কালের অধিষ্ঠাত্রী কালী। কালের কলন করেন তাই তাঁর এই নাম। তিনি হরপ্পা সভ্যতায় পূজিত নিশা। তিনি বৈদিকদের কালরাত্রি। তিনিই বৈদিকদের ভীতি মিশ্রিত রাত্রিসূক্তের কেন্দ্রে। তিনি ঘোর অমানিশা রাত্রির অধিষ্ঠাত্রী, কার্তিকী অমাবস্যায় এজন্য তিনি পূজিত হন। কালী নামের উল্লেখ অবশ্য প্রথম পাই বেদে। অবশ্য সম্পূর্ণ অন্যভাবে– "কালী করালি মনজবা চ ধুম্রাক্ষী স্ফুলিঙ্গিনী লোলজিহ্বা"। মানে তখন হোমের শিখাকে কালী নামে ডাকা হত। এই শিখার তলায় পড়ে থাকত সাদা রঙের ছাই। যখন হিন্দু ধর্মে তন্ত্রের ভাব প্রবল হল, তখন এই শিখাকে উলঙ্গ দেবী হিসেবে কল্পনা করা হল, আর নিচের ছাইকে ভষ্ম মাখা শিবরূপে। প্রথমে কালীর দুই হাত ছিল। বিষ্ণুশর্মা যখন পঞ্চতন্ত্র লিখলেন তখন কালীর রমরমা দেখে ঠাট্টা করে বিষ্ণুর সাথে মিলিয়ে তিনি কালীকেও চতুর্ভুজ বলে উল্লেখ করেন। সেই থেকে মায়ের চারটি হাত। সব রঙ এসে কালো রঙে মেশে, এজন্য তিনি কালো রঙের দ্বারা প্রকাশিত হন। মার্কেণ্ডেয় পুরাণে কালীর জন্মকথা আছে। ক্রোধান্বিত চণ্ডীর তৃতীয় নয়ন থেকে বেরিয়ে এল ঘোর কৃষ্ণবর্ণের এক ভয়ঙ্করী দেবী। তারই নাম কালী। রক্তবীজের সেনাপতি চণ্ড ও মুণ্ডের মাথা কেটে হাতে ঝুলিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সেই কালরূপী কালী। দেবী চণ্ডী সন্তুষ্ট হয়ে কালীর নাম দিল চামুণ্ডা। কালীর হাতে যে নরমুণ্ডটি ঝোলে সেটা এই চণ্ড অথবা মুণ্ডর। এই কাহিনি থেকে জানা যাচ্ছে কালীর পরবর্তী রূপ চামুণ্ডা, কিন্তু পুরাতাত্ত্বিকদের মতে কালীর পূর্ব রূপ চামুণ্ডা।
প্রত্নসাক্ষ্য অনুসারে কালী নয়, চামুণ্ডাই প্রাচীন। পাল সেন আমলের প্রচুর চামুণ্ডামূর্তি বাংলার অনেক স্থানে মিলেছে। বর্ধমানে কেতুগ্রামের অট্টহাসের দ্বিভূজা চামুণ্ডামূর্তি ভয়াল রূপের। খিদের চোটে শরীরের হাড় কঙ্কাল যেন বেরিয়ে আসছে। দ্বিভুজা দেবী উবু হয়ে বসে আছে। অধরে রহস্যময় হাসির ঝিলিক। মূর্তিটি বর্তমানে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। এটি পালযুগের মূর্তি। বর্ধমানের কাঞ্চননগরের চামুণ্ডামূর্তিটি অসাধারণ সুন্দর। দেবী লোলজিহ্বা। চক্ষু কোটরাগত। গলায় মুণ্ডমালা। অষ্টভূজা। ডানদিকের দুহাতে ত্রিশূল, অসি, নরমুণ্ড। বামদিকের দুটি হা্তে নরমুণ্ড, পরশু ও একহাতের অনামিকা কামড়ে ধরেছে দেবী। পদতলে শায়িত শব। দেবী নৃত্যরত, নতকুচ, শরীরের শিরা উপশিরা দৃশ্যমান। মন্তেশ্বরের বা দিগনগরের চামুণ্ডামূর্তি দুটিও অসাধারণ।
সমগ্র দিনাজপুর থেকে আবিষ্কৃত হয় অগণিত পাল যুগের চামুণ্ডা মূর্তি। এখান থেকে কিছু নৃত্যরতা চামুণ্ডা মূর্তিও পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয় এই অঞ্চলে চামুণ্ডার মুখা পুজোর বহুলাংশে প্রচলিত। বর্তমানে কালী পুজোর সময় জিভ যুক্ত জীর্ণ শরীরের চামুণ্ডা মূর্তির পুজো হতে দেখা যায়। দক্ষিণ কলকাতার চেতলা অঞ্চলে আয়োজিত চামুণ্ডা কালী, আদি চামুণ্ডা, রক্ত চামুণ্ডা নামক এই সব দেবীর পুজোয় মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে পাল ও সেন যুগের চামুণ্ডার প্রভাব অবশ্যই আছে। এমন পুজো চেতলার সন্নিকটে অবস্থিত দুর্গাপুর ব্রিজের নিকটও আয়োজিত হয়। তাছাড়া বেহালা, ভবানীপুর হরিশ পার্ক, সিঁথির মোড় অঞ্চলেও এমন সার্বজনীন বা পারিবারিক চামুণ্ডা পুজো হয়। ভবিষ্যতে এই মূর্তিগুলোও হয়তো চামুণ্ডা নিয়ে গবেষণা বা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে উপস্থিত হবে। তবে চামুণ্ডার রকমফেরের মধ্যে একটি জনপ্রিয় ঐতিহাসিক রূপ হল চর্চিকা বা চর্চা। শব্দটির অর্থ ভয় দেখানো। অর্থাৎ যে দেবী ভয়ঙ্করী। পালযুগে জনপ্রিয় দেবী ছিল চর্চিকা। সিয়ান শিলালেখে এ বিষয়ে উল্লেখ্য তথ্যাদি মেলে। সুকুমার সেনের মতে, "এই চামুণ্ডা-চর্চিকাদেবী থেকেই আধুনিক কালীর উদ্ভব হয়েছে"।
মুর্শিদাবাদ জেলার সালার থানার শিমুলিয়া গ্রাম। এক অতি প্রাচীন জনপদ। প্রাচীন নাম সোমালিয়া। দ্বাদশ শতকের বল্লাল সেনের নৈহাটি তাম্রশাসনে গ্রামটি মুদ্রিত হয়ে আছে সোমালিয়া নামে। এ গ্রামেই জন্মেছিলেন প্রাকচৈতন্যযুগের মহাভারত অনুবাদক কবি রামচন্দ্র খান। এই গ্রামেই রয়েছে পালযুগের একটি অপূর্ব বিরল ব্যতিক্রমী চামুণ্ডা-চর্চিকার প্রস্তরমূর্তি। সালার রেল স্টেশন থেকে নেমে বাস বা রিক্সা, ভটভটি ভ্যানে করে শিমুলেতে অনায়াসে পৌঁছানো যাবে। অঞ্চলটার চারিদিকে শুধু ইতিহাসের হাতছানি। দেখতে পাবেন একাধিক প্রাচীন বিষ্ণুবিগ্রহ ও হাল আমলে গড়ে ওঠা বড় বড় মন্দির। এদের মাধ্যমেই আপনি হয়তো একসময় পৌঁছে যাবেন প্রাচীন সোমালি গ্রামে। কারণ, এইগ্রামেই রয়েছে বিরল চামুণ্ডা-চর্চামূর্তিটি। এই সব মূর্তি আমার স্বচক্ষে দেখা। সে সময় আমার ক্যামেরা-মোবাইল ছিল না– তাই মূর্তিগুলির বর্ণনা লিখে রাখলেও, কোনও ছবি তুলে রাখা সম্ভব হয়নি।
গঠনের দিক থেকে ভারী অদ্ভুত। উচ্চতায় প্রায় দেড় ফুট। চওড়া দশ ইঞ্চি। খানিকটা ভগ্ন হলেও অপূর্ব সৌন্দর্যময়। নীচে শায়িত শিব। সামান্য কাত হয়ে যেন শুয়ে আছে। দেবী ঈষৎ কটি হেলিয়ে সমপাদস্থানিক ভঙ্গিমায় দণ্ডায়মান। দু পাশে দেবীর দুই সহচর-সহচরী। ডানদিকে নিঃসন্দেহে পুরুষ। বাম হাঁটুর ওপর এক হাত রেখে অপর হাতে অস্ত্র নিয়ে প্রদর্শিত। বামদিকের মূর্তিটি যতদূর সম্ভব সহচরী। মাথায় জটামুকুট কিংবা পাগড়ি পরা। চর্চিকা অষ্টভুজা। ডানদিকের চার হাতের ঊর্ধ্ব হস্তে অভয় মুদ্রা, মারণাস্ত্র, নরমুণ্ড আর এক হাত দিয়ে সে নরমাংস চিবিয়ে খাচ্ছে। বামদিকের চার হাতের ঊর্ধ্বহস্তটি ডান হাতের মতোই। নরমুণ্ডধরা এবং একটি দীর্ঘ গদা ধরে আছে। ডান ও বামদিকের দুটি হাত দিয়েই সে নরমাংস গোগ্রাসে খাচ্ছে। হাড়কঙ্কালসার দেহ। উদরে বৃশ্চিক চিহ্ন। মুখমণ্ডলে পুরুষালি ভাব। দেবী ত্রিনয়নী। মাথায় সর্পমুকুট। দেহের তুলনায় কান দুটি দীর্ঘ। পরেছে কুণ্ডল। একচালিতে দেবীমূর্তি খোদিত। পাদপীঠে পদ্ম নেই। চালির দুদিকে কোনও বিদ্যাধর বা বিদ্যাধরী নেই। নেই চালির শীর্ষবিন্দুতে কীর্তিমুখ। পরিবর্তে ডানা মেলা শকুনি। অভিনব মূর্তি পরিকল্পনা। জৈন বা বৌদ্ধরা যে চামুণ্ডা বা চর্চা পুজো করতেন তা ছিল সম্পূর্ণ অহিংস রীতির। কে জানে এই চর্চিকা হয়তো তাঁদের পূজিত দেবীমূর্তি।
পালযুগে চর্চা অন্যতম জনপ্রিয় দেবী– একাদশ শতাব্দীর নয় পালের রাজত্বকালে মূর্তিশিবের বানগড় তাম্রলেখে "ওং নমশ্চর্চ্চিকায়ৈ" বলে প্রশস্তি উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, দেবী চর্চিকা বা চর্চা যেন জগৎকে রক্ষা করে। লেখে চর্চাদেবী সম্পর্কে দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মেলে। দেবী চর্চা খাদ্যের অভাবে আকুল হয়ে শুষ্ক তনু ধারণ করেছে এবং নরমুণ্ডের মালা পরে জগৎ রক্ষা করছে। এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় চামুণ্ডার সঙ্গে চর্চার মৌলিক পার্থক্য আছে। অর্থাৎ চামুণ্ডার মতো হাড়কঙ্কালসার শরীর হলেও দেবী কালীর মতো তার গলায় থাকে নরমুণ্ডের মালা। সিয়ান শিলালিপি থেকে জানা যায় নবম শতকের অন্যতম পালবংশীয় রাজা মহেন্দ্র পাল ছিলেন চর্চিকাদেবীর একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি সুবিশাল প্রস্তরমন্দিরে দেবী চর্চিকার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজা নয় পাল পরবর্তীকালে এই মন্দিরে একটি শিলাবলভী ও সোপান নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।
