Next
Previous
2

গল্প - সুস্মিতা হালদার

Posted in

 




















(১)

কাজের লোকের বড্ড সমস্যা। একটা সময় ছিলো যখন ‘ভাত ছড়ালে কাকের অভাব’ হতো না। আর এখন লোক পাওয়াই দুরূহ। যদিও বা লোক পাওয়া যায়, তাও তার কাজ দেখলে তো মাথার মধ্যে বজ্রপাতসহ শিলাবৃষ্টি হয়।— এ অভিযোগ এখন ঘরে ঘরে। একটু ভুল হলো। মধ্যবিত্ত ঘরে ঘরে। একটা সময় এসব শুনে রাজদত্তার মাথাটা জ্বলে যেত। মধ্যবিত্ত বাড়ির মানুষগুলো কি! সবকটা কুঁয়োর ব্যাঙ। এরা খালি লোকজনকে গালমন্দ করতে করতেই মরলো। এইজন্য এদের ভাগ্যে উন্নতি-ধনসম্পত্তি কিচ্ছু জোটে না। সত্যিই খুব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিবেচকের মতো করে ভাবতো সে। কিন্তু আজ সে নিজেই পাকাপাকি মধ্যবিত্ত গৃহী হয়ে গেছে। সময় তাকে বদলে দিয়েছে। তাই এতদিন যে সংকীর্ণ চিন্তা-ভাবনার জন্য নিজের মা-বাবাকেও বকাবকি করতে ছাড়েনি, ‘কূপমণ্ডূক’ বলে অভিহিত করে গিয়েছে, আজ বড়ো সত্যি মনে হয় সেই কথাগুলোই। সেই ছোটোবেলায়— কলেজ লাইফে একটা সুন্দর ‘রঙিন চশমা’ ছিলো তার চোখে। আজ সে চশমাটা ভেঙে গিয়েছে। স্বচ্ছ কাচের যে চশমাটা পরে ফেলেছে চাকরির দুনিয়ায় পা রাখতে না রাখতেই, সেটা বড়ো জ্বালা ধরায় চোখে— খুব স্পষ্টই সবকিছু দেখা যায় যে।

একটা সময় অনেক স্বপ্ন ছিলো রাজদত্তার। সোশ্যিওলজি অনার্স নিয়ে পড়েছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ইংরেজিটা তেমন শক্তপোক্ত না; লিখতে ভালোই পারে। কিন্তু বলতে গিয়ে আটকায়। তাই ভেঙে গেলো স্বপ্নের প্রথম ধাপটা— বিদেশ যাওয়া। মাস্টার্স শেষ করে বিদেশে পি.এইচ.ডি. করার জন্য অনেক নতুন পরিকল্পনা মাথায় এসেছিলো। সেইমতো প্রপোজালও তৈরি করে রেখেছে। কিন্তু আটকালো টোয়েফল-এ। স্কোর এত কম হয়ে গেলো যে কোথাও চান্স পেলো না। এখন দরকার তার ফ্লুয়েন্সি বাড়ানো আর শুনে চট করে বুঝতে পারা। ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে কোর্স করতে যাবে বলে ঠিক করলো। কিন্তু টাকা পয়সা? সে সময় হাতে তার কোনও চাকরি নেই। বাবা সাধারণ মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। মা হাউস-ওয়াইফ। এমনিতেই সংসারের যা খরচ তাতে বাবার ওপর চাপটা বেশিই হয়। দাদু-ঠাকুমা রয়েছেন, অনেক বয়েস— প্রায় নব্বই ছুঁইছুঁই। ওঁদের অসুখ বিসুখের জন্য টাকা তো হাতে রাখতেই হয়। আর তাছাড়া বাবা-মা’রও বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে— বাবার নানান অসুখ লেগেই আছে। তাই শেষ পর্যন্ত ঠিক করলো নিজে ক’টা টেম্পোরারি কাজ ধরবে। তারপর ওসব কোর্স করার কথা ভাববে।

