ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক২২
স্মৃতির শহর - সোরেন্তো
চিরকুমভিসুভিয়ানা। ইতালিয়ান না জানলে এই ধ্বনির আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রকৃত অর্থ আবিষ্কার করা অসম্ভব। আর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না হলে বিশেষ এই রেল সফরের রোমাঞ্চ, নামের মতোই পরতে পরতে যার নাটকীয়তা, তা অনুধাবন করা যাবে না। এই নাটকের প্রথম দৃশ্য অভিনীত হতে দেখা যায় নাপোলি গারিবলদি স্টেশনে। গিজগিজে ভিড়। চারপাশে প্ল্যাটফর্ম জুড়ে শুধু মানুষ আর মানুষ। সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে একটি ট্রেনের জন্য। তারপর আকস্মিক সেই ট্রেনের আগমন এবং শিয়ালদহ স্টেশনে লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালে দিনের শেষে বাড়ি ফেরার জন্য যে হুড়োহুড়ি লেগে যায়, ওখানেও দেখা যায় প্রায় অবিকল একই ছবি। ট্রেনের ভিতরে কোনোক্রমে ঢোকার পর দেখা যাবে বসার জায়গা নিয়ে কাড়াকাড়ি, ঝগড়া আর একে অপরের পা মাড়িয়ে দেওয়ার অতি পরিচিত চিত্র। ট্রেনটি ধীরে ধীরে অগ্রসর হলে বোঝা যায় আমারা ক্রমশ এগিয়ে চলেছি একটি পাহাড়চূড়ার দিকে।
ভিসুভিয়াস। হ্যাঁ সেই ভিসুভিয়াস, ৭৯ খ্রিস্টাব্দে যার গলিত ক্রোধ ধ্বংস করে দিয়েছিল পম্পেই এবং পার্শ্ববর্তী আরও কয়েকটি জনপদকে। মারা গিয়েছিলেন এক হাজারেরও বেশি মানুষ। প্রকৃতির এই উন্মত্ততা উপজীব্য হয়েছে কালজয়ী সাহিত্যের, তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র। ভিসুভিয়াসের বুকের মধ্যে এখনও ধিকিধিকি জ্বলছে আগুন। এখনও শিয়রে মারাত্মক বিপদ নিয়ে জীবন যাপন করছেন এই আগ্নেয় পর্বতের রোষানলের সীমার মধ্যে থাকা অনেক মানুষ। কিন্তু বিপদ যেখানে, রোমাঞ্চ তো সেখানেই। এখনও প্রতিদিন অনেক মানুষ পৌঁছে যান সেই জ্বলন্ত গহ্বরের কাছাকাছি। আমাদের ট্রেন সেদিকে যেতে গিয়েও গতিমুখ পালটে এগিয়ে গেলো পম্পেই হয়ে সোরেন্তোর দিকে। দক্ষিণ পশ্চিম ইতালির এই উপকূলবর্তী অঞ্চলটির প্রাকৃতিক শোভা ভুবনবিখ্যাত। এখানকার সবকিছুরই দাম আকাশছোঁয়া আর সেই কারণে ধনকুবের ছাড়া কেউ এখানে সম্পত্তির মালিক হওয়ার কথা ভাবতেও পারেনা। এই উপকূলেরই ছোট্ট একটি স্টেশন সোরেন্তো। ভিসুভিয়াস পর্বতকে অনেক পিছনে ফেলে চিরকুমভিসুভিয়ানা প্রকৃতির আপন খেয়ালে তৈরি ভূমধ্যসাগরীয় তটরেখা জুড়ে গালফ অফ নেপলস্-এর ছোট ছোট জনপদগুলির একটি সোরেন্তোর দিকে যত এগিয়ে যেতে থাকে, ততই অদ্ভুতভাবে চারপাশ কেমন হলুদে ভরে যেতে থাকে।
কেন এত হলুদ? ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে বাড়ির বাগান, রাস্তাঘাট, রেল লাইনের দুপাশ সব ভরে আছে লেবুগাছে। হলুদ লেবু। এই লেবু, যা প্রায় দুহাজার বছর আগে আরবদের হাত ধরে প্রবেশ করেছিল ইউরোপের এই দেশটিতে এবং কালক্রমে হয়ে উঠল ইতালীয় খাদ্য সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অঙ্গ। আর দক্ষিণ ইতালিতে, বিশেষত সোরেন্তো, আমালফি, কাপ্রি এই জায়গাগুলো লেবুর জন্য বিখ্যাত। এখানে রাস্তা দিয়ে হাঁটলে দুপাশে দেখা