ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক১০
‘আপনি কেন রয়ে গেলেন?’ স্মিৎজ প্রশ্ন করেন শ্নাইডারকে। তবে কোনো উত্তরের প্রত্যাশা করেন না তিনি। শ্নাইডার উত্তরও দেয়না। দুজনে কান পেতে শোনে ট্রাক স্টার্ট দেওয়ার শব্দটা। শব্দটা আঙিনা থেকে বেরিয়ে পথে যেতে যেতে ফিকে হতে থাকে। রেললাইন পেরিয়ে যে পথটা গেছে, সেই পথে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রাকটা। পরিষ্কার শোনা যায় শব্দটা। অবশেষে একসময় শব্দটা মিলিয়ে যায়।
ট্যাঙ্কের চলবার আওয়াজ বন্ধ এখন। তবে গোলাগুলির শব্দ আসছে।
‘খুব জোর লড়াই’… বলে উঠলেন স্মিৎজ… ‘বাঁধের উপরে উঠলে দেখা যেত ব্যাপারটা।’
-‘আমি যাবো’ বলে উঠল শ্নাইডার।
ঘরের মধ্যে ক্যাপ্টেন বলে উঠলেন- ‘বেলজোগার্স’। কোনো একটা যে বিশেষ সুর আছে কথাটায়, এমন নয়। অথচ মনে হচ্ছে এই কথাটা বলে ক্যাপ্টেন খুব আনন্দ পাচ্ছেন। ক্যাপ্টেনের গায়ের রং ময়লা, ভারিক্কি কালো দাড়িভর্তি মুখ, মাথা সম্পূর্ণ ব্যান্ডেজ করা।
‘আশা আছে কি?’ শ্নাইডার তাকায় স্মিৎজের দিকে… ‘যদি বেঁচে যায়… ভালভাবে সেরে ওঠে…’ সে কাঁধ ঝাঁকায়।
-‘বেলজোগার্স’ বলে উঠলেন ক্যাপ্টেন। তারপর কাঁদতে শুরু করলেন। নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন তিনি। কান্নার মাঝে মাঝেও তিনি ফাঁকে ফাঁকে বলে যেতে লাগলেন … ‘বেলজোগার্স…’
‘ওঁর বিরুদ্ধে একটা কেস জারি আছে এখনও। কোর্ট মার্শাল হয়েছে ওঁর’… স্মিৎজ বলে ওঠেন… ‘মোটরসাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত লেগেছিল। মাথায় স্টিলের হেলমেট ছিল না। উনি ক্যপটেন ছিলেন।’
‘আমি বাঁধের উপরে যাই একবার’… বলে ওঠে শ্নাইডার… ‘যদি কিছু দেখা যায়। যদি কোনো দল ফিরে আসে… দেখা যাক… তাহলে ওদের সঙ্গে যোগ দেওয়া যাবে’…
স্মিৎজ মাথা নাড়েন। ‘বেলজোগার্স’… বলেন ক্যাপ্টেন।
আঙিনায় এসে শ্নাইডার দেখতে পায় যে বড়সাহেবের বাংলোর ছাদ থেকে কেয়ারটেকার একটা পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। হতশ্রী একটা লাল কাপড়ের ঝাণ্ডা, কেটেকুটে একটা হলদে কাস্তে আর সাদা হাতুড়ি কোনোমতে সুতোর ফোঁড় দিয়ে সেলাই করে আঁকা সেই কাপড়ে। দক্ষিণ-পূব দিক থেকে মৌমাছির গুঞ্জনের মত ট্যাঙ্কের আওয়াজটা ভেসে আসছে। গোলাগুলির কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না এখন। সে পেছনের বাগানে পড়ে থাকা হাসপাতালের খাটগুলো পাশ কাটিয়ে জঞ্জাল ফেলবার স্তুপের পাশের পুকুরের সামনে থমকে দাঁড়ালো। একটা পুরনো বোমার টুকরো পড়ে আছে। টুকরোটা বেশ কয়েকমাস ধরে ওখানেই পড়ে আছে। বেশ কয়েকমাস আগে নাৎসিবাহিনীর সঙ্গে হাঙ্গেরিয়ান অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে একটা যুদ্ধ হয়েছিল। অবশ্য সেটা একটা ছোটখাট লড়াই ছিল। বোমাবাজির কোনো চিহ্ন এখানে বোঝা যায় না এমনিতে। শুধু এই একখানা টুকরো পড়ে আছে। এক হাত লম্বা, মরচে ধরা লোহার একটা ভাঙা ধাতব অংশ। এমনিতে চট করে নজরে পড়ে না। লম্বা ঘাসের মধ্যে হঠাৎ দেখলে মনে হবে একটা গাছের ডালের শুকনো টুকরো। বড়সাহেবের স্ত্রী বহুবার এই টুকরোটা নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন। তার অভিযোগ গৃহীত হয়েছে প্রতিবার, যদিও কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি।
শ্নাইডার বোমার টুকরোটার পাশ দিয়ে বেশ ধীরগতিতে যেতে লাগলো। ঘাসের উপরে ওটেন এবং ফাইনহালসের পায়ের ছাপ লক্ষ্য করলো সে। ওরা পুকুরে মেশিনগানগুলো ফেলতে এসেছিল। তবে পুকুরের উপরিভাগের ময়লা পানা আগের মতই জমাট বেঁধে সবুজ হয়ে আছে। কিছু বোঝা যাচ্ছে না। শ্নাইডার আবার খাটগুলোকে পাশ কাটিয়ে, গাছের নার্সারি পেছনে ফেলে ফাঁকা জায়গাটার মধ্য দিয়ে বাঁধের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। সাড়ে পাঁচ ফুট উঁচু বাঁধটার উপরে উঠে সে অনেকটা দূর দেখতে পেলো। গ্রাম ছাড়িয়ে, রেললাইন ছাড়িয়ে ডাইনে বাঁয়ে অনেকদূর দেখতে পাচ্ছে সে। কিন্তু ট্যাঙ্কের কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে না সে। তবে শুনতে পাচ্ছে। আগের চেয়ে অনেক পরিষ্কার আওয়াজ। রেলরাস্তার দিক থেকেই আসছে আওয়াজটা। শ্নাইডার বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। বাঁধের ডানদিকে দূরে গ্রামটা একদম চুপচাপ, থমথমে। মনে হচ্ছে গ্রামের বাড়িঘর, গাছপালা, চৌকোনা গির্জার স্তম্ভ, সবকিছু নিয়ে যেন গ্রামটা হঠাৎ মরে গেছে। বাঁধের বামদিকে কোনো বাড়িঘর নেই। শ্নাইডার বাঁধের উপরে বসে একটা সিগারেট ধরালো।
ঘরের মধ্যে যে লোকটা ক্রমাগত ‘বেলজোগার্স’ বলে যাচ্ছে, স্মিৎজ তার পাশেই বসে থাকেন।
বারে বারে বলছে লোকটা এক কথা। লোকটার চোখের জল এখন শুকিয়ে গেছে। লোকটা সোজা সামনের দিকে চেয়ে আছে তার কালো চোখগুলো মেলে আর বলে উঠছে ‘বেলজোগার্স’। লোকটার কথাগুলো স্মিৎজের কাছে একটা গানের সুরের মত সুন্দর বলে মনে হচ্ছে। যদিও অজস্র, অগুন্তিবার তিনি এই লোকটার মুখে এই শব্দটা শুনে ফেলেছেন। আরেকজন রুগি ঘুমিয়ে আছে।
যে লোকটা ‘বেলজোগার্স’ বলে যাচ্ছে ক্রমাগত, সে লোকটার নাম বাউয়ার। লোকটা টেক্সটাইল সেলসম্যান, মানে পোশাকের ফেরিওয়ালা আর কি! এই কাজের পাশাপাশি লোকটা পড়াশুনা চালিয়ে যাবে ভেবেছিল। ভর্তি হয়েছিল ফার্স্ট ইয়ারে। তবে ছাত্র হয়ে উঠবার আগে লোকটা পাক্কা চার বছর যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট হিসেবে কাজ করেছে। তার পরে টেক্সটাইল সেলসম্যান হয়েছে। সোজা ব্যাপার নয় সবটা। মানুষের হাতে পয়সা থাকা না থাকার উপরে নির্ভর করছে সবকিছু। সে যে সোয়েটারগুলো বিক্রি করতো, সেইসব সোয়েটারের ক্রেতাদের হাতে পয়সা থাকার উপরেও ব্যাপারটা নির্ভরশীল। খুব দামি সোয়েটারগুলো সবসময় বিক্রি হয়ে যায়। একবারে কমদামি যেগুলো, সেগুলোও পড়ে থাকে না। কিন্তু সমস্যা হয় মাঝারিমানের সোয়েটারগুলো নিয়ে। সে তো সেগুলোই বিক্রি করতো। ওইধরণের সোয়েটার খুব কম বিক্রি হত। সস্তা কমদামি জিনিস কিম্বা ভীষণ দামি জিনিস- কোনোটারই বিকল্প সে খুঁজে পায়নি। সহজে বিক্রি করা যায় না, এমন মাঝারিমানের সোয়েটারের ফেরিওয়ালা হয়ে কাটিয়েছে সে পনেরো বছর। প্রথম বারো বছর সে বিরক্তিকর, অসহনীয়, অনিশ্চিত, ঘ্যানঘেনে, ভয়ঙ্কর জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছে। দোকানে দোকানে ঘুরে, বাড়ি বাড়ি ঘুরে সে সোয়েটার ফিরি করেছে। কঠিন জীবন। তার স্ত্রী কেমন যেন বুড়িয়ে যাচ্ছিল। প্রথম যখন তার স্ত্রীর সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল, সেই সুন্দরী যুবতীর ছিল মাত্র তেইশ বছর বয়স, আর তার নিজের বয়স তখন ছাব্বিশ। তখনও সে ছাত্র ছিল। সে ওয়াইন খেতে ভালবাসতো। তার স্ত্রী তন্বী, ব্লন্ড সুন্দরী, সে একেবারেই সহ্য করতে পারতো না ওয়াইনের গন্ধ। কিন্তু এ বিষয়ে তার স্ত্রী তাকে কোনোদিন কটু কথা বলেনি। শান্ত সহনশীল এক মানুষ, কিচ্ছুটি অভিযোগ করেনি যখন সে পড়াশুনা বন্ধ করে পথে পথে সোয়েটার ফিরি করে ঘুরছিল। সে আশ্চর্য হয়ে ভাবে যে ব্যাপারটা কতখানি কঠিন ছিল! বারো বছর ধরে সোয়েটার বিক্রি করে যাওয়া! এবং এই সম্পূর্ণ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাড়া করে যাওয়া ব্যাপারটার সঙ্গে তার স্ত্রী কী ভাবে মানিয়ে নিয়েছিল। পরের তিন বছর একটু একটু করে ব্যাপারটা বদলে যাচ্ছিল। একদম পনেরো বছরের মাথায় সবকিছু বদলে গেল। খুব দামি এবং খুব সস্তা সোয়েটারের বিকল্প খুঁজে পেয়েছিল সে। দারুণ ব্যবসা চলছিল। সে কোথাও দৌড়ে বেড়ায় না আগের মত। এখন সবাই তাকে খুঁজে বেড়ায়। সে ঘরেই অফিস করে নিয়েছে। ফোনে কথা বলে, কাগজপত্র সইসাবুদ করে। স্টোর ম্যানেজার আছে একজন, একজন হিসেবরক্ষক আর একজন টাইপিস্ট। তার এখন পয়সাকড়ি আছে। কিন্তু তার স্ত্রী, যে সবসময় অসুস্থ ছিল… যার পরপর পাঁচবার আপনা থেকে গর্ভপাত হয়ে গিয়েছিল… তার ক্যান্সার হয়েছে। না, এই বিষয়টা অনিশ্চিত নয়।
পনেরো বছরের মাথায় সবকিছু বদলে যাওয়া স্বচ্ছল অবস্থাটা অবশ্য ঠিক চারমাস স্থায়ী হয়েছিল, কারণ তার পরেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল।
(চলবে)