Next
Previous
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in





কোভিড আবহের মধ্যে যেদিন থেকে স্কুলগুলোয় অনলাইন ক্লাস চালু হল আমার মনে হল আমিও দ্বিতীয় বারের জন্যে ছাত্র জীবনে প্রবেশ করলাম। আবাসনের আশপাশের ফ্ল্যাটে রোজ সকালে শুরু হয়ে যায় ক্লাস। একটা স্কুলে ঢুকলে যেমন চারিদিক থেকে নানা শ্রেণিতে পড়ানোর আওয়াজ আসে কানে সেরকম বিভিন্ন ফ্ল্যাট থেকে ক্লাসে টিচারদের পড়ানোর শব্দ ভেসে আসে। কয়েকজনের কম্পিউটারে সাউন্ড বক্সের আওয়াজ বেশি থাকায় আমার এই অবসর ও নিঃসঙ্গ জীবনে কর্ণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমিও প্রবেশ করি ক্লাসরুমে। এক এক দিন একেকটা ক্লাসের পাঠে মনোনিবেশ করি। পৃথিবীটা অ্যাকচুয়াল থাকলেও মানুষের জীবন যাপন ভার্চুয়াল। ফুল পাখিদের মত আর কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম হয় না। সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে এক অদৃশ্য ভাইরাস। আর তার মধ্যেই সব কিছু মেনে নিয়ে সকালের সময়টুকু আনন্দময় করে তুলতে আমার বিভিন্ন ক্লাসে যোগ দেওয়া। মন্দ তো নয়ই, বরং ভালো, অতি ভালো। এ যেন এক অন্য ছাত্রজীবন, অদৃশ্য অথচ সুখশ্রাব্য। শ্রবণেই কল্পনা করে নিই ক্লাসরুমের দৃশ্য। প্রথমে কলরব, তারপরেই শিক্ষক/শিক্ষিকার প্রবেশ, সমস্বরে ‘গুড মর্নিং স্যার/ম্যাডাম’। ইংরেজি-মাধ্যম স্কুল, আদবকায়দাও সেইমত। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতার বাইরে। প্রায় দিনই কোন ছাত্র বা ছাত্রীর জন্মদিন পালন; সমবেত গান ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’, আবহে পিয়ানোর মধুর ধ্বনি। গান শেষে শুভেচ্ছা জানানোর পালা। টিচারের জন্মদিনে বেশ মজা লাগে ছাত্রছাত্রীদের একাধিকবার উইশের বহর দেখে। এরপর শুরু হয়ে যায় ক্লাসের পড়াশোনা। টিচারের আগ্রহের সাথে পড়ানো, ছাত্রছাত্রীদেরও ততোধিক আগ্রহ প্রকাশ পায় প্রশ্নোত্তরে। একেকটি ছাত্র এত সুন্দর টিচারের প্রশ্নের উত্তর দেয় খুব আনন্দ পাই। আমি ছাত্র হয়েই শিখে নিই। মাঝেমধ্যে কোন ক্লাসে গান হয়। প্রথমে পিয়ানো সহযোগে একটা বা দুটো ইংরেজি গান, তারপর বাংলা মূলত রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গান। গান শেখানোও হয়। কয়েকজন ছাত্রছাত্রী সুরেলা গলায় সুন্দর গান গায়। আমিও ওদের সাথে গেয়ে উঠি। সকালগুলো সার্থক হয়। আমাদের মফঃস্বল স্কুলে সমবেত জাতীয় সংগীত ছাড়া গানের ক্লাস হত না, তাই ক্লাসে গানের অভিজ্ঞতা নেই। শোনা কথা, শহরে মিশনারি স্কুলগুলো ছাড়া হয়তো হাতে গোনা দু-একটা বাংলা মাধ্যম স্কুলে হত যেমন শান্তিনিকেতন, রবীন্দ্রভারতী, রামকৃষ্ণ মিশন এবং সেই ভাবাদর্শে প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলোয়। আমার এই ছাত্র জীবনের মেয়াদ শেষ হয়েছে এখন।

