Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in





দ্বিতীয় ভাগ

এবারের মত আকাশ ময়লা করে দেওয়া শীত আগে কখনও দেখি নি। হাওয়া নেই তবু দিনের বেলায় অভয়াশ্রম থেকে কেনা খাদির চাদরটা গায়ে জড়াই।
এক এক করে সবাই হোস্টেলে ফিরছি। আমরা ক্লাস টেন। তাই এবার দোতলায় রুম পেয়েছি। ছোটরা একতলায়।
স্কুল খুলতে এখনও তিনদিন বাকি। কিন্তু আশ্রমের জীবনে এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে বাড়িতে গিয়ে সাতদিন ভালো মন্দ সাঁটানোর পরই একঘেয়ে লাগতে থাকে। ঠাকুমার হাতের মাছের গায়ে লম্বা করে পেঁয়াজ জড়ানো তেল-কই, কাকিমার রান্না চিংড়ির মালাইকারি কিছুদিনের মধ্যেই অর্থহীন হয়ে পড়ে।এই ব্যবহৃত ব্যবহৃত হতে থাকা গম-পেষা কলের মত জীবনের ঘ্যানঘেনে লয় কী যা তা! কোন চমক নেই, নতুনত্ব নেই।
একদিন বাড়িতে বললাম –আশ্রমের হোস্টেল খুলে গেছে। এখন ক্লাস টেন। একবার গিয়ে দেখে আসি স্কুল কবে খুলবে।

বাড়ি থেকে পারমিশন দিল একা বাঁকুড়া যেতে। রাত্তিরের ট্রেন ধরে সাতসকালে বাঁকুড়া স্টেশন। সেখান থেকে নৌকোয় দারুকেশ্বর নদী পেরিয়ে বাস ধরে বেলা ন’টা নাগাদ আশ্রমের লাল মোরাম ঢালা পথ।
আশ্রমের গেট পেরোই। খরগোস ঠোঁটের বিহারী দারোয়ান হেসে হাত তোলে। আমিও হাসি। ও হয়ত বকশিস আশা করছে। কিন্তু আমার যে খালি কোলকাতায় ফেরার ট্রেন এবং বাসভাড়াটুকুই সম্বল।
ভেতরে গিয়ে যা তা লাগল। চারদিক খাঁ খাঁ করছে। কেউ কোথাও নেই। কানাইদার অফিসের সামানে দিশি কুকুরটা মাথা গুঁজে ঘুমুচ্ছে।
মানিদা দেখতে পেয়ে একগাল হেসে কাছে ডাকলেন। আমি জিগ্যেস করলাম-- আজকাল আপনার গাঁট্টার দর কত করে?
--- দূদ্দূর! ছেলেপুলে নেই, ডিমান্ড নেই। তোরা আয়, দেখবি গাঁট্টার দর চড়চড় করে চড়ছে। কবে আসছিস?
-- এই তো এসে গেছি।
--ধ্যাৎ, বিছানা বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে? আগামী সোমবারে চলে আয়! কী রে?
--- আসব, আপনি যখন বলছেন।
তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা নামাই-- একটা কথা বলুন তো? নতুন মহারাজ কবে আসছেন?
--- জানি না। তবে নাম ঠিক হয়ে গেছে।
--নাম জানেন?
-- না।
--কোথাকার আশ্রম থেকে আসছেন ?
--- জানি না।
হটাৎ মানিদা গম্ভীর হয়ে গেছেন। এখন উনি সেক্রেটারি মহারাজের টাইপিস্ট বা নতুন মহারাজের সম্ভাব্য পিএ। ওঁর মুখে সেই মুখোশ এঁটে বসেছে।
অথচ উনিই আমার ভর্তির সময় লোক্যাল গার্জেন মেজকাকে বলেছিলেন-- চিন্তা করবেন না। একটা কি দুটো বছর ওর বাড়ির জন্যে মন খারাপ করবে। তারপর আর বাড়ি ফিরতে চাইবে না। এই নাইনের ছেলেটিকে দেখুন।
একটা উত্তমকুমারের মত কায়দা করে চুল ছাঁটা ছেলেকে উনি ইশারা করলেন। ও হেসে মাথা নাড়ল।
তখন সেই ছেলেটার উপর খুব রাগ হয়েছিল। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না? এ আবার হয় নাকি? ওপরচালাক! পোঁদপাকা!
মানিদা অফিসে ঢুকে গেলে আমি আস্তে আস্তে গেট পেরিয়ে বাসরাস্তায় দাঁড়াই। বিকেলের আগে ঘরে ফিরব।

