত্নাবলী আনন্দময়ী নামে পরিচিত। দেবীর ভৈরব হলেন ঘণ্টেশ্বর। এখানে শ্রীমৎ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মহাশয় সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন বলে অনেকের বিশ্বাস। এই সিদ্ধপীঠস্থানের মন্দিরে বংশ পরম্পরায় শ্রীমৎ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মহাশয়ের বংশধররাই দেবীর সেবা করে আসছেন। এই মন্দিরটির মাহাত্ম প্রচার করার জন্য সর্ব প্রথম উদ্যোগী হন শ্রী গৌরাঙ্গ আগমবাগীশ মহাশয়। তাঁর দাবী ছিল, এই মন্দিরটি নাকি সতীপীঠ এবং এখানে সাধক রামপ্রসাদ সেন এসেছিলেন। কিন্তু তা বিতর্কিত। তবে কেবলমাত্র শ্রীমৎ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মহাশয়ই নন, এই মন্দিরে শ্রীমৎ শিবরাম আগমবাগীশ মহাশয় এবং শ্রীমৎ শঙ্কররাম আগমবাগীশ মহাশয়ও সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। বর্তমানে এই মন্দিরের পূজকের আসন অলংকৃত করে আছেন শ্রী সমীর কুমার আগমবাগীশ মহাশয়।

হাওড়ার শিবপুর অঞ্চলের ওলাবিবিতলা থেকে একটু এগোলেই দেখা মিলবে হাজার হাত কালী মায়ের মন্দিরের। মন্দিরের উত্তর দেওয়ালে রূপোলী কেশর জুক্ত হলুদ রং এর পা মুড়ে বসা সিংহের ওপর দেবীর বাম পদ। দক্ষিন পদের অবস্থান এক মহাপদ্মের উপরে। দেবীমূর্তি উচ্চতায় বারো ফুটের মতো। মূর্তির বাম হাতে খড়গ এবং ডান হাতে পঞ্চশূল। এখানে দেবীর দুটি হাত বড় ও বাকি প্রতীকী হাতগুলি (৯৯৮ টি) ছোট। সেগুলি মূর্তির পিছনের দেওয়ালে চালচিত্রের মত লাগানো আছে (হাতের সঠিক সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক না করাই ভালো। এটি বিশ্বাসের বিষয়।)। বিগ্রহের গাত্রাবর্ণ সবুজ। দেবীর পরনে শাড়ী। দুই কাঁধে দুই সর্পফনা, মাথায় পঞ্চপুষের মুকুট। তার কিছু ওপরে রাজচ্ছত্র। দেবীর হাতে বলয়, কানে কানপাশা এবং উন্নত নাসিকায় নথ। ত্রিনয়নী প্রতিমার তেজপূর্ণ চোখের দিকে তাকালে ভয় লাগতে পারে। দেবীর লোল জিহ্বা প্রলম্বিত নয়।

এই সব ব্যতিক্রমী বিচিত্র কালী মূর্তি সমূহের সঙ্গে অবশ্যই উল্লেখ্য– কলকাতা, নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগরে শিবের ওপর পদ্মাসনে বসে থাকা মা কালীর ব্যতিক্রমী মূর্তির কথা। নবদ্বীপের পোড়ামাতলায় বসা কালীর নাম ভবতারিণী। কৃষ্ণনগরে সেই বসা-কালী আনন্দময়ী নামে পূজিত। কলকাতায় "বসা-কালী" নামেই তিনি রামদুলাল দে স্ট্রিটে পরিচিত। বারুইপুরের দক্ষিণ রামনগর কালীবাড়িতে রয়েছে এক বৈচিত্রময় নিমকাঠের কালী মূর্তি। স্থানীয় সূত্রধর ৩০০/৩৫০ বছর পূর্বে চতুর্ভূজা এই দেবীমূর্তি নির্মাণ করেন। দেবী মহাকালী বলে পূজিতা। বৈশিষ্ট– দেবীর লোলজিহ্বা নেই, তিনি হাস্যবদনাও নন। কালী পুজোয় পারিবারিক গুহ্যমন্ত্রে মায়ের বিশেষ পুজো অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতার ১৪২, মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে অষ্টাদশভুজা গুহ্যকালীর মূর্তি বর্তমান। তন্ত্রসাধক আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নেপালে এক দুর্গম পাহাড়ের গুহায় পেয়েছিলেন একটি অষ্টাদশভুজা গুহ্যকালী বিগ্রহ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আঠারো হাতের দেবী কালিকার উল্লেখ আছে চণ্ডীতে। গর্ভমন্দিরে পাথরের বেদীর উপর কাঠের সিংহাসনে দেবী বিগ্রহ কুচকুচে কালো তেল চকচকে। নেপাল থেকে আনা সেই ছোট্ট বিগ্রহটিও রাখা আছে সযত্নে। নিত্যপুজোও পেয়ে আসছেন দেবী। দালান-মন্দিরে গুহ্যকালী শায়িত শিবের উপর পদ্মাসনে বসে আছেন হাঁটু মুড়ে। গলায় মুণ্ডমালা। মাথায় রুপোর মুকুট। ত্রিনয়নী দেবী সবসনা। দেবীর আঠারো হাতে রয়েছে অভয়মুদ্রা, ঢাল, তলোয়ার, খড়্গ, কৃপাণ, শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম ইত্যাদি নানান রকমের আয়ুধ।

এই গুহ্যকালীর সূত্র ধরে জানাই, বীরভূম জেলার পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত গ্রাম ভদ্রপুর। এখানেই ছিল রাজা নন্দকুমারের প্রাসাদ। এর সংলগ্ন পশ্চিম দিকের একটি গ্রামের নাম আকালিপুর। তার দক্ষিণপ্রান্তে বাহ্মণী নদীর তীরে আজও বর্তমান ২৪০ বছরের পুরনো এক মন্দির। তা নন্দকুমারের স্মৃতি বিজড়িত। মন্দিরটি আটকোণা, যেটা অষ্টাঙ্গিক যোগের প্রতীক। এই মন্দিরের গর্ভে প্রতিষ্ঠিত কষ্টিপাথরের এক বিরল কালী বিগ্রহ। আমরা জানি, সাধক বা ভক্তের উপাসনা কার্যের নিমিত্ত ব্রহ্মের রূপ দেব-দেবীর মূর্তিতে কল্পিত। এখানে দেবীর অট্টহাসিযুক্ত মুখাবয়ব। তিনি দ্বিভুজা— বর ও অভয় মুদ্রাযুক্ত, নাগ-উপবিতধারিণী, নাগাসনে উপবিষ্টা। তাঁর মস্তকে পাঁচটি স্তরে বিন্যস্ত সহস্রফনা বিশিষ্ট মুকুট; তিনি নাগরূপী কঙ্কন, কাঞ্চী ও নুপুরধারিণী। সাধনার সর্বৎকৃষ্ট গুহ্য তত্ত্ব, এই বিগ্রহে নিহিত। আমাদের দেহের মুলাধারস্থ কুলকুণ্ডলিনী সাধনার দ্বারা জাগ্রত হয়। এর ফলে সাধক সমস্ত মায়া মুক্ত হন। দেবী যে সর্পকুণ্ডলে উপবিষ্টা, সেই সর্পই মুলাধারস্থ কুলকুণ্ডলিনীর প্রতীক। মূলাধার থেকে সুষুম্না কাণ্ড ধরে পরবর্তী স্তর গুলি হচ্ছে, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞাচক্র। এই সব কটি স্তর ভেদ করে সাধনা যখন আজ্ঞাচক্রে পৌঁছোয়, তখনই সিদ্ধিলাভ হয়। তারপরই চেতনার সহস্রদল মুক্ত হয়, যার প্রতীক সহস্র ফনার মুকুট।

এর সঙ্গে অবশ্যই বলতে হবে কৃষ্ণকালী বা কৃষ্ণকালীকার কথা। তিনি হলেন কৃষ্ণ ও কালীর সম্মিলিত রূপ। ইনি শাক্ত ও বৈষ্ণব উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শাক্ত-বৈষ্ণব-দ্বন্দ্ব মেটাতেই হয়তো এই বিগ্রহ পুজোর প্রচলন হয়েছিল। পুরাণনুযায়ী ব্রজে রাধারানি গোপীনী সহ যখন কৃষ্ণের সঙ্গে বিহার করছিলেন, এমন সময় জটিলা ও কুটিলা আয়ান ঘোষকে গিয়ে নালিশ করল। আয়ান যখন রাধাকে হাতে নাতে ধরবে বলে যায়, তখন কৃষ্ণ কালী রূপ ধারণ করেন আর রাধাও নিষ্ঠা ও ভক্তি সহকারে কৃষ্ণকালীর পুজো করতে থাকেন। এই দেখে আয়ান আনন্দে আপ্লুত হয়ে গেল। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল যে আয়ান ছিলেন কালীভক্ত। দেবীর বাৎসরিক পুজো অনুষ্ঠিত হয় মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী বা রটন্তী চতুর্দশী তিথিতে, এছাড়াও যে যে স্থানে তাঁর মন্দির আছে সেখানে নিত্য পুজো হয়। কলকাতার কালীঘাট শ্মশানের কৃষ্ণকালীর মন্দির খুবই প্রসিদ্ধ। কৃষ্ণকালীর ধ্যান মন্ত্র অনুযায়ী, কৃষ্ণকালী চতুর্ভুজা কৃষ্ণবর্ণা চূড়ামুকুট মণ্ডিতা। দক্ষিণহস্তে শঙ্খ ও খর্পর ধারিণী এবং নবযৌবনসম্পন্না। বাম হস্তে খড়্গ ও চক্র ধারণ করে আছেন এবং মুণ্ডমালা বিভূষিতা। গোপিনীদের দ্বারা অর্চিতা এবং নানালঙ্কার ভূষিতা। আয়ানের দ্বারা ভয়ত্রস্ত শ্রী রাধিকার দ্বারা পূজিতা। চতুর্বর্গ প্রদানকারিনী সেই দেবী ব্রহ্মরূপা সনাতনী। দারিদ্র্য শোক নাশকারিনী এবং মোক্ষদায়িনী। তবে বর্তমানে বাঁশী ও খড়্গ সহযোগে কৃষ্ণকালীর রকমারি মূর্তি দেখা যায়— সেখানে কোথাও তাঁর চার-হাত তো কোথাও ছয়-হাত পরিলক্ষিত। কোথাও আবার তিনি শিবের ওপর দণ্ডায়মান।

তন্ত্রসাধনার গাম্ভীর্য থেকে ভক্তিরসের সহজিয়া স্রোতধারায় বা পটচিত্রে অথবা টেরাকোটার মন্দিরের অলঙ্করণে কিম্বা সঙ্গীতের আঙিনায়– সর্বত্র কালী বিরাজ করছেন স্বমহিমায়। কলকাতার খিদিরপুরের বাবুবাজার অঞ্চলে অবস্থিত ভূকৈলাশ রাজবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত পতিতপাবনী দুর্গা মন্দির চত্বরের এক ছোট্ট মন্দিরে দেবী "কালীগঙ্গা" নিত্যপূজিত। মকরবাহিনী গঙ্গার মূর্তি ইতিপূর্বে অনেক দেখেছি। কিন্তু এই মূর্তিতে কালী মকরবাহিনী। দেবীর চার হাত এখানে থাকলেও, জিভ নেই। এর চেয়েও এক বিচিত্র কালীর সন্ধান মিলবে পূর্ববর্ধমানের আমগোড়িয়া গ্রামে। সেখানে রয়েছে সুড়ঙ্গকালীর মন্দির। তবে মন্দির বলতে এটা নেহাতই একটা এক সাদামাটা চালাঘর। তার সামনেটা উন্মুক্ত। সেখানে মূর্তি বলতে কিছু নেই। একটি গম্ভীরা বা সুড়ঙ্গ বর্তমান। গম্ভীরায় জল ঢালার জন্য এমন ভাবে বাঁধ দেওয়া আছে যে, প্রথম নজরে আপনার মনে হবে– এ বুঝি মাটির তৈরি গৌরীপট্ট। দেবীর নিত্যসেবা হয়। সেবায়েত স্থানীয় কামারপাড়ার মুখার্জীরা। বাৎসরিক পুজো হয় দীপান্বিতা অমাবস্যায়। সেদিন ঘড়া ঘড়া গঙ্গাজল ঢালা হয় সুড়ঙ্গতে, ষোড়োশোপচারে দেবীর পুজো হয়। দেবীর উদ্দেশ্যে মাটির ঘোড়া নিবেদন করার প্রথা রয়েছে। ফাল্গুন মাসে দেবীর স্মরণে গ্রাম্য মহিলারা ব্রত করেন। এই সুড়ঙ্গকালীর পুজো হয় দক্ষিণাকালীর ধ্যানমন্ত্রে।

সমগ্র বাংলা জুড়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, বনে-বাদাড়ে, ঝোপে-ঝাড়ে, শ্মশানে-প্রান্তরে কত যে কালী পুজাে হয়ে থাকে– তা গুনে শেষ করা যাবে না। যেমন, প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন একটি নিমগাছকে কালী জ্ঞানে পুজো করে আসছেন কাটোয়া পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। যত দিন যাচ্ছে বাড়ছে দেবীর ভক্তের সংখ্যা। ‘ঝুপো মা’ বা ‘ঝুপো কালী’ নামে পূজিত এই কালীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে। ঝুপো কালীর কোনও মূর্তি নেই। প্রাচীন নিমগাছটিই স্বয়ং কালী। নিমগাছের গোড়ার অংশে তৈরি হয়েছে বেদি। গাছের গুঁড়িটি ফুল মালা দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। মাথার মুকুট থেকে হাতের খড়গ, সবই সাজানো থাকে গাছটিকে ঘিরেই। এই পুজো শুরুর পিছনে এক লোককথা শোনা যায়– বহু বছর আগে এই এলাকা ছিল জঙ্গলে ঘেরা। বসতির চিহ্ন ছিল না সে সময়। দুর্ধর্ষ বর্গি ডাকাত দল সে সময় ঘাঁটি গেড়েছিল এই জঙ্গলে। সারাদিন জঙ্গলে লুকিয়ে থাকত তারা। সন্ধে নামলেই লোকালয়ে হানা দিয়ে যা পেত লুঠ করে আনত। ওই বর্গি দস্যুরাই নিমগাছে কালী পুজো শুরু করে। দস্যুদের রাজত্ব শেষ হওয়ার পর গাছপালার জঙ্গল কেটে ওঠে কংক্রিটের জঙ্গল। তবে দস্যুদের পূজিত নিমগাছটি কাটা পড়েনি। ওই গাছে সারা বছর ধরেই চলে পুজো পাঠ। তবে কালীপুজোর দিন বিশেষ পুজো পাঠের আয়োজন করা হয়। দেবীর কোনও মূর্তি না থাকায় ঝুপো মায়ের বিসর্জন না হলেও প্রাচীন নিমগাছটির বাঁধানো ছবি নিয়ে শোভাযাত্রা বার করা হয় বিসর্জনের সন্ধেবেলায়। ওই দিন দেবী নগর ভ্রমণ করেন।

পৃথিবীতে যত রকমের কালী আছে এবং যে-গুলো কোথাও নেই, সেই সমস্ত কালী মূর্তিকে আপনি যদি এক জায়গায় দেখতে চান– তা হলে আপনাকে যেতেই হবে দক্ষিণ কলকাতার চেতলায়। দীপান্বিতা অমাবস্যা তিথির কালী পুজোর সময় বিভিন্ন ক্লাব-সংগঠন একে অপরকে টক্কর দেওয়ার জন্য শাস্ত্রের নানা রূপের বাইরেও, মনগড়া অজস্র কালী-রূপের আরাধনায় মেতে ওঠে। “ডুব দে রে মন কালী বলে”– কোথাও রাবণ-কালী, কোথাও অগ্নি-কালী, কোথাও আবার নেপালি কালী। চেতলার কিছু জনপ্রিয় কালীপ্রতিমার নাম ও অবস্থান :

