Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৫.১

ছোটে পালোয়ান বলছিল—দেবীদর্শন-টর্শন করতে হবে না। আমি তো শুধু লাল-ল্যাঙোটের গোলামি করি, বাকি সব দেবীদেবতাদের গেরাহ্যি করি না। সবাই ভাবছিল যে প্রথমে মন্দিরে গিয়ে দেবীদর্শন করলে হয়। ছোটুর কথায় কেউ কান দিল না। কেউ ওকে বোঝাতে চেষ্টা করল না। কারণ সবাই জানে যে ওকে বোঝানোর একটাই পদ্ধতি—ওকে চিত করে ওর বুকের উপর চড়ে ওর হাড়-পাঁজর ভেঙে দেওয়া।

এদিকে ছোটে এইসব বলার পর এখন দেখাতে চাইছে কি ও নাস্তিক নয়। তাই দাঁড়িয়ে উঠে নিজের উরুতে ঢোলক বাজাতে লাগল। কিন্তু এতে আস্তিকতা কোথায়? এবার একটা ভজন গুনগুন করতে শুরু করলঃ

“বজরঙবলী, মেরী নাও চলী, জরা বল্লী কৃপা কী লগা দেনা”।

আমার নৌকো ভেসে যায় বজরঙ্গবলী, একটু কৃপা কর, হাল ধরে নাও।

তারপর একটা মিঠাইয়ের দোকানের দিকে ইশারা করে বলল—“আমি ততক্ষণ ওখানে গিয়ে পেটে কিছু দিয়ে আসি। ওখানেই তোমরা এসে যেও”। তারপর নিজের মনে বলতে থাকল,” সকাল থেকে মুখে কিছু না দিয়ে ঘুরছি। পেট সালা গুরগুর করছে”।

রঙ্গনাথকে বলা হয়েছে যে এই মন্দির সত্যযুগে তৈরি। ও ভাবছিল এখানে কোন পাথরের টুকরোয় ব্রাহ্মীতে লেখা শিলালিপি দেখতে পাবে। কিন্তু মন্দিরটি এক নজর দেখেই ও বুঝতে পারল যে আমাদের দেশবাসী সময় বলতে দুটি শব্দই ব্যবহার করে—অনাদি এবং অনন্ত। এছাড়াও ওরা কোন পঁচাত্তর বছরের পুরনো মন্দিরকেও অনায়াসে গুপ্ত বা মৌর্য্যযুগের বলে চালিয়ে দিতে পারে।

মন্দিরের উপর ফুল-লতা এবং কল্কেদার নকশার ফাঁকে লেখা—“মহিষাসুরমর্দিনীর এই মণ্ডপ ভীখাপুরের রাজসিংহাস নে আসীন ইকবালবাহাদুর সিংহ পিতা নরেন্দ্রবাহাদুর সিংহ কর্তৃক ১৯৫০ বিক্রম অব্দের কার্তিক মাসের সপ্তমী তিথিতে নির্মিত”। এটা পড়তেই রঙ্গনাথের সমস্ত পুরাতত্ত্ব হাওয়ায় উড়ে গেল।

এম অবধ অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ জমিদারের গৃহে এমন অনেক তখত বা ভাঙা তক্তপোষ পড়ে আছে ,যাতে সমাসীন হয়ে ওঁয়ারা দু’এক জন চাষীর নজরানা হোলি অথবা বিজয়াদশমীর দিন গ্রহণ করেন। মন্দিরের নির্মাণে যা খরচ হয়েছে সেটার আন্দাজ থেকেই রঙ্গনাথ বুঝে গেল যে এই তখত বা সিংহাসন ওইরকম লাখো তখতেরই কোন একটি। মন্দিরের ইমারতও ওই রকম। একটি মাত্র কামরা, তাতে একটাই দরজা আর ভেতরের দেয়ালে ওয়ার্ডরোব মত কিছু কুলুঙ্গি। তাতেই নানারকম দেবতার আসন।

দরজা দিয়ে ঢুকলে চোখে পড়বে সামনের ওয়ার্ডরোবে রাখা কিছু দেবমূর্তির মধ্যে মুখ্য আকর্ষণ এক দেবী প্রতিমার। দেখলে বোঝা যায় প্রতিমাটি সত্যি বেশ প্রাচীন।

