Next
Previous
0

গল্প - জাকিয়া শিমু







আকাশে সুরমারঙের মেঘের দল, ছুটোছুটি ভুলে যেয়ে হঠাৎ করেই যেন দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপর মেঘের বরন কালো হয়ে পাহাড়ের মতো জমাট বেঁধে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে ভাবছি-এমন ভারি মেঘে নির্ঘাত বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি হলে পাল-পাড়ার মাঠে গোঁড়ালী-ছুঁয়া পানি জমবে। ফুটবলটি মাঠের ধারে অশথগাছের জটাতলে লুকানো আছে। কথা আছে- আকাশ কালো হতে সবাই গাছতলায় জড়ো হব! লাল-হলুদ দলের গতকালের বাকি খেলাটুকু আজ বৃষ্টির ভেতর শেষ হবে। বাকিরা হয়তো এতক্ষণে এসে গেছে! আমি মায়ের কাছ থেকে কোন ছুতু ছাতায় ছাড়া পেলে ভূদৌড়ে ছুটে যাবো মাঠে! কিন্তু মা জিগাআঠার মতো আমার গায়ে আরাম করে হেলান দিয়ে কুরুশকাঁটায় সোয়েটার বুনছেন। আমি খাঁচায়বন্দী চড়ুইয়ের মতো ছটফট করছি। এসময়ে সত্যি সত্যি আকাশ ছেড়ে মেঘেরদল ঝুমঝুম ছন্দে ঝরতে শুরু করলো আর তখনই আমার স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেল!

ঘুম ভাঙ্গলেও টিনেরচালে বৃষ্টির ঝুপঝাঁপ-শব্দ আমার কানে রয়ে যায়! আমি জেগে উঠলাম নাকি এখনো স্বপ্নলোকে আছি, বুঝতে পারছি না। ঘরের এককোণায় হারিকেনের মৃদু আলো দেখি। বুঝতে পারি এখনো রাত কাটেনি কিন্তু সময় রাতের কোনভাগে বইছে, ঠাহর করতে পারি না। কান পেতে শুনি,দূরে তাঁতিপাড়ার মাকুর ছন্দধ্বনি। এরপর পাশেরবাড়ির জগা কাকার লালমুরগের ডাক। ভোরের খুব পরিচিত এসব শব্দ শেষরাতের ইশারা দেয়। আরও পরে খোলাসা হই, ও-যে টিপটপ শব্দ তা বৃষ্টি নয়, শিউলি ঝরার শব্দ। এখন আশ্বিন মাস। আমাদের ঘরঘেঁষা পুরনো শিউলিগাছের লম্বা ডাল ঘরের চালের উপর ঝুলে আছে। ডাল থেকে বোটা খসে টুপটাপ শব্দে ফুল ঝরছে টিনের চালে। এসময় আমি অধীর অপেক্ষায় থাকি; কখন বাবা জেগে উঠবেন! এবং খট আওয়াজে কপাটের খিল খুলবেন। কপাটের একপাশটা খুলতেই বাবার হাতের কনুঁয়ের ঠিক নিচ দিয়ে সচেতন পায়ে, মা জেগে উঠার আগে বাড়ির সীমানা পেড়িয়ে যাবো! বাবা মৃদু হাসবেন, ও প্রশ্রয়ের হাসি। ও হাসি আমার সারা দিনের সমস্ত দস্যিপনার আশ্রয়। আমি অনেকটা পথ দৌড়ে বাড়ির পূবদিকে বাংলাঘরের ছঞ্চাতলে খানিকক্ষণ জিরোব। তখনও ভোরের নীল আলো ঠিকঠাক ফোটে ওঠে নাই। আমাদের বাড়ি বেশ পুরনো আমলের,কয়েক পুরুষ ধরে বসবাস। চার-পাঁচ পুরুষ আগে লাগানো গাছপালায় ভর্তি। রাতে এদের দিকে তাকালে ভয় ধরে যায়। মনে হয় যেন অন্ধকারের পাহাড়! বাড়ির সীমানা ছাড়াতে এক চিলতে নদী-আশ্বিন মাসের পাতলা মেঘের মতো শান্তস্নিগ্ধভাবে বয়ে চলেছে। আমি নদীপাড়ে যেয়ে থামি। অন্ধকার তার শাড়ির আঁচলের ভাঁজ পড়তে পড়তে খুলতে শুরু করে। ততক্ষণে নদীর অপরপাড়ে ঠাকুরঘরের কাছ ঘেঁসে বিশাল যে বটগাছটা আছে,তার মাথা বেধ করে লাল টকটকে গর্ভিণী গোলকাকৃতির সূর্যটা আড়মোড়া ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে। অন্ধকার পুরোপুরি বিদায় হয়। সকালের সকালের স্নিগ্ধকোমল রোদের চাদর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।

