পথে প্রান্তরে - সুতপা পাত্র
Posted in পথে প্রান্তরে
পথে প্রান্তরে
বনপাহাড়ির দেশে
সুতপা পাত্র
‘In the name of God, stop a moment, cease your work, look around you’ - Leo Tolstoy
শুধু ‘cease your work, look around you’ নয়, মাঝে ‘take your backpack’ জুড়ে দিলে মন্দ হয়না। সত্যিই প্রতিদিনের একঘেয়ে জীবনযাত্রার ফাঁকে কখনো কখনো দরকার একটু বিরতি নেওয়ার, চারপাশটা একটু ঘুরে দেখার, ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে নিজেকে আরেকটু উপলব্ধি করার।মনে মনে বেশ কয়েক দিন ধরেই ভাবছিলাম ক’দিনের জন্য কোথাও একটা ঘুরে আসি।ভাবছিলাম ডুয়ার্স যাব, কিন্তু নানা কারণে তা আর হয়ে উঠলনা। অবশেষে আমরা চারবন্ধু মিলে ঠিক করি এমন জায়গায় যাব, যেখানে পাহাড়ও আছে জঙ্গলও আছে। শেষে ঠিক করলাম আমরা সিলারীগাঁও-জুলুক যাব। এই জায়গাগুলির নাম খুব কম লোকজনই জানেন, ভিড়-ভাট্টাও কম হবে।
আমরা সিলারীগাঁও-জুলুকের ৩রাত্রি/৪দিনের প্যাকেজের জন্য ‘India Beacons Sojourn’ ট্রাভেল এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করি।এই ট্রাভেল এজেন্সির কর্ণধার মিস্টার সন্দীপ চৌরসিয়া। তিনিই সব ব্যবস্থা করে দেন।আমরা রওনা দিই ২৭শে মার্চ, রবিবার। আমাদের ট্রেন ছিল কলকাতা স্টেশন থেকে, রাত ১০:৪৫-এ, রবিবার স্পেশাল আলিপুরদুয়ার এক্সপ্রেস। রওনা দেবার ২৫ দিন আগে ঠিক হয় যে আমরা ঘুরতে যাব, তাই স্বাভাবিকভাবেই আমরা কোনো ট্রেনে এসিতে রিজার্ভেশন পাইনি। অগত্যা আলিপুরদুয়ার স্পেশাল এক্সপ্রেসে চেয়ার কারে চারটে টিকিট কাটি, মাথা পিছু ২৩৫ করে পড়ে। ভেবেছিলাম কষ্ট করে যেতে হবে বসে বসে, কিন্তু ট্রেনে উঠে দেখলাম চেয়ার কার টাইপ সীট না, জেনারেল কামরার মত, নরম গদি আঁটা সীট, হাত-পা ছড়িয়ে যাওয়া যায়। তার ওপর আবার উইন্ডো সীট, দু’জন দু’জন করে সীট ভাগাভাগি করে কখনো শুয়ে কখনো বসে রাতটা কাটিয়ে দিয়েছিলাম।
প্রথম দিন: নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে এসে পৌঁছালাম পরদিন সকাল ১০টায়।নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে আগের দিন বিকেলেই গাড়ি চলে এসেছিল। গাড়ির ড্রাইভারের সাথে আগে থাকতেই ফোনে কথা হয়ে গেছিল, তাই সট্যান্ডে পৌঁছে গাড়ি চিনতে বিশেষ অসুবিধে হল না।আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল‘সিলারী গাঁও’। শুরু হল পাকদণ্ডী পথ বেয়ে চলা, পাহাড়ি বাঁক আর তিস্তাকে পাশে রেখে আমরা উঠতে শুরু করলাম। চারিদিকের সবুজ গাছগুলিতে কচি পাতারা যেন হিল্লোল তুলেছে, পাহাড়ে বসন্তের ছোঁয়া।মাঝখানে একজায়গায় লাঞ্চ সেরে সিলারী গাঁওতে পৌঁছালাম প্রায় সাড়ে চারটে নাগাদ। সিলারী গাঁওতে ঢোকার আগে ১.৫কিমি রাস্তা মাটির, এবড়ো-খেবড়ো, তার মধ্যে বৃষ্টি হয়ে জায়গায়-জায়গায় জল জমে আছে, গাড়ি চলছে লাফিয়ে লাফিয়ে। রাস্তায় যেতে যেতে ডানদিকে পড়ল ‘সাইলেন্স ভ্যালি’, পাইন গাছ দিয়ে ঘেরা।