এখনও নতুন মহারাজ আসেন নি। কিন্তু শীগ্গিরই এসে পড়বেন। হয়ত স্কুল খুলে যাবে। তাতে কী?
ছোট মহারাজ সুনীলদাকে জিগ্যেস করি-- উনি গান জানেন?
-- ঠাকুরের কাছে আসলে সবাইকে গান গাইতে কম-সে-কম আরাত্রিকটুকু হারমোনিয়মে বাজাতে শিখতে হয়।
--সে তো আপনিও শিখেছেন?
-- হ্যাঁ। শিখতে হত। ব্রহ্মচারী পর্বে।
পাশ থেকে অমিয়দা মিচকি হাসে-- শিখে টিখে এই ফর্ম?
-- কী ? কী বলতে চাও তুমি?
অমিয়দা সতর্ক হয়।
--বলছিলাম কি, ক'টা গান শিখেছেন?
--- কেন?
-- মানে আপনাকে বেশি গান গাইতে শুনি না তো! ওই " সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে--" আর " নাচে পাগলা ভোলা"।
-- আরও দু-তিনটে জানি। যেমন " বিভু নামে এক রাজার ছেলে, যাত্রা করেছিল শ্রীদূর্গা বলে"। তারপর " কে গো আমার মা কি এলি", আরও একটা " ভাঙ খেয়ে বিভোর ভোলনাথ ভূতগণ সঙ্গে নাচিছে"।
-- আর?
সুনীলদা অসহায় মুখ করে আমার দিকে তাকান। আমার খারাপ লাগে।
-- কেন মহারাজ! আপনি আরও জানেন। সেই যে "কে ওই আসিল রে কামারপুকুরে", " এস হৃদয় দোলায় দোলাই তোমায়, প্রাণের ঠাকুর রামকৃষ্ণ মম। তুমি যে মোর প্রিয়তম, প্রাণসম প্রাণমম।"
--ঠিক বলেছ প্রদ্যুম্ন, ,ওই গানগুলোও জানি। শোন, আজকে রাত্তিরে খিচুড়ি রান্না হয়েছে। আর এখন থেকে দুধ দেওয়া শুরু হচ্ছে। খিচুড়ির সঙ্গে একটু দুধ দিয়ে মেখে খেয়ে দেখ, খুব ভাল লাগবে।
-- এ ম্যা! খিচুড়ির সঙ্গে দুধ ? আপনি নিজে কখনও খেয়েছেন?
--- আমি তো খাই। একবার টেস্ট করে দেখই না!
ছোটখাট ভিড় জমেছে। একজন টিপ্পনি কাটে-- অমিয়দা, উনি কথা ঘোরাচ্ছেন। গান কোথায় গেল?
অমিয়দা ছোটলোক। হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে-- সুনীলদা, আমি ভেবেছিলম কি আপনি একটাই গান জানেন। মানে আপনার সবগুলো গান একইরকম শোনায়।
সমবেত অট্টহাসির মধ্যে সুনীলদা ভ্যাবাচাকা খেয়ে যান। ওঁর চোখ সবার মুখের উপর দিয়ে ঘুরে যায়। দেখতে পান-- চাপা হিংস্র আনন্দ।
এবার উনি অমিয়দার চোখে চোখ রেখে তাকালেন-- তুমি আমাকে এইকথা বললে? উপহাস করলে? করতেই পার। তুমি ছিলে কানাইদার কালীকীর্তনের দলের সদস্য। কিন্তু একটা কথা শুনে যাও-- ঠাকুর আমার গলায় সুর দেন নি। বুকে ভক্তি-ভালবাসা দিয়েছেন। আমি যখনই গাই, যেমনই গাই-- ভেতর থেকে ভালবেসে গাই। তাই তোমরা হাসলেও আমার কিস্যু এসে যায় না।