বজ্রবারহী বা চর্চা বা চামুণ্ডা চর্চা শুধু প্রস্তরমূর্তিতে নয়, টেরাকোটা মন্দির ফলকেও স্থান পেয়েছে। বীরভূম, দাঁইহাট,গুপ্তিপাড়াতে এমন ফলক আমি নিজে দেখেছি। সঙ্গের ছবিতে রইলো বীরভূম জেলার ঘুরিষা অঞ্চলে অবস্থিত টেরাকোটার রঘুনাথ মন্দির-গোত্রের দেবী চামুণ্ডার রিলিফ ভাস্কর্য। বাংলার জনপ্রিয়তম দেবী কালীর প্রকৃত ঐতিহাসিক উৎস সন্ধান করতে হলে চর্চা ও চামুণ্ডা– এই দুই দেবীর সম্পর্কে পড়াশোনা করা খুব জরুরি। হয়তো এই ইতিহাসের সূত্র ধরেই মা কালীর সম্পর্কে আরও তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হতে পারে। চিত্তাকর্ষক বিষয় হল, পালযুগের বাংলায় বৌদ্ধদের মধ্যেও কালী পূজিত হতেন এবং মা কালীর বর্তমান মূর্তিরূপের পেছনে বৌদ্ধ তন্ত্রেরও অবদান আছে। বৌদ্ধদের মহাযান সাধনায় এবং বজ্রযান তন্ত্রে কালিকার উল্লেখ আছে। কালিকা হলেন মহাকালের পূর্ব দক্ষিণ দিকের অধিষ্ঠাত্রী। কালিকা কৃষ্ণবর্ণা, দ্বিভুজা, নগ্নিকা। এঁর হাতে কর্ত্রি ও নরকপাল (বিকল্পে নরদেহ)। মুক্তকেশী এই দেবী মুণ্ডমালা ধারণ করেন এবং দন্তব্যাদান করে থাকেন। ইনি ত্রিলোচনা, প্রত্যালীঢ়পদা ও শবারূঢ়া।
মধ্যযুগের বাঙালির তন্ত্রের জগতে কালীর গুরুত্ব সর্বাধিক। তন্ত্রের সমস্ত সাধনক্রমের ধারাকে কালীতত্ত্বের সমুদ্রে সমন্বিত করার যে উদ্যোগ পালযুগের শেষার্ধে আরম্ভ হয়েছিল; তার চরম রূপায়ণ ঘটে মধ্যযুগে। ভৈরবীতন্ত্রে বলা হয়েছে :
"দক্ষিণকালিকা দেবী সারাৎসারতরা পরা।
বিশেষত কলিযুগে তৎ সমা দেবতা নহি।।
কলৌ কালী নান্যদেবতা নাস্তি কলৌ যুগে।
একৈব কালী সারসর্ব্বস্ব কলৌ যুগে কীর্তিত।।"
সমস্ত আরাধ্যাগনেরও পরম সারাৎসারতমা হলেন শ্রীমদ্দক্ষিণকালী। বিশেষত কলিযুগে তার মতো কৃপাময়ী এবং তৎক্ষণাৎ সিদ্ধিপ্রদায়িনী কোনো দেবতা নাই। কলিযুগে একমাত্র কালী ভিন্ন কোনো গতি নাই। কলিতে কালী ভিন্ন আর অন্য কোনো মুক্তিপ্রদ দেবতা নাই, একা কালীই কলিযুগের সারসর্ব্বস্বরূপে কীর্তিত হয়েছেন। বজ্রযানে কালীর আদিরূপের আভাস থাকলেও তার বর্তমান রূপটি সহজ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে সেনযুগ এবং তার পরবর্তী সময়েই পরিপূর্ণ বিকশিত হয়। দক্ষিণাকালী, বামাকালী, রক্ষাকালী, শ্মশানকালী, নির্বাণকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী প্রমুখ অগণিত রূপভেদ এই সময় সুপ্রচলিত হয়ে ওঠে। আবার সাধনমার্গ অনুযায়ী তাঁর বিদ্যারাজ্ঞী রূপের বিশদ ধারণাও এই সময়ের তন্ত্রে বিশদে বর্ণিত। আবার কাশ্মীরের তন্ত্রধারা থেকেও কালীর বেশ কয়েকটি রূপ এই সময় কালীকুলে গৃহীত হয়; যাঁদের বিশদ উল্লেখ অভিনবগুপ্তের তন্ত্রালোকে পাওয়া যায়।
মধ্যযুগ বাঙালির জাতীয় জীবনের ক্রান্তিকাল। অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহিঃশত্রুর সাথে নিয়ত সংঘর্ষরত বাঙালির কাছে এই সময় মাতৃকার ভয়ঙ্করী ভয়হারিণী রিপুদলনী রূপটিই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। যেহেতু সহজ আন্দোলনের সময়ে উড্ডিয়ানে প্রবর্তিত সাধনক্রমে আরাধিতা মাতৃকাগণের সাধারণ বৈশিষ্ট্যই এইটি; তাই অক্ষোভ্যকুলের মাতৃরূপই নানা বিবর্তনের মাধ্যমে এই সময় তন্ত্রের প্রধান অন্বিষ্ট বিষয়। এই কারণেই মধ্যযুগের তন্ত্রে কালীর মধ্যে অবলীলায় মিশে গেছেন চর্চিকা, নৈরাত্মা, পর্ণশবরী, বজ্রযোগিনী, বজ্রবর্ণিনী, বুদ্ধডাকিনী। মহাকাল কিছুটা রূপান্তরিত হয়ে আজও আছেন। কুল্লা, কুরুকুল্লা প্রমুখ কালীর পঞ্চদশ নিত্যার অন্তর্গত হয়েছেন। এমনকি সুদূর অতীতের পক্ষীমাতৃকার স্মৃতিবাহী বলাকিনী মাতৃকাও কালীর দ্বাদশ নিত্যা রূপে পরিগণিত হয়েছেন। তাঁদের সকলেরই রূপ একান্তভাবেই উড্ডিয়ানে প্রবর্তিত সাধনক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁরা সবাই নীলবর্ণা, খড়্গধারিণী, মুণ্ডমালিনী, অট্টহাস্যরতা, দিগম্বরী। বজ্রযানের স্মৃতি হিসেবে মাতৃকার মণ্ডলে ডাকিনী, যোগিনী, যক্ষ, বটুক, বেতালদের উপাসনাও অব্যাহত থেকে যায় মধ্যযুগে। অন্যদিকে বজ্রযোগিনীর সাধনক্রমই আবার ছিন্নমস্তা প্রচণ্ডচণ্ডিকার সাধনমার্গ নির্মাণ করেছে। দুইপাশে ডাকিনী ও বর্ণিনীকে নিয়ে মিলনরত যুগলের উপর নৃত্যরতা মাতৃকার যে রূপটি নাঢ়া নাঢ়ীর দ্বৈতরহিতা মাতৃকার তত্ত্বের মূল ভাবনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল; সেই রূপটিই আজও ছিন্নমস্তার সাধকগণ ধ্যান করেন। আজও তন্ত্রের ধারায় কালী তারা ও ছিন্নমস্তা এই তিন মাতৃকাই সর্বাধিক জনপ্রিয়।
মধ্যযুগের তন্ত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল দশমহাবিদ্যার সাধনক্রমের উত্থান। দশমহাবিদ্যার ধারণা সেনযুগ থেকেই জনপ্রিয় হচ্ছিল। মধ্যযুগে তার চরম সমৃদ্ধি ঘটে। কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামুখী, মাতঙ্গী ও কমলার উপাসনা আজকের তন্ত্রের সিংহভাগ অধিকার করে আছে। এর মধ্যে বগলামুখী, ছিন্নমস্তা প্রমুখের সাধনক্রম বেশ প্রাচীন। এঁদের কিছু নাম যেমন তন্ত্রের আদিরূপের ইঙ্গিত দেয় (বগলামুখী>বকের মতো মুখ, পক্ষীমাতৃকার স্মৃতিবাহী); অন্যদিকে ব্রহ্মযামল, রুদ্রযামল প্রভৃতিতে উল্লিখিত কয়েকটি স্তব ও কবচ খুব সম্ভবত মাৎস্যন্যায়ের অরাজক অবস্থার স্মৃতি বহন করে। তবে শ্রীকুল ও কালীকুলের বিভিন্ন ধারা থেকে এই দশজন মহাবিদ্যার একত্র সমাবেশ সেনযুগ ও তার পরবর্তী সময়ের তন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য। এবং এই দশমহাবিদ্যার মধ্যেও কালীই সর্বাগ্রগণ্য রূপে পূজিত হয়েছেন।
মধ্যযুগের কালীসাধনার একটি দুঃখজনক বৈশিষ্ট্য হল গুহ্যাচারের প্রাবল্য। উৎকৃষ্ট সাধনদর্শন যখন মুষ্টিমেয় সাধক পরম্পরার কুক্ষিগত হয়ে যায়; তখনই গণধর্ম বিনষ্ট হয়। জাতীয় জীবন শিকড়বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আজ যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি তন্ত্রের বিষয়ে মারাত্মক অজ্ঞতা পোষণ করেন; মাতৃকার উপাসনার চিন্তায় ভক্তির থেকে ভয় বেশি পান; তার কারণ– এই গুহ্যাচারের প্রাদুর্ভাব। কিছু অপ্রয়োজনীয় কঠোর নিয়মের শৃঙ্খলে সহজ ধর্মভাবনাকে আবদ্ধ করার ফলেই তন্ত্রের সাথে সমাজের বৃহত্তর অংশের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। আর দীর্ঘদিন সমাজবিচ্ছিন্নতার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম অনাচার ও কদাচারের প্রাবল্য। পালযুগের আগে মাৎস্যন্যায়ের সময়ে কামাচার অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। পালযুগে মহেন্দ্রপালের মৃত্যুর পর থেকে মহীপালের সময়ের আগে পর্যন্ত বজ্রযানে অধঃপতনের বীজ প্রবেশ করেছিল। নাঢ়া নাঢ়ীর নেতৃত্বে সিদ্ধাচার্যগণের সহজ আন্দোলন তার অবসান ঘটিয়েছিল। কিন্তু সেনযুগের পর থেকে একটিও শাক্ত গণ আন্দোলন ঘটেনি।