১. রাখাল দাস আঢ্যি রোড/চেতলা রোড : বট-কালী, তামারুপো কালী, আকালী, ধ্যানতারা কালী, স্বর্ণকালী, রক্তচামুণ্ডা কালী, রাজবল্লভি কালী, জহুড়া কালী, ষোড়শী কালী, হাজার হাত কালী, কিরিটেশ্বরী কালী, আদি চামুণ্ডা কালী, শ্যামা কালী।
২. শঙ্কর বোস রোড : দশমুণ্ডা কালী, দশমহাবিদ্যা।
৩. গোপালনগর রোড : এলোকেশী কালী।
৪. চেতলা হাট রোড : পঞ্চমুণ্ডা কালী, ছিন্নমস্তা কালী, চন্দ্রঘন্টা কালী, শিবকালী, কালীঘাটের কালী, শ্বেত কালী, নটরাজ কালী, শিব-দুর্গা কালী, ডাকাত কালী, আগমেশ্বেরী কালী, আদ্যা মা, লক্ষ্মী-কালী, কৃষ্ণকালী।
৫. দুর্গাপুর ব্রিজের কাছে চামুণ্ডা কালী, সিংহবাহিনী কালী।

এটুকু জায়গার মধ্যে যত বড় বড় মাপের, নানা রকম রূপের এবং গা ঘেঁষাঘেঁষি করে যতগুলো প্রতিমার পুজো হয়– পৃথিবীর আর কোথাও তা হয় না। শুধু চেতলা ঘুরলেই দেবীর সকল রূপ দর্শন হয়ে যায়। যেন মা দুর্গার চারপাশে ঘুরে গণেশের পৃথিবী দর্শন। প্রতিমার ফিরিস্তি যত বড়, পথ কিন্তু তত বড় নয়। খুব বেশি হলে দু'-আড়াই কিলোমিটার। মনে পড়ে রামপ্রসাদ গেয়েছিলেন– “মা আমায় ঘোরাবি কত, চোখ বাঁধা কলুর বলদের মতো”। চেতলায় মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরতে ঘুরতে কেউ এই রামপ্রসাদী গান গুনগুন করে গেয়ে উঠতেই পারেন। কিন্তু একের পর এক বৈচিত্র্যময় প্রতিমা দর্শন এতটাই রোমাঞ্চকর এবং মধুর যে, পরের প্রতিমাটি দেখার জন্য মন কেবলই ছটফট করে আর প্রতিটি মূর্তিই মনের গভীরে স্মৃতি হয়ে থাকে অনেক অনেক দিন পর্যন্ত।

এর মধ্যে এক দেবীর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন– তিনি মহাক্ষণ কালী। এমন নামকরণের কাণ্ডারী কে? তা অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারিনি। এই দেবী নাকি সৃষ্টির আদিতে সিসৃক্ষার মহাক্ষণে মহাকালকে প্রসব করে, তাঁকে কোলে নিয়ে বসে রয়েছেন। চেতলার এমন সব অজস্র রকমের অভিনবত্বে পরিপূর্ণ কালী মূর্তিগুলোর নিখুঁত শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা বা বিবরণ খুঁজতে গেলে অবশ্যই হতাশ হবেন। কিন্তু তবু মনে করি ভাবনার দিক দিয়ে ও তার চেয়েও বেশী রসসৃষ্টির দিক দিয়ে এমন মূর্তি অনন্য। এমন মূর্তি বা প্রতিমার মধ্যে দেখা যাচ্ছে এক অবলুপ্ত মাতৃকেন্দ্রিক সমাজের ভাবাদর্শের ছোঁয়া। এই সার্বজনীন পুজোগুলোতে দেবীর সঙ্গে মহাদেব প্রায় সর্বত্রই রয়েছেন। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে তিনি নিতান্তই নিষ্ক্রিয়, শক্তির অধীনস্থ ভৈরব। পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা বর্জিত এমন মূর্তি সমগ্র বাংলা তথা ভারতে সে ভাবে দেখাই যায় না, পুজো তো দূরের কথা। সবই যখন কল্পনা, তখন এমনটা হতে বাঁধা কোথায়?

বৈচিত্রময় কালী মূর্তি ব্যতিরেকে সর্বজনগ্রাহ্য রূপটির ব্যাখ্যা করলে– প্রথমেই জানাতে হবে, শ্রী শ্রী চণ্ডীতে আমরা দেখি তিনি রুধিরপ্রিয়া। কালী অসুরদের রক্তপান করেন, সেজন্যও প্রসারিত জিহ্বা। পালযুগে মাতৃমূর্তির পদতলে একটি শব থাকত, যা জড়তার প্রতীক, যা মাতৃকা দলিত করতেন। এই শব পরবর্তীকালে শিব আখ্যা পায়। মায়ের চরণের স্পর্শ পেয়ে শবও শিবত্বে উত্তীর্ণ। মায়ের চার হাতে খড়্গ ও ছিন্ন মুণ্ড, অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রা: মা একদিকের হাতে মুণ্ড ও খড়্গ ধারণ করেন, অন্যদিকে অভয় দেন এবং বর দেন। মা দ্বেষকদের ভয় এবং সন্তানদের অভয় প্রদান করেন। মায়ের চার হাত চতুর্বর্গ প্রদায়িনী। আমাদের যাবতীয় জাগতিক ও সঙ্কীর্ণ আবিলতা ছিন্ন করে মায়ের জ্ঞানখড়্গ। এই খড়্গ আমাদের জীবনযুদ্ধের অস্ত্রও বটে। মায়ের খড়্গ সর্বদা চক্ষু বিশিষ্ট হয়, কারণ তা সত্যদ্রষ্টা। এছাড়া মা বলিপ্রিয়া, মা তাই খড়্গিনী। খড়্গ দিয়েই বলি হয়। মা ত্রিকালেশ্বরী, ভূত বর্তমান ভবিষ্যত এই ত্রিকালের অধিষ্ঠাত্রী; তাঁর তিনটি নয়ন তিন কালের দ্যোতক। কালী আমাদের তন্ত্রাশ্রয়ী বর্ণমালার অধিষ্ঠাত্রী, পঞ্চাশ বর্ণ তাঁর পঞ্চাশ মুণ্ডমেলায় প্রকাশিত। কালী স্বয়ং প্রথম বর্ণ “ক”তে সূচিত হন। তিনি জগদকারণ, তিনিই উৎস, এজন্য প্রথম বর্ণ। কালীর কখনও ক্ষেমঙ্করী। আবার কখনও বা ভয়ঙ্করী। বাড়িতে শুধু ক্ষেমঙ্করীর পুজো চলে। ভয়ঙ্করীর পুজো বাড়ি তো দূরে থাক, মানুষের বসবাস যোগ্য শহরাঞ্চলে বা গ্রামাঞ্চলেও করা চলে না। একমাত্র শ্মশানে এঁদের পুজো হয়। বামাচারীরা (যারা প্রচলিত ডানদিকের পথ না বেছে উল্টো পথ বেছে নিয়েছেন। এক কথায় তন্ত্র সাধনার বামপন্থী লোকজন) প্রথম বাংলায় ছিন্নমস্তা, বগলা ও ধূমাবতীর মত ভয়ঙ্করী রূপের পুজো চালু করলেন। বৌদ্ধ যুগের শেষ দিকে হিন্দু ও বৌদ্ধদের মিলনে বৌদ্ধ ধর্মে তন্ত্র সাধনার প্রবেশ ঘটে। ফলে তাঁদের মধ্যেও তারাদেবী আসেন।

বাংলা জুড়ে যত জনপ্রিয় সার্বজনীন কালী পুজো দেখা যায়, তাতে কালো রঙের কালীরই প্রাধান্য লক্ষণীয়, কিন্তু নীল বর্ণের কালীও যথেষ্ট পরিমাণে আছে। শাস্ত্র ও পুরাণ অনুযায়ী দুটিই যথার্থ। এই দুই রঙের প্রধান কারণ হল- যদিও কালী আদিতে অবশ্যই কালো, কিন্তু আজকের শ্যামা কালীর মধ্যে একজন পৌরাণিক নীলা দেবীর স্মৃতি আছে। নীল কালীর মধ্যে পার্বতী উপস্থিত। বেশিরভাগ পৌরাণিক মতে যাঁর নীলপদ্মের মত বর্ণ (পার্বতী আগে কালী, পরে তপস্যা করে গৌরী)। পৌরাণিক পার্বতী কালীর বর্ণ হিসেবে কালো দুয়েক জায়গায় দেওয়া হলেও, তাঁর বহুল প্রচলিত বর্ণটি নীল। এই নীল কালীর মধ্যে ভদ্রকালীও আছেন, যিনি আগুনের সু-উচ্চ শিখার মত নীল। নীল কালীর মধ্যে নীলাবতী/নীলচণ্ডী আছেন, শশাঙ্ক-যুগে যাঁর সঙ্গে শিবের বিবাহ উৎসব থেকে বঙ্গাব্দের উৎসবের সূচনা হয়। নীল কালীর মধ্যে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের নীল তারা আছেন, নীল সরস্বতীও আছেন।

কিন্তু কৃষ্ণবর্ণের কালী পৌরাণিক যুগের অনেক আগে থেকে বর্তমান। ইনিই সেই হরপ্পা সভ্যতায় পূজিত রাত্রি বা নিশা। বৈদিক আর্যের ইনিই নক্ৎ কৃষ্ণী, ঋগ্বেদে রাত্রি সূক্তে এঁরই স্তব করা হয়েছে। কৃষ্ণী শব্দের আক্ষরিক অর্থ কালো মেয়ে। এঁর উল্লেখ ভারতের ইতিহাসে গত সাড়ে চার হাজার বছর ধরে নথিবদ্ধ। এমনকি পৌরাণিক যুগেও ইনি সমানভাবে আছেন- সতী অগ্নিতে আত্মবিসর্জন করে পুড়ে কালো হয়ে পরজন্মে হিমালয় দুহিতা পার্বতী কালী হয়ে জন্মাচ্ছেন, এ-তথ্য বরাহ পুরাণে উল্লেখ করা হয়েছে। কালো রঙের কালীই সূচনা থেকে আমাদের আদ্যা, নিত্যা, অব্যক্ত পরমা, জগদকারণ প্রকৃতি। কিন্তু নীল বর্ণ সেই আদ্যা শক্তিরই একটি নির্দিষ্ট প্রকাশ। বস্তুত রাত্রির রঙ যেমন কালো, তেমনই নীল। এ দুই বর্ণেই মায়ের মূর্তি নির্মাণ ও পুজো আজ বিরাজমান।

কলকাতার কথায় আসি। অনেকে তো এখনও মনে করেন সেই পৌরাণিক “কালীক্ষেত্র” থেকে কলিকাতা হয়েছে। কাল-কাটা ঘাসের গপ্পোটা আমারও ঠিক জুতসই লাগে না। ষোড়শ শতাব্দীতে নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ স্মার্ত পণ্ডিত তথা নব্যস্মৃতির স্রষ্টা রঘুনন্দন দীপান্বিতা অমাবস্যায় লক্ষ্মী পুজোর বিধান দিলেও, কালী পুজোর উল্লেখ করেননি। ১৭৬৮ সালে রচিত কাশীনাথের কালী সপর্যাসবিধি গ্রন্থে দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালী পুজোর বিধান পাওয়া যায়। ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে, “কাশীনাথ এই গ্রন্থে কালীপূজার পক্ষে যে ভাবে যুক্তিতর্কের অবতারণা করিয়াছেন, তাহা দেখিলেই মনে হয়, কালীপূজা তখনও পর্যন্ত বাঙলা দেশে সুগৃহীত ছিল না।” তবে খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় কালী পুজোর প্রচলনের কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।

নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে কালীপুজোর সংযোগ এক ঐতিহাসিক বিষয়। তিনি ছিলেন কালীভক্ত এবং তাঁর আমলে কার্তিকী অমাবস্যায় শুরু হয়েছিল দীপান্বিতা কালীপুজো। অন্তত এই ব্যাপক আকারে কার্তিকী অমাবস্যায় কালীপুজো তার আগে ছিল না। তার আগে কালীপুজোর কোনও একটি নির্দিষ্ট দিন ছিল না, সারা বছরে বিভিন্ন সময়েই হত। তবে সারা বছর জুড়ে কালীপুজো গোটা বাংলায় আজও হয়। মধ্যযুগ জুড়ে বিশেষ বিশেষ তিথি(মূলত অমাবস্যা)-সহ প্রত্যেক শনিবারই কালীপুজো করার প্রচলন ছিল শাক্তদের মধ্যে। এছাড়া তিথি বার ব্যতিরেকে, যে কোনও কঠিন কাজের আগে মা কালীর পুজো করা হতো। আদিযুগে এই কার্তিকী অমাবস্যায় চামুণ্ডা/চর্চিকা/নৈরাত্মাদি মাতৃকাদের উপাসনা প্রচলিত থাকতে পারে। কিন্তু এখনও স্পষ্ট প্রমাণ মেলেনি। কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে নদীয়ায় দশ সহস্র কালীমূর্তি প্রস্তুত করে উপাসনা করা হয়। কালীপুজোর সামাজিক সমষ্টিগত গ্রহণযোগ্যতা কৃষ্ণচন্দ্রেরই কীর্তি। এই কাজে পরোক্ষভাবে তাঁর পরম সহায়ক হয়েছিলেন প্রখ্যাত কালী-সাধক কবি রামপ্রসাদ।

সোজা কথায় বাংলায় দীপান্বিতা অমাবস্যায় এই কালী পুজো খুব বেশি পুরোনো না। মোটামুটি তা দুর্গা পুজোর মতই পুরোনো। তবে দুর্গা পুজোর আগে কলকাতায় বারোয়ারি কালী পুজো শুরু হয়েছিল। কলেজ স্ট্রীট অঞ্চলের গোপাল মল্লিক লেনে কলকাতার সবচেয়ে পুরোনো যে বারোয়ারি পুজো হয়, তা ১৬৫ বছরের। এই শক্তি আরাধনার সময় বলি নিয়ে নানা ইতিবাচক কথার তুলনায় নেতিবাচক কথাই বেশি মাত্রায় শোনা যায় আজকাল। যাঁরা পুজোয় বলি বিরোধী, অথচ ধার্মিক– তাঁরা বলেন, “মা কি কারোর রক্ত চাইতে পারে?” যত সব ন্যাকা কথা! রক্ত পান করার জন্যই তো কালী মায়ের জন্ম! খুলে দেখুন চণ্ডীতে; চেয়ে দেখুন দুনিয়াটায়– চারদিকে কেমন রক্তস্রোত বয়ে যাচ্ছে অনাদিকাল থেকে ! রক্তবীজ দৈত্য, যার এক ফোঁটা রক্ত থেকে আরও একশোটা দৈত্য জন্ম নেয়। …সেই রক্তবীজকে মারার জন্যেই কালীর আবির্ভাব। তিনি রক্ত পান করতে করতে রক্তবীজের রক্ত নিঃশেষিত করে, তাকে বধ করলেন।

এবার ভুলে যান ধর্ম কথা। আসুন বাস্তবের দুনিয়ায়– চারদিকে শুধু রক্তই রক্ত! এই মুহূর্তে আপনি যখন এটা পড়ছেন, তখনই কত লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের প্রিয়জনকে হারানোর অশ্রুসিক্ত আর্তনাদ করছে শ্মশানচিতার সামনে! এই মুহূর্তে কত লক্ষ লক্ষ কন্যা ভ্রূণ হত্যা হয়ে গেল! কত কীট-পতঙ্গ-পশু সকলের অলক্ষ্যে মেরে ফেলা হল! আপনার রান্নার কড়ায় জ্যান্ত কই মাছ ফুটন্ত তেলে অকল্পনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মৃত্যুভিক্ষা চাইছে! লক্ষ লক্ষ খাসি হালালের নলি কাটা অবস্থায় কাতরাচ্ছে– আপনার প্লেটের সুস্বাদু মাংস হয়ে ওঠার জন্য! ক্ষুদ্র ব্যাক্তি চেতনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারলে দেখতে পাবেন, আতঙ্কবাদী হামলায় নিহত নিরীহ নিরপরাধী আর নিরাপদে আয়ু পূর্ণ হওয়া মৃত্যুপথযাত্রীর মধ্যে কোনও ভেদ নেই। ওই মুহূর্তে পিষে যাওয়া কুকুর ছানা আর আপনার আমার মৃত্যুর কোনও তফাৎ নেই। সে মৃত্যু বলিদানের হাড়িকাঠে হোল, নাকি মানব বোমার বিস্ফোরণে হোল– তাতে ব্রহ্মাণ্ডের কিছু যায় আসে না! প্রকৃতি চলে প্রকৃতির গতিতে। যেমন চন্দ্র সূর্য ওঠে, দিন আসে– দিন যায়; তেমনি মৃত্যুও একটা স্বাভাবিক ঘটনা। তার কোনও হেতু নেই, সময়-অসময় নেই!