কাল থেকে ক্লাস শুরু হবে। আজকে ক্রিকেট-- গোটা মাঠ জুড়ে।কিছু ডে-স্কলার ছেলেরাও হাজির। চারদিকে অন্ততঃ চার-চারটে ছোট বড় ম্যাচ। একটা নতুন ছেলে টেনিস বলেও ভালই অফ ব্রেক করাচ্ছে; তায় আবার বাঁহাতি--সোনায় সোহাগা।
এবার রুম অ্যালটমেন্ট একটু অদ্ভূত, অন্ততঃ আমার চোখে।
আমার গুরু অমিয়দা রুম-ক্যাপ্টেন--কেয়াবাৎ! আর ওঁর ডানহাত-বাঁহাত, প্রশান্ত ও আমি ওর দুপাশের চৌকিতে। দরজার ডানপাশে নিখিলেশ--বাঃ!
কিন্তু বাঁ-পাশে? মানস! মহারাজদের পুরনো দালাল বা টিকটিকি।

বিপ্লবের ঠাঁই হয়েছে বিশুদের সঙ্গে, আমাদের থেকে তিনটে রুম পরে।
কেন?
আমাকে আর বিপ্লবকে নিয়ে কেউ কিছু মহারাজদের বা ওয়র্ডেনকে বলেছে নাকি? মানস সব পারে। ওকে বিশ্বাস করি না।
ও কারও বন্ধু হতে পারে না; কিন্তু ও সবসময় মহারাজদের বিশ্বস্ত স্পাই। ও এই করেই আনন্দ পায়। ওকে কি জেনেশুনেই আমাদের রুমে দেওয়া হয়েছে? পরে ভাবব।
আসলে আমার কিচ্ছু ভাল লাগছে না। দু-এক ওভার বল নিয়ে হাত ঘোরালাম। লেংথের কোন মাথামুন্ডু নেই। নিজের উপর নিজেই খাপ্পা হয়ে বাগানে ঢুকে গোলাপ ও দোপাটির গাছগুলোর পাশ থেকে গোটা তিন ছোট ছোট কাঠি বা কাঠের গোঁজ তুলে নিয়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলাম।
মাত্র তিনবছর আগে,-- এইরকম এক শীতের দিনে কানাইদা ডাইনিং হলে নোটিস পাঠালেন যে আশ্রমের ব্যান্ডপার্টির পুনর্গঠন হবে। কারণ আগের অনেকে পাশ করে বেরিয়ে গেছে। নতুন ছ'জন ছেলেকে কেটল্‌ আর দুজনকে বিউগল বাজানোর জন্যে নেওয়া হবে।
আমাদের কুড়িজনের ব্যান্ড। দুজন বড় বিড্‌ ড্রামের জন্যে, আর ছজন বিউগল , তিন-তিন করে দু'সারিতে। আর বারোজন বাজায় কেটলড্রাম-ছয় -ছয় করে দু'লাইনে।
নোটিসে ছিল সাতদিন শেখা ও প্র্যাকটিসের টাইম, তারপর পরীক্ষা।
আমি তখন সেভেনে, সোজা গিয়ে কানাইদাকে বললাম--আমি শিখতে চাই; কী করতে হবে?
--- বাগান থেকে দুটো কাঠি তুলে নিয়ে আয়।
যথা আজ্ঞা।
উনি দুহাতে ড্রামস্টিকের আলাদা আলাদা গ্রিপ দেখিয়ে বললেন --এই এমনি করে স্ট্রোক দিবি--রাম্‌ পাম্‌, রাম্‌ পাম্‌। রাম্‌ পাম্‌, রাম্‌ পাম্‌।
-- কই মহারাজ! কোন রাম-পাম শব্দ বেরোচ্ছে না তো?
-- দূর ক্যাবলা! রাম-পাম শব্দটা নয়, দুটো স্ট্রোকের টেকনিকটা মন দিয়ে দেখ্‌ আর শব্দের ওজনের ফারাকটা দেখ।

