Next
Previous
0

পথে প্রান্তরে - শিবাংশু দে

Posted in


পথে প্রান্তরে


নীলমাধব - একটি বিকল্প নিমপুরাণ 
শিবাংশু দে 


নীলমাধব বৃদ্ধ হয়েছেন। নিজে গোলযোগ সইতে পারেন কি না, জানিনা। তবে তাঁকে নিয়ে অভ্রভেদী কোলাহল শুরু হয়েছিলো সেই কবে। উনিশ বছর পরে কায়াপলট হবে দেবতার। তাই গত বছর তিনেক ধরে সাজো সাজো প্রস্তুতি চলেছিলো চারদিকে। পুরীর জগন্নাথদেবের নবকলেবর হলো গত বছর রথযাত্রার সময়। যে শহরের স্থায়ী লোকসংখ্যা পঞ্চাশ হাজারও নয়, সেখানে পঞ্চাশ লাখ লোক এসে পুণ্য করে গেলেন। কোনও বড়োসড়ো দুর্ঘটনা হলোনা। পণ্ডাসমাজ বনাম ব্যুরোক্রেসি, নানা নাটকনবেল, মুর্গি লড়াই হলো। নবীনবাবুর আশীর্বাদে বাবুরা জয়ী হলেন। জনতাও বাবুদের সঙ্গে ছিলো। একুশ শতকে বসে মধ্যযুগের নিয়ম মেনে চলা পণ্ডারা বিশেষ আমল পেলো না। আসলে এদেশে বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে পণ্ডাসমাজের দুর্বৃত্তায়নের ইতিহাস বেশ পুরোনো। দেবতার নামে বদমায়েশির ভারিশিল্প। এদেশে লোকজন ভালোভাবেই জানেন সে সব। 

রথের মোচ্ছব শেষ হতে হতে পুজোর ভিড়। তার পর কাত্তিক মাস। এই মাসে ওড়িশায় যে কতরকম ধম্মোঅধম্মো'র বোলবালা চলে তার ইয়ত্তা নেই। সে সবও ফুরোলো। তার পর থেকে রথযাত্রা পর্যন্ত চলবে মন্দির সংরক্ষণের কাজ। গর্ভগৃহে পুণ্যার্থীদের প্রবেশ নিষেধ। অতএব রু-ব-রু তাঁকে দেখতে গেলে আর সময় নেই। রাতের খাবার খেয়ে লিখতে বসেছি, ভদ্রমহিলা এসে বললেন, শুতে যাও। আজ আর রাত দু'টো পর্যন্ত লেখা হবেনা। শুধো'ই , কেন? হলোটা কী? 

-ড্রাইভার কা নিদ জরুরি হ্যাঁয়, 

-ড্রাইভার? কেন? 

-কাল ভোরবেলা গাড়িটা নিয়ে বেরোতে হবে, পুরী যাবো... 

-সে কী, এই তো ঘুরে এলুম... 


মানে, মাসে এক-আধবার তো পুরী'র খেপ হয়েই যায়। হঠাৎ আবার কালকেই... 

- হ্যাঁ, নবকলেবরের পর দেখা হয়নি, এবার বন্ধ হয়ে যাবে, একবার দেখে আসি... 

-সে কী? তোমাকে ডেকেছেন নাকি? 

-না, ডাকেননি... কিন্তু জগন্নাথের প্রতি একটা অন্য ধরণের টান... 


এই দেবতাটির প্রতি তো আমিও 'অন্য' ধরণের আকর্ষণ অনুভব করি। একজন প্রাচীন অনার্য দেবতা। স্রেফ লোকপ্রিয়তার জোরে ব্রাহ্মণ্য প্যান্থিয়নে এত বড়ো একটা জায়গা হাসিল করেছেন। সম্পূর্ণ নিজস্ব একটা ভার্টিক্যাল, যেখানে বিষ্ণুবাদী আর্য প্রবণতাগুলি তাদের জোর ফলালেও শেষ পর্যন্ত প্রায় প্রাক ঐতিহাসিক, বনচর, শবরনিষাদদের বিশ্বস্ত দেবকল্পনাটিকে বুলডোজিং করে ফেলতে পারেনি। আর্যদের চিরাচরিত ধাতু বা পাথরের বিগ্রহ তাঁর জন্য নয়। উপজাতিক দেবতাদের জন্য প্রযোজ্য দারুবিগ্রহ। পরাবাস্তব কল্পনাময় সেই রূপায়ণ। যা লিঙ্গ বা মানুষমূর্তি নয়। এমন কি আদি টোটেমভিত্তিক পশু ও মানুষিক অবয়বের মিশ্রণও নয়। থাকার মধ্যে দুটি চোখ। আকাশের মতো, শুধু দেখে যাওয়া। কাজ করার মতো অঙ্গ কিছু নেই। নির্বিকার, নির্বিকল্প, নির্গুণ একজন কৃষ্ণদেবতা, অমাবস্যার মতো কালো। 'অদীক্ষিত, অশিক্ষিত' অনার্যদের সেরিব্রাল কল্পনা, সৃজনের স্বাধিকার। 