আমরাই আমাদের অহংবোধ থেকে আমাদের অস্তিত্বের ওপর অনর্থক গুরুত্ব আরোপ করতে ভালবাসি। আর যেহেতু আমাদের নিজ নিজ অস্তিত্ব আমাদের কাছে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের অপছন্দের মৃত্যুগুলোকেও আমরা মনে মনে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলি! এই সমস্ত মৃত্যুর তপ্ত শোণিতধার এসেই তো মেশে কালী মায়ের হস্তস্থিত খড়গে। তিনি যে মৃত্যুরূপ। আর আপনি বলছেন, “মা কি রক্ত চাইতে পারেন?” হাসালেন যে! আপনার চারদিকেই রক্তস্রোত, শুধু আপনিই তা দেখতে পাচ্ছেন না! পোকা মাকড়ের রক্ত হয় না। চিংড়ির রক্ত নীল। কিন্তু টকটকে লাল রক্তও আমাদের চোখে পড়ে না যতক্ষণ না সেটা আমাদের আপনজনের হয়! সংসার ব্যাপী মৃত্যু ঝঙ্কারের এই অভূতপূর্ব অনুরণনটিই তো মা কালী!

তাহলে মায়ের স্নেহ কোথায়? মা যদি শুধুই মৃত্যুময়ী বিভীষিকা হন, তাহলে তার মাতৃত্ব কই? উত্তরে জানাই, চেয়ে দেখুন মৃত্যুর পরের জগতটাকে– অগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ থেমে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে এই বিশ্বের বিপুল সংখ্যক বৃক্ষ-লতা-গুল্ম। এখন চরাচরের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে শুধুই ধুসর ছাইয়ের আস্তরন। কিন্তু তারই মধ্যে অঙ্কুরোদগম হয়েছে এক ক্ষুদ্র চারা গাছের। নতুন জন্ম, নতুন আশা। কিছুই থেমে থাকে না! পাড়ার অমুক কাকু মারা গেলেন। কিন্তু তার সাধের দোকানটা আজও খোলে। তার ছেলেরা চালায়। আপনি প্রিয়জন বিয়োগে শোকস্তব্ধ, কিন্তু ভোরের সূর্য আজও উঠেছে। প্রভাত পাখিরা আজও ডাকছে। শ্মশানযাত্রীরা ফিরে এসে যে যার বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। মৃতের নিকট আত্মীয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বেদনা-বিলাসের ছেদ টেনে স্নান ঘরে ঢুকেছে নতুন দিনের আহ্বানে! এই যে জীবনের জয়গান, এটাও কিন্তু সর্বত্র।

কালী ডাকাত দ্বারা পূজিত, সমাজ-বিরোধী দ্বারাও পূজিত; এমনকি বর্তমানে অনেক অসৎ নেতা-নেত্রীদের বাড়িতেও পূজিত। এ সব দেখে, শুনে অনেকে হতাশ হয়; ক্ষিপ্ত ও বিরক্ত বোধ করে। এর সুযোগ নিয়ে বহু পণ্ডিত, বিশেষ করে প্রতীচ্যের ভারততত্ত্ববিদরা কালীকে অন্ধকার, মৃত্যু ও ধ্বংসের দেবী বলে ভাবেন ও চিহ্নিত করেন। এমন তত্ত্বকথা পড়ে, অনেকে নিশ্চিতরূপে এ-সব বিশ্বাসও করে। এর পক্ষাবলম্বন করে তৈরি হয় বিতর্কিত চলচ্চিত্র, আঁকা হয় ছবি। এমনকি ইচ্ছাকৃত ভাবে বিভ্রান্তিকর নব্য fashion statement নির্মাণ করা হয়। তাই বলে এই মায়াময় পৃথিবীতে কালী কি শুধুই নেতিবাচক, সে কি প্রাণময় নয়? আমার উত্তর– এটাই তো মাতৃভাব। নতুনের লালন, শরণাগতের পালন। কালীতত্ত্ব এত সরল ও একরৈখিক নয়। ইংরেজিতে বলে “Time is the best healer”– কি অদ্ভুত গভীর ভাবনা। সেই সময় বা কাল-কে অনুভক করার জন্যে চাই নিবিড় মননশীলতা।


কাল-এর স্ত্রীলিঙ্গ কালী। কাল বলতে বোঝায় সময়। অর্থাৎ অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতকে যিনি কলন করেন তিনি মহাকাল। আর সেই মহাকালের নিয়ন্ত্রক যিনি, তিনিই মহাকালী। কালের গ্রাসকে ভুলিয়ে দিতে কালী নিজেই সদা-সর্বদা দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের শিয়রে! অত্যন্ত স্নেহ ভরে, তার রোষকষায়িত রক্তচক্ষু লুকিয়ে। সাধক কমলাকান্ত ভট্টচার্যের গানে তাই পাই, “সদানন্দময়ী কালী মহাকালের মনমোহিণী, আপনি নাচ আপনি গাও মা আপনি দাও মা করতালি।” এই গানেই আর একটু এগিয়ে কমলাকান্ত বলেন, “আদিভূতা সনাতনী শূণ্যরূপা শশীভালী, ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুন্ডুমালা কোথা পেলি?” এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই দেখা যায়, আসলে কালী অনন্তের প্রতীক। ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আগে মুণ্ডমালা পাওয়ার তাই প্রশ্ন উঠছে না। এ আসলে মানুষের অহং ছিন্ন করার প্রতীক। তাঁর এক হাতে তাই খড়্গ। সেই খড়্গের আঁকা চোখ প্রজ্ঞার প্রতীক। এখন থেকে নিজের অন্তরের প্রজ্ঞা দ্বারা অহং ছিন্ন করার বার্তা মেলে। তাই তিনি আমাদের এত আদরের, এত আপন। তিনি সর্বোচ্চ উপাস্য।

এই আদিশক্তি বা আদ্যাশক্তি সময়ের থেকেও উচ্চতর। কাল থেকে কালীর উৎপত্তি ধরলে– তা আসলে সময়ের সীমানা পেরনো এক ধারণা। সেই অনন্তকে কোনও জাগতিক বস্ত্রের আবরণে আবৃত করা যায় না। দেবী তাই নগ্নিকা। আবার কোনও কোনও মতে বলা হয় কালী শক্তির প্রতীক, শক্তিকে কোনও বসন বা আচ্ছাদনে আবদ্ধ করা যায় না। তাই নগ্নিকা হিসেবেই কালীর ধারণা গড়ে উঠেছিল। তবে আমাদের রক্ষণশীল সমাজ তা বদলে দিয়ে– দেবীকে বসন, গয়না পড়িয়েই ক্ষান্ত হয় নি; আজকাল ঘোমটা দেওয়া কালীও বেশ জনপ্রিয় করে তোলা হচ্ছে। অন্তরের উপলব্ধি সঠিক না হলে, এমনটা তো হবেই। কালী মাকে রূপে স্নেহময়ী জননী করে তুলতে গিয়ে, এর অন্তর্নিহিত তত্ত্বকে আজ গুরুত্বহীন করে দেওয়া হয়েছে।

আমাদের শরীরগত প্রাণশক্তিতে পাঁচটি ইন্দ্রিয় রয়েছে– চোখ, কান, নাক, জিভ ও ত্বক। পঞ্চেন্দ্রিয়কেই কালী কলন করছেন। এক্ষেত্রে কলন মানে গ্রাস করে ফেলা– “কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীর্তিতঃ।” আবার, কলন শব্দটির আরেকটি মানে স্পন্দিত হওয়া। নিজের স্বরূপচ্যুত হওয়াও কলন। মহাকাল শিব যখন খুব ছটফট করতে থাকেন, তিনি যখন সচঞ্চল ও স্পন্দিত হন, মা কালী তাঁকে কলন করেন। একেবারে গ্রাসই করে ফেলে শক্তিরূপে প্রকাশিতা হচ্ছেন। আমরা কান চাপা রাখলে, শুনতে পাই না; চোখ বুজলে, দেখতে পাই না। আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের শক্তিসমূহকে অনাবৃত রাখতে হয়। যে কোনো আবরণ যাবতীয় প্রকাশকে নষ্ট করে দেয়। এই জন্যই কালীকে বিবসনা রূপে কল্পনা করা হয়েছে।

তন্ত্র সাধকরা পাশমুক্তির কথা বলেন। পাশ হল সাধকের বন্ধন। পাশ হল বস্ত্র। আমার স্থূল শরীর আবৃত করার বস্ত্রাদি কিন্তু পাশ নয়। পাশ হল সূক্ষ্ম শরীরের কাপড়। ছয়টি রিপু দ্বারা আমরা সংসার জীবনে আচ্ছন্ন হয়ে থাকি। আমরা সবসময় নাম-যশ-অর্থ-খ্যাতি-প্রতিপত্তি নিয়ে মত্ত, কামনায় মত্ত। আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গভীরে প্রবেশ করা সূক্ষ্ম অনুভূতির মধ্যেই এ-সব রয়েছে। এই সূক্ষ্মভাবে অবস্থিত প্রবৃত্তিগুলিই পাশ। জগৎ গুণের অধীন। তা পাশ দিয়েই আবদ্ধ বা বস্ত্রাবৃত। কালীর কোনো পাশ নেই, তাই তিনি বিবসনা। দিগম্বরী। মায়ের এই রূপের পুজোর ভেতর গভীর আধ্যাত্মিক ভাবটি হল, আমাদের অন্তরাত্মাকে আবৃত রাখলে চলবে না। মানুষের মনের কোনো নির্দিষ্ট অবয়ব নেই। মন ঠিক কোন রঙের– তাও বলা যায় না। যখন যে প্রবৃত্তি সেখানে জাগে, সেই নির্দিষ্ট স্বভাব ও রঙের মাতামাতি শুরু হয় মনে। মন এক স্বাধীন বিচরণভূমি। তাই দিগম্বরী কালীর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির স্বার্থে কাপড়, মুকুট, অলংকার ইত্যাদি পড়িয়ে সংসার বন্ধনে আবদ্ধ ও মোহান্ধ জনগণকে সঠিক উপলব্ধির হাত থেকে বঞ্চিত করে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। বর্তমানে কালী হয়ে উঠেছেন চলচ্চিত্র বা television serial-এর makeup করা স্নেহময়ী জননীর সমতুল্য। তা বিরক্তিকর ও দুঃখজনক। স্নেহময়ী জননীর অভিব্যক্তিই মাতৃত্বের একমাত্র প্রকাশ নয়। তা অনুভবের প্রয়োজন রয়েছে।

আমরা কালী মাকে যে ভাবেই দেখার চেষ্টা করি না কেন, তাঁর যতটা কট্টর সমালোচনাই করতে চাই না কেন— শেষে গিয়ে মনে হয় যে, আমরা যতটা ধর্মহীন বা ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে গেছি বলে ভাবি নিজেদের— বোধহয় আমরা সত্যি ততটা ধর্মহীন ইহজীবনে হয়ে উঠতে পারি না। ধর্মের ঊর্ধ্বে ওঠাও কি সম্ভব! আমরা উদার হতে পারি, সেকুলার হতে পারি, পরধর্মসহিষ্ণু হতে পারি— কিন্তু গোপনে বা অবচেতনে আমাদের নিজেদের ধর্মের প্রতি বোধহয় আমাদের একটা মালিকানা থেকে যায়। আমাদের চিন্তাশক্তির ঊর্ধ্বে যে অনাদি অনন্ত মহাশক্তি সদাপ্রবহমানা, সৃষ্টির আদি মুহূর্ত থেকে যে জগন্মহিনী যোগমায়া নিরন্তর সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের মায়াজালে জগৎ সংসারকে অবোধ বালকের মতন ভুলিয়ে, হৃদপদ্মাসনে বিরাজ করেন— তিনিই কালী। সহজ মনে চললে, কালী পুজোয় কোনো আলাদা মন্ত্র লাগে না। পাঁচ অক্ষরের জয়ধ্বনি, “জয় মা কালী” বলাই যথেষ্ট। মায়ের পুজোয় মূর্তি, মন্ত্রপাঠ, উপাচার, বলি– এগুলো করতে চাইলে, করাই যায়। না হলে আমাদের ভেতরের শ্রদ্ধাটাই যথেষ্ট। কালী চ জগতাং মাতা সর্বশাস্ত্রেষু নিশ্চিতঃ... কৈবল্যদায়িনী মায়ের পুজো নিজের কর্মের মাধ্যমে আমরা অবিরত করে যেতে পারি। আর কিছু নয়, অন্তরের বিশ্বাসটুকুই আসল। জীবনের প্রত্যেকটা দিন হোক মা কালীর জন্যে উৎসর্গীকৃত। জয় মা কালী... জয় মা কালী... জ্ঞানের আলো দাও মা জ্বালি!


তথ্যসূত্রঃ
১.) ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্য, শশিভূষণ দাশগুপ্ত, সাহিত্য সংসদ।
২.) শ্রী শ্রী কালীপূজা, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ।
৩.) দেবদেবীতত্ত্ব, সতীশচন্দ্র শীল, শ্রীভারতী পাবলিশিং কোং।
৪.) মাতৃকাশক্তি, অশােক রায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
৫.) ধন্য কলকেতা সহর, কৌশিক মজুমদার, আখরকথা।
৬.) সৃষ্টির বীজ কুড়িয়ে রাখেন মা কালী, সোমব্রত সরকার, সাপ্তাহিক বর্তমান, ২২ অক্টোবর'২০২২।


বিঃ দ্রঃ - যে সমস্ত কালী মন্দির ও সার্বজনীন পুজোর উল্লেখ লেখাতে রয়েছে, সে-সব তথ্যাদি ক্ষেত্রসমীক্ষা করে প্রাপ্ত।

‘কালীগঙ্গা’ : কলকাতার খিদিরপুরের বাবুবাজার অঞ্চলে অবস্থিত ভূকৈলাশ রাজবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত পতিতপাবনী দুর্গা মন্দির চত্বরের এক ছোট্ট মন্দিরে এই দেবী নিত্যপূজিত।


কালীঘাটের কেওড়াতলা মহাশ্মশানের কৃষ্ণকালী।


কলকাতার রামদুলাল সরকার স্ট্রিটের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের মন্দিরে ‘বসা কালী’র এক দুর্লভ বিগ্রহ।


ঝুপো কালী, কাটোয়া।


অষ্টাদশভুজা গুহ্যকালী, মুক্তারামবাবু স্ট্রিট, কলকাতা।


Title : She and her pathfinders.
Medium : Mixed media. 
Size : 28.5c.m.×19.5c.m.


Title : The mother of death.
Medium : Mixed media.
Size : 13c.m.×17c.m.