জোগনাথ ভেতরে ঢুকেই এমন চটপট ঝাঁপিয়ে পড়ে সাষ্টাংগ প্রণিপাত করল যেন কোন সেপাই যুদ্ধক্ষেত্রে বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। তারপর পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে বসে এক ভজন গাইতে শুরু করল। কথাগুলো বোঝা যাচ্ছেনা, কিন্তু এটা স্পষ্ট যে ও কাঁদছে না, গান গাইছে।

জোগনাথের আবেগের পেছনে গাঁজার ছিলিম বা মদের পেয়ালার কোন যোগ নেই, যা কাজ করছিল তা’হল পুলিশের ডর। কারণ যাই হোক, ওর আবেগের চোটে অনেক ভক্ত নিজেদেরটা ভুলে ওর ভজন শুনতে লাগল।

শনিচরেরও গ্রাম-প্রধান হওয়ার আকাঙ্খা। ও দেবীর সামনে হাঁটু গেড়ে কোনরকমে বসে পড়ল আর “জগদম্বিকে, জগদম্বিকে” বলে শ্লোগান দিতে শুরু করল। দেবীমণ্ডপে মেলার লোকজনের ভারী ভীড়, হট্টগোলে কেউ কারও কথা শুনছে না। কিন্তু সে ‘গঞ্জহা’ই বা কেমন যে, কোথাও গেলে, সেখানকার পাবলিকের উপর বাতেলাবাজি করে নিজেদের জোর না ফলিয়ে ফিরে আসবে!

লোকজন শনিচরের থেকে একটু সরে গেল। ওদিকে রূপ্পনবাবুও চোখ বুঁজে বসে গেলেন এবং ধড়াক করে কোন বর প্রার্থনা করে বড় বড় চোখ খুলে তাকাতে লাগলেন। এবার তো মেলা দেখতে যেতে হয়। ওনার পাশে একটি মেয়ে কোন দেবতার সামনে চোখ বুঁজে কোন মন্ত্র বিড়বিড় করছিল। রূপ্পনবাবুর মনে হল-আসল মেলা তো এইখানে!

রঙ্গনাথ হাত জোড় করে সোজা দেবীপ্রতিমার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর যা দেখল, দেখতেই থাকল। কারণ প্রাচীন মূর্তিকলার বিষয়ে ও যা পড়াশোনা করেছিল এবার মনে হল সেসব জ্ঞান নিরর্থক, ফালতু। ভাবল—যদি এটাই দেবীমূর্তি হয় তাহলে ও যেসব মূর্তি খাজুরাহো, ভুবনেশ্বর বা ইলোরার কৈলাস মন্দিরে দেখেছে, সেগুলো তবে কী?

একবার চোখ বুঁজে প্রাণপণে নিজের সব বইপড়া বিদ্যে ভোলার চেষ্টা করতে লাগল। মনের ভিতর এক হাহাকার জেগে উঠল—বাঁচাও! বাঁচাও! আমার ভক্তির উপর যুক্তিতর্কের আক্রমণ শুরু হয়েছে। বাঁচাও!

কিন্তু যেই চোখ খুলল, অমনি টের পেল যে ওর ভক্তিটক্তি উধাও হয়ে তোতাপাখির মত মুখস্থ করা ইতিহাসের পাতা ওর উপর জেঁকে বসেছে। যারা ভক্তির চোখে না দেখে ইংরেজ ঐতিহাসিকদের লেখা বইয়ের পাতা দেখে এই মন্দিরে এসেছে তারা শুধু এই ধরণের বক্তব্য ঝাড়তে পারে—“ এই মূর্তির যতটুকু দেখতে পেয়েছি তাতে এইটুকু নিশ্চিত হয়ে বলা যায় যে এটি প্রায় বারোশো শতাব্দী আগের কোন সেপাইয়ের মূর্তি”।

আমাদের দেশের মূর্তিকলা নিয়ে যে যাই বলুক, এই অপবাদ কেউ দিতে পারবে না যে মূর্তির লিঙ্গভেদ নিয়ে কোন সন্দেহ বা অষ্পষ্টতা আছে। ছোট করে কাটা চুল এবং শার্টপ্যান্ট পরে গলফ্‌ ময়দানে ঘুরে বেড়ানো নারীদের দেখে লিঙ্গ সম্বন্ধে আমাদের চোখের ভুল হতে পারে, কিন্তু প্রাচীন নারীমূর্তি দেখে এমন ভুল হওয়া অসম্ভব।

