Next
Previous
6

গল্প - অচিন্ত্য দাস

Posted in





উফ, বেরোতে যা দেরি হয়ে গেছিলো – খুব জোর ফ্লাইটটা পেয়ে গেছি। ফসকালেই হয়েছিলো আর কি! মুম্বাইতে নামব সন্ধে ছটা নাগাদ। তারপর আটটা থেকে জিএম এর নৈশভোজ আর আলোচনা। বিষয় হলো সামনের পাঁচ বছরে কোম্পানীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কী কী কৌশল নেওয়া যায়। সোজা কথায় স্ট্রাটেজি কীরকম হওয়া উচিত।

কিছু নতুন ধরনের চিন্তা-ভাবনা দেখিয়ে ছোট কিন্তু বেশ একটা জমকালো প্রেজেনটেশন বানিয়েছি। এই যে এত খেটেখুটে এসব করলাম তার একটা গূঢ় কারণ আছে। বুঝিয়ে বলছি।

জিএম এর সঙ্গে সামনা-সামনি দেখা-সাক্ষাত হয় না বললেই চলে। লোকটাকে তাই ইম্প্রেস করার সুযোগ পাওয়া যায় না। মুম্বাইতে আজকের মিটিংএ লোকটাকে বোঝাতে হবে আমি অন্যদের তুলনায় কতখানি ‘স্ট্র্যাটেজিক’ বুদ্ধি রাখি। জি এম কাল ভোরে জাপান চলে যাচ্ছে, আসবে সেই পরের হপ্তায়। এসেই প্রমোশনের মিটিং। আমার নামটা এর মাথায় এখনই ঢোকাতে হবে।

পঁয়তাল্লিশ চলছে আমার। এবার যদি এই ঘাটটা পার হতে পারি, তাহলে বছর তিনেকে মানে পঞ্চাশ ছোঁয়ার আগেই সরসর করে উঠে যাব। কারণ কোম্পানী অনেকগুলো শাখা খুলছে। আর তখন আমার মেয়ে ক্লাস টেনের পরীক্ষা দেবে – এগারো-বারো ক্লাস অন্য শহরে পড়লে সুবিধেই হবে বরং। বছর দুয়েক ওই ধরনের দায়িত্বে থাকতে পারলে আমাকে তারপর আর কেউ আটকাতে পারবে না। সিঙ্গাপুরে বদলী হওয়াটা অসম্ভব নয়। আর একবার ওসব জায়গায় গিয়ে বসতে পারলে টাকা-পয়সা সুযোগ-সুবিধে মুষলধার বৃষ্টির মতো ঝরে পড়বে। বছর পাঁচেক বাদে তো আর দেশ ছাড়ার সমস্যা নেই, মেয়ে তখন পড়বে কলেজে।

এই হল আমার আগামী পাঁচ-সাত বছরের ‘পরিকল্পনা’। একদিক দিয়ে উচ্চাশাও বলা যায়। উচ্চাশা থাকলেই তো আর হয় না, সঙ্গে সঙ্গে নিজের রাস্তা নিজে বানিয়ে নিতে হয়। সেদিন একটা বই উল্টেপাল্টে দেখছিলাম –“ প্ল্যান ইয়োর ইয়ারস”। ছক কষে জীবনে কী করে এগিয়ে যেতে হয় তা উদাহরণ-টরণ দিয়ে বোঝানো আছে। বইটার কয়েক মিলিয়ন কপি নাকি বিক্রি হয়ে গেছে।

প্লেন ছাড়ল ঠিক সময়তেই। বসে থাকতে থাকতে একটু ঝিমুনির ভাব এসে গিয়েছিল। ঘন্টা দেড়েক হয়েছে কি হয়নি ঘুমটা চটকে গেল। পাইলট কী একটা ঘোষণা করছে। কান খাড়া করে শুনলাম কিংবা শুনে কান খাড়া হয়ে গেল! মুম্বাইএ বিমান এখন নামতে পারবে না। অন্য একটা প্লেন খারাপ হয়ে রান-ওয়েতে পড়ে থাকাতে সেখানে নামাওঠা সব বন্ধ। উড়োজাহাজ নামবে নাগপুরে। কয়েক ঘন্টা সেখানে অপেক্ষা করতে হবে। যাত্রীদের অসুবিধার জন্য ভীষণ দুঃখিত, ইত্যাদি।

বিমান নামল নাগপুরে। গেল রে, সব ভেস্তে গেল। সাজানো ছকের বারোটা বাজিয়ে রাত্তির বারোটার পরে হয়তো মুম্বাই পৌঁছে দেবে। সকালও হয়ে যেতে পারে। আমার এত সাধের ‘প্রেজেনটেশন’ তখন আর কোনো কাজে লাগবে না। মনটা হায় হায় করে উঠল। বিরক্ত মুখে বিমানবন্দরের রেস্তোরায় ঢুকে পড়লাম। কোণার দিকের টেবিলে পা ছড়িয়ে চোখ বুঁজে বসে রইলাম। যাচ্ছেতাই। যা তৈরি করে এনেছি তা মেল করে জিএম কে পাঠিয়ে দেব? না, তাতে চিঁড়ে ভিজবে না। লোকটার ইমেল এ আ্যালার্জি আছে। আর কমপিউটার খুলে অত ছবিছাবা দেখার সময়ই বা কোথায়! ব্যাটা নির্ঘাত বলে বসবে – এর কাণ্ডজ্ঞান বলে কি কিছু নেই, সকালের ফ্লাইটে আসতে পারল না! উল্টো ফল হয়ে যেতে পারে।

এসব ভাবছি এমন সময় আমার কাঁধে একটা হাত পড়ল। তাকিয়ে দেখি আরে এ তো আমাদের সেই প্রখরেশ! আমরা একই ক্লাসে পড়তাম।

প্রখরেশ বলল -“ওহ, ভাগ্যিস এটা তুই, অন্য কেউ নয়! এমন ভঙ্গীমায় বসে আছিস যে চেনাই যাচ্ছে না! বসেবসে ধ্যান করছিস না ঘুমোচ্ছিস?”

