প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ(একটি বামমার্গী ভাষ্য)
"Far from being a feudal poet, the Shakespeare that 'Troilus & Cressida', 'The Tempest,' or, even 'Coriolanus' shows us is much more a Bolshevik (using this little word popularly) than a figure of conservative romance". Wyndham Lewis, "The Lion and the Fox" [London, 1927]. p.3.
গৌরচন্দ্রিকা
[আকাদেমিক দুনিয়ার বাইরে বাংলায় শেক্সপিয়র চর্চার,(মঞ্চে এবং লেখালিখিতে) অন্যতম পথিকৃৎ এবং বিশিষ্ট নট, নাট্যকার ও পরিচালক উৎপল দত্তের ৯১ তম জন্মদিন গেল ২৯মার্চ তারিখে। আবার উইলিয়ম শেক্সপীয়রের জীবননাট্যে ২৩শে এপ্রিল তারিখটি ধরা হয় একই সঙ্গে তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিন হিসেবে। এই সামান্য প্রবন্ধটি ওঁদের দুজনের প্রতি আমার বিনীত শ্রদ্ধাঞ্জলি মাত্র]
বর্তমান প্রবন্ধটি মহাকবি শেক্সপীয়রের রচনার কোন একাডেমিক চর্চা বা মূল্যায়নের প্রচেষ্টা নয়, সে যোগ্যতাও আমার নেই। এ শুধু বিশ্বজোড়া ভুমন্ডলীকরণ এবং নব-উদারবাদী অর্থনীতির বোলবোলাওয়ের দিনে আমার মত এক প্রাক্তন বামরাজনৈতিক কর্মীর নিজস্ব শেক্সপীয়র পাঠ; একান্তই আমার ভালোলাগাটুকু বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার প্রয়াস। তাই এই ছোট পরিসরে আমি সংক্ষেপে ওঁর কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইশারা করব।
প্রথমতঃ আমরা মধ্য যৌবনে শেকসপিয়রকে অন্যভাবে পড়ার আগ্রহ পেয়েছিলাম উৎপল দত্তের “শেক্সপিয়রের সমাজচেতনা” বলে বইটি হাতে পেয়ে। কোলকাতার অধ্যাপককুল সেই বইটি নিয়ে কিঞ্চিৎ নাক সিঁটকে ছিলেন। পরে আমার বন্ধু সাংবাদিক প্রণয় শর্মা আমাকে দেখিয়েছিলেন যে ওই বইটিতে ‘যীশু” এবং “ধর্ম” অধ্যায় দুটিতে জার্মান কমিউনিস্ট কার্ল কাউটস্কির ১৯০৮ সালে প্রকাশিত ‘ফাউন্ডেশন অফ ক্রিশ্চিয়ানিটি”র প্রভাব বেশ প্রকট।
তাতে অবশ্য বইটির উপস্থাপনায় কোন তফাৎ হয়নি। আমার এই অকিঞ্চিৎকর লেখায় মৌলিক চিন্তার বদলে উৎপল দত্ত সমেত সমসাময়িক বামমার্গী সাহিত্য সমীক্ষক গারেথ জেঙ্কিস -- ‘শেক্সপিয়র বিলংস টু আস’(২০১৬)-- এবং টেরি ইগলটন এর মত দিকপাল মার্ক্সিস্ট সাহিত্য সমালোচকদের প্রভাব। তাই এই প্রবন্ধে যদি কিছু ভাল আর্গুমেন্ট থাকে তার কৃতিত্ব ওঁদের। আর দুর্বল বা টেনে মানে করার ক্ষেত্রে বুঝতে হবে আমি কতটা ছড়িয়েছি।
মার্ক্স, এংগেলস, জেনি মার্ক্স ও শেকসপিয়র
দুই বন্ধু, মার্ক্স ও এংগেলস মুগ্ধ ছিলেন শেক্সপিয়রের কলমে সাদামাটা একমাত্রিক স্টেনসিল চরিত্রের বদলে বহুস্তরীয় দ্বন্দ্বে দ্বিধাদীর্ণ মানুষের চিত্রণে। এদিক ওদিক চিঠিপত্রে ওঁরা একাধিকবার উল্লেখ করেছেন ‘টিমন অফ এথেন্স’ নাটকে প্রায় সর্বস্বান্ত টিমনের সোনা নিয়ে বৈপরীত্যের বিখ্যাত স্বগতোক্তি।১৮৭৭ সালে জেনি মার্ক্স ইংল্যান্ডের লাইসিয়াম থিয়েটারে হেনরি আর্ভিংএর রিচার্ড দি থার্ড অভিনয়ে বাঁধাধরা ভিলেন এর স্টেনসিল থেকে আলাদা বুদ্ধিদীপ্ত চিত্রণে মুগ্ধ হয়ে রিভিউ লিখেছিলেন। মার্ক্সের জীবনীকার ফ্রাঞ্জ মেহরিং জানিয়েছেন মার্ক্সের গোটা পরিবার ভুগত ‘শেক্সপিয়রফোবিয়া’তে।
