Next
Previous
0

প্রবন্ধঃ আইভি চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ

ভাষাদিবস ও বাংলাভাষা চর্চা
আইভি চট্টোপাধ্যায়



খাবার জোগাড় করা আর আত্মরক্ষা শিখলেই পশুপাখির শেখা সম্পূর্ণ। কিন্তু মানুষের তো তা নয়। মানুষের অভিব্যক্তির গতি অন্তরের দিকে। ‘আত্মানং বিদ্ধি’..আত্মাকে জানা, উপলব্ধি করা মানুষের উত্তরণের লক্ষ্য। ‘আপনাকে এই জানা’-র খোঁজে আসে অনেক দ্বন্দ্ব, অনেক ভুল বোঝাবুঝি। সেই পথ চলায়, অন্তরমহলের যাত্রায়, স্বজ্ঞাবিকাশে মানুষের প্রথম সহায় ভাষা। ভাষা আসলে তৈরী হয়েছিল বহির্জগতের প্রয়োজনে। কিন্তু একই ভাষায় অন্তর্জগতের প্রযোজন যখন মেটে,তখন তা হয়ে ওঠে প্রাণের ভাষা। মাতৃভাষা।

ভাষা তথা মাতৃভাষা ভাব-বিনিময়, ভাবনা বিনিময়ের সহজতম উপায়। এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী হয়তো বলবেন উৎপাদন সম্পর্কের কথা, আমি এর সঙ্গে যোগ করতে চাই শিক্ষাসহ জীবন ও জীবিকার সঙ্গে, কাজের সঙ্গে ভাষার সম্পর্কের কথা। একটি জাতির গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল সে জাতির মাতৃভাষা।

২১শে ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে ১৮৮টি দেশের ‘মাতৃভাষা দিবস’ হয়ে উঠেছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর জাতিসংঘ (ইউনেস্কো) একুশে ফেব্রুয়ারীকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারী আজ কেবল শহীদ দিবস নয়, একটি জাতির আবেগকে চিনে নেবার দিন।

তবে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারীর দিন আমরা, এপারের বাঙালিরা, একটু অপরাধবোধে ভুগি।উনিশশ’ বাহান্ন-র ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান আমরা শুনি নি। ইতিহাস পড়ে জেনেছি, ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর মোট জনসংখ্যার তেষট্টি প্রতিশত মানুষ বঙ্গভাষী হওয়া সত্ত্বেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তীব্র প্রতিবাদ করে, চলতে থাকে সংগ্রাম, আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী সেই ভাষা-আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ।সালাম-বরকত-রফিক-সৈফুদ্দিন, আরো অসংখ্য ছাত্রের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী। ভাষা নিয়ে উন্মাদনার এমন নজির ইতিহাসে আর নেই। রক্তাপ্লুত সেই গৌরবময় ঘটনায় বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ করা শিখেছি, বোধ হবার বয়স থেকে।

কি উত্তেজনা সে সময়!

ওপার বাংলায় যখন ভাষা নিয়ে এমন আন্দোলন চলছে, তখন এপারেও রাজনৈতিক আবহে অশান্তি।১৯৫১ সালে কোচবিহারে ভুখামিছিলে পুলিশি গুলিবর্ষণ। ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন। গোটা দশক জুড়েই অশান্তি আর আন্দোলন।

তার আগের দশকেই ঘটেছে স্বাধীনতা এবং যুদ্ধ। দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ, লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু শরণার্থীর বেদনাময় ইতিহাসের দশক।

তার মধ্যেই এপার বাংলাতেও বাংলাভাষা চর্চা চলেছে নিজের গতিপথ ধরে। ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের সঙ্গে সঙ্গেই প্রমথনাথ বিশী,সজনীকান্ত দাস, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসুরা তৈরী করে ফেলেছেন ‘ফ্যাসিস্মবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ’। প্রকাশ্য জনসভায় তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়-মাণিক বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বাংলা ভাষার অধিকারের জন্যে দাবি করছেন সাজ্জাদ জহির-কায়ফি আজমি-রাহুল সাংকৃত্যায়ন। প্রতিবাদের কবিতা লিখছেন অমিয় চক্রবর্তী-সমর সেন-সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আর এই সব নানা উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে দৃশ্যমান হচ্ছেন কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য।