দার্জিলিং জেলায় ৬০০০ফিট উচ্চতায় অবস্থিত ‘সিলারী গাঁও’ একটা ছোট্ট গ্রাম। চারিদিকে পাইন গাছে ঘেরা। স্থানীয় অধিবাসীরা এই ‘সিলারী গাঁও’কে নিউ দার্জিলিং বলে অভিহিত করে থাকে। পেডং থেকে আট কিলোমিটার দূরে আবস্থিত এই নিরিবিলি ছোট্ট গ্রামটি মোটামুটি ত্রিশ জন গ্রামবাসীকে নিয়ে গড়ে উঠেছে, যাদের মূল জীবিকা চাষবাস ও পশুপালন। এছাড়াও এরা হোম স্টে বানিয়ে টুরিস্টদের ভাড়া দিয়েও বেশ রোজগার করে। সিলারী নামে একধরনের গাছ এই অঞ্চলে প্রচুর জন্মায় বলে এই গ্রামের নাম হয়েছে ‘সিলারী গাঁও’। এছাড়াও এখানে সিঙ্কোনা গাছ প্রচুর জন্মায় যা থেকে কুইনাইন প্রস্তুত করা হয়। তবে সিলারী গাঁও-এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপূর্ব সৌন্দর্য দেখা যায়।
অবশেষে যখন সিলারী গাঁও পৌঁছালাম, দেখলাম আমাদের কটেজটা সব থেকে ওপরে। সৌজর্নদের দুটো কটেজ, সিলারী গাঁওয়ের আর সব হোম স্টে, কটেজের থেকে ওপরে, পাহাড়ের প্রান্তে আবস্থিত। তবে কটেজ দুটো পাশাপাশি নয়, একটা একটু নীচে একটা একটু ওপরে। কটেজ দুটির পিছনে পাহাড়ি জঙ্গল আর গাছপালায় ভর্তি।
এখানে কটেজ ও হোম স্টেগুলির চারিধারে প্রচুর পাহাড়ি ফুল গাছে সাজানো, তার মধ্যে কিছু চিনতে পারলাম, যেগুলো শীতকালে মরশুমি ফুল হিসেবে লাগান হয় সমতলে; যেমন হলুদ ছাড়াও সাদা, গোলাপি রঙের ক্যালেন্ডুলা।তবে সৌজর্নদের কটেজগুলি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। চারিপাশে প্রকৃতির সঙ্গে রঙ মিলিয়ে সাদা ও সবুজে মেশানো কটেজদুটি যেন ঠিক ‘Fairy tale house’।
কটেজের ইন্টিরিয়র ডেকোরেশনও অপূর্ব। ভেতরের একদিকটা কাঠের, একদিকে কাঁচের জানলা, আর একদিকে দরজার পাশে একটা টানা লম্বা অংশ কাঁচ দিয়ে ঘেরা। বিছনায় শুয়েটি-টেবিল, একটা সাইড-টেবিল, মেঝে পুরো সবুজ, কার্পেটে মোড়া। বাথরুমও বেশ ঝকঝকে তকতকে, আধুনিক ব্যাবস্থাপূর্ণ। বিছনাও বেশ নরম গদি বিছান, পরিপাটি। আমাদের কটেজ দুটি রেনুদি বলে একজনের জমির ওপর লিজ নিয়ে বানানো, সেই রেনুদির ঘরও আমাদের কটেজটার দুটো সিঁড়ি নীচে, তারও নিজস্ব হোম স্টে রয়েছে টুরিস্টদের ভাড়া দেবার জন্য। কিন্তু সৌজর্নদের কটেজের অতিথিদের থাকা-খাওয়া, দেখাশোনা সব রেনুদির ওখানেই হয়। প্রথমে আমরা ওঁর কাছ থেকে চাবি নিয়ে রুমে ঢুকি, গরম জল চেয়ে ভাল করে স্নান করি। লাঞ্চ রেডিই ছিল। স্নান সেরে, ফ্রেশ হয়ে রেনুদির ঘরে গিয়ে গরম গরম ডাল, সরু চালের ভাত, আলু-পাঁপড় ভাজা, আলু-বেগুনের তরকারি, ডিমের ডালনা খেলাম। কী অপূর্ব রান্না! সামান্য আলু-বেগুনের তরকারি, তাই কী চমৎকার স্বাদ! ঘরে ফিরে দেখি বাইরে বেশ মেঘ করেছে, বৃষ্টি হবে হবে। আশেপাশে একটু ঘুরে দেখব ভেবেছিলাম, তা আর হল না। রুমে বসে সবাই গল্প করতে লাগলাম।