মধ্যযুগের তন্ত্রে সার্বজনীন বন্দনার পরিবর্তে গুরুত্ব পেয়েছে রহস্যপূজা। মাতৃকার সাধনক্রমের মধুরতার পরিবর্তে প্রতিটি সাধনক্রম কতটা ভয়ানক; সামান্যতম ত্রুটিতেও কি ভয়ঙ্কর সর্বনাশ নেমে আসতে পারে; তার ঢক্কানিনাদ এই সময়ের অধিকাংশ তন্ত্রশাস্ত্রের একটি ধ্রুব বৈশিষ্ট্য। এর বিষময় পরিণাম এই হয়েছে যে ভারতের প্রধানতম মাতৃকা উপাসক মহাজাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আজ মাতৃ-পুজোর রীতি ও গুরুত্ব বিষয়ে কিছুই জানেন না। আজও যে তন্ত্রের দেবীগণকে অতি সহজেই অপশক্তি বলে অপপ্রচার করে দেওয়া যায়; তন্ত্রের নামে অযোগ্য সাধকরা যথেচ্ছ কদাচার করতে পারে; তার জন্য প্রধান দোষী শাক্তধর্মের এই অপ্রয়োজনীয় গুহ্যাচার। আজও শাক্তধর্মের এই সুমহান ধারাটি কয়েকটি সাধক পরম্পরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে।
সাকার উপাসনার সকল বিগ্রহের মধ্যে কালীমূর্তি আমার সর্বাধিক প্রিয়। কালী আমার অন্যতম প্রশান্তির আশ্রয়। তিনি আমায় শূণ্যরূপে পূর্ণকে খুঁজে ফেরার ডাক দিয়েছেন। যতবার এই নিরাবরণ, নিরাভরণ প্রতিমার দিকে তাকাই, বড় বেশি করে মনে পড়ে মানুষের কি অসম্ভব প্রচেষ্টা সেই শূণ্যতারও অতীত অনন্তকে চেখে দেখার। এই মৃত্যুরূপা প্রতিমা দক্ষিণ করে যেই কাম্যবস্তু বিলিয়ে চলেছেন, বাম করে তাকেই খণ্ডন করছেন অবলীলায়। এ বৈপরীত্য নয়। এ পূর্ণতা। কালী নিশাময়ী। কালী ঘোর তমিশ্রার আড়ালে থাকা সেই শক্তি, যাঁর কাছে পৌঁছে চাইবার কিছু থাকে না। সেই অনিরুদ্ধ পথে একে একে খসে পড়েছে সমস্ত আকাঙ্ক্ষা। 'কে তুমি' থেকে ততক্ষণে পৌঁছানো গেছে 'কে আমি'র ভূমিতে। বিশ্বরতি এসে ঠেকেছে আত্মরতিতে। আদপে কালীর রতি দুইয়ের নয়। একেরই উল্লাস। তিনি তো স্বেচ্ছাচারীণী। স্ব ইচ্ছায় বিচরণ করছেন সেই ভূমায় যেখানে স্ব-বই কিছুই নেই।
কালের খেলার অনেক অনেক আগে যা জেগে ছিল একা, মায়াবিম্বে তাই খণ্ডিত হয়ে গেছে টুকরো টুকরো সময়ে। সেই অজানা সময়ের কিনারে বসে মা আমার গেঁথে চলেছেন বিনি সুতোর মালা। ইচ্ছার মালা। যে ইচ্ছা ধীরে রূপ নেবে ক্রিয়ায় আর পরিণতি পাবে জ্ঞানে। আমার মূঢ়বুদ্ধিতে যে ধৃষ্টতা দেখালাম, একনায়িকা তা কৌতুকে উড়িয়ে দেবেন আর গুণীজন নিতান্ত অভাজন ভেবেই ক্ষমা করবেন এমন প্রার্থনা করি। দেবী কালীকে আমাদের এই বাংলা যেভাবে আপন করে নিয়েছে, তা ভারতের আর অন্য কোনো রাজ্য করতে পারেনি। বাংলার কোণায় কোণায় ছড়িয়ে আছে ছোট বড় অসংখ্য কালী মন্দির। তা গুনে শেষ করা যাবে না। পুজাের সংখ্যার দিক দিয়ে কালী কিন্তু দুর্গাকে হাসতে হাসতে দশ গোল দেবেন। বিভিন্ন জায়গায় কালীর কত বিচিত্র সব নাম, বিচিত্র সব রূপ! অনেক জায়গাতেই কালীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা ধরণের শিহরণ জাগানো কিংবদন্তি।
তন্ত্র অনুসারে, কালী দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত দশজন প্রধান তান্ত্রিক দেবীর প্রথম। শাক্ত মতে, কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। ব্রহ্মযামল নামক তন্ত্রগ্রন্থের মতে, কালী বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কালীর সংহার আর সৃষ্টির কনসেপ্ট অবশ্য আরও একটু পরে আসে। এ অবশ্য নতুন কিছু না। জরাথুস্ট্র তাঁর ধর্মে সাদা ও কালো– সোজা কথায়, সৃষ্টি আর সংহারের দুই দেবতার কথা বলেছিলেন– আহুর মাজদা ও অহ্রিমান। ইহুদীদের ক্ষেত্রে সেটি জিহোবা ও স্যাটান। এই দ্বন্দ্ব গোটা বিশ্বকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কালীর ক্ষেত্রে অবশ্য এই দুই রূপ এক দেহে। অবশ্য তার ভ্যারাইটি আছে। ভদ্রকালী মূলতঃ কল্যাণ করেন, আর চামুন্ডা যেমন ধ্বংস। এর মাঝে আরও ছয় রকম আছে– দক্ষিণা কালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্রীকালী, শ্মশানকালী ও মহাকালী।
আমরা ‘কথামৃত’তে পাই– শ্রীরামকৃষ্ণদেব মা কালী নিয়ে কেশবচন্দ্র সেনকে বলছেন, “তিনি নানা ভাবে লীলা করেছেন।... যখন সৃষ্টি হয় নাই, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, পৃথিবী ছিল না, নিবিড় আঁধার, তখন কেবল মা নিরাকারা মহাকালী... মহাকালের সঙ্গে বিরাজ করছে। শ্যামাকালী অনেকটা কোমল ভাব... বরাভয়দায়িনী। গৃহস্তবাড়িতে তাঁরই পুজো হয়। যখন মহামারী, দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি হয়... রক্ষাকালীর পুজো করতে হয়। শ্মশানকালীর সংহারমূর্তি। শব, শিবা, ডাকিনী, যোগিনী মধ্যে শ্মশানের উপর থাকেন। রুধিরধারা, গলায় মুণ্ডমালা, কটিতে নরহস্তের কোমরবন্ধ। যখন জগৎ নাশ হয়, মহাপ্রলয় হয়, তখন মা সৃষ্টির বীজ কুড়িয়ে রাখেন। গিন্নির কাছে যেমন একটা ন্যাতা-ক্যাতার হাঁড়ি থাকে, আর সেই হাঁড়িতে গিন্নি পাঁচ রকম জিনিস তুলে রাখে।... মা ব্রহ্মময়ী সৃষ্টি-নাশের পর ওইরকম সব বীজ কুড়িয়ে রাখেন।” বীজ ধ্বংস হলেই একটি গাছের জন্ম হয়। ধ্বংসের মধ্যেই আছে সৃষ্টির অনুপম সৌন্দর্য।
তন্ত্র মতে, দেবী কালীর বেশ অপ্রচলিত একটি রূপ শ্রীকালী। গুণ ও কর্ম অনুসারে তন্ত্র দেবীর এই রূপের বর্ণনা করে। বলা হয়, এই শ্রীকালী দারূক নামের অসুরকে বধ করেছিলেন। তন্ত্র আরও জানায়, শিবের শরীরে প্রবেশ করায় তাঁর কণ্ঠে আটকে থাকা বিষের প্রভাবে এই দেবীর সর্বাঙ্গ কালো হয়ে যায়। শিবের মতো এই দেবীও ত্রিশূল ধারণ করে থাকেন এবং তাঁরও অলঙ্কার সাপ। এই শ্রীকালী যেমন অশুভ শক্তির বিনাশ করেন, তেমনই আবার ভক্তদের রক্ষাও করেন বিপদ থেকে। সিদ্ধকালী বা সিদ্ধেশ্বরী কালীর সম্মুখে সাধারণত সাধকরা সাধনা করেন। দেবীর বাম হাতের খড়্গের সমান্তরালে শবরূপে শায়িত শিবের মাথা থাকে। ঠিক এমনটাই দেখতে কলকাতার ঠনঠনিয়ার কালী। জরাসন্ধ পূজিত আদি গুহ্যকালী কেমন দেখতে ছিলেন, তা জানার অসম্ভব কৌতূহল কোনওদিনই মিটবে না। বীরভূমের আকালিপুর যে মাতৃমূর্তি দেখি, তা মধ্যযুগের শেষে নির্মিত মূর্তি। সেই গুহ্যকালী মা সর্পের উপর বিরাজিতা। দেবী দ্বিভুজা, সর্প-উপবিত-ধারিণী। তাঁর মস্তকে সর্পের সহস্র ফনাযুক্ত মুকুট। কলকাতার মুক্তরাম বাবু স্ট্রিটের গুহ্যকালী মার আবার আঠারোটি অস্ত্র শোভিত হাত বর্তমান। অষ্টম থেকে দশম শতকে পালযুগে পূর্ব ভারতে গুহ্যকালী অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন, এই সময় থেকেই তাঁর উপাসনার ইতিহাস লিপিবদ্ধ। গুহ্যকালীর আট হাত, কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে চুয়ান্ন হাতও হতে পারে। এছাড়া নেপালের শিল্পকলা নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে দেখেছি, দশ মুখযুক্ত গুহ্যকালীও হয়। চিত্তাকর্ষক বিষয় হল– তাঁর মুখগুলি পিরামিডের মত উপর থেকে নিচে চারটি স্তরে বিন্যস্ত, অন্যান্য বহু-মুখী পৌরাণিক দৈব চরিত্রের মত সব মুখগুলি একটি রেখায় একই স্তরে পাশাপাশি নেই। গুহ্যকালীর দশটি আননের সবগুলি মানবীয় নয়, পশু পাখিও দ্রষ্টব্য। শুনেছি, এই গুহ্যকালীর সাধনা অতীব কঠিন।