আমি মহানন্দে ঘরে গিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করে দিলাম--রাম্‌ পাম্‌, রাম্‌ পাম্‌।সারাদিন।


আমি একা নই, আরো পাঁচজন।
রাম্‌ পাম্‌, রাম্‌ পাম্‌।
কিন্তু পরের দিন থেকে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়।
আরো জনাবিশেক ছেলে ওঁর সঙ্গে দেখা করে গুরুমন্ত্র নিয়ে এসে বাগান থেকে কাঠি তুলে প্র্যাকটিস করছে। ঘরে ঘরে মাথার উপরে বেজে উঠছে--রাম্‌ পাম্‌, রাম্‌ পাম্‌।
কয়েকটি ছেলে সিনিয়রদের হাতে ঠ্যাঙানি খাওয়ায় অভ্যাসে ভাঁটা পড়ল। তাতে কি!ঢের প্র্যাকটিস হয়েছে।
কিন্তু পরীক্ষায় ডাহা ফেল!
কানাইদা মাত্র তিনজনকে নিলেন। ওরা সিনিয়রদের থেকে টিপস্‌ ও ড্রামস্টিক নিয়ে রোল বাজিয়ে দিল। আমাদের গাঁইয়া প্র্যাকটিস দাঁড়াতে পারল না।
বললেন-- হয় নি। আরও প্র্যাকটিস কর।
আমি রাগ করে একবেলা খাই নি। তারপর অমিয়দাকে ধরে শুরুর গৎ, বড় চেঞ্জ, ছোট চেণ্জ সব তৈরি করে গেলাম। ব্যস্‌।
উনি চলে গেছেন কয়েকমাস হল। ব্যান্ডপার্টির ঘরে তালা। নতুন মহারাজ কি বিউগল বাজাতে জানেন?
আমি কাঠি তিনটে হাতে নিয়ে মাটিতে ঠুকে দেখি। তারপর ব্লেড দিয়ে চেঁছে মুখগুলো একটু গোল এবং ক্রমশঃ ছুঁচলো করে ফেলি।
তারপর টেবিলের উপর ট্রাই করি। রোল করার চেষ্টা করি।
কী আশ্চর্য! বেজে উঠল-- ড্রিরি-রি-রি-ড্রাঁও-ও-ও!
চমকে উঠে আবার স্ট্রোক দিই, আবার আবার আবার!
এর পর ব্যান্ডমাস্টারের স্টিকের ইশারায় সমবেত রেসপন্সের গৎটা বাজাতে চেষ্টা করি।
--- ঢ্যারার‌্যার‌্যা -- ঢ্যারার‌্যার‌্যা -- ড্রাঁও!
ঢ্যারার‌্যার‌্যা -- ঢ্যারার‌্যার‌্যা -- ড্রাঁও!
লিড্‌ ড্রাম বেজে ওঠে-
ট্যাট্‌ট্যারা--র‌্যাট্‌-ট্যারা--ট্যাট্‌ট্যারা-র‌্যাট্‌ ট্যাট্‌
ট্যাট্‌ট্যারা--র‌্যাট্‌-ট্যারা--ট্যাট্‌ট্যারা-র‌্যাট্‌ ট্যাট্‌
ট্যাট্‌ট্যারা--র‌্যাট্‌-ট্যারা--ট্যাট্‌ট্যারা-র‌্যাট্‌ ট্যাট্‌
ঢ্যারার‌্যার‌্যা -- ঢ্যারার‌্যার‌্যা -- র‌্যাট্‌ ট্যাট্‌-ড্রাঁও!
নাঃ, কিচ্ছু ভুলি নি।
ব্যান্ড্‌ থামে না।
এর পরে ছোট চেঞ্জ, বড় চেঞ্জ, স্টিকের গায়ে স্টিক ঠেকিয়ে তালফেরতা মত, সব একের পর এক হতে থাকে।
কখন যেন অমিয়দা সমর রবি বিজন সব যে যার স্টিক কাঠি সব নিয়ে এসেছে আর কেটল ড্রাম বাজতে শুরু করেছে পড়ার টেবিলে ও খাটের গায়ে।
এখন মাঘ মাস। কিন্তু ফাল্গুন-চৈত্র মাসে আশ্রমের ব্যান্ড পার্টি ভাল করে মাঠে নামবে, রিহার্সাল দেবে। পয়লা বৈশাখে মিউনিসিপ্যালিটির মাঠে পুলিশ ব্যান্ডের সঙ্গে টক্কর দেবে। কানাইদার নিজের হাতে তৈরি ব্যান্ড--চাট্টিখানি কথা!