সন্ধ্যেবেলায় চা আর পকোড়া আসে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিও শুরু হয়ে যায়, দেখতে দেখতে আটটা বেজে যায়। ডিনারের ডাক পড়ে, পাহাড়ি এলাকায় লোকজন তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ে এমনিতেই। কোনোরকমে ডিনার সারি, পেট এমনিতেই ভরতি ছিল, এতবেলায় লাঞ্চ খেয়েছিলাম বলে। রাত্রি বেলায় আবার ভাত-ডাল, আলু-বাঁধাকপি ভাজা আর দেশি মুরগির ঝোল গরম গরম। কী চমৎকার রান্না! লোভে পড়ে খাব না খাব না করে বেশ ভালই খেলাম।বাইরে বেশ বৃষ্টি পড়ছিল, ঠাণ্ডাও ধীরে ধীরে বাড়ছিল, কটেজে ঢুকে লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
দ্বিতীয় দিন: পরদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙতে দেখি সকাল আটটা বেজে গেছে। পর্দা সরিয়ে দেখি বাইরে আকাশটা যেন হাসছে, আর দূরে দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। রাতে বৃষ্টি হয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। মুখ ধুয়ে, গরম জামা গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম চারিদিক একেবারে ঝলমল করছে।রেনুদি বারান্দায় টি-পটে চা সাজিয়ে রেখেছে। টি-পট থেকে চা ঢেলে নিয়ে খেতে খেতে পাশের কটেজে আমাদের আর দু-জন বন্ধুকে ডেকে তুললাম। আজ আবার আমরা জুলুক যাব, গাড়ি আসার কথা সাড়ে ৯টা নাগাদ।দেরি আছে ভেবে, আমি ও আরেক বন্ধু মিলে ঠিক করি আশপাশটা একটু ঘুরে আসি, তাড়াতাড়িই ফিরে আসব। আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকি। বৃষ্টির জল পড়া এবড়ো–খেবড়ো উঁচুনিচু রাস্তা। চারিদিকে সিলারী আর নাম না জানা পাহাড়ি গাছে ভর্তি, বড় বড় ফার্নও রয়েছে। নানারকমের পাখি ডাকছে। চারিপাশে জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি রাস্তা ধরে রোদ-ঝলমলে সকালে হাঁটতে মন্দ লাগছে না। এভাবে কখন যে হাঁটতে হাঁটতে ‘রামিথে ভিউ পয়েন্ট’(Ramithey view point)-এ চলে এসেছি, খেয়ালই করিনি। রামিথে ভিউ পয়েন্টে পৌঁছে মনে হল- আহা! কী দেখিলাম! জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না। ঘন নীল আকাশের বুক চিরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বরফের মুকুটে শোভিত কাঞ্চনজঙ্ঘা।
