প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধ(৩য় পর্ব)
মহতাবচাঁদ ছিলেন ব্রিটিশভক্ত। ব্রিটিশভক্তি থেকেই তাঁর মহারাজাধিরাজ উপাধি লাভ। তাঁর সময় থেকেই বর্ধমান রাজপরিবারের অন্দরমহলেও চালু হয় ব্রিটিশ নিয়মশৃঙ্খল্লা, শিক্ষাদীক্ষা, নানান আদব-কায়দা ইত্যাদি। সেই সময় থেকেই রাজপরিবারের অন্দরমহলে সন্তানদের শিক্ষা দেবার জন্য একজন করে Nanny রাখার রেওয়াজ হয়। রাজপরিবারের নিয়মানুযায়ী রাজপরিবারে রাজকুমার বা রাজকুমারী জন্মগ্রহণ করলে এক একজন শিশুর প্রতি ছয় জন করে সাহায্যিকা বা সাহায্যকারিণী রাখার রেওয়াজ ছিল । এই সময় থেকেই এই ছয়জন সাহায্যকারিণীর উপরে আরো একজন করে ইংরেজ nanny রাখা শুরু হয়। এরা সাহায্যকারিণীদের শিক্ষা দিতেন কিভাবে বাচ্চাদের মানুষ করতে হবে, রাজপরিবারের নানান আদব-কায়দা শেখাতে সাহায্য করতেন। রাজপরিবারের নিয়মকানুন ছিল খুব কড়া। খাবার সময় ছিল এক নিয়ম, সারাদিনের জন্য ছিল আর এক নিয়ম, কে কিভাবে হাঁটাচলা করবে তাও শিখতে হত রাজকুমার-রাজকুমারীদের।
দুপুরের খাওয়া হত ভারতীয় তথা বাঙ্গালীদের মত মাটিতে আসন পেতে। রাত্রে হত ইংরাজি কায়দায় ডিনার, তখন খাওয়া হত চেয়ার-টেবিলে। একসঙ্গে খেতে বসতেন রাজা, রাণী, রাজকুমার, রাজকুমারীরা এবং অন্যান্য বয়োজ্যোষ্ঠরা। রাজা এবং রাণীর খাওয়া হয়ে গেলে উঠে দাঁড়াতে হত সকলকেই। একটা কথা বলে রাখা ভাল, এসব আচরণই শিখতে হত সেই বিদেশিনী nanny র কাছে এবং তা যে ইংরাজি আদব-কায়দা, সে কথা বলাই বাহুল্য। খাওয়া হয়ে গেলে অন্যত্র এসে সকলে মিলে বসতে হত মিনিট পনেরো। সামান্য কিছু কথাবার্তা, তারপর রাজা-রাণী ছেলেমেয়েদের অর্থাৎ রাজকুমার-রাজকুমারীদের একটি করে ‘চুমো’ দিতেন, তাঁরা শুতে চলে যেতেন nanny র সঙ্গে নিজের নিজের জায়গায়। সারাদিনে পিতা-মাতার কাছ থেকে এই একটিমাত্র চুমো খাওয়া ছাড়া আর কোনরকম সম্পর্ক শিশুদের ছিল না। কঠিন জীবন যাপন করতে হত। কোনোরকম emotion প্রকাশ করার উপায় ছিল না, করলে কঠিন শাস্তি পেতে হত। ভবিষ্যতের রাজা ও রাণীদের মনে পাছে কোনরকম দুর্বলতা মনের মধ্যে জন্মায়, তাই আচার, আচরণ, ব্যবহারে কোনরকম দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হত না। শিশুবয়স থেকেই তাঁদের এই শিক্ষা দেওয়া হত।
রাণীদেরও তাঁর নিজের সন্তানকে কাছে ডাকা, খেলা করা, কাছে থাকা এসবের নিয়ম ছিল না। এমন কি সন্তানদের অসুখ করলেও আগে রাজার অনুমতি, তারপর ডাক্তারের জন্য ফরমান বা আদেশপত্রে সাক্ষর এবং শেষে ডাক্তার ডাকার অনুমতি মিললে তবেই সন্তানের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হত। রাজকুমার-রাজকুমারীদের সারাজীবন কেটে যেত রাজবাড়ির চার-দেওয়ালের ভিতরেই। সেখানেও ছিল পদে পদে নিয়মের প্রহরা। যাতায়াতের পথে বড় এবং ছোট