Next
Previous
0

গল্প - সাধন চট্টোপাধ্যায়

Posted in







ফ্ল্যাটের টপ ফ্লোরের মহিলাটি এখন গ্রিলঘেরা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। স্থির। আপনমনে চুলের জট ছাড়াচ্ছেন। মাঝে মধ্যে চিরুনি বেছে গুটলিগুলো ফাঁক দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন। বাতাসে ঘুরপাক খেয়ে নীচে কোথায় পড়ছে, কৌতুহল নেই।

টপ ফ্লোর বলতে ইদানীংকার G+4 নয়। পুরনো কালের। ইংরিজি হিসেবে থার্ড ফ্লোর। প্রতিটি তলায় দু-দুটি পরিবার। মাঝবরাবর সিঁড়ি। কোনো লিফটনেই। এটাই গেরস্তপাড়ায় প্রথম ফ্ল্যাট হয়েছিল কিনা। তখনই বুকে হাঁফ, হাঁটু, বয়স, বার্ধক্য আসবে ভেবে লিফট-এর ভাবনা জরুরি হয়ে পড়েনি। তাছাড়া একতলা, দোতলার পার্টি পয়সা খরচে গা করতে চায় না। এখানে ‘শবনম’ অ্যাপার্টমেন্টে অবিশ্যি একতলায় কোনও পরিবার থাকে না।

একপাশে ভাড়াটে হিসেবে কাঠের দোকান। রাঁদা, চাঁছাই, কাঠের টুকরো, বাটালি, তুরপুন, হাতুড়ি- ঠকাঠক শব্দ। অনুপমা ফার্নিচার। প্লাইউডের সস্তা আলমারি, ড্রেসিং টেবিল তৈরি হয়। সকাল আটটায় খুলে রাত সাড়ে সাতটা। মাঝেমধ্যে আটটা অবধি ঝাঁপ আদ্দেক টেনে আড়ালে গ্লাস-বোতলের আয়োজন। আর সিঁড়ির ডানপাশেরটা বেশ কিছুদিন ধরে তালাবন্ধ। একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে—TO LET।

বেলা পৌনে দশটার মত। যুগযুগান্তরের টান টান আস্ত একখানা রোদ চারপাশে ছড়িয়ে আছে। টলটলে নীল আকাশ। টুকরো টুকরো কিছু সাদা মেঘ। শ্রাবণ মাস যদিও, কোনও কোনো দিনের শুরুটা এমন মাজাধোয়া নীল রঙের সূচনা হয়। কারও কল্পনার গভীর অভ্যেস থাকলে ‘শবনম’ নামক কংক্রিটের খাঁচাটাকে রোদপোয়ানো কুমীর ভাবতে পারেন। প্রবল একটি লোহার সিন্দুক বা ওয়াশিং মেশিন ভেবে নিলেও বাধা দেওয়ার কিছু নেই।

উঁচুতে ঐ মহিলার শাড়ির আঁচল ডান কাঁধে, হলদে রং। ব্লাউজটা গেরুয়া। কোনও বাঙালি গৃহবধূ আঁচল ডান কাঁধে তুলবে না। ঐ পরিবারেই, মাস তিন আগে, টকটকে ফর্সা একটি যুবকের সাদি হয়েছিল। তখনই পাড়ার মানুষ দেখেছিল, টপ ছাদে ম্যারাপ বেঁধে আত্মীয়দের মধ্যে নাচ, মেহেন্দি ও বিয়ের গাওনা।

রাস্তাঘাটের মানুষ, পাড়াপড়শিরা বুঝেছিল, প্রতিদিন ঢ্যাঙা, --- সাদা চুলে যে গৃহকর্তাটি দুহাতে ঝুলিয়ে বাজার করে ফেরেন—বাঙালি পরিবার নয়।

গৃহকর্ত্রী এখন কী ভাবছেন কাঁকই দিয়ে জট ছাড়াতে ছাড়াতে? মাটি থেকে ঘাড় উঁচিয়ে তা অনুমান দুঃসাধ্য। যেমন ঠিক নীচের অন্যান্য ফ্লোরের বারান্দার ছবিগুলো মহিলা ঠিক টের পাচ্ছেন না। তবে পথের মানুষ খানিক আন্দাজ দিতে পারে।

