Next
Previous
0

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ

Posted in





















অঙ্গিরা ও কর্দম ঋষি ব্রহ্মার পুত্র। কর্দমকন্যা শ্রদ্ধার সঙ্গে অঙ্গিরার বিবাহ হয়। অঙ্গিরা-শ্রদ্ধার দুই পুত্র—উতথ্য ও বৃহস্পতি। উতথ্যের বিবাহ হয় মমতার সঙ্গে। একদিন দেবগুরু বৃহস্পতি এলেন উতথ্যের বাড়িতে। উতথ্য মুনি বাইরে ছিলেন, মমতা ছিলেন গৃহে। গর্ভবতী মমতাকে দেখে কামাতুর হয়ে পড়েন বৃহস্পতি। তিনি মমতার সঙ্গম প্রার্থনা করেন। মমতা রাজি হলেন না। কিন্তু বৃহস্পতি বলপ্রয়োগ করলেন। মমতা শত চেষ্টা করেও রেহাই পেলেন না। দেবগুরু ধর্ষণ করলেন। মমতার গর্ভস্থ শিশু বৃহস্পতিকে রেতঃপাত করতে নিষেধ করলেন, কারণ একই গর্ভে দুজনের স্থিতি সম্ভব নয়। বৃহস্পতির বীর্য অমোঘ। বৃহস্পতি তার কথা শুনলেন না। তখন সেই শিশু পা দিয়ে বৃহস্পতির শুক্রকে আটকে দিলেন। বৃহস্পতি তাঁকে অভিশাপ দিলেন, তুমি অন্ধ হও। মমতার সেই পুত্রের নাম দীর্ঘতমা। বৃহস্পতির বীর্য ভূমিতে পড়ে যে পুত্রের জন্ম হল তাঁর নাম ভরদ্বাজ। ভরদ্বাজের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন মমতা। ওদিকে বৃহস্পতিও শিশুটিকে পরিত্যাগ করলে মরুৎগণ তাঁকে লালন পালন করেন। ভরদ্বাজ ঋষি নামকরা পণ্ডিত। তিনি গঙ্গোত্তরী প্রদেশে বাস করতেন। একদিন গঙ্গায় স্নান করার সময় তিনি ঘৃতাচী নামের রূপযৌবনসম্পন্না, যৌবনগর্বিতা, যৌবনমদে মন্দগমনা অপ্সরাকে নগ্ন অবস্থায় দেখে নিজেকে সামলাতে পারেন না। বস্ত্র পরিধান করার সময় নদীতীরের বায়ু এমন ভাবে বইছে যে তাঁর সমস্ত অঙ্গই দেখা যাচ্ছে। ভরদ্বাজের চিত্ত সংসক্ত হয়, তাঁর শুক্রপাত হয়। ভরদ্বাজ মুনি সেই শুক্র হস্তস্থিত কলশের ভিতর রাখেন। ওই কলশে দ্রোণের জন্ম হয়। ভরদ্বাজ মুনি এই পুত্রকে বেদ-বেদাঙ্গের শিক্ষা দেন। মুনি আগ্নেয় অস্ত্র বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন। এক সময় অগ্নিবেশ্য মুনিকে ভরদ্বাজ আগ্নেয় অস্ত্রের শিক্ষা দিয়েছিলেন। অগ্নিপুত্র অগ্নিবেশ্য মুনি দ্রোণকে সেই আগ্নেয়াস্ত্র শিক্ষার পাঠ দিলেন। ভরদ্বাজ মুনির একজন বন্ধু ছিলেন, তাঁর নাম পৃষত—তিনি পাঞ্চাল দেশের রাজা। পৃষতের পুত্র দ্রুপদ ভরদ্বাজের আশ্রমে খেলা করতেন। দ্রুপদের সঙ্গে দ্রোণের খুব বন্ধুত্ব হয়। পৃষতের মৃত্যুর পর দ্রুপদ পাঞ্চাল দেশের রাজা হন। দ্রোণাচার্য শরদ্বানের কন্যা কৃপীকে বিবাহ করেন। কৃপীর অগ্রজ কৃপ হস্তিনার অস্ত্রগুরু। দ্রোণ ও কৃপীর একটি পুত্র জন্মায়, তাঁর নাম অশ্বত্থামা।