* * *

কোভিডের প্রথম ঢেউ দু বছর আগে যে আতঙ্কসমেত সমগ্র পৃথিবীর সাথে ভারতে এবং পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং জনজীবন প্রায় স্তব্ধ করে দিয়েছিল তার থেকে অনেকটা বেরিয়ে আসা গেছে। সতর্কমূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষেধক মানুষের মনে অনেকটা আস্থা জুগিয়েছে। মানুষ আস্তে আস্তে একধরনের নব্য-স্বাভাবিকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে খুব সতর্কতার সাথে। পশ্চিম গোলার্ধের কয়েকটা দেশের সরকার বেপরোয়া হয়ে স্কুল খুলে দিয়ে নির্বোধের মত কাজ করেছে তা তারা বুঝতে পেরেছে যখন কোভিডের থাবা শিশু-কিশোরদের আক্রমণ করে। ভারত সরকার কোভিড নিয়ে মাঝেমাঝে কয়েকটা অবৈজ্ঞানিকোচিত জনমোহিনী কাজকর্ম করলেও মোকাবিলা ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক এবং সংযমের পরিচয় দিয়েছে। সতর্ক পশ্চিমবঙ্গ সরকারও। পশ্চিম দুনিয়ায় স্কুল খোলার খবর আসা থেকেই কিছু মানুষ এ রাজ্যেও স্কুল খোলার জন্যে বিভিন্ন মাধ্যমে চর্চা শুরু করে দিয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল যদি রাজ্যে ভোট হতে পারে, ছেলেমেয়েরা রাস্তায়, মলে, দোকানে যেতে পারে, উৎসবে ভিড় জমাতে পারে তাহলে স্কুলে যেতে বাধা কোথায়। মনে রাখতে হবে কলকাতা শহরের জীবনটাই সমগ্র রাজ্যের চেহারা নয়। আমরা দেখেছি বিধানসভা ভোট এবং শারোদৎসবের পর সংক্রমণের হার বেড়েছে এবং পরে আবার অতি ধীরে তা কমেছে। অন্য কয়েকটা রাজ্যে ধাপে ধাপে স্কুল খুলে যাবার খবর আসাতে এখানেও স্কুল খোলা নিয়ে চর্চা আরও বেড়ে যায়। আবার অন্যদিকে কয়েকজন অভিভাবক চান নি তখনই, বিশেষত সন্তানদের প্রতিষেধক দেওয়ার আগেই স্কুল খুলুক। স্কুলে পড়ুয়াদের অনেকটা সময় একসাথে থাকতে হয়, তারা মেলামেশা করে, বন্ধুদের মধ্যে উচ্ছ্বাস এবং উল্লাসে তারা অসতর্ক হতে পারে। তারওপর অনেক ছাত্রছাত্রী স্কুলবাস, পুলকার বা নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করে না, অনেক দূর থেকে ট্রেনে, বাসে যাতায়াত করে। তাদের নিরাপত্তার কথাও ভাবার। মাসখানেক আগেও এমনই ভাবনা ছিল। এখন সেটা থেকে অনেকটাই মুক্ত। স্কুল খুলেছে, ধাপে ধাপে। এত কথা বলার উদ্দেশ্য – আমরা এখনও কোভিডমুক্ত হই নি, পরবর্তি ঢেউ আসার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। সতর্কবার্তা জারি আছে।