সেইমতো অ্যাপ্লাই করলো বিভিন্ন কলেজে। সি.এস.সি., পি.এস.সি.-র চাকরি তো ‘ফটিকজল’-এর মতো। চাতকের আর্তনাদ, তাও জল মেলে না। যে বছর সে মাস্টার্স শেষ করলো, সেই বছরই নিয়ম হলো, সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কোনও কলেজে আগের মতো সরাসরি অ্যাপ্লাই করে গেস্ট ফ্যাকাল্টি হিসেবে চাকরি পাওয়া যাবে না। তাই বাধ্য হয়ে প্রাইভেট ল’ কলেজগুলোয় অ্যাপ্লাই করে। সেখানেও তো সোশ্যিওলজি পড়ানো হয়। কলকাতা আর তার আশেপাশে তিনটে কলেজে গেস্ট ফ্যাকাল্টির কাজ পেলো। ক্লাস ভিত্তিক স্যালারি। কোনও কলেজ দেয় প্রতি ক্লাসে ২৫০ টাকা, কোনও কলেজ একটু বেশি। মাস গেলে এক-একটা কলেজ থেকে ইনকাম মেরেকেটে ছয় হাজার। খুব কপাল ভালো থাকলে আট হাজার। এমনও গেছে, যেবার মাসে একটা কলেজ থেকে দুই হাজার টাকা জুটেছে। আর দু’জায়গা থেকে স্যালারিই পায়নি। ইউজিসি-নেট কোয়ালিফায়েড, মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করে আসা একজনের মাস গেলে আয় খুব বড়োজোর হলে কুড়ি হাজার টাকা— বেশিরভাগ মাসেই আটকে থাকে পনেরো থেকে ষোল হাজারে।

মনে মনে হিসেব কষে রাজদত্তা। তাদের বাড়ির কাজের লোকটা কত পায়? মাসে প্রায় পাঁচ হাজার। এর সাথে খাওয়ার খরচ তো আছেই। বছরে দু’বার করে দামী কাপড় দেওয়া; তার অসুখ-বিসুখেও খরচাপাতি দিতে হয় রাজদত্তাদেরকেই। তার মানে, বেকার পড়াশুনো করলো সে এত টাকা খরচ করে। এর চাইতে স্কুল পাশ করে এই সমস্ত সেলাইয়ের কাজ, কি লোকের ঘরে কাজ বা নার্সিং হোমে টেকনিশিয়ান বা রিসেপশনিস্টের কাজ ধরলেই পারতো। এখন এরকমই মনে হয় তার। ভারতীয় সংবিধানের ‘সোশ্যালিজম’-এর কথা মনে পড়ে যায়। অনুচ্ছেদ ৩৯ বলেই দিয়েছে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমিয়ে আনার উপায়— ধন-সম্পত্তি যেন ধনীর হাতে পুঁজিভূত না হতে পারে। সংবিধান তো বলে ধনী আর দরিদ্রের কথা। সেখানে যে অসাম্য তা সমতায় নিয়ে আসার কথা। কিন্তু এদের মাঝে যে রয়েছে মধ্যবিত্ত। সে তো ‘ঘরেও নহে পারেও নহে’। আজ যদি রাজদত্তার ওপর পুরো সংসারটার দায়িত্ব এসে পড়তো আর্থিকভাবে, কোথা দিয়ে সে মেটাতো সবকিছু? তার কুড়ি হাজার টাকা থেকে যদি পাঁচ হাজার টাকা বেরিয়ে যায়, পড়ে থাকে কত? পনেরো হাজার। কুলোতো এর মধ্যে থেকে ইলেকট্রিক বিল, মিউনিসিপ্যালিটি ট্যাক্স, নিজেদের নিত্য খরচ? হাতে বাঁচতো আর কত? ব্যাঙ্কে জমানোর টাকাও তো থাকতো না !

কাজের লোক না রাখারই ইচ্ছে ছিলো ওর বাবা-মা’র। কিন্তু মা-বাবার বয়স হয়েছে। দাদু-ঠাকুমাকে দেখভাল করতে করতে আর শরীর দেয় না। আর তাছাড়া ফ্ল্যাটে থাকে না তারা। নিজেদের বাড়িতেই থাকে। তার ছ’-ছ’টা ঘর সবকিছু পরিষ্কার রাখার ক্ষমতা মা’র আর নেই এই বয়সে এসে। রাজদত্তাকে তো সেই সকাল ন’টায় বেরিয়ে যেতে হয়, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে ছ’টা-সাতটা বাজে। ফিরে এসে ঘরের টুকটাক কাজ করে নিজের পড়াশোনা করে। ইচ্ছে আছে, ডব্লু.বি.সি.এস. দেওয়ার। সারাদিনে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়ে ঘরের সব কাজ করার মতো শরীর তারও দেয় না। তাই বাধ্য হয়ে লোক রাখতে হয়েছে। লোক রাখার সময় এত টাকা দিতে হবে শুনে মা-ই দরাদরি করেছিলো। প্রথমে তো সাত হাজার চেয়েছিলো। দরাদরি করতে করতে পাঁচ হাজারে রাজি হয়।