রাজকুমারদের নিয়ম মেনে চলতে হত, সেখানে কোনমতেই ছোট রাজকুমার বড় রাজকুমারের আগে পথ চলতে পারতেন না। এই নিয়মের জন্য এখনও ছোটো মহারাজকুমার বড় মহারাজকুমারদের আগে যেতে পারেন না, রাজপরিবারের নিয়ম তাঁকে মেনে চলতে হয় কিংবা বলা ভাল, সেই শিশু বয়স থেকে শেখা নিয়ম এখনও মেনে চলেন তাঁরা। আরো একটি বিষয় এখানে লক্ষ্য করার, তা হল ইংরাজি শিক্ষার প্রভাবে মহতাবচাঁদের সময় থেকেই বহুবিবাহ প্রথা রাজপরিবারে বন্ধ হয়ে যায়। মহারাজা মহতাব চাঁদ নিজেও দ্বিতীয় বিবাহ করেন প্রথমা পত্নী মারা যাবার পর। তার পর থেকে সকলেই একপত্নী গ্রহণ করেছেন। রাজপরিবারের মহিলা বিশেষতঃ রাজবধূদের আরো একটি শিক্ষণীয় ব্যাপার ছিল। তখন বর্ধমান রাজপরিবারে বধূ হয়ে যাঁরা আসতেন এত অল্প বয়সে তাঁরা এখানে আসতেন যে তাঁদের একরকম এখানেই মানুষ হতে হত। কিন্তু রাজপরিবারে তাঁরা একবার এলে আর নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারতেন না। কিন্তু অত বালিকা বয়সে তাঁরা আসতেন বলে তাঁদের বাবা, মা এবং পরিবারের অন্যান্য লোকদেরও সেখান থেকে বর্ধমানে নিয়ে আসা হত। কোন উপলক্ষ্যে নিজের মা, বাবার সঙ্গে দেখা হলেও রাণীরা পিত্রালয়ে ফিরে যেতে পারতেন না।
একটি কথা অনিবার্য ভাবেই মনে হয়, যাঁরা এখানে আসতেন অতি অল্প বয়সে রাণীর মর্যাদা নিয়ে, তাঁরা হয়ত আর তেমন ভাবে পিত্রালয়ে যাবার প্রয়োজনও বোধ করতেন না। কারণ, অতি অল্প বয়স থেকে এই রাজপরিবাবের ঐশ্বর্য্যের মধ্যে থেকে সেখানে ফিরে যাবার প্রয়োজন হত না, গেলেও মানিয়ে নিতে পারতেন না। কিন্তু পিতা-মাতারাও কি তাঁদের কন্যাদের অভাব বোধ করতেন না? কন্যারাও কি বিবাহকেই শৃঙ্খলিত জীবন এর মুক্তি বলে মনে করতেন? কারণ বেশির ভাগ নারীই তো আসতেন রাজা-রাজড়ার পরিবার থেকে, হয়তো এই শৃঙ্খলিত জীবন তাঁদেরও কাটাতে হত শিশু বয়সে। তাই তাঁরা বিবাহকেই মুক্তি বলে মনে করতেন। এসব কথা সবই অনুমান, নিশ্চয় করে কিছু বলা যায় না। আরো একটি কথা জানানো দরকার, তা হল এই যে, বর্ধমান রাজপরিবার দীর্ঘদিন এদেশে বসবাস করার জন্য একরকম বাঙ্গালীই হয়ে গিয়েছিলেন বলা যায়। কাজেই সুদূর পঞ্জাব বা অন্যত্র থেকে আগত এই সব রমণীরা যারা রাজপরিবারে বধু হয়ে আসতেন, একেবারে প্রথম থেকেই চলত তাঁর বাংলা শেখা ও বাঙ্গালীর আচরণ, আদব-কায়দা কে জানা। বর্ধমান রাজপরিবারের একেবারে নিজস্ব কিছু নিয়মকানুন, যেমন বিবাহ, চূড়াকরণ, নামকরণ বা কোন পূজা-পাঠ ইত্যাদি ছাড়া বাকি সব কিছুতেই ছিল বাঙ্গালীয়ানা। রাজকুমার, রাজকুমারী বা রাণীদের তা শেখা আবশ্যক ছিল।