খাওয়ার ঘন্টা বেজে উঠল।

নতুন মহারাজ এসে গেছেন। না, উনি একা নন। সঙ্গে আরেকজন। আমরা পেয়ে গেলাম বড় ও মেজ মহারাজ--একসঙ্গে। বেশ তো।
হয়তো আমাদের আশ্রমের ডিসিপ্লিনের দেয়ালে কোথাও ফাটল ধরেছে, তাই।
মেজ মহারাজ নাকি ইংরেজ আমলে জাঁদরেল পুলিশ অফিসার ছিলেন! চালাকি নয়। এসব উনি নিজেই প্রথম পরিচয়ে এইট ও নাইনের ছেলেদের জানিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু ওঁরা কেউ হাসেন না। আমরা আশা করেছিলাম যে সুনীলদা, মানে আমাদের ছোট মহারাজ , সেক্রেটারি হবেন। কিন্তু উনি সেই ছোটটিই রয়ে গেলেন। গান গাইতে পারেন না, তাই?
কিন্তু নতুন দুজনকেও তো কোনদিন গাইতে দেখি নি। হ্যাঁ, সবাই কি আর রামকানাইদার মত হতে পারে!
নাঃ, আমি কানাইদাকে ভুলতে চাই। আপনি চলে গেছেন; বেশ হয়েছে। মুখচোরা মলয় বাড়ুরি চলে গেছে। ওকেও ভুলতে শুরু করেছি। আর সেই দিদিমণিটি? ওঁর নামটাও আর মনে পড়ে না।
কিন্তু নতুন মহারাজেরা কেন যে বারবার কানাইদাকে মনে পড়িয়ে দেন! ওঁরা যদি একটু হেসে কথা বলেন তাহলেই কানাইদাকে ভোলা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
রোববারের ধর্মক্লাসে বড় ও মেজ মহারাজ এলেন। আমরা জেনেছি যে ওদের মহারাজ বলেই সম্বোধন করতে হবে। ওঁরা কখনই আগের সেজ'দা, কানাইদা বা সুনীলদার মত সুবিমলদা বা বীরেশদা হবেন না। আমরা ক'দিন সুনীলদাকেও মহারাজ বলে ডাকতে শুরু করলাম। উনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। তিনদিনের মাথায় বললেন-- প্রদ্যুম্ন, তোমরা আমাকে আগের মতই সুনীলদাবলে ডেকো; নইলে কি'রম যেন দূরে ঠেলে দিচ্ছ মনে হয়।
ধর্মক্লাসে বড় মহারাজ স্বামীজির ‘উপনিষদের গল্প ‘ বলে একটা সংকলন থেকে পড়ে শোনাচ্ছিলেন।
গল্পটা হল--দ! দ! দ!
আকাশের বজ্রনির্ঘোষে মানবজাতির জন্যে সন্দেশঃ দ! দ! দ!
মানে দমন কর! দান কর! ইত্যাদি।
-- কাকে দমন করব মহারাজ, শত্রু কই?
-- ষড়রিপুকে। সেই তোমার শত্রু, অহরহ তোমাকে ভ্রমিত করছে, ভুলপথে নিয়ে যাচ্ছে।
--বুঝতে পেরেছি। আমার এক পিসেমশায় আছেন-- তাঁর নাম রিপুদমন রায়।
--- তোমার পিসেমশায়ের গপ্পো বন্ধ কর; ক্লাসে মন দাও।