—“দেখো বাপু, আমার স্বামী রিটায়ার করেছেন। মেয়ে এখনও চাকরি পায়নি। আমাদের নিজেদেরই খুব টানাটুনি করে চালাতে হয়। বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ি রয়েছেন। ওঁদের অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। তুমি একটু যদি কম করে চার হাজারে করো, ভালো হয়।” মা কাকুতি মিনতি করেছিলো খুব।

—“অত কমে আমি খাবো কী? তোমাদের তো এই বাড়ি আছে। তোমার মেয়ে চাকরি পায়নি, সে তার ব্যাপার। তাতে আমায় টাকা দেবে না কাজ উশুল করবে, এ বললে চলবে না কো।”

—“টাকা দেবো না তো বলিনি। আমরা বিনা পয়সায় কাজ নিই না। শুধু একটু কম করতে বলছি।”

—“পাঁচ হাজারের নিচে আমি করবো না কো। রাজি থাকো তো বলো। না তো আমি চললুম। আমায় আরও দশ-দশটা বাড়ি ডাকছে।... দেখো, তোমাদের কাছে সকাল থেকে বিকেল অব্দি থাকতে হবে। সেই সন্ধ্যেবেলা ঘর যেতে পাবো। আমি এমনিতে সারাদিনে পাঁচটা ঘরে কাজ করি। তোমাদের ঘরে এতক্ষণ থাকলে তো আর কোনও বাড়িতে কাজ করতে পারবো না কো। শুধু সকালটুকু করলে আমি অত চাইতাম না কো। এতক্ষণ থাকবো তোমাদের ঘরে আর সব বাড়ির কাজ বাদ দিয়ে, তালে মাসের শেষে ক’টা টাকা ধরালে আমার পেট চলবে কী করে? আমারও তো সংসার আছে না কি? তোমাদের সব বুড়ো বুড়িরা আছে, তার জন্য না করতে পারলাম না কো। কিন্তু এ সাফ সাফ বলে দিচ্ছি, পাঁচ হাজারের কমে হবে না।”

মা’র সাথে রাজদত্তাও ছিলো সেদিন। কথাগুলো শুনে ওর খুব অসহায় লাগছিলো নিজেকে। যেদিন কলেজে ইন্টারভিউ বলেছিলেন, তাকে প্রতি ক্লাসের জন্য ২৫০ টাকা করে দেওয়া হবে, সেখানে ‘NET’ বা ‘non-NET’ এসব দেখা হবে না, পেরেছিলো সেদিন এভাবে দরাদরি করতে? তিনটে কলেজের কোনওটাতেই? না, পারেনি। মুখ বুজে সেটাই মানতে হয়েছিলো। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের চাকরির বড়ো আকাল। তারপর সে বাংলা ভাষাটা ছাড়া হিন্দিও তেমন জানে না, ইংরেজিতে বলতে গিয়ে ঠোকরায়, লিখতে ভালো পারলেও। এ রাজ্যের বাইরে অন্য রাজ্যে যে চেষ্টা করবে, সেখানেও তার ভাষাগত সমস্যা। তাও সাহসে ভর করে বাইরের রাজ্যে দু-একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করেছিলো। ডাক আসেনি কোনওটা থেকেই। নিজের রাজ্যেও প্রায় দশ-দশটা কলেজ, চারটে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করলেও ডাক এসেছিলো হাতে গোনা তিন-চারটি প্রাইভেট কলেজ থেকে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোর একটার থেকেও ইন্টারভিউর ডাক আসছে না। একটায় শুধু এইচ.আর. ইন্টারভিউ হলো, তারপর আর এক্সপার্ট ইন্টারভিউর ডাক এল না। একটা বিষয় খুব অবাক লাগলো, তারই এক ব্যাচমেট যার ‘NET-SET’ কিছুই নেই, এমনকি গ্র্যাজুয়েশন মাস্টার্স-এ ফার্স্ট-ক্লাসটুকুও নেই, তার সহজে হয়ে গেলো একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। সবই হয়! কপালের জোর না যোগাযোগের জোর— কোনটা যে লাগবে সে বোঝা দায়। মেরিট-এর জোর? যোগ্যতা? সে তো এক প্রহসন মাত্র। আর সরকারি চাকরি? সেটা না হয় উহ্যই থাক।


(২)

