Next
Previous
0

ধারাবাহিকঃ নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

ধারাবাহিক




ছুটি কথা ১০ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত



না, সব গরমের ছুটিতেই যে মামাবাড়ি যেতাম, এমনটা নয়। কোনও কোনও ছুটিতে যেতাম মেজমাসির বাড়ি, সেটা অধিকাংশ সময় হত কোন প্রস্তুতি ছাড়াই। কারণ মেজমাসির বাড়ি কোলকাতাতেই, বেনেপুকুর, পার্ক সার্কাসে। বেশী দূর নয় ঢাকুরিয়া থেকে। হয়তো কোনও সন্ধেবেলা বেড়াতে গিয়েছি, মাসি বলল, ‘থাইক্যা যা কয়দিন, ইস্কুল তো ছুটি!’ মাসি যে খুব ঝাড়া হাত-পা মানুষ, এমনটা নয়, অফিসে যায় রোজ। মাসতুতো দাদা মিঠুদা আমার থেকে অনেকটাই বড়, মানে যতটা বড় হলে ছোট ছোট ভাই বোনদের ‘দুধে-ভাতে’ বলে মনে হয়, ততটাই। আমার মোটে ক্লাস থ্রি আর মিঠুদা ইলেভেন। তাও মিঠুদা বেজায় ভয় পেত মেসোকে, খুব গম্ভীর রাশভারী মানুষ কিনা! তাহলে পাঠক- পাঠিকারা একবার ভাবো যে, আমি কতখানি ভয় পেতাম মেজমেসোকে। তার ওপর মেসোকে নিয়ে বেশ কিছু ‘মিথ’ আমি জন্মাবধি শুনে এসেছি, যে মেসো নাকি রেগে গেলেই মিঠুদাকে হকি স্টীক দিয়ে পেটায়, আর মেসোর নাম যেমন ‘বিশ্বনাথ’ মানে শিবঠাকুর, তেমনি স্বভাবেও নাকি শিবের মতই। কিন্তু এত ভয়ভীতি পেয়েও মাসির বাড়ি গরমের ছুটিতে থাকা আটকাত না কোথাও। মাসির থেকে যাওয়ার অনুরোধে ‘হ্যাঁ’ বলবার আগে শুধু এক দুবার আড়চোখে তাকাতাম দেওয়ালে টাঙ্গানো হকি স্টীকের দিকে। বসার ঘরে মেসোর সিগারেটের গন্ধ আর সেতারে প্রতিষ্ঠা করা রাগরাগিণীর সুর, সব মিলে মিশে বেশ একটা ম্যাজিকের মত ব্যাপার ছিল মাসির বাড়িতে। তার উপরে মাসির বাড়িতে ছিল টেলিভিশন। হ্যাঁ, আমরা তখনও টিভি বলতেই শিখি নি। আমাদের বাড়িতে তো নেইই, তিনটে পাড়া মিলিয়ে হয়তো খুঁজে পেতে দেখা যাবে, কাদের ছাতে সেই ইংরেজি টি-অক্ষরের মত দেখতে টেলিভিশনের অ্যানটেনা। সেখানে মাসির বাড়িতে ওই যাদু-বাক্স। ভর্তি ম্যাজিক! নব ঘোরালেই ওই বাক্সে বসে কারা যেন কথা বলে, গান গায়; মাঝে মধ্যে আবার সিনেমাও দেখায়। তবে? ঘরে বসেই এতকিছু। কাজেই গরমের ছুটিতে যদি মাসি বলত, ‘থাইক্যা যা!’, তাহলে বিশেষ প্রস্তুতি লাগে কি? কিন্তু ইস্কুল খুললেই যে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা, সেইটা আমার মনেও থাকতো না। আমার মনে না থাকলে কি হবে, মাসির দিব্য মনে থাকত। মাসি বাবাকে বলে দিত, ‘তাইলে কাইল অর কয়েকটা জামাকাপড় আর বইখাতা দিয়া যাইও! থাকুক কয়দিন আমাগো কাছে’। 

