Next
Previous
1

ধারাবাহিকঃ স্বপন দেব

Posted in


ধারাবাহিক




আমার বারুদ বেলা - ৪র্থ পর্ব 
স্বপন দেব



সমসাময়িক সময়ে, ছাত্র আন্দোলনে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের ছিল একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা। ১৯৬৫ সালে U.S Consulate, Calcutta কর্তৃক সংগঠিত একটি আলোচনা সভায় একজন কনসুলার অফিসার জন লেপার্ড ভারতীয়দের সম্পর্কে একটি অবমাননাকর মন্তব্য করলে, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র নেতাদের কয়েকজন আলোচনাসভা ত্যাগ করেন এবং সেই দিন ই U.S.I.S ( United States Information Service ) এর কলকাতা অফিসের সামনে একটি জঙ্গি বিক্ষোভ সংগঠিত করেন। এই ঘটনার পরপরই রণজিৎ চন্দ্র নামে ছাত্র-ফেডারেশনের সেক্রেটারিকে অভদ্র আচরণের অভিযোগে কলেজ কর্তৃপক্ষ কলেজ থেকে তাড়িয়ে দেন। কর্তৃপক্ষের এই আক্রমণাত্মক ব্যবহারে কলেজ ছাত্ররা ভয় পাওয়ার পরিবর্তে আরও ঐক্যবদ্ধ ও জঙ্গি হয়ে উঠল। অমল সান্যালকে সভাপতি ও অসীম চ্যাটার্জিকে সেক্রেটারি করে ইউনিয়ন পুনর্গঠিত হল এবং ধাপে ধাপে জঙ্গি কাজ-কর্ম বাড়তে থাকল। কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রথম বৃহৎ সংঘর্ষ বাধলো ইডেন হোস্টেলকে কেন্দ্র করে। ইডেন হোস্টেল ছিল বামপন্থী ছাত্রদের একটা ঘাঁটি। এখানকার প্রশাসনিক অব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে ছাত্ররা তাঁদের দাবী জানাচ্ছিলেন। 

অবশেষে ১৯৬৬ সালের সেপ্টেমবরে একদিন তাঁরা হোস্টেলের সুপার, যিনি কলেজের একজন অধ্যাপকও, তাঁকে ৩৬ ঘন্টা ঘেরাও করে রাখলে অসুস্থ ও অপমানিত সেই অধ্যাপক পদত্যাগ করেন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কলেজ কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ সরকার খুব অনমনীয় মনোভাব নেয় এবং হোস্টেলের চার জন বোর্ডারকে, যাঁরা কলেজেরও ছাত্র ছিলেন, কলেজ থেকে তাড়িয়ে দেয়। ছাত্র ইউনিয়ন এই বহিস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার পরিকল্পনা করতে করতেই কলেজ কর্তৃপক্ষ শৃঙ্খলারক্ষার অজুহাতে, কিছুদিনের জন্য কলেজ বন্ধ করে দেন। এই সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পোষ্ট গ্র্যাজুয়েটের তিনজন ছাত্র----অসীম চ্যাটার্জি, সুদর্শন রায় এবং অশোক সেনগুপ্ত নতুন ক্লাসে ভর্তি হতে অস্বীকার করেন এবং অধ্যক্ষ কে ৪০ ঘন্টা ঘেরাও করে রাখেন। তদানীন্তন বিপিএসএফ এর পক্ষ থেকে বিমান বসু ও দীনেশ মজুমদার এই ঘেরাও আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। 