কথাগুলো প্রায়ই মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে রাজদত্তার, বিশেষ করে ওদের বাড়িতে ‘হাউস হেল্পিং’ হিসেবে অহনা জয়েন করার পর থেকেই। অহনা রাজদত্তাদের বাড়িতে রান্নাবান্না, বাসন ধোয়া, ঘর পরিষ্কার— এসবের জন্য রয়েছে— মধ্যবিত্তের ভাষায় ‘কাজের লোক’। সেটা যে অপমানজনকভাবে সবাই ব্যবহার করেন তেমনটা সবসময় ঠিক নয়। শব্দদু’টোর মধ্যে কোনও অপমান বা মন্দভাষাও নেই। একরকম পোস্টটার নামই হয়ে গেছে ‘কাজের লোক’। সেটাকেই ইংরেজিতে অনুবাদ করলে শুনতে সফিস্টিকেটেড লাগে, ‘House Helping’ বা ‘Domestic Worker’। রাজদত্তা যখন কলেজে পড়ে, তখন বাবার মুখে প্রায় শুনতো, “সরকার গরিবদের জন্য নানান ভাতা, কত কী করছে, অথচ মধ্যবিত্তের জন্য কিছুই নেই তেমন। একটা কাজের লোকেরও ডিম্যান্ড কত— আর পড়াশোনা শিখে আমরা সব চাকরির জন্য হাহাকার করছি। বাবার কথাগুলো শুনে মুখের ওপর বলেই ফেলতো রাজদত্তা, “তুমি এত ছোটো মনের কেন বাবা? এরকম চিন্তাধারা কেন?” আজ নিজেকে বড়ো মনের ভাবা রাজদত্তাই এসবভাবে। কালে কালে সবই বদলে যায়।

—“তোর কোনও খবর এল? কোনও ইউনিভার্সিটির? কোথায় কোথায় যে অ্যাপ্লাই করেছিলি?”

টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো রাজদত্তা। মা’র ডাকে ঘুম ভাঙলো।

—“না। ওসব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির কোনও গ্যারেন্টি নেই মা। আর সি. এস.সি. শুনছি তো হবে। কাল দেখলাম, অ্যাড বেরোলো। অ্যাপ্লাই করবো।” চোখ কচলাতে কচলাতে উত্তর দেয় রাজদত্তা।

—“কবে হবে পরীক্ষা?”

—“দাঁড়াও আগে ফর্ম ফিল আপ হোক। তারপর এক-একটা সাবজেক্ট ধরে ধরে ইন্টারভিউ হবে। এখন কোভিড একটু কম আছে। কিন্তু ভোটের প্রচার পুরো দমে শুরু হয়ে গেলে আবার না বেড়ে যায়। তখন আরও লকডাউন হয় কি না...! সরকারি জিনিস, অত তাড়াহুড়ো করলে চলে না।”

কথাগুলো মাকে বলে নিজের মনেই হাসে রাজদত্তা। সত্যিই মানুষের ধারণাটাই হয়ে গেছে সরকারি চাকরি মানেই অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অনেকে আবার বলে, ‘কচ্ছপের চেয়েও ধীরে আসে।’

—“আর ডব্লু.বি.সি.এস.?” মা প্রশ্ন করেন, “এবার বসবি না?”

—“প্রিপারেশন ভালো নেই মা। এতো ক্লাসের চাপ। অনলাইন ক্লাস মানেই তো শুধু ক্লাস নয় রিপোর্ট পাঠানো। তারপর ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ক্ষেত্রে তো আমাদেরই খাতা দেখতে হচ্ছে সেমেস্টার এক্সামটারও। ইন্টারনাল তো আছেই। স্টুডেন্টদের নোটস তৈরি করে পাঠানো। নিজেরই পড়া হচ্ছে না ঠিকমতো। পি.এইচ.ডি.-র আর একটা অন্য প্রপোজাল ঠিক করলাম। কাল শেষ হলো। অ্যাপ্লাই করবো। এরমধ্যে পি.এইচ.ডি.টা করে ফেলবো।”

—“হ্যাঁ রে, কলেজগুলোয় তো হলো অনেকদিন। একটায় তো দু’বছর হয়ে গেলো। এবারে টাকা-পয়সা কিছু বাড়াবে? বা পার্মানেন্ট করবে? তোর তো NET-ও আছে।”

অনেক উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন মা। রাজদত্তা ম্লান হেসে ঘাড় নেড়ে ‘না’ টুকু জানিয়ে দিলো।

—“টাকা-পয়সা বাড়াবে? সে হলেই হলো! কলেজে ক্লাসই কমিয়ে দিয়েছে। গত বছর লকডাউনের পর থেকেই। আগে যা ছিলো তার অর্ধেক ক্লাস এখন। স্যালারিও তো হাফ হয়ে গেছে সবকটাতেই। ভাবছি টিউশন ধরবো। কিছু ছেলে-পিলে বলছিলোও।”

