ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিকএকটু কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে? কতজন এ লেখা পড়ছেন বা পড়বেন জানি না, তবে লেখার একটা পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে বিদেশের হেঁশেল সংস্কৃতি নিয়ে বেশি শব্দ খরচ করছি না তো? দেশজ রন্ধনশিল্প এত বিস্তৃত এবং বিপুলা হওয়া সত্ত্বেও আঞ্চলিক কিছু পদের প্রকরণকৌশল ও তার ইতিহাস প্রসঙ্গে লেখা ছাড়া এখনও পর্যন্ত অন্য প্রদেশের রান্নাবান্নার একরকম বহিরঙ্গেই ঘোরাফেরা করেছি। প্রথমত একথা বলা দরকার যে এটি কোনও বিশেষ উদ্দ্যেশ্যপ্রসূত নয়। একদিন নিজের অজান্তেই যেমন এই যাত্রাপথে নিজেকে আবিষ্কার করে একাধারে বিস্মিত ও আনন্দিত হয়েছিলাম কিন্তু কোথাও পৌঁছনোর তাগিদ ছিল না। অসামান্য সেই সরণি ধরে যত এগিয়েছি, তত ক্ষুদ্র মনে হয়েছে নিজেকে আর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছি চারপাশের শোভা। চলার পথ তৈরি হয়ে গেছে আপন খেয়ালে। আর দ্বিতীয়ত দেশের কোনও রান্নার হাঁড়ির খবর অনুসন্ধানে সিপিয়া-রঙা ছবি ওলটাতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছি অন্য আরেক দেশের অনুষঙ্গ আর গোয়েন্দা গল্পপ্রিয় আমার মন হাজির হয়ে গেছে অচেনা কোনও ভূখণ্ডে। তখন গৌণ হয়ে গেছে আলাদা আলাদা রন্ধনসংস্কৃতি – সবকিছুই এক বৃহৎ রান্নাঘরের অংশ বলে হয়েছে আর তারই কোনও কোনও বিচ্ছুরণ কখনও কখনও ঢেকে ফেলেছে পথ হারিয়ে সেখানে ঢুকে পড়া এক অর্বাচীনকে।
স্টেক। এর আভিধানিক অর্থ ব্যপক। রসনার সঙ্গে এই শব্দটিকে জুড়ে দিলে তার ফল হয় অতি সাঙ্ঘাতিক। কেমব্রিজ অভিধানে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে পাচ্ছি স্টেক বলতে ‘a thick, fat piece of meat or fish, especially from a cow’ কে বোঝাচ্ছে। এর থেকে কিছুটা বোঝা গেলো বটে কিন্তু যদি কোনও খাঁটি স্টেকরসিকের পাল্লায় পড়েন, তাহলে বুঝবেন এই সংজ্ঞা আসলে জলের তলা থেকে মুখ বাড়িয়ে থাকা হিমশৈলের চুড়া কিছুই নয়। আসুন প্রবেশ করি স্বাদু সেই জগতে। পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি স্ক্যান্ডিনাভিয়াতে প্রথম এই খাদ্যটির উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু যে আধুনিক স্টেকের সঙ্গে আমরা পরিচিত, তার জন্ম ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে, মাংস আগুনে পুড়িয়ে খাওয়ার প্রাচীন রীতি থেকে। সেই ফ্লোরেন্স! ইতালিয়ান রেনশাঁসেরও জন্ম যেখানে। আজও যেখানে সারাবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় করেন রেনেশাঁসের অবিশ্বাস্য সুন্দর নিদর্শনগুলি একটু সামনাসামনি দেখার জন্য। একসময়ের ব্যবসা- বানিজ্যের