कलकत्ते वाली।
कोलाज। १४ इंच × १२.५ इंच।


মহাক্ষণ কালী, চেতলা, কলকাতা।


বীরভূম জেলার ঘুরিষা অঞ্চলে অবস্থিত টেরাকোটার রঘুনাথ মন্দির-গোত্রের দেবী চামুণ্ডার রিলিফ ভাস্কর্য।

সুড়ঙ্গকালী, আমগোড়িয়া গ্রাম, পূর্ববর্ধমান।

0 comments:

1

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in





আমরা স্বপ্ন ভালোবাসি। স্বপ্ন আমাদের জাগতিক কঠিন সীমানাগুলোকে ভেঙে দেয়। যেন জলের মতো বাতাসের মতো তার গতি। অনায়াসে সে আমাদের নিয়ে যায় কালাতীত মহাক্ষণে। পরিচয় ঘটিয়ে দেয় মহতের সঙ্গে। কঠিন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে যে মহতের সঙ্গে পরিচয় হলে আমরা তাঁকে অনুধাবন করতে পারতাম না। কারণ সচেতন মনের প্রয়াস সেই অনুধাবনকে ক্রমাগত বাধা দেয়। সূর্য যেমন অনেক দূরে বলে আমরা তাকে ধারণা করতে পারি, কাছে আসলে ধরতে পারতাম না, ঠিক তেমনই মহামানবের পদসঞ্চার ওই দূরে বলে, স্বপ্নময় বলে আমরা তাঁকে একান্ত করে আন্তরিক করে পাই। সমকালের বাস্তবে আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান তাঁকে ধরতে দিত না।

ভারতবর্ষ এমনই এক মহামানবের জন্ম ও কর্মভূমি বলে আমাদের চেতনায় সেই চিহ্ন আজও বর্তমান। যতই হানাহানি, ক্ষুদ্রতা আমাদের গ্রাস করুক, কখনও কখনও সব ছাপিয়ে আমরা যেন শুনতে পাই—সব্ব জীবে সুখিতা ভবন্তু। জগতের সমস্ত প্রাণ সুখী হোক। দুঃখ যতই অনপনেয় হোক, তাকে জয় করা লক্ষ হোক।

একটি স্বপ্নই সেই মহামানবের মহৎ অস্তিত্বের আরম্ভ বলে মনে করি। এক পূর্ণিমায় নিজের শুভ্র শয্যায় শুয়ে আছেন মায়াদেবী। কোশল রাজ্যের উত্তরে এক ক্ষুদ্র ভূখণ্ড কপিলাবাস্তুর মহিষী। উন্মুক্ত জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে তাঁর শয্যায়। তিনি সবে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন। মনে একটি আনন্দের স্রোত সর্বদা অনুভব করেন। হঠাৎ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। স্বপ্নে দেখলেন চাঁদের আলোর পথ বেয়ে একটি শ্বেতশুভ্র হাতি হেলেদুলে এসে তাঁর উদরে প্রবেশ করল। তিনি তখনই জেগে উঠলেন। দেখলেন, স্বপ্নের প্রভাবে তিনি যেন একটি আনন্দধারায় আপ্লুত হচ্ছেন।

যথা সময়ে রাজদৈবজ্ঞ জানালেন, রানি একটি অসামান্য মানবের জন্ম দান করতে চলেছেন। শ্বেতশুভ্র বর্ণ অকলঙ্ক সৎ ও মহৎ এর প্রতীক। হাতি মন। এমন সুন্দর মনের এক মহামানব আসতে চলেছেন যে রাজার তা সৌভাগ্যের কারণ হবে।

স্বপ্ন সত্যি হল। রাজার ঘরে জন্মালেন যে রাজপুত্র তিনি জগতের মানুষের মনের রাজা হলেন।

আমরা সকলেই জেনেছি যে, রাজপুত্র সিদ্ধার্থ তাঁর যৌবনে তিনটি দুঃখময় দৃশ্য দেখে সংসার ছাড়েন। কিন্তু সত্যিই কি এমন সমাহিত শান্ত স্বভাবের যুবকের পক্ষে এমন ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব?

কপিলাবাস্তু ছিল কোশলের অধীনরাজ্য। যে রাজ্যের উত্তর সীমান্তে একটি ক্ষুদ্র পার্বত্য স্রোতস্বিনী, রোহিণী। এই রোহিণীর উত্তরে কোলীয় রাজ্য। কপিলাবাস্তুর শাক্য জাতি ও এই কোলীয় জাতি বিবাহসূত্রে বহুকাল পরস্পরের আত্মীয়। আত্মীয়দের মধ্যে যে স্বাভাবিক সৌহার্দ্য থাকার কথা তাও নিশ্চয় তাদের মধ্যে ছিল। কিন্তু মাঝে মাঝেই যুদ্ধ লেগে যেত রোহিণীর জল নিয়ে। কখনও কখনও সে যুদ্ধের ফলে রক্তপাতও ঘটত। ওদিকে শুদ্ধোদন তো জ্যোতিষীর গণনায় পূর্ণ আস্থা রাখেন। কুমার সিদ্ধার্থ হয় একজন সম্রাট হবেন নয়ত একজন সর্বজনমান্য সংসারত্যাগী মহাপুরুষ হবেন। এই সংসার ত্যাগ ঠেকাতে তাই রাজপ্রাসাদ ঘিরে নানা রম্য আয়োজন। এমনিই হিমালয়ের পাদদেশের সুন্দর প্রকৃতি, তারপরে রাজার নানান প্রচেষ্টা। যথা সময়ে যশোধরার সঙ্গে পরিণয়ও হল। সুখী রাজপুত্র। যেন রূপকথার গল্পের মতো। কিন্তু তাই কি? শুদ্ধোদন যে তাঁকে মাঝে মাঝেই শাক্য ও কোলীয় গোষ্ঠীর এই জল নিয়ে বিবাদ মেটাতে পাঠাতেন। সিদ্ধার্থও অতি সহজে তাদের শান্ত করতেন। মনে কিন্তু বেদনা রয়ে যেত। মানুষ কেন মানুষের সঙ্গে বিবাদ করে? কেন এই বিদ্বেষ? কেন রক্তপাত?

এক একবার তাঁর মধ্যস্থতায় কাজ হতো না। সিদ্ধার্থ কি তাহলে প্রাসাদসুখের মধ্যে থেকেও সেই কষ্টের কথা স্মরণ করতেন না? তা কখনোই সম্ভব নয়। স্মরণ হতো তাঁর। নর্তকীদের নৃত্যগীত তাঁকে সম্পূর্ণভাবে ভুলিয়ে রাখতে পারেনি নিশ্চয়। নগর পরিদর্শনে বেরোবেন ভাবী রাজা। একেবারেই শিক্ষণীয় কর্তব্য। প্রজাদের জানতে হবে। কাছে পৌঁছতে হবে। সিদ্ধার্থ তাই নগর পরিদর্শনে যেতেন। সারথি তাঁকে সুন্দর মনোহর রাজপথ দিয়ে ভ্রমণে নিয়ে যেত। তিনিও তাইই দেখতে দেখতে ভ্রমণ করতেন। কিন্তু এমন হৃদয় নিয়ে যার জন্ম তিনি কি আর দরিদ্রপল্লীর গলিতে একবারও প্রবেশ করবেন না? নিশ্চয় করবেন। নিশ্চয় বলবেন—মানবের মাঝে আমাকে নিয়ে চলো সারথি। আমি বিশ্বের সমস্ত মানবকে হৃদয়ে ধারণ করতে চাই। এই প্রাত্যহিক নগর পরিদর্শনে তিনি কখনও জরাগ্রস্ত বৃদ্ধকে দেখে থাকবেন। কিন্তু রাজপুরীতে কি বৃদ্ধ কেউ ছিলেন না? অবশ্যই ছিলেন। তবে তাঁদের পরিচর্যার জন্য পরিচারক ছিল। তাঁরা কখনও অসহায় অবস্থায় রাজপথের একধারে পড়ে থাকতেন না। তাঁর মনে সেই অসহায় বৃদ্ধের ছবি ফিরে ফিরে আসত। কখনও ব্যাধিজরজর কোনো মানুষকে বিনা চিকিৎসায় পথের ধারে দেখেছেন। রোগের জ্বালায় সে হয়ত বিকট চিৎকার করছে। তাকে দেখার কেউ নেই। তাহলে রাজপুরীতে কি কারোর অসুখ হতো না? নিশ্চয় হতো। অসুস্থ মানুষকে পুরীর চিকিৎসালয়ে রেখে যথাযথ চিকিৎসা করা হতো। সাধারণ মানুষের মতো তাঁদের কষ্ট পেতে হতো না। মৃত্যুও এমন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ এক কষ্টকল্পনা যে সিদ্ধার্থ যৌবনের আগে কখনও মৃত্যু কী তা জানেননি। বিশেষত, প্রায় জন্মমুহূর্তেই যিনি মাতৃহীন হয়েছেন। অতএব একথাই মনে হওয়া স্বাভাবিক, যে অসহায় মানুষের জীবন যন্ত্রণা তাঁকে কষ্ট দিয়েছে। রোহিণীর জল নিয়ে বিবাদ তাঁকে বেদনা দিয়েছে, হতাশ করেছে। মানুষের এত দুঃখ কেন? তবে কি এই জীবন শুধু দুঃখেই ভরা? নাকি এই জন্মই দুঃখের কারণ?

ক্রমে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। জীবন জিজ্ঞাসা তাঁকে অতিষ্ঠ করে তুলল। তিনি রাজপুত্র। তাঁর তো শুধু নিজের কথা ভাবার কথাও নয়! সর্বজনের দুঃখের মুক্তির কথাই তো তিনি ভাববেন! তখন সবে রাহুল জন্মেছেন। সদ্যজাত পুত্রকে পাশে নিয়ে যশোধরা ঘুমিয়ে আছেন। সিদ্ধার্থ সেই নিশীথ রাতের অন্ধকারে পুরী ত্যাগ করলেন। সম্ভবত সেদিন পূর্ণিমা রাত ছিল না।

রাজপরিবারের অন্তঃপুরে স্ত্রী পুত্র সুখে থাকবেন, কিন্তু জগতের মানুষের যে তাঁকে প্রয়োজন!

একটু দেখে নেওয়া যাক সেসময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি। উত্তরপূর্ব ভারত ও পূর্ব ভারত। চিরকাল যা বৈদিক ধর্মের প্রভাবমুক্ত ছিল। মুক্তচিন্তার ধারক ছিল এই ভূমি। অসংখ্য মেধাবী বিদ্বান মানুষের দর্শন এখানে প্রচলিত ছিল। সেই সব দর্শনে নাস্তিক্যবাদও প্রবলভাবে ছিল। সামাজিক ভাবে জাতিপ্রথা বর্ণাশ্রম সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠী বণিকদের সম্পদে পুষ্ট মহাজনপদগুলিতে ক্ষত্রিয় রাজা শ্রেষ্ঠীদের মান্যতা দিতে রাজী নন। তাঁরা ধনী হলেও তাঁরা সামাজিক মর্যাদায় নীচে। এদিকে সম্পন্ন রাজ্যের যা চিহ্ন, সেই ব্যভিচার, দুর্নীতি, অকারণ যুদ্ধ, ইত্যাদিতে ভারতবর্ষ যেন দীর্ণ। এমন সময় তথাগত এলেন। মানুষের আত্যন্তিক দুঃখের নিবৃত্তিই যার লক্ষ। ধনী নির্ধন, রাজা প্রজা নির্বিশেষে, মানুষের চেতনার মুক্তিই লক্ষ।

সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করে প্রথম যে গুরুর কাছে যান তিনি অরাঢ় কলাম। দুঃখমুক্তির উপায় হিসেবে গুরু তাঁকে ধ্যানের উপদেশ দেন। ক্রমে সিদ্ধার্থ দেখলেন গুরুর নির্দেশিত পথে তিনি শুধু লিঙ্গ শরীরের অস্তিত্ব থেকে উর্দ্ধে উঠছেন। সম্পূর্ণভাবে তাঁর অহং বিলুপ্ত হচ্ছেনা। ফলে,সুখ দুঃখের অনুভূতি তাঁর বিলুপ্ত হচ্ছে না। তিনি শান্তি পেলেন না। গুরু জানালেন, এর চেয়ে বেশি তাঁর আর কিছু দেওয়ার নেই। সিদ্ধার্থ বেড়িয়ে পড়লেন। এলেন সঞ্জয় বেলুঠিপুত্রের কাছে। আর একটু অগ্রসর হয়ে তিনি মনোময় শরীর থেকে মুক্ত হতে পারলেন। কিন্তু নির্বিকল্প এক সর্বব্যাপী আনন্দময় অস্তিত্ব তখনও অধরা। এবার তিনি একাই অগ্রসর হলেন। নৈরঞ্জনার তীরে তিনি কঠোর তপস্যায় রত হলেন। ইহৈব শুষ্যতু মে শরীরম। মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন। বৌদ্ধ শাস্ত্রে এই পর্যায়ের কথা বিশদে আছে। কিন্তু বুদ্ধের সময়ে সেসব লিপিবদ্ধ হয়নি। হয়েছে তাঁর মৃত্যুর বহু পরে। ফলে সেসব যে নিশ্চিত সত্য তা স্বীকার করতে মন সায় দেয় না। ঠিক কী তাঁর সাধন হয়েছিল, কেমন করে যুবক সিদ্ধার্থের রিপুগুলি পুনরায় তাঁকে ভীত করে তুলেছিল, এবং তিনি তা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, সেসব নিশ্চিত জানার উপায় নেই। তবে এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। মৃদুলক্ষণা জাতকের অংশ এটি। কাহিনী থাক, ঘটনা বলি। তথাগত তখন জেতবনে। শ্রাবস্তীর এক কুলপুত্র সংঘে প্রবেশ করেছেন। তিনি সংঘের নিয়ম অনুযায়ী ভিক্ষা করতে যান। একদিন একটি সুন্দরী রমণী তাঁকে ভিক্ষা দিতে এলে ভিক্ষু তাকে দেখে আকৃষ্ট হন। একমনে তাকে দেখতে থাকেন। ক্রমে অনুভব করেন যে তিনি কামের বশে এভাবে নারীটিকে দেখছেন। তিনি তখনই ফিরে আসেন এবং নিজের কুটীরে এসে শুয়ে থাকেন। তাঁর শরীরে তাঁর মনের সেই দাহ একটি কালিমা লেপে দিয়েছিল। বিহারের বাকি সাঙ্ঘিকরা তাঁকে দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করলে তিনি সত্যকথা বলেন। অতঃপর সকলে তাঁকে তথাগতর কাছে নিয়ে গিয়ে কথাটি ব্যক্ত করেন। আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখি, তথাগত তাঁকে বলেন, অর্হত্ত্ব অর্জনের পরও এমন হতে পারে। যে ধ্যানসিদ্ধ যোগী সেও এমন রিপুর দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। এতে লজ্জার কারণ নেই। ঘটনাটি পড়ে অবাক হয়ে ভেবেছি, মানুষের মন, তার অসহায়তা, তার অনুতাপ, এসবই তাঁকে কী অদ্ভুতভাবে স্পর্শ করত! তিনি তো ভিক্ষুর স্বভাবে দোষারোপ করেননি? বরং জানালেন, অতি বড় সিদ্ধপুরুষও রিপুতে আক্রান্ত হতে পারে। ও হল দেহের স্বভাব। ও থেকে উঠতে হবে, আর কিছুই না। অর্থাৎ, সিদ্ধার্থ নিজেও সাধনাকালে রিপুর এই আক্রমণ অনুভব করছেন। যুদ্ধ করেছেন অতিক্রম করতে। এ যে মানুষের ধর্ম!

