গল্প - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Posted in গল্পজান, ইদানীং আমি বুঝতে পারছি, আমার নাম আর আমার বাহ্যিক আচরণ, দুটোর মধ্যে এক অদ্ভূদ বৈপরীত্য আছে। ঋজু আমার নাম হলেও, স্বভাবে আমি আদৌ ঋজু নই। কারণ আমায় কোনদিনই ঋজু হতে দেওয়া হয় নি। আমার বাবা-মাও চান নি আমি ঋজু হই।
আর এই দেড় বছরের মধ্যেই তুমিও হয়ত সেটা ভালই বুঝে গেছ। অতি সম্প্রতি আমি উপলব্ধি করতে শুরু করেছি যে আমার নাম, আমার আচরণ বা আমার ব্যবহার ইত্যাদির সঙ্গে, একদমই মেলে না। আমার স্বভাবটাই হলো, আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনে, চলার পথে, কোন পরিবর্তিত অবস্থার ওপর সোজাভাবে দাঁড়াতে পারি না। এত বছর পর, আমার মনে হয়, আমার মা, বাবাও (বিশেষ করে আমার মা, এবং তাঁর প্রভাবে আমার বাবা) হয়ত চান নি, আমি কোনদিন কখনও, শিড়দাঁড়া সোজা করে, নিজেই নিজের কথা বা কাজ, নিজের পরিকল্পনায় করি। তাঁরা বলেন, এটা বাৎসল্য। আমার এখন মনে হয়, এটাও একধরণের ভয়। আমার কাছে অস্তিত্বহীন হয়ে যাওয়ার ভয়। সেই কারণেই, তাঁরা আমার ওপর তাঁদের অধিকারের ভিত্তিটা আমার ব্যাপারে সবলে ধরে, তা' জারি রাখতে চান।
আমার নাম রেখেছিলেন, আমার দিদিমা। এখন ভাবি, তিনি হয়ত চেয়েছিলেন, আমার চারপাশের নেতিবাচকতা থেকে, আমায় সরিয়ে রাখা দরকার। তার জন্যেই দরকার একটা ঋজুতা। তাই খুঁজে-পেতে আমার নাম রাখলেন, ঋজু। বলতে পার, আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ঠাট্টা ছিল, এটাই। আমি আদৌ ঋজু ছিলাম না। আমি ছিলাম, আমার মায়ের নেতিবাচকতা এবং বাবার নিরপেক্ষতার যৌথ 'জিন'গত ফসল।
আমার দুই মাসি তাদের শ্বশুড়বাড়ি ও স্বামীর প্রভাবে ছিলেন স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মায়ের বিষয়টা ছিল অন্যরকম। আমার বাবারও এ'ব্যাপারে মায়ের ওপর কোন প্রভাবই ছিল না। মনে হয়, তার তিনটে কারণ। প্রথমত, মায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অবশ্যই বাবার থেকে বেশী ছিল, সেটাই ছিল বাবার এক গোপন কমপ্লেক্স (এবং মায়েরও)। এখনও কোন বিষয়ে মা কিছু বললে, বাবার মধ্যে সেই কমপ্লেক্সটা গোপনে কাজ করে। এবং নিজের অস্তিত্বটা ধরে রাখার জন্যে, বেশ জোরের সঙ্গেই বলেন, "তোমার মা যা বলছেন, সেটাই সঠিক"। দ্বিতীয়ত, আমার দুই মেসোমশাইয়ের তুলনায় বাবার চাকরিগত অবস্থানও, বাবার কমপ্লেক্সের কারণ ছিল। মেজোজন ছিলেন, অধ্যাপক, আর ছোটজন ছিলেন ডাক্তার। সেই তুলনায় বাবা ছিলেন, টেকনিক্যাল