প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার
Posted in প্রবন্ধআচ্ছা, ভগবান বুদ্ধদেব কি কৃষক ছিলেন? এই প্রশ্নটা শুনে অনেকেই অবাক হতে পারেন। কিন্তু ঘটনাটি একেবারেই সত্য। সেটাই ভগবান বুদ্ধের জন্মমাসে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা এই আশ্চর্যের বিষয়টি এখানে আলোকপাত করব।
সেবার ভগবান বুদ্ধদেব মগধের একনাল গ্রামে ছিলেন। সেই গ্রামে বৃষ্টি হয়েছিল এবং সেটা ছিল ঠিক বীজ বপনের সময়। সকালবেলা যখন পাতাগুলো তখনও শিশিরে ভেজা ছিল। সেই সময় বুদ্ধদেব এক ক্ষেতে গেলেন। সেখানে তখন একজন ধনী ব্রাহ্মণ ছিলেন যাঁর নাম ভরদ্বাজ বা কাশী ভরদ্বাজ। তিনি একজন ব্রাহ্মণ কৃষক হলেও ধনবান ছিলেন কেননা তাঁর পাঁচশো লাঙ্গল দিয়ে চাষ করতেন। তা তিনি একবার তাঁর ফসল উৎসব পালন করছিলেন। সেই সময় বুদ্ধদেব তাঁর ভিক্ষার বাটি নিয়ে খাদ্য ভিক্ষা করতে এলেন ভরদ্বাজের কাছে। তথাগত বুদ্ধ যে সময়ে সেখানে পৌঁছে ছিলেন ঠিক তখনই ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজ শ্রমিকদের মধ্যে খাবার বিতরণ করছিলেন। তা, গৌতম বুদ্ধ সেখানে ভিক্ষা পাওয়ার আশায় অপেক্ষা করছিলেন। সন্ন্যাসী গৌতম বুদ্ধকে দেখে বেশ কয়েকজন শ্রদ্ধা জানালো। কিন্তু ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজ বুদ্ধের ওপর বেশ অসন্তুষ্ট হলেন ও রেগে গিয়ে বললেন, "ওহে শ্রমণ (বৌদ্ধ বা ভিক্ষু), ভিক্ষা করার চেয়ে কাজে যাওয়া আপনার জন্য ভালো হবে। আমি চাষ করি এবং বীজ বপন করি। আর চাষ ও বীজ বপনের পরে খাই। আপনি যদি একই কাজ করতেন, তাহলে আপনিও খেতে পারতেন। হে তপস্বী, আপনিও চাষ করুন এবং বীজ বপুন, তারপর খাবেন।"
তাঁর এই কথা শুনে তথাগত বুদ্ধ উত্তর দিলেন যে, "হে ব্রাহ্মণ, আমিও আপনার মতো চাষ করি এবং বীজ বপন করি আর চাষ ও বীজ বপনের পরে খাই।"
একজন সন্ন্যাসীর মুখে এই ধরণের কথা শুনে ভরদ্বাজ বেশ অবাক ও কৌতূহলী হয়ে বললেন, " আপনি বলছেন যে আপনি চাষ করেন এবং বীজ বপন করেন। অর্থাৎ, আপনি কি নিজেকে কৃষক হওয়ার দাবি করছেন? কিন্তু, আমি তো আপনাকে চাষ করতে তো দেখছি না। আপনি চাষ করলে, আপনার ষাঁড় কোথায়? বীজ এবং লাঙলই বা কোথায়?"