ভারতবর্ষে বুদ্ধের আবির্ভাব একটি চিরস্মরণীয় ঐতিহাসিক সত্য। আমরা জানি, বেদ বলছেন, মানুষের উত্তরণের পথ আত্মিকে। ব্যবহারিক জীবনের নীতিপরায়ণতার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষটা যদি অন্তরে অন্তরে বিবর্তিত হতে থাকে, তার বোধ যদি ক্রমে জাগতিক থেকে আন্তরিক, এবং আত্মিকে উত্তীর্ণ হয়, তবে ব্যবহারিক জগত তার কাছে মিথ্যা। অনিত্য। নিত্যশুদ্ধবোধরূপ আত্মার সংসর্গে সে তখন উত্তম পুরুষে উন্নীত। তাই, শীলসাধনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু বুদ্ধের কাল এক অন্ধকার যুগ। তাঁর সিদ্ধি তাঁকে এক অনন্য অন্তর্দৃষ্টি দিলো। তিনি অনুভব করলেন, মানুষ যদি ব্যবহারিক জীবনে সৎ না হয়, চরিত্রে যদি উন্নত না হয় তবে সিদ্ধি তার অধরা রয়ে যাবে। যে চরিত্রে অসৎ, দুঃশীল, হত্যাকারী, অত্যাচারী, তার স্বভাবের পরিবর্তন না ঘটলে সে কখনোই আত্মিক জীবনে উত্তীর্ণ হতে পারে না। অথচ সেই সময়ের সমাজ এমন মানুষেই পূর্ণ ছিল। পূর্ব ও উত্তরপূর্বের শ্রামনিক ধর্মগুলি মূলত নীতিশিক্ষাই দান করেছে মানুষকে। কিন্তু সেসব নীতিসাধনা বা শীলসাধনা এমন কঠোর নিয়মের নিগরে বাঁধা থাকত যে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে ধর্ম বজায় রাখা অসাধ্য হতো। বুদ্ধের পিতার বয়সী বর্ধমান মহাবীরের কথা স্মরণীয়। দিগম্বর, সূর্যাস্তর পর রন্ধন নিষিদ্ধ, কারণ আগুনে পোকামাকড় মরবে, তাই ভোজনও নিষিদ্ধ, ইত্যাদি নিয়মকানুন সাধারণ মানুষের পক্ষে পালন করা সম্ভব না হওয়াতে কতিপয় সন্ন্যাসীর মধ্যেই এটি আবদ্ধ রইল।

তথাগতর ধর্ম তাই মজ্ঝিম পন্থার। সকলে যাতে অনুসরণ করতে পারে। আর কত সহজেই না ধর্মে প্রবেশ করা যায়! যে কোনো মানুষ তিনবার ত্রিশরণ মন্ত্র উচ্চারণ করলেই সে বৌদ্ধ হবে। গুরু নেই। কেউ দীক্ষিত করবেন না। মানুষটা নিজেই নিজের পথ বেছে নিতে পারবে। তথাগতর অবয়বে সিদ্ধিজনিত যে বিভা দেখা যেত তা ছাড়াও তাঁর মধ্যে জগতের মানুষকে ভালোবাসার একটি করুণাঘন দীপ্তি প্রকাশ পেতো। তিনি যখনই পথ চলতেন, তাঁকে ঘিরে চলত বহু সাধারণ মানুষ। তারা সেই সময়েই হয়তো ত্রিশরণ উচ্চারণ করতে করতে সংঘে প্রবেশ করত। জাতি বর্ণ ধনী নির্ধনের বাছবিচার ছিল না। বৌদ্ধ ধর্মের এমন অসাধারণ বিস্তৃতির এটি অন্যতম কারণ। ভেদাভেদহীন ধর্ম। পরবর্তীতে দেখতে পাবো, এক সম্রাট হিংসার পথ ছেড়ে ধর্মবিজয়ে সামিল হলেন। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় ছড়িয়ে পড়ল সদ্ধর্ম ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে। গ্রীসদেশ পর্যন্ত গতি হয়েছিল তার। এদিকে সিংহল, জাভা, সুমাত্রা, বোর্ণীও ছাড়িয়ে ক্রমে জাপান চীন মহাচীন হয়ে উত্তরে পামিরের উত্তর ভূখণ্ডে ছড়িয়ে গেল বৌদ্ধ ধর্ম। ততদিনে অবশ্য সে ধর্মের নানা বিবর্তন হয়েছে। সে ধর্মের নানা শাখাপ্রশাখা, নানা দর্শনমত হয়েছে। কিন্তু তথাগতর মূল শিক্ষার গুরুত্ব এতটুকু ম্লান হয়নি।

কী ছিল তাঁর শীলসাধনা? মুক্তির প্রথম সোপান এই শীল। “চরিত্র শব্দের অর্থই এই যাতে করে চলা যায়। শীলের দ্বারা সেই চরিত্র গড়ে ওঠে”। সহজেই তিনি বলেছেন—পাণং ন হানে। প্রাণীকে হত্যা করবে না। এটিতেও মধ্যপন্থা আছে। ভিক্ষু যখন গৃহী বৌদ্ধের গৃহে অন্নগ্রহণ করবেন তখন গৃহস্থ যা দেবেন তিনি তাই গ্রহণ করবেন। সেখানে আমিষ আহার দোষের নয়। বুদ্ধ নিজে চুন্দর দেওয়া শূকরমাংস খেয়েছিলেন। দ্বিতীয়টি বললেন—ন চাদিন্নমাদিয়ে। যা তোমাকে দেওয়া হয়নি তা নেবে না। অর্থাৎ অপরের বস্তুতে হাত দেবে না। মুসা ন ভাসে। মিথ্যা বলবে না। যে কোনো অবস্থাতেই মিথ্যা বলবে না। তাতে যদি কেউ আহত হয় তাও মিথ্যার পথে যাবে না। শুনতে সহজ হলেও এই শীল সাধনা কঠিন। আমরা অহরহ কত সাদা মিথ্যেও তো বলে থাকি! আর একটি শীল, ন চ মজ্জপো সিয়া। মদ খাবে না! আশ্চর্য হই! সেই সময়ে রাজা ও শ্রেষ্ঠীদের পানভোজন আমোদপ্রমোদের অপরিমিত আয়োজন হতো। অপরদিকে বৈদিক ধর্মে এমন কথা নেই। মদ অগ্রহণীয় তো নয়ই, এমনকি কখনও কখনও ধর্মের খাতিরেও সোমরস দেবানাং প্রিয়। তৎসত্ত্বেও শ্রেষ্ঠীদের ত্রিশরণ নেওয়া ঐতিহাসিক সত্য। এক সময় রাজার সেনাদল থেকেও জলের স্রোতের মতো মানুষ সংঘে প্রবেশ করতে শুরু করল। রাজা বিপদে পড়লেন। তথাগতর কাছে আবেদন এলো। সেই থেকে নিয়ম হল, রাজার বিনা অনুমতিতে সংঘে সৈন্যরা প্রবেশ করতে পারবে না। একবার ভেবে দেখা যাক, আধুনিক সময়ে সৈন্যরা যদি কাউকে আঘাত করতে অস্বীকার করে, রক্তপাতে পাপ ঘটবে মনে করে অস্ত্রত্যাগ করেন। অহিংসা পরম ধর্ম, এই কথা মেনে নিয়ে শীল অনুসরণ করছেন। কী হবে আমাদের ভারতবর্ষের? যে ভারতবর্ষের পতাকা অশোকচক্র লাঞ্ছিত! যে ভারত বিশ্বকে জানিয়েছে এই মহামানব আমাদের পথপ্রদর্শক!

শীলসাধনায় যে উন্নতি করে, সে ব্যক্তি মঙ্গলের পথে এগিয়েছে। বুদ্ধ নিজে বলে গিয়েছেন মঙ্গললাভ কী। মঙ্গল লাভে কী হয়। কিন্তু মঙ্গললাভই চরম লক্ষ নয়। এইখানে তিনি স্বভাবের গতিকে মোড় ফিরিয়েছেন। শীলসাধনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষটি ধ্যানের পথে তপস্যার পথে অগ্রসর হবেন। ক্রমে দেখতে পাওয়া যাবে এক শান্তিময় অনুভূতির মধ্যে তিনি যেন স্থিত। নিয়মিত শীলসাধনার মধ্যে দিয়ে মানুষটি ধ্যান ও তপস্যার মধ্যে আত্মিক জীবনে অগ্রসর হবেন। যিনি সন্তুষ্ট, যিনি অক্রোধী, যিনি সামান্যতেই তুষ্ট, তাঁর সাধনার পথ প্রশ্বস্ত। তিনি কারুর ভয়ে ভীত নন। তিনি অপরিমেয় পার্থিব সম্পদের আশায় দুঃখিত নন। তিনি প্রিয়জনের জন্য হাহাকার করেন না। কারণ এই জগতের প্রতিটি প্রাণ তাঁর কাছে প্রিয়। সেই প্রিয়ভাবনা সেই মৈত্রীভাবনা তাঁকে এক অদ্ভুত শান্ত আনন্দের সন্ধান দেয়। ক্রমে আত্মবিমোচনের পথে এগিয়ে তিনি দেখতে পান নিরুপাধি এক অদ্ভুত অস্তিত্ব তাঁর বোধকে আচ্ছন্ন করেছে। তিনি যেন সেই বোধে সম্পূর্ণ উদ্ভাসিত। এখন যদি কোনো ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করেন—ভগবান আছেন? তিনি উত্তর দেন—না। তবে কি ভগবান নেই? তিনি উত্তর দেন—জানি না। অর্থাৎ, তোমাদের কল্পনার ভগবান কে, তিনি কোথায় বাস করেন, তাঁর সঙ্গে তোমাদের সম্পর্কই বা কি, সে আমি জানি না। তবে আমি নির্বাণের কথা জানি। নির্বাণ হল সেই পরম অস্তিত্ব, যেখানে অনিত্য এই জগতের সুখ দুঃখ তোমাকে স্পর্শ করবে না। স্পর্শ করবে না পাপ বা পুণ্য। সেই পরম অস্তিত্ব একটি আনন্দঘন অনুভব।

যারা প্রশ্ন করেছিলেন তাঁদের মনে ওঠেনি, বেদে যে ব্রহ্মের কথা বলা হয়েছে, বুদ্ধ সেই নিরুপাধি ব্রহ্মের কথাই বলছেন। বেদ বলছেন, ব্রহ্ম অবাংমানসোগোচরম। ব্রহ্ম বাক্য মনের অগোচর। কিন্তু তিনি আছেন। তিনি নিরাকার, নির্গুণ। তাহলে বুদ্ধ যখন এই প্রশ্নের উত্তরে চুপ করে রইলেন, তখন কি এইই বোঝায় না যে সেই ব্রহ্মের কথাই তিনি বলছেন? এখানে ব্রহ্ম বোধস্বরূপ। কেন তাহলে আমরা তাঁকে বেদবিদ্রোহী বলব? বলব, কারণ বুদ্ধ বেদের জটিল কর্মকাণ্ড স্বীকার করতেন না। তিনি বর্ণাশ্রম প্রথার মাধ্যমে মানুষকে হেয় করে তাকে ‘দলিত’ করা স্বীকার করতেন না। কিন্তু ব্রহ্মবিদ ব্রহ্ম ইব চ। সেই অর্থে বুদ্ধ স্বয়ং সেই পরমপদ অর্জন করেছেন। সনাতনীরা তা স্বীকার করেননি। নিজেদের জন্য ব্রহ্ম বাক্য মনের অগোচর বলে পাশ কাটালেও, বুদ্ধের এই সোজা সত্য তাদের স্বীকার করতে বাধা ছিল। তাহলে যে বুদ্ধকেই স্বীকার করতে হয়!

একটি সমসাময়িক প্রসঙ্গ দিয়ে এই নিবন্ধ শেষ করব। বুদ্ধ কোনো ধর্ম প্রবর্তন করেননি। জগতের মানুষের প্রতি সদাজাগরুক করুণায় তিনি একটি মার্গ প্রদর্শন করেছেন। যা অনুসরণ করলে মানুষ মৈত্রীভাবনায় একজন সার্থক মানব হয়ে উঠতে পারে। আজও ভারতবর্ষেই অসংখ্য মানুষ (মোট জনসংখ্যার ৮৫% প্রায়) অবর্ণ, শুদ্র, অতিশুদ্র, অস্পৃশ্য, ‘দলিত’ যারা প্রতিদিন সাবর্ণ সনাতনীদের দ্বারা অত্যাচারিত নিহত ধর্ষিত হয়ে চলেছেন। পরিসংখ্যান যে কোনো সুস্থ মানুষকে হতাশায় ঠেলে দিতে পারে। আমাদের কী অদ্ভুত দ্বিচারিতা! বুদ্ধনীতি অনুসরণকারী ভারতে আমরা এখনও বর্ণাশ্রমের বড়াই করে এমন পাপে লিপ্ত হই। লজ্জিত হই না। আমাদের পাপ হয় না। অপরাধ হয় না।

তাই এখনও অসংখ্য ‘দলিত’ বর্ণাশ্রমের এই অত্যাচার, সনাতনী হিন্দুদের এই অত্যাচার থেকে বাঁচতে সংঘের শরণ নেয়। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে। মাত্র ৬% উচ্চবর্ণ হিন্দু বাকিদের শাসন করে শোষণ করে অত্যাচার করে। আমরা মেনে নিই।

শেষ পর্যন্ত তাই শাক্যসিংহের সেই কথাটির ওপরে ভরসা করব। আত্মদীপো ভব। প্রতিটি অত্যাচারিত মানুষ একদিন সেই আত্মিক বলে বলীয়ান হয়ে বিশ্বকে পথ দেখাবে। রক্তাক্ত পৃথিবীতে বুদ্ধের শান্তির বাণী আবারও আমাদের আলোর পথে নিয়ে যাবে। আমরা আলোকিত হব। পরস্পরের প্রতি মৈত্রীতে আবদ্ধ হবো।



পাঠঃ

১ বুদ্ধদেব – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২ জাতক – ঈশান চন্দ্র ঘোষ
৩ Introduction to ‘Anihilation of Caste – Dr B R Ambedkar’, by Arundhati Roy.

[সাহিত্য আর সংবাদ বুদ্ধপূর্ণিমা সংখ্যা ২০২১]

1 comments:

0

প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in





গৌরচন্দ্রিকা

ইতিহাস কোন অনড় অজর প্রস্তরখণ্ড নয়। যুগের পরিবর্তনে এবং নতুন তথ্যের আলোকে ইতিহাসের পুনর্লিখন স্বাভাবিক এবং কাম্য। ইতিহাস-চর্চায় পূর্বাগ্রহকে একেবারে সরিয়ে রেখে বিশুদ্ধ বা পুরোপুরি নিরপেক্ষ মূল্যায়ন হয় না, হতে পারে না। এজন্যেই যাঁরা চর্চা করবেন তাঁদের দায়িত্ব অনেক বেশি। সজাগ থাকতে হবে যাতে নিজের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ এসে নির্বিবাদ তথ্য ও সাক্ষ্যকে খারিজ না করে দেয়।

আপাত বিরোধী তথ্যগুলোর উৎস, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং যাচাই করে নেওয়ার পদ্ধতিগত নিষ্ঠাকে (methodological rigour) মেনে চলা দরকার। সততার সঙ্গে নিজের বিশ্বাস ও পাশাপাশি বিরোধীমতের উল্লেখ করা দরকার। যাতে বিতর্কের ও চর্চার পথ খোলা থাকে।

এত কথা বলার উদ্দেশ্য ইদানীং স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নতুন ভাষ্য লেখা এবং প্রচার শুরু হয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তথ্যগত নিষ্ঠার অভাব বা তথ্যসূত্র এবং পরিপ্রেক্ষিতের উল্লেখ না করে মনগড়া একপেশে বর্ণনা চোখে পড়ছে। ফলে ইতিহাস-পুরুষদের নিয়ে পক্ষে- বিপক্ষে মিথ নির্মাণ শুরু হয়েছে।

এই ব্যাপারটি বিশেষ করে চোখে পড়ছে স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন বিতর্কিত প্রবাদ পুরুষ বিনায়ক দামোদর সাভারকর বা ‘বীর’ সাভারকরের জীবনের নবনির্মাণ নিয়ে। বিরোধীরা বলছেন কাপুরুষ এবং বিশ্বাসঘাতক আর সমর্থকেরা বলছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সেনাপতি।

এই সাদা কালো ছবির মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, তার নানা চোরাস্রোত এবং বাঁক বদলের প্রেক্ষিত।

সাভারকর—মারাঠি মানুষের কাল্ট ফিগার

আমরা বাঙালীরা যেমন আমাদের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বদের—রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, সত্যজিত রায় এবং হেমন্ত কুমার—সম্বন্ধে অতিরিক্ত স্পর্শকাতর এবং কিছুটা অসহিষ্ণু, তেমনই মারাঠিদের আইকন হলেন ছত্রপতি শিবাজী ও ‘স্বাতন্ত্র্যবীর’ বিনায়ক দামোদর সাভারকর বা বীর সাভারকর এবং লতা মঙ্গেশকর।

দেখা যাক, বিনায়ক দামোদর সাভারকর কেমন করে বীর সাভারকর হলেন?