যেদিন প্রেসিডেন্সির প্রিন্সিপ্যাল সনৎ বসুকে ঘেরাও করা হয়, সেদিন আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। কারণ, এই সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের এই ছাত্রদের কাছে কলকাতার অন্য কলেজের বামপন্থী ছাত্ররা আসা যাওয়া করতেন। এমন কি উত্তর বাংলার বামপন্থী ছাত্ররাও এখানে আসতেন। কলেজস্ট্রীট পাড়ায় প্রেসিডেন্সি কলেজ তখন হয়ে দাঁড়াল বামপন্থী আন্দোলনের একটা যোগাযোগের স্থান। তাই বিদ্যাসাগর, স্কটিশ চার্চ, বঙ্গবাসী, গুরুদাস প্রভৃতি কলেজের বামপন্থী ছাত্রনেতাদের নিয়ে এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের বহিস্কৃত ছাত্রদের নিয়ে তৈরি হয় প্রেসিডন্সি কনসলিডেশন। কিন্তু, যেদিন প্রেসিডেন্সির প্রিন্সিপ্যাল কে ঘেরাও করা হল সেদিন রাত এগারোটার পর ডিসি সেন্ট্রাল নিরুপম সোমের নেতৃত্বে এক বিরাট পুলিশ বাহিনী প্রিন্সিপ্যালকে ঘেরাও মুক্ত করতে আসে। কথা ছিল, পুলিশ এলে আমরা তার মোকাবেলা করব সশস্ত্র ভাবে। পুলিশ যখন লাঠি আর টিয়ার গ্যাস ছুঁড়তে লাগল, আমি পাশে থাকা বিমান বসুকে জিগ্যেস করলাম “আমাদের অস্ত্র কই ? কি দিয়ে লড়ব পুলিশের সঙ্গে ?” উনি অম্লান-বদনে পাশে পরে থাকা ইঁটের টুকরো দেখিয়ে বললেন ওটাই নাকি অস্ত্র!! 

পুলিশের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে আমি সহ বহু ছাত্র গ্রেফতার হই। একটা ঝোপের ভেতর থেকে অন্ধকার রাতে সাদা ধুতি আর সাদা পাঞ্জাবি পরা বিমান বসুও হাত তুলে বেরিয়ে এসে গ্রেফতার বরণ করেন। কিন্তু, প্রিন্সিপ্যালের পাশে বসে থাকা বিপিএসএফ এর নেতা দীনেশ মজুমদারকে পুলিশ গ্রেফতার করলনা!! এই সময়ে আন্দোলনে কিছুটা ধাক্কা এলেও আন্দোলন চলতে থাকে। ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলন, সন্দেহ নেই, প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্র-বিতাড়ন বিরোধী আন্দোলনকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। পশ্চিমবাংলার ভালো ছাত্র তৈরির পীঠস্থান এভাবে প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতছাড়া হয়ে যাবে, এটা তারা মেনে নিতে পারেনি। তাই, আতঙ্কিত প্রতিক্রিয়াশীলরা এবং এই সমাজব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক বুদ্ধিজীবীরা এই আন্দোলনের মোকাবেলায় উঠে পড়ে লেগে পড়েছিল। তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্ররা সেদিন যে সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন, তা বাংলার ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। 

প্রেসিডেন্সির ছাত্র আন্দোলন তথা প্রেসিডেন্সি কনসোলিডেশন সম্পর্কে কিছু ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও কনসলিডেশনের রাজনৈতিক লাইন এবং কাজকর্ম সম্পর্কে আমি সহ সেই সময়কার অনেক ছাত্রনেতারই ভিন্নমত ছিল।কনসলিডেশনের মধ্যে শুরু থেকেই ছিল নৈরাজ্যবাদী ঝোঁক। তারা পোষ্টার মারত, ‘ঘটনা ঘটাও, ফয়দা ওঠাও’ বা ‘শহরে চে,গ্রামে মাও’। চমকপ্রদ কিছু ঘটিয়ে জনসাধারণের দৃষ্টি কাড়ার অপরিণত ও বয়ঃসন্ধির আবেগই ছিল তাদের মূল কর্ম কৌশল। একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। পুলিশি জুলুমের পর থেকেই প্রেসিডেন্সি ছাত্র আন্দোলনে একটা ভাঁটা দেখা যায়। এর থেকে বেরিয়ে এসে আন্দোলনকে আরো জঙ্গি করে তোলার জন্যে বিপিএসএফ এর নেতৃবৃন্দ এবং প্রেসিডেন্সি কনসলিডেশনের কলেজ স্ট্রীট কফি হাউসের নিচে, সিঁড়ির তলায় একটা মিটিং হয়। সেখানে ছাত্র-ফেডারেশনের নেতারা এবং প্রেসিডেন্সির অসীম চ্যাট্টার্জি প্রমুখেরা প্রস্তাব দেয় প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যাবোরেটরি তছনছ করার!! আমি এবং প্রেসিডেন্সি কনসলিডেশনের আরো অনেকেই এতে বিস্ময় প্রকাশ করে এবং অসম্মতি জানিয়ে বলি যে, নাম করা মনিষী বিজ্ঞানীরা যেখানে গবেষণা করে গেছেন, সেটা তছনছ করা হলে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। 

