গল্প - রূপশ্রী ঘোষ
Posted in গল্প‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’। ‘লড়াই করে বাঁচতে চাই’। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ‘সর্বক্ষয়ী দলের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’। ‘এই লড়াই লড়াই লড়াই চাই’। ‘লড়াই করে বাঁচতে চাই’। পাটুলির ফুটপাত দিয়ে একজন মধ্যবয়সী লোক হেঁটে যাচ্ছে আর নিজের মনে একাই এভাবে স্লোগান আওড়ে চলেছে। মধ্যবয়সী লোক, কিন্তু দেখে এক ঝটকায় কুড়ি পঁচিশ বছরের ছেলেও মনে হতে পারে। খুব শান্তশিষ্ট, ভদ্রসভ্য দেখতে। চোখেমুখে লেখাপড়ার ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু দৃষ্টিতে একটা কুটিল কুটিল ভাব আছে। রুহিও ওইপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। সে বারবার একই স্লোগান শুনতে শুনতেই হাঁটছিল। তারপর আর তার কৌতূহল চেপে থাকতে না পেরে একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেলল –
এই? আপনি কে? এমন এভাবে একাই মিছিলের মতো স্লোগান দিচ্ছেন? মিছিলে তো প্রথমে একজন বলে, তারপর পিছনের বহুলোক সমস্বরে ওই কথাটাই বলে বা প্রশ্ন হলে তার জবাব দিয়ে একটা গণগর্জন তুলতে তুলতে হাঁটে। আপনি এমন একাই এসব করছ, কী ব্যাপার?
আমার দল সর্বহারা।
মানে? আপনাকে দেখে একটু চেনা চেনা লাগছে। নাম কী?
আমার নাম এক্স।
এক্স? বললেই হল?
কেন? হবে না কেন? এত এক্স ওয়াই ধরে অঙ্ক করলেন আর আমার নাম এক্স শুনেই চিৎকার করছেন? ওইতো আমার এক মেয়ে বন্ধুর নাম ওয়াই। সেও ওই প্রোলেতারিয়েতদের দল করে।
প্রোলেতারিয়েতদের দল? মানেটা কী?
আরে প্রোলেতারিয়েত, প্রোলেতারিয়েত। যাকে বলে সর্বহারা। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ পড়েছেন? পড়লে ওখানে ওই শব্দটা পেতে্ন। আপনারা তো কিছুই পড়েন না। আমরা যারা সর্বহারাদের দল করি, তারা অনেক লেখাপড়া করি।
ও! তা আপনাদের ওই সর্বহারা দলটা সম্পর্কে একটু বুঝিয়ে দেবেন? কী কাজ করেন শুনি।
আরে ওই তো, আমাদের একটা ম্যা-ম্যা-ম্যানুফেস্টো আছে। সেটা পড়ে নেবেন। সব জেনে যাবেন।
অ। তা একটু গুছিয়ে বলতে কী হয়? একা একাই যখন মিছিলের স্লোগান দিতে দিতে হাঁটছেন তখন তো আপনার ... ওই কী বললেন, ম্যানুফেস্টো সম্পর্কে জ্ঞান দিতেও ভালো লাগা উচিত…
হ্যাঁ তা লাগে, তো আমার অত সময় নেই, সংক্ষেপে যা দাঁড়ায় তা হল আমরা প্রতিবাদ করি। খেটে খাওয়া মানুষদের সমান কাজ, সমান অধিকার চাই। দারিদ্র ঘোচাতে চাই।
ও, তাই নাকি? তা সর্বহারাদের দল যখন, তখন কি সব হারিয়েছেন? নাকি আপনাদের দলটাই হারিয়ে গেছে? চেহারা সাজ পোশাক দেখে তো কিছুই হারিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না।
আরে আমার কথা বলছি নাকি? আমি তো সর্বহারা জনগণের কথা বলছি।
ও, তো আপনি কে? প্রতিনিধি?
হ্যাঁ, বলতে পা্রেন।
আর আপনার ওই বন্ধু ওয়াই, সেও?
