Next
Previous
0

ধারাবাহিক : নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




ধারাবাহিক - ছুটি কথা ৩

নন্দিনী সেনগুপ্ত



মামাবাড়িতে যখনই যেতাম, আমার বহু বিকাল, বলা ভালো খেলা-ধূলা দুষ্টুমি ভরা বিকেল কেটে যেত ঐ পাড়ায় বেশ কিছু আমার বয়সী বাচ্ছাদের সঙ্গে। বাবলি, ঝুম্পা, সোমা, মন্টি ... এদের শিশুবয়সের চেহারাগুলো এখনও আমার মনে আছে। এখন এই মুহূর্তে কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ নেই আর। ওদের সঙ্গে পুকুরের ঐ উত্তর পাড়ের ছোট মাঠটাতেই বেশীর ভাগ সময় খেলতাম। কবাডি, লুকোচুরি, ছোঁয়াছুঁয়ি, চুকিতকিত, ব্যাডমিন্টন খেলে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়লে আমরা রুমালচোর খেলতাম। একদিন আমি গিয়ে বললাম যে, ‘আজ আমরা কালারম্যান খেলবো’... শুনে সব্বাই চোখ গোল গোল করে বলল—‘সেইটা আবার কি খেলা?’ আমি বিশদ করে সবাইকে বোঝাতে লাগলাম যে কিরকম করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুর করে সমস্বরে ইঞ্জিরিতে জিজ্ঞাসা করতে হবে... কাকে? না যে কালারম্যান হবে একান্ত নিজের ইচ্ছেয়, তাকে। জিজ্ঞাসা করতে হবে যে কোনটা তার সবচেয়ে পছন্দের রং। এইবার সে তার পছন্দ বাতলাবে, অবশ্যই ইঞ্জিরিতে বলতে হবে তাকেও। এইবারে সব্বাই ছুট লাগাবে কোথায় রয়েছে আশেপাশে... কোথায় সেই রং... যেটা কালারম্যান বলেছে তার পছন্দের। যদি ছুটে গিয়ে ছুঁয়ে ফেলতে পারো সেই রং, ব্যস আর চিন্তা নেই! আর যদি খুঁজে না পাও, বা খুঁজে পেলেও ভুলে যাও ছুট লাগিয়ে সেই রং তখুনি ছুঁয়ে ফেলতে, হয়ে গেল তোমার দফা রফা, কালারম্যান এসে ছুঁয়ে ‘আউট’ বলবে আর তুমি সোও-ও-জা মাঠের বাইরে বসে বসে ঘাসের ডগা দাঁতে কাটবে। কালারম্যান এমনি চালাক, সে তার পছন্দের রং বলে একমুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকে না, তখুনি ছুট লাগিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে কজনকে খেলা থেকে ‘আউট’ করে দিতে পারে, সেই চেষ্টায় লেগে পড়ে। যে খুব জোরে দৌড়ায়, তাকেই কালারম্যান হতে হয়। ঝুম্পা খুব জোরে দৌড়ায়, কাজেই ও বারে বারেই কালারম্যান হতে চায়। সব্বাই যখন ‘আউট’ হয়ে যায়, আমরা মাঝে মাঝে সবুজ মাঠের ‘গ্রিন’এ চিৎপাত হয়ে শুয়ে শুয়ে আকাশের ‘স্কাই-ব্লু’ এর রকমফের দেখি। ছোট মাঠে আমাদের সবসময় খেলতে ইচ্ছে করেনা। মাঝে মাঝেই ঝুম্পাদের বাড়ির পাঁচিল টপকে পূর্বদিকে কয়েকপা গেলেই বিশা-আ-আ-ল মাঠ। তবে ওইখানে পাড়ার বড় দাদারা ফুটবল খেলে তো, তাই আমাদের ওখানে খেলতে মানা, যদি কারও গায়ে বল লেগে যায়, এই জন্য। তবে মাঝে মাঝে আমরা যাই তো, সেদিন ঝুম্পা এসে বলল, ওর দাদার কলেজ ছুটি হতে হতে পাঁচটা বাজবে, বড় দাদারা মাঠে আসতে আসতে সাড়ে পাঁচটা, আর আমাদের খেলা তো চারটে থেকে শুরু। কাজেই আমরা যেতেই পারি বড় মাঠে। উফফ, বড় মাঠে যা মজা না, কি বলব। অনে-এ-এ-ক দূর দেখা যায়, আকাশটাও যে কি পেল্লাই... সেটা তো বড় মাঠে এসেই বোঝা যায়। আর ভেবে ভেবে বের করতেও হয়না যে কি খেলা খেললে ভাল। শুধু দৌড়, দৌড়...আর দৌড়... সমস্ত আকাশ, বাতাস দুহাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে কি দৌড়! ঐ দূর মাঠে যাচ্ছে একটা ট্রেন-- ট্রেনটার গোটা শরীরটা ছোট একটা সাপের মত দেখাচ্ছে - এত দূর যে ট্রেনটাকে না দেখলে বুঝতেও পারতাম না যে ওইখানে একটা রেললাইন পাতা আছে। বাবলি গম্ভীর হয়ে বলল যে ঐ ট্রেনটা মধ্যমগ্রামের দিকে যাচ্ছে। এও বলল... যে রেললাইন টা পেরিয়ে গেলেই অনেকগুলো দীঘি আছে, সেই দীঘির জলে সম্বচ্ছর পদ্মফুল ফুটে থাকে, যত চাও নিতে পারো। শুনেই আমার গা ছমছম করে উঠল, ঐ পদ্মফুলের দীঘির তলাতেই নাগরাজের আসল আবাস কিনা কে জানে !