যেমন, তিনতলার ব্যালকনি ফাঁকা। দেখা যাচ্ছে কয়েকটা পাতাবাহারের সাজানো টব, দড়িতে ক্লিপআঁটা একখানা বেডশিট। অতীতদিনের ফুটবলারটি এবং তার বউ নিশ্চয় ভেতরে আড়াল হয়ে আছে। বেডরুম, কিচেন নাকি বাথরুমে--- নিজেরাই বলতে পারবে।

এলাকারই অতীত দিনের একজন প্রতিশ্রুতিবান ফুটবলার ছিলেন উনি। লোকাল লিগে ফি বছর প্রচুর গোল করেও, কলকাতা ময়দানে কোনো ক্লাবে ঢুকবার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এখন তো বয়স বাহান্ন-তিপ্পান্নর ঘরে। পথেঘাটে সর্বদাই মাথাটা ঝুঁকিয়ে মাটিমুখীন দৃষ্টিতে হাঁটেন, সোজা চোখ তোলে না। একটা ওষুধের দোকান চালান। বিক্রিবাটা কম তবে দোকানে হপ্তায় একদিন করে প্রখ্যাত হার্টবিশেষজ্ঞ—সরকারি হাসপাতালের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান।বহু উপরোধের পর বসেন বলে, একটু ইজ্জৎ আদায় হয়। এক হপ্তা আগেই লেখানো নামের কোটা ভরে যায় কিনা!

বউটির চেহারা লম্বা, সর্বদা বিষণ্ণমুখে ফুটবলার স্বামীকে রাস্তায় জ্ঞান দিতে দিতে একসঙ্গে দোকান খোলে। আর ফুটবলারটি তাতেই যেন কৃতার্থ।

তাদের ঠিক নীচের ব্যালকনিতে তখন একজন বারমুডা পরা, ভুঁড়িওয়ালা সেলফোনটি কানে চেপে কথা বলেই চলেছে। কী বলছে, কোনও উদ্বেগের ফোন কিনা –রাস্তায় কারও পক্ষে বোঝার উপায় নেই।

টেনশনে পায়চারিও করছে না, স্থির দাঁড়িয়ে হাতটি কানে ঠেসে ধরেছে। ওর নাম জয়দীপ। বেশি বয়স নয়, হঠাৎ‌ অতিরিক্ত মোটা হয়ে, গালের কোনও কোনও অংশের দাড়িতে পাক ধরায় মুখটা রাশভারী। ওরাই দোতলার দুটি ফ্ল্যাটের মালিক। সব কিছু বিনির্মানের আগে, জমি সহ একতলাটা ওদেরই মালিকানায় ছিল কিনা! নগদ কমিয়ে পাশাপাশি ফ্ল্যাট দুটি শর্ত করেছে। উত্তরেরটা মা – বাবার, দক্ষিণে বউ, ছেলে আর জয়দীপ। এখন অবশ্য, মাপজোক করলে, চারতলায় মহিলার চুল পরিপাটির আলম্ববিন্দুতে জয়দীপ দাঁড়িয়ে।

চলুন, ফের উঠে আমরা চারতলায় যাই। দক্ষিণের দিকটায়। সিঁড়ি বেয়ে অবশ্য নয়, রাস্তায় দাঁড়িয়েই ঘাড়টা ফেরাই।

বারান্দার কাচঘেরটা ঈষৎ খোলা। এসি বসিয়ে নিয়েছে বলে দিনরাত কাচ টেনে রাখতে হয়। এখন খোলা অংশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ইংলিশ মিডিয়ামের এইট কি নাইনের ছেলেটি স্যান্ডো গেঞ্জি গলাচ্ছে। ইদানীং টিভিতে সুপারস্টার অক্ষয় কুমার লাক্স গেঞ্জির খুব বিজ্ঞাপন হাঁকাচ্ছেন বলে, ধরে নিতেই পারি ব্র্যান্ড ভ্যালুর জন্য ছেলেটি লাক্স গেঞ্জিই পছন্দ করে।

ছেলেটির ঘন চুল-সহ গোল মাথাটিও রাস্তা থেকে দেখা গেল। নিশ্চয়ই একটু পরই নেমে পুলকার ধরবে। স্কুল ড্রেস ওদের সাদা প্যান্ড, নীল শার্ট। মাও নামে সঙ্গে। বড় রাস্তায় পুলকার অবধি যায়। এটুকু রাস্তাতেও ছাতি ব্যবহার করতে দেখা য়ায়। শীত, গ্রীষ্ম—বারোমাস, পুলকারে তুলে দিতে এবং ফিরিয়ে আনতে।