সকালবেলায় মাসি অফিস যাওয়ার আগে বলে যায়, ‘যা যা অঙ্ক দিলাম কষে রাখবি আর সব পড়া করে রাখবি, আমি এসে ধরব। আর দেখবি তো মিঠু সারাদিন পড়াশুনা করে, নাকি বন্ধুগো লগে খেলতে যায়’। দ্বিতীয় বাক্যটা ফিসফিস করে বলে, যেন সেটা ভারী গোপন কথা। আমার যে পড়াশুনায় দারুণ মন লাগে, এমন নয়, তবে ওই যে মাসি বলে গেছে, ঠিকঠাক না করে রাখলে টেলিভিশন মেসো নাকি চালাবেইনা আজ, আর চালালেও শুধু ওই সংবাদের সময়। অগত্যা একটু চেষ্টা করি অঙ্ক কষবার। কিন্তু ওই যে চোখ পড়ে, মাসির ঘরের পেছনেই একটা মাঠ, আর মাসির জানালার প্রায় লাগোয়া একখানা শিবমন্দির। শিবমন্দিরে যিনি পূজা করছেন, তার একখানা যা গোঁফ না সে কি বলব! শুধু কি গোঁফ? টিকিও আছে একখানা বিশাল, ডগায় আবার একটা ফুল বাঁধা। পাশেই সেই পুজারির থাকার ঘর। মাসি বলে গেছে, ওরা হিন্দুস্তানি। আচ্ছা হিন্দুস্তানি মানে কি? ওরা নিজেদের মধ্যে শুনতে পাচ্ছি হিন্দিতে কথা বলছে। হুঁ, বুঝলাম, ওরা বাংলায় কথা বলে না। আমি লক্ষ্য করি ওদের মেয়েদের শাড়ি পড়ার ধরনও অন্য রকম। এরকম আমি দেখেছি বটে, তবে বাংলার বাইরে। দেখেছ, আমি জানতামও না, কলকাতায় বাঙ্গালী ছাড়াও আরও কত ভাষাভাষী মানুষ থাকে। ঐযে দূরে, মাঠে কাদার মধ্যে অনেকে খেলছে, আবার আকাশ জুড়ে মেঘ ঘনিয়ে আসছে। আচ্ছা, এইগুলো দেখবো না পড়বো? চোখের সামনে এত কিছু হয়ে চলেছে, না দেখে পারা যায়! এই রে, হঠাৎ আমার খেয়াল পড়ে, মিঠুদা তো ঘরে নেই। মাসি তো বলে গিয়েছিল দেখতে যে মিঠুদা ছুটিতে সারাদিন পড়াশুনা করছে কিনা। আচ্ছা, ফ্ল্যাটের সামনের জমিতে এত হইহল্লা কিসের? খাবার ঘরে মাসির হাতের এমব্রয়ডারি করা পর্দায় একরাশ ফুল ফুটে আছে। আমি সব ফুলসমেত সেই পর্দাটা সরিয়ে উঁকি মারি। হুঁ, এখন বুঝলাম কেন মাসি বলে গিয়েছিল। মিঠুদা তো বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছে। একটু আগে যেন কে একটা আউট হল মিঠুদার বোলিংএ, তারই চীৎকার, হই-হল্লা কানে আসছিল। আচ্ছা, মিঠুদাও তো তাড়াতাড়ি আউট হয়ে ফিরে এসে বাড়ি ফিরে আবার পড়তে বসে যেতে পারে, তাহলে আমারও মাসিকে কিচ্ছু রিপোর্ট করতে হয় না। কিন্তু, মিঠুদার টীম তো বোলিং আর ফিল্ডিং করছে, সুতরাং এখনই মিঠুদার আউট হবার প্রশ্নই নেই। অতএব, মিঠুদা বেশ দেরি করেই ফেরে আর অফিস থেকে মাসি ফিরলে সেই কথাটা আমাকে বলতেও হয় মাসির প্রশ্নের জবাবে। মিঠুদা চেপে ধরে আমাকে, ‘বলে দিলি? দ্যাখ কি করি তোকে?’- কিন্তু মিঠুদার একটু একটু হাসিমুখ দেখে আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি যে ও ঠাট্টা করছে। তাছাড়া যদি আমাকে মিঠুদা রাত্রিবেলা সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে ভুতের ভয় দেখায়ও, আমি নিশ্চিত জানি ওটা ভূত নয়, মিঠুদা! 

অফিস থেকে ফিরে মাসি যে কত কাজ একসঙ্গে করে ফেলে, দেখে আমি একদম হাঁ হয়ে যাই। কুড়ি মিনিটের মধ্যে ‘একখান টান দিয়া লই’ বলে ঘচাঘচ কাঁচি চালিয়ে কাপড় কেটে সেলাই মেশিনে আমার একখানা ফ্রক সেলাই করে আমাকে পরিয়ে দেয়। আমাকে চুল বেঁধে দেয়, মুখে, গায়ে কি সুন্দর চন্দনের গন্ধওয়ালা একটা পাউডার লাগিয়ে দেয়। কিন্তু আমি জানি, মাসি এখুনি পড়া ধরবে। অঙ্কগুলো তো তবু করেছি, কিন্তু একটা বিভীষিকা পড়া মাসি দিয়ে গিয়েছিল হাইজিনের, সেটা নিয়ে একটু সমস্যা আছে। যাই হোক, যা মনে হয় বানিয়ে বানিয়ে বলতে থাকি, একটু পরে লক্ষ্য করি মাসি আর মেসো দুজনেই মুখ টিপে হাসছে। তারপর মাসি বলে, ‘এইবার চালাইয়া দাও’। হ্যাঁ, তারপর শুরু হয় টেলিভিশনের প্রোগ্রাম। আমি একদম বেশীক্ষণ একজায়গায় বসে থাকতে পারি না। মাঝে মাঝেই উঠে যাই, মাসির পায়ে পায়ে- রান্নাঘরে গিয়ে দেখি মাসি কি করে। মাসি বলে, ‘আচ্ছা, ওই টেলিভিশনে যে মেয়েটা খবর পড়ছে, তাকে দেখতে ভাল? নাকি আমাকে দেখতে?’ আমি আবার একছুটে দেখে আসি টেলিভিশনের পর্দায়; এসে মাসিকে বলি, ‘ইসস, তুমি ওই মেয়েটার থেকে অনেক দেখতে ভাল! ও তো মাথায় ফুল গুঁজেছে, ফুল গুঁজলে তোমাকে তো দারুণ দেখাবে’। কর্মব্যস্ত আর গুণী মানুষটিকে সেই মুহূর্তে আমার বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী বলে মনে হতে থাকে। মাসি ঘেমে নেয়ে গরম গরম রুটি আর অসাধারণ একটা পাঁঠার ঝোল বানিয়ে- আধঘুমন্ত আমাকে খাইয়ে দেয় দ্রুত হাতে। পরবর্তী কালে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় অনেক পাঁচতারা হোটেলেও নানাস্বাদের মাংসের পদ খেয়ে দেখেছি, সেই যে মাসির হাতের রান্না পাঁঠার ঝোল খেয়েছিলাম, অমনটি আর কোথাও খেতে পেলাম না!