Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in





পর্ব ২৫

স্মৃতির সরণি বেয়ে – গাজরের কেক তৈরি শেখা

হেঁশেলে প্রবেশ করা আর পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা তার অন্দর মহলের রহস্য উদঘাটন করতে চাওয়া এক জিনিস নয়। রান্নাঘরে তো জল গরম করার জন্যও ঢোকা যায় কিংবা ডিম সিদ্ধ করার জন্য। কিন্তু নিঁখুতভাবে ডিম সিদ্ধ করতে হলে যে ফুটন্ত জলে সামান্য নুনের প্রয়োগ জরুরি, কারণ জলের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে ডিমের সাদা অংশটি সেক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি জমে যায়, এই আপাতসাধারণ তথ্যটি যে মুহূর্তে জানা হয়ে গেলো, পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে গেলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণেই। কোনও এক অসতর্ক লগ্নে এই অধমের ঠিক তাই হয়েছিল। পরবর্তীকালে যে ক’জন অসামান্য রাঁধুনি তাঁদের অজান্তেই হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন রন্ধনশালার ভিতর থেকে গভীরে, বার্লিনবাসী বারবারা কাপ্টাইন তাদের মধ্যে একজন। আরও একটি চিত্তাকর্ষক বিষয়ের উল্লেখ এক্ষেত্রে করার প্রয়োজন আছে। টেলিভিশনের পর্দায় দেখা কোনও রথী- মহারথী শেফের চমক ধরানো পাকশৈলী নয়, যারা আমাকে স্বাদু এই জগতটির অলিগলি চিনতে শিখিয়েছিল, তাদের প্রত্যেকেই আটপৌরে সংসারী মানুষ। সাংসারিক যাবতীয় দায়দায়িত্ব নিঁখুতভাবে সামলে রান্নাঘরটিকে যারা নিয়ে গেছে পেশাদারী স্তরে। সেইরকম অনেকের কথাই লেখার সময় মাথায় ভিড় করে আসছে, কিন্তু আজকের লেখার প্রেক্ষিতে বেছে নিলাম বারবারাকে।

বারবারার সঙ্গে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব তিন দশকেরও আগে এই শহরেই। সেকথা আগেই লিখেছি। প্রথমবার যখন বার্লিন যাই এবং বেশ কিছু সময় বারবারা, ওর বর উরবান আর ওদের তিনটি আশ্চর্য সুন্দর ছেলেমেয়ের সঙ্গে অতিবাহিত করেছিলাম, গড়ে উঠেছিল এক অদ্ভুত সম্পর্ক, যা আজও একইরকম নিবিড় রয়ে গিয়েছে। অনেক দিন পরেও যখন দেখা হয়, সময়ের ব্যবধান বুঝতে পারিনা আজও। সে অন্য কাহিনী কিন্তু এইসব ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ অবতারণা করার উদ্দ্যেশ্য আমার এই বিচিত্র স্বাদগন্ধে ভরপুর যাত্রাপথের বাঁকগুলিতে যাঁরা আমাকে স্বাগত জানিয়েছেছেন, এগিয়ে দিয়েছেন পরবর্তী লক্ষ্যের দিকে, তাঁদের সঙ্গে এ লেখা যাঁরা পড়বেন, তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া।

সেই প্রথমবার ওই বাড়িটিতে গৃহে পা দেওয়ার কিছুদিন আগেই বারবারা, উরবান ওদের তিন ছেলেমেয়ে ইওনাস, পাউল আর জেনি-কে নিয়ে উঠে এসেছিল পশ্চিম বার্লিনের শারলটেনবুর্গ অঞ্চলের এই ফ্ল্যাটটিতে। বইয়ে ঠাসা এই বাড়িটির মধ্যে ভালো-লাগার উপকরণ ছিল অনেক কিন্তু তার মধ্যেই কেন জানিনা আমার আলাদাভাবে ভালো লেগে গিয়েছিল প্রশস্ত হেঁশেলটি। যার এক কোণে পশ্চিমি রীতি অনুযায়ী একটি ছোট্ট সুন্দর কাঠের টেবিল, যা পরবর্তী তিন দশকে যখনই ওদের অতিথি হয়ে থেকেছি, ওই টেবিলটি প্রতিদিন সকালে হয়ে উঠেছে আমাদের আড্ডাস্থল আর ঠিক তার পিছনদিকেই কাচের দরজার ওপাশে বারান্দা আর হ্বিন্টারগার্টেন অর্থাৎ শীতকালীন বাগান। এই রান্নাঘরটিতে বছরের পর বছর বারবারাকে দেখেছি গ্রিক, ইতালিয়ান, চাইনিজ, মেক্সিকান এবং অবশ্যই জার্মান নানান অপূর্ব সব পদ অবলীলায় তৈরি করতে। সবচেয়ে অবাক হতাম যখন দেখতাম, তিন কোর্সের এক অপূর্ব নৈশাহারের তোড়জোড় সেরে নিয়েই বারবারা যখন আমাদের নিয়ে চলে গেছে কোনও বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে বা অপেরায়, ফিরে এসে সরাসরি ঢুকে গেছে রান্নাঘরে আর তার কিছু পরেই টেবিলে হাজির হয়েছে সেই প্রতীক্ষিত আহার্য। এত নিঁখুত সময়ের সদ্ব্যবহার আমি খুব কম মানুষের মধ্যে দেখেছি। সেই বারবারা বছর তিনেক আগে একদিন দুপুরবেলা হঠাৎ বলল, ‘রাজা, চলো সুইস ক্যারট কেক করা যাক!’ সুইস ক্যারট কেক? এই বস্তুটি সম্পর্কে শুনেছিলাম বটে কিন্তু সম্যক পরিচয় ঘটেনি সেদিনের আগে। আমাদের সেদিনের দুপুর বিকেলের কর্মব্যস্ততার গল্পে ঢোকার আগে অসামান্য এই কেকটির জন্মবৃত্তান্তে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

