Next
Previous
0

ধারাবাহিকঃ নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

ধারাবাহিক



ছুটি কথা - ১৩ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত



এই তো বাতাসে কেমন পুজোর গন্ধ ভেসে আসছে। পুজো মানেই ছুটি। হ্যাঁ, আমাদের শিশুকালেও এমন হত, ঠিক একটা গন্ধ পেতাম বাতাসে। ঠাকুরের প্যান্ড্যালে বাঁশ বাঁধার আগেই একটা প্রস্তুতি ছিল, যেমন কি জামা হবে? পুজোয় নতুন জামা জুতো পরে ঠাকুর দেখতে বেরনো, তার মজাই আলাদা। ছোট থেকেই পুজোয় জামা বানিয়ে দিত ঠাম্মা। নানারকমের সেলাই জানত, কাজেই কাপড় কিনে এনে বাড়িতেই তৈরি ডিজাইনার ফ্রক। ওই বছরে কোন ফ্যাশান চালু আছে, এসব নিয়ে আমি বা আমাদের বাড়ির কেউ বিশেষ মাথা ঘামাত না। কিন্তু ছোটমা আমাদের বাড়ি আসবার পরে, আমার জামা প্রথম বানানো হল দর্জির দোকানে। ছোটমা করেই ছাড়ল। একদম অসাধ্যসাধন যাকে বলে। সেবার পিসি দিল পুজায় নেটের জামার কাপড়। ছোটমা সেই কাপড় আর আমাকে বগলদাবা করে চলল কাছেই এক দর্জির দোকানে। সেখানে গিয়ে দিব্যি ডিজাইন বলে কয়ে আমার মাপ দিইয়ে নিয়ে এল। আমি তো হাঁ। ইস্কুলের ইউনিফর্ম ছাড়া এমনি এমনি মাপ দিয়ে জামা বানানো? আর ইউনিফর্ম যে দর্জি বানাত সেও ভারী বুঝদার ছিল, মোটেই সঠিক মাপে বানাত না, সবসময় এক সাইজ বড় বানাত আবার উল্টে দেখিয়ে দিত, এই যে মুড়ির ভিতরে চওড়া কাপড় রেখেছি, জামা ছোট হলেই একটা সেলাই খুলে দেবেন। সত্যি, জামার মাপ ঠিক না ভুল... ঐসব ব্যাপার নিয়ে তার আগে কখনো আমাদের বাড়িতে কেউ মাথা ঘামায় নি। কারণ, মাপ একটু বড় বা ঢলঢলে হলেও সে পোশাক ভালই পরা যায়, আর মাপে ছোট হলে সে ত শরীরে গলবে না স্বাভাবিক নিয়মেই। কাজেই মাপে ছোট পোশাক তো অমনিতেই বাতিল। কিন্তু তাই বলে ঠিকঠাক নিজের মাপে জামা? নাহ, অমন হতই না। বরং নতুন অবস্থায় জামা থেকে জুতো সবই একটু বেশ বড় সাইজের পরতাম। কারণ, দুদিন পরেই তা মাপে ছোট হবে। ঠিকঠাক নিজের মাপের জামাজুতো কেনা ভারী বিলাসিতার ব্যাপার ছিল আমাদের শিশুবেলায়। আমি বেশ রোগা ছিলাম শিশুকালে, সব মাসতুতো- পিসতুতো, মামাতো দাদারা খ্যাপাত, ‘খ্যাঙরাকাঠি আলুরদম’ বলে। পুজোর সময় বলত, ‘এই রে, খ্যাঙরাকাঠি ভেতরে, বাইরে নতুন প্যান্ড্যাল’। সে যতই বলুক, প্রচুর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের সাইজের থেকেও বড় জামাজুতো পরে সারা রাজ্য ঘুরে আসতে আমার একটুও আটকাত না। সেই প্রথম ছোটমা এসেই বলল, ঠিকঠাক নিজের মাপে জামা বানানোর কথা, তায় আবার দর্জির দোকান থেকে। বেশ একটা চোরা বিপ্লব যে হয়ে গেল বাড়িতে, সেটা আমি তখন শিশু হলেও একটু একটু অনুভব করেছিলাম। 

সপ্তমীপুজোর দিন ভোরবেলা মামাবাড়ি সোদপুরে যাওয়া হত। সেদিন সব্বার মহামিলন উৎসব সেখানে, সব মামা মাসি, আমাদের মামাতো-মাসতুতো সব ভাইবোন আমরা সব্বাই একত্রিত হতাম। সারদিন খুব মজা করতাম সেখানে। মা, মাসিরা, মামিমারা সব্বাই মিলে রান্না করত। দারুণ মহাভোজ দুপুরে। সারাদিন ধরে চলত গান আর আড্ডা। বিকেলে আবার ফিরে আসতাম ঢাকুরিয়া নিজের বাড়ি। সোদপুরে যাবার সময় সপ্তমীতে ভোরবেলা প্রায় আলো ফোটার আগেই ট্রেনে চাপতাম আর প্রত্যেক বছর মাঝপথে শিয়ালদহে ট্রেন বদলানোর সময় একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করতাম। অনেক ঢাকি তাদের ঢাক নিয়ে ইষ্টিশানের প্ল্যাটফর্মে একসঙ্গে বসে বাজাতো। বিভিন্ন পুজো মণ্ডপ থেকে ওইখানেই বায়না করতে আসত ঢাকিদের। সে এক অদ্ভুত ঐকতান। দূর থেকে মনে হত যেন একটা সমুদ্রের ঢেউ। যত এগিয়ে যেতাম, মনে হত ঢেউটা আরও গর্জন করে আমার দিকেই আসছে। শত শত ঢাকি একসঙ্গে বসে একই বোল, একই লয়ে বাজাতো। বোধনের বাজনা। জানিনা, এখনও অমন ঢাকিরা আসে কিনা, কারণ বহুকাল পুজোর সময় ভোরবেলা শিয়ালদহ দেখিনি। 

