গল্প - গান্ধর্বিকা
Posted in গল্প“তারপর সেই কবর থেকে লিয়াং শানবো আর জু ইংতাইয়ের আত্মারা প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে এল। আর কেউ কখনো তাদের আলাদা করতে পারেনি...”*
ধীরে ধীরে ছেলেটার গলার আওয়াজ মিলিয়ে এল। ভাবুক দুটো চোখ নদীর ঢেউ পেরিয়ে দিগন্তে চলে গেল।
“তোমার বলা সব গল্পের শেষটা এমন দুঃখের কেন হয় গো?”
ঠোঁট ফুলিয়ে মেয়েটা তাকে জিজ্ঞেস করল। ছেলেটা সামান্য হাসল। কি কারণে যেন মাত্র পনের বছর বয়সেই তার মুখখানা বড়দের মতো হয়ে গেছে।
“বোকা মেয়ে! জীবন হয় সুখের হয়, নইলে সেই জীবন নিয়ে গল্প লেখা হয়। কিন্তু দুটো একসঙ্গে হয় না।”
কথাগুলো দু'জনের চারপাশে পাক খেতে খেতে শরতের নীল আকাশে মিশে গেল।
মেয়েটা আবার মন দিয়ে নীল-হলুদ প্রজাপতিদের দেখতে লাগল। ছেলেটা হাতে ধরা তলোয়ারে শান দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
***
প্রজাপতি
ফুলের শহরে সন্ধে নেমে এলে প্রজাপতিরা খেলতে বেরিয়ে পড়ে।
সকালবেলা সে সব রাস্তা দিয়েই হাঁটার সময়ে রাক্ষসদের ঘুমন্ত পুরীর কথা মনে হয়। চোখে পড়ে বাড়িগুলোর রঙ চটে যাওয়া দেওয়াল, কালি পড়া লণ্ঠন, আগের রাতের বাসি ফুল। নাকে আসে অবক্ষয়ের অস্বস্তিকর দুর্গন্ধ।
কিন্তু সূর্য পাটে নেমে যেই তারারা আকাশে উঁকি মারে, পুরো শহরটা যেন ভেল্কিবাজির মতো একেবারে নিজের ভোল পাল্টে ফেলে।
তখন ঘরে ঘরে রঙিন লণ্ঠন জ্বলে ওঠে। তাদের মায়াবী আলোয় প্রজাপতিদের রংচঙে পোশাক কি এক অপার্থিব রূপ পায়। দেওয়াল আর ছাদের বিচ্ছিরি ফাটলগুলো অন্ধকারে ঢেকে যায়, ঘুমন্ত নৈঃশব্দ্য হাসি ঠাট্টায়, গান আর কবিতায় কোথায় উড়ে যায়! ফুল আর আতরের গন্ধে চারিদিক ম ম করে ওঠে। সে শহর তখন দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত অঞ্চল – খ্যাতনাম্নী ওইরানদের* শহর।
ফুলের শহরের বিখ্যাত বাড়িগুলোর মধ্যেও বিখ্যাত হল ইজুমি-চানের বাড়ি। লোকে বলে, যেমন অনবদ্য ইজুমির শিল্পকলা, তেমনি দুর্দান্ত সেই শিল্পকলার দাম। সেটা অবশ্য কোন নতুন কথা নয়। যে কোন প্রজাপতির দলের মধ্যেই এমন একজন থাকে যে রূপে গুণে অন্য সবাইকে ছাপিয়ে যায়। সেরকম ওইরান আগেও অনেক এসেছে, পরেও আসবে। কিন্তু ইজুমির কথাই আলাদা। গান বাজনার বাইরেও ইজুমির কাছে তার গুণগ্রাহীরা এমন কিছু পায় যা অন্য কোন ওইরানের কাছে পাওয়া সম্ভব নয়। সেই 'বিশেষ শিল্পকলার' কথা কম লোকেই জানে, আর যারা জানে তারা পতঙ্গর মতো সেই টানে ছুটে আসে। নিজের শেষ কানাকড়ি দিয়েও সেই চূড়ান্ত আনন্দ তারা উপভোগ করতে চায়, কিন্তু পরে আর মুখ খুলে নিজের অভিজ্ঞতার কথা কাউকে বলে না।
***
অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও ইজুমি আয়নার সামনে বসে নিজের সুন্দর মুখ তুলির টানে আরো সুন্দর করে তুলছিল। ছাত্রী সাকুরা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল।
“একজন গ্রাহক এসেছেন,” গলাটা খাটো করে সে বলল, “তোমার 'বিশেষ শিল্প' অনুভব করতে চান।”
ইজুমির ভুরুতে হালকা তরঙ্গ খেলে গেল।
“আশ্চর্য! সে জিনিসের কদর বোঝার মানুষ আজও আছে বুঝি!”
