ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(৪)
নবাবহাটে সম্প্রতি একটি দ্বাদশ শিবলিঙ্গের প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে এদিকটায় এখন বেশ জনসমাগম দেখা যায়। এর কাছেই একটা খই-বাতাসার চালা নিয়ে বসেছে এক বৃদ্ধ, এর নাম দাশু বিশ্বাস। লোকটি দেখতে আপাত নিরীহ হলেও আসলে সে রাণীমার হয়ে এই জনপদের অনেক গোপন খবরাখবর অন্দরমহলে সরবরাহ করে থাকে। দোকান ঘরটা তার বাইরের খোলসমাত্র।
" কে বাপ! এ মুক্ তো আগে দেখিনিকো! মনে হচ্চে বাইরে থেকে আসা হল! তা বেশ! রাণীমার তৈরী এই শিবক্ষেত্তর কালে কালে গয়া- কাশী'কেও ছাড়িয়ে যাবে...তা আমি এখুনি বলে রাখতেছি ! " এই বলে লম্বা শ্বাস টেনে সানুনাসিক সেই বৃদ্ধটি একটু থামলে পর, গোলকপতি অতি বিনয়ে বলে ওঠে , " আজ্ঞে খুড়ো! আমি সেই পূর্বদেশ থেকে আসচি। সাথে আবার আমার পরিবারটিও এসেচেন। দু' পয়সার দই- চিঁড়ে- বাতাসা এইসব দুটো আলাদা আলাদা দোনায় এখন মিলবে কি?...এ-এই য্যা...ধরুন দিকি!..." -
এই বলে সে নগদ দুটি পয়সা দোকানী দাশু বিশ্বাসের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
যদিও গোলকপতির কাছে খবর আছে যে তার পরিচিত চকমাণিকপুরের নিবাসী সেই আড়তদারটিও এর কাছেপিঠেই থাকে, তবে সবার আগে আপাতত একটু জলযোগ সেবা করে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই যোগাড় করতে হবে। স্থলপথ ও জলপথ মিলিয়ে রাঢ়বঙ্গের এই জনপদটিতে আসতে অনেকটা পথ পার হতে হয়েছে!
লক্ষ্মীমণি কিছু মুখে না বললেও গোলকপতি বোঝে তারা দুজনেই পথশ্রমে এখন সমানভাবে কাহিল। তাই সে ভাবল, এই দোকানী খুড়োটিকে তো বেশ চটপটে বলেই তো মনে হচ্ছে, এর কাছে আস্তানাটার যদি একটা কোন উপায় হয় তো আপাতত বেশ শান্তি পাওয়া যাবে।
........
দাশু বিশ্বাস খুব সহজেই তার নিজের একটা একটা অর্ধপরিত্যক্ত চালাঘর সামান্য কিছু তঙ্কার বিনিময়ে গোলকপতি ও তার পত্নী লক্ষ্মীমণিকে ভাড়া দিয়ে দিল। কিছুদিন আগেও এই ঘরগুলি তীর্থযাত্রীদের মধ্যে কোনও বৃদ্ধ আ বৃদ্ধার অন্তর্জলি যাত্রায়র জন্য আসা আত্মীয়স্বজনের উদ্দেশ্যে এই ব্যবহৃত হত
এখন অবশ্য ইংরেজ পত্তনে সেসব অনেকদিন উঠে গেছে।
এইরকমের একটা কুটিরেই ওরা এসে আপাতত উঠল। কুটিরটি আসলে শিব মন্দিরের অদূরেই। জনশ্রুতি আছে পাঠান আমলে শাহী সড়ক নির্মাণকালে স্বয়ং শেরশাহের নিযুক্ত ঠিকাদারেরা অস্থায়ীভাবে এই এলাকাটিতে এসে থাকা জন্য সর্বপ্রথম ঘরগুলি বেঁধেছিল।