চেহারাটা লম্বা মহিলার এবং স্বাস্থ্যবতী। বিশেষ ছন্দ নিয়ে পথে হাঁটে, যেন পুরো শরীর দোল খাচ্ছে। তখন নিতম্বজোড়া এবং বুক দুটি--- কিছু অচঞ্চল থাকে না। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়। কিন্তু চোখের চাউনিতে সচেষ্টভাবে চারপাশকে উপেক্ষার ভাব। তবে, উপেক্ষার আগে একজনকে দেখে নিতে পটু।

এখন চারতলায় নিশ্চয়ই ছেলেকে তাড়া লাগাচ্ছে, মুখ ঝামটাচ্ছে পুলকারটি যাতে ছেড়ে না যায়। আজ চানে ঢোকার আগে বিল্টু গলির ক্রিকেটে অতিরিক্ত কুড়ি মিনিট খরচ করে ফেলেছিল কিনা। ফ্যামিলির স্বামীকর্তাটির চেহারায় মনেই হয় না অমন স্বাস্থ্যবতী আপন পুরুষটিকে দিয়ে পূর্ণ তৃপ্তিতে সংসার করছেন।

তিনি রোগা, সামান্য কুঁজো গোছের। চুলগুলো বারোমাসই যেন ধানের অঙ্কুর। কাঁধ-পিঠও সামান্য বাঁকাচোরা, মনে হবে অতীতে টাইফয়েড বা ভিন্ন কোনো জটিল ব্যাধিতে শরীরটা খুঁতো করে দিয়েছিল।ভারি কিছু কাঁধে তুললেই বেঁকে হাঁটে। চাকরি লালবাজারের গুন্ডাদমন শাখায়। করণিক জাতীয় কিছু। রোজই অফিস বেরোবার পর্বে, চারতলায় বউয়ের হাত নাড়ানোর জবাবে রাস্তা থেকে প্রতি-হাত নাড়ে। যদি ঘর থেকে বেরুত গিয়ে, কোনও ফ্লোর থেকে হাঁচি শুনল তো ফের ঘরে ঢুকে তবেই বেরুবে। সংস্কার। ‘শবনম’-এর খোপে খোপে নানা কিসিমের এমনধারা সংস্কার বলবৎ। সংঘাতও ঘটে, ছোটোখাট খটাখটি এবং বড় সংঘাতের পর পরস্পরে কেউ কথা বলে না অনেকদিন। দরজার দিকে তাকায় না পারতপক্ষে। নিঃশব্দেসিঁড়ি বেয়ে পাশাপাশি ওঠানামা। থমথমে, অদাহ্য একটা শান্তি বজায় থাকে কিছুদিন।

আজ দশটায়, নীলিমার নিচে অ্যাপার্টমেন্টটি থমকে। হ্যাঁ, আমরা প্রসঙ্গত দক্ষিণের তিনতলার ঘরটিতে ঢুকিনি। জয়দীপের মা-বাবাদের ঠিক ওপরেই।

এখন সেখানে আছে রুবি এবং ছ’বছরের মেয়ে দিয়া। রুবির স্বামী অবনীশ কুণ্ডু পরশু থেকেই ফেরার। গা ঢাকা দিয়েছে।

অবনীশের সংসার কীভাবে যে বাড়তি সচ্ছলতায় চলে, কেউ আন্দাজ করতে পারে না। তবে, গোপন অনুমানে সন্দেহ করে নিতে পারে।

সে নাকি কুখ্যাত চিট্‌, উঁচুমহলে কানেকশন। ওকে নিয়ে সংবাদপত্রে একবার খবর হয়েছিল। কলকাতার মানিকতলা অঞ্চলে পুরনো পাড়ায় জাল ওষুধের কারখানা রেইড হতে, পুলিশ যে চাঁই তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছিল, একজন অবনীশ। চটপট বেলও জুটেছিল। উঁচুমহলের যোগাযোগ থাকায়, গুরু পাপে দণ্ড হয়েছিল লঘু।

সিঁড়ির নীচে, অবনীশের ‘বুলেট’ এবং জয়দীপ-এর ‘পালসার’—পাশাপাশি থাকে। তাছাড়াও, সর্বক্ষণ চেনেবাঁধা একটি বিলিতি কুকুরও আছে তার। কৌতূহলী কেউ জানতে চাইলে, গম্ভীর মুডে সে নামও বলে। মাঝেমধ্যে ফাঁকফোকরে, ঘিঞ্জি পাড়ার দিকে হাগাতে নিয়ে যায়, বিকেলের দিকে। এনিয়ে অবনীশের সঙ্গে বচসাও হয়েছে অনেকের।

এখানে নয়! এখানে নয়!

