ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(১৭)
অযথা সময়ের অপচয় করাটা এখন বেশ অসুবিধাজনক। গোলকপতি দ্রুত দুটি হাতের নিগঢ়ে জড়িয়ে ধরে শৈলবালাকে উঠিয়ে বসালো।
যদিও সে মেয়েটির নাম এর আগে সে মোটেই জানত না বা তার জানার কথাও নয় তাও কিছু ঘনায়মান মুহূর্ত বোধহয় এত কিছুর বিচার কখনও করেনা বলেই হয়ত জীবনপ্রবাহ ঠিক বেঁচে যায়।
গোলকপতি খুব সপ্রতিভ স্বভাবের যুবাপুরুষ। মেয়েটির বাজুবন্ধে একটি তামার তাবিজে তার নিজের নাম লেখা ছিল সেটা তার চোখে পড়েছে বলে তার প্রত্যূৎপন্নমতিত্বের উন্মেষটি তাকে জানিয়ে দিয়েছে এই বধুটিকে সম্বোধন করার উপায় ও ভবিতব্যের ঈপ্সিত গৃহযাপনের ইঙ্গিতটিও। তাই সে শেষমেশ স্খলিতচরণা শৈলবালাকে সে জানিয়ে দিয়েছে তার অভিপ্রায়টুকু।
জনহীন প্রান্তরে কোনরকম বলপ্রয়োগের বদলে একজন মধ্যমাকৃতির সুঠাম পুরুষটির মুখে জেগে থাকা মানবতার আলোটি এসে ছুঁয়ে গেছে শৈলবালার নিজের বেঁচে থাকার অমলিন জীবনীস্পৃহাটিকে।
সে নিজেও এখন মনে মনে তৈরী! বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা তথা সতীদাহের আগুনে জ্বলে মৃত্যু হওয়ার বদলে সেও দ্বিধাহীন ভাবে বেছে নিয়েছে পুনর্যাপনের আপাত সমাজদ্রোহটিকেই।
........
নবাবহাট থেকে বেশ ঘন্টাখানেকের পথ একটি মাঝারি মাপের জনপদ আছে অজয়ের তীর ঘেঁষে। সিদিকুল্লা আর রাসেদ আলি নামের দুজন চালের আড়তদার ওর কাছেই ' গলসী 'বলে একটা গ্রামে থাকে। এরা দুজনেই বিষণকুমারীর বিশেষ গুপ্তচর হিসাবে গোলকপতির বেশ বশংবদ। তাই আশা করা যায় যে এই দুর্দিনে ওরা শৈলবালা সহ গোলকপতির আত্মগোপনের কিছুএকটা ব্যবস্থা নিশ্চয় করবে।
......
ঘন্টা তিনেকের বনপথ আর সাধারণ গ্রাম্য প্রান্তর পেরিয়ে ওরা ' মল্লাটি' বলে একটি গ্রামে এসে পৌঁছনোর পর দেখল সামনে কয়েকঘর তাঁতির নিবাস।
গোলকপতির কাছে পথ খরচার জন্য কিছু পয়সা আলাদা করে রাখা আছে বলে সে শৈলবালার সামান্য কটি গহনা একটি পুঁটুলিতে ভরে সরিয়ে রেখেছে। সবাই তার আসল পরিচয়টি জানুক সেটা এখন কিছুতেই কাম্য নয়। তাই সে শৈলবালাকে চুপ করে থাকতে বলেছে যাতে ঘুণাক্ষরেও কেউ কিছু টের না পায়। তার বদলে প্রয়োজনীয় যা কিছু বলার তা গোলকপতি সুযোগ বুঝে নিজেই বলবে।
.......
আপাতত তাদের ছদ্মপরিচয় ধরা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তাই যতদিন এখানে থাকতে হচ্ছে ততদিনের জন্য গোলকপতি হল তার গ্রামসম্পর্কিত দাদা! আর মেয়েটির স্বামী যেহেতু গত বছর বড়শূলের গাজনের মেলায় সন্ন্যাসী হতে গিয়ে নিরুদ্দেশ তাই ওরা গলসীর কাছে তার একটি সন্ধান পেয়ে তাকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে বেরিয়েছে। প্রয়োজনে শয়নের আলাদা ব্যবস্থা করতে হলে সেটাও করতে হবে।
......
গোলকপতি দেখল যে জনপদটির উত্তরপ্রবাহে অজয় ও দক্ষিণ পূর্বে দামোদরের নদীরেখা এঁকেবেঁকে চলে গেছে বলে এই অঞ্চলটি রাঢ়বঙ্গের স্বাভাবিক রুক্ষতা মুক্ত।
তবে এটাও বুঝল যে তাড়াহুড়োয় সে গলসী যাওয়ার পথনির্দেশটি আপাতত হারিয়ে ফেলেছে। তাই দু-একদিন লুকিয়ে থাকার জন্য ওদের এখানেই একটা আস্তানা যোগাড় করে নিতে হবে।
....
গোলকপতি ভাবছিল যে বহু প্রাচীনকালে যখন গঙ্গা-ভাগীরথী আরও পশ্চিম দিকে রাজমহল, সাঁওতালভূমি, ছোটনাগপুর, মানভূম, ধলভূমের তলদেশ দিয়ে সোজা দক্ষিণবাহিনী হয়ে সমুদ্রে পড়ত এবং এই প্রবাহই ছিল অজয়, দামোদর ও রূপনারায়ণের সঙ্গম। এই নদী তিনটি তখন ছিল নাতিদীর্ঘ। এই ভাগীরথী প্রবাহের দক্ষিণতম সীমায় অধুনা তমলুকে ছিল তাম্রলিপ্ত বন্দর।
এর পরবর্তীকালে গঙ্গার ক্রমশ পূর্বদিকে যাত্রা শুরু হলে তাম্রলিপ্ত বন্দর পরিত্যক্ত হয়। আদিগঙ্গা তীরস্থ ছত্রভোগ প্রাচীনকালে প্রসিদ্ধ বাণিজ্য বন্দর ছিল। চীনা পরিব্রাজক হিউ-এন্ সাঙ্ যখন এসেছিলেন ৪র্থ শতকে সেই ভ্রমণকালে তিনি এই ছত্রভোগেও এসেছিলেন।
বড়াশীর কাছে প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান চক্রতীর্থ - আজও এখানে বহু প্রাচীন 'নন্দার মেলা' হয় ও বর্ধমান রাজবাড়ি থেকে কিছুদিন আগেও সেজন্য সিধেও যেত । বলা হয় যে ছত্রভোগের পর গঙ্গা শতমুখী ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল। তাই এখানে এসে ভগীরথ শতমুখী গঙ্গার আসল ধারাকে চিনতে পারেননি। তখন গঙ্গা নাকি তাঁর হস্তস্থিত চক্র দেখিয়ে তাঁর স্থান নির্দেশ করেন। তবে সে সব কাব্য ও কিংবদন্তির কথা সাধারণ লোকজনের মুখে মুখে ফেরে বলে এসবের অনেক রকমফের আছে।
তবে অজয়ের নাম মনে আসলেই 'কেন্দুবিল্ব' বা 'কেঁদুলী'র বলতেই হয় । জনশ্রুতি এখানকার কবিই হলেন সেই গীতগোবিন্দম্ খ্যাত কবি জয়দেব।
গোলকপতির পূর্বপুরুষ মহামহিম লক্ষ্মণসেনের সভাকবি জয়দেবের কথা সে লোকমুখে অনেক আকৈশোর অনেক শুনেছে।
তবে শৈলবালার প্রতি তার একটি নারী ও পুরুষের সহজিয়া সম্পর্কটির সম্পূর্ণতা এখনও আসেনি বলে পুর্ণযৌবনা ও ঘর্মক্লান্ত শৈলবালার অবয়বটি তাকে ঈষৎ উত্তেজিত করলেও তা 'রতিসুখসারে গতম্ অভিসারে'র পদাক্ষরটির কোনও সুযোগ এনে দেয়নি।
তাই ও ঠিক করল সে আসলে একজন বর্ধমান রাজবাড়ির মহাফেজখানার ভান্ডারী এই পরিচয় দিয়ে কোনওভাবে এখানকার এই তাঁতী পরিবারটির কাছে আজকের মত রাত্রিযাপন করাটাই বেশ সুবিধের হবে।
....
ইংরেজ সরকার এখন দেশীয় রাজ্যগুলোর রাজনীতির ওপর আস্তে আস্তে হাত বাড়াতে শুরু করেছে বলে তাদের ভালো মন্দের অনেক বিষয়ে এখন ইংরেজ নাক গলাচ্ছে ও এক একটা আইন বলবৎ হচ্ছে। শহর কলকাতা যে এসবের প্রধান কেন্দ্র তা আজ বলা বাহুল্যমাত্র।
বর্ষাকালের কিছু আগে থেকেই বাংলায় ভেদবমি ও আমাশয় ব্যাপক হারে বাড়তে শুরু করে বলে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া অজানা জ্বরে প্রায়ই মড়ক লাগে বা শহরের নিকাশী ব্যবস্থা ও পরিবেশ সচেতনতার অব্যবস্থার সাথে শহরে একটি ভালো হাসপাতালের অভাবও এসবের জন্য দায়ী।
সতীদাহ নিবারণ সংক্রান্ত ঝামেলা একটু থিতিয়ে আসতেই লর্ড বেন্টিঙ্ক এখানে একটি হাসপাতালের প্রয়োজন অনুভব করছেন। বিলেতের রয়্যাল কলেজ ও মেডিসিন এ বিষয়ে যথোপযুক্ত পাঠক্রম সহ হাসপাতালের জন্য যাবতীয় ভার নিয়ে সাহায্য করবে বলে জানিয়েছে।
এমতাবস্থায় শহরের বিশিষ্টজনদের সাথে এ বিষয়ে একটি জরুরী মিটিং করা আশু প্রয়োজন বলেই বড়লাট বেন্টিঙ্ক লাটভবনের গার্ডেনে রামমোহন সহ আরও কয়েকজন কৃতীমান ভদ্রলোক যেমন রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায়, মতিলাল শীল, দ্বারকানাথ ঠাকুর, ডেভিড হেয়ার এঁদের সবাইকে বৈকালিক জলযোগের আসরে আজ একবার ডেকে পাঠিয়েছেন।