হ্যাঁ সেও। তার ইনফ্লুয়েন্সেই আমি এই দলটা করি। নাহলে আমি কোনো দলকেই ভোট দিতাম না।
তাই বলুন। কারণ আমি স্কুল কলেজ থেকেই আপনার মুখ চিনি। আপনি ওই ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছেলেটার মতো স্যুটকেশ হাতে নিয়ে, চুলের বাঁদিকে সিঁথি কেটে, ফার্স্ট বেঞ্চে ভালো ছেলেটার মতোই বসে থাকা বলে জানি। কলেজ টলেজেও ওই একইভাবে দেখেছি। কোনোদিন কোনো ইউনিয়নে টিউনিয়নে হাঁটতেও তো দেখিনি। আর এখন একাই হেঁটে হেঁটে একটা মিছিল বানিয়ে ফেলছেন?
আপনি আমায় চেনেন নাকি?
আমি আপনাকে চিনি। কিন্তু আপনারা আমাদের মতো লোককে চেনেন না। কেন বলুন তো?
এটা মগজ ধোলাই। এটা ওয়াই আমাকে শিখিয়েছে।
তা আপনার ওয়াই কি সর্বহারা?
না, সেও সর্বহারা নয়। তার অনেক টাকা পয়সা সম্পত্তি। বিদেশেও থাকে মাঝে। দেশেও অনেক বাড়ি গাড়ি।
ও বাব্বা! অবাক কাণ্ড তো মশাই। এতকিছু সম্পত্তি বাগিয়ে সে কিনা সর্বহারাদের প্রতিনিধি? আপনার কালটিভেট করতে ইচ্ছে হয়নি মশাই? আপনার সম্পর্কে তো অনেক অনেক ভালো ভালো কথা বলত সবাই। আপনি নাকি গোয়েন্দা গল্প সব গুলে খেতেন। তা আমাদের ফেলু মিত্তির আপনার মাথায় ধাক্কা মারেননি? আপনিও ওই দলে ভিড়ে গেলেন? আমি আসলে আপনারই পাড়ার মেয়ে, আর আপনার স্কুল কলেজেই পড়াশুনো। তাই আপনার সম্পর্কে অনেককিছু জানি।
ও তাই নাকি? তা কী কী জানেন?
সেসব পরে হবে। আপনি এখন আপনার ওই সর্বহারা দল নিয়ে বলুন কী কী জানেন। আমি বরং শুনি।
আরে সর্বহারা দল নিয়ে আর শোনার কী আছে, ও তো সবাই জানে। ওরা দুর্নীতি শুরু করেছিল বলে সব হারিয়েছে। আমি বরং শাসক দল নিয়ে বলি। ওদের সম্পর্কে আমার এখন শুনে শুনে অনেক ধারণা হয়েছে।
তা কী ধারণা হয়েছে শুনি…
আরে ওই যে রেলইয়ার্ডে কী সব ঘটল না, সেটার পিছনে কার হাত, কত বড়ো হাত সব ওয়াই আমাকে বলেছে। আর বলেছে ওই দলের প্রধান যিনি তিনি নাকি কোনো নারীকেই সম্মান করেন না।
ও তাই নাকি? তা আমিও শুনেছি বটে। কিন্তু আপনার সম্পর্কেও নাকি ওই একই কথা শোনা যায়…
মানে? আমার সম্পর্কে কেন শোনা যাবে? আমি কি কোনো বড়ো নেতা বা নেত্রী?
না, আপনি নেত্রী নন তো বটেই। আপনি পুরুষ। আপনার নামও এক্স।
তো? তাহলে কী শুনেছেন? আমি বিখ্যাত কেউ নই।
না, মানে খুব বিখ্যাত কেউ নন। কিন্তু আপনি যতটুকু বিখ্যাত হয়েছেন তা ওই কু কেলেঙ্কারি দিয়েই।
মানে? আপনি আমার সম্পর্কে এসব কোথায় শুনেছেন? কী শুনেছেন? এইজন্য আপনি এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন? এসব বলবেন বলে?