ম্যান। তৃতীয়ত, বাবার পক্ষে একা সামাজিক স্ট্যাটাস বজায় রাখা সম্ভব ছিল না। তাকে মায়ের চাকরির উপর নির্ভর করতেই হতো। অথচ, বাবার মা, অর্থাৎ আমার ঠাকুমা, মায়ের চাকরি করা পছন্দ করতেন না। অতএব বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা, নতুন establishment করা, এ'সবই ছিল বাবার কাছে ছিল প্রায় আবশ্যিক। অন্তত মায়ের সঙ্গে সহজ সহাবস্থানের স্বার্থে ভীষণ জরুরী।
সেই আবশ্যিকতাকে বাস্তবায়িত করার জন্যেই দরকার ছিল, আমার দিদিমার সক্রিয়তা। আমি ভেবে দেখেছি, মায়ের মধ্যেও, একধরণের "একাকীত্বের ভয়" কাজ করত। উচ্চ শিক্ষিত হয়েও মা, তার দুই বোনের মতো, established হতে পারে নি। মেজোমাসি, পাশ করার পর অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। ছোটমাসি, আর্কিটেকচার পাশ করে, উপযুক্ত প্রতিষ্ঠা পান। কিন্তু মা সেই তুলনায় কিছুই পায় নি। তখন থেকেই মায়ের মধ্যে একাকীত্বের ভয় আর বঞ্চিতের হতাশা স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধে। প্রথমটা ছিল, বোনেদের কাছে, হেরে যাওয়ার "ভয়"। আর দ্বিতীয়টা, নিজের যোগ্যতা, যথাযথ মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় মনের মধ্যে জমা হতাশা। এরই মধ্যে বিয়ের পর, ভয়ের চেহারাটা অন্য একটা মাত্রা নিল। ঠাকুমার ব্যক্তিত্ব বা সাংসারিক দাপট, যেমন তার ব্যক্তি অস্তত্বকে আঘাত করল, তেমনি তার মনে হতে শুরু করল, একদিন যুবতী বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় যে উচ্চমধ্যবিত্ত সুলভ জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা বোধহয় অধরাই থেকে গেল। সেখান থেকেও হয়ত তিনি বঞ্চিত হবেন। বিষয়টা দিদিমা বুঝেছিলেন। তখন থেকেই হয়ত মায়ের প্রতি বেশী protective হয়ে ওঠেন। মা আমাদের উত্তরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে, আমার মামার বাড়ির, কাছাকাছি দক্ষিণে থাকতে লাগল। বাবা তার যুক্তি নিরপেক্ষ মন দিয়ে, নিজের মধ্যেকার গজিয়ে ওঠা মানিসিক বিরোধীতাকে চাপা দিয়ে উত্তরাবাস থেকে দক্ষিণাবাসে চলে এলেন। তাঁর মা 'চাকর নির্ভর' একাকীত্ব নিয়ে, উত্তরে থেকে গেলেন। প্রতিবাদ করতে না পারলেও, বাবা এবার বেরিয়ে পড়লেন, কলকাতার বাইরে। অফিসের কাজ নিয়ে, অথবা সেই অজুহাতে। এ'সব কিছুর মধ্যেই দিদিমার মনেও হয়ত ভয় ছিল, মায়ের এই মানসিক বিভ্রান্তি, হতাশা, ভয়, যেন না, তার ছেলেমেয়েকেও প্রভাবিত করে! তিনিও চেয়েছিলেন, অন্তত একজনকে, আলাদা করে সোজা সরল করে গড়ে তুলতে। তাই হয়ত নাম রেখেছিলেন, ঋজু।