বিভূতিভূষণ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুবোধ ঘোষ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নবেন্দু ঘোষের অসামান্য হৃদয়স্পর্শী বাংলা গদ্য.. আই-পি-টি-এ, গণনাট্য সঙ্ঘ.. শম্ভু মিত্রের আবৃত্তি, নাটক.. বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’নাটক.. সতীনাথ ভাদুড়ির সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘জাগরী’। অসংখ্য অসাধারণ লেখা। কত নামই যে করা যায়! বাংলাভাষা সাহিত্য, গান, নাটকে নবরূপে জাগরিত।

এই দশকেই শম্ভু মিত্র, সত্যজিৎ রায়ের উত্থান। ‘রক্তকরবী’ নাটক, ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্র।অরুণকুমার সরকার, নরেশ গুহদের নতুন স্লোগান ‘আরো কবিতা পড়ুন’। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’পত্রিকা, জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’। সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘পূর্বাশা’। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সন্তোষকুমার ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর নতুন গদ্য। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অরবিন্দ গুহর কবিতা।‘কল্লোল’ হয়ে উঠল একটা যুগের প্রতীক। বাংলা ভাষা নিয়ে এপারের বাঙালির আবেগও কম নয়।

১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ঢাকার ভাষা-শহীদদের স্মৃতিবার্ষিকীতে এপারে দুই বাংলার লেখকের মহামিলন। তার আগেই অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ আর সমর্থন সংগ্রহের জন্যে এপারে নানা জায়গায় দলবদ্ধ গানের অনুষ্ঠানও হয়ে গেছে। বাংলাদেশ নিয়ে আবেগে ভরে থাকে এপারের পত্র-পত্রিকা।

উনিশে মে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গৌরবময় দিন। ১৯৬১ সালের এই দিনে আমাদের দেশেও আসাম রাজ্যের শিলচরে বাংলাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দানের দাবিতে এগারোজন শহীদ হয়েছিলেন। এ মহান আত্মত্যাগ ২১শে ফেব্রুয়ারির মতই উজ্জ্বল ও মর্যাদাপূর্ণ। সারা বিশ্বের বাঙালিদের জন্য এক গর্বের ইতিহাস। 

তবু.. প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারী এলেই আমরা একটু বিভ্রান্ত বোধ করি। একটু সঙ্কুচিত। আমরা এই দিনে বাংলাভাষা নিয়ে আবেগজর্জর সভা করি,পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করি, শহীদ দিবসের গৌরবময় অতীতের স্মৃতিচারণ করি। আর নিজেদের স্ববিরোধী কাজকর্মের জন্যে গোপনে লজ্জা পাই।অপরাধবোধে ভুগি। কারণ আসলে আমরা নিজেরাই জানি না আজ, বাংলা ভাষাটাকে কোথায় কতখানি রাখব।

আমরা সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াই, কারণ শুধু ভাষা শিক্ষা নয়,ইংরেজি কেতা শিক্ষাটাও আমাদের লক্ষ্য। বাজার আর অর্থনীতির বিশ্বায়নের নিরিখে সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে উদ্বিগ্ন আমরা বুঝি, ইংরেজি শিক্ষাটাই আসলে দরকার। সন্তানকে শেখাই ‘গ্লোবাল সিটিজেন’ হবার কথা, বিশ্বনাগরিক হবার উদার ভাবনায় নিজেরাই নিজেদের পিঠ চাপড়ে বাহবা দিই।

আমার প্রতিবেশিনী তাঁর আড়াই বছরের ছেলের সঙ্গে ইংরেজিতে বাক্যবিনিময় কারেন, কারণ মন্টেসরি স্কুলের ইন্টারভিউয়ে কাজে লাগবে। ইংরেজির সঙ্গে হিন্দীটাও জরুরী, রাজভাষা বলে কথা। টিভি, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে হিন্দী শেখার কত সুবিধে! আর যা-ই বলো, ভালো করে হিন্দী শিখে নিতে পারলেও লাভ।আজকাল ক’জন আর বাংলায় বসে থাকে! জীবিকার প্রয়োজনে উত্তর, দক্ষিণ,পশ্চিম ভারতে যেতে হচ্ছে না? ইংরেজি আর হিন্দী, দুটো ভাষা জানলেই হল।

