Next
Previous
0

প্রবন্ধ - প্রমিত বসু

Posted in






‘বিশেষ স্থানে গিয়ে, বিশেষ মন্ত্র প’ড়ে, বিশেষ অনুষ্ঠান ক’রে মুক্তিলাভ করা যায়, এই বিশ্বাসের অরণ্যে যখন মানুষ পথ হারিয়েছিল তখন বুদ্ধদেব এই অত্যন্ত সহজ কথাটি আবিষ্কার ও প্রচার করবার জন্যে এসেছিলেন যে, স্বার্থত্যাগ ক’রে, সর্বভূতে দয়া বিস্তার ক’রে, অন্তর থেকে বাসনাকে ক্ষয় ক’রে ফেললে তবেই মুক্তি হয়; কোনো স্থানে গেলে, বা জলে স্নান করলে, বা অগ্নিতে আহুতি দিলে, বা মন্ত্র উচ্চারণ করলে হয় না।

এই কথাটি শুনতে নিতান্তই সরল, কিন্তু এই কথাটির জন্যে একটি রাজপুত্রকে রাজ্যত্যাগ ক’রে বনে বনে, পথে পথে, ফিরতে হয়েছে।’ - এই ছিল বুদ্ধদেবের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন।

প্রতি ২-৩ বছর অন্তর বৈশাখী পূর্ণিমা ঘুরে ফিরে আসে ২৫শে বৈশাখের আশেপাশেই। তবে বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী জন্মদিন কাছে থাক বা দূরে--- শাক্যসিংহের প্রভাব রবীন্দ্রমননে যে কতটা প্রসারিত তা একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়।

যে জীবনদেবতার ধারণা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আমরা দেখতে পাই একদম তরুণ বয়স থেকেই, তার তার উৎস বহুবিধ হলেও তাতে বুদ্ধদেবের ভূমিকা ছিল ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সেই জীবনদেবতা যিনি অন্তর্মুখী। মানুষের রোজকারের জীবনের সঙ্গে, তাদের সুখ, দুঃখ, প্রেম, বিরহ, আনন্দ, ক্লেশের সঙ্গে মিলেমিশে সঙ্গী হয়ে থাকেন। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত ভারতবর্ষ গ্রন্থের 'মন্দিরের কথা' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেন 'বুদ্ধদেব যে অভ্রভেদী মন্দির রচনা করিলেন, তাহারই মধ্যে... মানবের মধ্যে দেবতার প্রকাশ, সংসারের মধ্যে দেবতার প্রতিষ্ঠা, আমাদের প্রতি মুহূর্তের সুখদুঃখের মধ্যে দেবতার সঞ্চার ছড়াইয়া পড়িল'।

বৌদ্ধধর্মের সারমর্মে যে বাসনাহীন ত্যাগ আর বিশ্বনিখিলের প্রতি যে প্রেমের কথা বলা আছে তা ছিল রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব দর্শনের সমভাবাদর্শ। অন্য ধর্মে যেখানে পরম ব্রহ্মকে খুঁজে পেতে ভিন্ন উপায়ের কথা ব্যাখ্যা করা হয় সেখানে বুদ্ধ প্রেমকেই ব্রহ্ম বলে মেনে নিতে বলেন। ক্ষেত্রবিশেষে সে প্রেম কখনও হয় করুণা, কখনও বা মৈত্রী, কখনও বা ক্ষমা। কিন্তু তার মূলে আছে বিশ্ব মানবপ্রেমের কথা। এর সাথে যোগ হয় অহং বা স্বার্থ বিহীন ত্যাগ, যা মানুষকে দিতে পারে এক অনির্বচনীয় আনন্দের উপলব্ধি।

এই দর্শনে প্রভাবিত হয়েই জীবনের প্রথম ভাগেই রবীন্দ্রনাথ পালি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন 'ধম্মপদ'। যুগ্মগাথা, চিত্তবর্গ, পুষ্পবর্গ - এই রকম অনেক শাখায় এই অনুবাদ নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষাকে নতুন করে সমৃদ্ধ করে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যেটা হলো যে এই অনুবাদে শ্লোকের কাব্যগুণ অটুট থাকে, অথচ বুদ্ধের বাণী এবং দর্শনের কোনো বিচ্যুতি ঘটে না।