আপনার কী তাতে?

দেখতে চান আমার কী?

সেই থেকে, অবনীশ তার ‘পেড্রো’-কে নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের নির্জন ড্রেনের ঘাস সন্ধান করে বেরায়।

অবনীশের ঠিক মাথার ওপরে, চারতলায় গুন্ডাদমনশাখার করণিকটি। তার বউটির দিকে নাকি অবনীশ ঠারেঠোরে ইঙ্গিততরঙ্গ ভাসিয়ে দেয়, তা নাকি প্রতিফলিত ফিরেও আসে--- রটিয়েছে ফুটবলারের বউটি। দোষারোপের কোনো সারবত্তা প্রমাণ হয়নি। তবু রুবি বদ্ধ ঘরে নাকি চুলের মুঠি ধরে অবনীশকে থ্রেট করেছিল, যদি ঐ খানকিটাকে নিয়ে তোমার সম্পর্কে কিছু শুনতে পাই--- বঁটিতে স্রেফ গলা নাবিয়ে দেব! বুজেছ?

করণিক হলেও লালবাজার নামটি জড়ানো বলেই, পাড়ায় পুলিশ হিসেবে চিহ্নিত।আর অঞ্জু হল গিয়ে পুলিশের বউ। অঞ্জুর দুষ্টুবুদ্ধিতে বলে, পরীক্ষা কাছে এলেই--- ছেলের যখন বেশি বেশি সিলেবাসে মনোযোগ দরকার--- নীচে বিলিতি কুকুরটা ঘনঘন চিৎকার করে।পাজি লোকটা ইচ্ছে করেই কুকুরটাকে উত্তেজিত করে। মোটিভ আছে।

পুরনো ফুটবলারের বউটির নাম সুলেখা। যেদিন দোকানে স্পেশালিস্ট ডাক্তারটির বসবার কথা, সকাল-সকাল চান সেরে, চুলের খোলা গোছটি পিঠে এলিয়ে দিয়ে, খুচরো ফুল ও জবার মালা কিনে তারা মায়ের ফটোটি ধূপ জ্বালিয়ে সাজায়। প্রতি শনিবার। আর কী অদ্ভুত কাকতালীয়, নির্দিষ্ট বারটিতেই সিঁড়ি দিয়ে নামতে গুচ্ছ গুচ্ছ চুল। চলতে গেলে পা-য়ে লাগবেই। সুলেখার বুকের ভেতর রিরি করে ওঠে। পায়ে লেগে থেকে ঘরে বা দোকানে যাওয়ার পনের আনা চান্স। এ-সব অলুক্ষণে ব্যাপারগুলো কি ধিঙ্গি মাগীরা বোঝে না? বয়স তো কম হল না! জটছাড়ানো চুল আল্লার নামে বাতাসে ছাড়ে? ঘরে ময়লা ফেলার পাত্তর নেই?

ঐ হিন্দুস্থানী ফ্যামিলির শাশুড়িটার কাজ। লাটের বাঁট। জঞ্জাল নিতে আসা ছেলেটি বাঁশি বাজালেই ময়লার পাত্তরটা নিয়ে নেমে এসে গাড়িটায় ফ্যাল। তা নয়, ন্যাকামো! বেশি টাকা কবুল করে ছেলেটাকে চারতলায় তুলে আনা। আর দ্রুত নামতে গিয়ে দু-চারটে ময়লা ফসকে পড়বেই। সিঁড়ি মাড়িয়েই সকলকে ওঠানামা করতে হয়। কে আর ভেতরের জ্বালাটুকু বুঝতে চায়? ওর বিশ্বাস, এইসব অনাচারেই ওষুধের দোকানটা রমরমা হতে পাচ্ছে না। তবু একটা দিন বিশেষজ্ঞ বসেন বলে, রক্ষে! এগুলো মানুষের ষড়যন্ত্র ছা্ড়া কি?

