গল্প - মনোজ কর
Posted in গল্প১৭ পর্ব
পলাশি যুদ্ধোত্তর বাংলা, বিহার। চুঁচুড়া ও বক্সারের যুদ্ধ এবং পরিণতি।
পলাশি যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই যে সমস্ত জায়গায় আমূল পরিবর্তন এলো তার মধ্যে অন্যতম কলকাতা। বর্তমানে যে জায়গাটা জিপিও কমপ্লেক্স তার দক্ষিণের গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে পরপর কয়েকটা বাড়ি। মাঝখানে একটা বিশাল উঠোন যেটা বর্তমানে পার্কিং লট হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে দুটি বাড়ি একটা ব্রিজ দিয়ে জোড়া। ওটা দিয়ে মেল ডিপার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে গেলে বাঁদিকের একটা বাড়িতে খোদাই করা আছে অতীতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। পিতলের দাগ দিয়ে যে জায়গাটা আলাদা করে দাগ দেওয়া আছে সেটা পুরোনো ফোর্ট উইলিয়মের তোরণের অংশ যেটা ১৯২০ সালে ভেঙে ফেলা হয়েছিল। এটি ফোর্ট উইলিয়মের তৃতীয় সংস্করণের কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় সংস্করণ ১৭৫৬ সালে সিরাজের আক্রমণের সময় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ডানদিকের আর একটি বাড়িতে পিতলের দাগ দিয়ে পুরোনো ফোর্ট উইলিয়মের দক্ষিণের দেওয়াল চিহ্নিত করা আছে। কুখ্যাত ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের কোনও চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। সেখানে এখন মূত্রালয় এবং যৌথ রান্নাঘর।
সেন্ট জনস চার্চের দিকে গেলে যে হলওয়েল মনুমেন্ট দেখা যায় সেটিই এখন কৃষ্ণগহ্বরের শহিদদের একমাত্র স্মারক। যেখানে কৃষ্ণগহ্বর মূলত ছিল সেখানে ১৯০২ সালে লর্ড কার্জন এই স্তম্ভটি নির্মান করেন এবং ১৯৪০ সালে স্তম্ভটিকে বর্তমান জায়গায় নিয়ে আসা হয়। তার পাশেই ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬’র গভর্নর জেনারেল স্কটিশ নাগরিক জেমস ব্রন র্যামসের স্মৃতিবিজড়িত ডালহৌসি স্কোয়ার (অধুনা বি বা দি বাগ)। তার উল্টোদিকেই ১৯১১ সালে নির্মিত এবং রাজা পঞ্চম জর্জকে উৎসর্গীকৃত প্রাচীন তিনতলা লাল বাড়ি যার ঠিকানা ১, কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট। সহজেই অনুমান করা যায় যে এই এলাকাই ছিল তখনকার কলকাতার স্নায়ুকেন্দ্র। তার অল্প দূরেই ওয়াটারলু স্ট্রিট যার এখনকার নাম সিরাজউদ্দৌল্লা সরণি।
একথা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়না যে কেন অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশরা ক্লাইভের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিল। এই অস্থির সময়সত্ত্বেও ক্লাইভ নিজের, কোম্পানির এবং ব্রিটেনের জন্য বিপুল অর্থভান্ডার সৃষ্টি করেছিল। ক্লাইভের অসাধারণ দূরদর্শিতা এই কাজে তাকে সাহায্য করেছিল সে কথা বলা বাহুল্য। যে সময় ইংরেজ ব্যবসায়ীরা কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলকে রাজনৈতিকভাবে অধিগত করা তো দূরের কথা নিয়ন্ত্রন করা নিয়েও মাথা ঘামাতো না সেই সময় এশিয়া মহাদেশের এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অঞ্চলে বাংলার এক নবাবকে নিজের হাতের পুতুল বানাতে সক্ষম হয়েছিল ক্লাইভ। সেই পুতুলরাজার নাম মিরজাফর