যাবে অন্য সবজির সঙ্গে পসরা সাজিয়ে বিক্রেতারা স্তূপীকৃত লেবু নিয়ে বসে আছে। আর এই লেবু থেকেই তো তৈরি হয় অনন্য সেই পানীয় – লিমনচেল্লো! এর স্বাদের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয়েছিলাম বছর দশ-বারো আগে যখন হানস্ তার বার্ষিক কলকাতা যাত্রার সময় সঙ্গে করে একটি নমুনা নিয়ে এসেছিল। ইতালীয় ভাষা ও খাদ্যসংস্কৃতির প্রতি ওর বিশেষ টানের ব্যাপারটা লক্ষ্য করি বোধহয় সে সময়েই, নাকি আরও অনেক আগে – জানি না।
পাশ্চাত্যে বিভিন্ন ফল থেকে সুরা, বিশেষত লিকিওর তৈরির যে ঐতিহ্য বহু যুগ ধরে বিদ্যমান, সে প্রসঙ্গে ওয়াকিবহাল ছিলাম ঠিকই কিন্তু খাওয়া-দাওয়াকে ঘিরে লেবু কীভাবে একটি জাতির আবেগ এইভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। অবশ্য আগেও বারবার বলেছি খাদ্য এবং পানীয় এদেশের সমাজে এমন একটা জায়গা জুড়ে আছে উদরপুর্তি সেখানে অতি নগণ্য ভূমিকা পালন করে, উদযাপনটাই সেখানে মুখ্য। ইতালিতে খাদ্য এবং পানীয়ের মান অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের কিন্তু সেই মানদণ্ডেও একমাত্র কফি ছাড়া আর অন্য কিছু নিয়ে এমন ‘পাগলামি’ আর চোখে পড়েনি। কফি যদি হয় ইতালিয়ানদের অস্তিত্বের ভরকেন্দ্র, লেবু তাহলে ছুঁয়ে আছে আবেগের এক সুক্ষ্ম তন্তু, যা সম্ভবত একজন ইতালিয়ানই সম্যক অনুভব করতে পারে। যাই হোক, সেই আশ্চর্য সুন্দর পানীয় লিমনচেল্লোর কাছে ফিরে যাই আবার। এতক্ষণ ধরে ইনিয়ে বিনিয়ে লেখা এত কথা পড়ার পর একথা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে এমন একটি বস্তু তৈরি করা না জানি কত কঠিন।
আসলে বিষয়টি ঠিক উলটো। অবিশ্বাস্য রকমের সহজ এই লিমনচেল্লোর রেসিপি। একটি বায়ুনিরোধক কাচের জারে লম্বা লম্বা করে কাটা লেবুর খোসা ভিজিয়ে রাখতে ভালো মানের ভদকায়। এমন একটি জায়গা, যেখানে সূর্যালোক আসে, সেখানে রেখে দিতে হবে ছ’সপ্তাহ মতো বা যতদিন না তরলের রং উজ্জ্বল হলুদ হচ্ছে এবং একইসঙ্গে লেবুর খোসাগুলি বিবর্ণ হয়ে পড়ছে। এবার সিরাপ তৈরির পালা। আদতে যা মিষ্টির রস। এই সিরাপটি ঠাণ্ডা হয়ে গেলেই তা ভদকার মিশ্রণের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। আবার কয়েকদিন রেখে দেওয়া আর মাঝে মাঝে নাড়িয়ে দেওয়া। সবশেষে ছেঁকে নিলেই তৈরি লিমনচেল্লো! একটা জরুরি বিষয়ের উল্লেখ এখানে করতেই হবে। তা হল পরিবেশনের আগে থেকেই খুব ঠাণ্ডা করে নিতে হবে এই পানীয়টিকে তারপর খাওয়ার আগে মাঝখানে বা শেষে যেকোনো সময় এটি পান করা যেতে পারে। কখনও এটি ক্ষুধাবর্ধককারী, কখনও এটির কাজ একটি পদের রেশ রসনা থেকে সম্পূর্ণ মুছে দিয়ে পরবর্তী পদের জন্য জিহবাকে প্রস্তুত করে দেওয়া আবার কখনও ভুরিভোজের পর হজমে সাহায্য করা।
