ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত
Posted in ধারাবাহিকসুপ্রিয়বরেষু বাসু,
অফিসের কাজে শহরের বাইরে ছিলাম প্রায় একমাস। তাই তোমার চিঠির উত্তর দিতে দেরী হলো। তুমি নিশ্চয়ই পাহাড় থেকে ফিরে এসেছো। কদিন আগেই যাকে বিগত যৌবনা বলে উপহাস করলে তাকেই লিখছো চিরনতুন বৃদ্ধা এ কেমন কথা? ভীমরতি ধরেছে নাকি মশাই! অবশ্য তোমারও তো বয়স হয়েছে এই বয়সে শুনেছি প্রায় পুরুষের কিছু চারিত্রিক ভীমরতি ঘটে, তোমারও কি তাই হলো নাকি বিগত যৌবনা বলে অনুশোচনায় ভুগছো? বছরের প্রথমেই শহরের বাইরে যাবার তাড়া ছিলো তাই নতুন বই কেনা হয়নি। বহুবছর পরে এয়ারপোর্টে কার সাথে দেখা হয়েছে শুনলে তোমার মনে দোলা লাগবে। কলেজের দিনগুলিতে যাকে একপলক দেখবে বলে তুমি ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যান্টিনে বসে থাকতে তোমার সেই চির যৌবনার সাথে দেখা হলো। স্বামী পুত্র নিয়ে দারুন সংসারী সে। তোমার কথা জিজ্ঞাসা করেছে খুটেখুটে আজও সংসারী হওনি শুনে মনে হলো কষ্ট পেয়েছে খুব। ওর সাথে ঘন্টাখানেকের সাক্ষাতের পরে আমার মনে হয়েছে নারীর জীবন ব্যক্তিগত নয়, পুরোপুরি রাজনৈতিক। দেশকেও তো আমরা মায়ের রূপে দেখি অর্থাৎ সেই নারী আর তাই হয়ত তারও ব্যক্তিগত কিছু নেই যা আছে তা পুরোপুরি রাজনৈতিক তা হোক ভারতবর্ষ,বাংলাদেশ, সিরিয়া কিংবা অন্য যেকোন দেশ। শহীদুল জহিরকে তোমার মতন করে গভীরভাবে আমার পড়া হয়নি তবে তোমার চোখে তাকে দেখে আরো গভীরভাবে তাকে পড়ার ইচ্ছে জেগেছে প্রবলভাবে তা স্বীকার করি। বাংলাদেশকে দেখার কথা যদি বলো তাহলে সবচেয়ে বেশি আমি দেখেছি সেলিনা হোসেনের লেখায়। ফ্রানৎস ফানো বলেছেন অতীত নয়, যে-অগ্নিগর্ভ বর্তমানের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি, যা এ-মুহূর্তে আকার পাচ্ছে, সে-সময়কেই চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখার কথা একজন সংবেদনশীল লেখকের সেটাই তো আত্মনির্ধারিত অন্বিষ্ট। শহীদুল জহির তেমনই একজন লেখক অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবু কেন জানি আমাকে বেশি টানে সেলিনা হোসেন। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতা গভীরভাবে যেসব লেখকের রচনায় মূর্ত হয়ে উঠতে শুরু করে, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তাঁদেরই একজন। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি কিন্তু বাবা মা ও আত্মীয় স্বজনের মুখে এত গল্প শুনেছি আমার এখনো মনে পড়ে স্কুল থেকে ফিরে দুপুরের ভাতঘুমের আগে ঠাকুরমার কাছে রোজ মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার দিনগুলি। মুক্তিযুদ্ধ প্রীতির জন্যই কিনা জানিনা বাবা সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬) বইটি কিনে দিয়েছিল বইমেলা থেকে। সেই জন্যও সেলিনা হোসেন আমার প্রিয় হতে পারেন। তুমি নিশ্চয়ই সেলিনা হোসেনের বহু লেখা পড়েছো। হাঙর নদী গ্রেনেড পড়ার পরে আমি সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে লেখা বেশকিছু উপন্যাস পড়েছিলাম।
বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের উদ্বেগ বেশি হয়ত পূর্বপুরুষের নাড়িপোতা আছে সেইজন্য কিংবা নিকটতম প্রতিবেশি দেশ বলে, কিন্তু পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখো সর্বত্র জনসাধারণ সমর্থিত ও অংশগ্রহণকৃত যুদ্ধ। ইতিহাস জানায়, এই সভ্য পৃথিবীতে একটি দিনের জন্যেও কখনো যুদ্ধ বন্ধ হয় নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজায় রাজায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রশাসকবৃন্দ নিজেদের প্রতিহিংসা, লোভ মেটাতে জনগণকে ছুড়ে ফেলেছে ক্ষুধার্ত
বাঘের খাঁচায়। এরিক মারিয়া রেমার্কের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’-এ দেখা যায়, দেশের যুবকরা বাধ্য হচ্ছে যুদ্ধে যেতে। সেই যুদ্ধ গৌরবের অনুভূতির পরিবর্তে তাদের দিয়েছে ক্লান্তি আর ঘৃণাবোধ। যুদ্ধ থেকে তারা ফিরেছে একরাশ হতাশা আর অর্থহীনতার বোধ সঙ্গে নিয়ে। ছাত্র রাজনীতি করলেও আমি যে তুখোড় রাজনীতিবিদ তেমনটা একদমই না। তবে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির কিছু গলদ অবশ্যই আছে। যা বাংলাদেশে ঘৃণাকে বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির কাল থেকেই ভারত এককভাবে আওয়ামী লীগকে অন্ধভাবে সমর্থন করেছে যা এতবড় গণতান্ত্রিক দেশের কুশলী পরারাষ্ট্রনীতি হতে পারেনা কোন ভাবেই।
বাংলাদেশের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানকে ছাত্ররা বলছে নতুন স্বাধীনতা। এটা একটা রাজনৈতিক পন্থা হলেও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম গণঅভ্যুত্থানের পরে অস্বীকার করতে চাইছে, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি ঐতিহাসিক দলিল। এটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। তাঁর ভাষণ পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার সংগ্রামের বীজমন্ত্র হয়ে উঠে। কালজয়ী এ ভাষণ বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত ও মুক্তিকামী মানুষকে সবসময় প্রেরণা জুগিয়ে যাবে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে সেলিনা হোসেনের একটি উপন্যাস আছে 'সাতই মার্চের বিকেল'। এই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা দুজনেই একাত্তরে রমনার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছে। ইতিহাসের সেই অগ্নিঝরা বিকেলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তারা উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। লেখিকা উপন্যাসে দেখিয়েছে, নায়ক-নায়িকা যুদ্ধের পরে আবারও রমনার রেসকোর্স ময়দানে চলে আসে। মেয়েটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, পাশাপাশি পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে গর্ভবতী হয়েছে। ছেলেটি মেয়েটিকে দেখে বলল, যুদ্ধের আগে আমাদের প্রেম ছিল। আমিতো তোমাকে এখনো একইভাবে চাই। তখন মেয়েটি বলে, আমার এই অবস্থাতেও তুমি আমাকে গ্রহণ করতে সম্মত আছো? ছেলেটি জানায়, গর্ভের সন্তানের দায়িত্ব নিতেও সে রাজি। গর্ভের সন্তানটি যেহেতু কোনো কিছুর জন্য দায়ী নয়, তাই তাকে গ্রহণ করতে তার আপত্তি নেই। তখন তারা দুজনে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে যায়। বঙ্গবন্ধু সে সময় বাড়িতে ছিলেন না। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা তখন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বঙ্গমাতাকে জানায়, তারা দুজনে বিয়ে করতে আগ্রহী। যুদ্ধের আগেও তারা ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেত, তাই বঙ্গমাতা তাদের সম্পর্কের কথা জানতেন। তিনি এই নতুন পরিবর্তিত অবস্থায় দুজনের বিয়ে করার বিষয়ে সম্মত হওয়ার খবর জেনে কাজী ডেকে বিয়ে দিয়ে দেন। বঙ্গমাতা তার গলার সোনার চেইন খুলে মেয়েটির গলায় পরিয়ে দিয়ে তাদের আশীর্বাদ করেন। উপন্যাসটি পড়ে আমার মনে হয়েছে সেলিনা হোসেন এটাই দেখাতে চেয়েছেন যে, এসবই বাংলাদেশের সাতই মার্চের অর্জন।
