Next
Previous
0

গল্প - অচিন্ত্য দাস

Posted in

মিকা আজ খুব ব্যস্ত। জন্মদিনের পার্টি এই শনিবার – বন্ধুদের ডাকতে হবে। ফোন থেকে নামের লিস্ট করছে। কলেজে এটাই শেষ বছর, এরপর বন্ধুরা কে কোথায় চলে যাবে কোন ঠিক নেই। এ তে অর্কাভ, অনুসূয়া … বি তে বিপ্র, বিদিশা, এই করতে করতে এইচ এ হরিতাভ, হিয়া। তারপর আই। একটাই নাম রয়েছে। ইন্দ্রাশিস। মিকা এখানে একটু থেমে গেল। সবাইকে নেমতন্ন করতে যে বয়ানটা ফরওয়ার্ড করছিল, একে আলাদা করে একটু অন্যরকম লিখল। শেষে ফুল কেক এসবের অনেকগুলো ইমোজি লাগিয়ে দিল।

কলেজের মেয়েদের মধ্যে মিকাকে সুন্দরী বলা যেতে পারে। স্মার্ট আর মিশুকে - তাই বন্ধুর অভাব নেই। ছেলেরা সকলেই মিকার আশেপাশে থাকতে চায়। ইন্দ্রাশিস ছেলেটা বিহার থেকে পড়তে এসেছে। একটু কম মিশুকে, বাংলাটা ভালো বলতে পারে না বলে কথা কম বলে। সারা কলেজে এই শুধু মিকাকে ওর ভালোনাম মানে অনামিকা বলে ডাকে। মিকা একবার জিগেস করাতে বলেছিল “অনামিকা মিকার থেকে ভালো শোনায়।” ছেলেটাকে সকলে ইন্দর বলে ডাকত। মিকা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল “আমিও ইন্দ্রাশিস বলবো, এই নামটাই আমার ভালো লাগে।”

একটা মেয়ের কাছ থেকে যথেষ্ঠ জোরালো ইঙ্গিত। ইন্দ্রাশিসের অবশ্য সেরকম কোনো জবাব মুখে আসেনি, তার স্বভাবসিদ্ধ হাসিটুকু ছাড়া।

***

মিকাদের ফ্ল্যাটটা বেশ বড়। বাবা বড় কী একটা কোম্পানীর ডিরেক্টার। সন্ধে থেকেই মিকার জন্মদিনের পার্টি জমে গেল। প্রায় সকলেই এসে গেছে – মেয়েরা হইচই করছে, ছেলেরা অনেকেই মিকার সঙ্গে ফ্লার্ট করতে চাইছে। মিকা দারুণ সেজেছে আজ, সিনেমার রাজকুমারীদের মতো লাগছে। মিকার চোখ কিন্তু একজনকে খুঁজছে, সাড়ে আটটা তো বেজে গেল। সে কি আসবে না?

সে যখন এলো তখন প্রায় নটা বাজে। উৎসবের সন্ধে শেষ হতে চলেছে। মিকা কালো চকলেট ভালোবাসে তাই সে বড় সাইজের একটা চকলেট এনেছে। প্যাকেটটা সুন্দর কিন্তু তার ওপর রাংতা লাগানো একটা কাগজ জড়িয়েছে যত্ন করে। মিকা দেখেই বুঝেছে – কালো চকলেট। পরে মিতা দেখেছিল একটা ছোট কার্ডে ইংরেজিতে লেখা ছিল – শুভ জন্মদিন, টু ইউ ফ্রম আই। সেদিন সে বেশিক্ষণ ছিল না, রাত সাড়ে দশটার ট্রেন ধরে দেশে যাবে, তার মার শরীর ভালো নয়।

