গল্প - আর্যা ভট্টাচার্য
Posted in গল্প‘ওঃ, এত দেরি হয়ে গেল আজ কাজ থেকে ফিরতে! একটু বাদেই রিস্কো তুলে দিয়ে চুমকির বাপ ফিরে আসবে। আর ফিরে যদি দ্যাখে রান্না শেষ হয়নি, ব্যাস তাহলেই করুক্ষেত্তির।মা, মেয়ে দুজনার পিঠের ছাল আর আস্ত থাকবে না।
আর দোষই বা কী! দুটো মুড়ি চিবিয়ে কোন সকালে রিস্কো নিয়ে বেরিয়ে যায়। খিদে তো পাবেই। কিন্তু কবিতার কথাটাও যদি একটু বুঝতো! তার ও তো কোনোদিন বাবু বাড়িতে বেশি কাজ পড়ে যায়। 'পারবোনা' বলে তো আর সে চলে আসতে পারে না। কিন্তু চুমকির বাপ সেকথা বুঝলে তো! রেগে গেলে চন্ডাল।
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে তাড়াতাড়ি এস্টোভ জ্বালায় কবিতা। এমনিতেই এখন মাসের শেষ। দত্ত মাসীমা বললো, 'ছেলে আজ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছে। বাজার করার সময় পায়নি। যা না মা, একটু বাজারে ঘুরে আয়। দশটা টাকা দেবো। বেশি কিছু না। একটু, মানে পাঁচশো মতন মাছ, পাঁচশো পটল আর একটু পেঁয়াজ, কাঁচালংকা নিয়ে আয়। আজ ওতেই হবে। মা ছেলের সংসার। ওতেই হবে। '
এক তো বুড়ী এমন করে বললো তাই সে আর না বলতে পারলো না। তাছাড়া বাজারটা করে দিয়ে দশটা টাকাও তো পেল। আরও দশটা টাকা সে অবশ্য বাজার থেকে সরিয়েছে। বেশ করেছে। অত্ত বড়োলোক, নিজের দরকারে বাবা, বাছা অথচ ঠ্যাকায় পরে দুটো টাকা চাইলে খ্যাঁক করে ওঠে। বেশ করেছে সে সরিয়েছে। ওই টাকা দিয়েই তো একটু শাক আর শেষ বাজারের একটু চুনোমাছ নিয়ে এসেছে। তা করতে আরও একটু দেরি হয়ে গেলো।কী আর করা! চুমকিটা বড্ড ভালবাসে যে।
মাছটায় একটু গন্ধ ধরেছে, কিন্তু পেঁয়াজ দিয়ে কষে দিলে কিসসু বোঝা যাবেনা । তাড়াতাড়ি খুন্তি নাড়তে নাড়তে নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকে কবিতা। মেয়ের মুখে একটু মাছ তুলে দেবার আনন্দে হাসি মুখে রান্না বসায়।
‘মা দেখো, দেখো’ বলতে বলতে হাতে একটা পাতলা পুরোনো বই নিয়ে ফুরফুরে হাওয়ার মত নাচতে নাচতে ঘরে ঢুকে তার মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চুমকি। ওই তো তার একটি শিব রাত্তিরের সলতে। বাকিগুলো তো জন্মের আগেই পেট থেকে খসে গেছে। 'গভভোপাত' বিশু ডাক্তার বলেছিল।
ওই একটাই তো সম্বল। দুমুঠো দুটো ভাতের জন্যে তাকেও লোকের বাড়ি কাজ করতে পাঠাতে হয়। কিন্তু বেশি কাজ সে মেয়েকে করতে দ্যায় না। ওই দত্ত মাসীমার বাড়িতেই ওদের রাতের রুটি, চচ্চড়ি করে দ্যায়। ব্যস। সকালে ইস্কুলে যায়। মেয়ে তার ভালো। কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন তখন ওই মাতাল বজ্জাত বাপের হ’কথা ন’কথায় মার।
না একখানা ভালো পোশাক, না একটু ভালোমন্দ খাবার! এই তো একটা খুপরি। তক্তাপোষে শোয় বাপ, আর মাটিতে সতরঞ্চি চাদরে তারা মা মেয়েতে জটাপটি করে।
‘ছাড়, ছাড়। মেলা কাজ পড়ে আছে’..মেয়েকে একটা হালকা ঠ্যালা মেরে বলে কবিতা।
‘তা হলো কী হঠাৎ ভরদুপুরে? এত নাচুনি কিসের?’, পেঁয়াজটা এক চামচ তেলে ছেড়ে দিয়ে আর তারমধ্যে সামান্য জল ছিটিয়ে জিগ্যেস করল কবিতা।
“ওই যে সিনেমার নায়িকাটা আছে না?..সুতপা চক্রবর্তী...ওই যো গো রোববার যার সিনেমা দিল টিভিতে।ওই যে নতুন নায়ক পোথোম ও ছিল।“
মাকে খুব করে বোঝাবার চেষ্টা করে চুমকি।
“বুঝেছি, বুঝেছি। তা কী হয়েছে তার? করোনা? আর তা হলেই বা কী! তেনারা সব বড়োলোক। আমাদের মতো তো হাঘরে নয়, যে হলো আর মলো। ওদের অনেক টাকা পয়সা। দু'দিনেই ড্যাংডেঙিয়ে ..”