তাছাড়া, কমন সিঁড়ি নিয়মিত ঝ্যাঁটানো, মূল দরজায় তালা ঝোলানোর দায়িত্বভার, মূল আলো নেবানো, কারও মেঝে থেকে দুমদাম শব্দ তৈরি না করা--- অনেক দিন ধরেই চাঁদা - ঢিলেঢালা কাজের জন্য ‘শবনম’ নামক বিপুল কংক্রিটখাঁচাটির খোপ-খোপান্তরে নীরব খিঁচুনিতে ভুগছিল।

দোতলায়, একদা সম্পত্তির গোটা মালিক জয়দীপের বউ নিবেদিতা এককাঠি সরেস। সে যখন বিশেষ কাউকে টার্গেট না-করে মাথা গরম করে পথ চলাচলের মানুষরা অবধি মাথা তুলে তাকায়। নিচে অনুপম ফার্নিচারের মজুর-মিস্ত্রিগুলো হাসে। নিবেদিতা থামে না, ঘরের কাজ করে আর অনর্গল অসন্তোষ, হা-হুতাশের কথা আর সব কটি পরিবারের উদ্দেশে নানা হুল ফোটানো।ফার্নিচার মজুরদের একজন, নৃপতি—সন্ধ্যা হলেই যে বোতল-গেলাসে ভোঁ-দোতলার চ্যাঁচামেচিতে হাসতে হাসতে মাথা দুলিয়ে বলে যায় নিজের জ্বালায় জ্বলছি/ সবাইকে নিয়ে চলছি/ কার মাল কে খায়। বস্তুত, লরির পেছনে লেখা ছন্দটি ওর খুব মনপছন্দ। এখনো কোথাও বেনিয়ম বুঝলেই, আত্মগত আওড়াতে থাকে।

ভাগ্যিস অ্যাপার্টমেন্টে গত পরশুর সন্ধ্যারঘটনায় নিবেদিতা টুকিটাকি কেনাকাটায় বেরিয়েছিল। উপস্থিত থাকলে যে কী হতো! নিবেদিতার শাশুড়ি তার কামরায় উদ্বেগ করছিল, ভাগ্যিস ছেলের বউটি নেই তখন, থাকলে এমন পরিস্থিতিতে তিনতলায় উঠে রুবিকে কামড়েই দিত। দু-জন কেউ-কাউকে সহ্য করতে পারে না। পরশুর আগে থেকেই নিবেদিতার শ্বশুরের ডান অঙ্গ অবশ হওয়া শুরু হতেই জয়দীপ অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে হাসপাতালে রওনার মুখে তিনতলার মেঝেতে ধেই ধেই গোড়ালির তাথৈ নৃত্য। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছিল নিবেদিতা। একেই তার হাইপ্রেসার। মটকা গরম হয়ে গেলে কাককাঁকুড় জ্ঞান থাকে না। হাত উঠে যায়। এজন্য জয়দীপকে কম লাঞ্ছনায় ভুগতে হয়?

শুধু চারতলার উত্তরদিকে হিন্দুস্থানী পরিবারটি ঝগড়ায় জড়ায় না। এখনও তাদের বাগধারায়সেইসব বাঙালিবুলি রপ্ত হয়নি। ওরা বিহারের রাজপুত, সিং পদবি। যখন ফ্ল্যাটের নানা তলায় মহিলাদের মধ্যে ছোটখাট নানা তুচ্ছ কারণে কুঙ্কু – সিকি, কিকি – মুমু লেগে যায়, নিজের ফ্ল্যাটের দরজাটি টেনে, টপ্‌ ছাদে চলে আসে। ওটা সকলেরই মুক্তির স্থান কিনা। ওদের পক্ষে আবার চট করে উঠবার সুবিধায় বুড়োবুড়ি প্রায়ই ফিতেবাঁধা হালকা একখানা খাটিয়া নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলে, তালপাতার পাখায় হাওয়া খায়। সব কটা ফ্যামিলির মূল দরজার ল্যাচ্‌ আটকে দিলে ভেতরে কি চলছে, কেউ কারোরটাই টের পায় না। সকলেরই টিভি আছে--- ছাদে যার যার ডিস্‌ বসানো।

কিচেনে মিক্সি মেশিন--- মাঝেমধ্যে করাতি শব্দ বোঝা যায়। আছে চওড়া স্ক্রিনের হাতফোন। সিঁড়ি দিয়ে নীরবে পাশ কাটিয়ে গেলেও যার যার হাতে ধরা থাকে। তানপুরা নেই কারও, গিটার কিংবা হারমোনিয়াম--- থাকলে সকাল সন্ধ্যা মূর্ছনা শোনা যেত। তবে, যার যার ঠাকুর আছে। সকালে বেরিয়ে ফুল কিনে ফেরে, সন্ধ্যায় শঙ্খ শোনা যায়।