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত, তিনবোনের এই "বিষম ত্রিভূজ" সম-ত্রিবাহু হল, আমার মেজো মেশোমশাই হঠাৎ মারা যাওয়াতে। মা এগিয়ে এল মেজোবোনের সাহারা হয়ে, ছোটর সাথে পরিকল্পনায় ঠিক হলো, তিনজনে একসাথে থাকবে। ততদিনে দিদিমা মারা গেছে। মা আবার ফিরে পেল নিজের স্বীকৃতী আর কর্তৃত্ব। দুইবোন, বিশেষ করে মেজোবোন, অন্তত বাহ্যিকভাবে বড়দিদির কর্তৃত্বকে মেনে, নিজের মতো করে, নিজের মেয়েদের গড়ে তোলার দিকে মন দিল। ছোট মেশোমশাই ডাক্তার আর মাসি ইঞ্জিনীয়র। তাদের ছেলেমেয়ে, নিজেদের খেয়ালে বেড়ে চলতে থাকল। কারণ তারা অর্ন্তমনে জানত, ঠিক পিছনেই মা আর বাবার শক্ত খুঁটি আছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হবে না।
পড়ে থাকলাম আমি আর আমার বোন। মা চাইল, যা যা সে পারে নি, সবকিছু আমাদের দিয়ে পূরণ করবে। এটা অবশ্য স্বাভাবিক। বোনকে ভর্তি করল উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে। এতে ট্যুইশানীর খরচাটা যেমন সীমিত হবে, তেমনি মা-ও নিজের বিষয়গত যোগ্যতাকে সবার সামনে প্রমাণ করতে পারবে। কিন্তু নিজের অপূর্ণতাকে, ছেলেমেয়ের মধ্যে দিয়ে পূর্ণ করার স্বপ্ন দেখা এক জিনিস, আর মানুষের, বিশেষ করে ছেলেমেয়ের জীবনটাকে নিজের পরিকল্পনার ছাঁচে ঢেলে, পুতুলের মত তৈরী করার যান্ত্রিক চেষ্টা, অন্য জিনিস। মানুষকে ছাঁচে ঢেলে তৈরী করে স্পার্ম আর ডিম্বানুর মিলনে সৃষ্ট ভ্রুণ। আর ভ্রুণের পরিচয় তার "জিন"গত বিশিষ্টতায়। বাইরে থেকে আমরা যা করি, তা'হল, সৃষ্টিকে পরিপোষণ। মা, এই বিকল্পহীনতা মেনে না নিয়ে, আমাদের ছাঁচে ঢালার যান্ত্রিক প্রচেষ্টা শুরু করলেন! কারণ, যে জিজ্ঞাসা তাকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়াতো, তা ছিল আমি কেন কিছু পাব না? আমি কম কিসে? যে দায়িত্ব নিয়ে একদিন দক্ষিণাবাসে এসেছিলেন, তা' পূর্ণ করার ভার যে তাকেই নিতে হবে, এটা মা ভাল মতোই বুঝেছিলেন। বাবা নিরপেক্ষ নিরাপদ দূরত্ব ছাড়া আর কিছুই বুঝবেন না বা বোঝার চেষ্টাও করবেন না।