ঝিনুক বসানো প্রসাধনের বাক্সে আঙুল ডুবিয়ে ইজুমি ঠোঁট রাঙিয়ে নিল। “ঠিক আছে, ওনাকে ফুলের ঘরটায় বসাও। আমি এক্ষুনি আসছি।”
সাকুরা চলে গেলে ইজুমি দু'হাত জোর করে প্রার্থনা সেরে নিল। যদিও এ কাজে তার বহুদিনের অভিজ্ঞতা আছে, গ্রাহকের সঙ্গে হাসিঠাট্টা, গানবাজনা, বিনোদন সবেতেই পটু হয়ে গেছে, কিন্তু 'বিশেষ শিল্পকলার' গ্রাহক এলে ভুলেও ভুল করা চলে না। সবকিছু একেবারে গ্রাহকের মনের মতন হওয়া চাই।
প্রার্থনা শেষ করে এক ঝলক সুগন্ধী হাওয়ার মতো ইজুমি ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
ফুল, লণ্ঠন, রংবেরঙের ছাতা আর দুষ্প্রাপ্য ছবি দিয়ে সাজানো 'ফুলের ঘর'। মেঝেতে ছড়ানো ফুতোন* আর বালিশের মধ্যে বেশ আরাম করেই 'গ্রাহক' বসে আছে। মনে হয় কোন এক চিন্তায় মগ্ন। বছর চল্লিশেক বয়স, চোখের নীচে গভীর কালি, ভাঙা তোবড়ানো গালে কাঁচাপাকা দাড়ি...
ইজুমি দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। মুখের রঙ বিবর্ণ হয়ে গেলেও তা সাদা প্রসাধনের নীচে বোঝার উপায় রইল না। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল – যেন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। তারপর সাবলীল পায়ে ঘরের ভেতর ঢুকে এল।
লোকটা ইজুমির দিকে তাকাল।
“যাক, অবশেষে ফুলের শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত ওইরানের দেখা পেলাম।” আপন মনেই হাসতে থাকে সে। “দেখতে গেলে ঠিকই আছে...”
ইজুমি লোকটাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। দরজার দিকে তাকাতে, একজন কর্মচারী গোপন সংকেতে জানাল যে হ্যাঁ, টাকা পুরো দেওয়া আছে। ইজুমি দরজা বন্ধ করে মেঝেতে হাঁটু গেঁড়ে বসল।
“মহাশয়ের কি ইচ্ছা?” মায়াবী হেসে ইজুমি সামনে বসা গ্রাহককে জিজ্ঞেস করল। “কোতো* বাজিয়ে শোনাই? নাকি গান শোনাব? নাকি আগে একটু চা বানিয়ে দেব?”
“চুপচাপ আমার পাশে বসে থাক, ছোট্ট চড়াই পাখি।”
ইজুমি চমকে উঠল।
কুড়ি বছর পার হয়ে গেছে...নাকি এক অন্য জন্মের কথা? শেষ কবে এই ডাকটা শুনেছে?
“ইজুমি? সারাক্ষণ বকবক করেই চলেছ, তোমার নাম সুজুমে – চড়াই পাখি!”
ঝাপসা হয়ে যাওয়া অতীতের এক টুকরো স্মৃতি। ইজুমি জোর করে মুখ থেকে দুঃখের অভিব্যক্তি মুছে ফেলল। তাহলে কি প্রসাধনের তলায় আজও তার নিজের মুখটা কোথাও বেঁচে আছে?
“তুমি জানতে আমি কে?” রুদ্ধশ্বাসে আগন্তুককে প্রশ্ন করল ইজুমি।
“তুমি ওই দরজা দিয়ে ঢোকার আগে অবধি আমি একেবারেই জানতাম না তুমি কে।”
ইজুমি ইতস্তত করে।
“কাজুকি, তোমাকে আমি টাকা ফেরত দিয়ে দিচ্ছি। এখানে তোমাকে থাকতে হবে না। টাকাটা নিয়ে চলে যাও।”
নির্মেঘ শরতের আকাশের মতো চোখে কি যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল।
“তার আগে একটা কথার জবাব দাও তো, ছোট্ট চড়াই পাখি। আমি কে, সে কথা বুঝেও কি তুমি ওই দরজাটা দিয়ে ঢুকে এসেছিলে?”