নদীরপাড় ঘেঁষে সাপের দেহের মতো আঁকাবাঁকা সরু চিকন মেটেপথ। পথের দু’ধারে অসংখ্য বন-গুল্ম, ঝোপঝাড়- লতাপাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের গায়ের বুনোগন্ধ হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। সে হাওয়া গায়ে মেখে অচেনা একস্বপ্ন পথে আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে চলি। পথে বিছানো দূর্বাঘাসের গায়ে লেপটে থাকা শিশিরের আদরস্পর্শে আমার খালি পা ভিজে ওঠে। নদীর দু’পাশে জেগে উঠা চরে অসংখ্য কচুঁরীপানা আটকা পড়ে আছে। বিস্তীর্ণ তীরজুড়ে রঙের খেলা। হালকা গোলাপির মাঝে নীল আর বেগুনির বেষ্টনী মাঝখানে হলুদের ছুঁয়া- একফুলের পাঁপড়িতে এমন অসংখ্য রঙয়ের আলপনা অন্যকোনো ফুলে আছে বলে আমার জানা নেই। দু’হাত ভরে কচুরিপানা ফুল নিয়ে আমি আবার পথ ধরি।

খানিকটা পথ পেরুলে পথটাকে বাঁশে্রসাঁকো ঠিক মাঝ বরাবর চিঁড়ে আলাদা করে দিয়েছে। পথের ও-প্রান্তে যেতে হলে সাঁকো পেরুতে হবে! আমার সাঁকোতে বড্ড ভয়! একদিন সাঁকোর মাঝ বরাবর যেতে পা পিছলে ধপাস করে পানিতে পড়ে যাই। ভাগিস্য, জগাচাচা অল্পদূরে তিনকোণা জালে ইচা মাছ ধরছিলেন। আমাকে জল কাদায় মাখামাখি অবস্থায় তুলে এনে, চাচার সে কী হাসি! আমি ভয় আতঙ্কে কেঁদেকেটে অস্থির। চাচার হাসির কারণ অবশ্য অমূলক নয়। সাঁকোর নিচের জলের গভীরতা ছিল আমার শরীরে উচ্চতার অর্ধেক। আমি ভয়ে পানিতে না দাঁড়িয়ে, শুয়ে পড়ে একহাড়ি জল পেটে পুরেছি। কিন্তু সাঁকো যে আমাকে পার হতেই হবে।

আমার গন্তব্য ক্ষেত্রমোহন দাদার বাড়ি। বাবা ডাকেন ক্ষেত্রদা’। আমিও তাঁকে সে নামেই ডাকি। অবশ্য দাদার বউকে জ্যাঠি ডাকি। জেঠিকে আমার ভিন্ন জগতের মানুষ মনে হয়। আমার সাথে তার তেমন আলাপি সখ্যতা নেই, আমার ধারণা অনেকের সাথেই নেই। তিনি ভারী ব্যক্তিত্বের মানুষ। তাঁর ব্যক্তিত্বের আব্রুবেড়া ভেদ করে সংস্পর্শে আসতে পারে খুব অল্পসংখ্যক মানুষ। তবে আমাকে সে খুব স্নেহ মমতায় জড়িয়ে রাখেন। তা অবশ্য আমি বুঝতে পারি। আমি তাঁকে ভয় নয়, সমীহ করি। আমি আজ অবধি তার পুরো মুখখানা দেখতে পাইনি। শুভ্র সাদা জমিনে লালপেড়ে তাঁতের শাড়ির আঁচলে মাথার ঘোমটা কপাল পেরিয়ে চোখের খানিক অংশ ঢেকে থাকে। হেসে উঠলে তার পান খেয়ে লাল করা ঠোঁট দু’খানা ভারি রহস্যময় লাগে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁকে দেখার চেষ্টা করি। ভাঁজপড়া কপালে লাল টকটকে চন্দনের টিপটাকে আমার কাছে চোত- মাসের পরিষ্কার আকাশে ভোরবেলার লাল টকটকে সূর্যটার মতো মনে হয়। সদ্য স্নানে লম্বা এলোমেলো চুলের গুছা আঁচল পেরিয়ে কোমরে এসে দোলে। আমি বিস্ময়ে চেয়ে থাকি। পুজোর ডালা হাতে তুলসি তলে তাঁর উলুধ্বনি আমাকে কেমন উদাস করে তোলে। সাদা ধবধবে সুতির লাল পেড়ে শাড়িতে শীর্ণ দেহটাকে কলার খোলসের মত করে ঢেকে যখন ধীর পায়ে সারা বাড়ি হেঁটে বেড়ান,আমার মনে হয় মেঘেরদেশ থেকে নেমে আসা শরৎ মেঘেরকন্যা বুঝি মাটিতে নেমে এসেছে। আমার পাঁচ বছর বয়সের কল্পনাজল্পনার প্রায় সমস্তটাই এই মেঘকন্যাকে ঘিরে!