ভক্তদের জন্য বুদ্ধের মূল বক্তব্যই ছিল "আত্মদীপো ভব, আত্মশরণ্যে ভব", অর্থাৎ কিনা অন্ধ বিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে নয়, নিজেই নিজের প্রদীপ হও, জ্ঞানের দীপ্তি জ্বালিয়ে জ্বলে ওঠো। বিশ্বমানবের স্বার্থে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দাও, নিজের ক্ষমতায় আস্থা রাখো, নিজেই নিজের শরণ নাও। বুদ্ধ-নির্দেশ্য এই শরণ বা আস্থার কথা খুব স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে উল্লিখিত রবীন্দ্ররচিত কবিতাগুলোর সারমর্মে।

এই দর্শনের প্রভাব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, গানে, নাটকে, প্রবন্ধে। 'শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা' বা 'নগরলক্ষ্মী' কবিতাগুলোর মধ্যে এই স্বার্থ বিহীন ত্যাগের কথা খুব পরিষ্কার করে ফুটে ওঠে। যেখানে রাজ শাসনে নয়, বরং আত্ম উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে এই ত্যাগের আনন্দ অনুভূত হয়।

নগরলক্ষ্মী কবিতায় শ্রাবস্তীর ভিক্ষুণী সুপ্রিয়া বৌদ্ধধর্মের করুণা ও সেবার মূর্ত প্রতীক মহান আদর্শে বলেন ‘প্রকাশ করে নতুন করে/ আমার ভাণ্ডার আছে ভরে/ তোমা-সবাকার ঘরে ঘরে।/ তোমরা চাহিলে সবে/ এ পাত্র অক্ষয় হবে।/ ভিক্ষা-অন্নে বাঁচাব বসুধা/ মিটাইব দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা।’

'অভিসার' কবিতায় দেখা যায় সেই বিশ্ব প্রেমের বা মানবতার এক রূপ। সন্ন্যাসী উপগুপ্ত পরিত্যক্তা বাসবদত্তার কাছে ফিরে আসে তার সবথেকে কঠিন সময়ে, তার সেবক হয়ে। এখানে উপগুপ্তর প্রেম অহং বর্জিত, তাই সে সেবার মধ্যে দিয়েই আনন্দের সন্ধান পায়।

তেমনি আবার শ্যামা নাটকে বজ্রসেনের 'ক্ষমিতে পারিলাম না যে/ ক্ষমো হে মম দীনতা' আসলে সেই বুদ্ধের সেই ক্ষমাসুন্দর দর্শনকেই নতুন করে প্রকাশ করে।

বুদ্ধের এই সর্বত্যাগী দর্শন যেমন অনেক সাধারণ মানুষকে টেনে এনেছিল বৈদিক আচার-সর্বস্ব ধর্মাচরণ থেকে, তেমনই এতে আকৃষ্ট হতে দেখা যায় তৎকালীন কিছু শাসককে। ধর্মপ্রচারে তথাগতের জন্য ছিল এটা ছিল ব্যতিক্রমী সাহায্য। এমনকি বিম্বিসারের মতো শাসকদের আনুকূল্য বুদ্ধ পেতে শুরু করেন বোধিলাভের অনেক আগে থেকেই। কিন্তু তা বলে যে প্রথম থেকেই এটা সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছিল তা কিন্তু নয়। সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ, বিশেষ করে রাজ পরিবার বা প্রভাবশালী অংশের মধ্যে এর বিরোধিতাও ছিল যথেষ্ট পরিমাণে। হয়তো তার একটা বড়ো কারণ ছিল এর ধর্মচর্চার দিকটা। ব্রাহ্মণ্যবাদের রীতি থেকে বেরিয়ে এসে বা বিলাসবহুল জীবন থেকে নিজেদের বিচ্যুত করে আক্ষরিক অর্থে সর্বত্যাগী হওয়া সোজা কথা নয়।