পুরাতত্ত্বের ছাত্রদের মূর্তির গলার নীচে দুই উঁচু উঁচু পাহাড় দেখার অভ্যেস সহজেই হয়ে যায়। আরেকটু নীচে নামলে পাহাড় বদলে গিয়ে অন্য কিছু হয়ে যায়। এসব বোঝার দিব্যদৃষ্টি পুরাতত্ত্বের ভোঁদাই ছাত্ররাও সহজে অর্জন করে। তাই ওরা বৌদ্ধবিহারকে গোপুরম এবং গোপুরমকে স্তুপ ভাবার ভুল করতে পারে বটে, কিন্তু নারীমূর্তিকে পুরুষ বলে ভুল? কদাপি নহী।

রঙ্গনাথ পুরুত মশাইকে জিজ্ঞেস করল –এটা কোন দেবতার মূর্তি?

উনি খুব ব্যস্ত। চেঁচিয়ে বললেন—পকেট থেকে কিছু বের করে পূজোয় প্রণামী চড়াও, তখন নিজের থেকে টের পাবে উনি কোন দেবতা!

রঙ্গনাথের জ্ঞানপিপাসায় আকুল হয়ে এগিয়ে গিয়ে মূর্তির গলা ছুঁয়ে দেখল। পুজারী ওকে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করল। তারপর শিক্ষিত লোকের ঢঙে বলল—মূর্তি ছোঁয়ার নিষেধ আছে।

মেয়েটি ততক্ষণে প্রতিমা দর্শন করে বাইরে চলে গেছে। রূপ্পনবাবুর মনে হল—মেলা শেষ, ফিরে যাই। তাই রঙ্গনাথের হাত ধরে টান মেরে বলল—দর্শন তো হয়ে গেছে, এবার চলা যাক।

ইতিহাস হচ্ছে সবচেয়ে বড় মূর্তিভঞ্জক কালাপাহাড়। এখন রঙ্গনাথের মাথায় ইতিহাসের খ্যাপামি, ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল—দর্শন আর কী হবে? এটা তো কোন দেবী মূর্তি নয়!

শোনামাত্র তিন গঞ্জহা রঙ্গনাথের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। দু-চারজন চমকে উঠে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। রঙ্গনাথ কোন মিউজিয়ামের অ্যাসিসট্যান্ট কিউরেটরের ভঙ্গীতে লেকচার দিতে শুরু করল-- “দেখছ না, এটা কোন সেপাইয়ের মূর্তি! এই দেখ ওর শিরস্ত্রাণ, আর এদিকে দেখ, পিঠের পেছন থেকে তূণ বেরিয়ে রয়েছে। আর এদিকে দেখ, বিলকুল সমতল---“।

রঙ্গনাথ সেপাইয়ের ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের বর্ণনা শেষ করার আগে পুজারী লাফিয়ে এসে এমন ধাক্কা দিল যে ও বিনা চেষ্টায় ভীড় চিরে বাইরে এসে দরজার গায়ে আটকে গেল। ওদিকে পুজারী লোকের পুজো করানো এবং প্রণামী সামলানোর দায়িত্ব ছেড়ে রঙ্গনাথকে প্রাণভরে গাল পাড়তে লাগল। ওর মুখটা ছোট, ফলে বড় বড় গালি নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করে ভাঙাচোরা অবস্থায় বাইরে পৌঁছচ্ছিল। খানিকক্ষণের মধ্যে মন্দির গালাগালিতে ভরে গেল। কারণ, ভক্তরাও পুজারীর পক্ষে দাঁড়িয়ে গালিবর্ষণ শুরু করে দিল।

শিবপালগঞ্জের গঞ্জহারা থতমত খেয়ে মন্দিরের বাইরে চলে এল। কিন্তু পুজারী মন্দিরের দরজায় এসে চেঁচাতে লাগলেন—আমি তো মুখ দেখেই বুঝে গেছি। ব্যাটা কেরেস্তান। বিলায়েতের সন্তান। একটু কী গিটপিট-গিটপিট শিখে নিয়েছে, আজ বলতে শুরু করেছে এই প্রতিমা তো দেবী নয়! কালকে নিজের বাপকে বলে দেবে আমার বাপ নয়!