আমি সকাল হলে প্রায়ই এ-বাড়ি চলে আসি। বিশেষ করে হাটবার হলে তো কথাই নেই। আমার বাড়িতে আমার ঠিকঠাক স্বাধীনতা নেই। আমার মায়ের প্রায় সবকিছুতে শাসন, বাধা। আমার অমন বদ্ধ চলায় চরম অনীহা। রাতে বাড়ি ফিরে অবশ্য নিয়মমাফিক মায়ের তালপাতার পাখার প্রহার অবধারিত! ওসব উপেক্ষা করে আমি ক্ষেত্র’দা’র বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করি। বাড়ির বাইরের পথঘাট ঠিকঠাক চিনি না, তবে এবাড়ির পথ আমার জানা। বাঁশের সাঁকোর ওপারে খানিকটা পথ পেরুলে স্বর্ণলতায় জড়ানো বরই গাছটা ঘেঁষে, ডান দিকে খেতেরআল বেঁয়ে যে পথটা গিয়েছে, সেখান থেকে ক্ষেত্র’দা’র বাড়িটা স্পষ্টই দেখা যায়। বাবার সাথে সেই বুঝতে অবুঝ বেলা হতে এপথ ধরে আসা যাওয়া।

ক্ষেত্রদা’র বাড়িটি পটে আঁকা ছবির মতোন। বাড়ির তিন পাশটা জুড়ে ফসলের মাঠ, সেসব ছাড়িয়ে আরও দূরে- ধু ধু চোখে পড়ে গাছগাছড়ায় জড়িয়ে থাকা লোকালয়। বছরের বিভিন্ন ঋতুতে নানান রঙবর্ণের ফসলে ভরে ওঠে মাঠগুলো। অপরপাশে ময়না পিসির বাড়ি। ময়না পিসিকে নিয়ে আমার তেমন মাথা ব্যথা নেই! অবশ্য ময়না পিসিও তাবৎ দুনিয়ার কিছুকে পাত্তা দেন বলে মনে হয় না। একখানা পাড়বিহীন শাদা শাড়িতে নিজের শীর্ণকায়া দেহটাকে অবিন্যস্তভাবে গুঁটিয়ে রাখেন। আধঃমাথায় ঘোমটা মাঝেমধ্যে টেনে রাখলেও আব্রুসচেতনটা নিয়ে তার কোন বাড়তি আগ্রহ নেই। সারাদিন নিজের মনে বিরবির করে কথা বলেন। মেজাজের আঁচ অতি উষ্ণ। কথায় কথায় ছ্যাঁত করে উঠেন! দিনের বেশিরভাগ সময় ঘরের ভেতর থাকেন। পারতপক্ষে কেউ তাকে ঘাটায় না। ক্ষেত্রদাকে বলতে শুনেছি; অল্প বয়সে একমাত্র ছেলে নিয়ে বিধবা হয়েছেন। ছেলে লায়েক হয়ে ওপার বাংলায় চলে গিয়েছে। মা কে অবশ্য নিজের কাছে নিতে চায় কিন্তু তিনি কিছুতেই স্বামীভিটে ছেড়ে যাবেন না। স্বামীর ভিটে থেকে সরাসরি চিতেয় যাবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। ক্ষেত্রদা’র কাছের স্বজন, তিনিই তাকে দেখাশুনা করেন। আমি খুব প্রয়োজন না হলে তার সীমানায় ঘেঁষি না। তবে ময়না পিসির ভিটেয় একটি কাঁচামিঠে বরই গাছ আছে। গাছেরতলা বিছিয়ে থাকে ঝরা-বরই। মাঝেমধ্যে লোভ সামলে উঠতে না পেরে সুযোগ বুঝে বরইতলায় ঝাঁপিয়ে পড়ি। আর তার চোখে পড়লে রক্ষা নেই, মরা চিৎকার জুড়ে দেন! কী নাকি জাতপাত চলে যায়! আমি মুসলিম, সে সনাতন। আবার ক্ষেত্রদা’, জেঠি এরাও সনাতন। এদের জাতে ঘা না লাগলেও ময়না পিসির জাত যায়। এতসব জটিল কথা বুঝি না, আমি দ্রুত তার উঠোন থেকে পালিয়ে আসি!