চারদিকে ফিক ফিক করে হাসি শুরু হয়ে গেছে।
এবার মেজ মহারাজ পড়ে শোনালেন ব্রহ্মজ্ঞানী মদালসার গল্প। সেই পরমাসুন্দরী বিদুষী এবং সংসারে বীতরাগ মহিলা নিজের পুত্রসন্তানের নাম রাখলেন-- অলর্ক; তার মানে পাগলা কুকুর!
--- এই তুমি উঠে দাঁড়াও! পেছনের লাইনে বাঁদিক থেকে তিননম্বর! কালো ছেলেটি,--তোমাকে বলছি , হাসছ কেন?
--- মানে, উনি অত জ্ঞানী , কিন্তু নিজের ছেলের নাম রেখেছেন কুকুর, আবার পাগলা কুকুর! তা হলে উনি হলেন কুকুরের মা।
উঠে দাঁড়িয়েছেন মেজ মহারাজ; ---আমার অফিস থেকে কেউ বেতগাছাটা নিয়ে এস। তোমার এটা শুনে হাসি পেল? এটা কি হাসির গল্প? এটা ধর্মক্লাস!
ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। আমতা আমতা করি।
-- না , মানে ধর্মক্লাসেও তো ভয়ের গল্প, হাসির গল্প সবরকমই হতে পারে ভেবে ছিলাম। স্বামীজি তো হাসতে ভালবাসতেন। বন্ধু গিরীশ ঘোষের সঙ্গে কত ইয়ারকি ফাজলামি করতেন।
-- কী নাম তোমার?
--- প্রদ্যুম্ন; ডাকনাম পোদো।
-- কেন?
পেছন থেকে সমবেত স্বরে ফিসফিসানি শোনা গেল-- বিচ্ছিরি পাদে বলে।
হাসির হররা!
--সাইলেন্স! অল স্পয়েল্ড ব্র্যাটস্‌! এদের কী করে ঢিট্‌ করতে হয় জানা আছে।
---- প্রদ্যুম্ন! তোমার নামের মানে জান? তুমি কৃষ্ণের সন্তান। নিজের নামের অপমান কর না। এসব কী হাবিজাবি বকছ? স্বামীজি গিরীশ ঘোষের সঙ্গে ফাজলামি করতেন? কে বলেছে তোমায়?
-- কেউ বলেনি; বইয়ে পড়েছি।
-- কী পড়েছ? কিরকম ফাজলামি।
ওনার গলার স্বর এখন অনেক নরম, স্কেল উদারায় নেমে এসেছে।
আমি ভরসা পেলাম, এবার ওনাকে আমার ফান্ডা দেখিয়ে ইম্প্রেস করে দেব।
-- উনি গিরীশ ঘোষকে শালা বলতেন, থিয়েটারে মাগী-নাচানো লোক বলতেন।
প্রচন্ড শব্দ করে চেয়ারটা পড়ে গেল। আমার দিকে ভারী বুট পায়ে এগিয়ে আসছেন একজন পুলিশ অফিসার। ইংরেজ আমলের। কুতকুতে চোখজোড়া জ্বলছে। ভিড় সরসর করে সরে জায়গা করে দিচ্ছে। এ কী! ওঁর পাকানো মুঠো যে ডাম্বেলের মত।

বিকেলবেলা বিছানায় শুয়ে গরম দুধ খেতে খেতে বিপ্লবকে বললাম-- উনি কি পুলিশ ক্লাবের বক্সিং চ্যাম্পিয়নও ছিলেন? জেনে নিস তো!