ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক১৮
ফাইনহালস মার্চিং অর্ডারটা পড়তে থাকে।
‘এখনই!’ ফাইনহালস বলে… ‘এখনই… আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না!’ হাতে কাগজটা নিয়ে বলে ওঠে সে… ‘আমাদের দুজনের একইসঙ্গে মার্চিং অর্ডার… মানে একসঙ্গে’…
‘কেন? বোকা বোকা কথা বলবেন না!’ সার্জেন্ট চোখ সরু করে তার দিকে তাকিয়ে আলতো করে বলে ওঠে।
‘কটার সময়?’ ফাইনহালস বলে।
‘সাতটায়,’ জবাব দেয় ওটেন। সে উঠে এরই মধ্যে কোমরে বেল্ট বেঁধে পিঠের বোঝা গুছিয়ে রেখে দিয়েছে সামনের টেবিলে।
সার্জেন্ট টেবিলের সামনে বসে ড্রয়ারটা টেনে বের করে ওটেনের দিকে তাকায়।
‘একসঙ্গে নাকি আলাদা আলাদা…’ অবজ্ঞার সুরে বলে ওঠে সে… ‘এতকিছু ভাবতে আমার বয়ে গেছে। একবার আমার হেপাজত থেকে বেরিয়ে গেলে আর আমার কোনো দায়িত্ব নেই।’… কাঁধ ঝাঁকায় সার্জেন্ট… ‘আমি লিখে দেব যে একজন বেরিয়ে গেছে। ব্যস!’
‘আমি এখনই আমার ব্যাগ নিয়ে আসছি।’ ফাইনহালস বলে ওঠে।
উপরে উঠে ইলোনাকে দরজা বন্ধ করতে দেখে সে করিডোরে থমকে দাঁড়াল। ইলোনা দরজার হাতলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নাড়ল একবার। পোশাকের উপরে ভারি কোট চাপিয়েছে, মাথায় টুপি, হাতে ফাইনহালসের কিনে আনা সেই কেকের প্যাকেট। ফাইনহালসের মনে হল এই পোশাকে তাকে একদম অন্যরকম, একটু ভারিক্কি দেখাচ্ছে। কিন্তু যখনই সে মুখ ফিরিয়ে তাকাল, তার ঘাড় আর গলার রেখা দেখে সে এমনকিছু একটা অনুভব এলো তার মনে, যা অতীতে কোনো মেয়েকে দেখে জেগে ওঠেনি তার মনে। সে কি ভালবেসে ফেলেছে ইলোনাকে? এক অদ্ভুত অধিকারবোধ জেগে উঠেছে তার মনে। ইলোনা দরজাটা ঠিক মত বন্ধ হয়েছে কিনা, সেটা পরীক্ষা করে দেখছে হাতলটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। তারপর হাঁটতে শুরু করলো সে করিডোর দিয়ে। ফাইনহালস দূর থেকে নিবিষ্টমনে দেখছিল তাকে। হঠাৎ চমকে উঠল যখন সে নিজেকে ইলোনার একদম সামনে আবিষ্কার করল; ইলোনা তার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে।
‘আপনি অপেক্ষা করবেন বলেছিলেন…’ সে বলল।
‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম একটা জরুরি কাজ। আমি নিচে আপনার জন্য লিখে রেখে যেতাম যে আমি এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরব।’ ইলোনা জবাব দিল।
‘আপনি সত্যি ফিরে আসতেন?’
‘হ্যাঁ’… ইলোনা মুচকি হাসে তার দিকে তাকিয়ে।
‘আমিও আপনার সঙ্গে যাবো,’… সে তড়িঘড়ি বলে ওঠে… ‘এক মিনিট অপেক্ষা করুন।’
‘আপনি যেতে পারবেন না। নাহ, দয়া করে আসবেন না আমার সঙ্গে…’ ইলোনা অদ্ভুতভাবে মাথা ঝাঁকায় … ‘আমি ঠিক ফিরব।’
‘কিন্তু আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?’
ইলোনা জবাব দেয়না। চারপাশে তাকায়। যদিও করিডোরটা একদম ফাঁকা, তবুও সে চারদিকে দেখে। এখন ডিনারের সময় হয়ে গেছে। ঘরগুলোর ভেতর থেকে একটা অস্ফুট গুঞ্জনের মত শব্দ ভেসে আসছে।
ইলোনা আবার তার দিকে তাকায়… ‘ঘেটোতে’ সে বলে ওঠে … ‘আমাকে আমার মায়ের সঙ্গে ঘেটোতে যেতে হবে।’ … বলে একদৃষ্টে সে তাকায় ফাইনহালসের দিকে।
‘কিন্তু… আপনি ওখানে গিয়ে কী করবেন?’