এছাড়া গত শতাব্দীর গোড়া থেকে সেসময়ের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ও পরিচালক বের্টল্ট ব্রেখট ও ছিলেন শেক্সপিয়রভক্ত। শুধু ‘করিওলেনাস’ নয় অন্য কয়েকটি নাটককেও নতুন করে গড়ে তোলার বারবার পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন।
সে যাই হোক, গোদা বাংলায় আমার বক্তব্যের মোদ্দা কথাটা হল শেক্সপীয়র ছিলেন ওঁর যুগের ,মানে এলিজাবেথান যুগের, জনতার কবি।
যদিও মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গীর সাহিত্য সমালোচকেরা এ’ব্যাপারে দুই বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে একদল যান্ত্রিক ভাবে মার্ক্সের অর্থনীতিকে ভিৎ এবং শিল্পসাহিত্যকে ওপরের তলা, তথা এগুলো আর্থিক সম্পর্কের নিগড়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা গোছের যান্ত্রিক বিশ্লেষণে মগ্ন হয়ে ভাবতেন-- যেহেতু শেক্সপিয়রকে প্রগতিশীল হতে হবে , অতএব ওনাকে উঠতি বুর্জোয়ার প্রতিনিধি ধরতে হবে। কারণ ইতিহাসের বিচারে এলিজাবেথান ইংল্যান্ডে সামন্ততন্ত্র প্রতিক্রিয়াশীল এবং উঠতি বণিকপুজি হল প্রগতিশীল। অতঃ শেক্সপিয়র হলেন রেনেসাঁর এবং উঠতি বুর্জোয়ার প্রতিনিধি। ওঁরা উদাহরণ দেবেন মার্চেন্ট অফ ভেনিসের, কমেডি অফ এরর্সের এবং এই জাতীয় কিছুর। এযেন শার্টের গায়ে বোতাম লাগানোর বদলে হাতে একটা গোটা বোতাম পেয়ে তাতে শার্ট সেলাই করে দেয়া।
জীবননাট্যের কিছু প্রস্থানবিন্দুঃ
উইলিয়ম এসেছিলেন হ্যাভন নদীর তীরের স্ট্র্যাটফোর্ড নামের একটি অনামী গ্রামের সাধারণ পরিবার থেকে ।
পিতা জন শেকসপীয়র ছিলেন একজন সফল কারিগর। কিঞ্চিৎ সম্পত্তি অর্জিত করে চাইছিলেন সমাজের উঁচুতলায় উঠতে; আবেদন করেছিলেন ‘কোট অফ আর্মস’ পেতে। এই সাপসিঁড়ি খেলায় ব্যর্থ হন। কিন্তু ছেলে উইলিয়ম তাঁর সেই বাসনা পূর্ণ করেছিলেন। নিজে গ্লোবের নিয়মিত ভাল অভিনেতাদের একজন। তারপর সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ক্রমশঃগ্লোব থিয়েটারের মালিকানার অংশীদারি ছাড়াও নদীর পাড়ে বেশ কিছু জমিজমার মালিক হওয়া। দুনিয়াদারির ঘাঁতঘোঁত ভালই বুঝতেন। তাই রাণী এলিজাবেথের কড়া শাসন ও নাটক নিয়ে সেন্সার এবং জেল তথা মুন্ডচ্ছেদের সময়েও ধরি-মাছ, না-ছুঁই-পানি ভালই চালিয়ে গেছলেন।
ভাষাতেও অসামান্য দখল এবং বৈপরীত্য। কবিতায় সনেট ও ব্ল্যাংক ভার্সে পটুত্বের সঙ্গে নিজস্ব ছাপ। নাটকীয় গদ্য লেখার ও কাব্যময় সলিলোকিতে একমেবাদ্বিতীয়ম। চরিত্রের সৃজন ও তাদের মুখে সঠিক ভাষাশৈলীর প্রয়োগ—সে জেন্টলম্যানের হোক কি শুঁড়িখানার মাতালের বা ভবঘুরের। একদিকে ‘ টু বি অর নট টু বি’ বা ‘ হোয়াট ইজ ম্যান’ এর দার্শনিকতা, অন্যদিকে কমেডি অফ এরর্স ও মিডসামার নাইট’স ড্রিমএর বটম তাঁতি ও তার সাথিদের ভাঁড়ামি; শেক্সপিয়রে এই দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্যের সহাবস্থান।আজ সাড়ে চারশ’ বছর পরে তাঁর লেখা কেন আপন লাগছে?