এক্স গজগজ করতেই থাকলেন। রুহি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে এক্সকে উস্কিয়ে দিয়ে হনহন করে হেঁটে গেল। আসলে রুহি আর ভূতের মুখে রামনাম সহ্য করতে পারছিল না। একই পাড়ায় থাকার দৌলতে সে তার সম্পর্কে কিছু কেমন কথা জানে। আর বাঙালির স্বভাবেই তো তা আছে। পরচর্চা পরনিন্দা। কিছু ঘটালে কেউ তা শুনবে না এটা হতে পারে না। খবর হাওয়ার থেকে, আলোর থেকে আগে দৌড়োয়। মুখরোচক খবর হলে তো কথাই নেই। রুহি ভাবছে, লোকটাকে ভালো জবাব দেওয়া গেছে। আবার দেবে একদিন। ও খেয়াল রেখেছে ওখান দিয়ে নাকি ওই ভদ্রলোক দুবেলা হেঁটে যায়। কোনো কোনোদিন দুবেলা না হলেও একবেলা তো মাস্ট। অতএব চিন্তা নেই, আবার ধরা যাবে। ভাবতে ভাবতে রুহি নিজের মনে হাঁটতে লাগল। রুহিও কাজ থেকে ফেরার সময় বা যাওয়ার সময় হাতে টাইম থাকলে একটু হেঁটে নেয়। ওভাবে যাওয়া আসার পথেই তার চোখে পড়ে ওই ভদ্রলোকের মিছিল। কিন্তু কোনোকিছুতেই তার কৌতূহল মেটে না। এই যেমন রান্নাঘরে সে যখন কাজ করে জানলা দিয়ে দেখতে পায়, উপরের তলা থেকে নিচের দিকে কী যেন একটা উড়ে গেল। কী উড়ে যায় সে কোনোদিন দেখতে পায় না। তাই সে ভাবে কালো পাখি বা কালো প্লাসটিক প্যাকেট বা কালো কোনো কাপড়ের টুকরো। কিন্তু কালো যে, সেটা সে স্পষ্ট বুঝতে পারে। অন্য কোনো রঙ নয়। কালোই দেখে সে। এই কালো নিয়ে তার ভয় সারা জীবনেও যায় না। ছোটো থেকেই ভাবত, চা খেলে কালো হয়ে যায়, শাক খেলে কালো হয়ে যায়, কালো লোক দেখে ভয় পায়, কালো ছেলে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না, আর অন্ধকারের কালো দেখলে তো কথাই নেই। সে অন্ধকারকে ভয় পায় কালো বলেই। একবার তো শিয়ালদা থেকে রাজাবাজার যাওয়ার সময় বাসে কন্ডাক্টরকে বলেছিল, ‘কালোটাকা আমি নেব না’। গোটা বাস হো হো করে হেসেছিল কিন্তু সে তার ‘কালো আর ময়লা’র ক্যাবলামির তফাৎ করতে পারেনি। রুহি এসব ভাবতে ভাবতেই আবার এক্সের চিন্তা নিয়ে পড়ল। তার মনে হল, ‘আচ্ছা এক্স যে সর্বহারা দলের প্রতিনিধি বলল, কিন্তু সে তো কই সাদা ফতুয়া আর সায়ার মতো বা তার থেকেও বেশি ঢোলা পাজামা পরে হাঁটতে দেখেনি। মনে মনে ভাবল, ‘ছোটোবেলায় তো পুকুর পাড় দিয়ে যে মিছিল হেঁটে যেত তার নেতাদের বেশিরভাগ লোকই ওইরকম সাদা পোশাক পরে হাঁটত। তাহলে কি যুগের সঙ্গে পোশাক বদলে গেল আর দলটার নাম আর এজেন্ডা এক রয়ে গেল’? রুহির এ আর এক সমস্যা। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যেন নিজেই নিজের পেটের ভিতর থেকে টপিক বের করে আর ভাবতে থাকে। এমন ভাবতে ভাবতে সে কতবার ভাত তরকারি পুড়িয়ে ফেলেছে। তবুও তার ভাবা চাই। যা বলা সত্যিই তাই। ভাতের ফ্যান উপচে পড়ে গোটা রান্নাঘর, গ্যাস ওভেন সব নোংরা হয়ে গেল। আবার সবকিছু ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতে হবে। এই নোংরা ব্যাপারটাও তার পছন্দ নয়। নোংরা ঘটনা, নোংরা দৃশ্য, নোংরা ছবি…। অবশ্য ও যেগুলো নোংরা ছবি বা ভিডিও ভাবে সেগুলো আসলে অন্যদের কাছে রোম্যান্টিক। ও নিজেই একটু কেমন খুঁতখুঁতে পুরোনো পন্থী। এই নিয়ে সে ঝাড়ও খায় বন্ধুবান্ধবদের কাছে। এই দ্যাখো পুরোনো কথাটা মাথায় আসতেই সে আবার ভাবতে বসল, ‘এক্স কেন সবুজের কালো হাত বলল? সবুজ তো নিজেই পুরোনো। সেই কবে ক্ষমতা থেকে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। ওরাই তো সাফ করে দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। এখন সে দলও তো সর্বহারা। ইনফ্যাক্ট সর্বহারাদের সঙ্গে তারা জোটও তো বেঁধেছিল দু একবার’। এবার রুহি ঠিক করেই নিল, যেভাবে হোক ওই ভদ্রলোককে রাস্তায় পেতেই হবে। নাহলে চলবে না। যা ভাবা তাই করা। যাওয়া আসার পথে রুহিও যেন ওত পেতে বসেছিল, শিকারীর মত। এক্সকে দেখতে পেয়েই সে খপ করে ধরল –
আরে মশাই দাঁড়ান দাঁড়ান। আপনি ওভাবে সেদিন মিছিলে সবুজের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও বললেন কেন? ও তো অনেক পুরোনো দল, সে তো আপনারাই সাফ করেছিলেন…
না, মানে ইয়ে (প্রথমে রুহিকে এড়িয়ে পালাবে কিনা ভাবছিলেন) মানে, মানে আমরা তো প্রথম থেকে ওই দলটাকেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে শিখেছি, পুরোনো অভ্যেস আর কী। আর তাছাড়া ঘাস পাতা জুড়ে বর্তমান দল ক্ষমতায় এলেও আসলে তো শিকড় ওখানেই পোঁতা ছিল। তাই আমরা ওটা থেকে আর বেরোতে পারছি না…
হ্যাঁ তা বুঝলাম মশাই। কিন্তু ওই দল তো এখন আপনাদের মতোই সর্বহারা। আর আপনাদের সঙ্গেই জোট বেঁধে শক্ত পোক্ত একটা দল গড়তে চাইছে। তা আপনারা যে, এই স্লোগান দিচ্ছেন তাতে তাঁদের নেতা নেত্রীরা রাগ করছেন না?
না, মানে আমাদের এখন একটাই লক্ষ্য। এই ক্ষমতাটাকে সরাতে হবে আর ওই হিন্দু দলটাকে আসতে দেওয়া যাবে না। তাই আমরা যা খুশি তাই বললেও ওরা গায়ে মাখছে না। কারণ লক্ষ্য তো এক। তাই লক্ষ্যবস্তুর দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে যেটা ভালো বা যেমনভাবে এগোলে লক্ষ্যে পৌঁছোনো যাবে আমরা সেভাবেই এগোচ্ছি।
ওরা মেনে নিল? এতবড়ো একটা অপবাদ…?
মানবে না কেন? কালো হাত কী ছিল না? কালোই তো ছিল। তাই মানতে বাধ্য। বলুন তো সেই চালে কাঁকর মেশানো থেকে শুরু করে জরুরি অবস্থা হেনতেন আর কী কী শোনেননি বলুন? ওরাও কি অস্বীকার করতে পারবে? পারলে তো ট্যাঁ ফোঁ করত এই স্লোগান নিয়ে …। কেন করছে না তাহলে... এবার আপনিই বুঝুন। আর শুনুন আপনি এমন মাঝে মাঝেই শিকারীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে অ্যাটাক করবেন না তো? আমার ভয় করে আপনাকে দেখলেই?