ক্ষেত্রদা’ আমাকে তাঁর মেয়ের মতো ভালোবাসেন। তাঁর বাড়িটা আমার নিজের বাড়ির চেয়ে আপন মনে হয়। এখানে আমার স্বাধীনতার ঘাটতি নেই। যা খুশি তাই আবদার চলে। এবাড়িতে সুখের কোন অভাব নেই। তবে বিশেষ একটি দিনে এ-বাড়ির চালচিত্র একদমই মরাবাড়ির মতো হয়ে যায়! সেইদিনে,কালিপদ পোষ্ট মাষ্টার একটা ঝুলি কাঁধে নিয়ে ‘ক্ষেত্রমোহন মহাশয় বাড়ি আছেন’-বলে দরাজ গলায় হাঁক তুলেন। ক্ষেত্রদা’ হয়তো তুলসিতলা ঘেঁষে যে পড়ো-ভিটেটি পড়ে আছে,সেখানে বসে নির্ভারে হুক্কা টানছেন। এবং আমি তাঁর পাশে বসে খড়ি দিয়ে মাটিতে আঁকাঝুঁকি করছি। কালিপদ’র হাঁক শুনে ক্ষেত্রদা’র কুচকুঁচে চেহারায় আরেক প্রস্ত কৃষ্ণবর্ণের প্রলেপ পড়ে। হুঁকা থেকে মুখ তুলে নিয়ে আমাকে চোখের ইশারায় কালিপদ পোষ্ট মাষ্টারের কাছে যেতে বলেন।

আমি হাতের খড়ি ছুঁড়ে ফেলে, এক লাফে কালিপদ পোষ্ট মাষ্টারের সামনে যেয়ে দাঁড়াই। কালিপদ তাঁর কাঁধে ঝুলানো লম্বা খাকি রঙয়ের ঝুলা হতে অনেকগুলো নীল খামের ভিতর থেকে একটা নির্দিষ্ট খাম আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ময়না পিসির উঠোন দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়! জেঠি হয়তো রান্নাঘরে মাটির হাঁড়িতে উপচে পড়া ভাতের ফেনা সামলে উঠতে ব্যস্ত। সেকাজ ফেলে হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকেন, যাতে খামটা দাদার হাতে না পড়ে। আমি নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে হাত বাড়িয়ে নীলখামটা জেঠির হাতে দিয়ে ভুদৌড়ে শূন্যভিটেয় ক্ষেত্রদা’র গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু পরিচিত সেই ক্ষেত্রদা’কে আর খুঁজে পাই না। তিনি বিমর্ষ মুখে চুপচাপ বসে থাকেন! সারাদিনে মুখে আর বাক্য ফুটে না! জেঠিও মুখ গোমরা করে থাকেন। ক্ষেত্রদাকে উদ্দেশ্য করে নিজের মনে কথা বলেন! এসময়ে ময়না পিসি ক্ষেত্রদা’র দলে ভিড়েন। ময়না পিসির ছেলের সাথে ক্ষেত্রদা’র দু’ছেলেও চলে গেছেন ওপার বাংলায়। ক্ষেত্রদা’ ভুলেও তাদের নাম মুখে আনেন না। এরপর জেঠির চাপাচাপিতে সন্ধ্যা নামলে ক্ষেত্রদা’ তাকে নিয়ে আমাদের বাড়ি আসেন। আমার বাবা গম্ভীর হয়ে নীল খামের ভেতর থেকে পত্র বের করে তাদের পড়ে শুনান। ক্ষেত্রদা’ হু হু করে কেঁদে ওঠেন। পত্রের ভারি কথাগুলো আমার বোধগম্য হয় না যদিও এসময় আমি ক্ষেত্রদা’র গা লেপটে পোষা বিড়ালের মতো বসে থাকি।

