Next
Previous
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in

১২

কথায় বলে না ভালোলোকের শত্রুর অভাব নেই।সুমন নানারকম অসুবিধা থাকলেও এদল ওদল করে না। টাকার লোভ তার নেই।আর এইসব গান বাজনার লাইনে রাজনীতি খুব বেশি।অনেকে ভালো শিল্পীকে নিয়ে টানাটানি করে।সুমন আর রূপসী বড় শিল্পী।তবু তারা মুরারী অপেরা ছাড়ে নি।মুরারী এখন ভালো ব্যবহার করে।আলকাপের দল খোলার পর থেকে লাভের অঙ্কটা হু হু করে বেড়ে চলেছে।তাই সে খুব খুশি।

সুমন এবার নেশা ধরেছে মদের।বাড়ির কথা মনে পড়ে তার।কিন্তু দল ছেড়ে সে থাকতে পারে না। তারপর বাড়িতে বাঁশি বাজাতে দেখলেই তার বৌ খেপে যায়।তাই অশান্তি করতে তার ভালো লাগে না। একবার তার বৌ বাঁশি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো।সেবার সুমন বৌকে একচড় মেরেছিলো ছেলের সামনে।মন খারাপ হয়েছিলো তারভাগীদার গণেশ হাজরা বলেছিলো,কাজটা আপনি ঠিক করেন নাই দাদাবাবু। সেবার গণেশকে বলে পালিয়ে এসেছিলো সুমন। এখন বাড়ি কম যায়।মাঝে মাঝে টাকা পাঠিয়ে দেয়।

 

দলে একটা নতুন মেয়ে এসেছে বিজয়া।মুরারীর সঙ্গে খুব মাখামাখি।একবার পুকুরে চান করতে গিয়ে বিজয়া সুমনকে চুমু খেয়েছিলো।বলেছিলো,কি গো নাগর। রূপসী ছাড়া আর কাউকে ভালো লাগে না। তোমার রস একদিন আমাকে খাওয়াও।সুমন এসব পছন্দ করে না। সে বললো,আর কোনোদিন আমাকে এসব বলবে না। রূপসীও আমাকে বিরক্ত করে না।

বকুনি শুনে ভিজে কাপড়ে পালিয়েছিলো বিজয়া।      তারপর অনেক দিন পরে একটা যাত্রার পালা করতে সুমনরা গেলো কোপা গ্রামে।সেখানে মেনকার বাড়ি।মেনকা বাড়ি এসেছে কয়েকদিনের জন্য।আর বন্ধুরা সবাই মিলে আয়োজন করেছে এই অনুষ্ঠানে। ঠিক রাত দশটায় কনসার্ট বেজে উঠলো।সুমনের বাঁশির সুরে মাতোয়ারা    হয়ে গেলো গ্রাম।

পালাশেষে  মেনকা সুমনের সঙ্গে আলাপ করলো। সে বললো,আমার এখন গবেষণার বিষয় এই, আড় বাঁশি।সুমন বললো,অনেক বড় হও মা। আমার তো বয়স হয়েছে।রূপসীও নেই।মরে গেছে।

মেনকা বল, কে এই রূপসী।

-----আমার ঘর বাঁধার স্বপ্নের পাখি।সে আমার সঙ্গে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলো।আমি পারি নি।

----কেন,পারেননি কেন?

----আমার বৌ বাচ্চা আছে তাই।

----ও বুঝেছি

----এই আড়  বাঁশির আড়ালে অনেক কান্ড ঘটে গেছে মা।

-----আপনি ঠিকানাটা দিন। একদিন আপনার বাড়ি যাবো। প্রণাম নেবেন।

তারপর সুমন কোপা ছেড়ে চলে এলো নিজের গ্রামে।এখন সবাই নতুন নায়ক নায়িকা। পুরোনো কেউ নেই।দল ছেড়ে এসে সে বাড়িতে বাঁশি বাজানোর শিক্ষা দিতে শুরু করলো।বহুদূর থেকে ছাত্র ছাত্রী এলো।  সুমন তার স্কুলের নাম রাখলো, মধুবনি 

শত শত শিক্ষার্থী এই মধুবনি থেকে বাঁশি বাজানোর শিক্ষা গ্রহণ করতে লাগলো।একদিন মেনকা এলো তার গবেষণার কারণে।এসেই খেনীদেবীর নজরে পড়লো সে।

তিনি বললেন,মা তোমার কোথায় বাড়ি।

----কোপা।

----তোমার বাবার নাম কি? 