কেন? ভয়ের কী হল? আমি কি কামড়ে দেব আপনাকে?
না তা নয়, কিন্তু আপনি বড্ড প্রশ্ন করেন। এই এত প্রশ্ন আমার ভালো লাগে না। এত কৈফিয়ত আপনাকে দিতে যাবই বা কেন?
আরে, এ আপনার দোষ নয়। এটা গোটা পুরুষ জাতির দোষ। তারা প্রশ্নে ভয় পায়। বিশেষ করে ব্যক্তিগত প্রশ্নে। আপনিও তো পুরুষ, তাই আপনার ভয় পাওয়াতে আমি অস্বাভাবিক কিছু দেখছি না
একি? আপনি আবার জাত তুলে কথা বলছেন? আমি তো কই জাত তুলিনি, আমিও যদি নারী জাতি বলে গালাগাল দিই? আপনার ভালো লাগবে?
ভালো লাগা না লাগার কিছু নেই মশাই। আপনারা এখনো গালাগালি, শাপ শাপান্ত, আধিপত্যবাদ চালিয়েই যাচ্ছেন মেয়েদের উপর। আপনারা তো মেয়েজাত বলেই আর রাত হলেই ধরা বাঁধা কোনো নারী না থাকলে সোনাগাছি ছোটেন। আপনাদের কথা ছাড়ুন মশাই। ও না না সোনাগাছি না, আজকাল কী যেন নতুন নাম শুনি, এসকর্ট গার্ল। তা মশাই আপনিও যান নাকি?
এই শুনে তো এক্স আবার রাগে খাপ্পা। আবার গজগজ করতে করতে চলে গেল। নেহাত শান্তশিষ্ট লোক বলে তাই রুহির রেহাই। নাহলে হয়তো কোনোদিন বলে বসত বাড়িতে গুণ্ডা পাঠাব…। যতই হোক রাজনীতি বলে কথা। রুহি মনে মনে ভাবে, এক্স যতই সর্বহারা দলের হয়ে এখন গুণগান করুক না কেন, ওর নিজস্ব কিছু বুদ্ধি সুদ্ধি আছে বলেই মনে হয়। কারণ কখনো সখনো ওদের দলের খারাপ কাজ নিয়ে সমালোচনা করতেও সে শুনেছে। তাদে।।সর্বক্ষয়ী দলের মতোই বহু খারাপ কাজ, বহু দুর্নীতিকে এক্স সাপোর্ট করে না। এইসব ভাবতে ভাবতেই রুহি সর্বহারা দলের খারাপ কাজ এবং দুর্নীতিগুলোর একটা তালিকা তৈরি করে ফেলল। নেক্সট দিন এক্সকে দেখতে পেলেই সে সরাসরি তার মতামত জানবে বলে। দু একদিন সেই তালিকা নিয়ে আসা যাওয়ার পথে এক্সের খোঁজ করল আপন মনে। কোথাও খুঁজে পেল না তাকে। একটু হতাশ হল রুহি। কী ব্যাপার, আর দেখা যাচ্ছে না কেন এক্সকে। সে কি চাকরি ছেড়ে দিল? এ পাড়া থেকে অন্য পাড়া চলে গেল? নাকি অন্য দেশ? সুস্থ হল না তো? নানান উদ্ভট প্রশ্ন রুহির মাথায় ঘুরতে লাগল। লাগারই কথা। সে তো ভেবে রেখেছে দেখা হলেই সর্বহারা দলের দুর্নীতি বিষয়ে তার মতামত জানতে চাইবে। যতক্ষণ না পাচ্ছে উত্তর ততক্ষণ শান্তি নেই। এইসব ভাবনার মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতেই রুহি অফিস গেল। ফেরার পথে সিমেন্ট ব্রিজের নিচে ভিড় হট্টগোল থেকে সেও থমকে গেল। সে দেখল বিভিন্ন দিক থেকে গাড়ির লম্বা জ্যাম। সে এঁটুলি মোড় থেকে হেঁটে ফেরে বলে তার অসুবিধা হয়নি, মোড়ে জটলার কাছে পৌঁছে সেও হতবাক হয়ে গেল। ওখানে একটা বড়সড়ো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। গোটা রাস্তা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। ওখানে মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে বসে এক্স হাউহাউ করে কেঁদে চলেছে। কিছুতেই তাকে কেউ থামাতে পারছে না। কেন কাঁদছে তাও কেউ তার কাছ থেকে বের করতে পারছে না। রুহি ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল। গিয়েই এক্সের কাছে জানতে চাইল,
কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন এমন করে?