ক্ষেত্রদা’র বাড়ির দক্ষিণদিকে দমকলের পানি, নালার পথ ধরে ছুটে যায়, দূর ধানক্ষেতের মাঠে। নালার জল কুচকুচে কালো কিন্তু পরিষ্কার। আমি নালারপাড়ে দু’পা ঝুলিয়ে গোঁড়ালী জলে ভিজিয়ে বসে থাকি। দত্তপাড়ার বউ-ঝিরা এসময় সংসারের যাবতীয় বাসি কাপড়,বাসন কোসন পরিষ্কার করতে নালের পাশে ভিড় করে। এবং নিজেদের সুখ দুঃখের গল্প পাতে। আমি সেসব গল্পে কান পাতি। ওসব গল্পের পুরোটাজুড়ে দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষের কষ্টের কথা থাকে। এপার বাংলা ছেড়ে, যারা ওপার বাংলায় গিয়েছে তাদের বিভিন্ন দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভরে এসব আপনজনের কাছে নীলখামে চিঠি আসে। ক্ষেত্রদা’র মতো চিঠি পেয়ে এরাও ফুঁপিয়ে কাঁদে। একসময় এরা একে একে গোপনে বাড়িঘর বেচাবিক্রি করে নিজদেশ ছেড়ে ওপারবাংলায় চলে যায়। কেনো চলে যায় কিংবা কীসের বেদানায় কাঁদে আমি তখনো এসবের কিছুই বুঝি না তারপরও ওদের কষ্টে আমার বুকটা ভার হয়ে আসে।

ওদিকে ক্ষেত্রদা’র বেলা বয়ে যায়। আজ হাটবার। হুঁকায় গুটিকয় টান দিয়ে আমাকে নালার পানি ছেড়ে উঠে আসতে তাগাদা দেন। আমি ফিরে এসে সকালের নরম রোদমাখা শূূন্যভিটেয় শীতলপাটির বিছানায় জোড়াসনে বসে পড়ি। ক্ষেত্রদা’র বাড়িতে বছরজুড়ে নাড়ুমুড়ির আয়োজন। পূজাপার্বণে অবশ্য পদের সংখ্যা ঢের বেশি থাকে। দুধের ক্ষীর দিয়ে বানানো নারিকেলের নাড়ুর সাথে বাড়িতে ভাঁজা কালিকোড়া চালের মুড়ি অমৃতসম। জেঠি বাঁশের সাজিতে মুড়ির ঠিক মাঝখানে নানান পদের নাড়ু সাঁজিয়ে আমাদের সামনে রাখেন। ক্ষেত্রদা’ আমাকে তাড়া দেন, সবজি তুলতে বেলা বয়ে যায়- হাটবার বলে কথা। কিন্তু ওরকম স্বাদের পদ রেখে উঠতে আমার বড্ড দেরি হয়ে যায়। একসময় ক্ষেত্রদা’ চাঙ্গাড়ি কাঁধে নিয়ে ভিটের পথে হাঁটতে শুরু করলে আমি বাকি নাড়ুমুড়ি কুঁচরে পুরে তাঁর হেঁটে যাওয়া পথে ছুটে যাই।