পুরাকালে এই জায়গাটার নাম ছিলো মহা উদধি। মানে ভারতভূমির প্রথম সূর্যোদয় নীলাচলের এই সাগর উপকূল থেকেই লোকের চোখে পড়তো। এখনও ভোর হয় হয় এখানে পাঁচটা বাজার আগেই। তবে এই শেষ হেমন্তবেলায় আলো ফুটতে একটু দেরি হয়। তার উপর অঘ্রাণের কুয়াশা সমুদ্রের ঢেউ বেয়ে পশ্চিমে ভেসে আসে। মেঘলা লাগে একটু। ছটা নাগাদ গাড়ি বার করলুম। আমার রসুলগড়ের তাঁবু থেকে জগন্নাথ স্বামীর বাড়ি নতুন বাইপাস দিয়ে ঠিক সাড়ে চুয়াত্তর কিমি। রাস্তার নাম শ্রীজগন্নাথ জাতীয় সড়ক। ছবির মতো চার লেন পথ। একশো কুড়ি-পঁচিশ চললেও গাড়ির ভিতরে কো'ই গল নহি। শুধু ভোর ভোর নতুন গাড়িশিখিয়েরা এখানে চালানো শেখে। তার উপর লিঙ্গরাজের বাহনরা পরমানন্দে রাস্তার উপরেই ঘরবাড়ি বেঁধে জাবর কাটছে। এই সব কেষ্টর জীবদের বাঁচিয়ে চালানো। রাস্তার উল্টোদিক আসা রাশি রাশি দু'চাকা, ট্র্যাক্টর, বালুর লরি, ঘাসবোঝাই সাইকেল, যাত্রীবোঝাই বিশাল বিশাল ভলভো বাস, পরস্পর আড়াআড়ি করে রাস্তা কাঁপিয়ে উড়ে যাচ্ছে। গ্রামের পাশ দিয়ে যাবার সময় সদ্য ঘুমভাঙা লোকজন গামছা সম্বল হয়ে সরকারি রাস্তাকে বাড়ির উঠোন ভেবে এপার ওপার করছে দাঁতন করতে করতে। ছাগল-পাগল, ইশকুলের বাচ্চা, যখন তখন সামনে এসে গেলে, এসব কিছু চাপ তো থাকেই। পুরোনো ডেরাইভারকেও দেখে চালাতে হয়। তাও গাড়ি যখন তিন সংখ্যার স্পিডে চলে। বহুদিন পর ভোরের রোদ গায়ে পড়লো। সঙ্গে ভীমসেনের আসাবরি তোড়ি। শিহর লাগায় হাওয়া, শিহর জাগায় সুর। 

পিপলি, সতশঙ্খ, সাক্ষীগোপাল, দণ্ডসাহি, চন্দনপুর, আগেকার সব মাথাখারাপ ট্র্যাফিক দঙ্গল এখন প্রায় উড়ে পেরিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু বটমঙ্গলা মন্দির থেকে রাস্তা রোগা হতে শুরু করে। গায়ের উপর ঘরবাড়ি, অলস'পদ গ্রামীনদের চলাফেরা, তার ভিতর রাস্তা করে অত সকালেও রাশি রাশি আসাযাওয়া। অঠারানালার ট্র্যাফিক আলো থেকে ডানদিকে ঘুরে বড়াদণ্ড, গ্র্যান্ডরোড, রথের পথ, মন্দির চলে যাচ্ছে সটান। যেখানে ইতর লোকজন গাড়ি রাখেন, সেখান থেকে মন্দির অনেকটা পথ। যাঁরা হেঁটে যান না, তাঁদের জন্য রিকশা, অটো, মন্দিরের অরুণধ্বজ পর্যন্ত। মিঠেরোদে হেঁটে যাওয়াই ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু পণ্ডামশাই ফোনে তাড়া করছেন। ভিড় বেড়ে যাচ্ছে। ফলে সকালবেলাতেই বিবেকবিরুদ্ধ ডিসিশন নং ১ । রিকশায় যেতে হবে। তবে তাই হোক। 

কথা আছে, আমাদের স্টেশন রোড ব্রাঞ্চের নিচে এসে দাঁড়াতে হবে। সেখান থেকেই ঠাকুরের প্রেরিত পুরুষ আমাদের খুঁজে নিয়ে যাবেন। সেখানেই দাঁড়াই। চারদিকে শত শত সারাভারতের তৃণমূল পুণ্যার্থী। সবাই এই নরম ভোরে নানাভাবে অবিরাম নিষ্ঠীবন বর্ষণ করে চলেছেন তীর্থযাত্রার গৌরচন্দ্রিকা হিসেবে। একটুক্ষণ পরে অসহ্য বোধ হওয়ায় এগিয়ে যাই অরুণস্তম্ভের কাছে। না, আশেপাশে এখনও কেউ থুতু ফেলা শুরু করেনি। এখান থেকে বোধ হয় ঠাকুরের রাজত্ব শুরু হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পণ্ডামশাই এসে যান। কিন্তু ততোক্ষণে সিংহদুয়ারের সামনে আক্ষরিক অর্থেই প্রায় রথযাত্রার ভিড় লেগে গেছে। যেকোনও বঙ্গীয় ভদ্রলোকের মতো পিছনের দরজা খুঁজি। দক্ষিণদিকের এই দরজাটির নাম ঘোড়াদ্বার'অ। প্রথম পাঁচিল মেঘনাদ পচির-অ, পেরিয়ে কূর্মবেধ'অ। ভিতরে রয়েছে নাকি একশো কুড়িটা মন্দির। সহস্র মানুষের ভিড়ে আলপিন পড়ার জায়গা নেই। উচ্চকিত দেবতার ভোর। মন্দিরের মাঝে মন্দির। গলির মাঝে গলি। ভিক্ষার থেকে ভিক্ষা, প্রত্যাশার থেকে প্রত্যাশা। পাইয়ে দেওয়ার দেবতা এতো হট্টগোলের মাঝখানে দারুব্রহ্ম হয়ে নীরব, নিশ্চুপ। তিনি আর হতচকিত হন'না। প্রায় হাজার বছরের অভ্যেস। 