-----কার্তিক মাঝি।

----ও তাহলে তুমি আমার পিসির গ্রামের দাদার মেয়ে।কোপার কার্তিক মাঝিকে আমি দাদা বলতাম ।যাওয়া আসা না থাকলে আপনজনও পর হয়ে যায় মা। এসো ঘরে এসো।

তারপর সুমন এসে তার জীবনের সমস্ত কথা বললো।মধুবনির স্বপ্নের কথা বললো।মেনকা বললো,আমি আপনার কাছে।

সুমন বললো,তোমার যতদিন খুশি থাকো।আমার মধুবনিকে দেখো।আরও অনেক তথ্য পাবে।

সুমনবাবুর ছেলে কালো, মেনকাকে দেখেই ভালোবেসে ফেলেছে।কিন্তু বলতে পারছে না।সুযোগ এসে গেলো।সুমনবাবু বললেন,কালো একবার মেনকাকে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাও।গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে কালোর সঙ্গে মেনকার পরিচয় হলো।মেনকা জিজ্ঞেস করলো,তুমি বাঁশি বাজানো শিখেছো।কালো বললো,বাবা আমাকে মায়ের আড়ালে সুর শিখিয়েছেন

-----কই বাজাও দেখি।

কালো বাঁশি বাজালো।এযেনো রাধার পোড়া বাঁশির সুর।মেনকা সুরের প্রেমে ধরা দিলো।সে বললো,আমিও এই সুর শিখবো,বাজাবো।

----নিশ্চয় শিখবে।বাজাবে।

তারা দুজনে বাড়ি ফিরে দেখে প্রচুর ভিড় মধুবনি স্কুলে।ছুটে গিয়ে তারা দেখলো, সুমনবাবুর ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ।কে বা কারা মাঠে তাকে মেরে পালিয়েছে।তিনি মাঠে যেতেন বাঁশি বাজাতে।বাঁশিটাও ভেঙ্গে দিয়েছে।মেনকা সুমনবাবুর কাছে শুনেছেন কে বা কারা যেনো তাকে মারার চক্রান্ত করছে।তার মধুবনি ধ্বংস করতে চাইছে।

পুলিশ এলো।তারা তদন্তের ভার নিলেন। 

সুমনবাবুর ছাত্র ছাত্রী সকলে কাঁধে করে শবদাহ করতে শ্মশানে গেলো।আগুনে বিলীন হলো নশ্বর দেহ। কিন্তু তার স্বপ্ন সফল করবে শত শত মধুবনির ছাত্র   ছাত্রীরা।

এমন একটা অঘটন ঘটে যাওয়ার জন্য মেনকা কালোর কাছে থাকলো অনেকদিন।এই বড় শোকে যে পাশে থাকে সেইতো আসল বন্ধু।কালোর মা বললেন,মেনকা তোমার মত একটা মেয়ে পেলে আমার জীবনে বাঁচার ইচ্ছাটা থাকবে।মেনকা বললো,একবার আমার বাবার সঙ্গে কথা বলবেন।তিনি বললেন,আমরা তোমাদের বাড়ি যাবো।

মেনকা আর কালো দুজনে      ঠিক করলো তারাই এই মধুবনির অপূর্ণ সাধ পূরণ করবে শত বাধা অতিক্রম করে।কালো বাঁশি বাজানো শেখাবে।আর মেনকা একটা গবেষণার গ্রন্থ প্রকাশ করবে।তার নাম দেবে,আড় বাঁশির আড়ালে।মেনকার গবেষণা তিন বছরে পড়েছে।আর এক বছরের মধ্যে পেয়ে গেলো পি এইচ ডি ডিগ্রি।এখন তার নামের আগে লেখে ডঃ,মেনকা বোস।

সুমনবাবুর মৃত্যুর দুবছর পরে কালো আর মেনকা বিবাহ  বন্ধনে আবদ্ধ হলো। ভালোাসার জয় হলো।কালো এখন একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক

ধীরে ধীরে মধুবনি সুরের আকাশে নক্ষত্রের জায়গা নিলো।