মননের দিক থেকে তিনি ছিলেন সে’ সময়ের জনতার প্রতিনিধি। আত্মসাৎ করেছিলেন তাদের মুল্যবোধ ও রুচি। এখানেই তিনি তাঁর সমসাময়িক অন্য নাট্যকারদের – যেমন, বেন জনসন, এডওয়ার্ড মার্লো—থেকে স্বতন্ত্র। ওঁরা ছিলেন অভিজাত পরিশীলিত রুচির। তাই জনসন অনায়াসে শেক্সপীয়েরের লাতিন এবং গ্রীক সাহিত্যের সঙ্গে অপরিচয়ের কথা বলে খোঁচা দিতে একটুও ইতস্ততঃ করেন না, যদিও উইলিয়ম তাঁর গ্রামার স্কুলে গ্রীক-লাতিন সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
আসলে তাঁদের চোখে মহাকবি একটু গ্রাম্য রুচির। অনেকবার তাঁর চরিত্রদের ঠাট্টাতামাশা ভদ্রলোকের কানের পক্ষে মাত্রাছাড়া লাগে।
শুধু ফলস্টাফের ভাঁড়ামো নয় , রোমিও জুলিয়েটের একটি দৃশ্য দেখুন।
চজুলিয়েটের বয়স নিয়ে ওর মা এবং ধাইমার আলাপে। বৃদ্ধা মহিলাটি নিজের প্রয়াত স্বামীর রগুড়ে স্বভাবের কথা তুলে বলে-- ছোট্ট জুলি যখন পড়ে গিয়ে কপাল ফুলিয়ে কাঁদছিল তখন আমার কত্তাটি ওকে ভোলাতে গিয়ে বলে –এখন ছোট্টটি, তাই উপুড় হয়ে পড়েছ, যখন ডাগর হয়ে উঠবে তখন চিৎ হয়ে পড়বে।
“Won’t you Jule?
‘Aye’, quoth she.”
প্রশ্ন ওঠে, ডক্টর জনসন কি সেই ১৭৬৫ সালেই বলেননি যে শেক্সপীয়রের রচনা অগভীর, শুধু আনন্দলাভের জন্যেই পাঠ করা যায় , তার বেশি নয় ? এ বিষয়ে ডক্টর জনসন ও যাঁরা কেবল আনন্দলাভের জন্যে শেক্সপীয়র পাঠের কথা বলেন, এবং ব্র্যাডলির মত সমস্ত বিদগ্ধ অধ্যাপককুল, অর্থাৎ যাঁরা শেক্সপীয়রকে তাঁর সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেবল মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দিতে চান, তাঁদের নমস্কার করে আমি সবিনয়ে অন্য মত পোষণ করতে চাই ।
শেক্সপীয়র পড়ব শুধু আনন্দ বা মজা পেতে? মানে প্রেম? তলোয়ারবাজি? প্রেতাত্মা? রোমান্স এবং ভাঁড়ের ভাঁড়ামো ? মহাকবি নিজে এ ব্যাপারে কী বলেছেন শোনা যাকঃ
"Though it makes the unskillful laugh, cannot but make the judicious grieve". Hamlet (III, 2).
আরেকটি প্রশ্নঃ কীভাবে বুঝব কোনটি নাট্যকারের নিজের মত , আর কোনটি একান্তভাবে নাটকের চরিত্রটির? নিশ্চয়ই ওথেলো নাটকের শয়তান ইয়াগোর উক্তি শেক্সপীয়রের বলে ধরে নেব না ? তাহলে? কঃ পন্থা?
অধ্যাপক আর্থার সিটওয়েল তাঁর "Character and Society in Shakespeare" [Oxford, 1951] বইয়ে একটি পথ বাতলেছেন। উনি বলছেন যদি মুখ্য চরিত্রের মুখে একটি আইডিয়া বারবার, এমনকি নানান বিপরীত পরিস্থিতি ও পরিবর্তিত সময়েও, শোনা যায় তাহলে সেটা রচয়িতার নিজের চিন্তা বলে মানতে বাধা কোথায়? তেমনই যেটা উনি বারবার ভিলেনের মুখে বসিয়েছেন সেটা নিশ্চয়ই ওনার অপছন্দের স্বর?