আমাকে একজন বাংলার অধ্যাপক বলেছিলেন, ‘‘বাংলা না শিখিয়ে মেয়েকে বরং ফ্রেঞ্চ বা জার্মান ক্লাসে ভর্তি করে দাও। আখেরে লাভ হবে।’’

লাভ। ভারী আকর্ষণ এই শব্দটায়। আমরা লাভ-লোকসানটা বেশ বুঝি। ভাষা নিয়ে আবেগ! ওসবের বিশেষ মূল্য নেই জীবনে।

যৎসামান্য লেখালেখির চর্চা রাখতে চাই নিজের ভাষায়, সে নিয়েও নানা গুণীজন পরামর্শ দেন, কিভাবে হিন্দী বা ইংরেজিতে লেখাগুলো অনুবাদ করে ‘সফল’লেখকের তকমাটা পাওয়া যায়। ‘কি করে লেখো বাংলায়’.. ‘বাংলায় কেন লেখো’.. ‘শুধুই বাংলায় লেখো!’ আহা, আজকের দিনে শুধু শুধুই নিজের ভাষাকে ভালোবাসা যায় নাকি! এত আবেগ থাকলে চলে!

এমনিতেও আজকের সমাজে যে কারণে নিজের ভাষার প্রতি ভালোবাসা জন্মায়, সে পরিবেশ নেই। বহির্বঙ্গে সব স্কুলে বাংলা পড়ানোই হয় না। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোয় হোমওয়ার্ক-প্রাইভেট টিউশনের চাপ। ভালোবেসে গল্প কবিতা পড়ার সময় নেই। যেটুকু বাকি সময়, গ্রাস করে নিচ্ছে টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, সেলফোন। সাহিত্যপাঠের সময় কই!

খুব চাপাচাপি করলে হ্যারি পটার কিংবা চেতন ভগত পর্যন্ত পড়ানো যেতে পারে।

বাংলা বইয়ের সে সৌভাগ্য হয় না। বঙ্কিম শরৎ রবীন্দ্রনাথ তারাশঙ্কর বিভূতিভূষণ মাণিক জীবনানন্দ,সবাই ব্রাত্য। বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব.. আজকের প্রজন্ম তাঁদের সঙ্গে আদৌ পরিচিত কিনা কে জানে।সুকান্ত, নজরুল, সুভাষ মুখোপাধ্যায়.. আজকের যুব মানসলোকে এঁদের প্রবেশের সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। আজকের অনেক শিশুই লীলা মজুমদারকে চেনে না। তেমন চাপ দিলে পড়ার জন্যে কমিকস আছে.. হ্যারি পটার আছে, ওটা তো সিনেমাও হয়েছে.. এখন শিশুরাও আর রূপকথার গল্প শোনার সময় পায় না। পড়ার অভ্যেসই তৈরি হয় না, ভাষাচর্চা করবে কে?

কে জানে, আজ থেকে কুড়ি বছর পর ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নিয়ে একটা আবেগ-দিন কাটানোর ভাবনাটাও থাকবে কিনা।

বিশ্বায়নের দাপটে ওলোটপালট হয়েছে ব্যক্তিগত কত আবেগ, হৃদয়বৃত্তি, জীবন-বোধের দর্শন,নৈতিক মাপদণ্ড। এসময় মাতৃভাষা নিয়ে আবেগ, আন্দোলন কতখানি যুক্তিযুক্ত সে নিয়েও ভাবনা আসে। ভাবনার এই দোলাচলের সময়ই পড়ে ফেললাম একটি আফ্রিকান কবিতার অনুবাদ।

কবিতার নাম Soweto.. কবিতার সূচনায় নৃশংস এক ঘটনার কথা।

ট্রান্সভালের এক শহর সোয়েটো, সেখানে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সাদা বোয়ারদের ‘আফ্রিকান্স’ ভাষা চাপিয়ে দেবার সরকারি নির্যাতন চলছিল। তারপর ১৯৭৬ সালের ১৬ জুনের ঘটনা। অন্য কারো ভাষা নয়, মাতৃভাষায় শিখতে চাই.. এই দাবি নিয়ে স্কুলের ইউনিফর্মে অল্পবয়সীদের এক মিছিল সেদিন।বারো বছরের এক মেয়েকে গুলি করে মেরেছে পুলিশ।

কবিতা শুরু হযেছে মৃত সেই মেয়েটির অশ্রূত অদৃশ্য সংলাপ দিয়ে: ‘আমি কোথায়? কেন আমি শুয়ে আছি এই ধূলোয়?’