ঝুম্পার বাড়ির পাঁচিল টপকে ফিরছি, ঝুম্পার মা ডাকল, ‘একটু আয়, দেখি... এতো আমাদের বাঁশরীর মেয়ে,-- ইসস, কি রোগা রে তুই! নিশ্চয়ই খাওয়া নিয়ে মাকে খুব জ্বালাস, না রে’!-- আমি আর কি বলি, মনে মনে ভাবছি... এইরে এইবার নিশ্চয়ই কিছু খেতে দেবে, তারপর মামাবাড়ি ফিরে আর সন্ধ্যাবেলা দুধের গেলাসটা নিয়ে আর কতক্ষণ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গেলাসের সাইজ, আকার, নকশা, তারপর কার নাম লেখা আছে গেলাসের গায়ে-- এইসব দেখবো? না খেলে তো দিদা...। ভাবতে ভাবতেই বলে উঠল ঝুম্পার মা, ‘এই নে, খা’, বলেই আমার হাতে একটা বাদামচাকতি দিল। আমি ভাবছি এই যে এত পছন্দসই খাবার, এইটা খাবনা বলা ভারি মুর্খামি। বাদামচাকতি হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসছি ঝুম্পাদের বাড়ি থেকে, এমন সময় ঝুম্পার দাদা সাইকেল নিয়ে ঢুকল আর ঝুম্পা আহ্লাদে আটখানা হয়ে আমাকে দেখাতে লাগল, ‘এই দ্যাখ, আমার দাদা, আমার নিজের দাদা’। আমি নির্বিকারভাবে বাদামচাকতি চেবাতে চেবাতে বললাম,... ‘হ্যাঁ, চিনি তো... সমুদা... দারুণ তবলা বাজায়, গত রবিবার ছোটমামুর সঙ্গে বাজাচ্ছিল’। সমুদা আকাশ ফাটিয়ে হাহা করে হেসে উঠল। ঝুম্পা কি একটু দুঃখ পেল? হাসিটা ফিকে হয়ে গেল ওর মুখ থেকে। বলে উঠল, ‘শুধু তবলা বাজায় ভাল? জানিস আমার দাদা ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেয়েছে? জানিস কত ভাল আমার দাদা পড়াশুনায়? কত তাড়াতাড়ি অঙ্ক কষে জানিস? কার দাদা দেখ তুই!’ ... আমি এতকিছু কোথা থেকে জানব? সমুদা তো আর আমার নিজের দাদা নয়। আসলে আমার নিজের কোনও দাদা নেই-- ঠিকই, কিন্তু আমার অনেক দাদা আছে, যারা কোনদিন আমাকে বুঝতে দেয়না যে নিজের দাদা না থাকলে কোনও কষ্ট হয়না। 