শনিচর আর জোগনাথ ব্যাপারটা কিস্যু বোঝেনি। তাতে কি, হাত-পা নাড়িয়ে ওরাও খুব চেঁচাতে লাগল। এবার রূপ্পনবাবুর বাস্তববুদ্ধি জেগে উঠল। রঙ্গনাথের হাত ধরে বলল—চলো দাদা। তারপর পুজারীর দিকে ফিরে চড়া কিন্তু হিমশীতল স্বরে বলল—“দ্যাখো মহারাজ, মেলা-টেলার দিন বেশি দম লাগিও না। বয়স অনেক হল, এখন বেশি গাঁজা টানলে বড্ড তাড়াতাড়ি চড়ে যায়, বুদ্ধি ঘুলিয়ে যায়”।

পুজারী ফুসুফুস করে কিছু বলার চেষ্টা করতেই রূপ্পনবাবু হাত তুললেন—ব্যস, ব্যস; বেশি পাঁয়তারা কর না। আমরা শিবপালগঞ্জের লোক। জিভটাকে কমণ্ডলুতে ভরে রাখ।

কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর রঙ্গনাথ বলল—আমারই দোষ, এখানে মুখ খোলার দরকার ছিল না।

রূপ্পন সান্ত্বনা দিলেন—কথা তো ঠিক, কিন্তু দোষ তোমার নয়, তোমার বেশি বেশি লেখাপড়ার।

শনীচর পোঁ ধরল—বই পড়ে মানুষ লেখাপড়াজানা লোকের মত কথা বলতে শুরু করে দেয়। কথাবার্তার আসল ঢং ভুলে যায়। তুমি কি বল জোগনাথ?

জোগনাথ জবাব দিল না। ও ভীড়ের ঠেলাঠেলির মধ্যে ঢুকে যুবতী মেয়েদের ধাক্কা দিতে ব্যস্ত। ওর মুখের ভাবে স্পষ্ট যে ও খানিকক্ষণ এই কাজেই লেগে থাকতে চায়।

শনিচরও এখন মেলার মুডে এসে গেছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে একটা মিঠাইয়ের দোকানের দিকে রওনা দিল যেখানে আগে ছোটে পালোয়ান গেছে। এই যাত্রাপথে ও অনেক বুড়োমানুষকে ডাইনে বাঁয়ে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে দিল, অনেক নারীর কাঁধে ‘ভালোবেসে’ হাত রাখল, তাদের বুকের মাপজোক দেখে নিল। আর এইসব এমন স্বাভাবিক ছন্দে করে গেল যেন মেলায় এমনটাই দস্তুর।


এইসব কান্ড করতে এই রোগাপটকা তালপাতার সেপাইয়ের এমন ফুর্তি, এমন এনার্জি দেখা গেল যে কোন টনিক নির্মাতা আমেরিকান ওষুধের কোম্পানী ওকে এখন দেখলে ‘এপ্‌’ এর বিজ্ঞাপন ভেবে খাঁচা শুদ্ধ কিনে নিত। তবে শনিচরের জন্য এখনও কোন খাঁচা তৈরি হয়নি—এই যা!

রঙ্গনাথের মটকা গরম হয়ে গেছল। একবার শনিচরের হাত একটি কিশোরীর গালের দিকে এগোতেই ও হাতটা ধরে মুচড়ে দিল, আর ধমকে উঠল—‘এটা কী ধরণের বেয়াদবি’?

শনিচরের চোখ বড় বড়—‘বেয়াদবি কোথায় গুরু? এ তো মেলা চলছে’! তারপর সুর নরম করে দাঁত বের করে বলল- ‘গুরু, এসব দেহাতি মেলার চক্কর। এখানে তো এইরকম হাতের জাদু চলতেই থাকে গুরু’।

প্ল্যানিং কমিশনও কোন সমস্যার সমাধান খুঁজতে নতুন কোন ইংরেজি শব্দ আমদানি করে এত খুশি হতেন না, শনিচর যেভাবে মুখ থেকে আচমকা ‘জাদু’ শব্দ ছিটকে বেরোনোয় হল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল –একবার গ্রামসভার প্রধান হয়ে যাই, তখন দিনের মধ্যে কম করে তিনবার এই ‘জাদু’ শব্দ আউড়ে দেব।