—“থাক, আর টিউশন ধরিস না। তাহলে তোর নিজের পড়া হবে না। ডব্লু.বি.সি.এস.-টা লাগিয়ে দিতে পারলে আমরা নিশ্চিন্ত হই।”

কথাটা কি মা মন থেকে বললেন? না কি পরিস্থিতির চাপে পড়ে? কিন্তু যদি টিউশন না ধরে, এত খরচা পোষাবে কী করে? বাবার ওপর খুব চাপ পড়ে যাচ্ছে। দাদুর তো সাধারণ ব্যবসা ছিলো, তার সাথে কবরেজি। সে ব্যবসা বাবা ধরে রাখতে পারেননি। জ্যেঠু দেখেন পুরোটাই। দাদু জ্যেঠুর নামেই করে দিয়েছেন। কিন্তু তার থেকে লাভের ছিটেফোঁটাও দাদু-ঠাকুমা পান না। জ্যেঠুর কাছে হাত পাততেও খুব অপমানজনক লাগে। এমনিতেই দিনরাত যা কথা শোনান বাবাকে-মাকে। সাধারণ মধ্যবিত্ত হয়ে পড়ে থাকার জন্য। আর রাজদত্তাকে তো আরও বেশি— মাস্টার্স করা থেকে দু’বছর হয়ে গেলো, কোনও ভালো চাকরি জুটলো না। তার জন্য তো খোঁটা খেতেই হয় প্রায় দিনই। তাও ওঁরা আলাদা হয়ে গেছেন বলে রক্ষে। আগের মতন জয়েন্ট ফ্যামিলি থাকলে তো ঘরে টেকাই দায় হতো।

সে যা হোক, কিন্তু মা যেটা বললেন সেটাও ভাববার। টিউশন ধরলে সত্যি নিজের পড়ার সময় থাকবে না। আর না ধরলে সংসারে টানাপোড়েন। কি যে করে! এদিকে ব্যাঙ্কে ইন্টারেস্ট রেটও কমছে। শেয়ার কিনবে এমন পয়সা তাদের নেই। বাবা তো মিউচুয়াল ফান্ডের বিষয়টা ঠিক বোঝে না, না হলে ওটা করা গেলে ভালো হতো।

—“না, তুই পড়, আমি ছাতে যাই। জামাকাপড়গুলো আনতে হবে।” মা উঠে যাচ্ছিলেন। রাজদত্তা বাধা দিলো।

—“কেন? অহনাদি আনবে। তুমি বসো।”

—“ও আনবে না। একটু আগে ওবেলার রান্নার বাসনগুলো পড়ে আছে, মাজতে বললাম বলে যা কথা শোনালো। আর এই বয়েসে ভালো লাগে না বাপু। আমি যাই।”

—“আমি আনছি। তুমি বসো।”