কথার পর কথার মালায় গড়ে উঠছে তার বারো বছরের আটপৌরে যাপনের ছবি, তাদের সমবেত প্রতিবাদের কথা। কবিতার শেষে ‘মেয়েটির আর্তধ্বনির মধ্যে Soweto শব্দটা ভেঙে ভেঙে যায় So-we-to.. So-we, আর অসমাপ্ত ওই ‘we’ ধ্বনিতে শেষ হয়ে যায় নিবিড় এই কবিতা।’ (সৌজন্য শ্রী শঙ্খ ঘোষ)

নতুন করে অনুভব করি, সবদেশে সবকালে একই আবেগ নিয়ে মাতৃভাষার জন্যে আন্দোলনের গভীর সত্য। একই ধাঁচে পীড়ণও যেমন সত্যি।

‘সাহিত্য’ শব্দটার ব্যাপ্তি অনেকখানি। গদ্যে যেমন মানবসমাজের সভ্যতা সমাজ সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস, তেমনই কবিতায় মানুষের অন্তরমহলের ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গ খবর।

রবীন্দ্রোত্তর যুগের নন্দনচর্চায় অবলীলায় এসেছে পশ্চিমি সাহিত্যের প্রত্যক্ষ প্রভাব। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়টা আধুনিক কবিতার জন্মকাল। বিশ্বের আর্থিক সঙ্কটের ছায়া, বেকারসমস্যা, সমাজে একই সঙ্গে চোখ-ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য আর দারিদ্র্য-পীড়িত অন্ধকারের বৈপরীত্য... যন্ত্রণাবিদ্ধ দ্বিধা ও ক্রুদ্ধ প্রশ্ন নিয়ে কবিতা আর সর্বদাই প্রশান্ত নয়... সহজাত ক্ষমতায় বাঙালি সাহিত্যিক এই সময়ের ছবি আঁকেন তাঁর সৃষ্টিকর্মে। প্রশংসনীয় অন্তর্দৃষ্টি থেকে সীমা খোঁজা,সীমা ছাড়ানো, ব্যক্তিপ্রকৃতির জটিলতার উত্তরোত্তর বিবর্তন, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর অনুভবের জগতে ভ্রমণ – আমাদের প্রাণের ভাষা, আরামের ভাষায় নানা সৃষ্টিকর্মে তা প্রতিনিয়ত প্রতিফলিত।

আদি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার পূর্বতম শাখা ইন্দো-ইরানী। এই ভাষা থেকে আধুনিক বাংলা ভাষার উদ্ভব। আদি ভারতীয়-আর্য ভাষা থেকে বিভিন্ন মধ্যভারতীয়-আর্য বা প্রাকৃত ভাষা। সেই থেকে বাংলা ভাষার জন্ম। সম্রাট অশোকের সময় খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর অনুশাসনগুলোয় ভারতবর্ষের কথ্য আর্য ভাষার যে নিদর্শন পাওয়া যায়, তাতে চারটি প্রধান ভাষা। উত্তর-পশ্চিমা, দক্ষিণ-পশ্চিম, মধ্যপূর্বী, পূর্বী।

পূর্বী মধ্য-আর্য শাখা থেকে বাংলা ভাষার জন্ম সম্ভবত দশম শতাব্দীতে। বাংলা বিকাশের স্তরকে দু’ ভাগে ভাগ করা যায়। আদ্য ও মধ্য। মোটামুটি ৯৫০ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত বাংলার আদ্যপর্ব। ১৩৫০ থেকে ১৭৫০ পর্যন্ত মধ্যপর্ব। ১৭৫০ থেকে আধুনিকপর্ব। মধ্যপর্বকে গবেষকরা আদিমধ্য ও আন্ত্যমধ্য পর্বে ভাগ করেন। আদিমধ্য থেকে আন্ত্যমধ্য কালে বাংলা ভাষায় যে পরিবর্তনগুলো হয়েছিল, তা হল বিশেষ্য ও সর্বনামপদের বহুবচনে একই বিভক্তির ব্যবহার,সমাপিকা ক্রিয়াপদে একবচন-বহুবচনের পার্থক্য লোপ, যৌগিক ক্রিয়াপদের ব্যবহার। এবং প্রচুর ফারসী শব্দের আমদানি।