কিন্তু যদি ওই জনরুচির তাগিদে তলোয়ারবাজি, প্রেতাত্মা,এবং স্থুল রসিকতাতেই শেক্সপীয়র আটকে থাকতেন তাহলে তাঁর রচনা কালোত্তীর্ণ হত না, কিছুতেই না । উনি খুব বেশি হলে সেকালের জনপ্রিয় আমুদে নাট্যকার হতেন যার রচনা দু’তিন দশকের পরে মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই ভুলে যায় । কিন্তু উনি একইসঙ্গে যুগের হয়েও ছাড়িয়ে গেছেন নিজের সময় ও সমাজকে। জনরুচিকে উপেক্ষা না করলেও তার গোলামি করেননি। প্রশ্ন করেছেন প্রচলিত মূল্যবোধকে, বারংবার।
আসুন, আমরা তাঁর লেখা থেকে তেমনই কিছু ধারণাকে—ধরুন, বাজার, মুনাফা, সমুদ্রযাত্রা, নারী এবং অল্পসংখ্যক সম্প্রদায় ইত্যাদিকে মহাকবির যুগ, কালখন্ড এবং সমাজের প্রেক্ষিতে নেড়েচেড়ে দেখি।
এলিজাবেথীয় যুগ
আমাদের মানসে রাণী এলিজাবেথের রাজত্বকাল ও ইংল্যান্ডের রেনেসাঁ বা নবজাগরণ একাকার হয়ে আছে। এবং শেক্সপীয়র হলেন সেই নবজাগরণের কবি ও নাট্যকার, যেমন দান্তে অলিঘিয়েরি হলেন ইতালীয় নবজাগরণের মুখপাত্র। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলে এই বহুপ্রচারিত সযত্নে লালিত ধারণাটি ধাক্কা খেতে বাধ্য।
আমরা জানি যে রেনেসাঁ হল মধ্যযুগের অন্ত, নতুন করে গ্রীক-লাতিন ক্লাসিক্স পড়ার ঝোঁক, এবং ফলে চিন্তা ও বিচারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরবাদের জায়গায় মানুষের জয়গান। কিন্তু এই ধারার মুখপাত্র তো আসলে বেন জনসন, মার্লোর মত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী এলিট নাট্যকারেরা, আর শেক্সপীয়র তো ওই দুনিয়ার লোক ন’ন। জনসনের উক্তি- উনি লাতিন ও গ্রীক বিশেষ জানতেন না !
আর ভাবনার জগতে এই বিপ্লব তখনকার আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোয় কতটুকু ছাপ ফেলেছিলো?
ভুললে চলবে না যে এলিজাবেথীয় যুগ একই সঙ্গে ‘কর্ন ল’ বা শস্য আইন জারি হওয়ার যুগ বটে! ওই কানুনের ফলে প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র চাষির দল নিজেদের জমি থেকে উৎখাত হয়ে শহুরে মজুর এবং ভবঘুরে হয়ে গেল। কারণ তাদের ছোট ছোট ক্ষেতগুলো জুড়ে তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল ভেড়াপালন খামার। কাপড়ের মিলমালিকদের উলের চাহিদা পূরণ করতে হবে যে ! এভাবেই ক্ষয়িষ্ণু জরদ্গব সামন্ততন্ত্রের কবরের উপর গজিয়ে উঠেছিল ‘মার্কেন্টাইল ক্যাপিটালিজম’ বা নব্য বণিকতন্ত্রের সৌধ।
[ কোথাও আজকের ভারতবর্ষের কৃষিবিতর্কের ছায়া টের পাচ্ছি কি?]
শেক্সপীয়রের নাটক হল সেই বিশাল পরিবর্তনের ছবি, তার জীবন্ত দলিল---ঠিক যেভাবে তিন শতাব্দী পেরিয়ে লেনিনের চোখে তলস্তয়ের সৃজন সমাজবিপ্লবের ডাক না দিলেও সমাজের বিশ্বস্ত আয়না বলে ধরা দিত, অথবা মার্ক্স বালজাকের উপন্যাসে পুঁজিবাদী নরকের আগুন দেখে শিউরে উঠতেন।
অথচ মার্ক্সবাদের যান্ত্রিক ব্যাখ্যায় শেক্সপীয়রকে জোর করে বিপ্লবী বানাতে গিয়ে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে নবাগত পুঁজিবাদ বা বণিকবাদের মুখপাত্র ধরে নেওয়া হয়েছে। সাক্ষ্য হিসেবে দেখানো হয় ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’। তাতে কি সাগর পেরিয়ে নতুন দেশে গিয়ে ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’ মন্ত্রের আরাধনা করতে বলা হয়নি?
ধর্মাবতার, উই বেগ টু ডিফার। আবারও বলছি , শেক্সপীয়র নন’ –উদীয়মান পুঁজিবাদের চারণকবিরা হলেন মার্লো, জনসন, গ্রীন, মেসিঙ্গার, ও বোমন্ট এবং ফ্লেচার।
বণিকবাদঃ শেক্সপীয়র বনাম অন্যেরা
আমরা জানি যে বণিকবাদের পহচান বা হলমার্ক হচ্ছে-- সামুদ্রিক বাণিজ্য, নতুন নতুন দেশের এবং বাজারের খোঁজ, এবং দিন- দোগুণী, রাত- চৌগুণী মুনাফা। রাণী এলিজাবেথের ইংল্যান্ড তখন সাম্রাজ্যের সীমানা বাড়িয়ে এমন করতে ব্যস্ত ‘যেখানে সূর্য অস্ত যায় না ‘। তাই জাতীয় সংগীত হলঃ
" Britania! Rules Britannia.
Britannia rules the waves."