কালী মায়ের মূর্তিতে দক্ষিণপদ আগে প্রসারিত থাকলে অথবা শবরূপী শিবের বুকের ওপরে থাকলে সে মূর্তি দক্ষিণাকালী এবং বামপদ এই ভঙ্গিতে থাকলে সেই মূর্তি বামাকালী বলে খ্যাত হয়। মায়ের দক্ষিণপদ সম্মুখে থাকলে বলা হয় দক্ষিণদিকের অধিপতি যম মায়ের ভয়ে পালিয়ে যান, অর্থাৎ মা তাঁর সন্তানদের মৃত্যুভয় নিবারণ করেন। দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর বিগ্রহটিকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। জনমানসে এই কালী মূর্তির বিপুল গ্রহণযোগ্যতা। বামদিকে পা সম্মুখে সম্প্রসারিত থাকলে মা সমস্ত বাম/বিপরীত/বিভ্রান্তি নিরসন করেন, বিপরীত দশা থেকে সন্তানদের রক্ষা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সব সিদ্ধেশ্বরী কালীই বামা কালী; কিন্তু সব বামা কালী সিদ্ধেশ্বরী কালী নয়। কিন্তু এর বাইরেও সমগ্র বাংলা জুড়ে বহু রকমের কালী মূর্তির সন্ধান মেলে। সে-সব অতি জাগ্রত ও নিত্যপূজিত।
বৃহৎ তন্ত্রসারঃ প্রণেতা কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মহাশয় দক্ষিণাকালিকার ধ্যানে স্পষ্টতঃ উল্লেখ করেছেন— "মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম্"। কিন্তু সেই রূপ বহুল প্রচারিত নয়। এই দেবী কোথাও "বিদ্যারাজ্ঞী", তো কোথাও "শবশিবা কালী" নামে পরিচিত। নদীয়ায় রয়েছে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র সেবিত জগৎজননী বিদ্যারাজ্ঞীর মূর্তি। রাস-উৎসবে শবশিবা মায়ের যে রূপটি দু-তিনটি সার্বজনীন পুজোয় আমরা দেখতে পাই, তা এঁনার থেকেই অনুপ্রাণিত। এছাড়া এমন সার্বজনীন পুজো শান্তিপুর, দাঁইহাট ও কলকাতার চেতলা অঞ্চলেও আয়োজিত হয়। কৌলসাধক শ্রী শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব আরাধিতা শ্রীশ্রী সর্বমঙ্গলা কালীমাতার মন্দির হাওড়ার বাকসাড়ায় অবস্থিত। নাম সর্বমঙ্গলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি শবশিবা কালী। বেলমুড়ির আনন্দময়ীতলাতেও বিদ্যারাজ্ঞী দেবীর মন্দির আজও বর্তমান।
বিদ্যারাজ্ঞী কালীবিগ্রহের চরণলগ্ন শ্বেতবর্ণ পুরুষমূর্তিটিকে আমরা শবরূপ সদাশিব বলে থাকি। যদ্যপি এই শ্বেতবর্ণ শবরূপসদাশিব শৈব দর্শনের সদাশিব নয়। এনার ধ্যান মন্ত্রও পৃথক। শবরূপসদাশিবের ধ্যান মন্ত্রটি খেয়াল করলে, দেখতে পাই— শুরুতেই বলা হচ্ছে "শুদ্ধস্ফটিকসঙ্কাশং মহাকাল ত্রিলোচনাম"। অর্থাৎ, এই শ্বেতবর্ণ মহাপ্রেত শবরূপশিব শুদ্ধ স্ফটিকের ন্যায় বর্নোজ্জ্বল এবং ইনি ত্রিলোচন মহাকাল। ধ্যানের মধ্য অংশে দেখতে রয়েছে— "কালীপাদ ব্যবস্থিতম"। এর অর্থ, ইনি কালিকার চরণে স্থিত। আবার ঐ ধ্যান মন্ত্রের শেষে দেখা যায়— সেখানে বলা হচ্ছে "দেব্যাবাহনমুত্তমম্"। অর্থাৎ, এই মহাপ্রেত শবরূপী শিব কালীর উত্তম বাহন। এই কারণেই মা কালী শববাহনা, মায়ের বাহন মড়া বা শব।
আবার তন্ত্রে দেখতে পাই বলা হচ্ছে— "সপ্তপ্রেতপর্যাঙ্কে শবহৃচ্ছিবা শ্বেতরূপ মহাকাল হৃদয়াম্বোজনিবাসিনি"। যার অর্থ, সপ্তপ্রেতের উপর শবরূপ এবং শ্বেতরূপ মহাকালের হৃদয়ে শ্রীশ্রী মা দক্ষিণকালী চরণ স্থাপন করে কৃষ্ণ-ধুম্রবর্ণ শ্রীমন্মহাকালভৈরবের সহিত বিপরীত রতিতে স্থিতা থাকেন। অর্থাৎ, একটি বিষয় পরিষ্কার যে এক মহাকালই দ্বিবিধরূপে কালীমূর্তিতে বর্তমান। প্রথম মূর্তিটির মূল মূর্তির রঙ ঘোর ধুম্রবর্ণ। সেটি মায়ের সঙ্গে রতিতে সংযুক্ত এবং অপর মূর্তিতে ঐ মহাকালই নিজেকে শ্বেতবর্ণ যুক্ত সদাশিব বা শবশিব রূপে প্রকাশিত করেছেন কালিকার চরণের তলায় (দেব্যাবাহন রূপে)। মায়ের বাহন এই শবরূপ সদাশিব সাক্ষাৎ মহাকাল ভৈরবেরই একটি স্বরূপ।
মা কালীর পীঠ-পুজোয় পরাশক্তি, পরাপরাশক্তি, অপরাশক্তি ত্রয়ের উর্দ্ধে এই শবরূপ সদাশিব মহাকাল শায়িত। ইনি সত্ত্বগুণের প্রতীক— তাই শুক্লবর্ণ। ইনিই সূর্যস্বরূপ প্রকাশমান— তাই শুদ্ধস্ফটিক সাদৃশ্য। সূর্যও তাই স্ফটিক শিলায় পূজ্য। জগতের আত্মাস্বরূপ বা প্রণব স্বরূপ এই সূর্যের অনন্ত রশ্মি হতে পারে। কিন্তু সকল রশ্মির উৎস শুক্ল বর্ণ বা শুক্লরশ্মি। সূর্য বস্তুত এই শুক্লবর্ণ তেজশক্তি/তেজরশ্মির পুঞ্জিভূত অবস্থা। তাই মধ্যগগন স্থিত সূর্য শুক্লবর্ণ। কিন্তু এই পরমতত্ত্বস্বরূপ শুক্লবর্ণকেও অতিক্রম করে আছেন বর্ণাতীত তত্ত্ব অখণ্ড শুদ্ধাতিশুদ্ধ মহাশক্তি কালী। সমস্ত বর্ণের অতীত বলে এবং খণ্ডাভাসহীন অখণ্ড বলে ইনি ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ। তাই একাক্ষর মন্ত্রের ধ্যানে শুদ্ধস্ফটিক সাদৃশ্য শ্বেতবর্ণ শবরূপী সদাশিবস্বরূপ মহাকালের উপর বর্ণাতীতা কৃষ্ণবর্ণা কালী সরাসরি কখনো বাম কখনো দক্ষিণ চরণ অগ্রে বিন্যস্ত করে দণ্ডায়মান।
নিচ থেকে দেখলে— সূর্যস্বরূপ প্রকাশমান শুক্লবর্ণ শবরূপ সদাশিব মহাকাল যেন এর ভিত্তি। তদুপরি না ঘোর কালো না শুভ্র শুক্ল, তথাপি ঘোর ধূম্রবর্ণ মহাকাল বিরাজিত এবং তার উর্ধে বর্ণাতীতা কৃষ্ণবর্ণা কালী অধিষ্টিতা। উপর থেকে দেখলে— প্রথমে গুনাতীতা-বর্ণাতীতা কালী। তারপর আসে নির্গুণ-ধূম্রবর্ণ মহাকাল এবং তার নিচে আছে শুদ্ধসত্ত্বময় শুক্লবর্ণ শবরূপ সদাশিব মহাদেব (তিনি মহাকালেরই আরেক রূপ)। তিনটি স্তর, তিন ভাবে স্থিত। এই তিন মূর্তি দিয়ে সগুন-নির্গুণাতীতা এবং সকল বর্ণাতীতা ঘোর কৃষ্ণবর্ণা কালীমূর্তি প্রকাশিত। অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা এটাই আজকের কালী মূর্তির আদিরূপ।
হুগলী জেলার খানাকুলের রাধানগর গ্রামের শ্মশান ভূমিতে ত্রিকোণাকৃতি মন্দিরে মা কালী মহাকাল রুপী বিষ্ণু এবং পদ্মযোনি ব্রহ্মার উপর উপবিষ্ট। দেবী রত্নাবলী আনন্দময়ী নামে পরিচিত। দেবীর ভৈরব হলেন ঘণ্টেশ্বর। এখানে শ্রীমৎ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মহাশয় সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন বলে অনেকের বিশ্বাস। এই সিদ্ধপীঠস্থানের মন্দিরে বংশ পরম্পরায় শ্রীমৎ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মহাশয়ের বংশধররাই দেবীর সেবা করে আসছেন। এই মন্দিরটির মাহাত্ম প্রচার করার জন্য সর্ব প্রথম উদ্যোগী হন শ্রী গৌরাঙ্গ আগমবাগীশ মহাশয়। তাঁর দাবী ছিল, এই মন্দিরটি নাকি সতীপীঠ এবং এখানে সাধক রামপ্রসাদ সেন এসেছিলেন। কিন্তু তা বিতর্কিত। তবে কেবলমাত্র শ্রীমৎ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মহাশয়ই নন, এই মন্দিরে শ্রীমৎ শিবরাম আগমবাগীশ মহাশয় এবং শ্রীমৎ শঙ্কররাম আগমবাগীশ মহাশয়ও সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। বর্তমানে এই মন্দিরের পূজকের আসন অলংকৃত করে আছেন শ্রী সমীর কুমার আগমবাগীশ মহাশয়।
হাওড়ার শিবপুর অঞ্চলের ওলাবিবিতলা থেকে একটু এগোলেই দেখা মিলবে হাজার হাত কালী মায়ের মন্দিরের। মন্দিরের উত্তর দেওয়ালে রূপোলী কেশর জুক্ত হলুদ রং এর পা মুড়ে বসা সিংহের ওপর দেবীর বাম পদ। দক্ষিন পদের অবস্থান এক মহাপদ্মের উপরে। দেবীমূর্তি উচ্চতায় বারো ফুটের মতো। মূর্তির বাম হাতে খড়গ এবং ডান হাতে পঞ্চশূল। এখানে দেবীর দুটি হাত বড় ও বাকি প্রতীকী হাতগুলি (৯৯৮ টি) ছোট। সেগুলি মূর্তির পিছনের দেওয়ালে চালচিত্রের মত লাগানো আছে (হাতের সঠিক সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক না করাই ভালো। এটি বিশ্বাসের বিষয়।)। বিগ্রহের গাত্রাবর্ণ সবুজ। দেবীর পরনে শাড়ী। দুই কাঁধে দুই সর্পফনা, মাথায় পঞ্চপুষের মুকুট। তার কিছু ওপরে রাজচ্ছত্র। দেবীর হাতে বলয়, কানে কানপাশা এবং উন্নত নাসিকায় নথ। ত্রিনয়নী প্রতিমার তেজপূর্ণ চোখের দিকে তাকালে ভয় লাগতে পারে। দেবীর লোল জিহ্বা প্রলম্বিত নয়।