আন্দামানে দশ বছর জেল খেটে দেশে ফিরে আসার পর ওঁকে মহারাষ্ট্রের (তৎকালীন বোম্বে রাজ্য) যারবেদা এবং রত্নাগিরির জেলে আরও তিন বছর বন্দী থাকতে হয়। তারপর ১৯২৪ সালে ওঁকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে রত্নাগিরি জেলায় সপরিবারে একসঙ্গে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়, কিন্তু জেলার বাইরে যাবেন না এবং কোন রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করবেন না এই শর্তে।

১৯৩৭ সালে ওঁর উপর থেকে ওই সব শর্ত তুলে নেওয়া হল। তখন সেসময়ের খ্যাতনামা মারাঠি নাট্যকার ,লেখক, এবং ফিল্ম-নির্মাতা পি কে আত্রে তাঁর পুণের বালমোহন থিয়েটার গ্রুপের তরফ থেকে এক সম্বর্ধনা সভা ডেকে সাভারকরকে “স্বতন্ত্রবীর” উপাধি দিলেন। সেটাই লোকের মুখে মুখে ‘বীর’ সাভারকর হয়ে গেল।[1]

বিনায়ক দামোদর সাভারকর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একজন গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বিতর্কিত নায়ক।

স্বাধীন ভারতে গান্ধীহত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগের থেকে জনমানসে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তার ফলে তিনি ক্রমশঃ রাজনীতির মূল ধারার থেকে সরে প্রান্তিক হয়ে যান, একরকম স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান। এরপর ভগ্নস্বাস্থ্য ও ভাঙা মন নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ তারিখে প্রয়াত হন। [2]

কিন্তু বর্তমানে দেশের ক্ষমতাসীন এবং সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে গত দু ’দশক ধরে তাঁর পুনর্বাসন হয়েছে। আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ার এয়ারপোর্টের নতুন নাম হয়েছে বীর সাভারকর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। দাবি উঠছে তাঁকে ভারত রত্ন দেওয়ার।

এরপর পক্ষে বিপক্ষে রাজনৈতিক তর্জা শুরু হয়েছে এবং প্রায় দু’দশক পরেও তা অব্যাহত। বর্তমান প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে আমি চেষ্টা করব পক্ষে বিপক্ষের বিভিন্ন বহু-প্রচারিত মিথগুলোর মধ্যে অল্প কয়েকটির সত্যতা যাচাই করতে, অবশ্যই উপলব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে।

সাভারকরের বিরুদ্ধে প্রচারিত মিথগুলো

· সাভারকর ভীরু কাপুরুষ, ইংরেজের কাছে বারবার মার্জনা ভিক্ষা করে মুক্তি পেয়েছেন।

-- সাভারকরকে ভীরু কাপুরুষ বলা মানে গোড়ায় গণ্ডগোল।

যিনি তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু লন্ডনে বসে তাদের বিরুদ্ধে এজিটেশন , প্যাম্ফলেট লেখা এবং সশস্ত্র আক্রমণের পরিকল্পনা করতে পারেন, তিনি আর যাই হোন, ভীরু নন কিছুতেই। ব্যাপারটা অত সরল নয়।

না, মার্সি পিটিশন লিখে সেলুলার জেল থেকে কোন রাজবন্দী ছাড়া পান নি, সাভারকর, বারীন্দ্রনাথ ঘোষ বা অন্য কেউ নয়। ইংরেজ সরকার সাভারকরের পিটিশনে সহজে বিশ্বাস করে নি। আন্দামানের সেলুলার জেলের ১৯০৯ থেকে ১৯১৬ পর্য্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নাসিক, আলিপুর, দিল্লি, লাহোর ইত্যাদি ষড়যন্ত্র মামলায় দ্বীপান্তরের শাস্তি পাওয়া বাঙালী , মারাঠী, শিখ এবং অন্য রাজবন্দীরা সবাই ছাড়া পেয়েছিলেন ১৯১৯ থেকে ১৯২১ এর মধ্যে। এদের দেশে ফেরত পাঠানো এবং কয়েকজনকে মুক্তি দেওয়া হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের আনন্দে ব্রিটেনের সম্রাটের ‘রাজকীয় ক্ষমা’ বা রয়্যাল ক্লেমেন্সির ঘোষণা অনুযায়ী।

বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্র, উপেন্দ্রনাথ এবং শচীন সান্যাল ও কুড়ি জন গদর পার্টির শিখবন্দী ছাড়া পান ১৯১৯শে। সাভারকর ভাইয়েরা, ঝাঁসিওয়ালে পরমানন্দ, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীরা ছাড়া পান ১৯২১শে। কিন্তু সাভারকরকে ভারতে পুণের যারবেদা এবং রত্নাগিরি জেলে আরও তিন বছর থাকতে হয়েছিল। ইংরেজের জেল থেকে বেরিয়ে নিজের পরিবারে ফেরার অনুমতি পান ১৯২৪ সালে।

· সাভারকর ছাড়া আর কোন রাজবন্দী ক্ষমা ভিক্ষা করে আবেদন দেন নি।

--এই কথাটিও ঠিক নয়। সেলুলার জেলে এসে বারীন্দ্রনাথ ঘোষ– ভুল করেছিলাম, এখন ছাড়া পেলে বিপ্লবের পথ মাড়াব না, শান্তিপূর্ণ অরাজনৈতিক জীবন কাটাবো—লিখে ক্ষমা চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন এবং হোম সেক্রেটারি ক্র্যাডক ১৯১৪ সালে সেলুলার জেল পরিদর্শনে এলে ওই চিঠির ভিত্তিতে ওঁর সঙ্গে আলাদা করে দেখা করেছিলেন।

এ নিয়ে বারীন্দ্র ঘোষের আফশোস ছিল। দিল্লি এবং পরে কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলার শচীন্দ্রনাথ সান্যালের স্মৃতিকথায় দেখছি আন্দামান থেকে দেশে ফেরার সময় জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে বিষণ্ন বারীন বলছিলেন—আমরা বীর নই, মাথা উঁচু রাখতে পারি নি[3]

· সাভারকর ’৪২ এর ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। কাজেই উনি বিশ্বাসঘাতক।

--শুধু ওই একটি ঘটনাকে ভিত্তি করে অমন রায় দেওয়া অনুচিত। তখন আরও অনেকে ওই আন্দোলনে যোগ দেন নি এবং কেউ কেউ বিরোধিতা করেছিলেন—যেমন, জিন্না, আম্বেদকর, রামস্বামী নাইকার এবং অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি। এঁরা কি বিশ্বাসঘাতক?

আসলে সবার আলাদা আলাদা এজেন্ডা ছিল। যেমন , জিন্না চাইছিলেন মুসলমানদের জন্যে আলাদা দেশ, সাভারকর চাইছিলেন বেশি বেশি করে হিন্দু যুবকদের ব্রিটিশ ফৌজে ভর্তি করে অস্ত্রশিক্ষা দেওয়ানো আম্বেদকার এবং তামিলনাড়ুর দ্রাবিড় আন্দোলনের প্রণেতা রামস্বামী নাইকার চাইছিলেন দলিতদের বিশেষ অধিকার এবং কন্সটিট্যুয়েন্সি। কমিউনিস্ট পার্টি ফ্যাশিস্তদের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে ‘জনযুদ্ধে’ মিত্রশক্তির সমর্থনে দাঁড়িয়েছিল, তাই ব্রিটেনকে তাৎকালিক সমর্থন।

সাভারকরের কাছে এটা ছিল হিন্দু যুবকদের বিশেষ সুযোগ-- বৃটিশ ফৌজে ঢুকে যুদ্ধবিদ্যা অস্ত্রচালনায় পারঙ্গম হয়ে আগামী দিনের মহাসমরের জন্যে (মুসলিম-মুক্ত ভারত) প্রস্তুত হওয়া।[4]
হিটলারের জার্মানি ১৯৩৮শের মার্চে অস্ট্রিয়া দখল করায় সাভারকর হিটলারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এটা ওঁর চোখে জার্মানির ‘ঐক্যবদ্ধ’ হওয়ার উদাহরণ! উনি মনে করলেন এইভাবেই ‘হিন্দু ভারত’ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে । নেহরুর হিটলার এবং মুসোলিনির নিন্দা সাভারকরের চোখে ‘অনাবশ্যক’ ।[5]


· তিনি গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী এবং শুরু থেকেই মুসলমান বিদ্বেষী।

--এটাও আংশিক সত্য। লণ্ডনে আইন পড়তে যাওয়া ২৪ বছরের সাভারকর ছিলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রচারক। সে সময় ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে উনি একটি বই লেখেন, তাতে ওই বিদ্রোহকে উনি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম আখ্যা দিয়েছিলেন। সেই বইয়ের ভূমিকায় এবং আরও অনেক জায়গায় বারবার বলেছেন-- ইংরেজদের তাড়াতে হলে দরকার হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। এও বলেছেন যে চতুর ইংরেজ দুই ধর্মের বিভাজনের ফাঁদ পেতে রাজত্ব করতে চায়। শিক্ষিত হিন্দুরা যেন ওই ফাঁদে পা না দেয়।

“The Englishmen will try now also their old work of deception, they will try to incite the Hindus to rise against Mossalmans, and the Mohomedans to rise against the Hindus. But, Hindu Brothers! Do not fall into their nets. It is hardly necessary to tell our clever Hindu Brethren that the English never keep their promises”[6].

কিন্তু আন্দামান থেকে ১৯২১ সালে ভারতে ফিরে এলেন অন্য এক সাভারকর। যিনি ‘হিন্দুত্ব’ এবং ‘হিন্দুপদ পাদশাহী’ বলে দুটি বই লিখে প্রচার করেন যে ভারতের সভ্যতা মানে বৈদিক হিন্দু সভ্যতা। মুসলমানরা বাইরে থেকে আসা আক্রমণকারী, ওদের পিতৃভূমি এবং পূণ্যভূমি আলাদা। কাজেই ভারত স্বাধীন হলে সেটা হিন্দুরাষ্ট্র হবে, তার জাতীয় পতাকা হবে শিবাজীর গৈরিক পতাকা। ওই ভারতে মুসলমানদের সমান অধিকার থাকতে পারে না।

সাভারকরের জীবনী লেখক পুরন্দরে বলছেন যে যাঁরা ভারতের বহুত্ববাদী আপাতবিরোধী ধর্মাচরণ এবং জীবনযাপনের সমন্বয়ের কথা বলতেন তাঁদের বিপরীতে সাভারকর দাঁড়ালেন এমন হিন্দু জাতীয়তাবাদী ধারণা নিয়ে যা মুসলিম-ক্রীশ্চানদের বাদ দিয়ে শুধু হিন্দু ভারতের কথা বলে।[7]

শেষ বয়সে লেখা 'সিক্স গ্লোরিয়াস ইপোক্স অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি' বলে ওঁর বইটি পড়লে দেখা যাবে এমন এক অতীতমুখী মন যার চেতনা শুধু অতীতের হিন্দু-মুসলিম বাইনারিতে আবদ্ধ হয়ে হিন্দুর কথিত বিক্রমগাথায় সান্ত্বনা খোঁজে। শুধু তাই নয় , এই মানস একটি প্যারানইয়া--- শিগগিরই মুসলিমরা ভারতে মেজরিটি জনগোষ্ঠী হয়ে উঠবে --- থেকে আত্মসমর্পণকারী বন্দী মুসলিমদের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হত্যা তথা 'টু পে ইন দেয়ার ওন কয়েন' নীতিতে মুসলিম মেয়েদের ধর্ষণকে উচিৎ বা কর্তব্য বলে ওকালত করে। বৃদ্ধ অসুস্থ সাভারকরের লেখাটির ইংরেজি অনুবাদে সহকারী এস টি গোড়বোলের চোখে এগুলো রীতিমত ‘শকিং’ মনে হয়েছিল।[8]

তাঁর অন্য এক মারাঠি ভাষায় জীবনী রচয়িতা ডি এন গোখলের মতে সাভারকরের এই ‘বদলা’ নেবার থিওরি হিন্দুধর্মের কিছু বেসিক ভ্যালুজকে --যেমন’ ক্ষমা, নারীর প্রতি সম্মান, উদার হৃদয় হওয়া’—খারিজ করে । তাই এর তীব্র সমালোচনা হয়েছিল।[9]


১.২ সাভারকরের সমর্থনে বহুপ্রচারিত মিথগুলো

· সাভারকরের পঞ্চাশ বছর কালাপানির শাস্তি হয়েছিল এবং সাভারকর রাজনৈতিক বন্দীদের মধ্যে আন্দামানের সেলুলার জেলে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন।

--শুধু প্রথম অংশ টুকু সত্যি। সাভারকরের দুটি মামলায়-- নাসিকের ম্যাজিস্ট্রেট জ্যাকসনকে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং লণ্ডন থেকে বোম্বাইয়ে গোপনে কুড়িটি পিস্তল পাঠানো-- আলাদা করে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হয়। তখন যাবজ্জীবন মানে ছিল পঁচিশ বছর। কিন্তু বলা হল দুটো শাস্তি একসঙ্গে নয়, একের পর এক চলবে। মানে সাভারকরকে পঞ্চাশ বছর আন্দামানে কাটাতে হবে! এত বড় শাস্তি ইংরেজ সরকার আর কাউকে দেয় নি।

তবে সাভারকরকে আন্দামানে দশ বছরের এক মাস আগেই ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

বারীন ঘোষেরা ১৯০৯ সালে সেলুলার জেলে এসে ১৯১৯ সালে ছাড়া পান, অর্থাৎ দশ বছর। সাভারকর জুলাই ১৯১১ সালে সেলুলার জেলে এসে জুন ১৯২১ সালে ছাড়া পান। অর্থাৎ ওনারও কালাপানি বাস প্রায় দশ বছর, তার বেশি নয়। লণ্ডনে বন্দী হওয়া থেকে রত্নগিরি জেল থেকে ১৯২৪ সালে মুক্তি পাওয়া পর্য্যন্ত ধরলে ইংরেজের জেলে তাঁর বন্দী জীবন ১৪ বছরের বেশি নয়,

আর শচীন্দ্র সান্যাল দু-দুবার সেলুলার জেলে বন্দী হয়ে মোট তের বছর ওখানে কাটিয়েছেন। ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (মহারাজ)ও আন্দামানের সেলুলার এবং ব্রহ্মদেশের মান্দালয় মিলিয়ে ভারতের বাইরের জেলে ওঁর চেয়ে বেশি সময় রয়েছেন।

মহারাজ লিখেছেন--“আমি ১৯০৮ সন হইতে ১৯৪৬ সন পর্য্যন্ত ৩০ বছর কারাগারে কাটাইয়াছি’।[10] ত্রৈলোক্য মহারাজের কালাপানি এবং পূর্ব ও দক্ষিণ ভারত, বর্মার মান্দালয়, ইসনিন ও রেঙ্গুনের বিভিন্ন জেল মিলিয়ে মোট জেলযাত্রা ৩০ বছরের। উনি এবং আরও অনেকে মুক্তির প্রলোভন সত্ত্বেও মাফিনামা দেননি। [11]



· শুধু সাভারকরকে বছরের পর বছর আন্দামানে নারকোলের ছোবড়া পিটিয়ে, দড়ি পাকিয়ে এবং তেলঘানিতে জুতে রাখা হয়েছিল।

--পুরোপুরি সত্যি নয়। সাভারকর কোন ব্যতিক্রম ছিলেন না। ওই অমানুষিক বেগার শ্রম তখন সেলুলার জেলে সব রাজবন্দীকেই করতে হত। বারীন ঘোষ[12], উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়[13], ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী—সবার আন্দামানের স্মৃতিকথায় এর গ্রাফিক বর্ণনা রয়েছে।

আর তাঁর জেল টিকেটের রেকর্ড( কনভিক্ট নং ৩২৭৭৮) অনুযায়ী শুধু প্রথম তিনটে বছর, অর্থাৎ ১৯১১ থেকে ১৯১৪ পর্য্যন্ত তাঁকে ওভাবে খাটানো হয়েছিল। এর মধ্যে উনি তিনটে পিটিশন দিয়েছেন। হোম সেক্রেটারি ক্র্যাডকের সঙ্গে জেলে দেখা করে সদাচরণের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর ওঁকে আর এসব করতে হয় নি। উনি দ্বিতীয় শ্রেণীর কয়েদি হয়ে গেলেন এবং প্রথমে একজন কেরাণীর দায়িত্ব পেলেন এবং তারপর ১৯২০ সালের মাঝামাঝি তেলঘানির ফোরম্যান হয়ে অন্য কয়েদিদের উপর হুকুম চালানোর অধিকার পেলেন, মাসিক একটাকা মাইনে।[14]

· সাভারকর কোন মার্জনা ভিক্ষা করে কোন পিটিশন দেন নি।

--- ২০১৮ সালে মুম্বাইয়ের মারাঠি খবরের কাগজ লোকসত্তায়[15] লেখা হয় সাভারকর আদৌ কোন পিটিশন --পাঠান নি, আর যদিও পাঠিয়ে থাকেন তাহলেও তাতে কোন মার্জনা ভিক্ষা (ask for clemency) করেন নি। এর দেড় দশক আগে, ওয়াই ডি ফড়কে লেখেন – মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী সাভারকর কখনও ব্রিটিশ শাসকের সঙ্গে সহযোগিতা করেন নি[16]

কিন্তু সাভারকরের গবেষণাভিত্তিক জীবনী লেখক বৈভব পুরন্দরে জানাচ্ছেন কথাটা সত্যি নয়, কারণ সাভারকর নিজেই ক্লেমেন্সি পিটিশন লেখার কথা অস্বীকার করেন নি। [17]

কতগুলো লিখেছিলেন?