(কেঁদেই চলেছে এক্স, কোনো উত্তর নেই)
আরে বলুন কী হয়েছে? গোটা রাস্তা জ্যাম হয়ে গেছে তো। চারদিক পুরো ব্লকড। কী হয়েছে আপনার ? এমন কী হল যে, পুলিশও তোমাকে তুলতে পারছে না? কলকাতার রাস্তায় এমন অ্যাকসিডেন্ট, রক্ত, এমনকি প্রকাশ্যে দিনের আলোয় শুট আউট করে খুনও তো ঘটে থাকে। আপনি কি সবসময় এমন অ্যাক্সিডেন্ট দেখে শোরগোল বাঁধিয়ে দাও নাকি?
রাস্তার এমন বেহাল অবস্থা দেখেই রুহি জোরে জোরে ধমক দিচ্ছিল এক্সকে। তারপর একটা সময় এক্স নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে শুরু করল, ‘এই রক্তই তো সেই রক্ত, যে রক্ত দিয়ে আমার দল, দলের নেতারা বৃদ্ধা মাকে ভাত মেখে দিয়েছিল। এ তো সেই রক্ত। আমি তো এই রক্তের মধ্যে সেই বৃদ্ধা মায়ের যন্ত্রণা দেখছি। আপনারা তো সাধারণ অ্যাকসিডেন্টের রক্ত বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন, ঘটনাটা তাচ্ছিল করছেন, লঘু করে দিচ্ছেন, কিন্তু আমি তো তা পারছি না। যতই আমার দল হোক, আমি যতই সেই দলের প্রতিনিধি হই না কেন, রক্ত দেখলে আমার সেই বৃদ্ধা মায়ের যন্ত্রণা ছাড়া কিচ্ছু আসে না চোখের সামনে। আমি দেখতে পাই দুয়ার ভেসে যাওয়া সেই রক্ত, উঠোন ভেসে যাওয়া সেই রক্ত, মায়ের বুক ভেসে যাওয়া সেই রক্ত… লাল, চারিদিক লাল, কেবল লাল, টুকটুকে লাল রঙ ছাড়া আমি আর কিচ্ছু দেখতে পাই না, লাল, চারিদিক লাল, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত সব লাল…। দুহাত রাঙিয়ে নিয়ে আমরা সর্বহারা…। আমরা রক্তপতাকা, আমরা লড়াই চাই। লড়াই লড়াই লড়াই চাই। লড়াই করে বাঁচতে চাই…’। এক্সের কান্নার তীব্রতা আরও বেড়ে গেল। রুহি রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মুখে আর কোনো কথা নেই, ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে প্রশ্নের তালিকাটা বের করে ছিঁড়ে কুচিয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে দিল…। ধীর, ক্লান্ত পায়ে রুহি আবার হাঁটতে শুরু করল বাড়ির দিকে…। এক্সের মতামত নিয়ে রুহির আর কোনো বক্তব্য নেই!
মোড়ের মাথায় লাল সিগন্যাল। সব গাড়ি দাঁড়িয়ে। মানুষ কিন্তু চলেছে। পায়ে, পায়ে এগিয়ে চলেছে ক্লান্ত, বিষণ্ণ মানুষ। লড়াই করতে করতে তারা আর লড়াই করতে চায় না। বাইপাসে লম্বা যানজটে গাড়ির পর গাড়ির ভিতর, অ্যাম্বুলেন্সের পর অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের ভিতর দিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস পাক খাচ্ছে চারিদিকে।
সিগন্যালের রঙের বদল হচ্ছে না। সব থমকে আছে।