রোজ খেলতে যেতাম মাঠে এমন নয়, কখনও কখনও দিদা হাঁটতে যেতেন বিকেলবেলা উত্তরের মাঠ পেরিয়ে অমরাবতীর দিকে শিবমন্দির পর্যন্ত, সঙ্গে যেতাম আমি। সন্ধেবেলা ফেরবার সময় একদিন দেখি পুকুরধারে বিরাট জটলা...টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসতে লাগল... ‘দরকার হলে কি? কলকাতায় নিয়ে যাওয়াই তো ভাল!’... ‘এখনও জ্ঞান ফেরেনি?’... ‘আর কি বলবেন, এইসব ছেলেপুলেদের কাণ্ড! ধাক্কাধাক্কি করে একটা আধলা ইটে গিয়ে মাথাটা’... ‘না, না, মাথার চোট ভাল ব্যাপার নয়!’... ‘কলকাতায় পিজিতে নিয়ে যাওয়া উচিত’। দিদা ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে বাবলুদাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি অইসে? কার কি অইসে বাবলু?’ বাবলুদা মামাবাড়ির পাশের বাড়িতেই থাকে, সামনের দুটো দাঁত উঁচু, মুখটা হাসি হাসি দেখায় অমনিতেই। কিন্তু সেই সময় বাবলুদার মুখটা একটুও হাসি হাসি দেখাচ্ছিল না। বাবলুদা বলল, “আর বোলো না দিদা, সমু...” দিদা আবার প্রশ্ন করল, “হ, কি অইসে সমুর? কাইলও তো শিবুর লগে আড্ডা দিল রাইত অবধি আমাগো ঘরে... কয় শিবুর বিয়ায় হগলের আগে যাইবো বরযাত্রী সাইজ্যা..!” বাবলুদা বলল, “দিদা, তুমি ঘরে যাও, তোমারে দিয়া আসি...সমুর একটা এক্সিডেন্ট হইসে। মাঠে ধাক্কাধাক্কি কইরা পইড়া গিয়া মাথায় চোট লাগসে’। দিদা কি একটু কেঁপে উঠল? আমি দিদাকে ধরলাম। 

রাত্রিবেলা ছোটমামু খুব গম্ভীর মুখ নিয়ে বাড়ি ঢুকল। ছোটমামু বলল যে পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু ডাক্তাররা বলেছেন যে বাহাত্তর ঘণ্টা না কাটলে কিছু আশা নেই। আমি রাত্রিবেলা ঘুমাতে যাওয়ার আগে ঠাকুরকে ডাকতে লাগলাম যেন বাহাত্তর ঘণ্টার তিনটে দিন সমুদার তবলার বোলের তেহাইএর মত তাড়াতাড়ি ভাল ভাবে কেটে যায়, কারণ ঝুম্পা যে ওর দাদাকে খুব ভালবাসে। সমুদার যদি কিছু হয়, ঝুম্পার যে খুব কষ্ট হবে। ঠাকুর কি আর আমার প্রার্থনা শোনেন? কস্মিনকালে ঠাকুরকে ডাকিনা, এখন হঠাৎ ডাকলে কি আর ঠাকুর শুনবেন? পরদিন সন্ধেবেলা দেখলাম ছোটমামু কাঁদতে কাঁদতে এল। ছেলেরা অমন করে কাঁদে, আমি তো এর আগে কখনো দেখিনি। ছোটমামু কাঁদছে আর বলছে ‘গেলি রে, তুই সবার আগে যাবি বলেছিলি আমার বিয়ের বরযাত্রী সেজেগুজে... সেই সবার আগে গেলি! তোকে আমি নিজের হাতে সাজিয়ে দিলাম সমু’ ! আমি জানিনা, ছোটমামু তো সমুদার নিজের দাদা নয়, পাড়ার দাদা, ছোটমামুর এত কষ্ট হচ্ছে, তাহলে যদি কারও নিজের দাদা চলে যায়, তার কিরকম কষ্ট হয়... আমি জানি না রে, ঝুম্পা রে, আমি সত্যিই জানিনা, আমার তো অনেক দাদা আছে। সবাইকে ভাইফোঁটা দিতে পারি এমন নয়, কিন্তু জানি যে তারা আমার নিজের দাদার বেশী বই কম নয়।