Next
Previous
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in





















বের্নহার্ড বেশ ঘাবড়ে গেল। প্রায় কেঁদে ফেলবে সে। এই প্রথমবার সে শুনল যে গের্ট এবং ইনেস একেবারে বয়ে যাওয়া ছেলেমেয়ে এবং এই বন্ধুমহলে মেলামেশা না করাই তার পক্ষে মঙ্গল। এদের সঙ্গে মিশলে বের্নহার্ডের ধ্বংস অনিবার্য। ‘বয়ে যাওয়া’ আর ‘ধ্বংস’ শব্দদুটো শুনে সে বেশ বিরক্ত হল, যদিও উল্টে কিছু বলবার সাহস তার ছিল না। তাছাড়া এই কথাটা তো অগ্রাহ্য করা চলে না যে গের্ট একেবারেই পরিশ্রমী ছাত্র নয়। কিন্তু ইনেসকে এই দলে ফেলা যায় না। সে এইসব নিন্দার উর্ধে। তাছাড়া বাবা তো জানেনও না যে ইনেস তাদের বন্ধুবৃত্তে বেশ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে। তবে বন্ধুদের দলের সবাই খারাপ, এটাও সঠিক কথা নয়। কারণ অনেকেই যথেষ্ট পরিশ্রমী, ভাল স্বভাবের এবং নিয়মানুবর্তী…

এই ঘটনার কিছুদিন পরে বের্নহার্ডকে বাড়িতে যাবার কথা বলা হয়েছিল, কারণ তিন সপ্তাহের ছুটি ছিল তার স্কুলে। বাবা বলেছিলেন যে সবকিছু বদলে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। বের্নহার্ড ভেবে উঠতে পারছিল না যে ঠিক কেমন বদল ঘটবে। তার একটু ভয় ভয় করছিল। তাকে গের্ট এবং ইনেসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বারণ করা হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে গের্টকে একবার ফোন করেছিল এবং জিজ্ঞাসা করেছিল যে তাদের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব কি না।

এই দেখা করবার ব্যাপারটা শেষ অবধি বেশ অদ্ভুত হয়ে দাঁড়ালো। বের্নহার্ড গের্টের বাড়িতে গিয়ে বেল বাজানোর পরে গের্ট নিজে এসে দরজা খুললো। তারপর তার নিজের ঘরে নিয়ে গেল। গের্টের ঘর এমনিতেও বেশ অগোছালো থাকে, আজও তাই। ঘরের কার্পেটে ফ্লক শুয়ে আছে। সে বের্শেনকে দেখে লেজ নেড়ে আহ্লাদ প্রকাশ করল। গের্ট বলল যে ইনেস চলে গেছে কুকুরটাকে রেখে দিয়ে। ‘কুকুর’ বলে উল্লেখ করাটা বের্নহার্ডের ভাল লাগল না। কারণ ফ্লককেও সে বন্ধু বলেই মনে করে। কিন্তু ইনেস চলে গেছে, এটা শুনে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। তার হতবাক দশা দেখে গের্ট মজা পেলেও, বের্শেনের মতে ইনেসের চলে যাওয়াটা সত্যি সত্যি একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ফার্দিনান্দের চলে যাওয়া, লাতিন পেপারের পরীক্ষার খারাপ ফল, বাবার সঙ্গে তর্কাতর্কি, সব বিচ্ছিরি ঘটনা ছাপিয়ে গেছে ইনেসের চলে যাওয়া।

-‘ইনেস কোথায় গেছে?’ অবশেষে একেবারে বিধ্বস্ত স্বরে বের্শেন প্রশ্ন করে।

-‘ইংল্যান্ডে গেছে, ওর দিদির কাছে। দিদির বাচ্চা হয়েছে। তিন-চার সপ্তাহের জন্য গেছে।’

-‘হঠাৎ করে যেতে হল?’

‘হ্যাঁ। যাই হোক, তোমাকে বারতিনেক ফোন করেছিল ইনেস। কিন্তু তুমি ছিলে না।’

রাগে, দুঃখে, অসহায়তায় বের্নহার্ড একদম ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। ইনেস তার নামে একটা চিঠি লিখে রেখে গেছে গের্টের কাছে।

‘প্রিয় বের্শেন,

আমি তোমাকে বিদায় জানিয়ে যেতে পারিনি বলে মন খারাপ করবে না। তোমায় তিন বার ফোন করেও কথা বলতে পারলাম না। আমি জানি না বিষয়টা আসলে ঠিক কী। কিন্তু আমার মনে হল ইচ্ছাকৃত তোমাকে ফোনে ডাকা হয়নি। তুমি যদি এমন কিছু করে থাকো, যেটা তোমার ঠাকুমা কিম্বা বাবা-মায়ের অপছন্দ, তাহলে সেই বিষয়ে তাড়াতাড়ি মিটিয়ে নাও পরিবারের মধ্যে কথা বলে। যদি আমাদের কোনও কাজকর্ম ওঁরা বুঝতে না পেরে থাকেন, সেক্ষেত্রে সেটা বোঝানোর দায়িত্ব আমাদের উপরেই বর্তায়। কারণ, আমাদের সামনে এখন গোটা জীবনটা পড়ে আছে। ভাল থেকো, খুশি থেকো আর আমার চিঠির উত্তর দিও।