যাকে হাত ধরে নবাবের আসনে বসিয়েছিল ক্লাইভ। ২৬শে জুলাই, ১৭৫৭- লন্ডনের দরবারে চিঠি পাঠালো ক্লাইভ – ‘ বাংলার যে বিস্তৃত অঞ্চলে আমরা আধিপত্য কায়েম করেছি তাকে রক্ষা করার জন্য কেবল অতিরিক্ত সেনা এবং আধিকারিক নয়, আরও অনেক বেসরকারি যুবককে দরকার হবে এই অঞ্চলে আপনাদের ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। আপনারা যারা এই অঞ্চলকে নদী-নালা আর খাল-বিল-পুকুরের অঞ্চল মনে করেন তাদের পক্ষে অনুমান করা কঠিন যে কী পরিমাণ রাজস্ব আদায়কারি জমি আমরা অধিগ্রহণ করেছি। এই ক্ষুদ্র অঞ্চল থেকে আদায়ীকৃত রাজস্বের পরিমাণ আনুমানিক দশ লক্ষ টাকা প্রতি বছর। এই মুহূর্তে নবাবের এবং আমাদের আধিকারিকরা কলকাতায় গিয়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করছে।‘ রেভারেন্ড লং জানালো যে অবিলম্বে এই রাজস্ব আদায় কার্যকরী করা হবে যেহেতু কোষাগার থেকে নিয়মিত অর্থ আসার ক্ষেত্রে বিলম্ব ঘটতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এছাড়াও মিরজাফরের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সম্মতি দিতে বাধ্য করা হলো যে ৩৮টি গ্রামের জমিদারদের কাছে চিঠি লিখে জানতে চাওয়া হবে যে কী সর্তে তারা তাদের জমিদারি ব্রিটিশদের কাছে স্থায়ী হস্তান্তর করতে রাজি হবে। আরও কিছু সময়ের জন্য উইলিয়াম ওয়াটস কাশিমবাজারে এবং ক্লাইভ মুর্শিদাবাদে থেকে যেতে মনস্থ করলো। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে দরবার গঠনের এবং নীতি নির্ধারণের পদ্ধতি তৈরির কাজ সম্পন্ন করা হলো যাতে কোম্পানির স্বার্থরক্ষা এবং ব্রিটিশদের হাতে রাজস্ব তুলে দেওয়া সম্পর্কিত বিষয়গুলি অগ্রাধিকার পায়। মিরজাফরের দরবারকে অনেক ঐতিহাসিক ক্লাইভের প্রথম সরকার বলে অভিহিত করেছেন।
এই ভূখন্ডকে সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশদের অধীনে নিয়ে আসার আগে আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল ক্লাইভের এবং সেইসব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে নিতে হয়েছিল ক্লাইভকে।কলকাতাকে সুরক্ষিত করার জন্য অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে অনুরোধ জানানো হলে তিনি বিস্তারিত পরিকল্পনা পর্যালোচনা করে ৩রা আগস্ট ,১৭৫৭ জানায় -‘আমার মনে হয় এই পরিকল্পনাকে রূপায়িত করার জন্য যে পরিমাণ যত্ন এবং কৌশলের প্রয়োজন তার নিরিখে বিচার করলে আমার পরিচিত কাউকে আমি এই কাজের যোগ্য মনে করছি না। তবে আপনারা আমার বাহিনীর কাউকে যদি একাজের যোগ্য মনে করেন এবং তিনি যদি ভারতবর্ষে থাকতে রাজি হন তবে আমি তাকে এই কাজে নিয়োগ করতে পারি।‘ দুর্ভাগ্যবশত তার মাত্র তেরদিন পরে তিনি অ্যাডিমিরাল ওয়াটসন অজানা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দেহত্যাগ করে। সেই সময় ক্লাইভের পক্ষে কোনও ভুল পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব ছিলনা। সুচতুর ক্লাইভ যে কোনও অসুবিধাকে সুযোগে পরিবর্তন করতে সিদ্ধহস্ত ছিল। আর সিরাজ ছিল তার উল্টো। নিশ্চিত জয়কে পরাজয়ে পরিবর্তন করে প্রমাণ করেছিল যে জীবনে কোনও কাজই সে সঠিক ভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি। ১০ই জানুয়ারি ১৭৫৮ কলকাতার আধিকারিকরা লন্ডনে জানাল যে মুদ্রা থেকে আলিনগর নামটি মুছে ফেলা হয়েছে। সিরাজের কাছ থেকে বার বার চাওয়া সত্ত্বেও এই পরিবর্তনের অনুমতি মেলেনি।