দু বছর ধরে এই কোভিড ভাইরাস নিয়ে ঘর করায় মানুষ এই রোগ নিয়ে অনেক অভিজ্ঞ হয়েছে। বিশেষজ্ঞ হবার দিন এখনও আসেনি। কোভিডের আক্রমণাত্মক চরিত্র বলে দিচ্ছে ভাইরাস যদি চলে আসে বাড়িতে এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে যাদের কোমর্বিডিটি আছে তারা গুরুতর আক্রান্ত হয় কারণ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় কোভিডের বাসা বাঁধায় সুবিধে হয়। আরও একটা বিষয় হল প্রথম ঢেউয়ের পর কয়েকটা জেলায় গিয়ে জেনেছিলাম গ্রামের দিকে আক্রান্তের খবর নেই। শহরের লোকজন নানা কারণে আক্রান্ত হলেও গ্রামের লোকেদের লকডাউন পর্বে শহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় সংক্রমিত হবার সুযোগ হয়নি যেটা পরের ঢেউয়ে আর রক্ষে করা যায়নি। পেটের টানে কাজ জোগাড়ের জন্যে তাদের শহরে আসতেই হয়েছে এবং সংক্রমিত হয়ে ফিরে গেছে। সচেতনতা এবং প্রতিষেধক সংক্রমণের ব্যপকতা রুখতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু স্কুল খুলতে গেলে যে সব সাবধানতা মানার কথা বলা হয়েছিল সেই পরিকাঠামো পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র নেই। শহরের কিছু স্কুল সেই ব্যবস্থা নিতে সমর্থ হলেও আর্থিকসঙ্গতি না থাকায় শহর থেকে গ্রামে অনেক স্কুলেই তা সম্ভব ছিল না। অনেক স্কুল বাড়ি ভেঙে গেছে, আসবাব নষ্ট হয়ে গেছে, যেটুকু পরিকাঠামো ছিল তা আগের মত আর নেই। এইসব প্রান্তিক স্কুলের অনেক ছাত্রছাত্রীই সংসারের অভাব মেটাতে, বিশেষ করে করোনাকালে অনেক অভিভাবকেরই নিয়মিত আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, তারা রোজগারের পথ বেছে নিয়েছে। ছোট ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় এবং বাড়ির আবহ সেইভাবে না থাকায় ভাষা, অঙ্ক ইত্যাদির মত বিষয়গুলো ভুলে গেছে। তাদের আবার নতুন করে মনে পড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব শিক্ষকদের। গ্রাম থেকে শহরে সমাজে আর্থিক ব্যবস্থার সার্বিক অবনতি অভাবগ্রস্ত ছেলেমেয়েদের স্কুল-বিমুখ করে দেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবু কিছু ছেলেমেয়ের পড়ায় প্রবল আগ্রহ। পুরোপুরি খোলার আগে দেখা গেছে কিছু শিক্ষক গাছের তলায় ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন।

অস্তমিত কোভিডের আতঙ্ককে সরিয়ে সবরকমের সাবধানতা অবলম্বন করেই স্কুল খুলেছে। শহরের চিত্রটাই সব নয়, প্রান্তিক ছেলেমেয়েদেরও সমান অধিকার শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার আর সেই দিকে নজর রেখেই ধাপে ধাপে এগিয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা আবার আগের মত স্কুলে যাক। সন্তানেরা সামাজিক হয়ে উঠুক, বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে মানসিক বিকাশ লাভ করুক, যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে প্রায় দু বছর কাটিয়েছে তার থেকে স্বশিক্ষিত হোক সামাজিক দায়বদ্ধতায়। এর সাথেই ভাবতে হবে যারা বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন তাদের কথাও। দীর্ঘদিন গৃহবন্দি অবস্থায় অনেকে মানসিক বিপর্যস্ত। অনলাইন ক্লাসে তাদের আবেগ সব সংযমের বাঁধ ভেঙে অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছে। যে আবহে তারা স্কুলে মানব-দরদী আন্টি-আঙ্কেল এবং সহায়কদের আদর-যত্ন পেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, বন্ধুদের সাথে হাসি-কান্না ভাগ করে নিত, একটা নিয়ম এবং শৃঙ্খলতার মধ্যে দিন কাটাত সেটা নষ্ট হয়ে ঘরে আবদ্ধ জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে যা তাদের ব্যবহারিক চরিত্রের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। অনেকেরই মনোবিদের পরামর্শ ও চিকিৎসার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তাদেরও আবার আগের জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। এটা একটা বড় সমস্যা এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এইসব ছেলেমেয়েরাও আবার আস্তে আস্তে স্কুলে যেতে শুরু করেছে।

* * *

এবারে আমায় একটু বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। এতক্ষণ যা কিছু লিখলাম দুবছরের প্রায়ান্ধকার স্কুল এবং পারিপার্শ্বিক জীবনের অংশ মাত্র। কোভিড মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে তিন ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। কোভিড-পূর্ব জীবন যা জানা আছে। কোভিড-কাল সম্বন্ধে কিছুটা জানলেও এখনও অসম্পূর্ণ। হোঁচট খেতে হচ্ছে কারণ এই যুগের অবসান হয়েছে কি না তা নিশ্চিত নয়। আর কোভিডের পরের জীবন কী হতে চলেছে তার আন্দাজ খুব সামান্য হলেও বোঝা যাচ্ছে। স্কুল জীবন নিয়েই কথা যখন চলছে তখন সেইটাই আলোচনার প্রধান বিষয় হোক। কিভাবে শিশু-কিশোরের শরীর ও মনের স্বাস্থ্যের ওপর আঘাত হেনেছে তার কিছুটা আলোচনা করা দরকার।

