Next
Previous
0

ধারাবাহিকঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


বানরায়ণ ১৪
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়



লোক দু’টো আমার দু’হাত দূরে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে আমার পিছনে অন্ধকারের দিকে তাকালো। আমি সাবধানতাবশত কয়েক মুহূর্ত ওদের উপর দৃষ্টি রেখে, ওদের প্রতিক্রিয়া দেখে তারপর পিছন ফিরলাম। অন্ধকার ফুঁড়ে এগিয়ে আসছে একটা বিশাল অবয়ব...

কাছাকাছি আসতে চিনতে পারলাম। গা টা কেমন শিরশির করে উঠলো। এও সম্ভব? কি করে এলেন ঠিক এই সময়ে, এখানে? আমার চরম বিপদের মুহূর্তে?

আমি হতবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। সামনের লোক দু’টোও যেন পাথর হয়ে গেছে। হনুমান এগিয়ে এলেন। আমি যেন অনুভব করলাম, তাঁর পায়ের ভারে নীচের মাটি কাঁপছে। আমাকে পেরিয়ে লোক দু’টোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। পরমুহূর্তে একটা চড়ের শব্দে রাত্রির নিস্তব্ধতা খান্ খান্ হয়ে গেলো... আর আমি দেখলাম, ওদের দু’জনের মধ্যে একজন হাওয়ায় উঠে ছিটকে গিয়ে পড়লো হাত দশেক দূরে।

অন্য লোকটা বোধহয় পালানোর জন্য ঘুরতে যাচ্ছিলো। হনুমান তার ঘাড়টা বাঁহাতে ধরে অমন শা’জোয়ান লোকটাকে একটা বেড়ালছানার মতন শূন্যে তুলে ফেললেন, এবং সজোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। লোকটা মুখ থুবড়ে পড়লো, আর ওই ভাবেই পড়ে রইলো।

মাথায় শিরস্ত্রাণের ঘা খাওয়া লোকটাও ততক্ষণে পরিস্থিতি বুঝে বসা অবস্থা থেকে সটান শুয়ে পড়েছে মাটিতে। অন্য লোক দু’টো মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে বার কয়েক পরস্পরের দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে তারপর সোজা হাতজোড় করে মাটিতে বসে পড়েছে হাঁটু গেড়ে। বুঝতে পেরেছে, পালিয়ে লাভ নেই।

হনুমান ওদের সামনে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর কঠোর স্বরে বললেন, ‘‘ওঠ্!’’

লোক দু’টো প্রায় কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো। সাধারণ মাপে যথেষ্ট লম্বা-চওড়া লোক দু’টো হনুমানের সামনে যেন বালক। হনুমান এবার মাটিতে পড়ে থাকা লোকগুলোকে নির্দেশ করে এই দু’জনকে আদেশ দিলেন, ‘‘দড়ি জোগাড় করে এদের হাত-পা বাঁধ্ শক্ত করে।’’ একটু থেমে ঠাণ্ডা, নিস্পৃহ গলায় বললেন, ‘‘ঠিক এক দণ্ড সময় দিলাম। তার মধ্যে বাঁধা না হলে তোদের হাত-পাগুলো এক এক করে ছিঁড়ে ফেলবো।’’ 

হনুমানের কথা শেষ হতেই লোক দু’টো পড়িমরি করে দৌড় দিলো। বোধহয় দড়ি খুঁজতে গেলো। মেয়েটাও এতক্ষণ আমারই মতন অবাক বিস্ময়ে ঘটনাটা দেখছিলো। হনুমান এবার ওর দিকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘‘তুমি এত রাতে এখানে একা কি করছিলে?’’

মেয়েটা গায়ের ছেঁড়া কাপড় সামলাতে সামলাতে উত্তর দিলো, ‘‘ভাইকে খুঁজছিলাম।’’ শক্ত মেয়ে। এইরকম একটা ঘটনার পর এমন একজন বিশাল পুরুষের এরকম কঠিন স্বরে প্রশ্নের সামনে ঘাবড়ে যায়নি।

এবার হনুমান স্বর নরম করে প্রশ্ন করলেন, ‘‘পেয়েছো?’’

মেয়েটা মাথা নাড়লো। ওর দু’চোখে কান্না ঠেলে আসছে। প্রাণপণে চেপে রেখেছে। হনুমান এবার কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তোমার নাম কি?’’