কিন্তু তার বড়োলোকদের বিরূদ্ধে তীব্র রাগের প্রকাশটা শুরুতেই ঘুচিয়ে দেয় চুমকি।
‘চুপ করো তো। কোনো করোনা নয়।'
এবার মায়ের গলাটা জড়িয়ে ধরে চুমকি। উত্তেজনায় তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। “.জানো মা ওর মেয়ের জন্মদিনের ছবি বেরিয়েছে এই সিনেমার কাগজটায়। তাও আবার নাকি নিজের মেয়ে নয়। কুড়িয়ে পাওয়া। সেই কুড়িয়ে পাওয়ার দিনকেই জন্মদিন বলে। নাকি আঠেরো বছর বয়েস হলো।”
‘বেশ হোলো। আমার নেই মরার সময়, উনি কোড়ানো মেয়ের গল্প নিয়ে এলেন। ..সর্, সর্ তো’
‘আররে আসল কথাটাই তো এখনো বলিনি’-
আহ্লাদে হি হি করে হেসে মায়ের গায়ে একেবারে গড়িয়ে পড়ে চুমকি ।
‘মজার কথা কি জানো মা, রিণা, শুভ্রা সবাই বলছে আমাকে নাকি অবিকল ওই মেয়েটার মতো দেখতে।... আরে, দেখোনা একটু। .. সত্যি মা?’
হ্যাঁ, সিনিমার নায়িকার মেয়ে নাকি তোর মতো দেখতে। হাসাসনি বাপু। মেলা কাজ পরে আছে। '
'আরে দেখোইনা একবার '
মেয়ের বায়নায় বইটা হাতে নিয়ে দেখে কবিতা।
বেশ বড়ো ছবি। সামনে একটা কেক আর মেয়েটা বড়োলোকের মেয়েদের সিনিমায় যেমন দ্যাখায়, তেমনই সেজে দাঁড়িয়ে আছে।
মেয়েটার মুখটা ভালো করে দেখে একেবারে যেন পাথর হয়ে যায় কবিতা। ঠিক যেন তার চুমকি। অথচ কী উজ্জ্বল...কী সাজপোশাক...কত সুখ...
‘শোনো না মা, মেয়েটার কপাল বটে। হাওড়ার বেলিলিয়াস রোডের এক ডাস্টবিনের ভেতর এক শীতের ভোরে...’আরো কী কী যেন বলে যেতে থাকে চুমকি…
কিন্ত মেয়ের কোনো কথাই যেন আর করুণার কানে ঢুকছেনা।
..সেও তো ছিল এক শীতের ভোর..হাওড়াতেই তো রেনু পিসি তাকে দাইঠাকমার বাড়িতে নিয়ে গেসলো...।হ্যাঁ, তা বছর আঠারো তো হবে...বলাই যে তাকে ফাঁসিয়ে এমনভাবে লাপাত্তা হয়ে যাবে...
কবিতা তো বলাইকে বিশ্বাস করেছিল। তার তখন কীইবা বয়েস। এই চুমকির মতনই হবে হয়তো। বলাই বস্তির উল্টো দিকের শা-স্টোরের মালিকের ছেলের বন্ধু ছিল। হাতে উল্কি, কানে চাপা দুল মোটরসাইকেল ফটফোটিয়ে যখন আসতো, বস্তির মেয়েদের মধ্যে সারা পরে যেত।
কিন্তু বলাই-এর নজর ছিল কবিতার দিকে। কত সুন্দর সুন্দর কথা বলতো। স্বপ্ন দেখাতো। হোটেলেও নিয়ে গেছিল দু’দিন।
তারপর সেই যে ভাগলো ব্যস।
অনেক বছর বাদে রেনুপিসির চাপা স্বর কানে ভেসে এলো। প্রথমে ‘ডাসবিন’, ডাসবিন’
বলে কিছু যেন বলল। আর তারপর পষ্ট শুনেছিল-‘আপদ বিদায় করে এলাম।একটু দুরেই দিলাম। বেলিলিয়াস রোডের যে চার মাথাটা, তার একটু দূরের ডাসবিনে। মেয়েটাকে নিয্যস কুকুরে টেনে খাবে। এবার তাড়াতাড়ি তোর এই মুখপুড়ি মেয়েকে পার কর তো বাপু। না হলে আবার কী কেলেংকারী বাঁধাবে কে জানে! যা উলসোনো মেয়ে তোমার। এই বয়সেই খাই খাই করে গেলো। মা গো মা! ঘেন্না, ঘেন্না”
'আচ্ছা, সবাই বলে না যে চুমকির মুখ খানা কেটে কবিতার মুখ বসানো? তাহলে হতেও তো পারে.…'
আর ভাবতে পারেনা কবিতা। কেমন একটা ভয় তার বুক খামচে ধরে।
নিজের উপর তার আর যেন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বেভভুলোভাবে কাজগুলো শেষ করে নেভানো স্টোভের সামনেই স্থবির হয়ে বসে থাকে কবিতা।