মিঠাই আর চাটের দোকানের সামনে খুব ভীড়। ভারতীয় মিষ্টান্নের সৌন্দর্য্যের মহারাণী হল কড়াপাকের সন্দেশ। সেই সন্দেশ বা বরফির স্তুপ দোকানে সাজানো আর গাঁয়ের ছেলেপুলে জানে যে মারামারির সময় এগুলো ঢিলের মত কাজে আসে। এই মেঠাই হালুইকর এবং ফুড ইন্সপেক্টরদের অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল। অনেক পরিশ্রমের পর ওঁরা জানতে পেরেছেন যে ক্ষীরের বদলে মুখিকচু, আলু-চালের আটা, মাটি, এমনকি গোবর পর্য্যন্ত কাজে লাগে। এঁরা হলেন সমন্বয়বাদী—প্রতিজ্ঞা করেছেন যে ভ্যাজাল না দিয়ে কোন জিনিস বানাবেন না, এমনকি বিক্রিও করবেন না।

একটা দোকানের কোনায় ছোটে পালোয়ানের দেখা পাওয়া গেল। ভীড় থেকে আলাদা, একটা মোড়ায় বসে শালপাতার ঠোঙা থেকে নিমের কাঠি দিয়ে গেঁথে আলুর টুকরো খাচ্ছে। শনিচর আর জোগনাথ রূপ্পনবাবুর থেকে সরে গিয়ে ছোটুর কাছে গেল।

শনিচর বলল, ‘ গুরু, হুকুম দাও তো এক-আধ টুকরো বরফি খেয়ে নিই’?

ছোটে পালোয়ান শনিচরের দিকে করুণাঘন চোখে তাকিয়ে হাসল। তারপর বর দেওয়ার ভঙ্গীতে বলল—“ হ্যাঁ রে ব্যাটা, খা। জোগনাথকেও দে”।

রঙ্গনাথ দেখল ধূলো, মাছি আরও অনেক কিছু মিঠাইয়ের উপর বসে ওজন বাড়াচ্ছে। ব্যাজার হয়ে ও রূপ্পনকে জিজ্ঞেস করল—তুমি কিছু খেতে চাও?

জবাব এল কিঞ্চিৎ রুক্ষ স্বরে—আমি খেয়ে কী করব?

তারপর রূপ্পন ভীড়ের দিকে একবার বিহঙ্গম-দৃষ্টিতে দেখল। একটু দূরে সিংহ সাহেব দেখা দিলেন, যাকে রূপ্পন মেলায় ঢোকার সময় দেখেছিল। ওনার মাথায় এখন শোলার হ্যাট, তাই স্যানেটারি ইন্সপেক্টর নয়, সোজা পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটের মত দেখাচ্ছে। ওনাকে ঘিরে ধরেছে একগাদা লোক।

রূপ্পন বলল—‘যতক্ষণ এই হ্যাংলাগুলো মিঠাইয়ের দোকানে সেঁটে থাকবে , ততক্ষণ ওই তেএঁটে ব্যাটার হালচাল দেখে আসি, চলো,’।

রূপ্পনবাবু এখন সিং সায়েবের গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়েছেন। সায়েবের গালে চার-পাঁচ দিনের না-কামানো দাড়ি-গোঁফ, ঠোঁটের কোণ দিয়ে খৈনির পিক পড়ল বলে--- কিন্তু ওই সোলার হ্যাট কামাল করেছে।

--বলুন সিং সায়েব, কেমন চলছে? রঙ্গঢঙ কেমন?

--রঙ সব বদরঙ হয়ে গেছে ভাই। দশ-দশটা চালান কাটতে হয়েছে। এই বয়সে আমি তো এসবেরই লায়েক হয়েছি, রূপ্পনবাবু। এরপর সাক্ষী হয়ে এজলাসে হাজিরা দিতে দিতে আমার পায়ের চামড়া উঠে যাবে।

রূপ্পনবাবু গলার জোরে ভীড়ের হট্টগোল ছাপিয়ে গেলেন। --আরে এইসব চালান-টালানে আছেটা কী, সিংহ সায়েব? দশ-পাঁচ টাকা নিয়েটিয়ে কেস খতম করুন।

সিং সায়েবও অমনই উঁচু আওয়াজে বললেন—কোন সালা দশ-পাঁচ টাকা দেবে? ওদিকের খাবারের ঠেলাগুলোর চালান করলাম, সব সালাই চায় দুটো টাকা ধরিয়ে মামলা দফারফা করতে। আমিও বলেছি –চালান হোক চাচ্ছিলে তো, তাই হবে।

রূপ্পনবাবু হাত তুলে বললেন—কোথাকার ওই দোকানদারগুলো? ভারি বদমাশ তো!