ক্লাচার দিয়ে চুল আঁটতে আঁটতে সিঁড়ি ভেঙে ছাতে উঠে যায় রাজদত্তা। আজ প্রায় দু’তিন বালতি কাচা হয়েছে। না, হাউস হেল্পিং কাপড় কাচে না। কাচতে বললে হুমকি দেয় কাজ ছেড়ে দেবে। বিছানার চাদর, বাবার আর মা-র জামাকাপড় মা-ই কাচেন। নিজেরগুলো আর দাদু-ঠাকুমার গুলো রাজদত্তা কাচে। তার সাথে পর্দা পা-পোষ এগুলোও। বাথরুম পরিষ্কার আগে মা করতেন। একবার পরিষ্কার করতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন, তাই তারপর থেকে মাকে করতে দেয় না সে। নিজেদের দু’টো বাথরুম সে-ই পরিষ্কার করে। আউট-হাউসেরটা সুইপার দিয়ে করানো হয়। কাপড়-জামাগুলো তুলতে তুলতে ভাবে, সত্যি অহনাদি কত সুন্দর সবসময় কাজ ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। বাসন ক’টা বেশি হলে কাজ ছেড়ে দেবে, কোভিডের সময় হাত-পা স্যানিটাইজ় করতে বললে কাজ ছেড়ে দেবে, মাস্ক পরতে বললে কাজ ছেড়ে দেবে। নিজেই দেরি করে এসে সময়ে কাজ গোছাতে না পারলে খেতে দেরি হয়ে যায়— তখনও হুমকি “তোমাদের বাড়িতে একটুকু খাওয়ার সময়ও দেও না। আর এ কাজ করবো না।” সিঁড়ির কোণ ঝুলে ভরা, আলমারির পেছনে মাকড়সার জাল হয়েছে অনেক, সিলিং-এও প্রচুর ঝুল, তাতে পোকা আটকে আছে। সেগুলো ঝাঁট দেওয়ার সময় ঝাড়তে বললেও মেজাজ। বলে বলেও করাতে পারে না দেখে, এখন রাজদত্তা নিজেই করে, রোববার দেখে। আচ্ছা, অহনাদির এত রাগ-মেজাজ কীসের? মানছে, অনেক কাজ করতে হয়। কিন্তু সেটা কি তাকেও করতে হয় না? পড়াশুনোর কাজ কি খুব কম চাপের? সারাদিনে সে পাঁচ ঘণ্টার বেশি ঘুমোতেই পায় না। খুব কম দিনই ছ’ঘণ্টা হয়। মা অসুস্থ, শয্যাশায়ী, সেই অবস্থাতেও ক্লাস নিতে যেতে হয়েছে মাকে একা ফেলে রেখে। বাবাও সেদিন বেরিয়েছিলেন কাজে, হঠাৎ দরকারে। কই, তার জন্য তো কলেজ অথোরিটিকে সে মেজাজ দেখায়নি? ওঁরা ক্লাস অ্যাডজাস্ট করতে চাননি। তা সত্ত্বেও কিছু বলেনি। খুব কষ্ট হলেও সেটা নিজের মধ্যে চেপে নিয়েছিলো। কিছু বললে যে চাকরিটা চলে যাবে। তখন আর একটা চাকরি জোটানো তো চাট্টিখানি কথা নয়।

আচ্ছা, অহনাদি যে ক্ষণে ক্ষণেই এমন হুমকি দেয় “কাজ ছেড়ে দেবো”, সত্যি যদি রাজদত্তারা ওকে ছাড়িয়ে দেয়, তাহলে কী হবে? কাজ পেয়ে যাবে এত সহজে? ওর ভয় করে না, সংসার চলবে কী করে সেটা ভেবে? ... একবার ঠাকুমা খুব অসুস্থ। রাজদত্তার কলেজ। মা সকাল থেকে রান্না নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। বাবাকেও বেরোতে হবে। এদিকে ন’টা বেজে গেলো অথচ অহনাদি এল না। সেই দেখে মা অনেকবার ফোন করলেন, স্যুইচড অফ। সেদিন সারাদিন ফোন বন্ধ ছিলো। তারপরও দু-তিনদিন আসেনি। কিছু জানায়ওনি। তারপর যেদিন এল, মা শুধু বলেছিলেন, “তুমি আসলে না ক’দিন, কী হয়েছিলো?”

—“শরীর খারাপ ছিলো।” মেজাজ দেখিয়ে উত্তর দেয় অহনাদি।

—“একবার জানাতে পারতে তো। শরীর খারাপ নিয়ে আসতে বলছি না। কিন্তু ফোনে তো বলে দিতে পারতে। আমার বয়েস হয়েছে, সবদিক সামাল দিতে পারতে।”