সংবাদপত্র ছাড়া মাসের পর মাস কিছু পড়া হয়ে ওঠে না। সকলেরই মধ্যে ঢাকা দেওয়া বিপুল দুঃখ, আপশোস ও উৎকণ্ঠা আছে। তা নিয়ে, গ্যাস লিক্‌ হবার মতো, ছেলেপুলের সামনেই স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে বিদ্ধ করে।

চারতলার রাজপুত পরিবারটি ভেন্ন পরিবেশে প্রথম প্রথম দেশ থেকে হিং, আচার বা ক্ষীরের বিচিত্র মেঠাই আনলে--- একটু আধটু বিতরণ করত। এমনকী, ছেলেটির সাদির পানিভরণের লাড্ডু পাঠিয়েছিল ‘শবনম’ অ্যাপার্টমেন্টের ঘরে ঘরে। সেপরিস্থিতি দ্রুত বদলে গেছে।

আজ এখন যে নীলিমার নিচে কংক্রিটের স্তুপটিকে দূর থেকে স্থির ছবির মতো লাগছে, আঁচড়ানো চুলের গুচ্ছ নিরুদ্দেশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে যে, খাড়া নিচের তলায় মস্ত ভুঁড়ি নিয়ে জয়দীপের কানে ফোনচাপা কনুইটা স্থির--- প্রতিটির কার্যকারণ গভীর ব্যক্তিগত।

চিরুনি চালানোর ফাঁকে প্রৌঢ়া নিঃশব্দে শিহরিত, মৃদু পুলকিত, দু মাস হল বৌমার কোনো . . .। আর ফোন হাতে জয়দীপের স্থির কনুইটির কারণ, খবর এল বুড়ো বাবা বিছানায় মরে পড়ে আছেন। ভোর রাতে মস্তিষ্কে ফের বড়সড় ধাক্কা। এখন শবের গাড়ি ‘বৈতরণী’র খোঁজ। নানা সোর্স কাজে লাগাতে হচ্ছে।

ক’দিন আগে ‘শবনম’ অ্যাপার্টমেন্টে যখন সুলেখা – রুবি – অঞ্জুদের মধ্যে উক্ত, অনুক্ত মনের কাওতালি চলছিল, জয়দীপ নিবেদিতা গিয়েছিল বাবাকে হাসপাতালে থেকে নিয়ে আসতে। হাসপাতাল মানে বড় নার্সিংহোম। আচমকা ছুটি দিতে চেয়েছিল কিনা। হপ্তা জুড়েই অবস্থার বাড়তি কোনও অবনতি হয়নি। যদিও শরীরের ডান দিকটা পড়ে গেছিল, কথাবার্তাও স্বাভাবিক ‘নয়’। মাথায় জমাট রক্ত ওষুধে গলিয়ে দেয়, থেরাপির ওপর নির্ভরতা--- ওখানে অতিরিক্ত পড়ে থেকে মিছিমিছই বিল-এর মিটার বাড়ানো। বাড়িতেই লম্বা শুশ্রূষা, দিনরাতের আয়া রাখা, যত্ন-আত্তি ইত্যাদি। তবে ডাক্তার শেষ মুহূর্তে ‘কিন্তু’ বলায় রিলিজ হল না। তখন জোড়া ফ্ল্যাটে একমাত্র পাহারায় ছিল মা। নিবেদিতা দশবছরের ছেলে মাধবকে অবধি টেনে নিয়ে গেছল। শ্বশুরকে জয়দীপের সঙ্গে পাঠিয়ে, নিবেদিতা টুকিটাকি কেনাকাটা সেরে ফিরবে। মাধবকে সঙ্গে রাখার উদ্দেশ্য তাই।

একা ঘরে শান্তিসুধা কেবলই ঈশ্বরকে ডাকছিলেন ভালোয় ভালোয় মানুষটা ফিরে এলে হয়। ব্যাধির আসর গুরুত্ব ছেলে মা-কে জানায়নি। আচমকা ঘরে এসে, মার মুখে স্বস্তি আনবে। ডাক্তারের ‘কিন্তু’ এড়াতেই পারত জয়দীপ। ‘থাক না দুটো দিন!’ ডাক্তারের অনুরোধ ফেলেনি সে। হয়তো এটাকেই বলে নিয়তি।