ক্ষেত্রদা’র ভিটেয়, জমি থেকে ঈষৎ উঁচু জায়গা বলে সবসময় আগাম ফসলে ভরে থাকে। শীতেরসবজি শীত না আসতে ভিটেয় উপচে পড়ছে। মূলা,ধনেপাতা,ঢেড়স,পেঁয়াজ- কাঁচা মরিচ, লাউ- কুমড়ো কী নেই তাতে ! কাঁচা সতেজ সবজির গা জুড়ে শিশির বিন্দু নরম রোদের আঁচড়ে ঝিলমিল করছে। আমি ভিটেয় ফিরে কুমড়ো মাচায় এগিয়ে যাই। কুমড়ো ফুল তুলে নিতে। মটর ডালের সাথে আতপ চালের গুঁড়ায় সামান্য হলুদ আর কাঁচা মরিচে অমৃত স্বাদের কুমড়ো বড়ার স্বাদের তুলনা হয় না। মাচা ভর্তি হলুদ কুমড়ো ফুল, মৌমাছিরা মনের আনন্দে হেসে খেলে মধু নিয়ে ছুটছে। ক্ষেত্রদা’র ভিটে ঘেঁসে ডোবা। ডোবা ভর্তি স্বচ্ছ কালো জল। ডোবায় কচুরিপানা দিয়ে ডিবির মতো উঁচু করে ভেলা বানিয়েছেন। কচুরির ছোবার পুঁটুলি বানিয়ে তাতে লাউয়ের বীজ কৌশলে ঢুকিয়ে দিলে কয়েকদিন না যেতে চারাগাছ শিকড় ছেড়ে ছোবার পুঁটুলি ভেদ করে বেরিয়ে আসে। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার আগেই লাউগাছে ছেয়ে যায় ভেলা। তার কিছুকাল পরে লাউয়ে লাউয়ে ভেলা ভরে ওঠে! কী মনোরম সে দৃশ্য! আমি ভিটেয় বসে পা জলে ভিজিয়ে ক্ষেত্রদা’র এসব ছইয়ালি কাজ খুব পরখ করে দেখি। ওদিকে ক্ষেত্রদা’র চাঙ্গাড়ি ভরে উঠে হাটে বেচার শাকসবজিতে।

আমরা সবজি নিয়ে ফিরতে জেঠির ব্যস্ততা বাড়ে। মাটির হাঁড়িতে ধোঁয়া উঠা খুদের ভাতের ভেতর থেকে সেদ্ধ বন শিম,আলু বের করতে ক্ষেত্রদা’ তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাঁক দেয়- বেলা গেলো বলে! জেঠি, এক হাতে পেয়াজের খোসা ছাড়েন, অন্য হাতে শুকনো মরিচে জলন্ত ছাই ঢালেন। গরম ছাই এর ভেতর থেকে বিশেষ কৌশলে পোড়া মরিচ বের করে এনে পেয়াজ,ধনেপাতার সাথে ঘানী ভাঙ্গানো সরিষার তেল মাখেন। ততক্ষণে সাদাবেগুন পোড়ার গন্ধ বেরোয় মাটির চুলা থেকে। আলুমাখায় ঘিয়ের মিশ্রন দাদার খুব প্রিয়। জেঠি শিকেয় তুলে রাখা বয়াম থেকে কয়েক ফোঁটা খাঁটি গাওয়া ঘি সাবধানী হাতে মিশিয়ে দেন আলুমাখায়। গতদিনের শিংমাছের ডিম আলাদা করে খোলা বারান্দায় আড়ার সাথে শিকেয় রাতভর ঝুলানো ছিল। সামান্য লবণ আর হলুদ মেখে কচি লাউয়ের পাতায় মুড়ে রান্না শেষে জ্বলন্ত চুলার ছাইয়ের তলায় এরই মাঝে গুঁজে দেওয়া হয়েছে। তা না হলে যে ক্ষেত্রদা’ চটবেন! গতকাল ডিমওয়ালা শিং এনে জেঠিকে স্মরণ করিয়েছে যে! জেঠি চটজলদি পাতাসহ মাছের ডিমের সাথে সরিষার তেল, মরিচ-পেঁয়াজ ডলে অমৃত বানিয়ে গরম ভাতে ছড়িয়ে দেন। আমরা আমরা একনিমিষে পরম তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে শেষ করি।