এবার দেখুন, গ্রীনের ‘অর্ল্যান্ডো’ নাটক ঘটিত হচ্ছে আফ্রিকায়, মার্লো’র ‘ট্যাম্বারলেইন’ এশিয়ায়, ম্যালিগ্নারের ‘রেনেগাদো’ টিউনিসে, বোমন্ট-ফ্লেচারের ‘ আইল্যান্ড প্রিন্সেস’ ঘটছে পর্তুগালের মশলা দ্বীপে। কিন্তু আমাদের শেক্সপীয়র তাঁর বিপুল রচনায় সহজে ইউরোপের বাইরে পা ফেলেন না । এমনকি ঊনি শুধু ইংল্যান্ডেই স্বচ্ছন্দ, ইতালিতেও নয়। নইলে কোন ভূগোলের হিসেবে মিলান থেকে জাহাজ ছাড়ে(টেম্পেস্ট)? বা বোহেমিয়ায় নোঙর ফেলে? এটাও সবাই জানে যে হ্যামলেট নাটকে প্রিন্স অফ ডেনমার্কের গল্প বললেও সেটা আসলে রূপকের আড়ালে তাঁর সমসাময়িক ইংল্যান্ডেরই কথা । যে কারণে পুশকিনের “ক্যাপটেইন’স ডটার” উপন্যাস আসলে সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী পুগাচেভের বন্দনায় লেখা উলটপুরাণ। ধড়ের থেকে মুন্ডু খসে পড়ার ভয় সব যুগেই থাকে; সেসব যুগে আরও বেশি।
ঊনি একবারই ইউরোপের বাইরে পা রেখেছিলেন, ওথেলো নাটকে সাইপ্রাসে। বোঝা যায় উথালপাথাল সমুদ্রের ঢেউয়ে জাহাজে চড়ে বিদেশযাত্রা ওঁর খুব একটা পছন্দ নয় । কলম্বাস বা ম্যাগেল্লানের আবিষ্কার, ১৫০০ সালে ব্রেজিলের খোঁজ –এসবের কোন কিছুই ওঁর লেখায় নেই । চ্যাপম্যান তাঁর ‘ইস্টওয়ার্ড হো’ নাটকে এবং জনসন তাঁর ‘ এভরিম্যান ইন হিজ হিউমার’ নাটকে সগৌরবে উল্লেখ করছেন স্যার ফ্রান্সিস ড্রেকের ‘গোল্ডেন হাইন্ড’ জাহাজে চড়ে বিজয়পতাকা ওড়ানো যা তখন ছিল পুঁজিবাদের অজেয় শক্তির প্রতীক। কিন্তু এর কোনকিছুই শেক্সপীয়রকে প্রেরণা দেয়নি।
আমাদের মতে, এই যে সোনার খোঁজে মুনাফার লালসায় দিকে দিকে নৌ- অভিযান তা’ শেক্সপীয়রের না-পসন্দ ।
পেরিক্লিস নাটকের দৃশ্য দুইয়ে শুনতে পাইঃ সমুদ্রযাত্রায় শান্তি নেই । আকাশ থেকে বজ্র নামে, সাগরের অতলে তলিয়ে যায় বাণিজ্যপোত, এভাবেই আমাদের রাজপুত্র সর্বস্বান্ত হলেন।
উইন্টার্স টেল নাটকে ক্যামিল্লো রাজকুমার ফ্লোরিজেলকে বলে সাগরে না যেতে। টেম্পেস্টে শান্ত গঞ্জালো আফসোস করে বলে মরতে হলে ডাঙায় মরব, জলে ডুবে কেন ?
এবার মার্চেন্ট অফ ভেনিস নাটকে মুনাফার ছবিটি কেমন দেখা যাক। সেইসময়ে সমাজে ব্যবসায়ী ও বণিককুলের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ছিল সন্দেহ নেই । এই নাটকের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে পারস্পরিক সন্দেহ, গলাকাটা প্রতিযোগিতা, নগ্ন লোভ এবং মানবমূল্যের অবনমনের ছবি। শেয়ারবাজারের অনিশ্চয়তা এবং মুনাফার ঝুঁকি কেড়ে নিচ্ছে রাতের ঘুম। আন্তনিওর বন্ধু সালেরিও এবং সোলিনিওর কথাবার্তা শুনুনঃ
"Your mind is tossing in the ocean" এবং " Believe me Sir, had I such venture forth, the better part of my affection would be with my hopes abroad.