প্রায় দুটো শতাব্দী ধরে যারা স্কুলে গিয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছে তারা একটা প্রাচীর ঘেরা নির্দিষ্ট চার দেয়ালের মধ্যে স্কুল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। সেখানে ছিল কিছু নিয়ম, শৃঙ্খলা, আচার, সময়ানুবর্তিতা; ছিল নির্দিষ্ট শ্রেণি হিসেবে পাঠ্য পুস্তক, খাতায় লেখার চর্চা, শিক্ষকের শিক্ষাদান, পড়ানো এবং ছাত্রদের শিক্ষাগ্রহণ, নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদের শিক্ষিত হওয়ার মূল্যায়ন; ছাত্রদের মধ্যে মেলামেশা, খেলাধুলা, শারীরচর্চা, হাতের কাজ শেখা, সামাজিক হওয়া; মতান্তর, তর্ক-বিতর্ক, রাগ, মান, অভিমান, হিংসা, ঝগড়া, মারামারি, বন্ধুতা, স্নেহ, মায়া, মমতা, সেবা। আরও হয়তো অনেককিছু আছে যা ছাত্রজীবন ভবিষ্যতের সম্পূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে, মানবিক করে তোলে। সময়ের সাথে এসবের প্রকার বদলেছে, ব্যবহারিক চরিত্র পরিবর্তন হয়েছে, স্কুলের প্রকারভেদে ছাত্রদের মানসিক গঠন এক থাকেনি। কিন্তু ছাত্রদের মধ্যে কেউ ভাল কেউ দুষ্টু বা খারাপ থাকলেও কোথাও একটা অদৃশ্য সুতোর বাঁধন থেকে গেছে। পৃথিবীর বুকে নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় মানুষকে বিপর্যস্ত করেছে। মনুষ্যকৃত মহামারি, যুদ্ধের মত নানাবিধ কাজ মানুষের অগ্রগতিকে মাঝেমাঝে থমকে দিয়েছে। প্লেগ, কলেরা, বসন্ত, ডেঙ্গুর মত অসুখ লক্ষ লক্ষ লোকের জীবনহানি করেছে। কিন্তু কোভিড ভাইরাসের মত একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য মানুষের জীবনকে পৃথিবীব্যাপী স্তব্ধ করে দিতে পারেনি এর আগে। জলের নিচে যেমন ক্রমাগত পলি জমতেই থাকে, কখনও বেশি আবার কখনও কম সেরকমই চলছিল। কিন্তু এই পলি আসাটাও কোন এক প্রাকৃতিক কারণে বন্ধ হয়ে যায়। একটা সময়ের ব্যপ্তি থাকে যখন কোন পলি জমা হয় না। আবার সেই সময় শেষ হলে পলি আসে, জমা হয়। এই পলিহীন অন্তর্বর্তী সময়কে বলা হয় আনকনফর্মিটি বা অসঙ্গতি। সদা চলমান সময় এখানে হারিয়ে যায়। মানুষের জীবনেও এই সময়টা সেই অসঙ্গতি, যেন কিছুটা সময় কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে। মানুষ এমন নিঃসঙ্গ এর আগে কখনও হয়েছে কিনা জানা নেই, হয়তো ডেঙ্গু, কলেরা এবং প্লেগের সময় কিছুটা তাও নির্দিষ্ট কিছু জায়গায়, এরকম সর্বনাশী বিশ্বব্যাপী নয়। প্রত্যেকটা মানুষ যেন একেকটা দ্বীপ। পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, সন্দেহ মানুষকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। সামাজিক দূরত্ব মানসিক দূরত্বের কারণ হয়েছে। শঙ্খ ঘোষের সেই বিখ্যাত উক্তি “বেঁধে বেঁধে থাকা”র বন্ধনটাই আলগা হয়ে গেছে।