একদিন দ্রোণ শুনতে পেলেন, মহাত্মা পরশুরাম যিনি পৃথিবীকে একুশ বার ক্ষত্রিয়শূন্য করেছিলেন, সেই মহাধনুর্ধর নিজের সব ধনসপম্পত্তি ব্রাহ্মণদের দান করবেন। ধনুর্বেদ এবং অলৌকিক অস্ত্র বিষয়ে পরশুরাম সব কিছু জানতেন। দ্রোণাচার্য কৃপী ও অশ্বত্থামাকে রেখে পরশুরামের কাছে গেলেন মহেন্দ্র পর্বতে। অঙ্গিরা, বৃহস্পতি ও ভরদ্বাজের নাম করে নিজের বংশপরিচয় দিয়ে পরশুরামকে প্রণাম করলেন তিনি। জানালেন, তিনি ভরদ্বাজের পুত্র কিন্তু অযোনিজ, পিতাও তাই, এমনকি তাঁর স্ত্রী কৃপীও অযোনিজ। পরশুরামের কাছে তিনি প্রচুর ধন দান দান হিসাবে চান। পরশুরাম বললেন, দ্রোণ একটু দেরি করে ফেলেছেন, সোনারূপা, মণি যা ছিল সব তিনি ব্রাহ্মণদের দান করে দিয়েছেন। গোটা পৃথিবী দিয়েছেন কশ্যপকে। অবশিষ্ট রয়েছে তাঁর শরীর, অস্ত্র ও শস্ত্র—এই তিনের মধ্যে যা দ্রোণ চাইবেন তাই তিনি দান করবেন।

দ্রোণ বললেন, প্রয়োগের সঙ্কেত, মন্ত্র এবং উপসংহারের উপায় এই সব কিছুর সঙ্গে সমস্ত অস্ত্র ও শস্ত্র আমাকে দান করুন।

পরশুরাম উচ্চারণ করলেন, তথাস্তু! তার পর সঙ্কেত, মন্ত্র ও নিয়মসমেত সমগ্র ধনুর্বেদ দ্রোণকে দান করলেন।

প্রসন্ন দ্রোণ ফিরে এলেন পাঞ্চাল নগরে। বাল্যসখা দ্রুপদের কাছে এসে বললেন, হে বন্ধু! আমি তোমার রাজ্যে সখার মতো থাকতে চাই।

দ্রুপদ বললেন, এক সময় একসঙ্গে অধ্যয়ন ও ক্রীড়া করেছি বলে আমি তোমার সখা হয়ে গেলাম! দরিদ্র-ধনবান, মূর্খ-পণ্ডিত, নপুংসক-বীর, প্রবল-দুর্বল কোনও দিন বন্ধু হয় না।

ক্রুদ্ধ দ্রোণ স্ত্রীপুত্র নিয়ে পাঞ্চাল ছেড়ে হস্তিনানগরে চলে গেলেন। সেখানে শ্যালক কৃপাচার্যের গৃহে প্রচ্ছন্নভাবে বাস করতে লাগলেন। কৃপাচার্য হস্তিনার রাজপুত্রদের অস্ত্রশিক্ষা দিতেন। দ্রোণ নিজের পুত্র অশ্বত্থামাকে শিক্ষা দিতে লাগলেন। অবশিষ্ট সময়ে হস্তিনার রাজপুত্রদের খেলাচ্ছলে অনেক কিছু শেখাতেন বটে, কিন্তু নিজের পরিচয় গোপন রাখতেন। শ্যালক কৃপাচার্যকে বলেও কাজের ব্যবস্থা হল না। এদিকে পরগৃহে থাকতেও আর প্রাণ চায় না। অর্থকষ্ট রয়েছে। স্ত্রীপুত্রের ভরণপোষণও ঠিক মতো করতে পারছেন না বলে দ্রোণের মনে শান্তি নেই, অথচ সমগ্র ধনুর্বিদ্যা তাঁর হাতের মুঠোয়।

একদিন হস্তিনাপুরের এক মাঠে রাজকুমাররা ডাংগুলি খেলছিল। এমন সময় একটি কূপে তাদের গুলিটি পড়ে যায়। কুমাররা সেই গুলি কিছুতেই তুলতে পারছেন না, আবার গুলি না পেলে খেলা শুরু করা যাবে না।

এমন সময় রাজকুমাররা দেখলেন, একজন শ্যামবর্ণ, শুভ্রকেশ ও কৃশশরীর এক ব্রাহ্মণ সামনে আগুন রেখে হোম করছেন। বালকরা সেই ব্রাহ্মণকে ঘিরে ধরলেন।

দ্রোণ জানতে চাইলেন, কেন তাঁকে ঘিরে রয়েছে বালকরা?