পুঁজিবাদী সমাজে প্রেম? ব্যাসানিও এবং পোর্শিয়ার প্রেম? হাসালেন মশাই। বন্ধু আন্তোনিওকে ব্যাসানিও চুপি চুপি জানায় যে বেহিসাবী খরচায় ও দেউলে হয়ে গেছে। সম্পত্তি গেছে ভোগে, আকন্ঠ ধারে ডুবে সম্মান যায় যায় । উপায়? অগাধ ধনসম্পত্তির মালকিন বেলমন্টের পোর্শিয়াকে বিয়ে করা । [Merchant of Venice, I, 1,122 and 161]
শুধু এইই নয়, নারীকে পণ্যদ্রব্য (কমোডিটি) হিসেবে দেখা পুঁজিবাদী ধ্যানধারণায় স্বাভাবিক। তাই ব্যাসানিও’র চোখে পোর্শিয়া হলেন একটি লোভনীয় বস্তু, উনি অনায়াসে স্বয়ংবরা পোর্শিয়ার পাণিগ্রহণে তিন প্রার্থীর মধ্যে প্রতিযোগিতাকে বর্ণনা করেন বণিকদের মধ্যে লুটের মাল ভাগাভাগি হিসেবে। প্রেমই বটে! এক্কেবারে টুরু লাভ।
এবার দেখুন, পুঁজিবাদের গতিপ্রকৃতির সবচেয়ে গহন ভাষ্যকার মার্ক্সের চোখে শেক্সপীয়রের সময়ে বণিকতন্ত্রের জন্মলগ্নের ছবিটি কেমন ছিল। কেমনভাবে বর্বরের মত শিল্পী কারিগর ও লঘু উৎপাদকদের লুঠ করে পুঁজিবাদের ভিত্তি তৈরি হচ্ছিল।
"--- under the stimulus of passions, the most infamous, the most sordid, the pettiest, the most meanly odious". Karl Marx: Capital (New York, 1906), Part VIII, P. 835-836 [Footnote]
টিমন অফ এথেন্সেও প্রায় একই ভাষায় অভিশাপ বর্ষিত হয় লোভ, সম্পত্তি, সোনা ও মুনাফাখোরির উপর। আপেমান্তুস এক বণিককে বলে যে ব্যবসা হল তোমাদের ভগবান। এই ভগবানই তোমাদের জাহান্নমে পাঠাক।টিমন চোরেদের সোনা বিলিয়ে দিয়ে বলেন—যাও, এবার সবার গলা কাটো আর গোল্লায় যাও।
টিমনের চোখে সোনা হল অমিতশক্তিধর। বানিয়া সমাজে সোনা সব জিনিসকে তার বিপরীত বস্তুতে বদলে দিতে পারে । যেমন, সোনা (পড়ুন টাকা) থাকলে সবচেয়ে কুৎসিত পুরুষ হয়ে যায় সবচেয়ে রূপবান। কারণ সে অর্থের জোরে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে কুক্ষিগত করতে পারে। ঠিক যে ভাবে সবচেয়ে রোগাপ্যাংলা লোকও টাকার জোরে বাউন্সার রেখে হয়ে ওঠে শক্তিমান।
Timon of Athens, I, 1, 237; IV, 3,443; III, 6, 97; and IV, 1, 8.
কী করে ভুলব আলবানির সেই ভবিষ্যবাণী যাতে উনি নবযুগের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলছেন – যখন মানুষ মানুষকে ছিঁড়ে খাবে? King Lear, IV, 2, 46.
শেক্সপীয়রের চোখে নারীঃ
আচ্ছা, আজকাল যে নারী-স্বাধীনতা বা লিঙ্গসাম্য নিয়ে এত কথাবার্তা, কল্পনা করুন তো সাড়ে চারশ’ বছর আগে কী ভাবতেন মহাকবি? ধরুন লাভ-জিহাদ নিয়ে ?
আমার ভাবতে ভাল লাগে যে আমার (এবং আরও অগণিত মানুষের) প্রিয় কবি ও নাট্যকার এ’ব্যাপারে যুগের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন । তাঁর সমসাময়িক সমাজের চোখে প্রশ্নটি অবান্তর । এ নিয়ে প্রচুর সাক্ষ্য বর্তমান। পাদ্রীদের মুখ থেকে নারী -নরকের-দ্বার বা শয়তানের দূতী গোছের ফতোয়া আকছার শোনা যেত। বাইবেলে দেখুন-আপেল খেলেন আদম ঈভ দুজনে, দোষী সাব্যস্ত হলেন একা ঈভ। আদম যেন এক অপাপবিদ্ধ কিশোর যাকে ফুসলে পাপের পঙ্কিল পথে টেনে নামিয়েছে ঈভ।
কিন্তু কবি নিজে কী ভাবতেন?
ওঁর অনেক নাটকে পিতা-পুত্রী মুখোমুখি, এবং মেয়েটি প্রশ্ন তুলছে--‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার’?
নাটকের নাম ‘মিড সামার নাইটস’ ড্রীম’। মেয়ে হার্মিয়ার পছন্দের ছেলে লাইসান্ডারকে নাকচ করেছেন বাবা। তাঁর চোখে কন্যা হল তাঁর সম্পত্তি, জমিজমা, গয়নাগাটি বা টাকাপয়সার মত । এসব তিনি যথাসময়ে সুযোগ্য জামাইবাবাজির হাতে তুলে দেবেন, যেন খপ- পঞ্চায়েত বসেছে। তাঁর ফরমান শুনুনঃ
"And she is mine; and all my right of her
I do estate into Demetrius".