মিকার ঘরের দেয়ালে একগাদা ছবিছাবা লাগানো ছিল, যেমন থাকে আর কি। অরিজিৎ সিং, বিরাট কোহলি, টিউলিপের ক্ষেত, দিল দে চুকে সনমের ঐশ্বরিয়া। জন্মদিন-পার্টির পাট চুকে গেলে রাত্তিরে ঘরে বসে মিকা চকলেটের মোড়কটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করল কয়েকবার। তারপর ছিঁড়ে-যেন-না-যায় তেমন করে সাবধানে খুলল। তা কাগজটা আস্ত ছিল। দুফুট খানেক লম্বা, ইঞ্চি দুয়েক চওড়া ফিতের মতো চকচকে কাগজ। হাতে নিয়ে দেখল খানিকক্ষণ। তারপর কী ভেবে কে জানে ফিতের মতো কাগজটা আঠা দিয়ে ওদিকের খালি দেয়ালে লম্বালম্বি সেঁটে দিল। কেউ অতটা বুঝবে না যে ইরেজির আই অক্ষরটা মিকা তার ঘরের দেয়ালে লাগিয়ে রাখল।

ঘড়ির কাঁটা ঘোরে, ক্যালেন্ডারের পাতা শেষ হয়, নতুন বছর আসে আবার চলেও যায়। কলেজের পর মিকা ভর্তি হলো ইউনিভারসিটিতে। এম এ পরীক্ষার আগেই কথাবার্তা শুরু হয়েছিল, পরীক্ষার পর পাকাপাকি হয়ে গেল। ছেলেটি দিল্লীর, ওখানেই বাড়ি, ওখানেই বড় হয়েছে, চাকরিও করে দিল্লীতে। মানানসই ঘরের ছেলে। সম্বন্ধ করা বিয়েতেও আজকাল আলাদা করে ছেলে আর মেয়ের দেখা-সাক্ষাতের রেওয়াজ হয়েছে – মিকার অনীশকে খারাপ লাগেনি। অনীশ ছেলেটাও মোটামুটি ভালো। তারও পছন্দ মিকাকে। অতএব, অতএব দেরি না করে বিয়ে হয়ে গেল। কোলকাতা ছেড়ে মিকা চলে গেল দিল্লী।

মাস ছয়েক পর অনীশের কী একটা আপিসের কাজ পড়ল কোলকাতায়। আর ঠিক তখনই মিকার বাবা-মা একটা ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে ইউরোপ ঘুরতে গেলেন। অনীশ আপিসের কাজের পরে কদিনের ছুটি নিল। মিকাকে এসে বলল – “ডারলিং, আমাদের দ্বিতীয় হনিমুন হতে চলেছে। আমি ভীষণ লাকি – শ্বশুর বাড়িতে হনিমুন – ভাবা যায়!”

মিকা অনীশকে নিয়ে কলকাতা দেখাল ঘুরে ঘুরে। ট্রাম, হাতে টানা রিক্সা, মোগলাই পরোটা, বিশ্ববাংলা গেটের ওপর রেস্তঁরা। অনীশ খুশি, মিকাও। অনীশ একবার হাসতে হাসতে বলল “এত জায়গা দেখাচ্ছ, তোমার এক্স এর সঙ্গে দেখা করালে না!” মিকা বলল “আমার এক্স ওয়াই জেড বলে কোন কিছু নেই।” অনীশ মিকার গাল টিপে দিয়ে বলল “আমার আছে, ওয়াই – মানে ইউ মানে তুমি!” মিকা হেসে গড়িয়ে পড়ল “আহা কী ভালো ছেলে রে আমার, নাক টিপলে দুধ বেরোয়…”

সারাদিন ঘোরাঘুরির পর রাত্তিরে তাড়াতাড়ি বিছানায় শুয়ে পড়ল দুজনে। এটা মিকার ঘর, যদিও এখন এ ঘর সেই কলেজের মিকার ঘর আর নেই। তার দু-একটা বই, টেডি বিয়ার তাকে রাখা আছে এই পর্যন্ত।