৫ই আগষ্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পরে ৩২ নম্বরের সেই ঐতিহাসিক বাড়িটিতে আগুন দেয়া হয়েছে তারপর ৫ ই ফেব্রুয়ারি সেই বাড়ি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর সব প্রতিকৃতি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে আমার তখন আফগানিস্তানের কথা মনে পড়ছিল। সারাদেশ জুড়ে যে সব তান্ডব চলেছে তা শোনার পর অজানা কষ্ট ঘিরে ধরলেও আমাকে সাহস জুগিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেলিনা হোসেনের ১৯৭৬ সালে লেখা প্রথম উপন্যাস হাঙর নদী গ্রেনেড। এই লেখায় জনযুদ্ধ চিত্রায়নের সার্থক রূপায়ণ পাওয়া যায়। এই উপন্যাসে নেই কোনো রাজনৈতিক চরিত্র, সেনা কর্মকর্তা, কিংবা অসাধারণ কোনো ব্যক্তিত্ব। হলদীগাঁ নামে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম হওয়া বুড়ি নামের মেয়েটির শৈশব থেকে মধ্যবয়স পর্যন্ত বেড়ে ওঠা আর জীবনযাপনের অতিসাধারণ বর্ণনা আছে এতে। বুড়ির বিয়ে হয় বিপত্নীক দুই পুত্রের বাবার সাথে। উপন্যাসের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত হলদীগাঁয়ের নিস্তরঙ্গ কৃষিভিত্তিক গ্রামসমাজের আবহমান ছবি তুলে ধরা হয়েছে। রাজনীতি, মিটিং-মিছিল, দাবি-দাওয়া এসব যেন শহুরে বিষয়, গ্রামজীবনের নিভৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন বহুদূরের প্রসঙ্গ। উপন্যাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে শহর থেকে যুদ্ধ ক্রমশ গ্রামীণ জীবনকে আক্রান্ত করে। হতচকিত গ্রামবাসী বিষয়টা বুঝে উঠতে উঠতেই অনেকখানি ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায়। গ্রামের সব যুবকের সাথে বুড়ির সৎ ছেলে সলিম-কলিম যুদ্ধে চলে যায়। বিশেষ পরিস্থিতিতে গ্রামের প্রতিবেশী দুই মুক্তিযোদ্ধার জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের বহু সাধনার কাঙ্খিত প্রতিবন্ধী পুত্রকে হায়েনার মুখে তুলে দেয় বুড়ি। সলিম-কলিম, বুড়ি কিংবা উপন্যাসে উল্লিখিত অন্য মুক্তিযোদ্ধারা কেউ ডিগ্রিধারী শিক্ষিত কিংবা রাজনীতি সচেতন চরিত্র নয়। কিন্তু এরাই একাত্তরের সিংহভাগ জনতা, যারা মাতৃভূমি বাঁচাতে নিত্যকার ঘর-গৃহস্থালি ফেলে কাস্তে-লাঙলের বদলে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। এই গল্পের আরেক ধরনের যোদ্ধার উপস্থিতি সম্পর্কে না বললেই নয়। বুড়ির বাল্যসখী নীরা ছিল বাউল দলের সদস্য। সারাদেশ ঘুরে দোতারা হাতে গান গাইত সে। গ্রামের রাজাকাররা তাকে প্রাণের হুমকি দিয়ে দোতারা কেড়ে নেয়, কারণ গানের ভেতর দিয়ে সে দেশমাতৃকার কথা বলছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল মূলত বায়ান্নের ভাষা সংস্কৃতি বাঁচানোর লড়াইয়ের ধারাবাহিক ফলাফল। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাওয়া, ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা, সবশেষে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড প্রমাণ করে দেয় যুদ্ধটা কেবলই ভূমি দখলের নিমিত্তে ঘটে নি। একটি জাতির মস্তিষ্ককে ধৌতকরণের মাধ্যমে দাসে পরিণত করাটাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেবল সশস্ত্র যুদ্ধ হলে এত দ্রুত স্বাধীনতা লাভ করা যেত না সম্ভবত, যদি না আব্দুল মান্নান আর আরজাতুন্নেসার মতো স্বেচ্ছাসেবকেরা কোনো প্রাপ্তির আশা না রেখে জনতার কাতার থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত। কসবার কুল্লা পাথর এলাকার এই দুজন বাসিন্দা ইতিহাসস্বীকৃত চরিত্র। যুদ্ধের নয় মাস এই দুজন শহিদদের লাশ বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে উপযুক্ত মর্যাদায় দাফন করেন। আব্দুল মান্নান এবং আরজাতুন্নেসার জন্য বহু শহিদের লাশ বেওয়ারিশ হয়ে যায় নি। লাশ ধোয়ানোর সেই চৌকি আজও ইতিহাসের স্বাক্ষ্য দেয়। আর তাতেই বলতে সাহস পাই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আদতে অসাম্প্রদায়িক, হয়ত এখনও।
তেমনি ‘ঘুমকাতুরে ঈশ্বর’উপন্যাসে নদীভাঙা মানুষের জীবনের দুঃখগাথা দিয়ে যে কাহিনির শুরু, সেইসব উপকাহিনির যোগসূত্র ঘটে একটি গণকবরের কাছে এসে। লেখক দেখাতে চান যে দেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় হয়ত যে কোনো উপায়ে আরো অধিক পুঁজি গড়তে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার জীবন বেছে নিয়েছে, যার ফলে দেশাত্মবোধ তাদের কাছে এখন লোকদেখানো আনুষ্ঠানিকতার নামান্তর। কিন্তু এই দেশেরই যেসব অতি সাধারণ জীবনযাপন করা মানুষের অবদানের কারণে একাত্তরে বিজয় এসেছিল, তাদের জন্য আজও স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের বোধে একাত্ম হওয়ার বিকল্প নেই। একতার শক্তিই পারবে মানবেতর জীবনযাপন করা এইসব মানুষের জীবনে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ বয়ে এনে দিতে। আর নওরতন বেওয়া সেই মানুষ, যিনি পেরেছেন স্বদেশ ও স্বাধীনতার প্রতিকৃতিরূপে নিজেকে দশগ্রামের মানুষের কাছে দাঁড় করাতে। তাই তার বাড়িতে যারা আসে, তারা বলে, ‘শহীদের লাগি মোরাই তো কাঁদুম। শহীদের লাগি কাঁদলে মাটি, আকাশ, বাতাস খুশি থাকবে। নইলে মোগ উপর গজব নামবে। মাটি ফুঁইসা উঠবে। নদীগর্ভে তলায়ে যাইবে। জলোচ্ছ্বাস মোগরে দুইয়া সাফ কইরা দিবে। আবার ফুঁইসা উঠবে। বজ্রপাত অইবে। মোগরে বেইমান বইলে গালি দিবে। মোরা ধ্বংস অইয়া যামু।’ একটি গণকবর, একটি গণহত্যা দিবস এবং স্মৃতিসৌধরূপী নওরতন বেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রতীকায়িত করা হয়েছে, যে দেশের শেকড় ‘একাত্তর’ নামক একটি সময়ে প্রোথিত রয়েছে। শেকড়ে ফিরতে পারলে, নওরতন বেওয়ার মতো স্বাজাত্যবোধ আর স্বদেশপ্রেম ধারণ করতে পারলে অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব কিছু নয়। অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব হলে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমবে, অনেক মূল্যের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে উঠবে।
