Next
Previous
1

নোলা পরিক্রমা - ময়ূখ ও ইরাবান


বাঙালী সবসময়ই ভোজনরসিক। তাই বাঙালীর জিহ্বায় আরাম পাওয়ার জন্য কোনও উৎসবের প্রয়োজন হয় না। সবে দুর্গা পুজো শেষ হয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই কম বেশী নানা ধরনের খাবার চেখে দেখে থাকি এই সময়ে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই শোনা যায় অনেক বড়ো সুনামধন্য রেস্তরাঁও অতিরিক্ত ভীড়ের কারণে গুণগতমান বজায় রাখতে সক্ষম হয় না। এছাড়া কোভিদ সতর্কতা মানয়ার দরুন আমরা অনেকেই সাহস করে কোন অচেনা জায়গায় খেতে পারিনি।
যাইহোক, আজকে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় আমরা চেষ্টা করবো ভোজনরসিকদের কাছে কিছু চমক রাখার। আমরাও একদিন এরকমই জিহ্বায় তৃপ্তি পাওয়ার লক্ষ্যে চলে গিয়েছিলাম কলকাতার সনামধন্য ডেকার্স লেনে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ডেকার্স লেন নিয়ে এর আগে অনেক লেখা বা ব্লগ আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের এখানে আসার কারণ চিত্তবাবুর দোকান ও সুরুচি রেস্টুরেন্ট বাদ দিয়ে ডেকার্সলেনকে অন্যভাবে তুলে ধরার জন্য এবং দ্বিতীয়ত আমাদের হয়তো সব পাঠকই কম বেশী অবগত ডেকার্স লেন সম্বন্ধে, কিন্তু বিগত কিছু দিনের মধ্যে হয়তো সেভাবে কারোরই যাওয়ার কোনও প্ল্যান নেই। তাই আমাদের সাধ্যমত কিছু বিষয় আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি যা হয়তো পাঠকদের নতুন করে এই জায়গায় আসার বাসনাকে উদবুদ্ধ করে।
প্রথমেই, সকলের পরিচিত হলেও একবার পথনির্দেশটি বলে রাখি। এসপ্ল্যানেড মেট্রো বা ধর্মতলা মোড়ের কে সি দাস মিষ্টির দোকানের পাশ দিয়ে বাম দিকে কিছুটা এগোলেই দানদিকের সরু গলি পড়বে ডেকার্সলেনের। ভেতরে পেয়ে যাবেন ষ্ট্রীট ফুডের এক বিশাল খনি। চাইনিজ থেকে শুরু করে ইন্ডিয়ান, তন্দুর বা বাঙালী খাবার মোটামুটি সবই আছে এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
প্রথমে যে জায়গার খাবার আমরা চেখে দেখেছিলাম সেটা হলো নাম না জানা একটি চাইনিজ ষ্ট্রীট ফুডের ভেন্ডরের চিকেন ফ্রায়েড মোমো। ডেকার্স লেনে ঢুকতেই ২ টো স্টল পেরিয়ে নীল রঙের এই ভেন্ডরটি ডানদিকে আপনার চোখে পড়বেই। মাত্র ৪০ টাকায় ৫ পিস মোমো সঙ্গে স্যুপ। মোমোগুলোকে খুব হালকা অথচ মুচমুচে ভাবে ফ্রাই করা ফলে মোমোর নরম মোলায়েম texture টা কোনওভাবে নষ্ট হয়নি। ভেতরে চিকেনের পরিমাণ খারাপ নয়, এবং মোমো এবং স্যুপের স্বাদও বেশ ভালো।