কেন্দ্র, তুমুল বিত্তশালী এই জনপদটি ‘মধ্যযুগের এথেন্স’ বলেও পরিচিত। এবার একটা ছবি কল্পনা করুন। প্রবল শীতের রাত। আলো-আঁধারির মধ্যে এক বিশাল আগুনকে ঘিরে কিছু মানুষ আর সেই আগুনে ঝুলিয়ে পোড়ানো হচ্ছে একটি পশুকে। ধীরে ধীরে জমে উঠবে নৈশাহার! সেইদিন থেকে কীভাবে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে স্টেক হয়ে উঠলো পৃথিবীর জনপ্রিয়তম একটি আহার্য, সেইদিকে একটু তাকানো যাক। একেবারে শুরুতেই যে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে, তা হলো স্টেকের মাংস কাটার নিয়ম। সবসময় লম্বালম্বিভাবে, আড়াআড়ি নয় আর এখানেই স্টেক আর রোস্টের মাংসের মধ্যে মৌলিক তফাৎ। লম্বালম্বি কাটার অর্থ শরীরের পেশীতন্তুর বিপরীতে ছুরি চালানো, যে কারণে স্টেক তৈরির সময় রোস্টের থেকে তুলনামুলকভাবে কম। কারণ রোস্টের জন্য মাংস কাটা হয় পেশীতন্তুর অভিমুখে। তাই রোস্ট ‘স্লো কুক’ করা হয় অনেকক্ষণ সময় নিয়ে আর স্টেক ‘ফাস্ট ফুডে’র তালিকায় পড়ে। শোনা যায় যে ফ্লোরেন্স শহর থেকে স্টেকের উৎপত্তি, ব্যবসার প্রয়োজনে সেখানে যাতায়াত ছিল ইংরেজদের। তাঁরাই এই বস্তুটির স্বাদে এমন মজে যান যে দেশে ফেরার সময় সঙ্গে নিয়ে যান এর রেসিপি এবং তার অবশ্যম্ভাবী ফল যা হওয়ার তাইই হয়েছিল। অর্থাৎ পৃথিবীর যেখানে যেখানে তাদের উপনিবেশ ছিল, সেইসব জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়ল পোড়া মাংসের গন্ধ! কলকাতা নিশ্চিতভাবেই বাদ পড়ল না। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে জন্ম নিল নতুন এক হেঁশেল সংস্কৃতি – যার নাম ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কুইজিন’। যার সৌরভ ছড়িয়ে পড়ল শহরের অলিতে গলিতে আর পার্ক স্ট্রিট নামক এক অঞ্চলে কয়েকটি পদ খুঁজে পেল তাদের স্থায়ী ঠিকানা। যার একটি ছিল অলিপাব। অলিপাবের স্টেক, বিশেষত শাতু ব্রিয়াঁর খ্যাতি হলো ভারতজোড়া। আপাত সাধারণ এই রেস্তোরাঁটির সামনে অপেক্ষমান স্টেকপ্রেমী জনতার জটলা বিরল কোনও দৃশ্য ছিলনা এই সেদিন অবধিও। ভুলে গেলে চলবেনা আশপাশে আরও এমন কয়েকটি জায়গা ছিল, বোদ্ধামহলে স্টেক পরিবেশনে যারা যথেষ্ট কৌলীন্য দাবী করতে পারতো। এছাড়াও ছিল কিছু ক্লাব, কলকাতার স্টেক-প্রেমের সুদীর্ঘ ঐতিহ্যে যাদের অবদান ছিল গগনস্পর্শী। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে বাঙালিদের মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার প্রশ্নে আজকের তুলনায় ছুৎমার্গ ছিল অনেক কম। ‘প্রাইমাল কাট’ কী বা টি-বোন, পোর্টারহাউস কিংবা সিরলয়েন, টেন্ডারলয়েন বা ব্রিস্কেট কাকে বলে – এ নিয়ে মন্তব্য করার মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক। আজ সে প্রজাতি লুপ্তপ্রায়। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ঘরাণার দুয়েকটি ক্লাবে বছরের কিছু বিশেষ সময়ে কাঠকয়লার আঁচের ওপর জাল দিয়ে বারবিকিউ এর সময় সদস্যদের মধ্যে যে উৎসাহের ঢল দেখা যেত, তা এখন ইতিহাস। এখন ওইসব দিনগুলিতে যা দেখা যায়, তা হলো ‘সাজানো ঘটনা’। বারবিকিউ এর সস্তা বানিজ্যিকরণ। বহু আগে থেকে সব কিছু তৈরি করে প্লেটে সাজিয়ে রাখা।
ইউরোপের মাটিতে সেবার পা রাখার আগেই ইউরোপীয় খাবার, বিশেষত স্টেক খাওয়ার বিষয়ে আমরা যথাযথভাবে দীক্ষিত হয়েছিলাম অশোকদার কাছে। অশোক সেন। কলকাতার একটি অভিজাত পরিবার থেকে উঠে আসা, দীর্ঘসময় বিলেতে কাটানো, ভিন্ন রুচি আর মনন – সব মিলিয়ে এক অন্য গ্রহের ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। সমান উৎসাহ নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর কিশোর গল্পসংকলন সম্পাদনা করতেন বা স্টেটসম্যানের জন্য করতেন কোনও গ্রন্থ সমালোচনা আর পাশাপাশি আমাকে শেখাতেন পশ্চিমী রান্নার নানান কৌশল।
দেশের বাইরে স্টেকের স্বাদ পেতে লেগে গেলো অনেকটা সময়। আমাদের সেই ভ্রমণ যখন শেষ পর্বে। ইংল্যান্ডে এক সপ্তাহের বেশি কাটালেও স্টেক খাওয়ার সুযোগ হয়নি। যা হলো ক্যোলন্, হির্শবার্গ হয়ে বাড়ি ফেরার পথে বার্লিনে বারবারার কাছে গেলাম যখন। বার্লিন শহরে একটা বিশেষ রাস্তা আছে। উন্টার ডেন লিন্ডেন। এর একটা তর্জমা হতে পারে ‘লেবু গাছের তলায়’। ইতিহাসের নানা অধ্যায়ের সাক্ষী পুব আর পশ্চিম বার্লিনকে জুড়ে রাখা প্রশস্ত এই পথটি। চারপাশের সৌধগুলি দেখতে দেখতে কত যে হেঁটেছি! এখানেই একটি হোটেলে একসময় দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন সুভাষচন্দ্র বসু। আরেকটি লক্ষ্যনীয় বিষয় আছে। এই পথের দুপাশে অজস্র পাব আর রেস্তরাঁ। বারবারা আমাদের নিয়ে একদিন হাজির হলো স্টেক হাউস-এ। নাম থেকেই জায়গাটির মাহাত্য বোঝা যাচ্ছে। তাই না? বিভুয়ে স্টেকদর্শনের সেই প্রাথমিক অভিজ্ঞতায় যা চোখে পড়েছিল তা হচ্ছে পরিমাণ। মাংসের টুকরোটা বেশ বড়, স্যালাড এবং আনুসঙ্গিকতাও বেশি। তখন ভেবেছিলাম, ওদেশের লোকজনের চেহারা যেমন, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়েই হয়তো ওই আকার। কিন্তু না। অচিরেই একটা মৌলিক পার্থক্য আবিষ্কার করলাম দুদেশের রেস্টুরেন্ট মালিকদের মানাসিকতার মধ্যে। মাংসের বড় টুকরো তো বটেই, তার সঙ্গে স্যালাড ইত্যাদি পর্যাপ্ত দেওয়াটাই ওদেশের রেওয়াজ। মাংসের গুণগত মানটাও অনস্বীকার্যভাবে আলাদা। আর এখানেই আসল ম্যাজিক! যেকোনোও রান্নার শিরদাঁড়া হলো উপাদান। উপাদান সঠিক এবং টাটকা না হলে নিছক জ্ঞান