কতক্ষণ কেটে গেছে এইভাবে ! চুমকি পুকুরে বন্ধুদের সংগে কখন নাইতে চলে গেছে, সে সব যেন হুঁশই নেই কবিতার। চুমকির ফেলে যাওয়া সিনেমার বইটা হাতে নিয়ে ছবিখানা বারবার দেখতে থাকে সে। আর আঁচলের খুঁটোয় ভেজা চোখ মুছতে থাকে।
কতবার ভেবেছে, সে কী আর আছে! কুকুরে টেনে খেয়েছে। মাঝে মাঝে তার মুখখানা দেখার জন্য মনটা ছটফট করে উঠতো। মনে হতো ওরা বাচ্চাটাকে বাঁচতে দ্যায়নি, সেই পাপেই তার গভভো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বারবার। শেষ কালে নীলের ঠাঁই মানত করে, নাক কান মুলে মাফ চেয়ে তবে ওই শিবরাত্তিরের সলতে তার বেঁচেছে।
তবুও যাকে ওরা 'ডাসবিনে' দিয়ে এসেছিল তার জন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে বুকটা হঠাৎ হঠাৎ টনটন করে উঠতো। এ কি সত্যি সে? হতে পারে!!
ওই যে চুমকির বাপ এলো। তাড়াতাড়ি করে বইটাকে রেখে দিয়ে ভাত বাড়তে শুরু করে কবিতা।
কিন্তু তার মন ঘুরে ফিরে ওই ছবির দিকেই চলে যায়।
বিকেলে আর কাজে যেতেও ইচ্ছে করে না। শরীর ভালো নেই বলে মাদুরখানা বিছিয়ে শুয়ে থাকে।
চুমকির বাপ কাজে বেরিয়ে গেলে, আর চুমকি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে চলে গেলে, মাদুর ছেড়ে উঠে আবার সিনিমার বইখানা খুলে বসে। সত্যিই তো, তার চুমকিই যেন। অথচ কত আলাদা!
এত বড়োলোকের জীবন...এত সুখ...এত আরাম...এমন মা..
সুখে না দু:খে - কে জানে, কবিতার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরে।
রাত হয়। তাও কবিতার চোখে ঘুম নেই। সমানে এপাশ ওপাশ করছে আর মাথার মধ্যে একবার করে চুমকির মুখ ভেসে উঠছে, আর একবার করে ওই মেয়েটার।
ইশশ্ জন্মানোর পরেই চুমকিকেও যদি ডাসবিনের পাশে...
হয়তো সেও আজ এইসব সুখ...আরাম...
না..আ.আ.আ, বুকের ভেতর থেকে একটা নি:শব্দ চিৎকার হাহাকারে ছড়িয়ে পড়ে।
ছি,ছি এ কী ভাবছে সে! চুমকি… তার বুকের ধন, তার প্রাণ। তাকে সে রাজা চাইলেও দিতে পারবে না। দু'চোখে জল নিয়ে মেয়েকে আকুলভাবে জড়িয়ে ধরে কবিতা।
' উ: মা, গলায় চাপ লাগছে। সরো না। ' ঘুম জড়ানো গলায় কবিতার কাছ থেকে একটু সরে শোয় চুমকি।
কিছুক্ষণ বিছানার উপরেই বসে থাকে কবিতা। তারপর আস্তে আস্তে উঠে বইখানা হাতে নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে আসে ।
চুমকি বলেছে কালকেই বইটা ফেরত নিয়ে যাবে। কিন্তু সে কিছুতেই বইটা ছাড়তে পারছে না। কিন্তু তার কী বা করার আছে? সে দিনও ছিলো না। আজও নেই।
এদিক ওদিক তাকিয়ে বইটা খুলে সন্তর্পণে ওই পাতাটা ছিঁড়ে নেয় কবিতা। আর ঘরে গিয়ে ভাংগা তোরঙ্গটার একেবারে নীচে, শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে রাখে।
তারপর চুমকির পাশে এসে সন্তর্পণে শুয়ে পরে।
ঘুমোনোর আগে ঠিক করে ফেলে নীলষষ্ঠীর দিন চুমকির সঙ্গে ওই মেয়ের জন্যও শিবের মাথায় জল ঢালবে সে। উপোস করবে ওই মেয়ের ভালোর জন্যও।
ভালো হোক। ওরও ভালো হোক চুমকির সাথেই।