এই ত্যাগ ও ভোগের দ্বন্দ্বের পরিসরটা রবীন্দ্রনাথ ব্যাপকাকারে দেখিয়েছেন 'নটীর পূজা'য়। যেখানে রাজমহিষী লোকেশ্বরীর হাহাকার বেরিয়ে আসে তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে। তার আনুকূল্যে বৌদ্ধধর্ম প্রবেশ করে রাজপ্রাসাদে, সে নিজে ভিক্ষুদের অন্নবস্ত্র দান করেছে, নিষ্ঠার সাথে তথাগতের থেকে ধর্মোপদেশ শুনেছে। কিন্তু তার বিনিময়ে আজ সে হয়েছে রিক্ত। রাজা বিম্বিসার সিংহাসন ত্যাগ করেন--- একমাত্র পুত্র বুদ্ধের অনুগামী হয়ে ভিক্ষুজীবন বেছে নেয়, তখন সে নিজেকে সর্বস্বান্ত ভাবে। তাই আবার ফিরে যেতে চায় পুরোনো বিশ্বাসে, ক্রোধে অন্ধ হয়ে বলে ওঠে ‘অহিংসা ইতরের ধর্ম। হিংসা ক্ষত্রিয়ের বিশাল বাহুতে মাণিক্যের অঙ্গদ, নিষ্ঠুর তেজে দীপ্যমান। দুর্বলের ধর্ম মানুষকে দুর্বল করে। দুর্বল করাই এই ধর্মের উদ্দেশ্য। যত উঁচু মাথাকে সব হেঁট করে দেবে।’

কিন্তু সেই দ্বন্দ্ব ঘুচে যায় শ্রীমতীর ভক্তি দেখে, নিবেদিত নিষ্ঠা দেখে। মানবতার প্রেম বিতরণের মন্ত্র শ্রীমতী নিয়েছে, তাই শিয়রে মৃত্যু নিয়েও অকুতোভয় শ্রীমতি নাচের অর্ঘ্য দান করে বুদ্ধের প্রতি, সব শাসন দূরে সরিয়ে গেয়ে ওঠে 'যা-কিছু মলিন, যা-কিছু কালো/ যা-কিছু বিরূপ হোক তা ভালো,/ ঘুচাও ঘুচাও সব আবরণ।/ হে মহাজীবন, হে মহামরণ,/ লইনু শরণ, লইনু শরণ।'

আর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তখন সমবেত হয়ে গেয়ে ওঠে 'সকল কলুষ তামস হর,/ জয় হ'ক তব জয়,/ অমৃতবারি সিঞ্চন কর/ নিখিল ভুবনময়।'

পথের শেষে সবাই এসে আশ্রয় নেয় বুদ্ধ, ধর্ম, সঙ্ঘের ত্রিশরণে। জয় হয় সেই অহিংসার আর মানবতার।

বুদ্ধের দর্শনে সামাজিক সাম্যের কথা যোগ করে এক নতুন মাত্রা, সরাসরি আঘাত হানে সামাজিক বর্ণভেদের ওপর, যা ভাঙ্গন ধরায় ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিষ্ঠানিক চিন্তাধারাকে। সেই আঘাতের আঁচ এসে লাগে সমাজের অভিজাত শ্রেণীর ওপর। তাই রাজমহিষী বা রাজকুমারীরা মেনে নিতে পারে না যখন দেখে রাজবাড়ীর নটী পেয়ে যায় বুদ্ধের পুজোর দায়িত্ব আর বুদ্ধের অন্য ভিক্ষু বা অনুচররাও আসে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণী থেকে।

প্রকট সেই বৈষম্যের মাত্রা প্রকটতর হয় ‘চণ্ডালিকা’য় এসে। পৃথিবীতে খুব কম ধর্মই আছে যা মান্যতা দেয় জন্মান্তরবাদকে। হিন্দু আর বৌদ্ধ হয়তো তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তবে দুই ধর্মের দর্শনে একটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। দুই ধর্মেই জন্মান্তরবাদের সাথে জুড়ে আছে কর্মফল। হিন্দুধর্মে এই কর্মফলের সঙ্গে যেখানে জুড়ে রয়েছে বর্ণভেদ, কিন্তু বুদ্ধের দর্শন কখনই কর্মফলের অজুহাতে বর্ণভেদ বা অস্পৃশ্যতাকে অনুমোদন করেনি।

আপাত সাদৃশ্যের আড়ালে অন্তর্লীন বিরোধের চরিত্র পরিস্ফুট হয়ে উঠতে দেখি ‘প্রকৃতি’র বিদ্রোহে। সে দৃপ্ত ঘোষণায় জানায় সে মানে না এই ধর্ম, বলে, ‘যে-ধর্ম অপমান করে সে-ধর্ম মিথ্যে। অন্ধ ক’রে, মুখ বন্ধ ক’রে সবাই মিলে সেই ধর্ম আমাকে মানিয়েছে।’ মরিয়া হয়ে উঠে বলে, ‘যে-বিধানে কেবল শাস্তিই আছে, সান্ত্বনা নেই, মানব না সে বিধানকে।’ হাহাকার করে বলে ওঠে, ‘যে আমারে পাঠাল এই অপমানের অন্ধকারে, পূজিব না, পূজিব না সেই দেবতারে পূজিব না।’