আর মেয়েটি ভাবছে: "O hell! To choose love by another's eyes."
নাটকের শেষে হার্মিয়া বিজয়ী হয় এবং মনের মানুষকে বিয়ে করে ।
ওথেলো নাটকে নায়িকা ডেসদেমোনার বাবা ব্রাবান্তসিও ওথেলোর নামে অপহরণের কেস করেন । কিন্তু আদালতে দাঁড়িয়ে ডেসদেমোনা বলেনঃ
"I am hitherto your daughter; but here's my husband,
And so much duty as my mother show'd
To you, preferring you before her father,
So much I challenge that I may profess
Due to the Moor, my Lord."
(Othello, I, 3, 185)
‘কমেডি অব এরর্স’ নাটকে আদ্রিয়ানা লিঙ্গসাম্যের দাবি তোলে: "Why should their liberty than ours be more?" (II, I)।
জুলিয়েট বাবার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতে দোনোমোনো করে বাবার কাছে বকুনি খায়। ‘মারচেন্ট অফ ভেনিস’ নাটকে জেসিকা কাপড়চোপড় গয়নাগাটি নিয়ে মায়কা থেকে পালিয়ে দয়িতের সাথে মিলিত হয় । নাট্যকারের পক্ষপাতিত্ব জেসিকার প্রতি প্রকট, সূদখোর বাবা শাইলকের জন্যে ঝরে পরে অবজ্ঞা ও সামান্য করুণা। ‘হ্যামলেট’ নাটকের অফিলিয়াকে বাবা পোলোনিয়াস আচ্ছা করে কড়কে দেন , কারণ ও বাবার পছন্দকে অগ্রাহ্য করে পাগলাটে রাজকুমার হ্যামলেটের প্রেমে পাগল। টেম্পেস্টের প্রসপেরো মেয়ে মিরান্দার জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকারকে তাচ্ছিল্য করে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করেন। কিন্তু শেষপর্বে মেয়ের পছন্দকে স্বীকৃতি দিয়ে পাঠকের চোখে মহান হয়ে ওঠেন।
‘মেরি ওয়াইভস অফ উইন্ডসর’নাটকে বিবাহিত মহিলারা দল পাকিয়ে রাজদরবারের বিদূষক ফলস্টাফকে মেয়েবাজির জন্যে ভাল করে উত্তমমধ্যম দেন। রাজার বয়স্য বলে লুজ -ক্যারেকটারটি রেহাই পায় না
[।আমার মনে হয় দীনবন্ধু মিত্রের ‘কমলে কামিনী’ নাটকে হলধর বলে চরিত্রটি, পদে মন্ত্রী স্বভাবে স্থুল রসিকতায় ডগোমগো মেয়েবাজ এবং পরিণতিতে মেয়েদের হাতে উত্তম মধ্যম পাওয়া, ফলস্টাফের আদলে তৈরি।]
শেকসপীয়র এবং থিয়েটার
থিয়েটার সমস্ত যুগেই ক্ষমতার সমালোচনা করেছে এবং প্রতিবাদের মঞ্চ হয়ে উঠেছে। শাসকেরাও তাই যুগে যুগে থিয়েটারকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছেন। বর্তমান সময়ও তার ব্যতিক্রম নয় ।
ইংল্যান্ডে ক্রমওয়েল বিপ্লবের পর পিউরিটানরা ক্ষমতায় এসে এক অর্ডিন্যান্স জারি করে সবরকম থিয়েটারকে নিষিদ্ধ করলেন। ফিলিপ স্টাবসের চোখে থিয়েটারই হল বেশ্যাবৃত্তি ও বিকৃতির মূল। টমাস হোয়াইট লন্ডনে প্লেগের জন্যে দায়ী করলেন থিয়েটারকে। গসন এবং নর্থব্রুক থিয়েটারকে আখ্যা দিলেন শয়তানের আখড়া যেখান থেকে মেয়েরা শেখে বেশ্যাবৃত্তি,( ১৫৭৮ থেকে ১৫৮৩ নাগাদ প্রকাশিত বিবিধ প্রবন্ধ ও বক্তৃতামালা)।
রাণী এলিজাবেথ- প্রথম স্বয়ং থিয়েটারের অনুরাগী ছিলেন । সাধারণ মানুষ থিয়েটারের নামে পাগল। তাতে কি ? ক্ষমতাশালী লর্ড মেয়র হরদম বখেড়া খাড়া করতেন। টমাস ন্যাশের ‘আইল অফ ডগস’ নাটক নিষিদ্ধ হল। ওতে নাকি রাজদ্রোহমূলক ডায়লগের বাড়াবাড়ি! অভিনেতাদের জেলে পোরা হল।
বেন জনসনের মত নাট্যকারকেও হাজতবাস করতে হয় । ‘ইস্টওয়ার্ড হো!’ নাটক নিষিদ্ধ হয় এবং নাট্যকার চ্যাপমান কারারুদ্ধ হন। শেক্সপীয়রকেও বাধ্য করা হয়েছিল ‘রিচার্ড দ্বিতীয়’ নাটকে রাজার সিংহাসনচ্যুত হওয়ার দৃশ্যটি বাদ দিতে ।গোড়ায় ফলস্টাফ চরিত্রটির নাম ছিল ‘ওল্ডক্যাসল’, কিন্তু সেন্সরের চাপে শেকসপীয়র বাধ্য হলেন বদলে দিতে, --একেবারে ‘পদ্মাবতী’ থেকে ‘পদ্মাবৎ’ কেস।এরকম উদাহরণ আরও আছে।
শেকসপীয়রের প্রাসংগিকতা
আজকে সাড়ে চারশ’ বছর আগের শেকসপীয়র কতটা প্রাসংগিক? বা আদৌ প্রাসংগিক কি?উনি কি ইতিমধ্যেই সযত্নে জাদুঘরে রক্ষিত একটি পুরাতাত্ত্বিক বস্তু হয়ে যান নি? মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো মোটা মোটা রচনাবলীর মধ্যে মুখ লুকোননি?
