Next
Previous
0

প্রবন্ধ - দিলীপ মজুমদার

Posted in




















-“ আমি তখন পড়ছিলাম । ছেলে হিকারি শুনছিল মিউজিক । আমার অন্য ছেলে যে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ো-কেমিস্ট্রির ছাত্র এবং আমার মেয়ে সোফিয়া ছিল ডাইনিং টেবিলে । এরা কোনদিন আশা করে নি যে আমি নোবেল প্রাইজ পাব । তখন রাত পৌনে ন’টা । একটা ফোন কল এল। ফোনটা ধরল হিকারি । বাড়িতে ফোন এলে হিকারই ফোনটা ধরে । ফোনে কথা বলা , উত্তর দেওয়া তার শখ । ‘হ্যালো , কেমন আছেন ? ‘ ওদিক থেকে কেউ বলছেন । ফরাসি , রাশিয়ান , জার্মান , চিনা ও কোরিয়ান ভাষায় । হিকারি ইংরেজি ভাষায় শুধু বলল ‘নো’ , একটু পরে সে ‘নো’ শব্দটার পুনরাবৃত্তি করল । এরপর সে ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিল । যিনি ফোন করেছেন , তিনি সুইডিশ অ্যাডেমির একজন সদস্য । তিনি প্রশ্ন করলেন , ‘আপনি কি কেনজাবুরো ওয়ি ? আপনি নোবেল পেয়েছেন । ‘ আমি জানতে চাইলাম হিকারি কি বলেছে , সে নোবেল প্রত্যাখ্যান করেছে কি না । যখন জানলাম এ ব্যাপারে হিকারি কিছুই বলে নি , তখন আমি পুরস্কার গ্রহণের সম্মতি জানালাম । ফোন রেখে আমি ডাইনিংএর চেয়ারে বসলাম । আমার ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে বললাম নোবেল পাওয়ার কথা । আমার স্ত্রী রুদ্ধশ্বাসে বলল . ‘ঠিক তো ?’

এসব ১৯৯৪ সালের কথা । জাপানের দ্বিতীয় নোবেল প্রাপ্তি । ১৯৬৮ সালে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা পেয়েছিলেন নোবেল , ১৯৯৪ তে পেলেন কেনজাবুরো । ‘আ পার্সোনাল ম্যাটার’এর জন্য এই বিশ্বখ্যাত পুরস্কার । না, কোন গোল , মজাদার গল্প নেই উপন্যাসটিতে । কাওয়াবাতার রচনাভঙ্গির সঙ্গে মিল নেই কেনজাবুরোর । একজন হতাশ , বিষণ্ণ , বিক্ষুব্ধ মানুষের বিহ্বল অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে উপন্যাসটিতে।

জাঁ পল সাত্রে , আলবের ক্যামুর মতো কেনজাবুরো বেছে নিয়েছেন চেতনাপ্রবাহ রীতিকে । উপন্যাসের নায়ক বার্ড নামে একটি মানুষ । এই বার্ড তো কেনজাবুরো নিজে্ই । বার্ড এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন । এক বিকলাঙ্গ পুত্র জন্মেছে তার । মাথায় হার্নিয়ার জন্য তার মাথার খুলি অস্বাভাবিক স্ফীত। অথচ অবাক কাণ্ড সে ছেলের বুদ্ধিবৃত্তি ও সংবেদনশীলতা কম নয় । এই বিকলাঙ্গ সন্তানকে নিয়ে হতাশা জাগে বার্ডের মনে । সে কখনও ভাবে পালিয়ে যাবে সংসার ছেড়ে । পালিয়ে যাবে সুদূর আফ্রিকায় ।

আবার কখনও ভাবে মেরে ফেলবে পঙ্গু ছেলেটাকে । শেষ পর্যন্ত সে কিছুই করতে পারে না । বিক্ষত হতে থাকে অন্তর্দ্বন্দ্বে । আমরা জানি কেনজাবুরোর ছেলে হিকারিও প্রতিবন্ধী । উপন্যাসের নায়ক যেন এই যুগের প্রতিনিধি । যাকে প্রতিদিন প্রতিকারহীন পরাভবের মধ্যে দিয়ে চলতে হয় । হিকারি আর হিরোশিমার বোমা , তাঁর লেখার প্রধান প্রেরণা । ১৯৩৫ সালে জাপানের সবচেয়ে ছোট দ্বীপ শিকোকুতে কেনজাবোরোর জন্ম । হিরোশিমাতে যখন পারমাণবিক বোমা পড়ে তখন তিনি শিশু । কিন্তু বোমাবিধ্বস্ত হিরোশিমার আর্তনাদ গেঁথে যায় তাঁর সত্তায় । তিনি নিজেই বলেছেন যে তাঁর জীবনে দুটি ঘটনার প্রভাব গভীর – হিরোশিমার বোমা আর হিকারির যন্ত্রণা ।

কানজাবুরো উচ্চশিক্ষা লাভ করেন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে । তাঁর বিষয় ছিল ফরাসি সাহিত্য । সেই সূত্রে তিনি পরিচিত হলেন ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে । জাপানি সাহিত্যে তিনি নিয়ে এলেন আধুনিকতা নতুন প্রকাশভঙ্গির ব্যাপারে সজাগ ছিলেন তিনি । কানজাবুরো বলেছেন , ‘আমি জাপানি ভাষায় নতুন এক লিটারারি স্টাইল তৈরি করতে চেয়েছিলাম সচেতনভাবে । জাপানি লেখকদের মধ্যে তানিজাকি ও কাওয়াবাতা ক্ল্যাসিকাল ঐতিহ্য অনুসরণ করেছিলেন , আমি আলাদা কিছু লিখতে চেয়েছিলাম । ‘

কালানুযায়ী তাঁর রচনার তালিকা এই রকম : আ পার্সোনাল ম্যাটার ( ১৯৬৪) , দ্য সাইলেন্ট ক্রাই (১৯৬৭), দ্য ওয়াটার্স কাম ইন আনটু মাই সোল ( ১৯৭৩) , দ্য পিঞ্চ-রানার মেমোরেণ্ডাম (১৯৭৬) , দ্য গেম অব কনটেমপোরারিটি (১৯৭৯) , ‘আ কালেকশন অব গ্রটেস্ক স্টোরিজ’ (১৯৮১) , ‘ওম্যান হু লিশন টু রেইন ট্রি ( ১৯৮৩), ‘রাইজ আপ ও ইয়ং মেন অব নিউ এজ” ( ১৯৯০) ।

আত্মমগ্ন লেখক ছিলেন কেনজাবুরো । কিন্তু গজদন্তমিনারবাসী ছিলেন না কদাচ । তাঁর দৃষ্টি উন্মোচিত করে দিয়েছিল হিরোশিমার বোমা । পরে লিখেছিলেন ‘হিরোশিমা নোটস’ । যেমন ওকিনাওয়ারের গণহত্যা নিয়ে লিখেছিলেন ‘ওকিনাওয়া নোটস’ । গুন্টার গ্রাস , অ্যালান গিনসবার্গ. কুট ভনে গার্ট , কিম চি হা-র মতো ঠাণ্ডা যুদ্ধ ও পারমানবিক যুদ্ধের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে চেয়েছেন । সামিল হয়েছেন পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে । আওয়াজ তুলেছেন , ‘ রক্ষা করো আমাদের পৃথিবীকে , রক্ষা করো গাছপালা আর মানুষকে’ ।