তাঁরা বললেন, ওই গুটিটা না তুলে দিলে খেলার ব্যাঘাত হচ্ছে।

দ্রোণ বললেন, আমি তুলে দিতে পারি কিন্তু একটি শর্তে। আমাকে এক সন্ধ্যার খাবার দিতে হবে।

উত্তরের অপেক্ষা না করে দ্রোণ নিজের আংটিটি খুলে সেই জলহীন কূপে ফেলে দিলেন।

তখন রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ভ্রাতুষ্পুত্র যুধিষ্ঠির বললেন, কৃপাচার্যের অনুমতি হলে আপনি নিয়মিত খাদ্য লাভ করবেন।

দ্রোণ হাসলেন। তার পর একটি ঈষিকা দিয়ে সেই গুটিটিকে বিদ্ধ করলেন, তার পর একটার পর একটা ঈষিকা পরস্পরকে বিদ্ধ করে সেই গুটি উপরে তুলে আনলেন।

রাজকুমাররা বিস্মিত হলেন। এমন ভাবে যে গুটি তোলা যায়, তা তাদের ধারণার বাইরে ছিল। তখন ধৃতরাষ্ট্রপুত্র দুর্যোধন বললেন, হে বিপ্র! আপনি এই বার অঙ্গুরীয় উত্তোলন করে দেখান।

দ্রোণ সেই আংটিও কূপ থেকে তুলে ফেললেন। রাজকুমাররা বিস্ময়ে বললেন, আমরা আপনার জন্য কী করতে পারি?

দ্রোণ জবাব দিলেন, একটাই কাজ করতে পারো তোমরা। এই ঘটনার কথা রাজাকে নয়, ভীষ্মকে জানাও! ভীষ্মই হস্তিনাপুরের আসল রাজা আর তাঁকে চালনা করেন তাঁর বিমাতা সত্যবতী। সত্যবতীর দুই পুত্র মৃত। পৌত্রদের একজন রাজা ধৃতরাষ্ট্র হলেন অন্ধ, কনিষ্ঠ পাণ্ডু কিছু কাল আগে মারা গিয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্রের ১০২ জন সন্তান আর পাণ্ডুর পুত্র পাঁচটি।

ছেলেরা এসে ভীষ্মকে সব কথা খুলে বললেন। ভীষ্ম এমন একজন অস্ত্রগুরু খুঁজছিলেন। কৃপাচার্য মানুষ ভাল, শিক্ষাদানের পদ্ধতিও ভাল কিন্তু বড্ড প্রাচীনপন্থী। ওদিকে শত্রুদের তীক্ষ্ম নজর হস্তিনার দিকে। মগধের রাজা জরাসন্ধের ভয়ে সকলে কম্পমান। পাহাড় ও জঙ্গলের রাজারাও তাঁর পক্ষে। এমন অবস্থায় রাজকুমারদের উপযুক্ত অস্ত্রশিক্ষা না দিতে পারলে বীর তৈরি হবে না। আর বীর তৈরি না হলে কে রক্ষা করবে হস্তিনার সাম্রাজ্য! ভীষ্ম ডেকে পাঠালেন আচার্য দ্রোণকে।

দ্রোণ ভীষ্মের সামনে এসে নিজের দুরাবস্থার কথা বললেন ও দ্রুপদ রাজার বিরুদ্ধে নানা রকমের ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। ভীষ্ম জানালেন, পাঞ্চাল রাজকে তিনি এক্ষুণি চটাতে চান না। আপাতত আচার্য হিসাবে দ্রোণ কুরুবালকদের অস্ত্রশিক্ষা দিন এবং কুরুগৃহে সম্মানের সঙ্গে বসবাস করুন ও ধনসম্পত্তি ভোগ করুন।

দ্রোণ বললেন, তা কী প্রকারে হয়? এই বালকদের অস্ত্রগুরু কৃপাচার্য রয়েছেন। বরং আমাকে কিছু ধন দিন, আমি অন্যত্র চলে যাই।

বুদ্ধিমান ভীষ্ম জানেন যে দ্রোণ হলেন কৃপের ভগ্নীপতি। তাই তিনি বললেন, কৃপাচার্যও সম্মানের সঙ্গে থাকবেন, তাঁর ভরণপোষণও কুরুবংশ করবে, আমরা আপনার মতো উপযুক্ত লোক খুঁজছিলাম যিনি সমগ্র ধনুর্বিদ্যা জানেন।

দ্রোণ অবাক হন। কৃপাচার্য তবে কি উপযুক্ত নন? তিনি কি শ্যালকের পদ কেড়ে নিচ্ছেন! আর সমগ্র ধনুর্বিদ্যার কথাই বা শান্তনু ও গঙ্গার পুত্র ভীষ্ম কীভাবে জানলেন!

ভীষ্ম বললেন, রাজ্য চালাতে গেলে অনেক কিছুর খবর রাখতে হয়। চার দিকে গুপ্তচর নিয়োগ করা হয়েছে রাষ্ট্রের অর্থে, সে কি আর এমনি এমনি! পরশুরামকেও ভীষ্ম ভাল মতো চেনেন। তাঁর সঙ্গে একদা ঝামেলাও হয়েছিল দেবব্রত ভীষ্মের।

চলবে