মা এগুলো বলার জন্য অহনাদি খুব অপমানিত বোধ করেছিলো। সেদিনই কাজ ছেড়ে দিচ্ছিলো। লোক পাওয়া সমস্যা, তাই মা প্রায় হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছিলেন। কিন্তু দোষটা কি সত্যি মা’র ছিলো? এটা যদি আজ রাজদত্তা তার কলেজগুলোয় করতো? হঠাৎ করে অ্যাবসেন্ট হতো? কোনও খবর না দিয়ে, ফোন স্যুইচড অফ রাখতো তিনদিন ধরে? তাহলে তাকে আর কলেজ যেতে হতো না, টারমিনেশন লেটার বাড়িতেই চলে আসতো। এই কলেজগুলোয় তো কম হেনস্থা হতে হয়নি তাকে। একটা কলেজে যা অভিজ্ঞতা হয়েছে সে কোনওদিন ভুলবার নয়। ক্লাসে স্টুডেন্টদের ডাউট ক্লিয়ার করতে গিয়ে দশ মিনিট দেরি হয়ে গেছে, পরের টিচারের ক্লাসের দশ মিনিট নিয়ে ফেলেছে। তারজন্য কি অপমান! তাই ঠিক করলো, টিফিনে বা ছুটির পর পার্সোনালি ডাউট ক্লিয়ার করবে স্টুডেন্টদের। সেরকম করেওছিলো ক’দিন। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের লোক বললেন, সে স্টুডেন্টদের অপ্রেস করছে, হ্যাকল করছে। টিফিন খেতে দিচ্ছে না, ছুটির পরও আটকে রাখছে। এরকম করলে আর কোনও স্টুডেন্ট ভর্তি হবে না কলেজে। কলেজের রেপুটেশন খারাপ হচ্ছে। তাই হয় নিজের নিয়ম বদলাক, না হলে কলেজ ছেড়ে দিক। বাধ্য হয়ে নিজের নিয়ম বদলাল। নিজের ইমেল আইডি আর ফোন নাম্বার দিয়ে দিলো স্টুডেন্টদের। বললো, ফোনে ডাউট ক্লিয়ার করে দেবে। সেটা সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে। তাতেও শুনতে হলো, সে কলেজের স্টুডেন্ট ভাঙিয়ে টিউশনের ব্যবসা ফেঁদেছে। কিছু ফ্যাকাল্টি মিলে কয়েকজন স্টুডেন্টকে শেখালেন অনেক কিছু। টিচার-স্টুডেন্ট-অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মিটিং-এ তারা শেখানো বুলিগুলো বললো, রাজদত্তার নামে। সেই মিটিং-এ সবাই থাকলেও রাজদত্তার থাকা চলেনি। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে বলেছিলেন, যে সেমেস্টারে সে ক্লাস নেয় না সেই সেমেস্টারের স্টুডেন্টরাও তার সম্বন্ধে নেগেটিভ কথা বলছে। তার ব্যবহারে কতটা নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট পড়েছে স্টুডেন্টদের মনে! কোড অব কনডাক্ট ঠিক করুক, নয় তো কলেজ ছাড়ুক। যুক্তিগুলো শুনে সেদিন হাসবে না কাঁদবে, অপমানিত বোধ করবে না করুণা করবে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে— সেটা ভেবে পায়নি রাজদত্তা।... এগুলো সব মেনে নিতে হয় নিজের ত্রুটির ফল হিসেবেই। না হলে কী করবে? প্রতিবাদ করবে? কাজ চলে যাবে। সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখবে? তাহলে তো মানহানির মামলা শুরু হয়ে যাবে তার বিরুদ্ধে। কোর্টে কেস করবে? কিন্তু প্রমাণ দেখাবে কী করে? এটার তো পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে বোঝা যায় তেমন কোনও প্রমাণ ছিলো না। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টা দিয়ে বুঝতে হয়— যেটা লুক্কায়িতই থাকে— বোধ— মানবিক বোধ।

নিজের মনেই এতাল-বেতাল ভাবতে ভাবতে কাপড় তুলছিলো রাজদত্তা। ভাবলো একটুক্ষণ থাকবে ছাদে। কিন্তু হঠাৎ একটা চেঁচামিচির শব্দে ঝটপট নেমে এল।


(৩)

—“তুমি আমায় একমাস আগে বলবে তো? এই করোনার সময় আমি বাড়িতে নতুন লোক ঢোকাই কী করে? বাড়িতে দু’দুটো বয়স্ক মানুষ। তোমায় কতবার জিজ্ঞাসা করেছি, তখন তো কিছুই বলোনি।”

মা’র চিৎকার শুনে অবাক হয়েই কথার মাঝখানে ঢুকলো রাজদত্তা।

— “কী হলো মা?”

— “আমি কাল থেকে আর আসবো না।” মার কথা কেড়ে নিয়ে অহনাদিই উত্তর দিলো।

—“আসবে না মানে?” অবাক চোখে জিজ্ঞাসা করে রাজদত্তা।

—“একটা কাজ পেয়েছি। নার্সিং হোমে। রান্নার। অনেক বেতন। থাকার জায়গাও দেবে।”

কেউ ভালো কাজ পেয়েছে তাতে বলার কিছু নেই। সেটা মানুষ পেতেই পারে। তারা তো আর বণ্ডেড লেবারের মতো অহনাদিকে আটকে রাখছে না! কিন্তু একটু আগে জানাবে না? অন্তত একটা সপ্তাহ। আজ বলে কাল থেকে বন্ধ? রাজদত্তা আর থাকতে পারলো না। বলেই ফেললো।

—“দেখো দিদি, সবকিছুরই একটা নিয়ম আছে। আমিও যেমন অন্য জায়গায় পার্ট-টাইম চাকরি করি, তেমন তোমারও তো এটা চাকরি। আমায় চাকরি ছাড়তে হলে অন্তত তিনমাস আগে জানাতে হবে— কমপক্ষে একমাস। তুমি এরকম হুট করে বললে কী করে চলে? বলো।”

অহনাদি কোনও উত্তর দেয় না। তার এই মৌন থাকাটা বড্ডো মাথাটা গরম করে দিলো।

—“সাতটা দিন তো সময় দাও। সাতদিন পরে জয়েন করতে অসুবিধা কোথায়?”