ইতি,

তোমার প্রিয় বন্ধু ইনেস’



গের্ট তার কাঁধের উপর উঁকি দিয়ে চিঠিটা পড়ে ফেলেছিল। সে ক্রমাগত জিজ্ঞেস করে যেতে লাগল যে বের্শেন কী এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে।

চিঠিটার দিকে তাকিয়ে বের্শেন বলে… ‘কিচ্ছু না।’

গের্ট চিন্তান্বিত মুখে বের্নহার্ডের চুলে টোকা মারে।

‘কিন্তু কিছু একটা কাণ্ড তো নিশ্চয়ই তুমি ঘটিয়েছ বের্শেন। যদি ইনেস এখানে উপস্থিত থাকতো, তাহলে কি তুমি তাকে সেই কাণ্ডটা বলতে? এখন সে এখানে নেই, ফলে আমি হয়তো বুঝতে পারব না, সেইজন্য বলছ না আমায়?’

বের্নহার্ডকে নিরুত্তর বসে থাকতে দেখে অবশেষে সেও চুপ করে। ধীরে ধীরে তার মাথার চুলে টোকা মারে।

বের্নহার্ড হঠাৎ নিজের হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে হাহাকার করতে থাকে, ফেটে পড়ে দুঃখে… ‘আমায় ওঁরা আর তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে দেবেন না।’

গের্ট সাঙ্ঘাতিক অবাক হয়। বের্শেনকে টেনে নেয় তার কাছে। হাসবার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে… ‘এর চেয়ে যদি বেশি কিছু না ঘটে থাকে… তো… কিন্তু ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর!’

‘আগামীকাল আমায় বাড়ি চলে যেতে হবে… ছুটি পড়বে।’

‘খুশি থাকো, বের্শেন, তোমার একটু ছুটি খুব প্রয়োজন!’

‘এবং হয়তো তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। আমি আর নাও ফিরতে পারি!’

গের্ট চুপ করে বসে থাকে এক মুহূর্ত।

-‘কিন্তু বের্শেন!’ বলে ওঠে গের্ট… ‘আমিও যে এখানে একা থাকতে পারব না। ইনেস চলে গেছে… আবার তুমিও… আমি কী ভাবে থাকব যদি তুমিও এখানে না থাকো?’ গের্ট দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে একদম চুপ করে বসে থাকে। অবাক হয়ে বের্শেন লক্ষ্য করে যে গের্ট অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে আছে। বের্শেন চলে যাচ্ছে বলে গের্টের চোখে জল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে বের্শেনের গলা জড়িয়ে ধরে।

শিক্ষকের কাছে চিঠি লেখে বের্নহার্ড ফরাসি ভাষায়,


মঁসিয়ে,

আপনাকে আমার পরিস্থিতি বিষয়ে অবগত করাবার জন্য নিঃসঙ্কোচে এই পত্র লিখছি। আপনি যখন পারী নগরে গিয়েছিলেন, তখন আমি জানতাম না যে এত শীঘ্র নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি স্থির করবার জন্য কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। বর্তমান সময়ে আমি দ্বিধাগ্রস্ত যে আমি যে কোনো চাকরিতে যোগ দেব নাকি আপনার নির্দেশিত পথে আপনার সঙ্গে পারী শহরে গিয়ে নিজের সঙ্গীতপ্রতিভা প্রমাণ করবার জন্য আরও কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়াব। আমার পিতা অর্থনৈতিক সমস্যায় আছেন এবং তিনি চান যেন আমি এখনই স্কুল ত্যাগ করি। পিতা আমাকে খুব বেশি অর্থনৈতিক সাহায্য দিতে সক্ষম হবেন না। ফলে আমি যদি পারী নগরে যাই, সেখানে আমাকেই উপার্জন করতে হবে। যদি আপনি আমাকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করেন, তাহলে অবশ্য আমি সব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব এবং সবক্ষেত্রে সফলতা লাভ করব, এমন আশা রাখি।

আপনার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

আপনার একান্ত অনুগত ছাত্র,

বের্নহার্ড


বাড়ির পরিবেশ যে সাঙ্ঘাতিকভাবে বদলে গেছে, ব্যাপারটা এমন নয়। বাবা মা যেভাবে থাকতেন বোন মনিকে নিয়ে, তেমনটিই আছেন। তবে বাড়ির ঘোড়াগুলো এবং গাড়িটা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির চারপাশে যে জমিগুলো ছিল, সেগুলো বিক্রি করা হয়েছে। চাকরবাকর যারা ছিল, সব একে একে বিদায় নিচ্ছে। শুধু যে পুরনো বৃদ্ধ গাড়োয়ান ছিলেন, তিনি এখন থেকে গৃহভৃত্য হিসেবে থাকবেন। মনির আয়া, যিনি শিশুকালে বের্নহার্ডকেও দেখাশোনা করতেন, তিনিও থাকছেন।