এই সব ব্যতিক্রমী বিচিত্র কালী মূর্তি সমূহের সঙ্গে অবশ্যই উল্লেখ্য– কলকাতা, নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগরে শিবের ওপর পদ্মাসনে বসে থাকা মা কালীর ব্যতিক্রমী মূর্তির কথা। নবদ্বীপের পোড়ামাতলায় বসা কালীর নাম ভবতারিণী। কৃষ্ণনগরে সেই বসা-কালী আনন্দময়ী নামে পূজিত। কলকাতায় "বসা-কালী" নামেই তিনি রামদুলাল দে স্ট্রিটে পরিচিত। বারুইপুরের দক্ষিণ রামনগর কালীবাড়িতে রয়েছে এক বৈচিত্রময় নিমকাঠের কালী মূর্তি। স্থানীয় সূত্রধর ৩০০/৩৫০ বছর পূর্বে চতুর্ভূজা এই দেবীমূর্তি নির্মাণ করেন। দেবী মহাকালী বলে পূজিতা। বৈশিষ্ট– দেবীর লোলজিহ্বা নেই, তিনি হাস্যবদনাও নন। কালী পুজোয় পারিবারিক গুহ্যমন্ত্রে মায়ের বিশেষ পুজো অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতার ১৪২, মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে অষ্টাদশভুজা গুহ্যকালীর মূর্তি বর্তমান। তন্ত্রসাধক আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নেপালে এক দুর্গম পাহাড়ের গুহায় পেয়েছিলেন একটি অষ্টাদশভুজা গুহ্যকালী বিগ্রহ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আঠারো হাতের দেবী কালিকার উল্লেখ আছে চণ্ডীতে। গর্ভমন্দিরে পাথরের বেদীর উপর কাঠের সিংহাসনে দেবী বিগ্রহ কুচকুচে কালো তেল চকচকে। নেপাল থেকে আনা সেই ছোট্ট বিগ্রহটিও রাখা আছে সযত্নে। নিত্যপুজোও পেয়ে আসছেন দেবী। দালান-মন্দিরে গুহ্যকালী শায়িত শিবের উপর পদ্মাসনে বসে আছেন হাঁটু মুড়ে। গলায় মুণ্ডমালা। মাথায় রুপোর মুকুট। ত্রিনয়নী দেবী সবসনা। দেবীর আঠারো হাতে রয়েছে অভয়মুদ্রা, ঢাল, তলোয়ার, খড়্গ, কৃপাণ, শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম ইত্যাদি নানান রকমের আয়ুধ।
এই গুহ্যকালীর সূত্র ধরে জানাই, বীরভূম জেলার পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত গ্রাম ভদ্রপুর। এখানেই ছিল রাজা নন্দকুমারের প্রাসাদ। এর সংলগ্ন পশ্চিম দিকের একটি গ্রামের নাম আকালিপুর। তার দক্ষিণপ্রান্তে বাহ্মণী নদীর তীরে আজও বর্তমান ২৪০ বছরের পুরনো এক মন্দির। তা নন্দকুমারের স্মৃতি বিজড়িত। মন্দিরটি আটকোণা, যেটা অষ্টাঙ্গিক যোগের প্রতীক। এই মন্দিরের গর্ভে প্রতিষ্ঠিত কষ্টিপাথরের এক বিরল কালী বিগ্রহ। আমরা জানি, সাধক বা ভক্তের উপাসনা কার্যের নিমিত্ত ব্রহ্মের রূপ দেব-দেবীর মূর্তিতে কল্পিত। এখানে দেবীর অট্টহাসিযুক্ত মুখাবয়ব। তিনি দ্বিভুজা— বর ও অভয় মুদ্রাযুক্ত, নাগ-উপবিতধারিণী, নাগাসনে উপবিষ্টা। তাঁর মস্তকে পাঁচটি স্তরে বিন্যস্ত সহস্রফনা বিশিষ্ট মুকুট; তিনি নাগরূপী কঙ্কন, কাঞ্চী ও নুপুরধারিণী। সাধনার সর্বৎকৃষ্ট গুহ্য তত্ত্ব, এই বিগ্রহে নিহিত। আমাদের দেহের মুলাধারস্থ কুলকুণ্ডলিনী সাধনার দ্বারা জাগ্রত হয়। এর ফলে সাধক সমস্ত মায়া মুক্ত হন। দেবী যে সর্পকুণ্ডলে উপবিষ্টা, সেই সর্পই মুলাধারস্থ কুলকুণ্ডলিনীর প্রতীক। মূলাধার থেকে সুষুম্না কাণ্ড ধরে পরবর্তী স্তর গুলি হচ্ছে, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞাচক্র। এই সব কটি স্তর ভেদ করে সাধনা যখন আজ্ঞাচক্রে পৌঁছোয়, তখনই সিদ্ধিলাভ হয়। তারপরই চেতনার সহস্রদল মুক্ত হয়, যার প্রতীক সহস্র ফনার মুকুট।
এর সঙ্গে অবশ্যই বলতে হবে কৃষ্ণকালী বা কৃষ্ণকালীকার কথা। তিনি হলেন কৃষ্ণ ও কালীর সম্মিলিত রূপ। ইনি শাক্ত ও বৈষ্ণব উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শাক্ত-বৈষ্ণব-দ্বন্দ্ব মেটাতেই হয়তো এই বিগ্রহ পুজোর প্রচলন হয়েছিল। পুরাণনুযায়ী ব্রজে রাধারানি গোপীনী সহ যখন কৃষ্ণের সঙ্গে বিহার করছিলেন, এমন সময় জটিলা ও কুটিলা আয়ান ঘোষকে গিয়ে নালিশ করল। আয়ান যখন রাধাকে হাতে নাতে ধরবে বলে যায়, তখন কৃষ্ণ কালী রূপ ধারণ করেন আর রাধাও নিষ্ঠা ও ভক্তি সহকারে কৃষ্ণকালীর পুজো করতে থাকেন। এই দেখে আয়ান আনন্দে আপ্লুত হয়ে গেল। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল যে আয়ান ছিলেন কালীভক্ত। দেবীর বাৎসরিক পুজো অনুষ্ঠিত হয় মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী বা রটন্তী চতুর্দশী তিথিতে, এছাড়াও যে যে স্থানে তাঁর মন্দির আছে সেখানে নিত্য পুজো হয়। কলকাতার কালীঘাট শ্মশানের কৃষ্ণকালীর মন্দির খুবই প্রসিদ্ধ। কৃষ্ণকালীর ধ্যান মন্ত্র অনুযায়ী, কৃষ্ণকালী চতুর্ভুজা কৃষ্ণবর্ণা চূড়ামুকুট মণ্ডিতা। দক্ষিণহস্তে শঙ্খ ও খর্পর ধারিণী এবং নবযৌবনসম্পন্না। বাম হস্তে খড়্গ ও চক্র ধারণ করে আছেন এবং মুণ্ডমালা বিভূষিতা। গোপিনীদের দ্বারা অর্চিতা এবং নানালঙ্কার ভূষিতা। আয়ানের দ্বারা ভয়ত্রস্ত শ্রী রাধিকার দ্বারা পূজিতা। চতুর্বর্গ প্রদানকারিনী সেই দেবী ব্রহ্মরূপা সনাতনী। দারিদ্র্য শোক নাশকারিনী এবং মোক্ষদায়িনী। তবে বর্তমানে বাঁশী ও খড়্গ সহযোগে কৃষ্ণকালীর রকমারি মূর্তি দেখা যায়— সেখানে কোথাও তাঁর চার-হাত তো কোথাও ছয়-হাত পরিলক্ষিত। কোথাও আবার তিনি শিবের ওপর দণ্ডায়মান।
তন্ত্রসাধনার গাম্ভীর্য থেকে ভক্তিরসের সহজিয়া স্রোতধারায় বা পটচিত্রে অথবা টেরাকোটার মন্দিরের অলঙ্করণে কিম্বা সঙ্গীতের আঙিনায়– সর্বত্র কালী বিরাজ করছেন স্বমহিমায়। কলকাতার খিদিরপুরের বাবুবাজার অঞ্চলে অবস্থিত ভূকৈলাশ রাজবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত পতিতপাবনী দুর্গা মন্দির চত্বরের এক ছোট্ট মন্দিরে দেবী "কালীগঙ্গা" নিত্যপূজিত। মকরবাহিনী গঙ্গার মূর্তি ইতিপূর্বে অনেক দেখেছি। কিন্তু এই মূর্তিতে কালী মকরবাহিনী। দেবীর চার হাত এখানে থাকলেও, জিভ নেই। এর চেয়েও এক বিচিত্র কালীর সন্ধান মিলবে পূর্ববর্ধমানের আমগোড়িয়া গ্রামে। সেখানে রয়েছে সুড়ঙ্গকালীর মন্দির। তবে মন্দির বলতে এটা নেহাতই একটা এক সাদামাটা চালাঘর। তার সামনেটা উন্মুক্ত। সেখানে মূর্তি বলতে কিছু নেই। একটি গম্ভীরা বা সুড়ঙ্গ বর্তমান। গম্ভীরায় জল ঢালার জন্য এমন ভাবে বাঁধ দেওয়া আছে যে, প্রথম নজরে আপনার মনে হবে– এ বুঝি মাটির তৈরি গৌরীপট্ট। দেবীর নিত্যসেবা হয়। সেবায়েত স্থানীয় কামারপাড়ার মুখার্জীরা। বাৎসরিক পুজো হয় দীপান্বিতা অমাবস্যায়। সেদিন ঘড়া ঘড়া গঙ্গাজল ঢালা হয় সুড়ঙ্গতে, ষোড়োশোপচারে দেবীর পুজো হয়। দেবীর উদ্দেশ্যে মাটির ঘোড়া নিবেদন করার প্রথা রয়েছে। ফাল্গুন মাসে দেবীর স্মরণে গ্রাম্য মহিলারা ব্রত করেন। এই সুড়ঙ্গকালীর পুজো হয় দক্ষিণাকালীর ধ্যানমন্ত্রে।