সুইৎজারল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের একটি রাজ্য আরগাউ। পাহাড়ি এই দেশটির সমতলভূমি বলে যদি কিছু থাকে, তা সম্ভবত এখানেই। আরে নদীর তলার দিকে অবস্থিত বলেই এমন নামকরণ এই জায়গাটির। আরেকটি কারণেও এই প্রদেশটি বিখ্যাত – তা হল গাজর উৎপাদন। সে হেতু আরগাউ-কে ‘গাজর-রাজ্য’ও বলা হয়। তা এখানকার মহিমান্বিত কেক যে ‘আরগাউয়ার র‍্যুবলিটর্টে’ (Aargauer Rueblitorte) বলে প্রসিদ্ধ হবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সত্যিই কি নেই? যে ‘গাজর-কেক’ নিয়ে সুইসদের এত গর্ব, (জীবনের অধিকাংশ সময় দেশের বাইরে কাটিয়েও জাত্যাভিমানের মর্যাদা রক্ষায় সদা-সজাগ বারবারা কাপ্টাইনও সেই দলেরই সদস্য) তার জন্ম আসলে কোথায়?

অনেক খাদ্য ঐতিহাসিকের মতে মধ্যযুগে ইউরোপে যখন চিনি বা মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য দুর্মূল্য, তখন জন্মলাভ করে ‘ক্যারট পুডিং’, যেখানে চিনির বিকল্প উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হত গাজর। পরবর্তীকালে বিবর্তনের নানা পথ পেরিয়ে ইংল্যান্ডে এসে থিতু হয় সেই পুডিং কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে খাদ্য ‘রেশনিং’ ব্রিটেনের গৃহিণীদের কপালে ফেলে ভাঁজ। অতএব আবার সেই চিনির বদলে গাজরের ব্যবহার। ততদিনে এই বিশেষ কেকটি ইউরোপের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে খাদ্যরসিকের প্রিয় তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে আলাদা আলাদা নামে। আর শুধু ইউরোপ কেন, আমেরিকাতেও এই কেকের জনপ্রিয়তা বিপুল কিন্তু আমেরিকার পিৎজা, স্টেক বা লিমুজিনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই টর্টে বা কেকও বিপুলায়তন। অনেক শুকনো ফল ইত্যাদি উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন সব টর্টে এক অর্থে কেক বটে কিন্তু সব কেক টর্টে নয়। কারণ চিনি, ডিম আর মাখনের সঙ্গে কেকের মূল উপাদান ময়দা আর টর্টের ক্ষেত্রে ময়দার পরিবর্তে মেশানো হয় বাদাম গুঁড়ো। এই মৌলিক পার্থক্যই এই দুই সহোদরকে চরিত্রগতভাবে এতটা আলাদা করে রেখেছে।

সেদিন কেমন হয়েছিল আমাদের কেক? তিনটি পর্যায়ে বিন্যস্ত এই কেকটি শেষ পর্যন্ত যখন বারবারার আভেন থেকে আত্মপ্রকাশ করলো, সোনালি দীপ্তি ঠিকরে পড়ছে তখন তার অঙ্গ থেকে আর ওদের খাবার ঘরটি ভরে উঠল অপূর্ব সুন্দর এক সৌরভে। কিন্তু কাজ তখনও বাকি ছিল। ডিমের সাদা অংশ, মিহি চিনি (আইসিং সুগার), লেবুর রস আর কির্শ (চেরি ব্র্যান্ডি)- এর মিলমিশে তৈরি হওয়া গাঢ় সাদা মিশ্রণটি লেপে দিতে হবে কেকের ওপর ওস্তাদের মার শেষ রাত্রে আপ্তবাক্যটি প্রমাণ করার জন্য ওপরে সাজিয়ে দিতে হবে গাজর মারৎসিপান। এই মারৎসিপান প্রসঙ্গে সবিস্তারে এর আগে লিখেছি। এইবার সবকিছুকে ঘরের তাপমাত্রায় আনার পালা। খাওয়ার সময় ছুরি দিয়ে কেটে প্রথম টুকরোটি কেটে মুখের ভিতর দিতেই জিভে জড়িয়ে গিয়েছিল অনাস্বাদিতপূর্ব এক অনুভূতি ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিয়েছিল মুখের স্বাদ গ্রহণের কোষগুলিকে। প্রথমে মারৎসিপান, তারপর ক্রিম আর তৃতীয় স্তরে গাজরের স্বাদ যেন একে অপরের কমপ্লিমেন্টারি! বিশুদ্ধ ম্যাজিক সম্ভবত এটাই।

অতিমারীর আগ্রাসনের আগে চেনা পৃথিবীর সঙ্গে সেই শেষ দেখা। প্রতিবারের মতো সেবারও বারবারা চলে আসার আগে টুকিটাকি উপহারের সঙ্গে দিয়েছিল একটি র‍্যুবলিটর্টে মিক্স। বলেছিল তৈরি করে ছবি পাঠিও। ফেরার পর ছকটি বদলে গিয়েছিল। খুঁজে পাচ্ছিলাম না সেই প্যাকেটটি। অনেক পরে সেটির পুনরুদ্ধার যখন হল, তখন দেরি হয়ে গেছে অনেক। যে ছবি পাঠানোর কথা দিয়ে এসেছিলাম বারবারাকে, তা আর হয়ে ওঠেনি। এ আক্ষেপ কখনও যাবে না।