সেই বিকেলে ‘শবনম’ অ্যাপার্টমেন্টে হঠাৎই সিঁড়ি জুড়ে দক্ষযজ্ঞ। চিৎকার, অভিযোগ, পাল্টা হুমকি ও হুঙ্কার কানে যেতেই, শান্তিসুধা ভাবছিলেন, ভাগ্যিস তার গুণবতী পুত্রবধূটি আজ বাড়ি নেই। যা ভয়ংকরী। বলা যায় না, হাত চালিয়ে দিতে পারে! অথচ, দুশ্চিন্তায় শান্তিসুধা বিছানা থেকে টের পাচ্ছিল না, কলহের বিষয়গুলো অতিসামান্য। তুচ্ছ খুবই।

অ্যাপার্টমেন্টের মূল পাম্প হঠাৎ বিগড়ে গেলে, যত তৎপরতাই থাকুক, ফের সচল হতে কিছু সময় লাগবেই। অথচ, গেরস্তদের জীবনযাত্রায় জল খুবই জরুরি। কিচেন থেকে বাথরুমে ফ্ল্যাশ্। জয়দীপের তৎপরতায় পৌরসভা একট্যাঙ্ক জল পাঠিয়েও দিয়েছে--- তবে সেটা দাঁড়িয়ে রাস্তায়। তিনতলা, চারতলায় ভর্তি বালতি বয়ে উপরে তুলতে কিছুটা চলকানো, সিঁড়ি ভেজা, পেছর হওয়া, পা হড়কানোর শঙ্কা, কার ভাগের বালতি কতটুকু অপরাধের জন্য দায়ি--- এক কথা, দু-কথা, ঘুরিয়ে টিজ্‌, বাঁকা কথার ইঙ্গিতে ফুলকি ছুটে আগুন জ্বলতে কতক্ষণ! সঙ্গে সঙ্গে এলোমেলো বাদানুবাদের উত্তাপ।

সুলেখা, রুবি আর অঞ্জু—কেউ কোমরে আঁচলগুঁজে, কারও বা ম্যাক্সি হাঁটু অবধি তোলা--- এমনকি, চারতলার লম্বা পাকাচুলের হিন্দুস্থানি কত্তাটি পর্যন্ত . . .!

ওদের ভাষায় নিজেদের মধ্যে বলে কিনা, চুঁহে কি পিঞ্জরা!

ইঁদুরের খাঁচা। উদ্দেশ্যটি খুবই অপমানকর। ভাগ্যিস, তিনমহিলা হিন্দিভাষায় তেমন সড়োগড়ো নয়। ইঁদুর-ছুঁচো বললে, কার না রাগ হয়? বুঝতে পারলে, নির্ঘাৎ তেড়ে আসত।

কান্তিবাঈ দরজা বন্ধ করে স্বামীকে ছাদে টেনে নিয়ে গিয়ে ধমকেছিল মৃদু, তুমি কেন ওদের গন্দা বাত বলতে গেলে?. . . সিঁড়ি দিয়ে এখন নামতেই বা গেলে কেন? . . . মজুত যা পানি আছে আমাদের, দিব্যি চলে যেত!

শুধু আঙুল তুলে শাসানো, গলা ফুলনো কি ভাষাশব্দের যত কিছু ফাউল ও বিকৃতি উগরে দেওয়া নয়, আচমকা সুলেখা কামড়ে দিল রুবির হাত এবং রুবি অঞ্জুকে ধাক্কা দিতে, অঞ্জুও সজোরে রুবির কান মুচড়ে দিতে ছাড়েনি। এবং ব্যাপারটা এটুকুতেই মিটে গেলে সামাল দেওয়া যেত! মেয়েলি ঝগড়া বলে কথা!

নিজের ফ্ল্যাটে বেডরুমে অবনীশ উত্তেজিত হতে হতে, হঠাৎ বেরিয়ে এসে রুবির হয়ে অঞ্জুর গোলগাল হাতটা ডলে দিয়ে, নিতম্ব ধরে জোরসে ঠেলে দিয়েছিল। হাঁটার ছন্দে অঞ্জুর যেবিশেষ স্থানটি এ বলে আমায় দ্যাখ ও বলে আমায়! আর যায় কোথায়? দাবানল!