“হাটে ছেলে ধরা আছে’। আর সামান্য বড় হলে তবেই আমাকে সাথে নেওয়া হবে”! হাটবার এলেই ক্ষেত্রদা’র এই আশ্বাস-অজুহাত! পরের সপ্তাহের জন্য আমি অধীর অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু পরের সপ্তাহেও আমি উপযুক্ত বড় হই না। আমি ঠোঁট ফুলিয়ে বসে থাকি উঠোনের পাশে তুলসী তলায়। ক্ষেত্রদা’ আমাকে আদর করে জেঠি- মা ডাকেন। কিন্তু আমি যদি অতিরিক্ত জ্বালাতন করি,তখন খুকি বলে ডাকে! তবে আমাকে একবার খুকি ডাকা মানে তাঁর সারাদিন বিষিয়ে ফেলা! মুখ ফুলিয়ে বসে থাকি এবং সবরকম কথা বন্ধ! আমার ধারণা খুকি নামটা তাঁর মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ে- ইচ্ছে করে এমন যন্ত্রণা কে কাঁধে নেয়! এরপর সে আমার মান ভাঙ্গাতে কত কী যে করে! ওদিকে হাটের বেলা বয়ে যায়। ক্ষেত্রদা’ ব্যর্থ হয়ে জেঠিকে পাঠায়, আমি স্থানু হয়ে বসে থাকি তুলসীতলে। ওদিকে জোর হাতে ক্ষেত্রদা’ আমার কাছ ঘেঁষে বসে থাকে। আমাদের এমন মান-অভিমান খেলায় জেঠি ভীষণ মজা পান। তিনি পান খাওয়া রক্ত জবার মতো ঠোঁটের কোণে হাসি চেপে ধরে- আমার পক্ষ হয়ে ক্ষেত্রদাকে ভৎসনা করেন। ওদিকে বেলা বাড়তে থাকে। ক্ষেত্রদা’ মাফ পাওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে-ই থাকে! শেষমেশ অবশ্য আমিই জিতে যাই। মণ্ডা মিঠাই, বিন্নি বাতাসা আর মণ্ডলের দোকানের ফুলরি আমার খুব পছন্দের ফর্দ তাঁকে ধরিয়ে দিয়ে সে যাত্রায় মাফ করে দিই। এবং ক্ষেত্রদা’ ধবধবে সাদা ধুতির উপর হালকা নীল রঙয়ের পাঞ্জাবি গায়ে জড়াতে জড়াতে হাটের পথে দ্রুত পা বাড়ান।

বেশকিছুদিন ধরে কালিপদ পোষ্ট মাষ্টারের আনাগোনা বড্ড বেড়ে যায়। নীল খামের চিঠিগুলোর ভারে ক্ষেত্রদা’ আজকাল অতিরিক্ত বিমর্ষ থাকেন। তুলসিতলার কাছে উঠোনে পা মাথা নিচু করে বসে থাকেন। আমি তাঁকে তাড়া দিই- নামার বিলে শালুক তুলতে যাবো বলে। কিন্তু সে নড়ে না ঠায় বসেই থাকে। জেঠি ক্ষেত্রদা’কে খুব ভালোবাসেন। সে-ও তাঁর পাশে চুপচাপ বসে থাকে। পাল পাড়ার রণজিৎ পাল,ক্ষেত্রদা’র খুব কাছের বন্ধু। তিনি তাঁর বাড়ির পরে এলে তাঁকে ধরে হাঁউমাঁউ করে মরা কান্না জুরে দেন। সময় সময় আমাকে ধরেও ঢুকরে কেঁদে ওঠেন। জেঠিকে আমি আগে কখনো কাঁদতে দেখিনি। সেই জেঠিও তাঁর সাথে সুর মিলিয়ে কাঁদেন। ময়না পিসির বিরবির করে কথা বলার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে ক্ষেত্রদা’র বাড়ির স্বাভাবিক চিত্র খুব দ্রুত বদলে যায়! আমি এসবের রহস্য ভেদ করতে পারি না। কিন্তু কষ্টে আমার বুকটা ভেঙ্গে যায়! প্রচণ্ড রাগ হয়, কালিপদ পোষ্ট মাষ্টারের উপর। নীল খামের ভেতর ভাঁজ করা কাগজটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করতে ইচ্ছে হয়।