‘‘প্রভা।’’

‘‘শোনো, প্রভা, এখন এভাবে খুঁজে পাবে না তোমার ভাইকে। কাল যুদ্ধ শেষ হলে মশাল নিয়ে এসো। আর… একা এসো না।’’

‘‘আমার আর কেউ নেই।’’

হনুমান একটু থমকে গেলেন। যেন কিছু প্রশ্ন করতে চাইলেন। কিন্তু করলেন না। একবার আমার দিকে তাকালেন। তারপর প্রভাকে বললেন, ‘‘কাল যুদ্ধ শেষ হলে এখানে এসো। ও থাকবে। খুঁজতে সাহায্য করবে তোমার ভাইকে। এখন যাও। আর কেউ তোমায় বিরক্ত করবে না।’’

প্রভা একবার আমার দিকে তাকালো। আবছা অন্ধকারে মনে হলো, টলটলে জলে ভরা দু’টো চোখ কৃতজ্ঞতায় ভরা। তারপর হাত জোড় করে সামনে ঝুঁকে হনুমানকে প্রণাম করে মুখ ফিরিয়ে রওনা দিলো লঙ্কাপুরীর প্রাচীরের দিকে। কয়েক মুহূর্ত পর অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।

লোক দু’টো ততক্ষণে দড়ি নিয়ে ফিরে এসেছে। হুড়মুড়িয়ে বাঁধতে লেগে গেছে কিছুক্ষণ আগের দুষ্কর্মের সঙ্গীদের। বাঁধার সময় দেখলাম, যে লোকটা চড় খেয়ে ছিটকে পড়েছিলো, সে তখনও অজ্ঞান। বাকি দু’জনও কোনওরকম বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলো না। তিনজনকে বাঁধা হয়ে যাওয়ার পর হনুমান লোক দু’টোর একজনকে নির্দেশ দিলেন অন্যজনকে বাঁধার। সেটাও হয়ে গেলে আমার দিকে অর্থপূর্ণ চোখে তাকালেন। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে বাকি দড়িটুকু নিয়ে পঞ্চম লোকটকে কষে বেঁধে ফেললাম।

একটু আগে পৌরুষ প্রদর্শনকারী পাঁচটা লোককে ওরকম অসহায় ভাবে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখতে আমার মজা লাগছিলো। হনুমান বললেন, ‘‘সূর্যোদয় অবধি এখানে বাঁধা থাকবি তোরা। আলো ফোটার পর রক্ষীরা এসে শিবিরে নিয়ে যাবে। তারপর শাস্তির ব্যবস্থা হবে।’’ তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘‘চলো।’’

আমরা অন্ধকার যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে হাঁটছিলাম। আমার অদ্ভূত লাগছিলো। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন, অবাস্তব পরিস্থিতি... এই কয়েক মাস আগে অবধিও জীবন কি ছিলো? এখান থেকে কত, কত দূরে জঙ্গলে ঘেরা আমাদের ছোট্ট গ্রাম... সেখানকার সহজ, সরল জীবনযাত্রা... দল বেঁধে শিকার... বুড়ো সোমুকের ওষুধপত্র, মন্ত্রতন্ত্র... জন্তা বাবা... মনে হচ্ছিলো যেন কোন সুদূর গতজন্মের কথা! 

এই যে আমি, তাম্বলি গাঁয়ের ঋচিক, এই অন্ধকার রাত্রে লঙ্কার যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখান দিয়ে, রাশিরাশি মৃতদেহের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি এক আশ্চর্য মানুষের সঙ্গে, এ কি সত্যিই বাস্তব? এই মানুষটাই কি বাস্তব? আমাদের মতনই রক্তমাংসের মানুষ...?

‘‘এত রাতে কি করতে এসেছিলে এখানে?’’ হনুমানের গম্ভীর কন্ঠস্বরেআমার চটকা ভাঙলো। কি উত্তর দেবো? কি করতে এসেছিলাম? নিজেই কি ছাই জানি...? 

জলের থলিটা কাঁধে ঝুলছিলো। মুখ থেকে আপনা হতেই বেরিয়ে গেলো, ‘‘জল... জল দিতে।’’

হনুমান দেখছেন আমাকে। আমার মাথা প্রায় ওঁর কোমরের কাছে। ‘‘কাকে?’’

আমি চুপ। সত্যিই তো! কাকে?কাঁচুমাচু মুখে তাকালাম হনুমানের দিকে। আবছা অন্ধকারে মনে হলো যেন হনুমানের দু’চোখ কৌতুকের ঝিলিক খেলে গেলো...

‘‘কী? কাকে জল দিতে এসেছিলে?’’

‘‘মানে...’’ আমি আমতা আমতা করছিলাম... ‘‘ওরা জল চাইছিলো সন্ধ্যেবেলা...’’

‘‘ওরা কারা? লঙ্কার আহত সৈনিকরা?’’

আমি মাথা নীচু করে আবার চুপ।

‘‘জল দাওনি ওদের সন্ধ্যেবেলা?’’

আমি মাথা নাড়লাম। ‘‘দিয়েছি। কিন্তু সবাইকে নয়।’’

খানিকক্ষণ নীরবে চলার পর হনুমান নির্লিপ্তস্বরে বলতে আরম্ভ করলেন, ‘‘যুদ্ধক্ষেত্র বড় নিষ্ঠুর, নিষ্করুণ জায়গা। তোমার মন এখনও নরম। যুদ্ধের জন্য তৈরি নয়। তবে এই যুদ্ধে তৈরি হয়ে যাবে। তোমার সৌভাগ্য, যে জীবনের প্রথম যুদ্ধে তোমায় লড়তে হচ্ছে না। বাইরে থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছো। এত বড় যুদ্ধ এই পৃথিবীতে হয়নি কোনওদিন। এ যুদ্ধ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। যে কোনও যুদ্ধ থেকেই থাকে।’’ একটু থেমে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তোমার নাম কি? কোথা থেকে এসেছো তুমি?’’