সমগ্র বাংলা জুড়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, বনে-বাদাড়ে, ঝোপে-ঝাড়ে, শ্মশানে-প্রান্তরে কত যে কালী পুজাে হয়ে থাকে– তা গুনে শেষ করা যাবে না। যেমন, প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন একটি নিমগাছকে কালী জ্ঞানে পুজো করে আসছেন কাটোয়া পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। যত দিন যাচ্ছে বাড়ছে দেবীর ভক্তের সংখ্যা। ‘ঝুপো মা’ বা ‘ঝুপো কালী’ নামে পূজিত এই কালীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে। ঝুপো কালীর কোনও মূর্তি নেই। প্রাচীন নিমগাছটিই স্বয়ং কালী। নিমগাছের গোড়ার অংশে তৈরি হয়েছে বেদি। গাছের গুঁড়িটি ফুল মালা দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। মাথার মুকুট থেকে হাতের খড়গ, সবই সাজানো থাকে গাছটিকে ঘিরেই। এই পুজো শুরুর পিছনে এক লোককথা শোনা যায়– বহু বছর আগে এই এলাকা ছিল জঙ্গলে ঘেরা। বসতির চিহ্ন ছিল না সে সময়। দুর্ধর্ষ বর্গি ডাকাত দল সে সময় ঘাঁটি গেড়েছিল এই জঙ্গলে। সারাদিন জঙ্গলে লুকিয়ে থাকত তারা। সন্ধে নামলেই লোকালয়ে হানা দিয়ে যা পেত লুঠ করে আনত। ওই বর্গি দস্যুরাই নিমগাছে কালী পুজো শুরু করে। দস্যুদের রাজত্ব শেষ হওয়ার পর গাছপালার জঙ্গল কেটে ওঠে কংক্রিটের জঙ্গল। তবে দস্যুদের পূজিত নিমগাছটি কাটা পড়েনি। ওই গাছে সারা বছর ধরেই চলে পুজো পাঠ। তবে কালীপুজোর দিন বিশেষ পুজো পাঠের আয়োজন করা হয়। দেবীর কোনও মূর্তি না থাকায় ঝুপো মায়ের বিসর্জন না হলেও প্রাচীন নিমগাছটির বাঁধানো ছবি নিয়ে শোভাযাত্রা বার করা হয় বিসর্জনের সন্ধেবেলায়। ওই দিন দেবী নগর ভ্রমণ করেন।
পৃথিবীতে যত রকমের কালী আছে এবং যে-গুলো কোথাও নেই, সেই সমস্ত কালী মূর্তিকে আপনি যদি এক জায়গায় দেখতে চান– তা হলে আপনাকে যেতেই হবে দক্ষিণ কলকাতার চেতলায়। দীপান্বিতা অমাবস্যা তিথির কালী পুজোর সময় বিভিন্ন ক্লাব-সংগঠন একে অপরকে টক্কর দেওয়ার জন্য শাস্ত্রের নানা রূপের বাইরেও, মনগড়া অজস্র কালী-রূপের আরাধনায় মেতে ওঠে। “ডুব দে রে মন কালী বলে”– কোথাও রাবণ-কালী, কোথাও অগ্নি-কালী, কোথাও আবার নেপালি কালী। চেতলার কিছু জনপ্রিয় কালীপ্রতিমার নাম ও অবস্থান :
১. রাখাল দাস আঢ্যি রোড/চেতলা রোড : বট-কালী, তামারুপো কালী, আকালী, ধ্যানতারা কালী, স্বর্ণকালী, রক্তচামুণ্ডা কালী, রাজবল্লভি কালী, জহুড়া কালী, ষোড়শী কালী, হাজার হাত কালী, কিরিটেশ্বরী কালী, আদি চামুণ্ডা কালী, শ্যামা কালী।
২. শঙ্কর বোস রোড : দশমুণ্ডা কালী, দশমহাবিদ্যা।
৩. গোপালনগর রোড : এলোকেশী কালী।
৪. চেতলা হাট রোড : পঞ্চমুণ্ডা কালী, ছিন্নমস্তা কালী, চন্দ্রঘন্টা কালী, শিবকালী, কালীঘাটের কালী, শ্বেত কালী, নটরাজ কালী, শিব-দুর্গা কালী, ডাকাত কালী, আগমেশ্বেরী কালী, আদ্যা মা, লক্ষ্মী-কালী, কৃষ্ণকালী।
৫. দুর্গাপুর ব্রিজের কাছে চামুণ্ডা কালী, সিংহবাহিনী কালী।
এটুকু জায়গার মধ্যে যত বড় বড় মাপের, নানা রকম রূপের এবং গা ঘেঁষাঘেঁষি করে যতগুলো প্রতিমার পুজো হয়– পৃথিবীর আর কোথাও তা হয় না। শুধু চেতলা ঘুরলেই দেবীর সকল রূপ দর্শন হয়ে যায়। যেন মা দুর্গার চারপাশে ঘুরে গণেশের পৃথিবী দর্শন। প্রতিমার ফিরিস্তি যত বড়, পথ কিন্তু তত বড় নয়। খুব বেশি হলে দু'-আড়াই কিলোমিটার। মনে পড়ে রামপ্রসাদ গেয়েছিলেন– “মা আমায় ঘোরাবি কত, চোখ বাঁধা কলুর বলদের মতো”। চেতলায় মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরতে ঘুরতে কেউ এই রামপ্রসাদী গান গুনগুন করে গেয়ে উঠতেই পারেন। কিন্তু একের পর এক বৈচিত্র্যময় প্রতিমা দর্শন এতটাই রোমাঞ্চকর এবং মধুর যে, পরের প্রতিমাটি দেখার জন্য মন কেবলই ছটফট করে আর প্রতিটি মূর্তিই মনের গভীরে স্মৃতি হয়ে থাকে অনেক অনেক দিন পর্যন্ত।
এর মধ্যে এক দেবীর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন– তিনি মহাক্ষণ কালী। এমন নামকরণের কাণ্ডারী কে? তা অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারিনি। এই দেবী নাকি সৃষ্টির আদিতে সিসৃক্ষার মহাক্ষণে মহাকালকে প্রসব করে, তাঁকে কোলে নিয়ে বসে রয়েছেন। চেতলার এমন সব অজস্র রকমের অভিনবত্বে পরিপূর্ণ কালী মূর্তিগুলোর নিখুঁত শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা বা বিবরণ খুঁজতে গেলে অবশ্যই হতাশ হবেন। কিন্তু তবু মনে করি ভাবনার দিক দিয়ে ও তার চেয়েও বেশী রসসৃষ্টির দিক দিয়ে এমন মূর্তি অনন্য। এমন মূর্তি বা প্রতিমার মধ্যে দেখা যাচ্ছে এক অবলুপ্ত মাতৃকেন্দ্রিক সমাজের ভাবাদর্শের ছোঁয়া। এই সার্বজনীন পুজোগুলোতে দেবীর সঙ্গে মহাদেব প্রায় সর্বত্রই রয়েছেন। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে তিনি নিতান্তই নিষ্ক্রিয়, শক্তির অধীনস্থ ভৈরব। পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা বর্জিত এমন মূর্তি সমগ্র বাংলা তথা ভারতে সে ভাবে দেখাই যায় না, পুজো তো দূরের কথা। সবই যখন কল্পনা, তখন এমনটা হতে বাঁধা কোথায়?
বৈচিত্রময় কালী মূর্তি ব্যতিরেকে সর্বজনগ্রাহ্য রূপটির ব্যাখ্যা করলে– প্রথমেই জানাতে হবে, শ্রী শ্রী চণ্ডীতে আমরা দেখি তিনি রুধিরপ্রিয়া। কালী অসুরদের রক্তপান করেন, সেজন্যও প্রসারিত জিহ্বা। পালযুগে মাতৃমূর্তির পদতলে একটি শব থাকত, যা জড়তার প্রতীক, যা মাতৃকা দলিত করতেন। এই শব পরবর্তীকালে শিব আখ্যা পায়। মায়ের চরণের স্পর্শ পেয়ে শবও শিবত্বে উত্তীর্ণ। মায়ের চার হাতে খড়্গ ও ছিন্ন মুণ্ড, অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রা: মা একদিকের হাতে মুণ্ড ও খড়্গ ধারণ করেন, অন্যদিকে অভয় দেন এবং বর দেন। মা দ্বেষকদের ভয় এবং সন্তানদের অভয় প্রদান করেন। মায়ের চার হাত চতুর্বর্গ প্রদায়িনী। আমাদের যাবতীয় জাগতিক ও সঙ্কীর্ণ আবিলতা ছিন্ন করে মায়ের জ্ঞানখড়্গ। এই খড়্গ আমাদের জীবনযুদ্ধের অস্ত্রও বটে। মায়ের খড়্গ সর্বদা চক্ষু বিশিষ্ট হয়, কারণ তা সত্যদ্রষ্টা। এছাড়া মা বলিপ্রিয়া, মা তাই খড়্গিনী। খড়্গ দিয়েই বলি হয়। মা ত্রিকালেশ্বরী, ভূত বর্তমান ভবিষ্যত এই ত্রিকালের অধিষ্ঠাত্রী; তাঁর তিনটি নয়ন তিন কালের দ্যোতক। কালী আমাদের তন্ত্রাশ্রয়ী বর্ণমালার অধিষ্ঠাত্রী, পঞ্চাশ বর্ণ তাঁর পঞ্চাশ মুণ্ডমেলায় প্রকাশিত। কালী স্বয়ং প্রথম বর্ণ “ক”তে সূচিত হন। তিনি জগদকারণ, তিনিই উৎস, এজন্য প্রথম বর্ণ। কালীর কখনও ক্ষেমঙ্করী। আবার কখনও বা ভয়ঙ্করী। বাড়িতে শুধু ক্ষেমঙ্করীর পুজো চলে। ভয়ঙ্করীর পুজো বাড়ি তো দূরে থাক, মানুষের বসবাস যোগ্য শহরাঞ্চলে বা গ্রামাঞ্চলেও করা চলে না। একমাত্র শ্মশানে এঁদের পুজো হয়। বামাচারীরা (যারা প্রচলিত ডানদিকের পথ না বেছে উল্টো পথ বেছে নিয়েছেন। এক কথায় তন্ত্র সাধনার বামপন্থী লোকজন) প্রথম বাংলায় ছিন্নমস্তা, বগলা ও ধূমাবতীর মত ভয়ঙ্করী রূপের পুজো চালু করলেন। বৌদ্ধ যুগের শেষ দিকে হিন্দু ও বৌদ্ধদের মিলনে বৌদ্ধ ধর্মে তন্ত্র সাধনার প্রবেশ ঘটে। ফলে তাঁদের মধ্যেও তারাদেবী আসেন।