সময় হিসেবে শুনতে দু বছর, মনে হতেই পারে কি আর এমন। কিন্তু মনে রাখতে হবে শিশু ও কিশোর বয়সীদের এই দু বছর মানসিক গঠনের দিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ, ভিত গড়ে ওঠার সময়। একেবারে ছোট থেকে শুরু করা যাক। শৈশবে প্রাথমিক শিক্ষা আসে বাড়ির আপনজনদের থেকে, মানে মা-বাবা ও অন্যান্য পরিজনদের থেকে। করোনাকালে যে শিশু বেড়ে উঠছে তাদের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা যে তারা ঘরের বাইরে বেরোতে পারেনি। এইসময় সামাজিক হতে শেখে শিশুরা, সেখানে বাধা পেয়েছে। প্রাকৃতিক বস্তুজগতের সাথে পরিচয় হয় নি। পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের সাথে যোগসূত্র স্থাপন হয়নি। গরুর ডাক শুনলেও গরু দেখেনি, পাখির কিচিরমিচির শুনে আনন্দে খিলখিল হাসলেও পাখিটাকে দেখেনি। গাছের সাথে পাতা ফল ফুলের সম্পর্ক শেখা হয়নি। রাস্তা, নানা রকমের গাড়ি নাগালের বাইরে। এতকিছু বলার উদ্দেশ্য, যে সময় ইন্দ্রিয়গুলো প্রবল ক্ষমতাশীল, মানুষের মস্তিষ্ক সবচেয়ে দ্রুত ও বেশি তথ্য গ্রহণের ক্ষমতা থাকে সেটায় সাংঘাতিক ব্যহত হয়েছে ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশে এটা অন্তরায় হবার সম্ভাবনা প্রবল। এইসময় তথ্য সংগ্রহের সাথে তার প্রয়োগও করে শিশুরা যখন মস্তিষ্কে যুক্তির খেলা চলে, মস্তিষ্কের নিউরনগুলো প্রবল সক্রিয় থাকে, বুদ্ধি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। নির্দিষ্ট পরিসরে ইচ্ছেমত ছোটাছুটি করা সম্ভব না হওয়াটাও অন্যতম বাধা যা শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিকে সম্পূর্ণ করে না। বাড়ির ভেতরে থাকার ফলে অন্তর্মুখী হওয়াটাও সম্ভব। এ তো গেল দু-আড়াই বছর পর্যন্ত বয়সের শিশুর কথা। এর থেকে যারা বড়, যাদের প্রি-স্কুলে যাবার সময় তারাও বসে রইল ঘরে, মেলামেশা, বন্ধু, রঙিন শিক্ষামূলক খেলা ও খেলনা, মা বাবা ছাড়া অন্য অপরিচিতদের সাহচর্য ও আপন করে নেওয়ার শিক্ষা, প্রাথমিক অক্ষর ও সংখ্যা জ্ঞান ইত্যাদি অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল। যারা সবে স্কুলে ঢুকেছিল তারা বন্ধুদের হারিয়ে ফেলল। অনেকের স্মৃতির কোটরে জমা হল শুধু অন্তরিন আতঙ্কের ছবি। আনন্দ নেবার প্রধান উৎস হল মোবাইল ফোন। অনেক বাড়িতে হয়ত অভিভাবকেরা যত্ন নিয়েছেন এবিষয়ে কিন্তু স্কুল পরিবেশই মনে হয় শিশুরা স্বচ্ছন্দ বোধ করে। শহর এলাকায় যদিও বা কিছু হয়, মফঃস্বলে তার কম আর গ্রাম্যজীবনে এগুলো স্বপ্ন।

* * *

জন্মের সময় মানুষের মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ তৈরি থাকে না এবং জন্মের পর থেকে সময়ের সাথে লক্ষ লক্ষ মস্তিষ্কের কোষ তৈরি হয় যা তার নির্দিষ্ট কাজের জন্যে তৈরি, পুষ্টি ও বৃদ্ধি হয়। প্রতিটা কোষের কাজ ‘প্রি-কোডেড’। এরকম ভাবে বয়স ভেঙে ভেঙে দেখলে জানা যাবে যে প্রতিটা ক্ষেত্রে এই দু বছরে অনেকটা শূন্যতা সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা অথবা যে কর্মদক্ষতা হবার কথা সেটায় ঘাটতি রয়ে গেল। পরবর্তিকালে সেইসব কোষের অসম্পূর্ণ কাজ কতটা সক্রিয় হবে তা সময়ই একমাত্র উত্তর দেবে।