একটা মোটা-তাগড়া লোক ওনার সামনেই দাঁড়িয়েছিল। দেখলে মনে হয় হেব্বি দম, কিন্তু মুখ খুলল যেন বড়সড় তরমুজ পচে গেছে। মিনমিনিয়ে বলতে লাগল—‘আমরা রোহুপুরের লোক, বাবুসাহেব। তখন থেকে নিস্পিক্টর সাহেবকে খোসামোদ করে যাচ্ছি, কিন্তু উনি দোকানপ্রতি দশটাকার নীচে নামছেন না যে’।

রূপ্পন—মেনে নিন সাহেব। দু’টাকা করে হলেও আপনার কুড়ি টাকা হচ্ছে, কম তো নয়। আপনিও কোন গমের বস্তা বেচছেন?

মোটা লোকটি রূপ্পনের হাবভাবে উৎসাহিত হয়ে বলতে লাগল—‘বাবু সাহেব , আমার অবস্থাটাও দেখুন একটু। এক বছর পরে এখানে দোকান লাগিয়েছি। দশ টাকা এনার কাছে গেলে থাকবেটা কী’?

কথাটা শুরু হয়েছিল ইয়ার্কির ছলে, কিন্তু রূপ্পনবাবুর এখন দোকানদারের ওকালতি করার মজা মাথায় চড়েছে। উনিও গলা চড়িয়ে বললেন—‘ঠিকই তো বলছে, দশটাকা গেলে থাকবেটা কী? এবার মেনে নিন সিং সাহেব, প্রতি দোকান আড়াই টাকা, ব্যস্‌। না আপনার কথা রইল, না এর’। এই বলে উনি মোটুকে হুকুম দিলেন—যাও, এক্ষুণি দশজনের পঁচিশ টাকা নিয়ে এসে সাহেবের হাতে দাও। আর কিছু মিষ্টি-টিষ্টিও।

মোটু দৌড় লাগালো। পেছন থেকে সিং সায়েব বললেন—‘দেখ, দেখ, মিঠাই এনো না যেন’।

তারপর পাবলিককে ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে লাগলেন—‘ওসব সালার রেড়ির তেলে রান্না হয়েছে নাকি মহুয়ার তেলে—কে বলতে পারে! ছাগলের নাদির মত গন্ধ ছড়ায়’।

রূপ্পন আরও ঘেঁষে এলেন। ঘরোয়া কথাবার্তা শুরু হল।

--আপনার মহল কতদূর? সেই যে বানাতে শুরু করেছিলেন?

--‘আর মহল! ওটাকে এখন বাড়ি বললেই ভালো হয়’। এই বলে সাহেব চুপ মেরে গেলেন। একটু পরে মিইয়ে যাওয়া স্বরে বললেন—আদ্দেক তৈরি হয়ে পড়ে আছে। ভাবছি, যেমন আছে থাক। নীলামে চড়িয়ে দেব’।

রঙ্গনাথ ভেতরে ভেতরে টগবগিয়ে ফুটছিল। মন্দিরে পুজারীর গালি খাওয়ার পর থেকে ও কারও না কারও সঙ্গে ঝগড়া করতে মুখিয়ে আছে। বলে উঠল—‘এত এত ঘুষ খেয়েও আপনার মহল পুরো হল না’?

সিং সায়েব রাগ করলেন না। ভুরু নাচিয়ে রূপ্পনকে জিজ্ঞেস করলেন—এ কে?

রূপ্পন—‘আমার দাদা, পিসতুতো ভাই। এর কথা ধরতে নেই। একটু বেশি লেখাপড়া করেছে, তাই মাঝে মাঝে উলটো কথা বলে ফেলে। চিন্তা করবেন না, যেমনই হোক আমাদের ঘরেরই লোক তো’।

রঙ্গনাথ ঠোঁট কামড়ে বড় করে শ্বাস টানল। সিং সায়েব ওকে বোঝাতে লাগলেন—আগের দিন আর নেই ভাই। মহলের দিন গেছে। ঘুষ নিয়ে মহল হয় না। বড়জোর ঘরের উপর পাকা ছাত, তাহলেই হল। দেখলে না—“ঘুষের রেটের কী অবস্থা ! দশ-দশটা চালান লিখতে লিখতে হাতের চামড়া উঠে গেল, পেলাম কী? মারলাম বক, হাতে লাগল ওর পাখনা, ব্যস্‌”।

(চলবে)