বাংলা জুড়ে যত জনপ্রিয় সার্বজনীন কালী পুজো দেখা যায়, তাতে কালো রঙের কালীরই প্রাধান্য লক্ষণীয়, কিন্তু নীল বর্ণের কালীও যথেষ্ট পরিমাণে আছে। শাস্ত্র ও পুরাণ অনুযায়ী দুটিই যথার্থ। এই দুই রঙের প্রধান কারণ হল- যদিও কালী আদিতে অবশ্যই কালো, কিন্তু আজকের শ্যামা কালীর মধ্যে একজন পৌরাণিক নীলা দেবীর স্মৃতি আছে। নীল কালীর মধ্যে পার্বতী উপস্থিত। বেশিরভাগ পৌরাণিক মতে যাঁর নীলপদ্মের মত বর্ণ (পার্বতী আগে কালী, পরে তপস্যা করে গৌরী)। পৌরাণিক পার্বতী কালীর বর্ণ হিসেবে কালো দুয়েক জায়গায় দেওয়া হলেও, তাঁর বহুল প্রচলিত বর্ণটি নীল। এই নীল কালীর মধ্যে ভদ্রকালীও আছেন, যিনি আগুনের সু-উচ্চ শিখার মত নীল। নীল কালীর মধ্যে নীলাবতী/নীলচণ্ডী আছেন, শশাঙ্ক-যুগে যাঁর সঙ্গে শিবের বিবাহ উৎসব থেকে বঙ্গাব্দের উৎসবের সূচনা হয়। নীল কালীর মধ্যে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের নীল তারা আছেন, নীল সরস্বতীও আছেন।
কিন্তু কৃষ্ণবর্ণের কালী পৌরাণিক যুগের অনেক আগে থেকে বর্তমান। ইনিই সেই হরপ্পা সভ্যতায় পূজিত রাত্রি বা নিশা। বৈদিক আর্যের ইনিই নক্ৎ কৃষ্ণী, ঋগ্বেদে রাত্রি সূক্তে এঁরই স্তব করা হয়েছে। কৃষ্ণী শব্দের আক্ষরিক অর্থ কালো মেয়ে। এঁর উল্লেখ ভারতের ইতিহাসে গত সাড়ে চার হাজার বছর ধরে নথিবদ্ধ। এমনকি পৌরাণিক যুগেও ইনি সমানভাবে আছেন- সতী অগ্নিতে আত্মবিসর্জন করে পুড়ে কালো হয়ে পরজন্মে হিমালয় দুহিতা পার্বতী কালী হয়ে জন্মাচ্ছেন, এ-তথ্য বরাহ পুরাণে উল্লেখ করা হয়েছে। কালো রঙের কালীই সূচনা থেকে আমাদের আদ্যা, নিত্যা, অব্যক্ত পরমা, জগদকারণ প্রকৃতি। কিন্তু নীল বর্ণ সেই আদ্যা শক্তিরই একটি নির্দিষ্ট প্রকাশ। বস্তুত রাত্রির রঙ যেমন কালো, তেমনই নীল। এ দুই বর্ণেই মায়ের মূর্তি নির্মাণ ও পুজো আজ বিরাজমান।
কলকাতার কথায় আসি। অনেকে তো এখনও মনে করেন সেই পৌরাণিক “কালীক্ষেত্র” থেকে কলিকাতা হয়েছে। কাল-কাটা ঘাসের গপ্পোটা আমারও ঠিক জুতসই লাগে না। ষোড়শ শতাব্দীতে নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ স্মার্ত পণ্ডিত তথা নব্যস্মৃতির স্রষ্টা রঘুনন্দন দীপান্বিতা অমাবস্যায় লক্ষ্মী পুজোর বিধান দিলেও, কালী পুজোর উল্লেখ করেননি। ১৭৬৮ সালে রচিত কাশীনাথের কালী সপর্যাসবিধি গ্রন্থে দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালী পুজোর বিধান পাওয়া যায়। ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে, “কাশীনাথ এই গ্রন্থে কালীপূজার পক্ষে যে ভাবে যুক্তিতর্কের অবতারণা করিয়াছেন, তাহা দেখিলেই মনে হয়, কালীপূজা তখনও পর্যন্ত বাঙলা দেশে সুগৃহীত ছিল না।” তবে খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় কালী পুজোর প্রচলনের কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।
নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে কালীপুজোর সংযোগ এক ঐতিহাসিক বিষয়। তিনি ছিলেন কালীভক্ত এবং তাঁর আমলে কার্তিকী অমাবস্যায় শুরু হয়েছিল দীপান্বিতা কালীপুজো। অন্তত এই ব্যাপক আকারে কার্তিকী অমাবস্যায় কালীপুজো তার আগে ছিল না। তার আগে কালীপুজোর কোনও একটি নির্দিষ্ট দিন ছিল না, সারা বছরে বিভিন্ন সময়েই হত। তবে সারা বছর জুড়ে কালীপুজো গোটা বাংলায় আজও হয়। মধ্যযুগ জুড়ে বিশেষ বিশেষ তিথি(মূলত অমাবস্যা)-সহ প্রত্যেক শনিবারই কালীপুজো করার প্রচলন ছিল শাক্তদের মধ্যে। এছাড়া তিথি বার ব্যতিরেকে, যে কোনও কঠিন কাজের আগে মা কালীর পুজো করা হতো। আদিযুগে এই কার্তিকী অমাবস্যায় চামুণ্ডা/চর্চিকা/নৈরাত্মাদি মাতৃকাদের উপাসনা প্রচলিত থাকতে পারে। কিন্তু এখনও স্পষ্ট প্রমাণ মেলেনি। কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে নদীয়ায় দশ সহস্র কালীমূর্তি প্রস্তুত করে উপাসনা করা হয়। কালীপুজোর সামাজিক সমষ্টিগত গ্রহণযোগ্যতা কৃষ্ণচন্দ্রেরই কীর্তি। এই কাজে পরোক্ষভাবে তাঁর পরম সহায়ক হয়েছিলেন প্রখ্যাত কালী-সাধক কবি রামপ্রসাদ।
সোজা কথায় বাংলায় দীপান্বিতা অমাবস্যায় এই কালী পুজো খুব বেশি পুরোনো না। মোটামুটি তা দুর্গা পুজোর মতই পুরোনো। তবে দুর্গা পুজোর আগে কলকাতায় বারোয়ারি কালী পুজো শুরু হয়েছিল। কলেজ স্ট্রীট অঞ্চলের গোপাল মল্লিক লেনে কলকাতার সবচেয়ে পুরোনো যে বারোয়ারি পুজো হয়, তা ১৬৫ বছরের। এই শক্তি আরাধনার সময় বলি নিয়ে নানা ইতিবাচক কথার তুলনায় নেতিবাচক কথাই বেশি মাত্রায় শোনা যায় আজকাল। যাঁরা পুজোয় বলি বিরোধী, অথচ ধার্মিক– তাঁরা বলেন, “মা কি কারোর রক্ত চাইতে পারে?” যত সব ন্যাকা কথা! রক্ত পান করার জন্যই তো কালী মায়ের জন্ম! খুলে দেখুন চণ্ডীতে; চেয়ে দেখুন দুনিয়াটায়– চারদিকে কেমন রক্তস্রোত বয়ে যাচ্ছে অনাদিকাল থেকে ! রক্তবীজ দৈত্য, যার এক ফোঁটা রক্ত থেকে আরও একশোটা দৈত্য জন্ম নেয়। …সেই রক্তবীজকে মারার জন্যেই কালীর আবির্ভাব। তিনি রক্ত পান করতে করতে রক্তবীজের রক্ত নিঃশেষিত করে, তাকে বধ করলেন।
এবার ভুলে যান ধর্ম কথা। আসুন বাস্তবের দুনিয়ায়– চারদিকে শুধু রক্তই রক্ত! এই মুহূর্তে আপনি যখন এটা পড়ছেন, তখনই কত লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের প্রিয়জনকে হারানোর অশ্রুসিক্ত আর্তনাদ করছে শ্মশানচিতার সামনে! এই মুহূর্তে কত লক্ষ লক্ষ কন্যা ভ্রূণ হত্যা হয়ে গেল! কত কীট-পতঙ্গ-পশু সকলের অলক্ষ্যে মেরে ফেলা হল! আপনার রান্নার কড়ায় জ্যান্ত কই মাছ ফুটন্ত তেলে অকল্পনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মৃত্যুভিক্ষা চাইছে! লক্ষ লক্ষ খাসি হালালের নলি কাটা অবস্থায় কাতরাচ্ছে– আপনার প্লেটের সুস্বাদু মাংস হয়ে ওঠার জন্য! ক্ষুদ্র ব্যাক্তি চেতনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারলে দেখতে পাবেন, আতঙ্কবাদী হামলায় নিহত নিরীহ নিরপরাধী আর নিরাপদে আয়ু পূর্ণ হওয়া মৃত্যুপথযাত্রীর মধ্যে কোনও ভেদ নেই। ওই মুহূর্তে পিষে যাওয়া কুকুর ছানা আর আপনার আমার মৃত্যুর কোনও তফাৎ নেই। সে মৃত্যু বলিদানের হাড়িকাঠে হোল, নাকি মানব বোমার বিস্ফোরণে হোল– তাতে ব্রহ্মাণ্ডের কিছু যায় আসে না! প্রকৃতি চলে প্রকৃতির গতিতে। যেমন চন্দ্র সূর্য ওঠে, দিন আসে– দিন যায়; তেমনি মৃত্যুও একটা স্বাভাবিক ঘটনা। তার কোনও হেতু নেই, সময়-অসময় নেই!
আমরাই আমাদের অহংবোধ থেকে আমাদের অস্তিত্বের ওপর অনর্থক গুরুত্ব আরোপ করতে ভালবাসি। আর যেহেতু আমাদের নিজ নিজ অস্তিত্ব আমাদের কাছে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের অপছন্দের মৃত্যুগুলোকেও আমরা মনে মনে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলি! এই সমস্ত মৃত্যুর তপ্ত শোণিতধার এসেই তো মেশে কালী মায়ের হস্তস্থিত খড়গে। তিনি যে মৃত্যুরূপ। আর আপনি বলছেন, “মা কি রক্ত চাইতে পারেন?” হাসালেন যে! আপনার চারদিকেই রক্তস্রোত, শুধু আপনিই তা দেখতে পাচ্ছেন না! পোকা মাকড়ের রক্ত হয় না। চিংড়ির রক্ত নীল। কিন্তু টকটকে লাল রক্তও আমাদের চোখে পড়ে না যতক্ষণ না সেটা আমাদের আপনজনের হয়! সংসার ব্যাপী মৃত্যু ঝঙ্কারের এই অভূতপূর্ব অনুরণনটিই তো মা কালী!