যেহেতু আগে থেকেই ঠিক ছিল যে বের্নহার্ড সঙগীত নিয়ে পড়াশুনা করবে এবং পারী শহরে যাবে, সেহেতু তার অবস্থান কিছুটা বদলে গেছে বাড়িতে। ফলে সারাদিন সে যাইই করুক না কেন, তাকে কেউ কিছু বলে না এবং তার উপরে সাঙ্ঘাতিক কঠোর বিধিনিষেধ কিছু আরোপ করা হয়নি। সে যখন পিয়ানো অভ্যাস করে, তখন কেউ তাকে বিরক্ত করে না। অর্থাৎ তার ক্রিয়াকলাপ আগের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে এখন।

বের্নহার্ড মনির সঙ্গে অনেকটা সময় ধরে কথোপকথন চালিয়ে যায়। জঙ্গলে হাঁটতে যায় তারা। মনির ছোট হাত ধরে থাকে সে এবং তার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেয়। মনি খুবই বুদ্ধিমতী মেয়ে এবং ধৈর্য ধরে সে তার সব কথা শোনে। হাঁটতে হাঁটতে মাথাটা একদিকে একটু হেলিয়ে দাদার দিকে তাকিয়ে সব কথা শুনে যায় মনি।

-‘বের্শেন’… মনিই সাধারণত প্রথমে বাক্যালাপ শুরু করে এবং তার মিষ্টি গলায় নিজের নামটা শুনতে বের্নহার্ডের খুব ভাল লাগে … ‘বের্শেন, তুমি তো চলে যাবে শুনলাম… তা তুমি ফিরবে কবে?’

-‘সে তো জানি না, মনি!’

-‘জায়গাটা কি অনেক দূর?’

-‘নাহ, খুব বেশি দূর নয়। তুমি যদি আমায় চিঠি লেখ, আমি পরদিন সন্ধেবেলার মধ্যেই সে চিঠি পেয়ে যাব।’

-‘কিন্তু আমি তো লিখতে শিখিনি এখনও।’

-‘তুমি মা’কে বলে দেবে তোমার যা বলার। মা লিখে দেবেন তোমার হয়ে।’

-‘তুমিও আমায় চিঠি লিখবে তো?’

-‘অবশ্যই লিখব… আর তুমি যদি চাও তোমার জন্য খেলনাও পাঠাতে পারি।’

-‘ওঃ, অবশ্যই বের্শেন। অবশ্যই চাই।’

-‘সেইজন্য কি তুমি আমাকে একটা চুমু দেবে এখন?’

-‘অনেকগুলো দেব। কিন্তু তার জন্য তোমাকে নিচু হয়ে বসতে হবে। কারণ তোমার মুখ অবধি আমি উঠতে পারব না। আমার মনে হয় যে তোমার মুখটা খুব সুন্দর!’

বের্শেন একটা গাছের গোড়ার কাছে উঁচু শিকড়ের উপরে বসে মনির হাতটা ছেড়ে দিয়ে। শিশুটি তার সামনে চুপ করে গম্ভীরমুখে দাঁড়ায়… ‘বের্শেন, তোমার কি মনে হয় আমার মুখটাও সুন্দর?’

‘খুব’ বলে ওঠে বের্নহার্ড… ‘খুব সুন্দর, বিশেষভাবে সুন্দর!’

এবং এই কথাটা যে শুধুই তার মনে হয় এমন নয়। সে অন্তর থেকে অনুভব করে। মনির ছোট্ট মুখটা ভারি সুন্দর। তার কমনীয় ত্বক সূর্যের রশ্মিতে একটু লাল হয়ে গিয়েছে, তার বড় বড় চোখ যেন আলোর শিখার মত, নাকি তারার মত উজ্জ্বল। অসম্ভব মনে হয় বের্নহার্ডের কাছে মনির চোখের সঠিক কোনো উপমা খুঁজে বের করা… একটু ঢেউ খেলানো সোনালি চুল খুব ভারি নয়, রেশমের মত মসৃণ, মোলায়েম, ফুরফুরে। সবচেয়ে সুন্দর মনির হাতদু’খানি। সাধারণ শিশুদের মত নরমসরম গোলগাল নয় তার হাত। রোদ্দুরে লালচে হয়ে ওঠা সুঠাম হাতে সুগঠিত আঙুলগুলো, হাতের পাতার উপরিভাগে শিরা জেগে আছে। ক্ষুদ্র হাতের এই নীলচে চকচকে শিরাগুলি দেখতে অপূর্ব বলে মনে হল বের্নহার্ডের।

‘মনি’ বলে বের্নহার্ড… ‘চুমু কই?’


(চলবে)