এই যে ভাষার মধ্যে অন্য ভাষা ঢুকে পড়া, এ এক সাধারণ ব্যাপার। ভাষার বিবর্তনে অত্যন্ত স্বাভাবিক রীতি। যেমন লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্য যে কোনও ভাষার এক বড় সম্পদ। বাংলা ভাষাতেও তাই। বাংলা লোকসাহিত্যের মূল সুরটি পল্লীসাহিত্যের।

ছড়া, গীত, ধাঁধা, প্রবাদ, প্রবচন, পুরাতনী গান। বাউল, ভাটিয়ালী, লোকধুনী,ভাবগান, জারি গান, টুসু গান, নদীর গান, ধুয়া গান, গাজী গান, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদী, ভাওয়াইয়া, ফকিরি গান। সুফী আর আউল। ফকির আর বাউল। এই বিশাল ভাণ্ডারে কাব্যরচনার আধার হল ছন্দ। পালরাজাদের সময় প্রায় চারশ’বছর ধরে গানে, দোঁহায়, পদাবলী আর প্রবচনে এক অলিখিত বাংলা সাহিত্যভাণ্ডার গড়ে উঠেছিল।

বাংলার নবজাগরণ বলতে বোঝায় ব্রিটিশ রাজত্বের সময় অবিভক্ত ভারতের বাংলা অঞ্চলে ঊনবিংশ ও বিংশশতকে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের জোয়ার ও বহু কৃতী মনীষীর আবির্ভাবকে। রাজা রামমোহন রায়ের সময় এই নবজাগরণের শুরু এবং এর শেষ ধরা হয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ে, যদিও এর পরেও বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ এই সৃজনশীলতা ও শিক্ষাদীক্ষার জোয়ারের বিভিন্ন ধারার ধারক ও বাহক। ঊনবিংশ শতকের বাংলা ছিল সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় দর্শনচিন্তা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, দেশপ্রেম ও বিজ্ঞানের পথিকৃৎদের এক অন্যন্য সমাহার।

আজকের বাংলা ভাষার সাবলীল গতি অনেক দিনের সাধনার ফসল। লিখনরীতি ও কথনরীতির কমনীয় সমন্বয় বাঙলাকে সাবলীল করেছে। দীর্ঘ সমাসবহুল বাক্য একদিন ছোট ছোট বাক্যে ভাঙা শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে ছেদচিহ্ন ব্যবহার করে অর্থময় বাক্যাংশ তৈরী হওয়া, তারপর শ্বাস-অনুযায়ী ও অর্থ-অনুযায়ী বাক্যাংশ সেজে ওঠা। ক্রিয়ারূপ ও শব্দের সরলীকরণ। এসেছে ধ্বনি সামঞ্জস্য,শালীন অনুপ্রাস, তত্‍সম শব্দের সঙ্গে তদ্ভব ও দেশি শব্দের সুষম মিশ্রণে এক কমনীয় সমন্বয়। দিনে দিনে দেশজ ছন্দকে আয়ত্ব করেছে বাংলা ভাষা।

বাংলাচর্চায় আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল, এই ভাষার স্বাবলম্বন। সাহস, নিষ্ঠা, সময়ের সেবা না করে সময়কে সৃষ্টি করার চেষ্টা আজকের বাংলা ভাষার পথ-চলা নির্দিষ্ট করেছে। বাংলা সাহিত্য যেন নিজের অন্তরের তাগিদেই চলতে শুরু করেছে। প্রথম যুগের প্রাথমিক পরিকল্পনা অতিক্রম করে নিজে নিজেই বেড়ে উঠেছে। বাংলা ভাষায় নানা দেশজ শব্দ, নানা আঞ্চলিক শব্দের অনুপ্রবেশ হয়েছে সচেতনভাবে, এবং তা ভাষার উত্‍কর্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। শব্দের মধ্যে, ধ্বনির মধ্যে, উপমার মধ্যে, অলঙ্কারের মধ্যে স্বকীয় একটা রস। মাধুর্য। এই আমাদের বাংলা ভাষা।