মহারাজ আফতাব চাঁদের পর বর্ধমানের রাজপরিবারে সিংহাসনে বসেন মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাব। ‘মহতাব’ শব্দটি হল চন্দ্র কথার ফারসী রূপ। আবার চন্দ্র কথাটি হল সংষ্কৃত শব্দ। যেহেতু তিনি মহারাজা এবং হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই তাঁর প্রজা, সেকারণেই এইরকম একটি উপাধিকেই তিনি পদবী হিসাবে গ্রহণ করেন। মহারাজা বিজয়চাঁদের পত্নীর নাম ছিল রাধারাণী দেবী। বিজয়চাঁদের বিবাহ হয় দিল্লীতে, কিন্তু বিবাহের পর রাধারাণী দেবীর পুরো পরিবার চলে আসেন বর্ধমানে। রাজপরিবারে যে করকোষ্ঠীর মিল দেখে বিবাহ হত সেকথা আগেই বলেছি। সেইমতই রাধারাণী দেবীর সঙ্গে বিবাহ হয় মহারাজা বিজয়চাঁদেরও। রাধারাণী দেবী ছিলেন দরিদ্র পরিবারের কন্য। রাজরাজড়ার পরিবারের আদব-কায়দা, নিয়ম-কানুন তাঁর জানা ছিল না, তিনি কোনদিন তা পছন্দও করেন নি। মহারাজকুমারের মতে এই অসম বিবাহের জন্য মহারাজা বিজয়চাঁদ এবং মহারাণী রাধারাণী দেবীর বনিবনা হয়নি কোনওদিনও। রাজা-রাণীদের জীবনে অতুল ঐশ্বর্য্য-বিলাসিতার মাঝেও যে সাধারণ নরনারীর জীবনের মত তাঁদের জীবনেও নেমে এসেছিল দুর্ভাগ্যের ছায়া, তার প্রকৃত ইতিহাস আমরা জানি কতজন!
বিজয়চাঁদ কিশোর অবস্থা থেকেই আধ্যাত্মিক চেতনাসম্পন্ন ছিলেন। ‘বিজয়ানন্দ বিহার স্থলে’ তিনি প্রায়ই ধ্যানে রত থাকতেন। এমন কি একটানা সাতদিন ধরেও তিনি ধ্যানে রত থাকতেন এমন কথাও জানা যায়। সেই সময় রাজকার্য, রাজ্যশাসন কিছুই প্রায় সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে। আধ্যাত্মিক ভাবের ঘোরেই তিনি ডুবে থাকতেন। পত্নী রাধারাণী দেবীর সঙ্গে এই নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়, ক্রমে, মহারাজা বিজয়চাঁদ লর্ড কার্জনের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর মদত,পরামর্শ ও সাহায্যে ধীরে ধীরে আবার রাজ্য পরিচালনা ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন। কিন্তু মহারাণী রাধারাণী যে আধ্যাত্মিক চেতনার ঘোরে থাকার জন্য মহারাজার সঙ্গে বিরোধ বাধে, নিজে ধীরে ধীরে সেই জগতে ডুবে যান। আগেই বলেছি, মহতাব চাঁদের আমল থেকেই বহুবিবাহ প্রথা বন্ধ হয়ে যায় এবং রাজারা এক পত্নীতেই সন্তুষ্ট থাকনে। কিন্তু রাধারাণী দেবীর সংগে মহারাজা বিজয়চাঁদের কোনদিনই সদ্ভাব বা বনিবনা হয় নি। এমনকি রাজকুমার, রাজকুমারীগণের ইংরাজি শিক্ষা ও পঠন-পাঠনের জন্য বিদেশ গমনও রাধারাণী দেবী মেনে নিতে পারেননি। রাজবাড়িতে একত্রে টেবিলে বসে ইংরাজি কায়দায় মাছ, মাংস, মদ ইত্যাদি গ্রহণেও তীব্র আপত্তি জানান। প্রথম যৌবনে মহারাজার আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য যে মহারাণী এত প্রতিবাদ করেন সেই জীবন থেকে মহারাজা বিজয়চাঁদ লর্ড কার্জনের প্রভাবে একশ আশি ডিগ্রী ঘুরে দাঁড়ালেও রাধারাণী দেবীর আর কোন পরিবর্তন হয় না।