কিন্তু আমাদের কথা শোনা হলনা এবং একদল যখন ল্যাবোরেটরি ভাংচুর করছে তখন সুভাষ চক্রবর্তির নেতৃত্বে ছাত্র-ফেডারেশনের মিছিল শ্যামবাজার মোড়ে গিয়ে ট্র্যাফিক পুলিশের টুপি নিয়ে লোফালুফি খেলছে!! কাগজে ঐ লোফালুফির ছবি আর প্রেসিডেন্সির ল্যাবরেটরিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার দুটি ঘটনাই বেরোল এবং সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র-ফেডারেশনের তরফ থেকে জানানো হল যে তাদের কেউ এতে যুক্ত নন, কারণ তখন তাদের মিছিল শ্যামবাজারে ছিল!! ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র-নেতাদের ধারণা ছিল খুব ই অস্বচ্ছ, নেতিবাচক। সংগঠিত ছাত্র বা যুব আন্দোলনকে তারা নাকচ করেছিল। প্রেসিডেন্সি কনসলিডেশনের নেতৃস্থানীয় কিছু কর্মী তখন চব্বিশ পরগণার কালিকাপুরে কৃষক আন্দোলন করতে যেতেন। ফলে শহরের যাবতীয় সংগঠন ও আন্দোলন গুটিয়ে নিয়ে কালিকাপুরে হাজির করে দেওয়াটা তাদের মূল কর্মসূচী হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এসেছিল ছাত্র-যুব সংগঠন নাকচ করার বক্তব্য। ছাত্রদের যৌথ কর্মসূচীতে তারা কখনোই অংশ নেয় নি। নির্মল ব্রহ্মচারীর সঙ্গে মত-পার্থক্য ঘটায় প্রেসিডেন্সি কলেজে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে শারিরীক নির্যাতন করেছিল কনসলিডেশনের কর্মীরা। ‘দেশব্রতী’ পত্রিকা দফতর থেকে কো-অর্ডিনেশন কর্মী শঙ্কর ভট্টাচার্য কে তারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল। 

প্রেসিডন্সিতে পড়া পদস্থ আমলাদের মত প্রেসিডেন্সিতে পড়া কমিউনিস্টদেরও এক ধরণের বর্ণাভিমান এবং উন্নাসিকতা ছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের উত্তাল আন্দোলন এবং অন্যান্য কলেজের ছাত্রনেতাদের দেখেও সে অভিমান, স্বাতন্ত্র্য, বিচ্ছিনতা কাটেনি। যাই হোক, ১৯৬৭ সালের মার্চে যখন সাধারণ নির্বাচন এগিয়ে এল, তখন সিপিএম পার্টির কলকাতা জেলা কমিটির তরফ থেকে সমস্ত ইউনিটকে সার্কুলার দিয়ে বলা হল---এখন থেকে তাদের আর প্রেসিডেন্সির গেটে যাওয়ার দরকার নেই। তারা যেন নিজ নিজ এলাকায় নির্বাচনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে দীর্ঘ ১২৩ দিন ধরে চলা এই আন্দোলন এই সময়ে ক্রমশ দূর্বল ও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। ( চলবে )