তোমার নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে বাংলাদেশের সমসাময়িক গণঅভ্যুত্থানকে কেন আমি সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস দিয়ে দেখছি। আসলে আমি তোমার মন জগতে যে ঢেউ উঠেছে তার হাহাকারের সাথে একাত্ম বোধ করছি কিন্তু অসাম্প্রদায়িক ও সরলমনা সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের প্রতি বিশ্বাস রাখছি সেলিনা হোসেনের লেখা থেকে কেননা গল্প-উপন্যাসের বিষয় ও চরিত্রের অনুসন্ধানে সশরীরে মাঠে-প্রান্তরে ঘুরে ফেরেন তিনি। উদ্দেশ্য একটিই, যে জীবনের গল্প তিনি নির্মাণ করছেন বা যে চরিত্র তিনি সৃষ্টি করছেন, তা যেন সঙ্গতিপূর্ণ হয়। বাস্তববাদী লেখক হওয়ার ইচ্ছে থেকে তিনি এ কাজ করেন না। এ কাজ তিনি করেন একজন শিল্পীর লড়াই হিসেবে। এই লড়াই তিনি সকল ক্ষেত্রেই করেন। এছাড়া উপন্যাসের বিষয়বৈচিত্র্য খোঁজা তার শিল্পীসত্তার মৌলিক স্বভাব। একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি তাঁর লেখায় খুব বেশি নেই। গল্প-উপন্যাসের বিষয় ও আঙ্গিকের অন্বেষণে রীতিমতো গবেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখি সেলিনা হোসেনকে। সৃজনসত্তার এই বিশেষ প্রবণতা বা আকুতি তার লেখালেখির শুরু থেকেই শুরু। 'পোকামাকড়ের ঘরবমতি' লেখার পূর্বে তিনি সশরীরের জেলেদের ট্রলারে চড়ে গভীর সমুদ্রের গিয়েছিলেন। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি লেখেন-
যে ট্রলারে চড়েছিলাম তার প্রধান জেলে ছিলেন একজন বয়সী মানুষ। চুল-দাড়ি ধবধবে সাদা। মাথায় চুপি। ভেবেছিলাম তিনি আমাকে ট্রলারে উঠতে দিতেই চাইবেন না। দেখলাম তিনি অন্য মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আসেন আসেন। আমি আর আনোয়ার উঠলাম ট্রলারে। ট্রলার যখন গভীর সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে, তিনি গুড়-মুড়ির পোটলা খুলে বললেন, খাবেন মাগো? এই হলো আমাদের সাধারণ মানুষের চিত্র। বিপরীতধর্মী মানুষ নেই তা নয়। তবে এরাই সংখ্যায় বেশি। সেখানে গিয়ে কাহিনী মাথায় দানা বাঁধে। ঠিক করি যে উপন্যাসের নায়ক হবে একজন সাহসী মানুষ, যে হাঙর ধরার স্বপ্ন দেখে। জেলে মালেকের এই স্বপ্নের সঙ্গে ছিল তার প্রেম, দুঃখ-বেদনার গল্প। (গল্পকথা, সেলিনা হোসেন সংখ্যা, রাজশাহী, ২০১৫)
তাঁর এই আত্মকথন প্রমাণ করে তিনি কল্পনাপ্রসূত চরিত্র বিনির্মাণ করেননি, তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা তাঁর নিজ চোখে দেখা ও গবেষণা সৃষ্ট। যা সাধারণের বাস্তব মনজগৎকে তুলে এনেছেন পরম মমতায় বাস্তবসম্মতভাবে। তিনি সাধারণ মানুষের জীবনযাপন দেখেছেন নিবিড়ভাবে। তাঁর গল্পে শ্রমিক, চাষি, কাঠুরে, রিকশাচালকসহ বিচিত্র পেশার মানুষ উঠে এসেছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে রঙচঙ লাগিয়ে বিস্তর হৈচৈ হচ্ছে দেশের মিডিয়াগুলোয় কিন্তু বিশ্বের কোথায় সংখ্যালঘুরা ভালো আছে বলো তো? আমাদের দেশেও কি বিষ ছড়ানো হচ্ছে না? মানুষকে যতদিন মানুষ পরিচয়ে বিবেচনা না করে ধর্ম বা জাতি দিয়ে বিবেচনা করা হবে ততদিন মুক্তি আসবেনা। বিশেষ করে সংখ্যালঘু শব্দটা যতদিন আছে। সংখ্যালঘুদের জীবন নিয়েও সেলিনা হোসেনের একটি মুক্তিযুদ্ধকালীন উপন্যাস আছে। ‘মাটি ও শস্যের বুনন’ উপন্যাসে দেখা যায়, শ্যামল সবুজ ধমশর গ্রামে ভোর হয় গীর্জার ঘণ্টাধ্বনি শুনে। খ্রিষ্টধর্ম অধ্যুষিত গ্রামের শান্তিপ্রিয় মানুষদের জীবন নারকীয় হয়ে ওঠে পাক বাহিনীর আক্রমণে। ক্ষিতীশ ও মেরিনার কন্যাসন্তান র্ম্চ্ছূনার জন্ম হয় বিকট বোমা বিস্ফোরণের শব্দকে সঙ্গে নিয়ে। পরিবারের অসাম্প্রদায়িক