তারপরে দিনবদলের পালায় এখন যদিও ইংরেজ আমল, তবে দিগন্ত বিস্তৃত সেই শাহী সড়কটি আজও বহাল তবিয়তে শুধু যে টিকে আছে তাই নয় বরং সাহেবরা এটিকে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নাম সহ মান্যতা দিয়েছে ও অনেকাংশে আধুনিকীকরণও করেছে।
তবে যে ভাগ্যবিপর্যয়কে পুঁজি করে গোলকপতি দেশ ছেড়ে রাঢ়ভূমিতে এসে এখন অবতীর্ণ তারই অবিশ্রান্ত পক্ষবিস্তারের সূচনা যে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে তার জন্য বোধকরি সে নিজেও প্রস্তুত ছিলনা।
এখানে এসে পৌঁছনোর পরের ভোর রাত্রি থেকে ক্রমাগত বমি ও দাস্তে লক্ষ্মীমণি ক্রমে দূর্বল থেকে দূর্বলতর হয়ে উঠতে লাগল। একে নতুন জায়গা তায় অসুস্থ রোগিণীর শূশ্রূষা করাটাই গোলকপতির কাছে ভীষণ সমস্যার বিষয়। তবু গার্হস্থ্যধর্মের রীতি অনুসারে সে পত্নীকে ছেড়ে পলায়ন করতে পারেনা। তাই সে একাই রোগীণীর সেবায় সে যথাবিহিত চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকল।
তখন রাত বেশ গভীর। দু একটা ইতস্ততঃ শিবারব ছাড়া প্রায় এই জঙ্গলাকীর্ণ এলাকাটিতে জীবনের কোনও চিহ্নমাত্র এখন নেই।
হঠাৎ নারীকন্ঠে একটি গোঙানির মত শব্দে গোলকপতির ঘুমটা এখন ভেঙে গেল। সে বুঝল যে এই আওয়াজটির উৎস লক্ষ্মীমণির শয্যা।
সে ঝটিতে উঠে একটি কূপি জ্বালিয়ে পত্নীর শয্যার কাছে তক্ষুণি ছুটে গেল ঠিকই কিন্তু যে দৃশ্য তথা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন সে হল এ যেন অবধারিত ও নিয়তিতাড়িত। পত্নীর হঠাৎ অসুস্থতা হেতু সে লক্ষ্মীমণির শয্যার কাছেই একটি মাদুর বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
সে অস্ফূট শব্দটির উৎসসন্ধানে দেখল যে পান্ডুরবর্ণা ও কৃশকায়া লক্ষ্মীমণি তার সমস্ত প্রাণশক্তি উজাড় করে শেষবারের জন্য বিদেশবিভুঁইএ ভাগ্যাণ্বেষণে আসা তার একান্তজনের হাতটা নিজের কম্পিত অঙ্গুলীতে ধরবার জন্য অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
এখন তার মুখের কষ বেয়ে রক্তমিশ্রিত একধরণের ফেনিল তরল ক্রমশ বেরিয়ে আসতে দেখে গোলকপতি বুঝে গেল যে এ ক্রমাগত দাস্ত ও বমনের জন্য তার এখন এই ভীষণ পরিণতি।
যদিও জায়গাটির নামমাত্র পরিচয় নবাবহাট, তাও জনপদটিতে এত রাতে কোন কোবরেজ বা ওষুধ পাওয়াটাও একটা অসুবিধা। ১০৮ শিব মন্দির সংলগ্ন জনজীবন এখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। কাজেই সে নিজের চেষ্টায় একটু নুন-চিনি মিশ্রিত জল লক্ষ্মীমণিকে খাওয়াতে গেল করলো বটে, তবে তার আর শেষরক্ষা হলনা। একটুখানি সেই পানীয়জলের অংশ তার গলায় যেতে না যেতেই সে তার স্বামীর কব্জিটি অতি করুণ ভঙ্গিমায় ধরে থাকল শক্ত করে। এর অল্পক্ষণ পরেই তার প্রাণবায়ুটিও দেহছাড়া হয়ে গেল।