চারিদিকে সু-উচ্চ পর্বতশ্রেণী। দূর থেকে নদীগুলো দেখে জলের স্রোত বোঝা যাচ্ছে না। সকালে সূর্যোদয় দেখিনি তো কী হয়েছে! চারিদিকের এই সৌন্দর্য দেখে ক্ষণিকের জন্য হলেও মন থেকে দুঃখ, বিষাদ, ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। সময় যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। নীচে তাকিয়ে দেখি জঙ্গল। এখানে বেশ বাঁশ গাছ পাওয়া যায়। নীচের জঙ্গলে বাঁশের মড়মড় শব্দ শুনে নীচে তাকিয়ে দেখি, একটা ভালুক এ গাছ থেকে ও-গাছ দোল খাচ্ছে। বুঝতে পারি দেরি হয়ে যাচ্ছে, ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। এদিকে ফোন আসতে শুরু করে, এখনও দেড় কিমি মত রাস্তা ফিরতে হবে। পাহাড়ি জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে Robert Frostএর সেই বিখ্যাত লাইন...The woods are।ove।y, dark and deep, But I have promises to keep, And mi।es to go before I s।eep...।তাড়াতাড়ি না ফিরলে জুলুক পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে। সেখানে কীসব পারমিশান করানোর ব্যাপার আছে। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ফিরতে থাকি। তাও, কটেজে আসতে সাড়ে দশটা বেজে যায়। কোনরকমে দুটো লুচি আলুর দম খেয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে স্নান সেরে রেডি হয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ি জুলুকের উদ্দেশ্যে।
পথে যেতে যেতে পড়ে ‘সাইলেন্স ভ্যালি’ (Si।ence va।।ey), চারিদিকে পাইন গাছের জঙ্গল। নীচে ছোট গাছগুলো পাইন বনকে আরও ঘন নিবিড় করে তুলেছে। পাইনের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে নীলচে আকাশ। কথা বললে এখানে প্রতিটি ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে।তাই এই ভ্যালির নাম ‘সাইলেন্স ভ্যালি’। পাইন বনের সেই সারি সারি বৃক্ষ সমূহের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আবৃতি করতে থাকি...
‘অন্ধ, ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণ-
তুমি বৃক্ষ আদি প্রাণ।’
সেই পাইন বনের ভেতর দিয়ে একটা পায়ে চলা সরু রাস্তা চলে গেছে, যেটা শেষ হয়েছে একটা মাঠের সামনে, মানে একটা নিচু জায়গা জল জমে কোনভাবে একটা ছোট্ট উপত্যকা সৃষ্টি করেছে, যার চারপাশ ঘিরে আছে পাইন বন, দূরে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা।
ছবি তুলে, বেশ খানিকক্ষণ কাটিয়ে আবার গাড়িতে এসে বসলাম। পাহাড়ি পথ বেয়ে গাড়ি কখনো নামছে, কখনো উঠছে। গাড়িতে গান বাজছে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়.........’।
পেডং ছাড়িয়ে এবার আমাদের গন্তব্যস্থল ‘আরিতার লেক’(Aritar।ake)। ‘আরিতার লেক’টি সিকিমের পূর্ব প্রান্তে রোঙলি সাবডিভিশনের মধ্যে পড়ে। হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এই লেকটির চারিপাশ পাহাড়ি গাছপালা আর পাইন বনে সমৃদ্ধ, পেছনে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফ শোভা।