মানবতাবোধসম্পন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত দেশচেতনা ধারণ করেই বেড়ে ওঠে সে। গির্জার ফাদার যোসেফ এবং স্থানীয় মিশনারি হাসপাতালটি মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা ও আশ্রয়ের জন্য নির্ভরযোগ্য কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত ছিল। হাসপাতালে নির্যাতিত নারী পারুলিয়া যুদ্ধশিশুর জন্ম দিয়ে হত্যা করতে উদ্যত হয়। ক্ষিতিশ ও মেরিনার উদ্যোগে শিশুটিকে গ্রামের নিঃসন্তান দম্পতি দত্তক গ্রহণ করে। যুদ্ধশিশুর প্রতি এই অসাধারণ দায়িত্বশীল উপলব্ধি সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়লে পরবর্তীকালে বীরাঙ্গনা এবং যুদ্ধশিশুদের নানাবিধ করুণ পরিণতি বরণ করতে হতো না। হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মী চন্দ্রমুখী আহত মুক্তিযোদ্ধার কেটে ফেলা পা সশ্রদ্ধচিত্তে বাগানের মাটিতে পুঁতে রাখে, যেন সেই পা থেকে জন্ম নেবে স্বাধীনতা নামের বৃক্ষ। সেখানে ফুল ফুটবে প্রতিদিন বাংলাদেশ নামে। উপন্যাসের চরিত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধে যে বৈষম্যহীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিল তার প্রতিফল ঘটেনি বলে স্বপ্নগুলো যেমন মিথ্যে হয়ে যায়না তেমনি হাজার বছরের সংস্কৃতিকে চাইলেই বদলে ফেলা সম্ভব না। মনে রাখা জরুরি আমাদের সংস্কৃতিতে লোকাচারে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল মন্ত্র ছিল, বাংলার প্রত্যেক মানুষের সাংবিধানিক অধিকার ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে জনগণকে মুক্তি দেয়া। বাঙালি হবে একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি। ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মিশ্র আদর্শে এই ভূখণ্ড পরিচালিত হবে। বাংলাদেশের ভৌগলিক অনন্য বৈশিষ্ট এবং বিবিধ নৃতাত্ত্বিক সংমিশ্রণের ফলে এ সংস্কৃতি নিজস্বতা লাভ করেছে। বাঙালির স্বীকরণের ক্ষমতা এত বেশি ছিল যে শাসনতন্ত্র দিল্লি থেকে শত শত মেইল অবস্থানের পরেও শাসকদের অনুশাসন, ধার্মিকদের ধর্মাচার, দার্শনিকদের দর্শন ভাবনা ইত্যাদি যা কিছু বাংলা নামক এ প্রান্তিকে এসে পৌঁছেছে তাই বঙ্গীয় চরিত্র দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে। পাশাপাশি শতশত নদী শাখা নদী এবং বনভূমিতে পরিপূর্ণ বাংলাদশ আবার বহুভাগে বিভক্ত হয়েছে। এ কারণে এ অঞ্চলের সংস্কৃতিও খানিকটা স্বাতন্ত্র্র্য লাভ করেছে। এসব উপসংস্কৃতিও জাতি, ধর্ম, বর্ণ এবং বহু উপ-ভাষার কারণে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে। বৈদিক, বৌদ্ধ এবং জৈন ইসলাম ধর্মের মতো প্রধান প্রধান ধর্মের উৎপত্তি এবং স্থান বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে অবস্থিত। সে কারণে এসব ধর্মের আদি অকৃত্রিম রূপ এ অঞ্চলে পৌঁছায়নি; বরং এসব বহিরাগত ধর্মের সঙ্গে স্থানীয় ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আচারের এক অদ্ভুদ সমন্বয় ঘটেছে। তাই সংস্কৃতি সম্পর্কে একটা কথা বলা যায় যে, সংস্কৃতি একটা দেশ তথা অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীর শেকড়ের মতো।