শুনেছিলাম, আমার জন্মের সময় বাবা নাকি কলকাতায় ছিলেন না। মা, একাই বৃষ্টিভেজা রাতে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন, আমায় জন্ম দেওয়ার জন্যে। অফিস আর তার কাজকে কেন্দ্র করে বাবার কলকাতায় আসা যাওয়া চলতে থাকল। আমরা তখন ছিলাম দিদিমার অভিবাবকত্বে। তিনি ভেবেছিলেন, হয়ত আমি আমার "নামের" মতোই হব। কিন্তু 'জিন'গত বৈশিষ্ঠ্য কি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব? একদিকে জীবনবোধে নেতিবাচকতা, ও বঞ্চনা-জাত হতাশা, অন্যদিকে যুক্তি নিরপেক্ষ আনুগত্য -- এই দুয়ের বা তিনের সংমিশ্রণে গঠিত আমার 'জিন' ক্রমেই আমায় এমন এক দৈনন্দিনতার দিকে ঠেলে দিল, যেখানে আমি ছিলাম একা। ছোটবেলায়, মা অফিসে যাওয়ার আগে, আমায় আর দিদিকে দিদিমার জিম্মায় রেখে যেত। আর আমি দিদিমার কর্তৃত্ব থেকে আড়ালে থাকার জন্যে, একা একটা ঘরে চুপচাপ নিজেকে নিয়ে থাকতাম। দিদি স্কুলে যেত। এ'ভাবেই আমি আস্তে আস্তে ভুলে গেলাম, কিভাবে অন্যের সাথে মিশতে হয়। কিভাবে অন্যের সাথে কথা বলতে হয়! কিভাবে মনের অন্ধকার প্রশ্নগুলোর সামনে, জানালা খুলে দিতে হয় ( এই কথাটা আমি বিয়ের পর আমার শ্বশুরের কাছে শুনেছি) কিভাবে নতুন চিন্তা সৃষ্টি করতে হয়! কিভাবে আদুর গায়ে, রোদ হাওয়ার উত্তাপ পেতে হয়! জান, এভাবেই আমার পৃথিবীটা ছোট হতে হতে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে গেল। বিকশিত আর হলো না। আর আদুর গা-টা চাপা পড়ে গেল পোশাকের আড়ালে।
স্কুল জীবন অবধি আমার একমাত্র গ্রহণযোগ্য সঙ্গী ছিল আমার দিদি। স্কুলে আমি চুপচাপ থাকতাম। দেখতাম সবাই আমায় নিয়ে অনাবশ্যক "বুলি" করছে। আর আমি এককোণে বসে, সকলের 'বুলির' শিকার হচ্ছি। আর বাড়িতে সময় কাটত একা একা। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর বুঝতে শুরু করি, আমি হলাম আমি, আর দিদি হলো দিদি। তার অন্য একটা জগত আছে। স্কুল পেরিয়ে কলেজে গেলাম। পৃথিবীটা তখন একটু যেন বড় হলো। চেনা কিছু ছেলেমেয়ের সাথে আলাপ, বন্ধু সুলভ ঘনিষ্টতা হলো বটে, কিন্তু বন্ধু আর হলো না। কলেজের আনেকেরই নাম মনে আছে, কিন্তু যোগাযোগ নেই কারুর সাথে।
জান, আমি মা-বাবার কাছে শুনেছি, আমায় নিয়ে কোন ফাঁকা জায়গায় বেড়াতে গেলে, আমি না'কি একাই ফাঁকা জায়গাটায় আপন খেয়ালে জোরে জোরে দৌড়াতাম। সবাই মজা দেখত। আর আমি? আমার মনে হত, সেই দৌড়ানোর মধ্যেই আমার কৈশোরের স্বাধীনতা লুকিয়ে আছে। আমি তাকে ঐভাবেই খুঁজে পেতাম। খুঁজে পেতাম, আমার একাকীত্বের মধ্যে খোলা আকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু সেখানে আর কেউ এলেই, আমার ভয় করত। মনটাকে কুঁকড়ে ভাবতাম, ওরা এসে আমার চার দেওয়ালের নীরবতাকে তছনছ করে দিচ্ছে। আমায় হারিয়ে দেওয়ার জন্যেই এসেছে।