গুন্ডাদমন শাখার করণিকটি সোজা থানায়। এফ.আই.আর। শ্রেণিস্বার্থে তৎপরতায় থানা থেকে পুলিশ। অবনীশের গা ঢাকা। রুবি অঞ্জুর হাতে কর্নদলন খেলেও, স্বামীর প্রতিবাদের গোপন উদ্দেশ্যটি চোখ এড়ায়না। ভীষণ চটে গিয়েছে।

সে-বিকেলের এইসব ঝড়-ঝঞ্ঝার ফাঁকে অবনীশ ফেরার। রাতেও ফিরল না। প্রহর গড়িয়ে গেলে মধ্যরাতে ‘শবনম’ অ্যাপার্টমেন্টের অনেক উঁচুতে অজস্র তারা-নক্ষত্রের ফুলফোটা গগনমণ্ডল দেখে মনে হয়নি, এরই নিচে এতসব কাণ্ড ঘটেছিল কিছু আগে। এখন ঊর্ধ্বে ঝরে পড়া উল্কার খেলা। আর সকলের ফ্ল্যাট কোলাপসিবল আঁটা, দরজায় ল্যাচ্‌ বন্ধ।

কয়েকদিন পেরিয়ে, আজ এই মুহূর্তে জয়দীপ কান থেকে ফোনের হাতটা সরিয়ে নিচে উঁকি দিতেই দেখে রজনীগন্ধার স্টিক সাজানো কাচের গাড়িটা। সঙ্গে ভাড়া করা দুই যুবক। হঠাৎ কান্নার রোল। নিবেদিতা লুটিয়ে পড়ে। শান্তিসুধাকে কোনক্রমে জড়িয়ে ধরে ছেলে এরপর শেষবারের মতো উঁকি দেওয়ালো। উনি কেবল নীরবে কাঁদলেন, শব্দ হল না।

আশপাশের বাড়িগুলো থেকে দু-চারজন পুরনো মানুষ কাচে উঁকি দিয়ে, চুপচাপ চলে গেল। কেউ কেউ খানিক তফাতে গিয়ে, প্রকাশ করতে থাকে, বুড়োর নাকি ইচ্ছে ছিল না বসতবাটি ভেঙে প্রমোটারের হাতে তুলে দেয়। জয়দীপই বাপের সেন্টিমেন্টকে পাত্তা দেয়নি। মৃত্যুর সঙ্গে এইসব কারণগুলোর কী সম্পর্ক বোঝা গেল না। কিংবা ওরা হয়তো কোনো গোপন রহস্য খুঁজে পেয়েছে!

এ-সময় ‘শবনম’ অ্যাপার্টমেন্টের বাকি সংসারগুলোর গতি স্বাভাবিক ও ঠিকঠাক। তিনতলায় রুবি এখন ফেরার অবনীশের সঙ্গে মোবাইলে পরামর্শ দিচ্ছিল। হঠাৎ বাইরে কাচের গাড়ির আওয়াজে নিবেদিতার শোকের কারণটি আন্দাজ করেছে।

তালে, তোর শ্বশুর পটকেছে! খুব ঝাল দেখাতিস! বেশ হয়েছে! বসে বসে বুড়োর পেনশন খেতিস! . . . এখন কলা চুষবি!

নিজের ছ’বছরের মেয়েটাকে ডেকে ফিসফিসিয়ে বলে, যা তো মামন! বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে টা-টা করে দে!

মামন তৎক্ষণাৎ ছুট্টে গিয়েও থমকে যায়। কাচের গাড়ির অর্থ বোঝে সে। হাঁ করে দেখতে দেখতে, আজ ঐটুকু বাচ্চা নতুন কিছু যেন আবিষ্কার করল। ফিরে মাকে চোখপাকিয়ে বলে, মাধবদার দাদু, জান মামনি . . .

বলেই চোখ উল্টে, জিভ বার করে হাত দুটো দুপাশে ছড়াবার অভিনয় করে। হঠাৎ কচি মেয়েটাকে ও-অবস্থায় দেখে রুবির বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। বকাঝকা করে। তবু ভেতরটা ঢিক্ ঢিক্।

অনেকবার নিজের কাছেই নিজের ক্ষমা ভিক্ষার বিপুল চেষ্টায়, উঠে গিয়ে বারান্দায় ঝুঁকে কপালে আঙুল ছোঁয়াবার আগেই রুবি লক্ষ্য করে—শুনশান! কিছু আগেই স্পটটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে।



ব্যাপক রোজ আর নীলিমার নীচে আজ আকাশ যেন মহৎ একটা জীবনের প্রার্থনা ব্যক্ত করে চলেছে।