সাদা-বেগুনি রঙবেরঙের ফুল ফুটে আছে চারিদিকে। লেকটি অবশ্য আধুনিক কায়দায় রেলিং দিয়ে বাঁধানো, বসার জায়গা আছে। বোটিংয়ের ব্যাবস্থাও আছে। জলে মরাল-মরালী খেলা করছে। লেকটির মনোরম শোভা ছেড়ে আর আসতে ইচ্ছে করে না।
খিদে পেয়ে গেছিল, দেখি লেকের সামনে দু-একটি ছোট দোকান, স্থানীয় অধিবাসীরা ম্যাগী, পাঁউরুটি বিক্রি করে। সেইরকমই একটি ছোট্ট দোকানে আমরা মোমো ও কোল্ড-ড্রিঙ্কস খেলাম। মোমোগুলো দারুণ টেস্টি ছিল! দিনটা খুব রৌদ্র-করোজ্জ্বল থাকায় খুব ভাল ছবিও উঠছিল। এর মধ্যে আড়াইটে বেজে গেছে, আর দেরি না করে গাড়িতে উঠে পড়লাম। রোঙলি মার্কেটে এসে চল্লিশ মিনিট গাড়ি দাঁড়াল, পারমিশন করানোর জন্য। জুলুক মিলিটারি প্রোটেক্টেড এরিয়া, যেতে গেলে স্পেশাল পারমিট লাগে, এর জন্য লাগে দুকপি ছবি আর কোন একটা আই ডি প্রুফের জেরক্স।
রোঙলি(Rong।i) একটা ছোট্ট বাজার, আশেপাশে বেশ কিছু দোকানপাট আছে। পারমিট করার পর আবার ওপরে ওঠা শুরু। চেস্টনাট, ওয়ালনাট, ওক, লরেল সমৃদ্ধ পাহাড়ি পথ বেয়ে গাড়ি চলতে থাকল, সিল্ক রুটের পথে। যদিও সিল্ক রুট শুরু হয়ে গেছে কালিম্পং থেকেই। প্রাচীনকালে এই পথ দিয়েই ভারতের সাথে চিনের বৈদেশিক যোগাযোগ, আদান-প্রদান চলত। বেলা গড়াতে লাগল। বিকেল হয়ে গেছে, সূর্য প্রায় ঢলে পড়েছে পাহাড়ের কোলে, আকাশও মেঘলা। প্রায় চারটে নাগাদ লিংটমের কাছে এসে পৌঁছালাম ‘কুয়েখোলা’ঝর্ণার ধারে। ছোট্ট ঝর্ণা, উপর দিক থেকে জল ঝাঁপিয়ে পড়ছে নীচে, পাথরে পাথরে পা দিয়ে জল যেখানে পড়ে সমতলের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে, সেই মুখের সামনে গিয়ে বেশ কিছু ছবি তুললাম। ঝর্ণার জল ছিটকে ছিটকে গায়ে লাগছে, ভারি মজা লাগছিল। চারিদিকে বিশাল বিশাল পাহাড় গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে।
রাস্তার পাশে দুটো দোকান, একটাতে চা-কফি বিক্রি হয়, আরেকটাতে ম্যাগী, নুডলস এসব। আমরা চারজনে দুটো ওয়াই-ওয়াই নুডলস আর ডিমের ওমলেট খেলাম। খেয়ে দেয়ে আবার গাড়িতে উঠলাম, অবশেষে জুলুকে পৌঁছালাম প্রায় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ।
জুলুক(Dzu।uk)১০,০০০ফিট উচ্চতায় অবস্থিত, চারিদিকে গুরুগম্ভীর পাহাড় আর মেঘ। আমাদের সৌজর্নদের হোম স্টেটা যেখানে ছিল কয়েকটা সিঁড়ি নীচে নেমে সেখানে যেতে হত। এল শেপের একটা কটেজ যার লম্বা প্রান্তটার দুদিকে দুটো রুম, অ্যাটাচড বাথ। আর বর্ধিত অংশটার একদিকে রান্নাঘর, খেতে আসতে হলে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোন পেরিয়ে কিচেনে যেতে হত। আমাদের দেখাশোনা করতেন এক দম্পতি, তাঁরা রান্নাবান্না করে আমাদের খেতে-টেতে দিয়ে উপরে নিজেদের বাড়িতে চলে যেতেন। যাই হোক, আমাদের জুলুক পৌঁছতে সাড়ে-পাঁচটা বেজে যাওয়ায় আর স্নান করা হল না। গরম জল চেয়ে হাত-পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে লাঞ্চে বসলাম।