শোয়ার এবং আলো নিবিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের খেলা শুরু হয়ে গেল। আজ সারাদিন আকাশ পরিষ্কার ছিল তবে এখন পূর্ব সাগর থেকে হাওয়া উঠেছে। সে হাওয়ায় মেঘ এসে জড়ো হয়েছে – মেঘ কিন্তু রাতের আকাশের মতো কালো অন্ধকার হয় না। মেঘ থেকে খুব হালকা এক ধরনের হলদেটে লাল আলো বিচ্ছুরিত হয়। প্রায় অদৃশ্য ক্ষীণ সে আলো জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছে … পরদা উড়ছে এলোমেলো।

একটা ক্যালেণ্ডার গভীর এক রহস্যময় কক্ষের দেয়ালে ঝোলানো থাকে। তাতে বার-তারিখ অস্পষ্ট। কিছু অদ্ভুত ছবি আঁকা হতে থাকে তার পাতায় পাতায়। সে ছবির কখনো মানে থাকে কখনো থাকে না। কোন ছবিতে হয়তো আলমারির খোলা পাল্লা দিয়ে একটা চন্দন কাঠের বাক্স দেখা যাচ্ছে। ছবি হলেও চন্দনের হালকা সুবাস মাঝেমাঝে ভেসে আসে। কোনো পাতায় হয়তো ভ্যান গগের আঁকা ছবির মতো গমের ক্ষেত। মন খারাপ করা আলোয় দুটো বিকেলের পাখি উড়ে যায় – অনেক দূর থেকে ফিরে ফিরে আসে একটা বিষন্ন সুর– কোনো ওস্তাদ যেন সরোদে মারোয়া রাগে আলাপ ধরেছেন। কখনো সখনো অনেকদিনের ওপার থেকে অজানা এক বাতাস ঢুকে পড়ে, ক্যালেন্ডারের পাতা ফুরফুর করে উড়তে থাকে – পুরোনো কোনো একটা ছবি দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়। হয়তো বা কড়া দিনের আলোতে না এসে সে ছবি আসে স্বপ্নে, অথবা হয়তো ‘অলস অন্যমনে’।

এ ক্যালেণ্ডার এক এক জনের নিতান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এই সুবাস, এই সুর, এই মন খারাপের খবর অন্য কারোর সঙ্গে ভাগ করা যায় না, ভাগ হয় কি?

এ ক্যালেণ্ডার সবার কাছেই থাকে ঠিকই তবে এটা ধরে বসে কেউ বেঁচে থাকে না। বেঁচে থাকা যায়ও না।

বেঁচে থাকা মানে আজকের সময়, আজকের জায়গা, আজকের আমি, আজকের তুমি। বেঁচে থাকা মানে আজকের বৃষ্টি, আজকের যানজট, আজকের শোক-সংবাদ, আজকের ফুটবল ম্যাচ।

শরীরের খেলা চলছে। মিকার চোখ যায় দেয়ালের দিকে। মেঘের অতিস্তিমিত আভায় দেখতে পায় ফুট দুই লম্বা ইঞ্চি দুয়েক চওড়া এক ফালি দেয়াল যেখানে রংটা একটু আলাদা। কাগজটা আর নেই তবে মিকার নজরে পড়ল গুঁড়োগুঁড়ো একটু একটু কী যেন লেগে আছে। মিকা জানে ওটা আঠার বাকি থেকে যাওয়া চিহ্ন – যে আঠা দিয়ে কাগজটা লাগানো হয়েছিল।

শরীরের খেলা আরও জমে উঠেছে। মিকা আদুরে গলায় অস্ফুট স্বরে বলল “চল, অন্য ঘরে যাই”

- “কেন সোনা…”

- “এ ঘরটা ভালো নয়, দেখছো না দেয়ালগুলো কীরকম হয়ে গেছে, রং করাতে হবে।”