‘কাঠকয়লার ছবি’ সেলিনা হোসেনের আরো একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস, যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে দেখা যায় চৈতীরাণী নামে এক নির্যাতিত নারীকে, চৈতীরাণী আদিবাসী বাঙালি এবং চাবাগানের শ্রমিক। একাত্তর সালে এইসব প্রান্তিক, অন্ত্যজ শ্রেণি যারা আজন্মকাল বহুবিধ শোষণের শিকার তারাও যুদ্ধে অবদান রেখেছিল নানাভাবে, ইতিহাসে যাদের কথা কোথাও লেখা নেই। যাদের আমরা অনেক সময় অকৃতজ্ঞের মতো বাঙালি বলে পরিচয় দিতেও লজ্জিত হই। চৈতীরাণী তেমন একটি চরিত্রের যে কিনা পাক বাহিনী এবং চা বাগানের বাঙালি ম্যানেজার কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয় এবং দুটো পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। যুদ্ধশিশু দুলালকে অবশ্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে বিদেশি দম্পতির কাছে দত্তক দিয়ে দেওয়া হয়। ‘মাটি ও শস্যের বুনন’ উপন্যাসের পারুলিয়াকে আমরা দেখেছি যুদ্ধশিশুকে ঘৃণার বশে হত্যা করতে উদ্যত হয়। কিন্তু এখানে দেখা যায় চৈতীরাণী নবজাতক শিশু হারানোর শোক আজীবন বহন করে চলে। এই উপন্যাসে একাধিক কাহিনির বিস্তারকে ছাপিয়ে যুদ্ধশিশু দুলালের উৎস সন্ধানের নিরন্তর প্রচেষ্টা উপন্যাসের মূল পটভূমি হয়ে পাঠক হৃদয়ে জেগে থাকে। দুলাল তার পালক পিতামাতার কাছে সব জানতে পেরে প্রথমে ভেঙে পড়লেও পরে জন্মদাত্রী মা এবং জন্মস্থান অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে পড়ে। এই খুঁজে ফেরা প্রতিটি যুদ্ধশিশুর জীবনের বেদনাদীর্ণ প্রতিচ্ছবি। বীরাঙ্গনা ও তার যুদ্ধশিশু যুদ্ধের আগে পরে বহুমুখী অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। শোকের প্রেক্ষাপটে জেগে থাকে ক্ষত নিরাময়ের অযোগ্য আঘাত ও অপমানের স্মৃতি। পুরো উপন্যাসে দুলালের শেকড় খুঁজে বেড়ানোর আর্তি ও হাহাকার মিলেমিশে যুদ্ধশিশুর বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের নতুন করে ভাবায়। নাড়ির টানেই যেন দুলাল খুঁজে পায় মাকে। চারপাশে ঢোলের আওয়াজে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। মৃত্যু সন্নিকট হলেও মাতা-পুত্র দুজনেরই বিসর্জনের বাদ্য যেন হয়ে ওঠে হোলি খেলার উৎসব। এভাবেই লেখক যেন বাংলাদেশের মানুষকে সচেতনভাবে যুদ্ধশিশু আর বীরাঙ্গনা মায়েদের বরণ করে নেওয়ার জন্য উৎসবের আহ্বান করেছেন। যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য নারী নির্যাতন আর যুদ্ধশিশু একটি আদিম মারণাস্ত্র। সেই মারণাস্ত্রকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে হবে দেশবাসীকেই, মন-মানসিকতার পরিবর্তন ও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে ভয়াবহ মানবসৃষ্ট দুর্যোগের নাম সহিংস ধর্ম সন্ত্রাস বা লুকানো রিলিজিয়াস রেসিজম। এর বিষাক্ত ধোঁয়ায় আজ বাংলার আকাশও আচ্ছাদিত। শান্তিই নাকি পৃথিবীর সকল সম্প্রদায়গত ধর্মের গন্তব্য। তাহলে এই শতাব্দীর দ্বার প্রান্তে এসে এইসব আমরা কি দেখছি? মানুষের কল্যাণের জন্য যে ধর্ম তা নিয়েই কত রাজনীতি,মত বিভেদ, রক্তপাত, অত্যাচার, লাঞ্ছনা আর অশান্তি। ঔপনিবেশিক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের কারণে এই ধর্ম সন্ত্রাসের বীজ অনেক আগেই বাংলার মাটিতে বপন করা ছিল যা এখন বড় মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
ইতি-
সুস্মি
১৪ ফেব্রুয়ারি,২০২৫
পুনশ্চ: "আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি।"