এই প্রসঙ্গে ইতালিতে প্রথমবার লিমনচেল্লো পান করার স্মৃতি ফিরে এল। সেবার প্রথম রোমে। প্রথমবার মারিও আর পাপিয়ার অতিথি। প্রথমদিন। পাপিয়া সেদিন বাজার ঘুরে আমাদের জন্য মাছ এনেছিল, সম্ভবত আমার অত্যন্ত প্রিয় কড আর তাই দিয়ে তৈরি করেছিল মাছের চপ। একেবারে বাঙালি পদ্ধতিতে। ফলাফল হয়েছিল অনবদ্য। আমি রান্নাবান্নায় আনাড়ি নই এমন একটা ধারণা বন্ধুদের মধ্যে চালু থাকার জন্য পাপিয়া আমার ওপরেই চপগুলো ভাজার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল সেদিন। আর সেই কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে রান্নাঘরেই পরিবেশিত হয়েছিল লিমনচেল্লো। যদিও ওদের সেই রান্নঘরেরই একটি অংশে ছিল খাবার টেবিল। সেই টেবিলেই নৈশাহারের পর লিমনচেল্লোর সান্নিধ্যে ভোররাত পর্যন্ত আড্ডা চলেছিল। জাগতিক এবং মহাজাগতিক সব বিষয়ই বোধহয় সেই রাতে আমাদের আলোচনায় উঠে এসেছিল।
সোরেন্তো স্টেশনে নামার পর একটা বাসে করে পৌঁছেছিলাম আমাদের হোটেলে। দুপাশে সুদৃশ্য নানারঙা বাড়ি আর সেই হলুদের সমাহার। লেবু। আরেকটা জিনিস চোখে পড়ছিল বারবার। লঙ্কা। এবং অবশ্যই টোম্যাটো বা পমদরি। প্রথমত দৃশ্যত এই ত্রয়ীর সহবস্থান একধরনের ক্যানভাস রচনা করে আর অনুসন্ধিৎসু মনের কাছে মহান এক রন্ধনশৈলি সম্পর্কে পৌঁছে দেয় কিছু নির্দিষ্ট সঙ্কেত। যা থেকে বোঝা যায় এই পাকশালার অন্দরমহলের অপূর্ব স্বাদগন্ধে নির্মিত পদগুলি কেমন হতে পারে। আর দ্বিতীয়ত আবার প্রমাণিত হয় বহু আলোচিত সেই তত্ত্বটি, অসামান্য ইতালীয় পদগুলির নির্মাণকৌশল আসলে প্রাত্যহিক কিছু উপকরণ আর পাচকের সৃজনী ক্ষমতার ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। সোরেন্তোয় থাকাকালীন দ্বিতীয়দিন সন্ধেবেলা ওই শহরের একটি অতি বিখ্যাত পিৎজেরিয়া ফ্রাঙ্কিস-এ ঢুকলাম রাতের খাওয়া সেরে নেওয়ার জন্য। এর দিনদুয়েক আগেই নাপোলিতে খেয়েছিলাম স্মরণীয় সেই পিৎজা মারগারিতা (বা মারগারিটা)। এই ফ্রাঙ্কিস-এর কথা সোরেন্তোতে পা দিয়েই শুনেছিলাম। ঠিক করেছিলাম দাম যেমনই হোক, এই পিৎজা পরখ করে দেখতেই হবে। এক ঝলক মেনুকার্ডে চোখ বুলিয়ে যেটুকু বোঝা গেলো, তাতে দাম একটু বেশির দিকে হলেও তাকে অস্বাভাবিক বলা যায় না।
অতএব অর্ডার করা হল আবার সেই পিৎজা মারগারিতা আর লোরেঞ্জো। এর মধ্যে মারগারিতা অনেক জায়গায় বহুবার খাওয়া হলেও (নাপোলিতে সন্ধের মুখে খাওয়া মারগারিতাই এখনও পর্যন্ত সর্বোত্তম) লোরেঞ্জো সেই প্রথম। এটি একেবারে ব্যতিক্রমি অভিজ্ঞতা। এই পিৎজায় কোনও সস ব্যবহার হয়না। মোৎসারেলা চিজের সঙ্গে পরম আবেশে এখানে জড়াজড়ি করে পিস্তাচিও আর মোরতাদেল্লা সসেজ। এই মোরতাদেল্লা আরেক ইতালীয় বিস্ময়। শ্যাম্পেন বা একাধিক চিজের মতো এই বিশেষ সসেজটির উৎপত্তি বোলোনিয়া প্রদেশে এবং এর রেসিপি (যেখানে সাধারণত একটি বিশেষ মাত্রায় চর্বি মেশানো হয়ে থাকে) আইনের দ্বারা সংরক্ষিত। তবে সেই স্বাদের আস্বাদনের সময় ঘটে গেলো এক পরমাদ। প্লাস্টিকের কাঁটা ভেঙে গেলো মুখের মধ্যে। কোনও বড়মাপের দুর্ঘটনা যে সেদিন ঘটেনি তার প্রমাণ এই লেখা। পরদিন যাওয়া ছিল কাপ্রি। জাহাজে করে সেই জলপথ পেরিয়ে বন্দর থেকে অনেকটা ওপরে মূল লোকালয়ে পৌঁছে মনে হয়েছিল কোনও রূপকথার রাজ্যে এসে পরেছি। উৎসবের আবহাওয়া সর্বত্র। যার কেন্দ্রে লেবু থেকে উৎসারিত সেই পানীয় লিমনচেল্লো! এই রোম্যান্টিসিজম যেন কাপ্রির সঙ্গে একেবারে মানানসই।