রাজার নাম ছিলো বিশ্ববসু। তিনি ছিলেন অরণ্যময় নীলাচলে শবর, ব্যাধ, নিষাদ'দের রাজা। তাঁর একজন আরাধ্য দেবতা ছিলেন নীলমাধব। এই দেবতার মূল নাম 'কিতুং'। বিশ্ববসু নিজে অনার্য, প্রজারাও অনার্য। পাথর বা ধাতুমূর্তিতে দেবতাকে কল্পনা করেন না তাঁরা। বনের কাঠই তাঁদের জীবন, দেবতাও কাঠের। দেবতার গড়নও তাঁদের চিন্তা থেকেই আসে। আর্যদের তৈরি মানুষের মতো চেহারার দেবতারা তাঁদের জন্য ন'ন। পূর্ব উপকূলের স্থানিক, অন্ত্যজ মানুষদের কাছে তাঁর মাহাত্ম্য প্রশ্নহীন। উত্তরপশ্চিম প্রান্তের মলয় বা মালওয়া রাজত্বের আর্যরাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ইচ্ছা করেন পূর্ব উপকূলেও আর্যদের রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হোক। এই রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের একটা পৌরাণিক সন্দর্ভ রয়েছে। যদিও কিংবদন্তীমাত্র, তবু এই রাজার আনুমানিক সময়কালকে যদি স্বীকার করার চেষ্টা করা যায় তবে তা গৌতম বুদ্ধের আগে যাবে। এই রাজা একজন কিরাতবংশীয়, অর্থাৎ ব্যাধকূলের দলপতি ছিলেন বলে মনে করা হয় (আমাদের চণ্ডীমঙ্গল?)। যেহেতু নামটা আর্য, তাই মনে হয় 'ইন্দ্র' হয়তো এই জনগোষ্ঠীর টোটেম ছিলো। গৌতম বুদ্ধের অনেক আগে থেকেই দক্ষিণ ওড়িশা, অর্থাৎ কলিঙ্গদেশে সমৃদ্ধ সভ্যতার উল্লেখ রয়েছে। কারণ 'সম্ভল' রাজপাটেরও (এখনকার সম্বলপুর) ইন্দ্রদ্যুম্নের নামের সঙ্গে সম্পৃক্তি আছে। সম্ভলের যে উল্লেখ মহাভারতে পাওয়া যায় তাতে মনে হয় সেখানে আর্যদের সঙ্গে অনার্যদের যোগাযোগ বেশ প্রাচীন ব্যাপার। এ হেন রাজামশাই শুরু করার জন্য তিনি বেছে নিলেন অনার্যদের আরাধ্য দেবতা নীলমাধবকে আর্যায়িত করার কাজ। বিদ্যাপতি নামে এক আর্য ব্রাহ্মণকে তিনি নির্দেশ দিলেন সেই অরণ্যপ্রান্তরময় পূর্বদেশে গিয়ে তাঁদের দেবতা নীলমাধবকে খুঁজে বের করার কাজ। নীলমাধব থাকেন গভীর অরণ্যের গোপন গুহায়িত দেবালয়ে। সেখানে বিশ্ববসু তাঁর পূজা করেন। কী করে পাওয়া যাবে সেই দেবতার খোঁজ? চতুর ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি কীভাবে যেন রাজার দুহিতা ললিতাকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে ফেলতে সক্ষম হলেন। রাজজামাতার পক্ষে অনার্য দেবতা নীলমাধবের সন্ধান পাওয়া অনেক সহজ হয়ে গেলো। নীলমাধব থেকে দারুব্রহ্ম জগন্নাথ, 'ইন্দ্রদ্যুম্ন' রাজার সময়েই এই নতুন দেবতার কল্পনা করা হয়। যদিও সে সময় অনার্যদের মননে 'ব্রহ্ম' জাতীয় কোনও আর্য ধারণা ছিলো, এ রকমটা বিশ্বাস করা মুশকিল। বস্তুত আর্যদের দেবতা ধাতু বা প্রস্তরনির্মিত হতো। তাই কাঠের বিগ্রহ বা মাটির দেবমূর্তি অনার্যবিশ্বাস সম্ভূত বলেই মনে হয়। সব থেকে বড়ো ব্যাপার জগন্নাথের রূপকল্পনা আর্যদের সমস্ত দেবমূর্তি, গ্রিস বা গান্ধার সব প্রকল্পনা থেকে এত-ই ভিন্ন যে নিঃসন্দেহে জগন্নাথ অনার্য দেবতার প্রতীক। এর থেকেও উল্লেখ্য লক্ষণ যে জগন্নাথের কোনও জাতিবিচার নেই। শ্রমজীবী অনার্যদের মধ্যে শ্রেণীভিত্তিক দেব আরাধনার কোনও প্রচলন ছিলোনা। 

একই সঙ্গে এই সময় থেকেই শুরু হয় ভারতবর্ষের পূর্ব উপকূলের ওড্রদেশে লোকপ্রিয় অনার্য দেবতা নীলমাধব অথবা জগন্নাথকে নিয়ে আর্যদের অধিকার যুদ্ধের ইতিহাস। ইন্দ্রদ্যুম্ন নামক রাজচরিত্রটি আসলে আর্যদের উপনিবেশবাদের প্রতীক। নীলমাধবের খোঁজ পেতেই রাজা 'তীর্থযাত্রা' (হয়তো যুদ্ধযাত্রাই হবে) করতে ওড্রদেশে এসে উপস্থিত হলেন। কারণ নির্ভীক শবর, নিষাদ অনার্য যোদ্ধাদের যুদ্ধক্ষেত্রে মোকাবিলা করে বহিরাগত আর্যদের পক্ষে রাজ্যবিস্তার বেশ দুরূহ কাজ। পরবর্তীকালে মহারাজাধিরাজ অশোক মৌর্য তার সাক্ষী। তার থেকে যদি তাঁদের সর্বমান্য দেবতাকেই আর্যায়িত করে ফেলা যায়, তবে খেলাটা অনায়াসে জিতে নেওয়া যাবে। শবর'রা ইন্দ্রদ্যুম্নকে আসতে দেখে তাঁদের দেবতাকে লুকিয়ে ফেললেন। কোথাও খুঁজে না পেয়ে আবার কিংবদন্তির সূত্রপাত করতে হলো আর্যদের। ইন্দ্রদ্যুম্ন নামক চরিত্রটিকে সামনে রেখে চিরাচরিত কঠোর তপস্যা, দৈববাণী, অশ্বমেধ যজ্ঞ, ভেসে আসা কাঠ, স্বপ্নাদেশের পথ বেয়ে 'জগন্নাথ' দেবের সৃষ্টি হলো আদ্যন্ত আর্যদেবতা বিষ্ণুর রূপকল্প হিসেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাজিটা মেরেই দিলেন আর্যরা। ব্রাহ্মণ্যযুগে যেহেতু দেশের পূর্বপ্রান্তে আর্যদের তেমন স্ট্রাক্চার্ড অধ্যাত্মিক পরিকাঠামো ছিলোনা, তারা জগন্নাথের জনপ্রিয়তাকে ট্রোজান ঘোড়ার মতো ব্যবহার করে তাঁকে বিষ্ণুর রূপান্তর হিসেবে প্রচার করলো। নবম-দশম শতকে, বাংলাদেশের মতো-ই প্রচুর পশ্চিমদেশীয় (পড়ুন কান্যকুব্জীয়) মানুষকে এখানে আমদানি করা হয় গাঙ্গেয় উপত্যকার ব্রাহ্মণ্যধর্মের শিকড় মজবুত করতে। কৃষ্ণবর্ণ দেবতা জগন্নাথের সঙ্গে গৌরবর্ণ বলভদ্র ও সুভদ্রাকে যোজনা করা হলো। যদিও সপ্তম শতক থেকেই ওড্র, উৎকল, কলিঙ্গতে দেবতা হিসেবে শিবের (মূলত কৌম সমাজের দেবতা, আর্যদের আত্তীকৃত) রমরমা, কিন্তু নীলাচলে জগন্নাথকে কেউ টলাতে পারলো না। জনগণেশের চেতনার এত গভীরে এই দেবতার মাহাত্ম্য প্রোথিত রয়েছে যে কূটবুদ্ধি আর্যরা তাঁকে লোপ করতে চেয়ে বিফল হওয়ার পরিবর্তে নিজস্ব দেবতার দলে আত্তীকরণ করে নিলো। সঙ্গে ফাউ হিসেবে অগণিত লোককথা, কিংবদন্তী ইত্যাদি। বাংলায় যাকে বলে 'সিমলেসলি', জগন্নাথ বিষ্ণুর প্রতিরূপ হয়ে গেলেন। অনার্যদের স্বভাবজ কৃষ্ণবর্ণ গুহাবাসী একাকী দারুদেবতা'কে আর্যমতে পারিবারিক অবতারে আনতে গিয়ে নানা সন্দর্ভের আশ্রয়ও নিতে হলো তাঁদের। 'জগন্নাথ' তো এখন 'আর্য' দেবতা। তাঁর জন্য 'বিপুলাকার' মন্দির গড়া হলো। স্বয়ং ব্রহ্মা স্বর্গ থেকে নেমে আশীর্বাদ জানালেন। আর্যকবিরা ত্রেতাযুগ থেকে দ্বাপর পেরিয়ে 'জগন্নাথে'র কিংবদন্তি নিয়ে রচনা করে ফেললেন নানা আখ্যান। ইন্দ্রদ্যুম্নের যজ্ঞাগ্নি থেকে উদ্ভূত নৃসিংহ দেবতা 'নারায়ণে'র নতুনরূপ কী রকম হবে তা নিয়ে ফরমান জারি করলেন। পরমাত্মা জগন্নাথ আসলে বাসুদেব, সঙ্গী ব্যূহ হবেন বলভদ্র বা সংকর্ষণ বা সহজকথায় পুরাণের বলরাম। তবে নতুন দেবতার শক্তি যোগমায়া, অর্থাৎ সুভদ্রার সঙ্গে কিন্তু জগন্নাথের পুরুষ-প্রকৃতির সম্পর্ক নয়। সম্পর্কটিতে একটু টুইস্ট রয়েছে। আর্যাবর্তের পুরাণকথা অনুযায়ী সুভদ্রা কৃষ্ণের ভগ্নী। তাই প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মী ও নারায়ণের সম্পর্কের সঙ্গে জগন্নাথ ও সুভদ্রার সম্পর্ক ঠিক সমান্তরাল নয়। সম্ভবতঃ এই বিষয়টি (জগন্নাথ ও তাঁর শক্তি'র মধ্যে নারীপুরুষের স্বাভাবিক দাম্পত্য সম্পর্ক) নিয়ে অনার্যদের মধ্যে আপত্তি ছিলো। কারণ নীলমাধব বা জগন্নাথ একেশ্বরবাদের প্রতিভূ। তিনি সবার সৃজনকর্তা। যেকোনও দেবীকল্পনাও বস্তুতঃ তাঁরই সৃষ্টি। তাই সম্পর্কটি স্ত্রীপুরুষের হতে পারেনা কোনও মতেই। আর্যসভ্যতা হয়তো এক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ আপোস করেছিলো। কারণ আর কোনও দেবতার ক্ষেত্রেই এর পুনরাবৃত্তি দেখতে পাওয়া যায়না। বিষ্ণুর সুদর্শনচক্রকেও জগন্নাথ পরিকাঠামোর অংশ করে দেওয়া হলো জগন্নাথের 'বিভাব' হিসেবে। স্কন্দপুরাণ বা ব্রহ্মপুরাণ জাতীয় মধ্যপর্বের পুরাণগুলিতে জগন্নাথ সংক্রান্ত এই জাতীয় ডিসকোর্সগুলি পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে সরলাদাস, জগন্নাথদাস, বলরামদাস প্রমুখ পণ্ডিতের নানা লেখায় জগন্নাথ কাল্ট গড়ে ওঠার একটা রূপরেখা পাওয়া যায়। দু'টো ঘটনা, ১৫০১ সালে শ্রীচৈতন্যের পুরী আগমন এবং ১৫৮৬ সালে মুসলিম শাসনের পত্তন, ওড়িশায় জগন্নাথকেন্দ্রিক মন্থনের মেরুকরণ সূচনা করে। 

আরেকটি ক্ষেত্রে আর্যদের আপোস করতে হয়েছিলো। অনার্যরা তাঁদের কল্পিত দেবতার বিগ্রহে কোনও রকম রদবদল স্বীকার করেননি। আর্যদের দেববিগ্রহ নির্মাণ পদ্ধতির কিছু স্বীকৃত ব্যাকরণ ছিলো। প্রথমতঃ মাধ্যম হিসেবে ধাতু বা পাথর ছাড়া আর সবকিছুই অপবিত্র মনে করা হতো। দ্বিতীয়তঃ আকারগত কল্পনার ক্ষেত্রে মানুষী মূর্তির নির্দিষ্ট গঠনটিকে অস্বীকার করা নিষেধ ছিলো। কারণ আর্যদের কল্পিত সব দেবমূর্তিরই নির্দিষ্ট গুণ, কর্ম ও রূপের বাধ্যতা রয়েছে। আধার ও আধেয়'র মধ্যে একটা নির্ধারিত ছন্দ ও নিয়ম কাজ করে। শুধু এদেশে নয়। য়ুরোপের আর্যরা, যেমন গ্রিস বা রোমের দৈবী কল্পনাতেও একই ছাঁচ কাজ করেছে। কিন্তু জগন্নাথ, অনার্যদের বিচারে একটি ঐশী ধারণা, নিছক দেবমূর্তি ন'ন। তিনি নির্গুণ ব্রহ্ম। তাঁর বাহু, জানু, পদযুগলের প্রয়োজন নেই। রয়েছে শুধু আকাশের মতো দু'টি চোখ। তিনি সব কিছু দেখতে পা'ন। কিন্তু সৃষ্টি-স্থিতি-বিলয়ের কোনও খেলাতেই তাঁর কোনও ভূমিকা নেই। এই মহৎ লক্ষণটি আর্য প্যান্থিয়নের কোনও দেবতাই হাসিল করতে পারেননি। তাঁরা অতি শক্তিমান মানুষী রাজা বা পুরোহিতের প্রতিচ্ছবির ছায়া। ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারার কোনও এলেম তাঁদের নেই। আরও বহু কিছুর মতো 'অসভ্য' অনার্যরা যে আর্যদের সেরিব্রাল আধিপত্যকে নিজস্ব ভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে, 'জগন্নাথ' নামের অবধারণাটি তার একটি নিদর্শন। 

জগন্নাথের প্রচলিত রূপটি হয়তো আর্যদের বিশেষ পছন্দ ছিলোনা। তাই একটি গল্পের অবতারণা করতে হয় তাঁদের। ভেসে আসা নিমকাঠটি থেকে দেবমূর্তির রূপ দেবার জন্য পিতামহ ব্রহ্মা'র ইচ্ছায় স্বয়ং বিষ্ণু এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে অবতীর্ণ হ'ন। তাঁর শর্ত ছিলো যতদিন না কার্যসমাধা হবে, কেউ তাঁকে বিরক্ত করবে না। বেশ কিছুদিন পরেও যখন কাজটি সম্পূর্ণ হলোনা, তখন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পত্নীর অনুরোধে মন্দির কক্ষের দরজা বলপূর্বক খুলে দেখেন সেই ব্রাহ্মণ কোথাও নেই আর কিছু 'অর্ধসমাপ্ত' দারুমূর্তি রাখা আছে। আর্য অহমের একটি প্রকাশ এখানে পাওয়া যাবে। অনার্যদের কল্পিত জগন্নাথবিগ্রহ তাঁদের বিচারে 'অর্ধসমাপ্ত'। কারণ সেটি নান্দনিক বিচারে আর্য উৎকর্ষের নির্দিষ্ট স্তর স্পর্শ করেনা। আসলে এখন বিস্ময় লাগে, কীভাবে জগন্নাথবিগ্রহ স্তরের একটি সার্থক পরাবাস্তব শিল্পবস্তু সেই পুরাকালের শিল্পীদের ধ্যানে রূপ পেয়েছিলো। নিজেদের ধ্যানধারণা থেকে বহুক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকলেও আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদ বাধ্য হয়েছিলো জগন্নাথদেবকে নিজেদের বিষ্ণুকেন্দ্রিক প্যান্থিয়নে সসম্মানে স্থান করে দিতে। তার মূল কারণ দেশের এই প্রান্তে জগন্নাথের প্রশ্নহীন বিপুল লোকপ্রিয়তা। যেভাবে পূর্বভারতে প্রচলিত নানা শিব ও শক্তিভিত্তিক দেবদেবীদের জন্য ব্রাহ্মণ্যধর্মকে দরজা খুলে দিতে হয়েছিলো, সেভাবেই জগন্নাথও বিষ্ণুদেবতার সমার্থক হয়ে আর্য-অনার্য নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের পরিত্রাতা হয়ে ওঠেন। এখনও জগন্নাথদেবের মূলপূজারী অব্রাহ্মণ, সাবর্ণ হিন্দুগোষ্ঠীর বাইরের মানুষ। সত্যিকথা বলতে কি সারা দেশে অন্ত্যজ, নিম্নবর্গীয় মানুষজনদের জন্য জগন্নাথমন্দিরের মতো এই পর্যায়ে 'শাস্ত্র'সম্মত প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা আর কোথাও দেখিনি। কবি যখন বলেন, "জগন্নাথের জাত যদি নাই, তোদের কেন জাতের বালাই...", একটি আর্ষ সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। 

এহেন একজন ইতরের দেবতা, স্রেফ লোকপ্রিয়তার জোরে সর্বগ্রাসী ব্রাহ্মণ্য আনুকূল্যকে জিতে নিয়ে জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে সমগ্র 'জগতের নাথ'। হয়তো একটু অন্য রকমভাবে ভাবার দাবি তিনি রাখতেই পারেন। ব্রাহ্মণ্য অধ্যাত্মজগতে সম্ভবত এটিই একমাত্র সাম্রাজ্য যেখানে মুখ্য পূজারী দৈতপতির দল অনার্য শবরদের বংশধর। জগন্নাথ সৃজনের স্বীকৃতি হিসেবে অনার্যদের রাণী গুন্ডিচা, যিনি লোককথা অনুসারে একাধারে রাজা 'ইন্দ্রদ্যুম্নে'র মহীষী ও জগন্নাথ রূপকল্পের মুখ্য ধাত্রী, তাঁর গৃহে জগন্নাথকে বছরে মাত্র সাতদিনের জন্য বিশ্রাম নিতে পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হলো। সঙ্গে এল কৃষিভিত্তিক কৌমসমাজের রথযাত্রার আয়োজন। যেহেতু 'ভগবানে'র মা কোনও মানবী হতে পারেন না, তাই তাঁকে মায়ের ভগ্নী মাসিমা হিসেবে সম্বোধন করা হয়। জগন্নাথ ধারণাকে ভ্রূণ থেকে সাবালকত্ব পর্যন্ত প্রতিপালন করার স্বীকৃতি হিসেবে এই সম্মান সমস্ত কৌম অনার্য মায়েদের গরিমান্বিত করে। 'গুন্ডিচা' শব্দটি মনে হয় দ্রাবিড়িয় ভাষা থেকে এসেছে। বীরত্বের সঙ্গে শব্দটির যোগাযোগ আছে। তিনি একজন অনার্য গ্রামদেবী। লোককথায় ইন্দ্রদ্যুম্নের রাণী। এভাবেই গুন্ডিচা'কে নিয়ে আর্য বৈষ্ণব দুনিয়াকে আপোস করতে হয়েছিলো। এই নারী বা দেবী জগন্নাথের কাছে যাননা, জগন্নাথ তাঁর কাছে আসেন রথে চড়ে। যাবতীয় ঐশী অহংকারকে তাকে রেখে।  

বাল্যকাল থেকেই পুরী'তে আমাদের নিয়মিত আসাযাওয়া। বাইরে থেকে এই দুশো পনেরো ফিট উঁচু বিস্ময়কর মন্দিরটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতুম। গর্ভগৃহের শ্বাসরোধী ভক্তিকুটিল আবহ থেকে চিরকালই দূরে থেকেছি। স্থাপত্যটির প্রতি মুগ্ধতাই যথেষ্ট ছিলো। তার দেবতার বেদীকে স্পর্শ করার কোনও চাপ অনুভব করিনি। পরবর্তীকালে দেখেছি যদিও আমার সঙ্গিনী এই অধমের মতো'ই যাবতীয় বিগ্রহের আশ্বাস থেকে সতত দূরে থাকেন, 'পুজোআচ্চা' জাতীয় ধুলোখেলার থেকেও বহু দূরে। অথচ জগন্নাথের প্রতি তাঁর একটা 'আনুগত্য' চোখে পড়েই যায়। ইতরজনের দেবতার প্রতি টানটি আমি লক্ষ্য করি। অবরে সবরে তিনি জগন্নাথ মন্দিরের গর্ভগৃহ যেতে চাইলে 'দেহরক্ষী' হিসেবে আমারও বরকন্দাজের ডিউটি। 

তা ঘোড়াদের পেরিয়ে ভিতরে যাওয়া গেলো। প্রথম প্রাচীরের পর দ্বিতীয় প্রাচীরের সিঁড়ি। সেখান থেকে সারা ভারতবর্ষের তুমুল কোলাহল আর গুঁতোগুঁতি। সারি সারি ছোটোবড়ো দেবস্থান, বনস্পতি আর পুণ্যাতুর মানুষের ঘনসন্নিবেশ এড়িয়ে এড়িয়ে পণ্ডামশাই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ডানদিকে বিমলা মন্দির রেখে পিছনে মহালক্ষ্মী। গর্ভগৃহের পূর্বদিকের সিঁড়ির কাছে আসতেই গোরা পণ্ডার চিরাচরিত সাবধানবাণী। পার্স বা টাকাপয়সা যেন একেবারে আড়ালে রাখা হয়। যেন পাটনা জংশনে মিছিল ফেরত ভিড় বা মুম্বাই সেন্ট্রাল লাইনের অফিস টাইম লোক্যালের যাত্রীদের প্রতি সতর্কবার্তা। না, পকেটমারদের জন্য এই সাবধানতা নয়। এই দেবতার দালালদের জন্য এই প্রস্তুতি। পণ্ডামশাইয়ের কারুকার্যে সিঁড়িতে বিশেষ ধাক্কা না খেয়েই খাকি পেয়াদার বেষ্টনী পেরিয়ে যাই। পাশে ছড়িদার দাঁড়িয়ে। ছড়ি তুলতেই আমার চাহনি দেখে আর এগোলো না। তারপর শুরু সেই অত্যন্ত বিপজ্জনক জলেকাদায় ছপছপে পিছল ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে গর্ভগৃহে নামার অভিযান। পিছন থেকে ভক্তিমুখর আর্তিকঠোর অন্ধ পল্টনের চাপ। যথেষ্ট পটু না হলে নিজেকে বাঁচিয়ে দেবতার সামনে নিরাপদে ভূমিষ্ট হওয়া দায়। ভিতরে দুয়েক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে পারা পূর্বজন্মের সুকৃতিমাত্র। চারদিকে ধোঁয়া সম্বল কর্পূরের মশাল প্রদীপ। পায়ের নীচে অতি মলিন জলধারা। এই নির্বাত, নিরালোক, নিঃসীম শব্দপ্রদূষিত, শ্বাসরোধী, পরিত্রাণহীন আবহে দেবতা তাঁর 'রত্নবেদী'তে দাঁড়িয়ে কী ভাবেন, কে জানে?  

সেই অন্ধগৃহের এককোণায় টেনে নিয়ে যান পণ্ডামশাই। সেখান থেকে নাকি কিঞ্চিৎ সুস্থভাবে বিগ্রহ দর্শন করা যাবে। দেবতা তাঁর শাদা সুতি কাপড়ের পোশাকে রয়েছেন সেই মুহূর্তে, তড়পা উত্তরি বা অবকাশবেশে। নবকলেবর হয়তো বা। পূর্বকলেবর থেকে কোনও তফাত নেই। সেটাই তো হবে। অরণ্যের অনার্য সংস্কৃতি দারু ছাড়া অন্য মাধ্যমে তাঁদের দেবতাকে ভাবতে পারেননা। নিম মানুষের জন্য অতীব উপকারী বনস্স্পতি। উপরন্তু তার ভেষজগুণের জন্য কীটের আক্রমণ থেকে অনেকটা সুরক্ষিত। অতএব দেবতার বিগ্রহের মাধ্যম হিসেবে তা শ্রেষ্ঠ বিকল্প। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে দেবতার নতুন কলেবর তৈরি হবে। কিন্তু সেই গাছ খোঁজা থেকে শুরু করে মধ্যরাতে ব্রহ্মস্থাপন, অগণন রিচ্যুয়াল, অশ্রান্ত শ্রমদান। ভক্তি, ভালোবাসা, ভয়, অভ্যেস, শিল্প, বাণিজ্য, রাজনীতি, ঈর্ষা, দম্ভ, শ্রেণীস্বার্থ কতকিছু জড়িয়ে আছে এই উদযাপনটির সঙ্গে। দেবতা তো প্রতীক মাত্র। পণ্ডা ডাকেন প্রদক্ষিণ করার জন্য। এক অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকার গলিপথে মানুষ রত্নবেদী প্রদক্ষিণ করছে। প্রতিপদে পণ্ডারা দেবতার 'দর্শন' পাইয়ে দেবার মূল্য হিসেবে ভক্তের থেকে আরও অর্থ দাবি করে যাচ্ছে। কসাইয়ের দোকানে দরাদরি থেকে তার কোনও তফাত নেই। বেদী প্রদক্ষিণ করে যখন সেই অন্ধকূপ থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছি তখন একটি পণ্ডা এই ক্ষীণ গলিপথটি আটকে বেশ জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে তোলা আদায় করে যাচ্ছে। কিছু না বলে পাশ কাটাই। সে অত্যন্ত উগ্রমূর্তি ধারণ করে অভিসম্পাত করতে থাকে। অভিযোগ করে, সব টাকা মাংসভোজন করে, চিংড়িমাছ আর মদিরার পিছনে ব্যয় করা ভক্তের দল, চুলোয় যাবে। তাকে উৎকোচ না দিলে জগন্নাথ ভক্তকে প্রত্যাখ্যান করবেন। দর্শনের পুণ্য ব্যর্থ হবে। সেদিনের মতো তার সময় বোধ হয় শেষ হয়ে আসছে সেই মুহূর্তে। বুঝতে পারি, অন্য আর একজন লুব্ধ দেবতার দালালকে জায়গাটা ছেড়ে দিতে হবে অবিলম্বে। আজকের মতো তার রোজগার শেষ হবে। অসম্ভব পিছল ভাঙা সিঁড়ি পেরিয়ে পপাত চ না হয়ে গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। বাইরে দিনের আলোয় পৌঁছেই প্রথম যে কথাটা মনে এল, পা দুটো ভালো করে ধুতে হবে। 

প্রিয় কবির প্রিয়তম কবিতার একটি লাইন দেবতাকে ছাপিয়ে বহুক্ষণ ধরে 'মাথার চারিপাশে' ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। "শত শত শূকরের চিৎকার সেখানে, শত শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর"। আর কীই বা বলা যাবে? কিন্তু এত এত মানুষ চারদিকে, যারা এই যাত্রার পর নিজেদের ধন্য, তৃপ্ত, চরিতার্থ বোধ করছে। তারা কী ভুলভাল মানুষ? সম্ভবতঃ ও তল্লাটে সেই মুহূর্তে আমিই একমাত্র পোকামাকড় যে এভাবে ভেবে যাচ্ছে। তবে কি 'জগন্নাথ' আমার জন্য ন'ন? 

পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসি। জুতো পরি। পণ্ডামশাইকে দক্ষিণা চুকাই। কলরবমুখর ভিখারিরা, উষ্ণ সৌরভময় গজা'র দোকান, কাঁসার বাসন সকালের নরম রোদে ঝিকমিক করছে, বিভ্রান্ত গ্রামীণ ভক্তসমূহের জাঠা, কোনও এক পণ্ডা মেষপালকের মহিমায় তাঁদের তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে পুণ্যের সন্ধানে। সাইকেল, ষাঁড়, কুকুর আর ঝাঁক ঝাঁক পায়রা। জগন্নাথের দিন গড়াতে শুরু করে আরেকটা বিকেলের দিকে। আরও ফুল, আরও পাতা, শত শত মাটির বাসনে কুটে রাখা ভোগের শাকসব্জি, কাঁধে বাঁক নিয়ে আনন্দবাজারের দিকে ধেয়ে চলেছে অন্যান্য ভোগের সামগ্রী। কোথাও কোনও ফাঁক নেই, ফারাক নেই। জগন্নাথের মন্দির ঘুরে ঘুরে সূর্যের রথ গড়িয়ে যায় পূর্ব থেকে পশ্চিম। 

পাতকীর ছায়াও দীর্ঘ হয়ে আসে।