আজকাল সব শ্রেণীর লেখক পাঠককে সাদরে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট বেশ ভূমিকা নিচ্ছে। নানা বাংলা পত্রিকা, নতুন কবি লেখকের সঙ্গেই পুরনোদের লেখা নতুন করে প্রকাশ করার কাজটি ইন্টারনেটে দেখা যাচ্ছে। লক্ষণ ভালো, শেষ পর্যন্ত বাংলা পাঠের অভ্যেস কেমন তৈরি হয় দেখা যাক।

প্রবাসী পরবাসী অনাবাসী লেখক ও পাঠকের চাহিদায় আজকের বাংলা গল্প-কবিতায়, ভাষায় ও ভাবে এক বিশ্বজনীন ছবি। খাঁটি বাংলা শব্দের ব্যবহারই নয় শুধু, বদলে যাওয়া কলকাতার ভাষা সেসব গদ্যে-কাব্যে অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছে। ইঙ্গ-বঙ্গ বা মার্কিন-বঙ্গ ভাষা ও দ্বৈত সত্তায় আজকের বাংলা সাহিত্য বেশ স্মার্ট, ঝকঝকে। এই আটপৌরে ভাবটি কাম্য।

কিন্তু আটপৌরে বাংলা শব্দ ব্যবহার করতে গিয়ে যে চলতি শব্দগুলো বেশি প্রচার হচ্ছে, সেগুলো আদৌ বাংলা শব্দ কিনা সে নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। হিন্দী বলয়ের নানা অশিষ্ট অমার্জিত শব্দ,ইংরেজি বাংলা নানা অমার্জিত শব্দ আজকের বাংলা লেখকরা সজ্ঞানে ব্যবহার করেন। চলতি কথ্য অনেক শব্দ, নিতান্ত হালকা, প্রায়শই অশিষ্ট, কিছু অশালীন শব্দও আছে, ব্যঙ্গধর্মী লেখার নামে সে শব্দগুলোর বহুল ব্যবহার হচ্ছে।

যেগুলো মুখে মুখে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, আর যেগুলো লিখিত হবে, দুটোয় কোনও সীমারেখা থাকবে না? ভাষা শিক্ষা এবং একটি ভাষার সাহিত্য সে জাতির পরিচয়। শিক্ষিত বাঙালি কোন ভাষায় ভাবনার জগতে বিচরণ করবেন, তা কি একটি গভীর ভাবনার বিষয় নয়? বাংলা ভাষার এত দুর্গতি হয়েছে যে, সঠিক শব্দচয়ন হবে না? আমরা যারা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি, যে ভালোবাসায় অনেকগুলো তাজা প্রাণ শহীদ হয়েছে, তার একটা সম্মান নেই? শব্দ ব্রহ্ম, সে শব্দকে কি অবহেলায় অমার্জিত প্রয়োগে ব্যবহার করা সাহিত্যিকের কাজ?

এ ছাড়াও বাংলা বানান নিয়ে অজ্ঞতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা এখন অতি স্বাভাবিক ঘটনা। বিসর্গান্ত ও হসন্ত শব্দ বিসর্গহীন ও অ-কারান্ত রূপে লেখা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। হ্রস্ব-ই কার আর দীর্ঘ-ঈ কারের প্রয়োগ তো সত্যিই যা-ইচ্ছে-তাই। য-ফলা, ব-ফলা বাহুল্যবোধে বাদ পড়ে যাওয়াও এখন নিয়ম।

শব্দপ্রযোগে স্রষ্টার স্বাধীনতার কথা যদি মেনেও নিই, বানানের ক্ষেত্রে এমন স্বেচ্ছাচারিতা চলে কিনা,এ নিয়ে আমার জোর সওয়াল আছে। ভাষা বা বানানের শুদ্ধতা নিয়ে কথা বললে এক্সপেরিমেণ্টধর্মী লেখক-কবিকুল রে রে করে ওঠেন।