এরই মধ্যে, আমি যখন কলেজে পড়ি, তখন হঠাৎ আমার দিদির বিয়ে হয়ে গেল। বন্ধুর বাড়িতে নিমত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে মা-বাবা শুনলেন, একটি বিবাহযোগ্য ছেলে আছে। প্রবাসী এবং প্রবাসেই settled। তার বাবা-মা বিয়ের জন্যে পাত্রী খুঁজছেন। বিয়ের পর মেয়েকে প্রবাসেই স্বামীর সঙ্গে স্থায়ীভাবে settle করতে হবে। এর চেয়ে প্রত্যাশিত, বাবা-মার কাছে আর কিছুই ছিল না। একদিকে প্রবাসের গন্ধ, আন্যদিকে কার্য্যকালে ছেলেরও কিছু গতি হওয়ার সম্ভাবনা। প্রবাসী জামাই হলে, নিজেদের সামাজিক status-টাও বেড়ে যাবে। অতএব মা,বাবা যা'কে ব'লে, without second thought, রাজি হয়ে গেলো। আশ্চর্য্যজনক ব্যাপার হলো, মা-বাবা দিদিকে একবারও জিজ্ঞাসা করে নি। দিদির প্রাথমিক মতটূকুও নেওয়া হয় নি। জানানো হয়েছিল, কিন্তু মতামতের জন্যে নয়। বাবা-মা দুজনেই for granted ধরে নিয়েছিলো, দিদি ভীষণ খুশী হবে। কিন্তু আমি জানি, দিদি খুশী হয় নি, তবুও কিছু বলে নি। আমার সামনেই, দিদি প্রথমে কাঁদল, তার পর চুপ করে গেল। তার মৌনতাই, সম্মতি ব'লে ধরে নেওয়া হল। আমার মত দেওয়ার কোন প্রশ্নই ছিল না। শুধু আবছাভাবে বুঝতে পারলাম, আমার জন্যেও বাবা-মা এটাই চায়। বিদেশে যাওয়া ও স্থায়ীভাবে সেখানেই থাকা। অতএব আবার নতুন এক চিন্তার বোঝা।
এর বছরখানেকের মধ্যেই, এল সেই সময়টা। পড়াশুনা শেষ, এবার আমায় চাকরি পেতে হবে। কিন্তু কি'রকম চাকরি? যেখানে বিদেশের স্পষ্ট গন্ধ আছে; আছে কোম্পানীর নামের সামাজিক মর্যাদা। লোককে যেন বলা যায়, 'আমি কোথায় চাকরি করছি'। কিন্তু কোথায় সেই, "সোনার হরিণ"? আমি ত' জানি, প্রতিযোগীতা, লড়াই এ'সমস্ত আমার অচেনা ভয়ের বস্তু। আবার, অপেক্ষা, সে'ও ত' আমায় একাকীত্বের দিকেই ঠেলে দেবে। আমায় ডিপ্রেসড করে তুলবে। শুধু আমি নয়, ততদিনে আমার মা-বাবাও জেনে গেছে। আমায় বার কয়েক ডাক্তার (মায়ের বিশেষ চেনা মনঃস্তত্ববিদ) দেখানো হয়েছে। তিনি আমার নার্ভকে মজবুত করার জন্যে ওষুধও দিয়েছিলেন। কিন্তু নার্ভকে শক্ত করলেই কি, বাস্তবকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা, বা জীবনকে সহজ সরল চোখে দেখার ক্ষমতা বাড়ে? অতএব ওষুধে ঘুমটা হত ঠিকই, কোন অবাঞ্ছিত চিন্তা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতো না। কিন্তু ওষুধ ত' আর বাস্তবকে পরিবর্তন করতে পারে না। আমার একাকীত্বের বিকল্প হতে পারে না! আমায় অকারণে বাড়ি থেকে বের করতে পারে না! আমার মধ্যে বাড়িয়ে তোলা 'সম্ভাবনাহীন' প্রবাস স্বপ্নকে আমার কাছে এনে দিতে পারে না!