১৭৫৬ থেকে ১৭৬৩ পর্যন্ত মূলত ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মধ্যে যে সাতবছরের যুদ্ধ চলেছিল তার আঁচ অবশ্যম্ভাবী ভাবেই এসে পড়েছিল ভারতবর্ষে। মিরজাফর নবাব হবার বছর দুয়েকের মধ্যেই ক্লাইভ ব্যস্ত হয়ে উঠলো ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধে। সেই সুযোগে মিরজাফর ডাচ ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে গোপনে দেখা করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ব্যবসার অংশ বৃদ্ধি করা এবং ব্রিটিশ সৈন্যদের তাড়ানোর জন্য সমস্তরকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিল। ২৫শে নভেম্বর ১৭৫৯ চুঁচুড়াতে ব্রিটিশ এবং ডাচ ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। যদিও ডাচ এবং ব্রিটিশদের এই যুদ্ধের কোনও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ছিল না তবুও ডাচেরা মিরজাফরের ভরসায় এই যুদ্ধ শুরু করেছিল। কর্নেল ফ্র্যান্সিস ফোর্ডের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাচদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। এই যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ক্লাইভ মিরজাফরকে সরিয়ে অন্য কাউকে নবাব করবার প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। মিরজাফরের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী মিরানের নাম কেউ কেউ প্রস্তাব করলেও এ ব্যাপারে কোম্পানি এবং ক্লাইভ কেউই সম্মত হলোনা। ঐ বছরেরই ১৭ই আগস্ট যখন মিরজাফরের সঙ্গে ডাচেদের এই গোপন মধুচন্দ্রিমার কথা হেস্টিংসের কানে আসে তখন হেস্টিংস ক্লাইভকে আরও কিছুদিন বাংলায় থেকে যাবার জন্য অনুরোধ করে। ক্লাইভ তখন ইংল্যান্ডে ফিরে যাবার পরিকল্পনা করছিল। ২১শে সেপ্টেম্বর যখন মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারে ক্লাইভ নিশ্চিত হয় তখন লন্ডনে লিখে জানালো,’ মিরজাফরের বোকামি এবং সহজাত বিশ্বাসঘাতকতা আবার শুরু হয়ে গেছে। আমরা তাকে নিরাপত্তা না দিলে অনেক আগেই মিরজাফরকে তার বাবার পাশে সমাধিস্থ হতে হতো। আমি খবর পেয়েছি আজ না হোক কাল ঐ কমবয়সী নির্বোধ সারমেয় তার বাবাকে উৎখাত করবে। আমি অনেকবার মিরজাফরকে বলেছিলাম ঐ কুসন্তানের হাতে বেশি ক্ষমতা দিলে তা তার বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হবে।রাজবল্লভ নিজে নবাব হতে চায় এবং সে যদি মিরজাফরকে তার ছেলের সংসর্গ থেকে দূরে না সরায় তবে তাকেও কোনও ভয়ঙ্কর এবং অস্বাভাবিক পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।‘ চুঁচুড়া যুদ্ধের পর ৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬০ ক্লাইভ কলকাতা ছেড়ে চলে যায়। ক্লাইভ নিশ্চিত ছিল যে এরপর যদি কোনওরকম অসুবিধার সৃষ্টি হয় তাহলে কোম্পানির লোকেরা তা সামলাতে পারবে। এমনকি মোগল যুবরাজ আলি গোহর এবং অদম্য ফরাসি সৈনাধ্যক্ষ ল-এর জোট বেঁধে কোম্পানির বিরুদ্ধে আক্রমণের পরিকল্পনা বিহারের যুদ্ধে আপাতত ভেস্তে দিয়েছে ক্লাইভ।