—“না বোন, হবে না। কালই করতে হবে। আমার চেনা পরিচিত একজনের মারফত পেয়েছি এই কাজটা। কাজে কাল থেকে না গেলে ওর মুখ থাকবে না কো।”

সটান উত্তর দেয় অহনাদি।

—“দেখো অহনা, তুমি আজ প্রায় দু’বছর আছো আমাদের কাছে। এটুকু তো তোমার থেকে আশা করি যে তুমি বিশ্বাস ভাঙবে না। তোমায় যখন গতবার পুজোয় জিজ্ঞাসা করলাম তুমি বললে এখন কাজ ছাড়ছি না। ছাড়ার একমাস আগে জানাবো। তাহলে এমনটা কেন করলে?”

মা জিজ্ঞাসা করেন।

—“সে তো পুজোর সময় জানতে চেয়েছিলে। তখন কি ছেড়েছি, না কি? এই ক’মাসে তো আর কিছু বলোনি।” অহনাদি সোজা জবাব দেয়।

—“আমি কি প্রতি মাসে তোমায় জিজ্ঞাসা করবো? তুমি কবে কাজ ছাড়বে? সেটা কি খুব ভালো হয় অহনা?” মা কথার পিঠে কথা বাড়িয়েই যায়।

—“সেসব জানি না। কাল থেকে আর আসছি না। মাইনেটা দিয়ে দাও।”

রাজদত্তা আবার বোঝাতে যাচ্ছিলো, মা ইশারায় চলে যেতে বললেন। শুকনো কাপড়গুলো বালতিতে রাখাই ছিলো। ঘরে ঢোকানো হয়নি। কথাবার্তায় খেয়াল ছিলো না রাজদত্তার। বালতিসহ কাপড়গুলো ঘরে নিয়ে গিয়ে কাপড়গুলো খাটের ওপর রাখলো। মা টাকা বের করতে এসেছেন, অহনাদির মাইনের জন্য। নিজের মনে গজগজ করছেন, “কাল থেকে যে কী হবে! লোক পাওয়া মানে...!”

অহনাদির কথাগুলো শুনে কেমন যেন মুষড়ে পড়েছিলো রাজদত্তা। না, হিংসায় নয়, অসহায়তা বা ব্যর্থতায়ও নয়, ক্রমাগত বঞ্চিত হয়ে আসার যন্ত্রণায় ভীষণ জ্বলছিলো সারা শরীরটা। অহনাদির একটা কথা বড়ো নাড়া দিচ্ছিলো বারবার, “আমার চেনা পরিচিত একজনের মারফত পেয়েছি এই কাজটা।” অহনাদি কী সুন্দর নিশ্চুপে কাজ জোগাড় করে ফেললো, ভালো বেতনের। আর রাজদত্তা পারছে না কেন? রাজদত্তার চাকরিজীবন যখন শুরু হয়, তার প্রায় সম-সমকালেই ওদের বাড়ির কাজে ঢোকে অহনাদি। দু’বছরে অহনাদি কত সুন্দর কাজ ধরে ফেললো, আর রাজদত্তা সেই তিনটে কলেজেরই গেস্ট ফ্যাকাল্টি হয়ে পড়ে রইলো। অহনাদি তাকে টপকে গেলো কি শুধু ‘চেনা-পরিচিত’ লোক থাকার জন্য? অদ্ভূত এক কূপমণ্ডূক মানসিকতায় চেপে ধরলো রাজদত্তাকে। তার বন্ধু, কলিগ এদের ছেড়ে দিয়ে অহনাদিই হয়ে উঠলো তার ‘কম্পিটিটর’। যে রাজদত্তা একদিন আমেরিকা গিয়ে পি.এইচ.ডি. করার, অনেক বড়ো প্রফেসর হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলো, কয়েক মুহূর্ত আগেও যার প্রচ্ছন্ন স্বপ্ন ছিলো ডব্লু.বি.সি.এস. অফিসার হওয়ার, সে এখন সামান্য চাকরির জন্য হাহাকারে কম্পিটিটর ভাবছে অহনাদিকে!