বরঞ্চ তিনি রাজবাড়ির মায়া-মোহ ত্যাগ করে চিরজীবনের মত সন্ন্যাসিনী হয়ে যান ও রাজবাড়ি পরিত্যাগ করে বারাণসী ধামে চলে যান তাঁর গুরুর আশ্রমে। রাজ ঐশ্বর্য্য, রাজকীয় বিত্ত, বৈভব, রাজ রাণীর জীবন এক কথায় ঠেলে ফেলে দিয়ে তিনি আজীবন সন্ন্যাসিনীর জীবন যাপন করেন।
সেদিক দিয়ে বর্ধমান রাজপরিবারে এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা বলা যায়। এই জীবনের প্রতি তাঁর বিরাগ, বিতৃষ্ণা তিনি প্রকাশ করেছেন কবিতায়, যা তিনি রচনা করেছিলেন রাজঐশ্বর্য্য ছেড়ে চলে যাবার সময়। রাজমহিষী রাধারাণীর জীবনের এও এক আশ্চর্য্য সুকুমার মনোবৃত্তি যা হল তাঁর কবি প্রতিভা, যা প্রকাশিত হয়েছে দেবতার কাছে কবিতার বয়ানে। এটাই ছিল তাঁর শেষ আকুল প্রার্থনা। এই কবিতা এখনও লিখিত আছে মহারাজা কীর্তি চাঁদ কর্তৃক স্থাপিত নবরত্ন মন্দির বর্ধমানের দেবী সর্বমঙ্গলার মন্দিরের নাটমন্দিরের দেওয়ালে। আজও দেবীর ভক্তকুল মন্দিরে এলে দেখতে পান এক নারীর বেদনা, হাহাকার ও রাজঐশ্বর্য্যের প্রতি বিপুল অনীহা কবিতাগুলির ছত্রে ছত্রে,যা খোদাই করা আছে নাটমন্দিরের গাত্রে। মহারাণী রাধারাণী লিখিত তিনটি কবিতা---
(১)--কবিতা-১
তোমারে,ডাকি মা , তাই।
এ তিনি ভুবনে,জননী আমার,আপন কেহই নাই।।
ত্রিলোকতারিণী,তুমিনারায়ণী,তুমিত সহায় সার।
তোমার মহিমা,অনন্ত অসীম,শুনিয়াছি বারে বার।।
তাইসচন্দনে,জোড়া বিল্বদলে,পরশি জাহ্নবী জল।
তোমার চরণে সঁপিনু জীবন তুলনা করিয়া ছল।।
ধর্ম,অর্থ,কাম,মোক্ষ নাহি চাই তোমার চরণ তলে।
জনমে জনমে, তনয়া হইয়া, বসিব জজনী বলে...।
মা, বলে ডাকি গো, নিকটে থাকিও,দেখিব মা তব মুখ।
জননী বলিয়া করতালি দিয়া ভুলিবে রাধিকা দুখ।।
অসয়ায় তনয়া
কবিতা—২
করুণা রুপিনী, শোন।
এবারে মরিলে এ রাজ মহলে,মোরে না আনিও পুনঃ।।
যেখানে, মা হয় সাধুর পীড়ন,অসাধু জিনিয়া যায়।
ভক্তের মহিমা উড়িয়া যায় মা,বঞ্চনা আদর পায়।।
গুণের সম্মান, হয় অবসান,ধনের সম্মান বাড়ে।
দেবতা হয় মা ভুতের অধীন,ভয়িয়া বেড়ায় ঘাড়ে।।
প্রভুত থাকে মা, পাষন্ডের হাতে,বিনাশে ধর্মের প্রাণ।
সাধুর লাঞ্ছনা, উঠিতে বসিতে দুর্জনের বাড়ে মান।।
সতীর না থাকে, অন্নের সংস্থান,অসতী কাঞ্চন পরে
কপটতা হয়, সভ্যতা যথা, কলঙ্ক প্রেমের ঘরে।।
এ মহলে মোরে আর না আনিও, এ মিনতি তব পায়।
রাধিকার দিন যেভাবে যাইল,বলিয়া বোঝান দায়।
নিরুপায় তনয়াকবিতা—৩
মা, মা, মা, বলে ডাকিলে, জননী।
এই, ফল তার, ফলিল সঙ্করী।।
এই অপমান, নহে আমার তারিণী।
এই অপযশ, তব রবে জগভরি।।
রক্ষ, রক্ষ, সতী রক্ষ মা আমারে।
এই শত্রু কর হতে, ওগো কৃপা করে।।
তোরই, নামের জোরেতে জননী।
ত্যাজিয়া যাইব এই রাজধানী।।
ফিরিয়া হেথায় আসিব না আর।
এই প্রতিজ্ঞা মোর, পুর নারায়ণী।।
তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হউক।
তব, কাতরা তনয়া
অদ্য ২৯ বৎসর পর বঙ্গদেশ ছাড়িয়া চলিলাম। ইতি সন ১৩৩৭ সাল ১৩ই আশ্বিন মঙ্গলবার
বন্দেমাতরম্ ।