সৌভাগ্যক্রমে রাজা হবার এই দাবা খেলা থেকে এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় সরে যেতে হলো মিরানকে। কবুতরপ্রেম ছিল এই রক্তপিপাসু নিষ্ঠুর যুবরাজের একমাত্র দুর্বলতা। কোম্পানির দ্বিতীয় পুতুল নবাব হিসাবে যখন তার নাম হাওয়ায় ভাসছে তখনই বিহারের যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁবুতে নিদ্রিত মিরানের জীবনাবসান ঘটে আকস্মিক বজ্রপাতে। সেদিনটা ছিল ৩রা জুলাই ১৭৬০। এই দুর্ঘটনায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ল মিরজাফর এবং তার জামাতা মিরকাশিম ঐ বছরেরই শেষের দিকে মিরজাফরের জায়গায় নবাব নিযুক্ত হলো
ক্লাইভ কলকাতা ছেড়ে যাবার পর ফোর্ট উইলিয়মের গভর্নর পদে নিযুক্ত হন কৃষ্ণগহ্বরখ্যাত হলওয়েল। ১৯৬০ সালের মে মাসে হলওয়েল মিরজাফরের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। হলওয়েল মিরজাফরের কাছে ১ লক্ষ টাকা দাবি করে বলে যে জগতশেঠ তাকে ১০-১৫ লক্ষ টাকা ধার দিতে অস্বীকার করেছে যাতে সে অত্যন্ত বিরক্ত। কিন্তু এক মাঘে শীত যায় না। কোনও না কোনও সময়ে জগতশেঠের ব্রিটিশ নিরাপত্তার প্রয়োজন হবে আর তখন তারা কী করবে সে কথা জগতশেঠের ভেবে দেখা উচিৎ। এছাড়াও হলওয়েল তাকে সিরাজসহ আলিবর্দির পরিবারের অনেক মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী করতে থাকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আলিবর্দির স্ত্রী সার্ফুন্নিসা এবং কন্যা ঘসেটি বেগম। দিনের পর দিন চাপ এমন বৃদ্ধি পেতে থাকলো যে মিরজাফরের পক্ষে গদি আঁকড়ে বসে থাকা সম্ভব ছিলনা। রাই দুর্লভ এবং মিরকাশিমের মধ্যে যে কোনও একজনকে নবাব করতে মনস্থির করল হেস্টিংস। প্রথম প্রস্তাব ছিল রাইদুর্লভ নবাব হবে এবং মিরকাশিম হবে তার সহকারি। কিন্তু বাদ সাধল মিরজাফর। চুক্তি অনুযায়ী দু’পক্ষের সম্মতিক্রমে নবাবের আসনে বসল মিরজাফরের জামাতা মিরকাশিম। মিরকাশিমের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো ২৭শে সেপ্টেম্বর, ১৭৬০। নবাবের আসনে বসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বলা হলো এই আসন দখলের অনুমতিপ্রদানের জন্য কোম্পানির অফিসারদের দু’লক্ষ পাউন্ড অর্থাৎ ১৫লক্ষ টাকা অবিলম্বে প্রদান করতে হবে। এই ফি কেবলমাত্র নবাব হওয়ার জন্য। তারপর শুরু হলো ব্যবসার ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের অনুকূলে পক্ষপাতিত্বের দাবিসহ আরও নানারকমের চাপ। মিরকাশিম এই দাবি মেনে নেওয়ার শর্ত হিসাবে বাংলা থেকে ব্রিটিশ সেনা সরিয়ে নেওয়ার কথা বলার শাস্তি হিসাবে ৭ই জুলাই ,১৭৬৩ তাকে নবাবের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। ঐ দিন মিরজাফরকে পুনরায় নবাবের পদে বসানো হলো। এবার মিরজাফরের কাছে নবাব হবার ফি হিসাবে ২ লক্ষ৩০ হাজার পাউন্ড অর্থাৎ সাড়ে ১৮ লক্ষ টাকা দাবি করা হলো।
এদিকে মিরকাশিম অবধের নবাব সুজাউদ্দৌল্লা এবং মোগলরাজ ২য় শাহ আলমের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে মসনদ দখলের প্রস্তুতি নিতে লাগলো। ২১শে অক্টোবর ১৭৬৪ শুরু হলো বক্সারের যুদ্ধ। ২য় শাহ আলম আগে বিহার এবং বাংলার মসনদে বসার চেষ্টা করেছিল। তখন সে ছিল যুবরাজ আলি গহর। এই ২য় শাহ আলম পরবর্তীকালে মারাঠাদের তাড়া খেয়ে ভাগ্যান্বেষনে পূর্ব ভারতে চলে আসে। অক্টোবরের প্রথমদিকে রাজ্যভার গ্রহণ করার পরেই তাকে সৈন্যসামন্তসমেত রাজধানী ছেড়ে চলে আসতে হয় এবং একরকম অবধের নবাবের আশ্রয়েই থাকতে শুরু করে। বিতাড়িত ২য় শাহ আলম মিরকাশিমের মতই সিদ্ধান্ত নেয় যে বাংলা এবং বিহারের নবাবের উপর আক্রমণই সিংহাসন ফিরে পাবার একমাত্র উপায়। এইসমস্ত নকল নবাবেরা ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হল তাদের নবাব হবার স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে। শুরু হলো বক্সারের যুদ্ধ। এবারের যুদ্ধে অনেক বেশি শৃংখলাবদ্ধ ব্রিটিশ সেনা মেজর হেক্টর মুনরোর নেতৃত্বে কয়েকঘন্টার মধ্যে তাদের এক-চতুর্থাংশ শক্তিসম্পন্ন বিরোধীপক্ষকে ধরাশায়ী করে দিল। বিরোধীদের সাহায্য করতে আসা ল এবং তার ২০০সৈন্য পিছু হটতে বাধ্য হলো। মারাঠা এবং ব্রিটিশদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ২য় শাহ আলম শান্তির জন্য আবেদন জানালো। কোম্পানির আদেশে তাকে লিখে দিতে হলো যে মিরজাফরকেই সে নবাব হিসাবে মেনে নিচ্ছে। বক্সারের যুদ্ধে মোগলসম্রাটের পরাজয় কোম্পানি এবং ব্রিটিশদের প্রভাব প্রতিপত্তি বহুগুন বাড়িয়ে দিল। বলা যেতে পারে বাংলা, বিহার, অবধ এবং গাঙ্গেয় সমতলের অনেকটা অংশ সরাসরি ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল।
বক্সারে শোচনীয় পরাজয়ের পর মিরকাশিম পশ্চিমে পালাতে শুরু করে। পালানোর সময় মিরকাশিম ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। পাটনায় প্রায় দেড়শ’ কোম্পানি কর্মচারিকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে মিরকাশিম। টাকার আশায় মিরকাশিম জগতশেঠ মাধবরাই এবং মহারাজ স্বরূপচাঁদকে পণবন্দি করে রেখেছিল। কিন্তু পালাবার সময় কোনও উপায় না দেখে মিরকাশিম এদের দু’জনকেই হত্যা করে। বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত শাস্তিই তাদের প্রাপ্য ছিল বলে অনেকে মনে করেন। আর মিরকাশিম? ভীত, আতঙ্কিত সুজাউদ্দৌল্লা মিরকাশিমকে কপর্দকশূণ্য অবস্থায় সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে দিল্লিতে গিয়ে কোনওক্রমে কিছুবছর কাটিয়ে হতদরিদ্র অবস্থায় ১৯৭৭ সালে মারা যায় মিরকাশিম। লোকমুখে শোনা যায় সমাধিকালে তার একমাত্র সম্বল ছিল তার গায়ের একটি শতছিন্ন শাল।
মিরজাফরের দ্বিতীয় রাজত্বকাল খুব একটা সুখকর ছিলনা। নারীসঙ্গ, আফিম সেবন এবং ভাঙের নেশা তাকে সম্পূর্ণ শক্তিহীন করে তুলেছিল। মিরজাফরের চেয়ে কুড়ি বছরের বড় আলিবর্দির এই বয়সে যা শক্তি ছিল তার এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশও ছিলনা মিরজাফরের। অপদার্থ মিরজাফর এবং সিরাজ দু’জনেই বাংলার সিংহাসনের কলঙ্ক। শেষ জীবনে ক্লাইভের পোষা কুকুরের মত লজ্জাজনক দাসত্বের জীবন অতিবাহিত করার সময় কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৬৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি মারা যায় মিরজাফর। যে প্রাসাদে মারা যায় মিরজাফর তার পোশাকি নাম জাফরগঞ্জ প্রাসাদ হলেও নিমকহারাম দেউড়ি বলেই সকলে জানে। মারা যাওয়ার আগে একটি উইলে মিরজাফর ক্লাইভের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ৫ লক্ষ টাকা দিয়ে যায়। ক্লাইভকে তার ‘চোখের জ্যোতি’ বলে সম্মানিত করে মিরজাফর।