বা চোখ-ধাঁধানো গ্যাজেট প্রার্থিত ফল এনে দিতে পারে না। তবে এখনও অবধি বিদেশের মাটিতে সেরা স্টেক খাওয়ার অভিজ্ঞতা জার্মানিতেই, খাদ্যরসিক বন্ধুদম্পতি রলফ্ আর মনিকার সঙ্গে হামবুর্গে। কিন্তু হ্বিনার শ্নিৎসেল (Wiener Schnitzel)? স্বর্গীয় এই বস্তুটি পরখ করার জন্য বারবার ফিরে এসেছি বার্লিন আর উন্টার ডেন লিন্ডেন এ। রক্তের মধ্যে এই নেশা ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য যিনি এককভাবে দায়ী, তাঁর নাম বারবারা কাপ্টাইন। সম্ভবত সেবার ফেরার একদিন আগে বারবারা আবার আমাদের নিয়ে গেলো বার্লিন শহরের ওই অঞ্চলে। তখনও এই বস্তুটির সঙ্গে পরিচয় ছিল না। এমনকি আমাদের সামনে হাজির হলেন যখন তিনি কারটোফেলসালাটের (বিখ্যাত জার্মান আলুর স্যালাড) সঙ্গী হয়ে, তখনও জানিনা সারা জীবন তাঁর প্রেমে হাবুডুবু খাবো। বাছুরের ঘাড়ের কাছের হাড় ছাড়া ফিলেতে প্রথমে নুন, মরিচ মাখিয়ে নিতে হবে ভালো করে। তারপর প্রথমে ময়দা (রাইস ফ্লাওয়ার হলে ভালো হয়) তারপর ডিম আর সবশেষে বিস্কুটের গুঁড়ো মাখিয়ে ডুব তেলে ভাজতে হবে। এই বর্ণনাটা যত সহজে করলাম, মনে রাখতে ঠিকঠাক স্বাদ আনা ততোটাই কঠিন। কারণ শ্নিৎসেল খাওয়ার জন্য বিশেষ জায়গা আছে আর সেখানে আগে থেকে টেবিল বুক করা না থাকলে হতাশ হয়ে ফিরতে হতে পারে। বাছুরের মাংসের বদলে অবশ্য শুয়োরের মাংসও ব্যবহার হয়ে থাকে মূলত দামের কারণে। তবে সে স্বাদ আলাদা। আরেকটি জরুরি প্রসঙ্গ। নাম থেকেই মালুম এ জিনিসের কপিরাইট ভিয়েনা শহর আর অস্ট্রিয়ার কিন্তু আবার সেই ধাঁধাঁ। তথ্য বলছে উনিশ শতকে এক অস্ট্রিয়ান সেনাধ্যক্ষ্য ইতালির মিলান শহরে এটি চেখে দেখেন এবং দেশে ফেরার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এর রেসিপি। আবার সেই ইতালিয়ান যোগ!
কলকাতা ফেরার পথে আমাদের নামতে হয়েছিল মস্কো বিমান বন্দরে। তখন অনেক রাত। আমাদের সকলের পেট চুঁইচুঁই। সস্তার বিমান সংস্থার খাবারে ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়নি। কিন্তু কী খাবো, কোথায় খাবো? বিশাল এয়ারপোর্টের এমাথা ওমাথা চষে ফেলতে ফেলতে প্রথমে বিখ্যাত রুশ খেলনা পুতুলের সেট মাত্রুশকা কিনে ফেললাম। খিদে তখন চরমে। শেষমেশ পৌঁছলাম সেইসময় খোলা থাকা একমাত্র রেস্তরাঁটিতে। ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে বোঝাতেও পারলাম আমাদের বুভুক্ষু অবস্থার কথা। একগাল হেসে মোটাসোটা চেহারার মহিলা আমাদের ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে চলে গেলেন। ফিরলেন যখন, তাঁর হাতের প্লেটে মাংসের একটা বড়সড় টুকরো। স্টেক!! হলফ করে বলতে পারি এমন স্টেক আর কখনও দেখিনি। ফলত, সে রাত আমাদের অভুক্তই কেটেছিল।