সুতরাং, যা হওয়ার তাই হল। বাবার চেষ্টা ও যোগাযোগে, উইপ্রোতে, জমা রাখা টাকার শর্তে, ট্রেনী-কাম-এমপ্ল্যয়ী হলাম। মা বলল,"উইপ্রো, একটা সম্ভাবনাময় কোম্পানি"। দেখলাম, মা ফোন তুলে অনেককে, বেশ হাসি হাসি মুখে জানাতে আরম্ভ করেছে, আমি উইপ্রোতে জয়েন করেছি। বুঝলাম মায়ের ভয়টা কিছুটা হলেও কেটেছে, আর বাবার গুরুত্বটা বাড়িতে একটু হলেও, বেড়েছে। আমি কলকাতা ছাড়লাম। জীবনটা আরও স্বাধীন, একা হয়ে গেলেও, জীবনের ভার এসে পড়ল নিজের ওপরই। চাকরির শর্ত পূরণ করে, নিজের জন্যে সময় প্রায় পেতাম না বললেই চলে। কিছুদিন যেতে না যেতেই, জীবনে প্রথম, মাকে না জানিয়ে, আমি একটা মোটর-বাইক কিনলাম। মনে হল, আবার আমি আমার হারিয়ে যাওয়া কৈশোরের, একা "দৌড়টাকে"খুঁজে পেলাম।
বেশ কাটছিলো।পাঁচ বছর বছর কেটে যাওয়ার ফাঁকে, কোম্পানির গুঁতোয় এম টেক-টাও হয়ে গেল। এরপরই, ওরা জানালো আমার মেয়াদ শেষ। আমি আবার একা। জানি না কি করব! ভাবলাম, আবার প্রতিযোগিতা! আবার হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে,'দু-পা পিছিয়ে, এক পা এগোনো'। চারিদিকে শামুকের খোলের হাতছানি। মা-বাবা দৌড়ে এলেন। পাশে দাঁড়াতে। সঙ্গে এল ওষুধের ঝাঁপি। শেষ পর্যন্ত, প্রায় এগারোটা ইন্টারভ্যু দিয়ে, একটা দরজা খুলে গেল। তুমি ত' জানই, এখনও সেই ঘরেই আছি।
সেই একটা ঘর, আর এই একটা ঘর। দুটোই আমার কাছে প্রায় এক। কোথা থেকেও আমি বেরোতে পারছি না। এমন কি, তুমি ত' জানই, আদুর গায়ে আমি আমার নিজের ঘরের চার দেওয়ালের বাইরে বেরোতে অস্বস্তি পাই। মনে হয়, আমি যেন সবার সামনে ভীষণ রকম উন্মুক্ত হয়ে গেলাম। নিজের বলে আমার আর কিছু থাকল না। তুমি ত' জানই বিয়ের পর, ফুলশয্যার রাত্রিতে, আমার চোখেমুখে এই ভয়টাই তোমায়, বিভ্রান্ত, বিধ্বস্ত ও ভীত করে তুলেছিল। কিন্তু কি অদ্ভূদ, তোমায় হারিয়ে দিতে পারে নি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার কিছুই করার ছিল না। আমি কিছুতেই সেদিন আমার গণ্ডীর বাইরে বেরোতে পারছিলাম না। আমি ভয় পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, কোনভাবেই একা আমি কোন ভার বহন করতে পারব না। আমি নিজেকে উন্মুক্ত করে হাজির হতেই অক্ষম। তাইতো, গরমকালেও বাড়িতে আমি টি-শার্ট পড়ে থাকি। তোমার সাথে একসাথে পথ চলার প্রথম অভীজ্ঞতা তাই আমায় ভয়ার্ত করে তুলেছিল। এখন বুঝতে পারি, ভাগ্যিস তুমি, শুধু তুমি-ই,যার মধ্যে, সবার আড়ালে, "হার না মানার জেদ"টাকে প্রচন্ডভাবে বর্তমান। তাই তোমায় জয় করা যায়, কিন্তু হারানো যায় না। তুমি তোমার মত করে জেত, আবার তোমার মতো করেই হার। তুমি তোমার মতো করেই বাঁচ, তোমার মতো করেই ভাব। কিন্তু আমি? আমি ত' সেটা হতে পারছি না? আমার আবার কি হবে? আসলে আমি ত' শুধুই নামেই ঋজু। স্বভাবে নয়।