একদিন ভর সন্ধ্যায়, জেঠিসহ ক্ষেত্রদা’ আমাদের বাড়ি এসে খুব কান্নাকাটি করেন! আমাকে জড়িয়ে ধরে বেহুঁশে মতো হয়ে যান। বাবা তাঁকে বুঝান, কীসের যেন প্রতিশ্রুতি দেন! এরপরও ক্ষেত্রদা’ কাঁদেন কিন্তু গলা ছেড়ে নয়। কী যেন সবাই লুকায় কিন্তু ওটুকু বয়সে আমি টের পাই না! তবে তাঁর বুকের ভেতর কষ্টের পাহাড় সেটা বুঝতে পারি! বিদায় বেলায় আমাকে বললেন, দিন কয়েকের জন্য বেড়াতে যাবেন এবং ফিরে এসে আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাবেন। খালি বাড়িতে যাতে না যাই।

এরপর দিন যায়, মাসও কেটে গেল কিন্তু ক্ষেত্রদা ফিরে আসল না! আমি অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত হই। এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়। আমি স্কুলে ভর্তি হই। স্কুলে যাই কিন্তু মন পড়ে থাকে ক্ষেত্রদা’র বাড়ি- দাদা, জেঠির কাছে। কিন্তু ক্ষেত্র দা’ আর ফিরলেন না! আমি হাঁপিয়ে ওঠি। আমার ভেতর ভয়ংকর ভাঙ্গাগড়া চলে। আমার প্রচণ্ড জ্বর হয়। জ্বরের ঘোরে আমি ক্ষেত্রদা’ বলে চিৎকার করি। আমাকে নিয়ে আমার বাড়ির মানুষ অস্থির হয়। ডা.আমাকে সুস্থ করতে ব্যর্থ হয়। এতকিছুর পরও ক্ষেত্রদা’রা ফিরে আসে না!

একদিন অসুস্থ শরীর নিয়ে খুব ভোরবেলায় অন্ধকারে পালিয়ে ক্ষেত্রদা’র বাড়ি যাই। কিন্তু বাড়ির সামনে যেয়ে থমকে দাঁড়াই! এই যে এক ভিন্ন জায়গা! ক্ষেত্রদা’র বাড়ির সাথে এর ছিটেফোঁটা মিল নেই! আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। তখন অন্ধকার কেটে সূর্য প্রায় উঠো উঠো করছে। আমার ভ্রম হয়। সংশয় হয়, ভুল করে ভিন্ন বাড়ি চলে এসেছি না তো! কিন্তু না,সবই ঠিক আছে কিন্তু বাড়িটি যে এর পূর্বের বাড়িটি নেই! জেঠির সেই লেপাপোছা ধবধবে শাদা মাটির ঘরটি নেই, আধঃখোলা রান্নাঘর সেটাও নেই,পড়ো ভিটেটি সেও উধাও! বাড়িটির সমস্ত ভিটেগুলো গুঁড়িয়ে সমান করা হয়েছে। বাড়ির দক্ষিণ দিকে উঁচু করে ইট-বালু স্তুপ পালা দেওয়া! ইট কাটের দালান উঠবে হয়তো। আমি প্রচণ্ড বিমর্ষ হয়ে পড়ি। শরীরটা অবসন্ন লাগে! অনেকটা জোর করে অবশ-পায়ে তুলসীতলার দিকে এগিয়ে যাই। তুলসী গাছের কোন অস্তিত্ব নেই, মরে পচে মাটির সাথে মিশে গেছে! ঘন সবুজ শ্যাওলায় ঢেকে আছে গোবরে লেপা জেঠির সেই তুলসীতলা! ময়না পিসির ঘরটায় একটি নতুন তালা ঝুলছে! অর্থাৎ মালিক বদল হয়েছে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে! বুকেরপাঁজর দুমড়ে মুচড়ে বের হয়ে যাবে মনে হয়! শরীরটা অবশ হতে হতে, চোখদুটো আলগোছে মুদে আসে! এরপর আমি অসীম শূন্যতায় ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকি! তারপরের কিছু মনে নেই। একটা সময় পর হুঁশ ফেরে। চোখ মেলে দেখি, আকাশ ভরা মেঘ! আমি মেঘের উপর ভাসছি! হঠাৎ মেঘের ফাঁকে চোখ পড়তে চমকে উঠি! দেখি - দূরে আকাশের পরে ক্ষেত্রদা’র বাড়িটি ভাসছে! আমি দু’হাত মেলে উড়ে সেই বাড়ির পথে এগিয়ে যাই!