এ নিয়ে অনেকে বলছেন ৫টি বা ৬টি, কিন্তু পুরন্দরে বলছেন ৭টি। পুরন্দরে তারিখগুলো নিয়েছেন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র সাভারকরের জেল হিস্ট্রি টিকেট (কনভিক্ট নং ৩২৭৭৮) থেকে। উনি যে তারিখগুলো দিয়েছেন সে হিসেবে দেখলে নীচের ছবিটা পাই।

সাভারকর প্রথম পিটিশন লেখেন আন্দামানে আসার দু’মাসের মাথায়, ৩০ অগাস্ট ১৯১১ তারিখে। ওটা চারদিনের মাথায় খারিজ হয়ে যায়।

দ্বিতীয় পিটিশন পাঠান চোদ্দমাস পরে, ২৯ অক্টোবর, ১৯১২ তারিখে। তাতে বলেন যে ওঁর আচার আচরণ এখন অনেক ভাল, কাজেই জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হোক।

তৃতীয় এবং চতুর্থ পিটিশন পাঠান হয় যথাক্রমে, নভেম্বর ১৯১৩ এবং সেপ্টেম্বর ১৯১৪ তারিখে। তৃতীয়টি সাভারকর পোর্ট ব্লেয়ারে জেল পরিদর্শনে আসা হোম সেক্রেটারি স্যার ক্র্যাডকের সঙ্গে দেখা করে হাতে দেন এবং সাক্ষাতকারে নিজের চিন্তায় পরিবর্তনের কথা বলে সশস্ত্র বিপ্লবের ভুল পথ ছেড়ে সাংবিধানিক পথে সহযোগিতার রাজনীতি করার আশ্বাস দেন।

সাভারকর ভাইসরয়ের কাছে মার্জনা চেয়ে পঞ্চম এবং ষষ্ঠ পিটিশন পাঠান ১৯১৫ এবং ১৯১৭ সালে।

সপ্তম এবং শেষবারের মত আপিল করেন ৩০ মার্চ, ১৯২০ তারিখে।[18]

এখানে বলে রাখা ভাল যে এখন সাভারকরের মৃত্যুর পরে ন্যাশনাল আর্কাইভ থেকে ওনার পিটিশনগুলো পাবলিক ডোমেইনে রয়েছে। ফলে এ নিয়ে কোন কন্ট্রোভার্সি হওয়ার কথা নয়। আর প্রথম পিটিশনটি পাওয়া যায় নি। কিন্তু তার উল্লেখ জেল টিকেটে এবং সাভারকরের দ্বিতীয় পিটিশনে রয়েছে।

দুটো জিনিস গুলিয়ে ফেলা হয়। জেলে থাকতে ক্ষমা চেয়ে মার্সি পিটিশন দেওয়া এবং জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় রাজনীতি থেকে দূরে থাকা এবং সদাচরণের প্রতিশ্রুতির বণ্ড দেওয়া।

নিয়মমাফিক জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় শাস্তিপ্রাপ্তদের যেটা সাইন করতে হয় সেটা সদাচরণের বণ্ড যেটা সব বিপ্লবীকেই দিতে হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা কেউ আগে বার বার মার্জনা ভিক্ষা করে আবেদন দেন নি।

· সাভারকর গান্ধীজির নির্দেশে ক্ষমাভিক্ষার আর্জি লিখেছিলেন।

--প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং বল্লেন- সাভারকর মার্জনা ভিক্ষা করে আবেদন দিয়েছিলেন, কিন্তু গান্ধীজির নির্দেশে।[19] বিরোধীপক্ষ চটপট মনে করিয়ে দেয় যে সাভারকার একাধিক মাফিনামা লিখেছিলেন। এবং প্রথম পাঁচটি - লেখার সময় ---১৯১১ থেকে ১৯১৫ সাল -- গান্ধীজি সাউথ আফ্রিকায় আন্দোলনরত এবং নিজে ওখানকার জেলে বন্দী। কিন্তু কথাটা উঠেছে কেন?

১৯২০ সালে সাভারকরের ছোটভাই ডাক্তার নারায়ণ রাও গিয়ে গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করে দাদার মুক্তির জন্য কিছু করার অনুরোধ করলে গান্ধীজি বলেছিলেন আর একবার আবেদন পাঠাতে, উনি চেষ্টা করবেন। তখন সাভারকর শেষ বা সাতনম্বর মাফিনামাটি লেখেন এবং ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’য় সাভারকরের মুক্তির দাবিতে গান্ধীজির জোরালো প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ।

· অন্য সবাই অমন মুচলেকা দিয়েছিল। এমনকি বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল—সবাই।

--এটাও ভুল।

আমরা স্যার ক্র্যাডকের রিপোর্ট (Home Deptt. Poll A. Feb. 1915, Nos. 68—160) থেকে ১৯১৩ সালে সেলুলার জেলে দু’দফায় দশজন বিপ্লবীদের সংগে কথাবার্তা নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।

ওঁর মতে সাভারকর এবং বারীন ছাড়া কেউ মাফিনামা চেয়ে পিটিশন দেন নি। সম্পাদক নন্দগোপাল এবং হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল অন্য কয়েদিদের প্রতি অন্যায় এবং জেলের সামগ্রিক ব্যবস্থায় পরিবর্তনের দাবিতে পিটিশন দিয়েছিলেন।

বারীন্দ্র নিজের জন্যে মাফিনামা দিয়ে ছাড়া পেলে আর বিপ্লবের পথে যাবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন।

সাভারকর বললেন—উনি নিজে বিপ্লবের ভুল পথ ছেড়ে সংবিধানসম্মত সহযোগিতার পথে চলবেন তো বটেই, সঙ্গে যাঁরা ওনার নেতৃত্বে আস্থা রাখে এমন সব ভুল পথে পা বাড়ানো বিপ্লবীদের বুঝিয়ে সুজিয়ে ফিরিয়ে আনার এবং সরকার যা দায়িত্ব দেবে তা পালন করার কথা দিলেন।

পরের চিঠিতে (অক্টোবর ১৯১৪) উনি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় সেই যুদ্ধে বৃটিশ সাম্রাজ্য রক্ষার সৈনিক হবার শর্তে মুক্তি চাইলেন। এটি আর কেউ করেন নি।

ইতিহাসবিদ এবং সাভারকরের প্রশংসক ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদারের ‘দ্য পেনাল সেটলমেন্টস অফ আন্দামান অ্যান্ড নিকোবর’ একটি গবেষণাভিত্তিক প্রামাণ্য দস্তাবেজ। উনি বলছেন যে বারীন্দ্র, সাভারকরদের ক্ষমাভিক্ষা দেখে মনে হচ্ছে কালাপানির সাজা, নিঃসন্দেহে, ওই মহান বিপ্লবীদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলে দিয়েছে এবং তারা আর সশস্ত্র ক্রান্তি অথবা গুপ্ত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসন ধ্বংস করার কথা ভাবছেন না।[20]

শচীন্দ্রনাথ সান্যাল কোন মার্সি পিটিশন বা বন্ড দেন নি। আন্দামান থেকে ফিরে কোলকাতায় তাঁর ব্যারিস্টার নরমপন্থী কংগ্রেসি নেতা বি সি চ্যাটার্জির বাড়িতে দেখা করতে গেলে উনি তাঁকে শচীনের নিজের ভাইকে আন্দামান থেকে লেখা একটি পোস্টকার্ড দেখান, যাতে শচীন মন্টেগু -চেমস্ফোর্ড রিফর্ম অ্যাক্টের বিল (১৯১৮) নিয়ে মত প্রকাশ করেছিলেন যে সত্যিই কন্সটিট্যুশনে অমন রিফর্ম হয়ে ভারতীয়দের নিজেদের দেশ পরিচালনায় কিছুটা অধিকার দিলে কে আর ঘর ছেড়ে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে পা বাড়াবে!

ওটা দেখে শচীন ব্যারিস্টার চ্যাটার্জিকে বললেনঃ

“বিনায়ক দামোদর সাভারকরও তো তার চিঠিতে আমার মতই চিন্তা ব্যক্ত করেছে। তাহলে আমাকে ছেড়ে দিল ওকে ছাড়ল না কেন”[21]?

ওঁর “বন্দী জীবন” স্মৃতিকথা থেকে এই বক্তব্যটিকে বিচ্ছিন্ন ভাবে উল্লেখ করে বলা হয়—দেখ, শচীন্দ্র সান্যালও তো মুক্তির জন্যে চিঠি লিখেছিলেন।

এঁরা ঘুলিয়ে দেন যে শচীন্দ্রের লেখা চিঠিটি নিজের ভাইকে লেখা ব্যক্তিগত পোস্টকার্ড[22] আর সাভারকরেরটি বৃটিশ হোম ডিপার্টমেন্টকে ক্ষমা চেয়ে লেখা লম্বা এক পিটিশন।

এছাড়া বৈভব পুরন্দরে , সম্পত বিক্রম এবং ধনঞ্জয় কীর প্রমুখ সাভারকরের মারাঠি ইতিহাসবিদেরা শচীন্দ্রের “বন্দী জীবন” বইয়ে উল্লিখিত নিচের ঘটনাটি চেপে গেছেন।

পুলিশ অধিকর্তা স্যাণ্ডার্স শচীন্দ্রকে বারাণসীতে ১০০ টাকা মাইনের সরকারি চাকরির প্রস্তাব দিয়ে বললেন –একটাই শর্ত, সমস্ত রাজনৈতিক কাজকর্ম ছেড়ে দিতে হবে।

শচীন্দ্র ধন্যবাদ জানিয়ে উত্তর দিলেন-- যখন আন্দামান থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় কোন শর্ত মেনে নিইনি তখন আজ কেন কোন শর্ত মানতে যাব? সরকারী চাকরির করার মানে সরকারের নিয়ম কানুন মেনে কাজ করা। এর অতিরিক্ত কোন শর্ত মানা সম্ভব নয়’[23]

এর থেকেই স্পষ্ট শচীন্দ্রনাথ সান্যাল কোন মার্সি পিটিশন লেখেন নি। সাভারকরকে বড় করতে গেলে কি শচীন্দ্রকে ছোট করতে হবে?

আগের সাক্ষাতকারে শচীন্দ্র ব্যারিস্টার বি সি চ্যাটার্জিকে বললেন যে ওনার ইংরেজের সুবুদ্ধির উপর ভরসা নেই। তাই সহজে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ ছাড়বেন না[24]। তারপর উনি হিন্দুস্থান রিপাবলিক্যান আর্মি সংগঠিত করতে লাগলেন। ভগত সিং তাঁরই রিক্রুট।

· বৃটিশ সরকার সাভারকরকে দেশজুড়ে আন্দোলনের ফলে মুক্তি দিয়েছিল। উনি কোন মুচলেকা দেন নি।

-- এটাও সত্যি নয়। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্রথমে দুটো শর্তে সাইন করে মুচলেকা দিতে বলল।

এক, পাঁচ বছর কোন রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করা চলবে না।

দুই, পাঁচ বছর রত্নাগিরি জেলার বাইরে পা রাখা যাবে না।

এবং পাঁচবছর পর ওনার চালচলন নিয়ে সমীক্ষা করা হবে। দরকার হলে এই প্রোবেশন পিরিয়ড বাড়ানো যেতে পারে।

সাভারকর মুচলেকায় দস্তখত করলেন।

কিন্তু শেষসময়ে আরও দুটো অপমানজনক শর্ত জুড়ে দেওয়া হল।

সাভারকরকে লিখে দিতে হবে যেঃ

এক, উনি ন্যায়বিচার পেয়েছেন এবং তাঁর উচিত শাস্তি হয়েছিল।

দুই, হিংসার পথকে নিন্দা করে বিবৃতি দিতে হবে।

সাভারকর দুটো শর্তই মেনে মুচলেকা দিলেন। [25]

অবশেষে সাভারকর ৬ জানুয়ারি ১৯২৪ তারিখে ব্রিটিশ জেলের বাইরে পা রাখলেন।

আর দেশে সবাই হতবাক। ইন্দুপ্রকাশ, কেশরী ইত্যাদি মারাঠি দৈনিক ওই অপমানজনক শর্তের কথা প্রকাশিত করল। বুদ্ধিজীবিরা একজন নামকরা স্বাধীনতা সংগ্রামীর অমন বন্ডে দস্তখত করা নিয়ে বিষণ্ন। কানপুরের ‘প্রতাপ’ পত্রিকার সম্পাদক গণেশশংকর বিদ্যার্থী ৩ আগস্ট, ১৯২৮ তারিখে শ্রদ্ধানন্দ পত্রিকায় লিখলেন—এমন সব করার চেয়ে তাদের কি মরে যাওয়াই ভাল ছিল না?[26]

· সাভারকরের লণ্ডনে আইন পড়ার সময় লেনিন স্বয়ং ১৯০৯ সালের মার্চ মাসে ইন্ডিয়া হাউসে তিনদিন বা চারদিনের জন্যে শেল্টার নিয়েছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে বিপ্লব নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।

-- ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ত্রিপুরায় বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর যখন বেলোনিয়া এবং অন্য জায়গায় লেনিনের স্ট্যাচুর মুণ্ডচ্ছেদ করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন চ্যানেলে ও পত্রিকায় দলের মুখপাত্রেরা এটিকে উচিত কার্য বলে প্রশংসা করছেন তখন ইন্ডিয়া টুডে (৭ই মার্চ, ২০১৮) জনৈক প্রভাস কুমার দত্তের একটি লেখা প্রকাশ করে। তাতে বলা হয় যে সাভারকরের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া হাউস নাকি প্রায় বিশ্ব বিপ্লবের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। তাতে আইরিশ, চৈনিক, রুশ, মিশরীয়, তুর্কি, ইরান এবং অন্যদেশের বিপ্লবীরা সম্মিলিত হতেন।

তখন নাকি লণ্ডনের অ্যানার্কিস্ট সমাজবাদী নেতা গাই অ্যালড্রেডের প্রয়াসে লেনিন ১৯০৯ সালের মার্চ মাসে ইন্ডিয়া হাউসে চারবার এসেছিলেন এবং সাভারকরের সঙ্গে অনেক আলোচনা করেছিলেন। কী নিয়ে আলোচনা সেটা জানা যায় নি। লেখকের সূত্রঃ Savarkar.org 22/5/2017

এরপর সাভারকরের জীবন ও কাজের সাম্প্রতিক ব্যাখ্যাকার ইতিহাসবিদ বিক্রম সম্পত ও লেনিনের ইন্ডিয়া হাউসে এসে সাভারকরের সঙ্গে দেখা করার গল্পটি ফের আউড়ে দিলেন, কিন্তু কোন তথ্যসূত্র ছাড়াই। [27]

এরপর hindi.opindia.com এ ২৮/০৫/২০২০ , সাভারকরের জন্মদিনে লেখা হল সাভারকর পলাতক রুশ বিপ্লবী লেনিনকে ইন্ডিয়া হাউসে তিনদিন শেল্টার দিয়েছিলেন। সাভারকর সারাদিন কাজে , ব্যস্ত ছিলেন। রাতে খাওয়ার সময় লেনিনকে জিজ্ঞেস করলেন--ক্ষমতায় এলে রুশদেশে সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থার কীভাবে উন্নতি করবেন? লেনিন নাকি জবাবে বলেছিলেন যে আগে ক্ষমতায় আসি, তারপরে ভাবব। ।

তখন নাকি মদনলাল ধিংড়াও (যিনি মাস দুয়েক পরে কার্জন-উইলিকে হত্যা করবেন) সেই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন।

এ জাতীয় অনেক অর্বাচীন লেখা আজকাল বিভিন্ন সাইট ও পত্রিকায় টুইটারে দেখা যাচ্ছে।

এই প্রচারের স্পষ্ট উদ্দেশ্য, আইন পড়তে লণ্ডনে যাওয়া তরুণ সাভারকর তখনই কত পরিপক্ক আন্তর্জাতিক নেতা তা প্রমাণ করা, বলা বাহুল্য কেউ এর সমর্থনে কোন তথ্য দেওয়ার দরকার মনে করেননি।

লেনিন তখন কোথায় ছিলেন?