এরপরে আমরা চলে যাই বেবো স্যানডুইচ স্টলের কাছে। এই দোকানের কর্ণধার রাজু বিগত ৮ বছর ধরে এখানে খাবার বিক্রি করছেন। তাঁর কাছে নন ভেজের মধ্যে চিকেন ও এগ স্যানডুইচ পাওয়া যায়। ভেজের মধ্যে আছে মিক্স ভেগ, সুইট কর্ন, চিলি চিজ প্রভৃতি নানারকম স্যানডুইচ। দোকানটি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন এবং সকল উপকরণ যেমন মাখন, টম্যাটো মেয়োনিজের ব্যবহার বেশ পর্যাপ্ত পরিমাণে। আমরা নিয়েছিলাম এগ-চিজ স্যানডুইচ। যা স্বাদে ছিল খুবই ভালো এবং ডিমের পরিমাণ ছিল যথেষ্ট। চিজটা খুব ভালোভাবে মেল্ট হয়েছিল এবং স্যানডুইচটা খুব ভালোভাবে গ্রিল হয়েছিল। মূল্য মাত্র ৫০ টাকা। সঙে একটু পটেটো চিপস এবং কেচ-আপও দেওয়া হয়েছিল। সস্তায় টিফিন বা জলখাবারের জন্য এই জায়গাটি খুবই উপযুক্ত সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল ক্লাসিক ফাস্টফুড সেন্টার। প্রায় ২৫ বছরের পুরনো এই দোকান। আমরা এর কর্ণধার শ্রী মন্টু হালদারের সঙ্গে কথা বলি ও জানতে পারি দিনে প্রায় তিনশোর কাছাকাছি মানুষ এখানে খাদ্যগ্রহণ করে। এখানের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ খাবারটি হলো মশালা কুলচা। সঙ্গে ভেজের মধ্যে তড়কা, মিক্সভেজ পনীরের নানা পদ এবং ননভেজে চিকেন কষা, চিকেন ভর্তা ইত্যাদি আছে। আমরা মশালা কুলচার সঙ্গে মিক্সভেজ ও চিকেন ভর্তা নিয়েছিলাম। চারটি কুলচাসহ দুই পদের মোট মূল্য ছিল ১৭০ টাকা। কুলচার ওপর মাখনের উপস্থিতি বেশ লোভনীয় এবং ভেতরে ছানা, নানারকম মশলা এবং সবজীর স্টাফিংটা খুবই মুখরোচক। মিক্সভেজ ও চিকেন ভর্তার পরিমাণ পর্যাপ্ত যদিও ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের প্রতিটি পদই একটু মিষ্টি লেগেছে। ঝালের পরিমাণ আরেকটু বেশী হলে আশা করি আরও ভালো লাগতো। দোকানের এক কর্মচারীর অনুরোধে আমরা ফিস ব্যাটার ফ্রাই টা চেখে দেখেছিলাম। মাছের পরিমাণ এবং বাইরের প্রলেপ্টির সঙ্গে মশলার মিশ্রণ আমাদের খুবই ভালো লেগেছে।



অবশেষে আমরা চলে যাই আমাদের অন্তিম গন্তব্যে সেটি হলো সনামধন্য লস্যি যা ধর্মতলা থেকে ডেকার্সলেন আসার পথে আগের গলিতে প্রথম দোকান। মিষ্টি লস্যি বা আম লস্যি উভয়ের মূল্য ৩০ টাকা। দইকে বরফ চিনি বা আমের সঙ্গে খুব সুন্দর করে মেশানো হয়েছে তার প্রমাণ আপনার প্রথম চুমুক থেকেই বুঝিয়ে দেবে। এছাড়া প্রতি চুমুকেই খুজে পাওয়া যায় কাজু , কিসমিস ইত্যাদি ড্রাইফ্রুট ও খোয়া ক্ষীরের উপস্থিতি। এককথায় সারাদিন গরমের মধ্যে থাকার পর এক টুকরো ঠান্ডার আরাম এই ৩০ টাকা মূল্যের একটি গ্লাস।

পরিশেষে বলা যায়, ডেকার্সলেনে আপনি পাবেন না ঠান্ডা এ.সি তে বসে খাওয়ার আরাম, আপনাকে রোদ, বৃষ্টি সবকিছুর সঙ্গে মোকাবিলা করেই আপনার ভোজনবিলাসকে উপভোগ করতে হবে। তবুও কলকাতার ঐতিহ্যকে অনুভব করতে এবং সস্তায় আনন্দ পেতে এই জায়গাটি আজও আদর্শ। এখানে ২০ টাকা থেকে শুরু করে মোটামুটি ১৫০ টাকার মধ্যে আপনার রুচি, পছন্দ এবং খরচের ইচ্ছা অনুযায়ী আপনি করে নিতে পারবেন আপনার বিকেলের টিফিন বা নৈশভোজন।