কিন্তু সাহিত্যিকের বলার ক্ষেত্রটা শিল্প হয়ে উঠুক, সেটাই কাম্য। সৃষ্টি অর্থে শিল্প, এ বিশ্বাস বোধহয় এখন আর নেই। অন্তত সাম্প্রতিক বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়লে সেই অনুভূতি হয়। রুচি ও রসজ্ঞান; এই দুটো প্রায়ই একসঙ্গে অবস্থান করে না। আর্টতন্ত্রের রসজ্ঞানশাসিত রুচি বাংলা সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ যেন না করে, এই আমাদের কাম্য। রূপদক্ষ স্রষ্টা নিজের অন্তরের তাগিদে অবাধ স্বাধীনতায় ইচ্ছেমতো সৃষ্টি করুন শিল্পীর স্বাধীনতায়। কিন্তু রস বা রূপ তো কোনও আপেক্ষিক বিষয় নয়। নিজের সৃষ্টির প্রতি অকরুণ হয়ে কি রূপ-সৃষ্টি হয়?

সত্য ও সৌন্দর্য, এই হল প্রাণের ভাষার আসল টান। মাতৃভাষার মূল কথা হল, এ এক সর্বাঙ্গীন অনুভবের ভাষা। জীবনচর্যা আর শিল্প-সাহিত্য মিলিয়ে যে অখণ্ডতার বোধ, তার প্রথম ইমেজ তৈরী হয় মাতৃভাষার সুত্র ধরে। ব্যবহারিকতা আর সামাজিকতা শিক্ষার সেই প্রথম দিনে প্রাণের ভাষাটিই অবলম্বন, চৈতন্যলোকে প্রথম আলো।

মাতৃভাষাটি শুধুই একটি ভাষা নয়। একাধিক ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির সাধন এই প্রাণের ভাষা। শান্ত সংযত একটি গভীর স্রোত, পরিমিতিবোধ ও শাশ্বত আবেদন, প্রতিটি মানুষের বুকের মধ্যে যে একটা মুখ আছে সেই মুখ দেখতে পারার পরিতৃপ্তি। সেই তৃপ্তির ব্যাপ্তিতে বুকের মধ্যে টলটল করে ওঠে। কখনো চোখের জলে জোয়ার, কখনো শুধুই ঘুম-ঘুম শান্তি।

এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা, যা শুধু মানুষ-জন্মে সম্ভব।

প্রশংসনীয় অন্তর্দৃষ্টি থেকে সীমা খোঁজা, সীমা ছাড়ানো, ব্যক্তিপ্রকৃতির জটিলতার উত্তরোত্তর বিবর্তন,সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর অনুভবের জগতে ভ্রমণ – এই আমাদের বাংলা ভাষা।

ভাষা ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় বন্ধনেরই মুক্তি। আবার ভাষাই ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিচয়ের আশ্রয়। দেশ, জাতি ও মানুষের সঙ্গে ব্যাপক একাত্মতার প্রক্রিয়া শুরু হয় ভাষা-চর্চার মাধ্যমেই।

ভাষার লক্ষ্য আগামী কালের জন্যে। সাবেক আয়োজন যা অক্ষয় হয়ে আছে, আমাদের বাঙালিদের পক্ষে তাই যথেষ্ট। পৃথিবীর অনেক জিনিসই দ্ব্যর্থব্যঞ্জক। যা আটকে রাখে, তা-ই হয়ে ওঠে আশ্রয়। যা বেঁধে রাখে, তা-ই হয়ে ওঠে অবলম্বন। জীবনের এই নিয়ম। লেখনশৈলীর ক্রমাগত শুদ্ধিতে, সাবলীল সপ্রতিভ সহজ সুন্দর কথ্যরীতিতে বাংলা ভাষা অপরূপ হয়ে থাকুক।

আমাদের প্রাণের ভাষা, বাংলা ভাষা, যার জন্যে কত প্রাণের বলিদান, এই ভাষা চর্চার ধারা অব্যাহত থাকুক। এই আশাটুকুই আমাদের ভরসা। এই প্রাণের ভাষার প্রতি বাঙালির ভালোবাসা আর আবেগ তো মিথ্যে নয়!