শ্রেণিকক্ষে পড়াশোনা শুরু হবার পর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নানারকম সমস্যা দেখা দিয়েছে যার কিছুটা আগে বলা হয়েছে। শহর এবং শহরাঞ্চলের কিছু প্রতিষ্ঠিত শিক্ষায়তনে নিয়মিত অনলাইন ক্লাস হওয়ায় তাদের ক্ষতির পরিমাণ হয়ত পরিপূরণ করা সম্ভব কিন্তু প্রত্যন্ত এবং গ্রামাঞ্চলে বা শহরের অন্য সাধারণ স্কুলগুলোতে যেখানে পড়ুয়ারা আর্থিক বৈষম্যের শিকার সেখানে মূলত আর্থিক কারণেই অনলাইন ক্লাসের সুবিধে ছাত্রছাত্রীরা পায়নি। সেইসব স্কুলের শিক্ষকদের থেকে ছাত্রদের সম্পর্কে বিচিত্র তথ্য জানা যাচ্ছে। কেউ বর্ণমালা ভুলে গেছে, কেউ টানা পড়তে পারছে না, কেউ লিখতে ভুলে গেছে, কারোর লেখায় ডিসলেক্সিক প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে অর্থাৎ অক্ষরের মিরর ইমেজ। সংখ্যা চিনতে পারছে না এবং নামতা ভুলে গেছে। বলা হচ্ছে দীর্ঘদিন পড়ার অভ্যেস না থাকায় এইসব সমস্যা। হতে পারে যারা সবে স্কুলে ঢুকেছিল বা পড়া শুরু করেছিল। কিন্তু যারা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে তারা কী করে অক্ষরজ্ঞান হারায় বোঝা মুশকিল। অক্ষর বা বর্ণমালা আমরা শিখি ছবির মত করে। সেই ছবি স্থায়ী হয়ে যায় মস্তিষ্কে। এমনকি আমরা যখন বই ইত্যাদি টানা পড়ি তখনও শব্দগুলো ছবি করে পড়ি, বানান করে নয়। একসময় স্বাক্ষর অভিযান শুরু হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল সত্তর শতাংশ স্বাক্ষর হয়ে গেছে। পরে দেখা গেছে অনেকেই স্বাক্ষর করতে পারলেও অক্ষর জ্ঞান নেই। স্বাক্ষরটা ছবির মত নকল করতে শিখেছে। আসল কথায় ফেরা যাক। পঞ্চম শ্রেণিতে যারা এখন পড়ছে তারা তৃতীয় শ্রেণি অবধি স্কুলে পড়েছে অর্থাৎ অক্ষর জ্ঞান হয়ে যাবার কথা। খামতিটা কোথায় থেকে গেল সেটা গবেষণার বিষয়। এছাড়াও মাধ্যমিক পরীক্ষার খাতা দেখে পরীক্ষকদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পারছি। অতিমারি দেখিয়ে দিল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও পদ্ধতি কতটা গোলমেলে।

আমরা আর কখনো কোভিড-পূর্ব স্বাভাবিকতায় ফিরতে পারব কি না জানা নেই। ফিরলেও যেসব সন্তানেরা শৈশব ও কৈশোরের একটা মূল্যবান সময় হারিয়ে ফেলল তাদের যে কি ক্ষতি হল তা ভবিষ্যৎ জানাবে। তবে নব্য-স্বাভাবিক জীবন বলে যা প্রচার চলছে তার চেহারা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনও গভীর অন্ধকারে। আদৌ কিছু পরিবর্তন হবে কি না তাও ধোঁয়াশায় কারণ যেখানেই স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে সেখানেই মানুষের রিপুগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠছে। অতিমারিকালে প্রবীণ বয়সে ভার্চুয়াল ক্লাসে নব্য-শিক্ষা পদ্ধতি আমার শেষ হয়েছে তার জন্যে অবশ্য মনটা খারাপ লাগে।