মেনু সেই একই রকম, সিলারী গাঁওয়ের মত, বেশ সুস্বাদু। কিচেনটার একদিকে গ্যাস, বাসনকোসনের র্যাক অন্যদিকে পর্দা-টাঙ্গিয়ে ডাইনিং টেবিল রাখা, বেশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন।
খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমাদের এক বন্ধুর জন্মদিন সেলিব্রেট করলাম।
মোমবাতি দিয়ে বারান্দায় সাজিয়ে বার্থডে কেক কাটা হল। কেকের ব্যাবস্থা মিস্টার চৌরসিয়াই করে দিয়েছিলেন। কেকের সাথে চা-পকোড়া।
তারপর রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ডিনারে বসলাম। সেদিন নীচে বাজার বন্ধ ছিল বলে রাতে চিকেন হয়নি, অপশন ছিল মাছ কিংবা ডিম। আমরা সবাই ডিমের অমলেট দিয়ে গরম গরম ডাল-ভাত, ফুলকপি আলুর তরকারি খেলাম।রাতে একটু নিজেদের মধ্যে গান-বাজনা গল্প-সল্পের পর ঘুম। পরদিন আবার সকাল-সকাল জুলুক সাইট সিইং করতে যাব।
তৃতীয় দিন: পরদিন সকালে গরম জলে মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে লুচি-আলুরদম খেয়ে গাড়িতে উঠলাম নটা নাগাদ। আমাদের হোম স্টের পাশে দিল-মায়া বলে আরেকটা হোম স্টে থেকে ৫০টাকা দিয়ে পাহাড়ি বুট জুতো ভাড়া করে নিয়েছিলাম, বরফে হাঁটার জন্য। সেদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার, বৃষ্টিও হয়ে গেছে, মেঘলা আকাশের বুক দিয়ে যেন নীল কুয়াশা টুপটাপ করে ঝরছে। সিল্ক রুট ধরে গাড়ি চলতে থাকল। ১১,২০০ ফিট উচ্চতায় থাম্বি ভিউ পয়েন্ট (Thambi view point)থেকে Zigzag road-এর ভিউ দেখে মোহিত হয়ে গেলাম। কিন্তু কুয়াশা মেঘএসে ঢেকে দেওয়ায় বেশিক্ষণ আর ওই Zigzag road-এর ভিউ দেখা গেল না।
এরপর গেলাম নাথাং ভ্যালি (Gnathang va।।ey)। ইতিমধ্যে দেখছি বরফ জমে রয়েছে পাহাড়ের পাদদেশে। বরফ দেখে মন আনন্দে নেচে উঠল। নাথাং ভ্যালিকে ‘The Ladakh of East India’ বলে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৩,৫০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত নাথাং ভ্যালি ওল্ড সিল্ক রুটের (Old silk route) এক অন্যতম আকর্ষণ পর্যটকদের কাছে। চারিপাশে বরফ ঘেরা পর্বত আর মাঝখানে নাথাং ভ্যালি যেন ‘সিকিম কা জন্নত’।