আমার কাছে শেকসপীয়রের চরিত্রগুলো আজ আমার মত সাধারণ ছাপোষা মানুষের অনেক বেশি কাছের, ইদানীং যেন ওদের আরও ভাল করে চিনতে পারছি ।তাই ওরা আজকের ভারতে বৃটেনের চেয়েও বেশি প্রাসংগিক বলে আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত।
যখনই আমি বিশ্ববাণিজ্য ও গ্লোবালাইজেশনের বন্দনা শুনি বা নব-উদারনীতিবাদের ভাট ও চারণদের গাথায় এই আশ্বাসবাণী ধ্বনিত হয় যে কীভাবে মুক্ত ব্যাপার এবং ব্যক্তিগত বিদেশি পুঁজি (এফ ডি আই) এলে আমাদের সব জ্বালা-যন্ত্রণা জুড়োবে, তখনই আমার মগ্নচৈতন্যে মুনাফা ও বল্গাহীন লোভের ভয়াবহ পরিণামের বিষয়ে মার্চেন্ট অফ ভেনিসের সাবধানবাণী গুরু গুরু রবে বেজে ওঠে।
যখন দৈনিক পত্রিকায় ‘অনার কিলিং’, খপ-পঞ্চায়েতের ফয়সালা, ‘লাভ-জিহাদের’ নির্মমতা বা সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ যুগলের আত্মহত্যার খবর পড়ি তখন আমার সামনে অভিনীত হয় ‘রোমিও জুলিয়েট’, ‘মিডসামার নাইটস’ ড্রিম’ এবং ‘অবশ্যই ‘ওথেলো’।
এভাবেই অল্পসংখ্যক সমুদায়ের মানুষজনের উপর ধর্ম, পোশাক, খাদ্যাখাদ্য নিয়ে অপমান ও হিংস্র আক্রমণের খবরে দেখি ‘ওথেলো ‘ ও ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিসে’র পুনরাভিনয়।আমার কানে বাজে শাইলকের মার্মিক আবেদন ও অভিযোগ--" Hath not the Jews eyes and ears?"
মার্চেন্ট অফ ভেনিসের আপাত খলনায়ক শাইলকের ওই দীর্ঘ মনোলগের মতন অল্পসংখ্যকের পক্ষে এমন শক্তিশালী বয়ান সাহিত্যে অন্ততঃ আমার চোখে পড়েনি।
আর রাজনীতিবিদদের নিয়ে ঘোড়া কেনাবেচা, শিবিরবদল, গুপ্তহত্যা, ক্ষমতা দখল, প্রজা খেপিয়ে বিদ্রোহ? একেবারেই হাতড়াতে হবেনা,-- লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ম্যাকবেথ, হ্যামলেট, জুলিয়াস সীজার, করিওলেনাস ও টিমন অফ এথেন্স। রাজাদের নিয়ে একগুচ্ছ ডার্ক নাটক, যেমন রিচার্ড দ্য থার্ড এবং কিছু ডার্ক কমেডি।
এতসব লেখার পর একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি—তাহলে কি সাড়ে চারশ’ বছর পরেও মানুষ একটুও এগোয়নি?
[পাদটীকাঃ আমি জানি যে এই বামমার্গী শেকসপীয়ার -পাঠ অধ্যাপককুলে সমাদৃত নয়। কিন্তু এই ব্যাখ্যাটিও তো অনেক সম্ভবপর ব্যখ্যার একটি হতে পারে। সেই প্রত্যয়ে লেখাটি পেশ করলাম।]