‘আমার আত্মীয়স্বজন অনেকে আছে সেখানে। তাদের কিছু জিনিসপত্র দিতে যেতে হবে সেখানে। এই কেকটাও তাদের দিয়ে আসব।’ সে কেকের প্যাকেটটা ধরে ফাইনহালসের দিকে দেখায়… ‘আশা করি আপনি ভীষণ মনঃক্ষুণ্ণ হবেন না যদি আমি অন্য কাউকে এটা খেতে দিই!’
‘আপনার আত্মীয়স্বজন!’ ফাইনহালস এগিয়ে এসে ইলোনার হাত চেপে ধরে।
‘ছাড়ুন… যেতে দিন আমায়।’
ফাইনহালস ইলোনার সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে চাতালে দাঁড়ায়। কিন্তু চেপে ধরে থাকে তার হাত।
‘আপনার আত্মীয়স্বজন সবাই ইহুদী? আপনার মা?’
-‘হ্যাঁ। সবাই। আমিও… আমরা সবাই ইহুদী।’… ইলোনা ঘুরে দাঁড়ায়। … ‘এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন।’… ইলোনা হাত ছাড়িয়ে নেয়। মেরিমাতার মূর্তির সামনে রাখা ফুলদানি থেকে মূর্ছিত ফুলগুলি সাবধানে বেছে সরিয়ে নেয়। …‘আমাকে কথা দিন যে এই পাত্রে জল বদলে দেবেন। আমি আগামীকাল আসব না। আমাকে স্কুলে যেতে হবে। কথা দিন আমায়… সম্ভব হলে ফুলও বদলে দেবেন। কেমন?’
-‘আমি কথা দিতে পারছি না। আমায় আজ রাতের মধ্যেই চলে যেতে হবে। নয়তো…’
‘নয়তো আপনি আমায় কথা দিতেন?’
সে মাথা নাড়ে… ‘হ্যাঁ। আপনাকে খুশি করবার জন্য যেটা বলতেন করে দিতাম।’
‘শুধু আমাকে খুশি করবার জন্য?’ ইলোনা বলে ওঠে।
-‘আমি জানি না… করতাম ঠিকই!’ সে হাসে। তারপর গম্ভীর হয় … ‘তবে কিছু করবার সুযোগ পেলাম না।’ সে তীব্র উচ্চারণে বলে ওঠে।
তিনতলায় নেমে আসে তারা। ফাইনহালস একছুটে দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে ছড়ানো ছিটানো জিনিসপত্র তুলে নিয়ে ঠেসে দেয় নিজের পিঠের ন্যাপস্যাকে। তারপর বেল্ট বেঁধে দৌড়ে বেরিয়ে আসে বাইরে। ইলোনা ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে থমকে দাঁড়িয়ে আছে ১৯৩২ সালের ব্যাচের ছবিটার সামনে। তাকে চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছে।
‘কী হয়েছে?’ ফাইনহালস প্রশ্ন করে।
‘কিছু না’… সে শান্তভাবে জবাব দেয়… ‘আমি এই ছবিটার সামনে এসে স্মৃতিবিলাসী হতে চাই। কিন্তু পারি না। এই ছবিটা আর সেভাবে আমায় স্পর্শ করেনা। সম্পূর্ণ অচেনা ঠেকে সবকিছু আমার কাছে।’
‘চলুন এগিয়ে যাই!’
নারীটি দরজার বাইরে অপেক্ষা করবে কথা দিল। পুরুষটি দৌড়ে গেল অফিসে। হাতে নিল মার্চিং অর্ডার। ওটেন এর মধ্যে বেরিয়ে পড়েছে। সার্জেন্ট ফাইনহালসের জামার হাতা ধরে টানল… ‘কোথাও কোনো মুর্খামি করবেন না!’ বলে উঠল সে, ‘আমার শুভেচ্ছা জানবেন!’
‘ধন্যবাদ!’ বলে ফাইনহালস দৌড়ে বেরিয়ে এল। ইলোনা রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। সে তার হাত ধরে শহরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। কিন্তু বাতাসে একটা আর্দ্র ভাব, মিঠে সোঁদা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। তারা বড় রাস্তার সমান্তরালে শহরের ভিতরের শান্ত অলিগলি দিয়ে হাঁটতে লাগল। গলিগুলির পাশে ছোট ছোট বাড়িগুলির সামনে সাজানো বাগান।
‘এটা কী ভাবে সম্ভব যে আপনি এখনও ঘেটোর বাইরে আছেন?’ সে প্রশ্ন করল।
‘আমার বাবার জন্য। আমার বাবা সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন। যুদ্ধে উচ্চসম্মান পেয়েছেন। দুটো পা হারাতে হয়েছে তাকে। কিন্তু তিনি গতকাল তার সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছেন শহরের সেনাধক্ষ্যের কাছে। সম্মান আর তার নকল পা, দুটোই বিশাল পার্সেল করে ফেরত পাঠানো হয়েছে।’ হঠাৎ ইলোনা তীব্রভাবে বলে… ‘আপনি চলে যান এখনই!’