আমি নাম বললাম। তাম্বলি গ্রামের কথা বললাম। হনুমান আমার গ্রামের জীবনের কথা জানতে চাইলেন। বললাম। ঠাকুর্দার কথা, তার ওষুধপত্রের কথা, তার ভূত নামানোর ভড়ং-এর কথা, আমার পাহাড়ের মাথায় চড়ে ওষুধ নিয়ে আসার কথা... বলতে বলতে বুঝতে পারছিলাম, আমার ভালো লাগছে এসব কথা বলতে। কারণ, হনুমানের মতন কেউ যে আমার এই তুচ্ছ জীবনের কথা জানতে চাইছেন, এটাই আমার জন্য প্রায় অভাবনীয়। মনে হচ্ছিলো হনুমান শুনতে মজা পাচ্ছেন, কারণ তাঁর মুখে মাঝে মাঝে স্মিত হাসি ফুটে উঠছিলো। তাই শেষমেশ জন্তা বাবার কথাও বলে ফেললাম।

আমার জন্তা বাবাকে দেখতে যাওয়ার গল্প শুনে হনুমান বেশ জোরে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘‘তোমার সাহস তো কম নয় হে! তুমি মাঝ রাতে গাছে উঠে বসেছিলে জন্তা বাবাকে দেখবে বলে?’’

হনুমানের কথার ভঙ্গিতে আমারও হাসি পাচ্ছিলো। কিন্তু এই মানুষটার সামনে হাসা উচিত হবে কি না, বুঝতে পারছিলাম না। আমারও মনে কত প্রশ্ন ভীড় করে আসছিলো... ইনি কোথাকার মানুষ? আর্যাবর্তের উত্তরে, হিমালয় পর্বতেরও উত্তরের সেই চিরতুষারের দেশের কি? কুবেরের মতন? নলও কি সেখানকারই লোক? কেমন সে দেশ? সত্যিই কি সেখানকার বাসিন্দারা চায় না সেখানে কেউ যাক?

হনুমান আমার কাঁধে হাত রাখলেন। আমার সারা শরীর শিরশির করে উঠলো। ‘‘তুমি সাহসী।’’ ঘনিষ্ঠস্বরে হনুমান বললেন। ‘‘আমি প্রভাকে বলেছি, কাল তুমি ওকে ওর ভাইকে খুঁজতে সাহায্য করবে। করবে তো?’’

আমি মাথা নাড়লাম। না করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

‘‘তোমার বন্ধু কেমন আছে?’’

বন্ধু? কার কথা বলছেন হনুমান?

‘‘চম্পক না ওর নাম?’’ হনুমানের মুখে মৃদু হাসি।

এবার আমিও হাসলাম। আজ বিকেলে দেখে এসেছি, চম্পক দিব্যি আছে। ফূর্তি আর তেজ দেখে মনে হচ্ছিলো যুদ্ধ ব্যাপারটা উপভোগ করছে। বললাম হনুমানকে।

‘‘করবে, আমি জানতাম। খুব তেজী ঘোড়া। আর একটু বড় হলে অসাধারণ যুদ্ধাশ্ব হবে। অবশ্য যদি বড় হওয়ার সুযোগ পায়।’’

কথাটা শুনে আমার মনটা কেমন করে উঠলো। আমি জানি, প্রত্যেকদিন সেই সম্ভাবনা আছে। তবু মানতে মন চায়না...

‘‘কষ্ট পেয়ো না। ভবিতব্যকে মেনে নিতেই হবে। যুদ্ধে সব কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।’’

ভবিতব্য! বুড়ো সোমুকের কথা মনে পড়লো। সেই রাতে সে বলেছিলো... ‘‘যেতে তোকে হবেই। সেটাই ভবিতব্য।’’ আর তারপর... সেই বুড়ো বটের নীচের ফোঁকড়ে খুঁজে পেয়েছিলাম আসল জন্তা বাবাকে...

হাঁটতে হাঁটতে কখন শিবিরের কাছে পৌঁছে গেছি, খেয়াল করিনি। চিকিৎসাকেন্দ্রের কাছে পৌঁছে হনুমান থামলেন। বললেন, ‘‘যাও। ঘুমিয়ে পড়ো। রাত আর খুব বেশি বাকি নেই। কাল ভোরে ওই পাঁচজনের বিচার হবে। সেখানে তোমাকে প্রয়োজন হবে। থেকো।’’ বিশাল মানুষটি দীর্ঘ পদক্ষেপে শিবিরের অভ্যন্তরে চলে গেলেন। 


আমি নিঃশব্দ পায়ে গিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লাম... আর তারপর এক অনির্বাণ জ্যোতির্ময় পুরুষের স্বপ্ন দেখতে দেখতে কখন যেন তলিয়ে গেলাম ঘুমের অতলে...