ইজুমি দরজাটার দিকে অসহায় ভাবে তাকাল। রীতিমতো তালিম দিয়ে তাকে ছলাকলা রপ্ত করানো হয়েছে। কিন্তু আয়নার মতো চোখের কাজুকির সঙ্গে সে ছলনা করতে শেখেনি।
“কথার উত্তর দাও, ছোট্ট চড়াই পাখি।”
তার গলার স্বর রুক্ষ নয়, কিন্তু দৃঢ়। ইজুমি জানে, তাকে উত্তরটা দিতেই হবে। ধীরে ধীরে সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
“বেশ। সে ক্ষেত্রে আমি টাকা ফেরত নেব না।”
ইজুমি লোকটির দিকে কাতরভাবে তাকাল।
“আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ভুলে গেছ...”
কাজুকির হাসিতে ভর্ৎসনার লেশমাত্র নেই।
“কোন ব্যাখ্যা দিতে হবে না। আমার ছোট্ট চড়াই পাখি আমাকে তার 'বিশেষ কলা'র নিদর্শন দেখাতে চায়। এটাই যথেষ্ট।”
খুব ধীরে ধীরে বলা কয়েকটা মাত্র কথার মাধ্যমে কাজুকি ইজুমির বুকে শেল বিঁধিয়ে দিল।
“যাক গে, কি যেন করবে বলেছিলে? কোতো বাজাতে চেয়েছিলে না? সেটাই বাজাও।”
ইজুমি যন্ত্রটার দিকে তাকাল। সাধারণত, কঠিন কঠিন সুর বাজিয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ কররে সে গর্বই অনুভব করে, কিন্তু আজ যেন সূক্ষ্ম তারগুলো তার বরফের চেয়েও ঠান্ডা আঙুলকে শাস্তি দেবে বলে তৈরি হয়েছে।
“কি হল? বাজাবে না?”
ইজুমির ঠোঁট আর নড়ে না। কোনরকমে সে ঘাড় নাড়ল।
আজ্ঞাবহ দুই হাত যন্ত্রটা তুলে নিল। ইজুমির গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ভাগ্যিস কাজুকি তাকে গান গাইতে বলে নি!
“এরকম জায়গায় কি করে এসে পড়লে তুমি?” কাজুকি সহজভাবে প্রশ্ন করল।
চোখের আড়ালে থাকা জগৎটা হাতড়ে ইজুমি উত্তর খুঁজে আনার চেষ্টা করে। জীবনটা সোজা রেখা, না শব্দ আর রঙ দিয়ে বোনা মাকড়সার জাল, তা বুঝে উঠতে পারে না। এর শুরুই বা কোথায় আর শেষই বা কি?
“তুমি চলে যাওয়ার পর আমাদের গ্রামে সাংঘাতিক ভূমিকম্প হয়েছিল,” ভয়াবহ স্মৃতি মনে করে ইজুমি আবার শিউরে উঠল। “আমার কপাল খারাপ, নদীতে জল আনতে গেছিলাম তাই প্রাণটা বেঁচে গেল। ফিরে এসে দেখি গ্রামের প্রায় কিছুই বাকি নেই। আমাদের বাড়িটা ভেঙে পড়েছে, মা বাবা ওর নীচেই চাপা পড়ে আছে। তোমাদের বাড়িরও কিছু অবশিষ্ট নেই। অর্ধেকের বেশী মানুষের খবর নেই...”
ইজুমির ঠাণ্ডা নিঃশ্বাস কাজুকির বুক ছুঁয়ে যায়।
“যারা বেঁচে ছিল, তারা মিলে ঠিক করল আমাকে পাশের গ্রামে মাসীর বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। আমি বারবার বললাম, কাজুকি বলেছে আমার জন্য ফিরে আসবে, আমাকে এখানেই থাকতে দাও! কিন্তু কেউ আমার দায়িত্ব নিতে রাজি হল না। সবাই মিলে আমাকে মাসীর বাড়িতে রেখে এল।”
ইজুমির অজান্তেই তার হাত থেমে গেছে। ঘরের ছাদ থেকে নৈঃশব্দের ফোঁটারা নেমে এসে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
কাজুকি যদি ফিরেও আসে, আমরা তোর বিয়ে দেব কি দিয়ে? তোর মা পণের জিনিস যা যোগাড় করেছিল সব তো তোদের বাড়ির নীচে চাপা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা কি নিজেদের ঘর থেকে দেব নাকি? বরং তুই মাসীর বাড়ি গিয়ে থাক, মাসীই তোর বিয়ের ব্যবস্থা করবে।
“আমাকে খাওয়ানো পরানোর কোন ইচ্ছেই মাসীর ছিল না। কিন্তু অতগুলো লোকের মুখের সামনে 'না' বলারও বিপদ ছিল। তাই তখনকার মতো আমাকে থাকতে দিতে বাধ্য হল।”
মাসী ঠিক করল বাড়ির সব কাজ ইজুমিকে দিয়েই করাবে। বদলে আধপেটা খেতে দিত, আর কাজ পছন্দ না হলেই কি মার! তবুও ইজুমি কাজুকির পথ চেয়ে সেখানেই পড়েছিল। তারপর একদিন তার মেসো দুটো লোককে সঙ্গে নিয়ে এল। মাসীর সঙ্গে কিসব কথা হল, তারপর লোক দুটো টাকা দিয়ে ইজুমিকে কিনে নিয়ে গেল।
“আমি মাসীকে বললাম, আমাকে আর ক'টা দিন থাকতে দাও। বললাম, তোমাদের যা খরচ হচ্ছে কাজুকি এসে পুষিয়ে দেবে। কিন্তু ওরা কোন কথা বিশ্বাস করল না। বলল, তুমি আমার খোঁজ করতে এলে ওরা আমার বেশ্যাবাড়ির ঠিকানা দিয়ে দেবে।” ইজুমির মনের যন্ত্রণা শূন্য চোখের কোটর দিয়ে বেরিয়ে এসে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। “এই জেলের মধ্যে থেকেও আমি তোমার পথ চেয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম একদিন তুমি এসে আমাকে মুক্ত করবে। তুমি প্রতিজ্ঞা করেছিলে, যাই হোক তুমি আমার কাছে ফিরে আসবেই। কিন্তু তুমি আর কোনদিন এলে না।”
সামনে রাখা মদের পাত্র তুলে নিয়ে কাজুকি চুমুক দিল। এত ভালো মদ দেশের সম্রাট ছাড়া আর কারুর খাওয়ার অনুমতি নেই। সাধারণ মানুষের তো নয়ই। কিন্তু ফুলের শহরের, বিশেষ করে ইজুমির বাড়ির সবকিছুই আলাদা, অসাধারণ। সে বাড়িতে এসে যা কিছু উপভোগ করা হয় সবই একমেবাদ্বিতীয়ম। ইজুমি সমেত।
“তা...” ইজুমি কাজুকির দিকে তাকাল, “এত বছর তুমি করলেটা কি?”
কাজুকি পাত্রটা নামিয়ে রাখল।
“তুমি তো জান, আমি গ্রাম ছেড়ে দাইমিওর* সেনায় যোগ দিতে গেছিলাম। ভেবেছিলাম, টাকাকড়ি জমিয়ে তোমার জন্য একটা বাড়ি বানাব। কিন্তু জুয়া খেলে সব টাকা উড়িয়ে উলটে দেনায় পড়ে গেলাম। তারপর থেকে পাওনাদারদের ধার শোধ করার জন্য এই জমিদারের সেনায় ওই জমিদারের সেনায় ঘুরে ঘুরে কাজ জোগাড় করতে লাগলাম। অদ্ভুত কথা জান, যখন যুদ্ধ করতে বেরিয়েছিলাম তখন আমার মাথায় শুধুই বীরত্ব, সম্মান, এই সব বড় বড় কথা ঘুরত। কিন্তু যতদিন যুদ্ধ করেছি শুধু অন্যায় আর ভয়াবহতা ছাড়া কিছু দেখিনি। আমার জীবনে যা কিছু সরল ছিল, নিষ্পাপ ছিল, সব আমার ওই গ্রামেই পড়ে রইল।”
তখন তো আর জানতাম না, সেই সারল্য আবার খুঁজে পাব ফুলের শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত বেশ্যালয়ে...
“আমাদের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে, চড়াই পাখি?”
ইজুমি মাথা নাড়ে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখনো সেই দিনগুলো সাতরঙা রামধনু হয়ে দিগন্তে ভেসে ওঠে।
“মায়ের আদর মনে পড়ে, বাবার গলার আওয়াজ, ভাইয়ের সঙ্গে উঠোনে খেলা করা, তোমার মামাবাড়ি...”
“তোমার বাড়ির ঠিক পাশেই।”
সাত বছরের কাজুকি একদিন মায়ের সঙ্গে মামাবাড়িতে থাকতে এসেছিল। তার বাবা ছিলেন কাজুকির মতোই সৈনিক। কিন্তু অল্পবয়সেই বিশাল জুয়ার দেনা, আর কাজুকির জন্যে একটা তলোয়ার রেখে স্বর্গে চলে যান।
“বাবার তলোয়ারখানা এখনো সঙ্গে নিয়ে ঘুরছ বুঝি?”
কাজুকির চোখ কপালে উঠে গেল।
“ওই সস্তার জিনিস? কবে ভেঙে দু'টুকরো হয়ে গেছে!”
“তাই?”
ইজুমি ফুতোনের ঢাকাটা নখ দিয়ে খুঁটতে লাগল। চোট পেলে মামড়ি খোঁটার পুরনো বদ অভ্যাসটা কখন যেন ফিরে এসেছে। ক্ষতর মামড়ি টানলে যন্ত্রণা হয় বটে, তবু কিছু অনুভূতি তো হয়। সব অনুভূতিগুলো মরে যাওয়ার থেকে বোধহয় সেটাও বেশী ভালো।
চোখের আড়ালে ছোট ছোট দৃশ্য ভেসে ওঠে – বাবার সঙ্গে বাজারে যাওয়ার পথে কাজুকির সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়া, বাড়ির কাজ করার সময় কাজুকির মুখ থেকে চীনের গল্প শোনা, নদীর ধারে পাশাপাশি বসে গল্প করা...
“সেই সময় তুমি বলেছিলে তুমি শুধু আমারই জন্যে বেঁচে থাকবে। সত্যি করে বল তো, আজও কি তুমি একই কথা বলতে পারবে?”
কাজুকি শুধুই হাসে। উত্তর দেয় না। ইজুমি মুখ ফিরিয়ে নিল।
“তোমার জন্যে আমি গ্রামে ফিরে এসেছিলাম, চড়াই পাখি।” বসন্তের বৃষ্টির চেয়েও হালকা গলায় কাজুকি বলল। “দেনার জন্যে কয়েক বছর দেরি হয়ে গেছিল। ফিরলাম যখন, গ্রামের সবাই বলল তুমি মাসীর বাড়িতে আছ। সেখানে গেলাম। তোমার মাসী বললেন চোদ্দ বছর বয়সেই তুমি জ্বরে ভুগে মারা গেছ।”
এক ঝলক আলো হঠাৎ করে ইজুমির চোখ ধাঁধিয়ে দিল। বিদ্যুৎ চমকাল, নাকি কেউ বাজি ফাটাল?
“সবই নিয়তি...”
সেই কবে থেকে ইজুমি কাজুকির পথ চেয়ে বসে আছে। দিনের পর দিন ওই একটা আশার প্রদীপ জ্বেলে নিজের জীবনের সব অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করে গেছে। শেষে আজ কাজুকি তার দরজায় এসে দাঁড়াল বটে, কিন্ত রক্ষক নয়, গ্রাহকের বেশে।
সেটাও নিয়তি...
কাজুকি বলেছিল, মানুষের জীবন হয় সুখের হয়, নয় তা নিয়ে গল্প লেখা হয়। কিন্তু ছোট্ট বেলা থেকে ইজুমি শুধুই সুখী হতে চেয়েছিল – প্রাণপণে, নিজের সর্বস্ব দিয়ে। অথচ জীবন রোজ তার কানে গল্পকথা শুনিয়ে যায়।
ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত ইজুমি মৃদু হাসে। তারপর অস্ত্র নামিয়ে রাখে।
“তোমার মৃত্যুর কথা শোনার পর আমার টাকা জমানোর সব উৎসাহ চলে গেল।” কাজুকি মদের পাত্র তুলে নিল, তারপর একটু ইতস্তত করে আবার রেখে দিল। “কিছুদিন যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ালাম। শুঁড়িখানায় রাত কাটাতাম, অচেনা লোকজনের সঙ্গে জুয়া খেলে সন্ধেগুলো কাটাতাম। মাঝখানে একদল অভিনেতাদের সঙ্গে শহরে শহরে ঘুরে বেরিয়েছি। সেই সূত্রে এক বিধবার সঙ্গে দেখা হয়। স্বামী যুদ্ধে মারা গেছে, একা একটা শুঁড়িখানা চালায়। ওকে দেখে জানি না কেন আমার তোমার কথা মনে পড়ে গেল।”
ইজুমি গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইল।
“আমি ভাবলাম, ওই মেয়েটাকে যদি আমি বিয়ে করি, তাহলে তোমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে।” কর্কশভাবে হেসে উঠল কাজুকি। “বিয়ের এক বছর পরে জানতে পারলাম সে যা যা বলেছিল সব মিথ্যে। সে বিধবা নয়, বেশ্যা। যতদিনে সে কথা জানলাম, সে তার মারণ রোগ আমাকে দিয়ে স্বর্গে চলে গেছে।”
ইজুমি চমকে কাজুকির মুখের দিকে তাকাল। তোবড়ানো গাল, কোটরে ঢোকা চোখ, ফ্যাকাশে ঠোঁট...
মুমূর্ষু মানুষের মুখ।
“তোমার জন্যে বেঁচে থাকব এ কথাটা সত্যিই আর বলতে পারব না, চড়াই পাখি। বেঁচে থাকার মতো কোন জীবন আর আমার বাকি নেই।”
“এক্ষুনি তোমার টাকা নিয়ে এখান থেকে চলে যাও,” ইজুমি ব্যাকুলভাবে কাজুকির জামার হাতা টেনে ধরল। “আমার কাছে যখন আসতে পেরেছ তোমার জমা পুঁজি কম নয়। আমি নিজের কিছু টাকাও দিয়ে দিচ্ছি। একজন ভালো ডাক্তার দেখিয়ে নিজের চিকিৎসা করাও!”
কাজুকি কোলবালিশের ওপর হেলান দিয়ে বসে হাসতে থাকে।
“প্রজাপতি প্রেমিকদের গল্পটা মনে আছে?”
“শোন, তুমি লিয়াং শানবোর মতো পণ্ডিতও নও, আর আমার জু ইংতাইয়ের মতো বিয়েও হতে যাচ্ছে না। এসব গল্পের দুনিয়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দাও!”
“অনেক দেরি হয়ে গেছে। লিয়াং শানবো যতদিনে জু ইংতাইকে খুঁজে পেয়েছিল, তাদের আর বিয়ে হওয়া সম্ভব হয় নি। তাই তাকে ভাঙা হৃদয়ের যন্ত্রণা নিয়েই মরে যেতে হয়েছিল।” ইজুমির চুলের সোনার কাঁটাটা হালকা করে ছুঁল কাজুকি। “কিন্তু তুমি চিন্তা কর না। তোমাকে আমি আমার সঙ্গে কবরে নিয়ে যাব না।”
ইজুমি সজোরে মাথা নেড়ে উঠল।
“এটা পাগলামি! তোমার চিকিৎসা দরকার, এইসব না!”
“ঠিক আছে,” কাজুকির ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি খেলা করে, “তুমি যদি তাই চাও আমি চলে যাব। আর কোনদিন তোমাকে আমার মুখও দেখাব না। কিন্তু যাওয়ার আগে তোমার ঠোঁটের স্পর্শ নিয়ে যেতে চাই। এটুকু দেবে তো, চড়াই পাখি?”
ইজুমি নিমেষে পাথর হয়ে গেল। কাজুকি তাকে দু'হাতে জড়িয়ে নিল। ইজুমির মনে হল ঠেলে সরিয়ে দেয়, কিন্তু কি এক অমোঘ আকর্ষণে কাজুকির কাছে এগিয়ে যেতে থাকল। কাজুকির হাতের বেষ্টনীর ভেতরের জগৎটাই ইজুমির নিজস্ব জগৎ হওয়ার কথা ছিল। ফুলের শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত ওইরান নয়, এক সামান্য সৈনিকের স্ত্রীর জীবন - সেটাই তার পাওনা ছিল। শরতের আকাশের মতো পরিষ্কার ওই চোখে ইজুমি দেখতে পায় ওদের নিজস্ব বাড়িটা, সে বাড়ির বাগানে ওদের বাচ্চারা খেলছে, ইজুমি দড়িতে কাপড় মেলছে, কাজুকি বাজার করে ফিরছে...চিরকাল তো এসব স্বপ্ন স্বপ্নই ছিল, আলেয়ার মতো ধরা ছোঁয়ার বাইরে, শুধুই চোরাবালির মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে ইজুমির নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিত। কিন্তু কাজুকির দু'হাতের মধ্যে সেই সব স্বপ্ন সত্যি, সব সম্ভব, হাতের নাগালের মধ্যে।
ক্লান্ত ইজুমি নিজেকে কাজুকির কাছে সমর্পণ করে দেয়। নিজের দুর্বলতা দেখে নিজের প্রতি ঘৃণা হয়।
কাজুকির ঠোঁট ইজুমির অধর ঢেকে দিল। তৃষ্ণার্ত দুটো ঠোঁট আকুল আগ্রহে ইজুমির ঠোঁট রাঙানো লাল টুকটুকে করাল বিষ চুষে নিল। এই তো ইজুমির সেই 'বিশেষ পরিসেবা'। দূরদূরান্ত থেকে লোকে এর জন্যেই ছুটে আসে – মুমূর্ষুরা, অনর্গল যুদ্ধ-বিগ্রহে ক্লান্ত যোদ্ধারা, জীবনের প্রতি নিরাসক্ত পুরষেরা - ইজুমির 'ফুলের ঘরে' এসে শেষবারের মতো অস্ত্র নামিয়ে রাখে। এক রাতের জন্য ইজুমি তাদের সব ইচ্ছে পূরণ করে। সম্রাটের উপভোগের যোগ্য খাবার আর মদ, স্বর্গের সভার যোগ্য গান বাজনা, গ্রীষ্মের বাগানের মতো মনোরম ফুলের গন্ধ এবং – শরীরী আনন্দের তুঙ্গ মুহূর্তে – এক বেদনাহীন, আরামদায়ক মৃত্যু। অন্য বারাঙ্গনাদের ক্ষমতার বাইরে এক অনন্য অভিজ্ঞতা, সারা জীবনের পুঁজি খরচ করেও যা অনুভব করার লোভে মানুষ দূরদেশ থেকে ছুটে আসে...
ধীরে ধীরে কাজুকির হাত শ্লথ হয়ে আসে। ওর মাথাটা নুইয়ে পড়ে। ইজুমি জানে, এই ঘুম থেকে কাজুকি আর কোনদিনও উঠবে না। সে আরো দৃঢ়ভাবে কাজুকিকে জড়িয়ে ধরল, কাজুকির শরীর থেকে পালিয়ে যাওয়া উষ্ণতাটুকু ধরে রাখার জন্য নিজের শরীরের সবটুকু ঢেলে দিল।
কাজুকিকে দুই হাতে ধরে রাত কাটিয়ে দিল ইজুমি।
সবে যখন ভোরের আলো ফুটছে, তখন ইজুমি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। ওটাই ওর গোপন সংকেত। সেই সংকেত পেলে ওর কর্মচারীরা ঘরে ঢুকে কাজুকির মৃতদেহের ব্যবস্থা করবে।
শিশিরে ভেজা ঠান্ডা ঘাসের ওপর ইজুমি জুতো খুলে পা ডুবিয়ে দিল। হালকা হতে শুরু করা বিষন্ন পুবের আকাশের নীচে নীল-হলুদ প্রজাপতিরা ফুলে ফুলে উড়ে বেরাচ্ছে। দিনের এই সময়টায় ওদের ওড়ার কথা নয়, কিন্তু ইজুমি লক্ষ্য করে দেখেছে, ওরা সব সময়ে ওর চারপাশে ঘুরে বেরায়।
হয়তো শেষ অবধি কাজুকির কবর অবধিই পৌঁছে দেবে তাকে।
* প্রজাপতি প্রেমিক – চীনের একটা প্রচলিত লোককথা
* ওইরান – জাপানের উচ্চ শ্রেণির বারাঙ্গনা। গান, বাজনা আর অন্যান্য শিল্পকলা প্রদর্শনীর জন্য বিখ্যাত।
* ফুতোন – মাটিতে পেতে শোয়ার গদি
* কোতো – তেরোটা তারবিশিষ্ট জাপানি বাদ্যযন্ত্র
* দাইমিও – জাপানি জমিদার গোছের অভিজাত পুরুষ