১৯০৫ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর থেকে রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভেতরে অন্তর্দ্বন্দ্ব তীব্র হয় এবং মেনশেভিক ও বলশেভিকদের মধ্যে বিতর্ক উগ্র রূপ নেয়। ১৯০৮ সালে লেনিন বগদানভের দার্শনিক প্রবন্ধের জবাবে অভিজ্ঞতাবাদ ও সত্যের আপেক্ষিক রূপ ও ব্যক্তিনিরপেক্ষ রূপ, এবং অন্তিম সত্য বলে আদৌ কিছু হয় কিনা—এইসব নিয়ে একটি গ্রামভারী দর্শনের বই লেখায় ব্যস্ত। বইটি হল “মেটিরিয়ালিজম অ্যান্ড এম্পিরিও ক্রিটিসিজম—ক্রিটিক্যাল কমেন্টস অন এ রিয়্যাকশনারি ফিলজফি’।

লেনিন ১৯০৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্য্যন্ত জেনেভায় বসে বইটি লেখেন। তাতে পদার্থবিদ্যার দার্শনিক ব্যাখ্যা নিয়ে একটি অধ্যায় যোগ করার উদ্দেশ্যে নভেম্বরে লণ্ডন গিয়ে একমাস ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে আধুনিক বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করেন।

তারপর ডিসেম্বরে প্যারিস গিয়ে এপ্রিল ১৯০৯ পর্য্যন্ত ওখানে বসে প্রুফ দেখেন। বইটি ১৯০৯ সালের মে মাসে রাশিয়ায় প্রকাশিত হয়।[28]

তাহলে ১৯০৯ সালের মার্চ মাসে লেনিন ইন্ডিয়া হাউস যান কী করে?

এই উদ্ভট থিওরির অন্য আপত্তিগুলোঃ

· সাভারকর দেশি বিদেশি অনেক বিপ্লবীদের নিয়ে লিখেছেন বা উল্লেখ করেছেন –কিন্তু লেনিনের সঙ্গে আলাপ? কোথাও এমন দাবি করেন নি।

· ইন্ডিয়া হাউসে সাভারকরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এম বি পি টি আচার্য, যিনি পরে কাবুলে ১৯২০ সালে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা করেন, এবং লেনিনের সঙ্গে দেখা করেন, তিনিও সাভারকরের সঙ্গে ইন্ডিয়া হাউসে লেনিনের পরিচয় নিয়ে কিছু লেখেন নি।

· রয়-লেনিন থিসিসের এম এন রায়, যিনি কমিন্টার্নের প্রতিনিধি হিসেবে মেক্সিকো , চীন এবং কাবুল গিয়েছেন, ১৯৩৭ সালে সাভারকর মুক্তি পেলে দেখা করতে তাঁর বাড়ি গিয়েছেন—তিনিও কোথাও এমন কিছু লেখেন নি।

· সাভারকর এবং তাঁর সহকারী বাল সাভারকর দাবি করেছেন যে নেতাজি সুভাষ ১৯৪০ সালে তাঁর বোম্বের বাড়িতে গিয়ে দেখা করেছিলেন। তখন সাভারকর তাঁকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে জাপান/জার্মানির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ অনুযায়ী সুভাষ ১৯৪২ সালে পালিয়ে জার্মানি পৌঁছে যান এবং আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন।[29]

এ নিয়ে তাঁর প্রথম জীবনী লেখক ধনঞ্জয় কীর লেখেন যে সাভারকর হলেন ভারতের মাজ্জিনি (ইতালীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী) এবং শিবাজীর রাজনীতির ভক্ত সুভাষ চন্দ্র তাঁর অনুগামী, অর্থাৎ ভারতের গ্যারিবল্ডি। সুভাষ যা করেছেন সব সাভারকরের নির্দেশ মেনে![30]

জানুয়ারি ১৯৪১ এ ভারত থেকে নাটকীয় অন্তর্ধানের ছ’মাস আগে নেতাজি ২২শে জুন, ১৯৪০ তারিখে বোম্বের সাভারকর সদনে গিয়ে ওঁর সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। তখন সাভারকর বোসকে দেশের বাইরে গিয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে পরামর্শ দেন[31]

---- এর মধ্যে সত্যি কতটুক? এটা ঠিক যে নেতাজি ২২ জুন, ১৯৪০ তারিখে বোম্বের সাভারকর সদনে সাভারকরের কাছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য সমর্থন চাইতে গিয়েছিলেন এবং তার আগে উনি একই কারণে জিন্নার সঙ্গেও দেখা করে এসেছেন।

সেদিনের আলোচনা প্রসঙ্গে নেতাজি নিজে তাঁর বইয়ে লিখে গেছেন—‘ দেখলাম মিঃ সাভারকর আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কিছুই বোঝেন না। ওনার একটাই চিন্তা—কী করে হিন্দু যুবকদের ব্রিটিশ ফৌজে ভর্তি করিয়ে মিলিটারি ট্রেনিং দেওয়া যায়’![32]

রাসবিহারী বসু মার্চ, ১৯৪২শে ( কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন শুরুর ঠিক আগে) টোকিও থেকে এক চিঠি লিখে সাভারকরকে অনুরোধ করলেন যাতে উনি বৃটিশের এই দুর্বল সময়ে ওদের সমর্থন না করেন, শত প্রলোভন এমনকি স্বাধীনতার আশ্বাসেও বিশ্বাস না করেন।-- দেশের সব অনিষ্টের মূল বৃটিশ শক্তিকে ধ্বংস করতে জাপানের সংগে হাত মেলালে কেমন হয় ?[33]

সাভারকর হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে ওদের বিশিষ্ট নেতা জি ভি কেলকরের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া তাঁর সভাপতির অভিভাষণে বললেন—হিন্দুরা ‘এক মিনিট সময় নষ্ট না করে’ ফৌজে যোগ দিক। কারণ , জাপান অক্ষশক্তিতে যোগ দিয়েছে । এখন বৃটিশের শত্রুদের ভারতের মাটিতে ঠেকাতে আমাদের ভারত রক্ষার জন্যে সরকারের যুদ্ধপ্রচেষ্টাকে সবরকমে সাহায্য করতে হবে।[34]

অগাস্ট, ৪২ এর শেষে সুভাষ চন্দ্র বোস জার্মানি থেকে এক রেডিও ব্রডকাস্টে বললেন ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনে ভারতাবাসী জেগে উঠেছে এবং এই আন্দোলন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ছে । উনি আরও বললেন, ‘ আমি মিঃ জিন্নাহ, মিঃ সাভারকর এবং আরও যারা এখনও বৃটিশের সংগে সমঝোতার কথা ভাবছেন তাঁদের বলছি -- তাঁরা শেষবারের মত বুঝে নিন যে আগামী দিনে বৃটিশ সাম্রাজ্য বলে কিছু থাকবে না । আজ যারা স্বাধীনতার জন্যে লড়ছেন শুধু তাঁরাই স্বাধীন ভারতে সম্মান পাবেন এবং যাঁরা আজ বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বাভাবিকভাবেই তুচ্ছ বলে গণ্য হবেন’।[35]

সাভারকর সুভাষ চন্দ্র বোসের রাজনীতি নিয়ে কী ভাবতেন?

১৯৩৭ সালে সাভারকরের উপর থেকে রাজনৈতিক কাজকর্মের বিধিনিষেধ উঠে গেলে সুভাষচন্দ্র বসু সাভারকরের বাড়িতে দেখা করতে গেলেন। উদ্দেশ্য সাভারকরকে কংগ্রেসের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত করা।

সাভারকর সুভাষচন্দ্রকে ফিরিয়ে দিলেন। কারণ, হিন্দু মুসলমান প্রশ্নে সুভাষচন্দ্রের অবস্থান সাভারকরের বিপরীত। জীবনীকার ধনঞ্জয় কীর জানাচ্ছেন সাভারকরের অভিমতে সুভাষচন্দ্র ‘কংগ্রেস ক্যাম্পের কুটিল নেতা’। [36]

১৯৩৮ সালেই দুজনের মধ্যে মতবিরোধ তীব্র হয়। সুভাষ চন্দ্র (তখনও কংগ্রেসের সভাপতি) বললেন যে ভারতীয় ভাষা দেবনাগরী লিপির বদলে রোমান হরফে লেখা উচিত। সাভারকর ওঁর সমালোচনা করে বললেন যে আদৌ নয়, সংস্কৃত ঘেঁষা হিন্দিই আমাদের জাতীয় ভাষা হওয়া উচিত, এবং তার থেকে উর্দূ শব্দগুলো বেছে বেছে বাদ দিয়ে তবে[37]

পুণে শহরে অগাস্ট ১৯৩৯ এর জনসভায় উনি সমালোচনা করলেন গান্ধীইজম, বোসইজম, এবং রয়ইজম (মানবেন্দ্রনাথ রায়ের চিন্তাধারা) –তিন রাজনীতিরই। কিন্তু সব চেয়ে কড়া কথাটি বললেন সুভাষ চন্দ্রের বিরুদ্ধে—মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে বোসের খুব বেশি তফাৎ নেই, কিন্তু মুসলিম তোষণের ব্যাপারে ও আরও একধাপ এগিয়ে আছে’[38]

ফরওয়ার্ড ব্লক গঠনের পরে ১৯৪১ সালে হিন্দু মহাসভার ভাগলপুর অধিবেশনের সময় সাভারকর লিখলেন—

‘কিন্তু কংগ্রেস, ফরোয়ার্ড ব্লক এবং ভারতের ওই সব সংগঠন, যারা ভৌগলিক রাষ্ট্রবাদের মিথ্যে ধারণাকে মানে, তারা বাস্তবিক রাষ্ট্রবাদের এই অবধারণার বিরুদ্ধে পাপের অংশীদার’[39]

এখানে ‘বাস্তবিক রাষ্ট্রবাদ’ বলতে সাভারকরের সাংস্কৃতিক হিন্দু রাষ্ট্রবাদকে বোঝানো হয়েছে।

জীবনীলেখক ধনঞ্জয় কীরের মনে হল না যে জাপানকে আটকাতে বৃটিশ ফৌজে যোগ দিয়ে লড়াই করা এবং জাপান-জার্মানির সঙ্গে মিলে ব্রিটিশ ফৌজের সঙ্গে লড়াই করার পরামর্শ একেবারে পরস্পরবিরোধী অবস্থান?

এ’ধরণের আরও গল্পকথা সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব চোখে পড়ে। লণ্ডনে গান্ধীজিকে ১৯০৬ সালে নিরিমিষ খাওয়া নিয়ে ব্যঙ্গ, আন্দামানে বাঙালী বিপ্লবী ননীগোপালের অনশন ভাঙাতে সাভারকরের উদ্যম, গদর পার্টির নেতা লালা হরদয়ালকে সমাজবাদীর বদলে হিন্দুত্ববাদী বলে প্রচার, ঝাঁসির পণ্ডিত পরমানন্দকে এবং মেদিনীপুরের গাঁয়ের ড্রইং শিক্ষক এবং ভিটেমাটি বেচে প্যারিসে গিয়ে বোমা বানানো শেখা হেমচন্দ্র দাস কানুনগোকে (মানিকতলা বোমার মামলার মূল এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট) সাভারকরের শিষ্য এবং ওঁর অভিনব ভারত দলের সদস্য বলে প্রচার ইত্যাদি।

সে’সব প্রসঙ্গ বারান্তরে হবে।

কিন্তু এই ধরণের কাজ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস চর্চার ধারাকে হালকা করে দিচ্ছে। একমাত্র উপায় সঠিক তথ্য এবং দলিলকে উপযুক্ত প্রমাণ সহ পাঠকদের সামনে পেশ করা। তাই এই লেখা।

======================================================================

[1] আত্রে, “কড়েছে পানি”, খন্ড-২ পৃঃ ৩১৫-১৬।
[2] ঐ, পৃঃ ৪৩২।
[3] শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, ‘বন্দীজীবন’(হিন্দি), পৃঃ ১৯৬-৯৭।সাক্ষী প্রকাশন, দিল্লি, ২০২০ সংস্করণ।
[4] সাভারকর; “হোয়ার্লউইন্ড প্রোপাগান্ডা,; পৃঃ ১৫৭-৬৮।
[5] সাভারকর; “হোয়ার্লউইন্ড প্রোপাগান্ডা, পৃঃ ৫০-৫১।
[6] Savarkar, “The First Indian War of Independence—1957”, pp: 140-41.
[7] পুরন্দরে; ““সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব”, পৃঃ ১৭৭।
[8] “সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব”, পৃঃ৩৩৩।
[9] গোখলে, “স্বতন্ত্রবীর সাভারকর”, পৃঃ ১১৫-১৮।
[10] ত্রৈলোক্য নাথ চক্রবর্তী, “জেলে তিরিশ বছর’, প্রকাশক শ্রী সুরেশ চন্দ্র মজুমদার, গৌরাঙ্গ প্রেস, আনন্দ -হিন্দুস্থান প্রকাশনী, কলিকাতা, ১৯৫৪।
[11] ঐ ।
[12] বারীন্দ্র নাথ ঘোষ, ‘দ্য টেল অফ মাই এক্সাইল-টুয়েল্ভ ইয়ার্স ইন আন্দামান’, আর্‍্য অফিস, পণ্ডিচেরি, ১৯২২।
[13] উপেন্দ্রানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’, পারুল প্রকাশন, কোলকাতা, ২০২০।
[14] সাভারকর সমগ্র, খন্ড ২, প্রভাত প্রকাশন, দিল্লি, পৃঃ ২৪২; এবং লেখক অশোক কুমার মিশ্রের “সাভারকর, কালাপানি অউর উসকে বাদ”, রাজকমল পেপারব্যাক্স, দিল্লি, ২০২২, পৃঃ ৯৬; এবং ধনঞ্জয় কীর, ‘বীর সাভারকর’, পপুলার প্রকাশন, মুম্বাই, চতুর্থ সংস্করণ, ২০১৯; পৃঃ ১৫৫।
[15] লোকসত্তা, ২৭ মে, ২০১৮।
[16] ‘ এ কমপ্লেক্স হিরো’, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৩১ অগস্ট, ২০০৪, দিল্লি।
[17] পুরন্দরে, ‘সাভারকর’, পৃঃ ১৭২।
[18] ঐ , পৃঃ ১৫৯।
[19] ১৪ অক্টোবর, ২০২১ এর টাইমস্‌ অফ ইণ্ডিয়া এবং ডেকান হেরাল্ড।
[20] আর সি মজুমদার, দ্য পেনাল সেটলমেন্টস অফ আন্দামান অ্যান্ড নিকোবর, মিনিস্ট্রি অফ কালচার, গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া, ১৯৭৫; পৃঃ ১৪৫-১৭৫ এবং পৃঃ ১৯৮।
[21] শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, “বন্দী জীবন” (হিন্দি), পৃঃ ২২৩, সাক্ষী প্রকাশন, দিল্লি , ২০২০ সংস্করণ।
[22] ঐ, পৃঃ ২০৬।
[23] ঐ, পৃঃ ২৫৯।
[24] ঐ, পৃঃ ২২৩-২২৪।
[25] Bombay Chronicle, 21 February, 1924 এবং বৈভব পুরন্দরে, “সাভারকর”, পৃঃ ১৬৮।
[26] বৈভব পুরন্দরে, “সাভারকর”, পৃঃ ১৭০।
[27] বিক্রম সম্পত, ‘ইকোজ ফ্রম এ ডিস্ট্যান্ট পাস্ট’, পেঙ্গুইন(২০১৯), পৃঃ ১৪৯।
[28] Lenin, Collected Works, Vol.14, Progress Publishers, Moscow. 1972. Pp-17-362 & Marxist.org
[29] বৈভব পুরন্দরে, “সাভারকর”, পৃঃ ২৫৬।
[30] ধনঞ্জয় কীর, বীর সাভারকর, পৃঃ ২৬০।
[31] ধনঞ্জয় কীর, বীর সাভারকর, পৃঃ ২৬০।
[32] সুভাষ চন্দ্র বসু,” দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’, পৃঃ ৩৪।
[33] রথ এন্ড চ্যাটার্জি; “ রাসবিহারী বসু”, পৃঃ ১৭১-৭৪।
[34] বম্বে ক্রনিকল, ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৪১।
[35] সুভাষচন্দ্র বোস, “টেস্টামেন্ট অফ সুভাষ বোস”, পৃঃ ২১-২৪।
[36] ঐ, পৃঃ ১৯৮।
[37] সাভারকর, ‘বিবিধ লেখ’, পৃঃ ৮০-৯১ , এবং পুরন্দরে, ‘সাভারকর’, পৃঃ ২৪৩।
[38] বোম্বে ক্রনিকল, ৪ আগস্ট, ১৯৩৯ এবং বৈভব পুরন্দরে “সাভারকর”, পৃঃ
[39] সাভারকর, হিন্দু রাষ্ট্র দর্শন, পৃঃ ১০২; Savarkar.org/en/pdfs

0 comments: