Next
Previous
0

ধারাবাহিক : বিশ্বনাথ রায়

Posted in


ধারাবাহিক


‘যাবনী মিশাল ভাষা’র সন্ধানে ২
বিশ্বনাথ রায়



অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভুরশুট-মান্দারন অঞ্চলের উন্নত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বালিয়া, মণ্ডলঘাট পরগনায় ছোটো-বড়ো অনেক কবিই ‘সত্যপীর’-এর পাঁচালি লিখেছিলেন। এঁদের মধ্যে তিনজন বিখ্যাত কবি হলেন পেঁড়ো(পাণ্ডুয়া)-র ভারতচন্দ্র, হাফেজপুরের শাহ্ গরীবুল্লাহ ও তাজপুরের আরিফ (‘দশড়া দক্ষিণে ঘর তাজপুর মোকাম’)। দক্ষিণরাঢ়ের আর একজন বিখ্যাত কবি হলেন ভুরশুট পরগনার উদনা (বর্তমানে উদঙ) নিবাসী সৈয়দ হামজা। এছাড়াও চক-সাহাদাতের শের আলি, মুন্সীরহাট নিকটবর্তী ধসা গ্রামের জনাব আলি, প্রমুখ কবি পরবর্তীলকালে খ্যাতিলাভ করেছিলেন।

আরিফ-এর কাব্যে মুসলমানি বাংলা তেমন উৎকট না হওয়ায় তাঁর সত্যপীরের পাঁচালির দীর্ঘ ‘লালমোহন’ আখ্যান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।

চারি যে কলেমা শাহা আপনি পড়িল।
উঠিয়া উজিরজাদী শ্ছালাম করিল।।

* * *

হাস্য পরিহাস কথা কহে দুই জনে।
রচিল আরিপ কবি সত্যার চরণে।।

* * *

মরদানা পোসাগ করি বান্ধিব কোম্বর।
রাহা-খরচ নিব কিছু আশ্ছরপি মোহর।।

* * *

এতেক বলিয়া দুহে ঘোড়া হেকে যায়।
ভুলিল আজমের রাহা দিশা নাই পাই।।

বস্তুত অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভুরশুট পরগনা ও তার চারপাশের মুসলমান সমাজে আরবি-ফারসি-হিন্দুস্থানি মেশনো এই বাংলা ভাষার প্রচলন দৈনন্দিন জীবনচর্যার সঙ্গে এমনই ওতপ্রোত ছিল যে সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ ভারতচন্দ্র কিশোর বয়স থেকেই তার প্রভাব এড়িয়ে যেতে পারেননি। দেবানন্দপুরে রামচন্দ্র মুন্সীর বাড়িতে ছাত্রাবস্থায় চৌপদীতে প্রথম যে সত্যপীরের পাঁচালিটি লিখেছিলেন, তাতেও ব্যবহার করেছিলেন এই ভাষা। ‘গায়ে কাঁথা শিরে টোপ, গালে ছেলি মুখে গোঁপ, ঝুলিতে ঝুলিছে থোপ, হাতে আশবাড়ি’ নিয়ে ‘ফকির কায়’ সত্যপীর ভিক্ষারত ব্রাহ্মণকে বলেছেন:

সেলাম হামারা পাঁড়ে            ধুপমে তোম কাহে খাড়ে
পেরেসান্দেখে বড়ে              মেরে বাৎ ধরতো।
সির্নি বেদে পির বা             সভি হাম্ ছো মিরবা
মোকামে জাহির বা             দরব্ হস্ত তপতো।।

অষ্টাদশ শতাব্দীর যুগ-পরিবেশে রামশ্বর ভট্টাচার্য, ঘনরাম চক্রবর্তী, রামপ্রসাদ সেনের মতো কবিরা আরবি-ফারসি-হিন্দি শব্দ যে একেবারই ব্যবহার করেননি, তা নয়। তবে এই শতকের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্রের মতো ব্যাপকভাবে তা গ্রহণ করেননি। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের চোখেও পড়েছিল। মধ্যযুগের রাষ্ট্রব্যবস্থায় মুসলমানের প্রভাব আলোচনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন:
তখনকার ভদ্র সমাজে সর্বত্রই প্রচলিত ছিল পার্সি, তবু বাংলা কাব্যের প্রকৃতিতেএই পার্সি বিদ্যার স্বাক্ষর পড়েনি – একমাত্র ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরের মার্জিত ভাষায় ও অস্খলিত ছন্দে যে নাগরিক ভাষা প্রকাশ পেয়েছে তাতে পার্সি-পড়া স্মিতপরিহাসপটু বৈদগ্ধের আভাস পাওয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথের এই মতের তথ্যভিত্তিক সমর্থন মেলে গবেষক পণ্ডিতের প্রদত্ত পরিসংখ্যানে। মদনমোহন গোস্বামী লিখেছেন:
বিবিধ ভাষার শব্দের সার্থক ও রসময় প্রয়োগ ভারতচন্দ্রের বৈশিষ্ট্য। ভারত-কাব্যে প্রচুর পরিমাণে মুসলমানী শব্দ পাওয়া যায়। তাহার অন্যতম কারণ হইল যে, ভারতচন্দ্রের জন্মের বহুপূর্ব হইতেই ভুরসুটে একটি মুসলমান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গঠিত হইয়াছিল যাহা উত্তরকালে কবিকে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করিয়াছিল। কবির সমগ্র রচনাবলীতে মুসলমানী নাম ব্যতীত ৩৭৭টি মুসলমানী শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে এবং ইহাদের প্রয়োগ কবিকঙ্কনের ন্যায় আড়ষ্ট নহে।

ভারতচন্দ্রের বিদগ্ধ-সরস কবিচিত্তে মুসলমানি ভাষার বহুল অনুপ্রবেশ সর্বতোভাবে ক্রিয়াশীল হয়েছিল দু’টি কারণে। প্রথমত, ভুরসুট পরগনার দীর্ঘদিনের মুসলিম-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল অল্প বয়স থেকেই তাঁর বহুভাষাবিদ্ মানস গঠনে সহায়ক হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তাঁর ভাষাশিক্ষার আগ্রহ। কবি নিজেই অন্নপূর্ণার মুখে তাঁর পড়াশুনার খবর জনিয়েছেন:

ব্যাকরণ অভিধান সাহিত্য নাটক।
অলঙ্কার সঙ্গীতশাস্ত্রের অধ্যাপক।।
পুরাণ আগমবেত্তা নাগরী পারসী।
(রাজার অন্নদার সহিত কথা)


বালক বয়সে গাজিপুর-নওয়াপাড়ার মাতুলালয়ে থেকে তাজপুরের টোলে সংস্কৃত শিক্ষা শেষ করে কৈশোর-যৌবনে দেবানন্দপুরে রামচন্দ্র মুন্সী ও তাঁর পুত্র হীরারামের আশ্রয়ে দীর্ঘদিন অতিবাহিত করে তৎকালীন রাজভাষায় কৃতবিদ্য হয়েছিলেন ভারতচন্দ্র:

দেবের আনন্দধাম দেবানন্দপুর নাম
তাহে অধিকারী রাম রামচন্দ্র মুনশী।
ভারে নরেন্দ্র রায় দেশে যার যশ গায়
হয়ে মোর কৃপা দায় পড়াইল পারসী।।
(সত্যনারায়ণ ব্রতকথা / চৌপদী)


আরবি-পারসির সঙ্গে তিনি শিখেছিলেন ‘নাগরী’ অর্থাৎ হিন্দি। পশ্চিমা হিন্দি ও ব্রজবুলি লক্ষণাক্রান্ত হিন্দিতেও সাহিত্য রচনা করেছিলেন ভারতচন্দ্র। প্রথমটির প্রয়োগ করেছিলেন বিদ্যাসুন্দর কাব্যে বর্ধমান রাজসভায় গঙ্গাভাট-এর সঙ্গে রাজা বীরসিংহের সংলাপে:

রাজা:
  জো সব ভেদ বুঝায় কহা কি ধোঁ নহি তঁহা
সমুঝায় শুনায়া।
কামলিয়ে তুঝে ভেজ দিয়া সুধি ভুল গয়া
অরু মোহি ভুলায়া।।


ভাট: 
ভূপ মৈঁ তিহারি ভট্ট কাঞ্চিপুর জায়কে।
ভূপকো সমাজ মাঝ রাজপুত্র পায়কে।।
হাত জোরি পত্র দীহ্ন শীষ ভূমি নায়কে।
রাজপুত্রিকী কথা বিশেষ মৈঁ শুনায়কে।।


অষ্টাদশ শতাব্দীতে এত সাবলীল সরস হিন্দি ভাষায় ভারতচন্দ্রের কাব্য রচনা রবীন্দ্রনাথকে শুধু বিস্মিত করেনি, এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি লিখে ফেলেছিলেন ‘নাসিক হইতে খুড়ার পত্র’ কবিতাটি:

কলকাত্তামে চলা গয়ো রে সুরেন বাবু মেরা,
সুরেনবাবু আসল বাবু, সকল বাবুকো সেরা।

* * * * * *

ঘরকো যাকে কায়কো বাবা, তুমসে হমসে ফরখৎ।
দো-চার কলম লীখ্ দেওঙ্গে ইসমে ক্যা হয় হরকৎ!

* * * * * *

মনকা দুঃখে হুহু করকে নিকলে হিন্দুস্থানী –
অসম্পূর্ণ ঠেকতা কানে বাঙ্গলাকো জবানী।...
(প্রহাসিনী, সংযোজন)