-“ কী করছি ঠিক জানি না। তা এই ভরসন্ধেবেলায় তুই কোথা থেকে উদয় হলি?”

-“ চেন্নাই যাচ্ছি রে। আধঘন্টা মতো সময় আছে। এই, কফি খাবি নাকি?”

-“ হ্যাঁ, সঙ্গে কিছু নে। খিদে পেয়েছে”

-“ হু। লম্বালম্বা আলুভাজা আর পনীর টিক্কা বলছি। তা তুই হঠাৎ নাগপুর মানে এই বিদর্ভ রাজ্যে হাজির! ব্যাপারটা কি?”

প্রখরেশ কাছের বন্ধু, ওকে সবই বলা যায়। ভেস্তে যাওয়া ছকের কথা খুলে বললাম।

- “ হু, তোর সব ফন্দিফিকির মাঠে, থুড়ি আকাশে মারা গেল! মুখটা তাই ‘শোকসভায়’ বসে থাকার মতো করে রেখেছিস। ওসব মন থেকে ছেঁটে ফেলে দে। টিক্কাটা খা। ভালো করেছে রে ”

-“ তাহলে বলছিস ‘প্ল্যানিং’ করাটা ভুল কাজ…”

-“ না বন্ধু, তা কেন হবে। আচ্ছা, পাইলট যখন ঘোষণাটা করল তখন উড়োজাহাজ কতটা উঁচুতে উড়ছিল?”

-“ তা জানি না। কেন?”

-“ শোন, প্লেন তিরিশ-পঁয়েতিরিশ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে ওড়ে। তার মানে কৈলাশ-ফৈলাশ ছাড়িয়ে একেবারে আকাশের গা ছুঁয়ে। আকাশের ওপার থেকে তোর কাছে একটা ওর‌্যাকল মানে দৈববাণী এসেছিল”

-“ মানে?”

-“ মানে ওই পাইলট উপলক্ষ মাত্র। মুম্বাইতে কী না কী হয়েছে, নাগপুরে উড়োজাহাজ নামানো হয়েছে – এসব নেহাৎই তুচ্ছ ঘটনা। সত্যি শুধু একটাই। তোর কাছে আসা আকাশপারের ওই বার্তা।”

-“কী বলতে চাইছিস খোলসা করে বল তো…”

-“ আকাশের ওপার থেকে তোকে বলা হলো – ওরে ‘হোমো-স্যাপিয়েনের ছানা’…”

-“ কী, কী বললি..”

-“ ওটা বৈজ্ঞানিক পরিভাষা – ওর মানে হলো মানবসন্তান। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। তুই তো পাইলটের কথা শুনে মুষড়ে পড়লি। কিন্তু ওই আকাশবার্তার গভীর অর্থটুকু ধরতে পারলি না। অত অবাক হতে হবে না, সহজ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি”

-“হ্যাঁ, তাই দে।” আমি কফিতে চুমুক দিলাম। প্রখরেশ আজ সেই কলেজ-ক্যান্টিনের মেজাজে রয়েছে।

“ দূর আকাশ থেকে তোকে বলে পাঠানো হল – ওরে মানবসন্তান, মানুষের জীবনে স্কেল-পেনসিলে টানা ছক কাজ করে না। মাথামুণ্ডহীন আলটপকা ঘটনা, যার সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই, তাই হয়তো দুম করে সব বানচাল করে দিতে পারে। এই যেমন তোর হলো। অনেকের তো আবার জীবনের রাস্তা পর্যন্ত পাল্টে যায় .…”

কী বোঝাতে চাইছে প্রখরেশ? ইয়ারকি বলে তো ঠিক মনে হচ্ছে না।

-“তাই অত কিছু আগেভাগে ভেবে বসে থাকলে, বুঝলি রে বুড়োখোকা, দুঃখ পেতে হয়।”

আমি চুপ করে রইলাম।

-“ কি রে, আকাশবার্তাটা বুঝিয়ে দেওয়াতে তোর জ্ঞানচক্ষু খুলল কি? এই রে, আমার ফ্লাইট ছাড়বে বলছে … চলি রে..”

প্রখরেশ চলে গেল।


আমাকে এখনো অনেকক্ষণ বসে থাকতে হবে। ওয়াশরুমে আয়নার সামনে গিয়ে চশমা খুলে মুখেচোখে জল দিলাম। ঠিক বুঝতে পারলাম না জ্ঞানচক্ষু খুলেছে কি না। তবে একটা কথা। ব্যাপারটা আকাশবার্তা হোক বা প্রখরেশ-বার্তা হোক, ওটা মেনে নিয়ে দেখছি হতাশ ভাবটা কতকটা কেটে যাচ্ছে। খানিকটা যেন হালকাও ঠেকছে নিজেকে।