এই কথার উত্তরে বুদ্ধদেব খুব সুন্দর একটা উত্তর দিয়েছিলেন। তথাগত বুদ্ধ বললেন, "বিশ্বাস হল বীজ যা আমি বপন করি। আমার শিক্ষা, ভালো বা সৎ কর্ম হল সেই বৃষ্টি যা তাকে সার দেয় বা উর্বর করে তোলে। জ্ঞান হল ধুরা এবং নম্রতা হল লাঙল বা লাঙ্গলের ফাল। আমার মন হল নিয়ন্ত্রণকারী লাগাম বা দড়ি। মননশীলতা হল লাঙ্গলের ফাল এবং চালনা। আমি ধর্মের হাত ধরে থাকি। আন্তরিকতা হল আমার ব্যবহৃত ঠেলা। আর চেষ্টা হল আমার টানা গরু। আমি কর্মে, কথায় এবং খাদ্যে সংযত। এই চাষ করা হয় মায়ার আগাছা ধ্বংস করার জন্য। এই চাষ যে ফসল দেয় তা হল নির্বাণের অমর জীবন, এবং এইভাবে সব দুঃখের অবসান হয়।" এই নির্বাণ হল বৌদ্ধ সাধনার চরম পরিণতি বা পরম প্রাপ্তি এবং এই জগতের সমস্ত দুঃখ বা জন্ম-মৃত্যুর যে চক্রাকার তার থেকে মোক্ষলাভের শর্ত। নির্বাণ হল তৃষ্ণা বা জাগতিক সমস্ত চাহিদার বিনাশ। এই নির্বাণ হল সেই পরম অবস্থা যেখানে জন্ম-মৃত্যু, জরা, ব্যাধি, শোক, মনস্তাপ, হতাশা— এসব কিছুর স্থান নেই। এমনকি সেখানে পৃথিবী, সূর্য, গ্রহ, তারা, জল, তেজ, বায়ু, অন্ধকার— কোনও কিছুই নেই। এখানে সংসার স্রোতের গতি যেন রুদ্ধ হয়ে গেছে।
এই কথা শুনে ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজের মন গলল। তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন এবং খুব খুশি হয়ে গৌতম বুদ্ধের ওপর সদয় হলেন। তিনি একটি সোনার বাটিতে পায়েস ঢেলে বুদ্ধদেবকে উৎসর্গ করলেন। আর বললেন, "হে মানবজাতির গুরু, এই পায়েস গ্রহণ করুন। কারণ, পরম পূজনীয় গৌতম এমন এক চাষ করেন যা মানবজাতিকে অমরত্বের ফল প্রদান করে।"
কিন্তু গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিক্ষার বিনিময়ে খাবার গ্রহণ করতে পারবেন না বলে সেই খাবারটি অস্বীকার করলেন। তখন ধনী কৃষক ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজ ভগবান বুদ্ধের পায়ে পড়লেন। আর পায়ে পড়ে তিনি বুদ্ধদেবকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দলে যোগ দিতে চান তা জানালেন। এই ঘটনার কিছুকাল পরেই, ভরদ্বাজ অর্হৎ অর্থাৎ নির্বাণ প্রাপ্তিলাভ করেছিলেন।
আসলে, সেই বিখ্যাত একটা গান আছে না - “মন রে কৃষিকাজ জানো না, এমন মানব জমিন রইলো পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা।” সেই গানের সূত্র ধরেই বলছি বুদ্ধদেব মানুষের মনের চাষ করতেন। সেই চাষের ফলে যাতে সেই মানুষটি সমাজে একটি সোনারূপে প্রকাশিত হত। দেশ ও দশের কাজে যেন লাগে। অঙ্গুরীমালের মতো ডাকাতকে তিনি নিজের মঠের ভিক্ষু বানিয়ে তাকে স্বাভাবিক মানুষের জীবনে এনেছিলেন। আবার অন্যদিকে একজন পতিতাকেও তিনি ঘৃণা না করে তাকে বৌদ্ধ মঠের ভিক্ষুণী বানিয়েছিলেন। যার সন্ন্যাসে মন নেই সংসারে মন তিনি তাকে সন্ন্যাসী জীবন থেকে আবার সংসারে ফিরে কাজ করতে বলেছিলেন। সন্ন্যাস বা সংসারে যেকোনও মাধ্যমে থেকেই কাঙ্খিত নির্বাণ লাভ করা সম্ভব। তিনি তাঁর অসাধারণ বোঝনোর ক্ষমতা ও আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারা কুব্যক্তিকেও সুপথে চালনা করেছিলেন। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদি যাবতীয় বিভেদ মুছে দিয়ে তৎকালীন ভারতবর্ষের বুকে এক নতুন মানবতার ধর্ম প্রচার করেছিলেন। তাঁর বৌদ্ধ ধর্ম প্রথমদিকে হিন্দুধর্মের থেকে হিংসাত্মক প্রতিরোধ পেলেও এই ধর্মের কিন্তু হ্রাস হয়নি বরং ভারতবর্ষের বাইরেও বিভিন্ন দেশে স্বমহিমায় প্রচারিত হয়েছে। এই ব্যাপক প্রচারের পেছনে রয়েছে সমস্ত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে সত্য, অহিংস এবং মানবতার বাণী প্রচার করা। আর এই ধর্ম মানবজাতিকে জানিয়েছে চারটে সত্য কথা বা চতুরার্য সত্য আর সেটা হলঃ- ১) এই জগৎ দুঃখের। ২) এই দুঃখের কারণ আছে আর তা হল তৃষ্ণা বা আকাঙ্খা। এই তৃষ্ণা ইন্দ্রিয় সুখের প্রতি বা জীবনধারণের প্রতি বা যেকোনো কিছুর প্রতি হতে পারে। ৩) সেই তৃষ্ণা নিরোধ বা অবসানের মাধ্যমে দুঃখের নিরোধ বা অবসান ঘটানো সম্ভব। ৪) দুঃখ নিরোধ বা অবসানের জন্য একটি পথ আছে আর সেই পথটি আটটি নীতি নিয়ে গঠিত, যাকে ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’ বলা হয়।
এই দুঃখ অবসানের মার্গ বা উপায়কে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়। আর এই আটটি মার্গ একত্রে দুঃখের অবসান ঘটিয়ে নির্বাণলাভের দিকে নিয়ে যাবে। এই আটটি মার্গগুলি একে অপরের ওপর নির্ভরশীল এবং পরস্পর সংযুক্ত হয়ে নির্বাণলাভ করার জন্য এক সম্পূর্ণ পথ সৃষ্টি করে থাকে।
সেই অষ্টাঙ্গিক মার্গ হলঃ-
১) সম্যক দৃষ্টি বা সঠিক উপলব্ধি- এর ফলে চতুরার্য সত্যগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে পারা যায়।
২) সম্যক সংকল্প- অর্থাৎ, দৃঢ় বাসনা রাখা সত্য বা নির্বাণলাভ করার জন্য।
৩) সম্যক বাক্য- কোনোরকম মিথ্যাকথা, কটু বা কঠোর বাক্য, পরনিন্দা, বৃথা আলাপ ও মূর্খের মতো বাক্যালাপ না করা।
৪) সম্যক আচরণ- কোনোরকম প্রাণীহত্যা, চুরি, অন্যায় ও অসংযম আচরণ থেকে সম্পূর্ণভাবে নিজে বিরত থাকা।
৫) সম্যক আজীব- সুস্থ ও সবল থাকার জন্য সদালাপ ও সদাচারে অভ্যস্ত হয়ে সৎ উপায়ে বা সৎভাবে জীবন ধারন করা। সম্পূর্ণভাবে পাপ ও কলূষমুক্ত হয়ে জীবন কাটানো।
৬) সম্যক প্রচেষ্টা- মনকে শুদ্ধ ও পবিত্র রাখার জন্য সব সময় অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকার ও ভালো কাজের চেষ্টা করা।
৭) সম্যক স্মৃতি- দেহ ও মনকে সম্পূর্ণ সজাগ ও সচেতন রাখা।
৮) সম্যক সমাধি- পরিপূর্ণ একাগ্রতা বা সমাধি বা ধ্যান। সমাধির চারটি স্তর আছে এবং শেষ স্তরে গিয়ে নির্বাণ লাভ হয়। এই নির্বাণ অবস্থায় মানুষের যাবতীয় মোহ, চাহিদা, লোভ, তৃষ্ণা বা আকাঙ্খা এবং অবিদ্যা চিরতরে দূর হয়ে যায়। সেই ব্যক্তি জন্ম-মৃত্যুর জাল থেকে মুক্তিলাভ করেন এবং তাঁর সমস্ত দুঃখের অবসান হয়।
এইভাবে গৌতম বুদ্ধ কৃষকরূপে আমাদের মনে সত্য ও নির্বাণলাভের আকাঙ্খার বীজ বপন করে আমাদের যাবতীয় ভালো গুণগুলোর চাষ করে আমাদের প্রকৃত মানবতার পথ দেখিয়েছেন এবং সোনার ফসল ফলিয়েছেন। দুঃখ নামক আগাছাকে একেবারে সরিয়ে আমাদের পরম সুখ বা নির্বাণলাভের পথ দেখিয়েছেন। ভগবান বুদ্ধদেব একজন যেন প্রকৃতপক্ষে মানব-জমিনের অন্যতম সেরা কৃষক।