বাবি বলেছিল, ঢাকের বাজনায় সব বোল আলাদা আলাদা হয়, বোধনের, আরতির, সন্ধিপুজোর, বিসর্জনের। এসব বলতে গিয়েই বাবি অতীতে ফিরে যেত বাংলাদেশে ঢাকায় দেশের বাড়ি। সেখানে পুজোর সময় মোষ আর পাঁঠা বলি হত, একমাস ধরে মোষের ঘাড়ে ঘি মালিশ করা হত যাতে খাঁড়ার এক কোপে নামে। সলতে পাকাতে পাকাতে, দূর্বা বেছে, পান সেজে, ফল কেটে, পদ্মের পাপড়ি ফুটিয়ে, মালা গেঁথে, আলপনা দিয়ে আর নাড়ু পাকাতে পাকাতে বাড়ির মেয়েদের হাত ব্যথা হয়ে যেত। মায়ের ভোগ রেঁধে আর নৈবেদ্য সাজিয়ে বামুন- ঠাকুর, পুরোহিত সব্বার কোমর নড়ে যেত। যজ্ঞের আহুতির সময় স্বয়ং ব্রহ্মা প্রজাপতির রূপ ধরে আসতেনই। সেখানে প্রতিমার চোখ অদ্ভুত জীবন্ত। সেখানকার ঢাকি বোল তুলত ভারি মায়াবী সুরে। অমন পুজো, অমন যজ্ঞ, অমন প্রতিমার চোখ আর ঢাকের অমন সুর এদেশে এসে বাবি কোথাও খুঁজে পায়নি, সেটা প্রতি পুজোয় মনে করত। আমি অমন পুজো দেখিই নি কখনো, আমার কাছে সেসব অলীক রূপকথার মত মনে হত। আমি পাড়ার বারোয়ারি পুজোতে ঢলঢলে নতুন জামা পরে অঞ্জলি দিয়ে আর খিচুড়ি ভোগ খেয়ে সবিশেষ পরিতৃপ্ত থাকতাম। 

একবার, পুজোর আগেই, সারা পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষত মেদিনীপুরে ভয়াবহ বন্যা হল। ১৯৭৮ সাল। আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। যতদূর মনে পড়ে সম্পত্তি ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও, প্রাণহানিও ঘটেছিল সেই বন্যায়। কলকাতা শহরেও খুব জল জমেছিল। আমি আর ছোটমা দুজনে মিলে গিয়েছিলাম ঢাকুরিয়া ব্রিজের উপরে, জল দেখবার জন্য। উফফ, সেকি জল। গাড়িগুলো আসছে যেন নৌকার মত। একেকটা গাড়ি এসে ব্রিজে উঠছে আর সমুদ্রের ঢেউ যেন আছড়ে পড়ছে। খবরের কাগজে বন্যার ছবি, ডুবে যাওয়া বাড়িঘর, নিরাশ্রয় মানুষের দল, এসব ছবি দেখে খুব মন খারাপ লাগতো। জলের এমন সর্বগ্রাসী রূপ দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। পুজোয় সেবার নতুন জামা কেনার প্রসঙ্গ ওঠায়, মা আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলেছিল, ‘ছিঃ!’ আরও বলেছিল, ‘দেখছ না, সারা বাংলায় কত ছোট ছোট বাচ্চা তোমার বয়সী, যাদের থাকার ঘর, জামাকাপড়, খাবার- কিচ্ছুটি নেই, তারা ত্রাণশিবিরে পড়ে আছে। কি করে উচ্চারণ কর নিজের নতুন পোশাক কেনার কথা?’ আমি ভারী লজ্জা পেয়েছিলাম। তারপর মাকে বলেছিলাম যে টাকায় পোশাক কেনা হবে, সে টাকা ত্রাণের জন্য দিয়ে দিতে। নিজের জমানো টাকা যা দিয়ে পুজোর সময় পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে গিয়ে আইসক্রিম আর ফুচকা খাব ভেবেছিলাম, সেটাও দিয়ে দিয়েছিলাম মায়ের হাতে, ত্রাণে দেবার জন্য। না, সেবার নতুন জামা পুজোয় হয়নি, ঠিকই, কিন্তু তার জন্য আনন্দের কোনও কমতি আকাশে বাতাসে কোথাও ছিল না।