তাহলে মায়ের স্নেহ কোথায়? মা যদি শুধুই মৃত্যুময়ী বিভীষিকা হন, তাহলে তার মাতৃত্ব কই? উত্তরে জানাই, চেয়ে দেখুন মৃত্যুর পরের জগতটাকে– অগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ থেমে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে এই বিশ্বের বিপুল সংখ্যক বৃক্ষ-লতা-গুল্ম। এখন চরাচরের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে শুধুই ধুসর ছাইয়ের আস্তরন। কিন্তু তারই মধ্যে অঙ্কুরোদগম হয়েছে এক ক্ষুদ্র চারা গাছের। নতুন জন্ম, নতুন আশা। কিছুই থেমে থাকে না! পাড়ার অমুক কাকু মারা গেলেন। কিন্তু তার সাধের দোকানটা আজও খোলে। তার ছেলেরা চালায়। আপনি প্রিয়জন বিয়োগে শোকস্তব্ধ, কিন্তু ভোরের সূর্য আজও উঠেছে। প্রভাত পাখিরা আজও ডাকছে। শ্মশানযাত্রীরা ফিরে এসে যে যার বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। মৃতের নিকট আত্মীয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বেদনা-বিলাসের ছেদ টেনে স্নান ঘরে ঢুকেছে নতুন দিনের আহ্বানে! এই যে জীবনের জয়গান, এটাও কিন্তু সর্বত্র।
কালী ডাকাত দ্বারা পূজিত, সমাজ-বিরোধী দ্বারাও পূজিত; এমনকি বর্তমানে অনেক অসৎ নেতা-নেত্রীদের বাড়িতেও পূজিত। এ সব দেখে, শুনে অনেকে হতাশ হয়; ক্ষিপ্ত ও বিরক্ত বোধ করে। এর সুযোগ নিয়ে বহু পণ্ডিত, বিশেষ করে প্রতীচ্যের ভারততত্ত্ববিদরা কালীকে অন্ধকার, মৃত্যু ও ধ্বংসের দেবী বলে ভাবেন ও চিহ্নিত করেন। এমন তত্ত্বকথা পড়ে, অনেকে নিশ্চিতরূপে এ-সব বিশ্বাসও করে। এর পক্ষাবলম্বন করে তৈরি হয় বিতর্কিত চলচ্চিত্র, আঁকা হয় ছবি। এমনকি ইচ্ছাকৃত ভাবে বিভ্রান্তিকর নব্য fashion statement নির্মাণ করা হয়। তাই বলে এই মায়াময় পৃথিবীতে কালী কি শুধুই নেতিবাচক, সে কি প্রাণময় নয়? আমার উত্তর– এটাই তো মাতৃভাব। নতুনের লালন, শরণাগতের পালন। কালীতত্ত্ব এত সরল ও একরৈখিক নয়। ইংরেজিতে বলে “Time is the best healer”– কি অদ্ভুত গভীর ভাবনা। সেই সময় বা কাল-কে অনুভক করার জন্যে চাই নিবিড় মননশীলতা।
কাল-এর স্ত্রীলিঙ্গ কালী। কাল বলতে বোঝায় সময়। অর্থাৎ অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতকে যিনি কলন করেন তিনি মহাকাল। আর সেই মহাকালের নিয়ন্ত্রক যিনি, তিনিই মহাকালী। কালের গ্রাসকে ভুলিয়ে দিতে কালী নিজেই সদা-সর্বদা দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের শিয়রে! অত্যন্ত স্নেহ ভরে, তার রোষকষায়িত রক্তচক্ষু লুকিয়ে। সাধক কমলাকান্ত ভট্টচার্যের গানে তাই পাই, “সদানন্দময়ী কালী মহাকালের মনমোহিণী, আপনি নাচ আপনি গাও মা আপনি দাও মা করতালি।” এই গানেই আর একটু এগিয়ে কমলাকান্ত বলেন, “আদিভূতা সনাতনী শূণ্যরূপা শশীভালী, ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুন্ডুমালা কোথা পেলি?” এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই দেখা যায়, আসলে কালী অনন্তের প্রতীক। ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আগে মুণ্ডমালা পাওয়ার তাই প্রশ্ন উঠছে না। এ আসলে মানুষের অহং ছিন্ন করার প্রতীক। তাঁর এক হাতে তাই খড়্গ। সেই খড়্গের আঁকা চোখ প্রজ্ঞার প্রতীক। এখন থেকে নিজের অন্তরের প্রজ্ঞা দ্বারা অহং ছিন্ন করার বার্তা মেলে। তাই তিনি আমাদের এত আদরের, এত আপন। তিনি সর্বোচ্চ উপাস্য।
এই আদিশক্তি বা আদ্যাশক্তি সময়ের থেকেও উচ্চতর। কাল থেকে কালীর উৎপত্তি ধরলে– তা আসলে সময়ের সীমানা পেরনো এক ধারণা। সেই অনন্তকে কোনও জাগতিক বস্ত্রের আবরণে আবৃত করা যায় না। দেবী তাই নগ্নিকা। আবার কোনও কোনও মতে বলা হয় কালী শক্তির প্রতীক, শক্তিকে কোনও বসন বা আচ্ছাদনে আবদ্ধ করা যায় না। তাই নগ্নিকা হিসেবেই কালীর ধারণা গড়ে উঠেছিল। তবে আমাদের রক্ষণশীল সমাজ তা বদলে দিয়ে– দেবীকে বসন, গয়না পড়িয়েই ক্ষান্ত হয় নি; আজকাল ঘোমটা দেওয়া কালীও বেশ জনপ্রিয় করে তোলা হচ্ছে। অন্তরের উপলব্ধি সঠিক না হলে, এমনটা তো হবেই। কালী মাকে রূপে স্নেহময়ী জননী করে তুলতে গিয়ে, এর অন্তর্নিহিত তত্ত্বকে আজ গুরুত্বহীন করে দেওয়া হয়েছে।
আমাদের শরীরগত প্রাণশক্তিতে পাঁচটি ইন্দ্রিয় রয়েছে– চোখ, কান, নাক, জিভ ও ত্বক। পঞ্চেন্দ্রিয়কেই কালী কলন করছেন। এক্ষেত্রে কলন মানে গ্রাস করে ফেলা– “কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীর্তিতঃ।” আবার, কলন শব্দটির আরেকটি মানে স্পন্দিত হওয়া। নিজের স্বরূপচ্যুত হওয়াও কলন। মহাকাল শিব যখন খুব ছটফট করতে থাকেন, তিনি যখন সচঞ্চল ও স্পন্দিত হন, মা কালী তাঁকে কলন করেন। একেবারে গ্রাসই করে ফেলে শক্তিরূপে প্রকাশিতা হচ্ছেন। আমরা কান চাপা রাখলে, শুনতে পাই না; চোখ বুজলে, দেখতে পাই না। আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের শক্তিসমূহকে অনাবৃত রাখতে হয়। যে কোনো আবরণ যাবতীয় প্রকাশকে নষ্ট করে দেয়। এই জন্যই কালীকে বিবসনা রূপে কল্পনা করা হয়েছে।
তন্ত্র সাধকরা পাশমুক্তির কথা বলেন। পাশ হল সাধকের বন্ধন। পাশ হল বস্ত্র। আমার স্থূল শরীর আবৃত করার বস্ত্রাদি কিন্তু পাশ নয়। পাশ হল সূক্ষ্ম শরীরের কাপড়। ছয়টি রিপু দ্বারা আমরা সংসার জীবনে আচ্ছন্ন হয়ে থাকি। আমরা সবসময় নাম-যশ-অর্থ-খ্যাতি-প্রতিপত্তি নিয়ে মত্ত, কামনায় মত্ত। আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গভীরে প্রবেশ করা সূক্ষ্ম অনুভূতির মধ্যেই এ-সব রয়েছে। এই সূক্ষ্মভাবে অবস্থিত প্রবৃত্তিগুলিই পাশ। জগৎ গুণের অধীন। তা পাশ দিয়েই আবদ্ধ বা বস্ত্রাবৃত। কালীর কোনো পাশ নেই, তাই তিনি বিবসনা। দিগম্বরী। মায়ের এই রূপের পুজোর ভেতর গভীর আধ্যাত্মিক ভাবটি হল, আমাদের অন্তরাত্মাকে আবৃত রাখলে চলবে না। মানুষের মনের কোনো নির্দিষ্ট অবয়ব নেই। মন ঠিক কোন রঙের– তাও বলা যায় না। যখন যে প্রবৃত্তি সেখানে জাগে, সেই নির্দিষ্ট স্বভাব ও রঙের মাতামাতি শুরু হয় মনে। মন এক স্বাধীন বিচরণভূমি। তাই দিগম্বরী কালীর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির স্বার্থে কাপড়, মুকুট, অলংকার ইত্যাদি পড়িয়ে সংসার বন্ধনে আবদ্ধ ও মোহান্ধ জনগণকে সঠিক উপলব্ধির হাত থেকে বঞ্চিত করে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। বর্তমানে কালী হয়ে উঠেছেন চলচ্চিত্র বা television serial-এর makeup করা স্নেহময়ী জননীর সমতুল্য। তা বিরক্তিকর ও দুঃখজনক। স্নেহময়ী জননীর অভিব্যক্তিই মাতৃত্বের একমাত্র প্রকাশ নয়। তা অনুভবের প্রয়োজন রয়েছে।
আমরা কালী মাকে যে ভাবেই দেখার চেষ্টা করি না কেন, তাঁর যতটা কট্টর সমালোচনাই করতে চাই না কেন— শেষে গিয়ে মনে হয় যে, আমরা যতটা ধর্মহীন বা ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে গেছি বলে ভাবি নিজেদের— বোধহয় আমরা সত্যি ততটা ধর্মহীন ইহজীবনে হয়ে উঠতে পারি না। ধর্মের ঊর্ধ্বে ওঠাও কি সম্ভব! আমরা উদার হতে পারি, সেকুলার হতে পারি, পরধর্মসহিষ্ণু হতে পারি— কিন্তু গোপনে বা অবচেতনে আমাদের নিজেদের ধর্মের প্রতি বোধহয় আমাদের একটা মালিকানা থেকে যায়। আমাদের চিন্তাশক্তির ঊর্ধ্বে যে অনাদি অনন্ত মহাশক্তি সদাপ্রবহমানা, সৃষ্টির আদি মুহূর্ত থেকে যে জগন্মহিনী যোগমায়া নিরন্তর সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের মায়াজালে জগৎ সংসারকে অবোধ বালকের মতন ভুলিয়ে, হৃদপদ্মাসনে বিরাজ করেন— তিনিই কালী। সহজ মনে চললে, কালী পুজোয় কোনো আলাদা মন্ত্র লাগে না। পাঁচ অক্ষরের জয়ধ্বনি, “জয় মা কালী” বলাই যথেষ্ট। মায়ের পুজোয় মূর্তি, মন্ত্রপাঠ, উপাচার, বলি– এগুলো করতে চাইলে, করাই যায়। না হলে আমাদের ভেতরের শ্রদ্ধাটাই যথেষ্ট। কালী চ জগতাং মাতা সর্বশাস্ত্রেষু নিশ্চিতঃ... কৈবল্যদায়িনী মায়ের পুজো নিজের কর্মের মাধ্যমে আমরা অবিরত করে যেতে পারি। আর কিছু নয়, অন্তরের বিশ্বাসটুকুই আসল। জীবনের প্রত্যেকটা দিন হোক মা কালীর জন্যে উৎসর্গীকৃত। জয় মা কালী... জয় মা কালী... জ্ঞানের আলো দাও মা জ্বালি!
তথ্যসূত্রঃ
১.) ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্য, শশিভূষণ দাশগুপ্ত, সাহিত্য সংসদ।
২.) শ্রী শ্রী কালীপূজা, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ।
৩.) দেবদেবীতত্ত্ব, সতীশচন্দ্র শীল, শ্রীভারতী পাবলিশিং কোং।
৪.) মাতৃকাশক্তি, অশােক রায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
৫.) ধন্য কলকেতা সহর, কৌশিক মজুমদার, আখরকথা।
৬.) সৃষ্টির বীজ কুড়িয়ে রাখেন মা কালী, সোমব্রত সরকার, সাপ্তাহিক বর্তমান, ২২ অক্টোবর'২০২২।
বিঃ দ্রঃ - যে সমস্ত কালী মন্দির ও সার্বজনীন পুজোর উল্লেখ লেখাতে রয়েছে, সে-সব তথ্যাদি ক্ষেত্রসমীক্ষা করে প্রাপ্ত।
|
‘কালীগঙ্গা’ : কলকাতার খিদিরপুরের বাবুবাজার অঞ্চলে অবস্থিত ভূকৈলাশ রাজবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত পতিতপাবনী দুর্গা মন্দির চত্বরের এক ছোট্ট মন্দিরে এই দেবী নিত্যপূজিত। |
|
কালীঘাটের কেওড়াতলা মহাশ্মশানের কৃষ্ণকালী। |
|
কলকাতার রামদুলাল সরকার স্ট্রিটের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের মন্দিরে ‘বসা কালী’র এক দুর্লভ বিগ্রহ। |
|
ঝুপো কালী, কাটোয়া।
|
|
অষ্টাদশভুজা গুহ্যকালী, মুক্তারামবাবু স্ট্রিট, কলকাতা। |
|
Title : She and her pathfinders. Medium : Mixed media. Size : 28.5c.m.×19.5c.m.
|
|
Title : The mother of death. Medium : Mixed media. Size : 13c.m.×17c.m.
|
|
कलकत्ते वाली। कोलाज। १४ इंच × १२.५ इंच।
|
|
মহাক্ষণ কালী, চেতলা, কলকাতা।
|
|
বীরভূম জেলার ঘুরিষা অঞ্চলে অবস্থিত টেরাকোটার রঘুনাথ মন্দির-গোত্রের দেবী চামুণ্ডার রিলিফ ভাস্কর্য। |
|
সুড়ঙ্গকালী, আমগোড়িয়া গ্রাম, পূর্ববর্ধমান।
|
0 comments: