undefined
undefined
undefined
প্রবন্ধঃ পলাশ কুমার পাল
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
আধুনিকতায় আমি ও তুমি
পলাশ কুমার পাল
প্রবন্ধ লেখা আমার কাজ নয়। তবু কিছু লিখবো বলে লিখতে বসা। আর এই লেখার প্রারম্ভে মানসপটে উঁকি মারে প্রগতির হাতে ধরা আধুনিকতা। আধুনিকতা কথার অর্থ যদি ঢেউয়ে ভাসা ক্রমবর্ধমান প্রগতি হয়, তবু সেখানে চলে আসে 'আমি' ও 'তুমি'র প্রশ্ন। সমুদ্র সৈকতে সৃষ্টি ও প্রলয়ের যেন দুই রূপ-মহাদেব। সেখানে 'আমি'টাকে ঢেউয়ের আঘাতে বিশ্লেষিত করে 'তুমি'টা জমা বালুরাশির ন্যায় পর্যটককে আকর্ষণ করে। যাই হোক, যে যার কর্তব্য সে তাই করে। সেখানে যেচে নাক গলানোটা নাসিকার দৈর্ঘ্য স্ফীতি ছাড়া কোনো কার্যেই লাগে না। পাঠকেরও হয়তো একই মত! তবু লেখার ধর্মই এই যে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মনের ভাবটাকে খাতায় হিজিবিজি কাটা। আর এরই নাম আধুনিক।
আধুনিকতার অন্তরে প্রবেশ করতে হলে আধুনিকতার বিভাজনটা জানা দরকার। আর বিভাজনের ভেতরেই মূল গলদ। কারণ এই যে, প্রত্যেকে প্রত্যেকের কালে আধুনিক। সাহিত্যের দিকে তাকালে দেখবো বঙ্কিমের কালে হিন্দুধর্মই আধুনিক, কিন্তু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মার্কসীয় ও ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের কাছে সেটা backward। এর মাঝে বহে গেছে রবীন্দ্র-আধুনিকতা... অমিত ও লাবণ্যের রোমান্টিক প্রেমের কুলুকুলু ধ্বনি। অন্যদিকে মধুসূদনের নারীবাদী প্রগতির ছন্দ, জীবনানন্দের ব্যক্তির একাকীত্বের দ্বারে কান্নায় মাথা ঠোকে। যে যার কালে আধুনিক। কিন্তু এখানেই থেকে যায় আমিত্বের পার্থক্য। তুমিকে আপন করার মধ্যে ভিন্ন তাল ভিন্ন ছন্দ। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ভাষায়-
"কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভিতরে আজ কোথাও দেখছি না।"
এই 'শিশু'র মতোই হারিয়ে গেছে আমিত্ব। দিশাহারার মতোই 'আমি'র খোঁজে মানুষ মূল্যবোধকে দেয় বিসর্জন। 'আমি'র খোঁজে আপনাকে নিয়ে হয়ে যায় 'আপনি'। বিজ্ঞান যেমন সমস্ত জড়তা কাটিয়ে আধুনিক তালে যন্ত্রের নুপূর পায়ে নৃত্য করে। কিন্তু এই যন্ত্রের ঘূর্ণণ গতির প্রভাবে অপকেন্দ্র বলে কিছু যে বিক্ষিপ্ত রয়ে যায়, তা থাকে উল্টানো পাতার আড়ালে। তাই রয়ে যায় কিছু দায়। বিজ্ঞানের পায়ে মানুষ যতটা পেয়েছে চলার ছন্দ, আর তারই হাতে খুন হতে হয় তারও বেশি মানুষকে। স্পষ্টতই উঠে আসে 'তুমি'র গাঢ় বন্ধন।
এইসব পড়ে আপনি হয়তো গাল দেবেন। তাতে কোনও দোষ নেই। কারণ আপনার ভালো লাগা বা না লাগাটা সম্পূর্ণ আপনার আমিত্বের অধিকার। এইভাবেই আমিকে বিভাজন করে চলে আসে 'আমি' ও 'তুমি'র দুইরূপ। যেমন উনিশ শতকে যে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল কুড়ি-একুশ জন; একবিংশ শতকের কপাট খুললেই দেখব সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন-চার জন। প্রায় এক-সপ্তমাংশ। এটাই নাকি আধুনিক কালের কলিযুগ! তবে আধুনিক ভবিষ্যতকে এই অঙ্কের পদ্ধতিতে কষলে আরও দুই শতক পরে যা উত্তর পাবো তা হল এক ব্যক্তির খণ্ডিত একাংশ। যা একটা পরিবার। পদার্থবিদ্যার হিসাবেও সেই একই উত্তর। মানুষের মানবিকতাও এই সূত্র ধরেই এগিয়ে চলে। বীজগণিতে (a+b)² কে ভাঙতে জানি যে a²+2ab+b²। মানুষ আজ তার ব্যক্তি স্বার্থকে খণ্ড খণ্ড করে প্রয়োজনসর্বস্ব হয়ে পড়ছে। তবে সেখানে অখণ্ড (a+b)²-এর সৌন্দর্যের মানহানি ঘটছে। কিন্তু মানুষ বেশি বুদ্ধিমান। তাই তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের অসম্ভবের পাল্লাতেই পড়ে থাকে। পদার্থের আবিষ্কার, তার মৌলিক ও যৌগিক বিভাজন, বৈশিষ্ট্য আহরণ এবং অবশেষে অণু থেকে বিভাজিত পরমাণুর অস্তিত্ত্ব আবিষ্কার যেমন বিজ্ঞানের আধুনিকতার সমকাল। মানুষও এই একই ছাঁচে নিজেকে করে স্বার্থবান।
ধনীর ছেলের হুইস্কির বোতল যত না দামী, তার চেয়ে দামী নিরন্ন মানুষের মুখের একমুঠো অন্ন। কিন্তু আধুনিক তুলাযন্ত্রে দুটি weigh করলে দেখি হুইস্কির জয়জয়কার। যন্ত্রও স্বার্থেই চলে। সে তো নিরস। এই কৃত্রিম আধুনিকতার হাটে সরল মুখগুলিও ক্রীম মাখা মুখের সঙ্গে সমতালে বেগবান না হলেও মনের কোনও এক কোণে ছাপ রেখে যায়। এইখানেই জিত। খোলা খোলা পোষাকের রঙমাখা খোলা শরীরটার প্রদর্শন ভণ্ডামির মুখরোচক মশলা হলেও, অসহায়ের ব্যর্থ কান্নায় রেখে যায় তরকারির আসল স্বাদ। অসহায়কে আরও পিছনে ফেলাটা আধুনিকতা। তা যাই হোক, বিজ্ঞান যখন নিরস সাহিত্য সেখানে রস। তবু সাহিত্যে আধুনিক মন মুখোসটাকেই ফুটিয়ে তোলে। আসল চিত্রটা থেকে যায় মনের গভীরে। তাই বলি - মন জয় করে ভালোবেসে কছে টানা, মূল বোধকে ভেঙে মানববোধে উর্ত্তীণ হওয়ার নামান্তর হল আধুনিক। সাহিত্যও সেখানে ব্যর্থ।
আপনাকে দিয়ে অপরের আমিত্বকে জয় করতে পারলেই 'আমি'। তার ব্যতিক্রম হলেই 'তুমি'। তাই আসল 'আমি'কে উর্ত্তীণ করে আধুনিক হবো - এই ঝংকারে মানুষের মনও নেচে ওঠে। তবুও সৃষ্টির আনন্দে কোনও সাহিত্যিকও তাঁর সৃষ্টিকে 'একটি সূর্য, আমারই প্রাণে জ্বলন্ত' বলে ওঠেন। কারণ তিনি আপন সৃষ্টিতেই 'আপনা'কে পান। কিন্তু পাঠক সেখানে 'আমি'টিকে ধরতে না পারলে সেই সাহিত্য ব্যর্থ হয়। তাই 'আপনার চড়কায় তেল দাও' প্রবাদের সুরে আমিও বলি আমার তত্ত্বকথা। এতে আমি আমার 'আমি'কে খুঁজে পেয়ে আনন্দিত। তাতে আপনাদের নিরস ছিটে লাগলেও আমার যেমন কোনো দায় নেই, তেমনই জবরদস্তিও নেই। আপনার কাজ আপনি করবেন - আপনার আমিত্ব না পেলে লেখাটিকে ছিঁড়বেন। আর আমি আরও লিখবো। এটাই নাকি আধুনিক!