অন্ধকূপের সেই জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে সে আশ্রয় চায় আনন্দের কাছে। আনন্দ তাকে বলে 'যে-মানুষ আমি তুমিও সেই মানুষ; সব জলই তীর্থজল যা তাপিতকে স্নিগ্ধ করে, তৃপ্ত করে তৃষিতকে', আনন্দ তাকে নতুন করে জীবনের অর্থ শেখায়, আশ্বাস দিয়ে বলে 'যে মানব আমি সেই মানব তুমি কন্যা।' প্রকৃতি বিহ্বল হয়ে পড়ে, এক জন্মের মধ্যেই তার আরেক নবজন্ম হয়। আরও একবার জিতে যায় মানবধর্ম।

বুদ্ধের জীবন বা ধর্মীয় দর্শনের বাইরে এসে একটা বড়ো দিক হল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। যে কোনো প্রতিষ্ঠানে (এক্ষেত্রে ধর্মও একটা প্রতিষ্ঠান)--- বিশেষত কোনো প্রতিষ্ঠান যখন একজন দূরদর্শী মানুষের তৈরী এবং সেই মানুষটির দূরদৃষ্টি যখন নিজ-দর্শনে প্রতিষ্ঠানটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে নিজের সময়ের থেকে অনেক বেশি যুগ ধরে, তখন অনেক কিছুর মধ্যে--- প্রকট হয় কিছু গুরুতর সমস্যা যা প্রতিষ্ঠানকে অনেকটাই আত্মধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।

তার মধ্যে অতি পরিচিত অথচ প্রচলিত দিক হল নিয়মের বেড়াজাল। যে নিয়ম ভাঙার প্রথা নিয়ে প্রতিষ্ঠান শুরু করেন হোতাগণ, সময়ের সাথে তাঁরা নিজেরাও বাঁধা পড়ে যান এই নিয়মের বেড়াজালে। এই জালে বুদ্ধদেব নিজে পড়েছেন বারেবারে (ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রনাথ নিজেও এর শিকার)। সেই বেড়াজাল কাটানোর কথা, তার অচলাবস্থাকে তুলে ধরেছেন ‘অচলায়তন’ নাটকে।

আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান যখন সাম্রাজ্যলোভে বুদ্ধের দোহাই দিয়ে অন্য দেশ আক্রমণ করে, তখন সেই ধিক্কারে রবীন্দ্রনাথ লেখেন (‘বুদ্ধভক্তি’):

'জাপানের কোনো কাগজে পড়েছি, জাপানি সৈনিক
যুদ্ধের সাফল্য কামনা করে যুদ্ধমন্দিরে
পূজা দিতে গিয়েছিল। ওরা শক্তির বাণ মারছে চীনকে,
ভক্তির বাণ বুদ্ধকে।'

বোধিসত্ত্বের কথা নিখাদ ধর্মকথা নয়, একে ধর্মের কোনো বেড়াজালে বেঁধে রাখা যায় না। এ মানবতার গোড়ার কথা, যা কয়েক সহস্রাব্দ পেরিয়ে এসেও একই রকম প্রযোজ্য, প্রাসঙ্গিকতা হারায় না এতটুকু। আজীবন তাই সেই বুদ্ধদেবকে লালন করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ, কোথাও কোনো বিচ্যুতি দেখলে তার সমালোচনা করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। বুদ্ধদেবের কাছে নিজের অর্ঘ্য সাজিয়েছেন তাঁকে ভারতবর্ষের মহামানবের আখ্যা দিয়ে, যিনি জাতির বাইরে বেরিয়ে মানুষের অন্তরাত্মাকে আহ্বান করেছেন। গানের মধ্যে দিয়ে কবি ব্যক্ত করেছেন বুদ্ধের প্রতি তাঁর চিরপ্রণতি:

'দীনতা হতে অক্ষয় ধনে, সংশয় হতে সত্যসদনে,
জড়তা হতে নবীন জীবনে নূতন জনম দাও হে ॥
ভয় হতে তব অভয়মাঝে নূতন জনম দাও হে ॥'