‘কেন?’
‘আমি একা বাড়ি ফিরতে চাই।’
‘আমি সঙ্গে যাব।’
‘অসম্ভব। অর্থহীন কথা বলবেন না। আমার পরিবারের কেউ যদি আপনাকে দেখে’… ইলোনা তাকায় ফাইনহালসের দিকে… ‘তার পর আমি আর বেরতে পারব না ঘর থেকে।’
‘আপনি ঘুরে ফেরত আসবেন?’
‘হ্যাঁ’ সে শান্তভাবে উত্তর দেয়… ‘অবশ্যই। কথা দিলাম।’
‘একটি চুম্বন! একবার…’ পুরুষটি বলে।
নারীটি থমকে দাঁড়ায়। মুখ লাল হয়ে ওঠে তার। পথঘাট শূন্য, চুপচাপ। একটা দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় তারা। মূর্ছিত কিছু বেরি গাছের শাখা তাদের স্পর্শ করে।
‘চুম্বন… কেন?’ নারীটি নরমভাবে প্রশ্ন করে তাকায় তার দিকে। ফাইনহালসের মনে হচ্ছিল যে ইলোনা এখনই কান্নায় ভেঙে পড়বে… ‘আমি ভালবাসায় ভয় পাই!’
‘কেন?’ পুরুষটি মৃদুস্বরে জানতে চায়।
‘কারণ… অল্প কয়েকটা মুহূর্ত ছাড়া ভালবাসার কোনো অস্তিত্ব নেই।’
‘অল্প কয়েকটা মুহূর্ত ছাড়া সময়ও তো নেই আমাদের কাছে।’ সে নরমভাবে বলে, মাটিতে নামিয়ে রাখে পিঠের বোঝা। ইলোনার হাত থেকে প্যাকেটটা সরিয়ে নিয়ে রাখে তার বোঝার উপরে। তারপর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয় তারা। কানের লতিতে, কণ্ঠে সে চুম্বন করে নারীকে। নারীও তার গালে এঁকে দেয় ভীরু চুম্বন।
‘যেও না’… পুরুষটি ফিসফিস করে… ‘ছেড়ে যেও না আমায়। যুদ্ধের সময় বেশি এদিক ওদিক যাওয়া ঠিক নয়। থাকো, থাকো আমার কাছে।’
সে মাথা নাড়ে… ‘আমি পারব না। আমায় যেতেই হবে। আমার মা ভয়ে মরে যাবেন যদি আমি সময় মত না ফিরি।’
সে আবার তার গালে চুম্বন আঁকে এবং লক্ষ্য করে যে তার খুব ভালো লাগছে।
‘যেও না!’ পুরুষটি আবার বলে ওঠে।
ইলোনা তার কাঁধে মাথা রাখে। ঠোঁটের কোণে চুম্বন দেয় তাকে এবং অনুভব করে যে এই মুহূর্তগুলো খুবই উপভোগ্য হয়ে উঠছে তার কাছে।
বারবার চুম্বন করে তারা। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। নারীটি চিরকাল ভেবে এসেছে যে স্বামী, সন্তান সবকিছু নিয়ে পরিপূর্ণ সংসার হবে তার। সে চিরকাল সবকিছু নিয়ে সাজানো সংসারের কথা ভেবেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে সংসার, বাচ্চাকাচ্চা এসব কিছুই ভাবছে না। না, ভাবছে না। সে আবার পুরুষটিকে চুম্বন করছে আর ভাবছে যে আদৌ কি তাদের আবার দেখা হবে! এই ভাবনাটা তাকে ভালো লাগার সঙ্গে সঙ্গে আবার বিষণ্ণ করে তুলছে।
‘ছাড়ো’… সে ফিসফিস করে… ‘সত্যিই যেতে হবে আমায়… ‘
পুরুষটি নারীর কাঁধের উপর দিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। চারপাশ নিস্তব্ধ। রাজপথের কোলাহল দূর থেকে আবছা গুঞ্জনের মত শোনাচ্ছে। পথের ধারের গাছগুলি কেটে ছেঁটে ছোট করা। তার গলার উপরে ইলোনার হাতের স্পর্শ অনুভব করছে সে। হাতটা কত ছোট, অথচ একইসঙ্গে দৃঢ় এবং নরম।
‘যেও না।‘ সে বলে ওঠে… ‘থাকো, কিম্বা আমাকে যেতে দাও তোমার সঙ্গে। যা হয় হবে। তোমাকে একা ছাড়তে মন চাইছে না আমার। তুমি যুদ্ধ কেমন জিনিস, জান না। যারা এই যুদ্ধটা নির্মাণ করেছে, তাদেরও জান না। এক মুহূর্ত একা থাকা নিরাপদ নয় এখন, যদি না খুব প্রয়োজন হয়।’
(চলবে)