বেশ কিছু ছবি তুলে এরপরে আমরা রওনা দিলাম টুকলা ভ্যালি আর টুকলা বাবা মন্দিরের উদ্দেশ্যে। এই মন্দিরের পাশে মিলিটারিদের একটা সেন্টার আছে, যেখানে ফ্রিতে চা জল আর ১০টাকায় একটা করে আলুর বড়া পাওয়া যায়। আমরা চা-আলুর বড়া খেয়েটেয়ে টুকলা বাবা মন্দিরের পাশে বাবা হরভজন সিংয়ের মন্দিরে গেলাম। বাবা হরভজন সিং এখানকার একজন ঐতিহাসিক চরিত্র। হরভজন সিং ১৯৬৫-৬৬র ভারত-পাক যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অফিসারের পদে ছিলেন। ১৯৬৮ সালে নাথুলাতে প্রচণ্ড ধ্বস নামে, অনেক সৈনিকের প্রাণ যায়, হরভজন সিংয়ের বডিও খুঁজে পাওয়া যায় না, নদীর জলে ভেসে যায়। পরে তাঁর এক বন্ধু জানান স্বপ্নে নাকি হরভজন সিং বলে গেছেন তাঁর বডি কোথায় পাওয়া যাবে। বিশ্বাস না করলেও পরবর্তীকালে ওই জায়গা থেকেই হরভজন সিংয়ের বডি পাওয়া যায়। মিলিটারি সেনারা সব এখানে তাঁকে ভগবান জ্ঞানে পুজো করে। এটা এখানকার মিথ যে কোনো বিপদে-আপদে পড়লে ‘বাবা’ হরভজন সিংকে স্মরণ করলে উনি বাঁচান। নাথুলা এবং ভারত-চিন বর্ডারে পোস্টেড সেনারা অনেকেই বিশ্বাস করেন পূর্ব হিমালায়ের দুর্গম এলাকায় সেনারা বিপদে পড়লে বাবা হরভজন সিংয়ের আত্মা তাঁদের রক্ষা করে। আমাদের ড্রাইভারকেও দেখলাম বাবা হরভজন সিংয়ের ছবি বাঁধিয়ে গাড়িতে রেখেছে।
পরবর্তী গন্তব্যস্থল কুপুপ (Kupup)।কুপুপের বিখ্যাত লেক যা আঞ্চলিক ভাষায় ‘বিতান ছো’ নামে পরিচিত।এই লেকটির চারিদিকে পাহাড় আর উপত্যকা মিলিয়ে এক অদ্ভূত নৈসর্গিক শোভা সৃষ্টি করেছে, যা দেখে আর ফিরতে ইচ্ছে করেনা। সত্যি! স্বর্গ বলে যদি কিছু থাকে, তাহলে তা যে পৃথিবীতেই আছে, তা উপলব্ধি করলাম।ভারত-চিন বর্ডার জেলেপলা পাস(Jelepla pass) যাওয়ার পথে অবস্থিত এই লেকটি মোটামুটি ভাবে ১৩,০৬৬ফিট উচ্চতায় অবস্থিত। এই লেকটি ‘এলিফ্যান্ট লেক’ নামেও পরিচিত। কুপুপে পুলিশ পোস্ট সহ কয়েকটি ঘর নিয়ে একটা ছোট্ট গ্রামও আছে। এছাড়াও এখানে আছে, পৃথিবীর সর্বোচ্চ ‘গলফ কোর্স’। নাথাং ভ্যালি থেকেই শুরু হয়ে গেছিল বরফ। কুপুপে পৌঁছে দেখলাম গুঁড়ি গুঁড়ি বরফ পড়ছে, মিহি তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে।
কুপুপ থেকে ফেরার পথে বরফ খেলব বলে এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করালাম। আমরা সবাই মিলে বেশ খানিকক্ষণ বরফ ছোঁড়াছুড়ি করলাম, বরফের ওপর স্লিপ কেটে নামলাম, বেশ মজা করলাম, একটু পর দেখি জামাকাপড়গুলোর যে সব জায়গা বরফে ভিজে গেছে, সেই জায়গাগুলোয় বরফের ছুঁচ ফোঁটার মত যন্ত্রণা হচ্ছে, তাড়াতাড়ি গাড়িতে এসে বসলাম। রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট দোকানে বসে নুডলসের অর্ডার দিলাম। দোকানটিতে দুজন সিকিমিজ পুলিশ ছিল, বাঙালি দেখে তারা নিজেরা এসে আলাপ করল, গল্প-স্বল্প করল, তারা বেঙ্গলের পুলিশদের মত র্যালা দেখায় না, বেশ মিশুকে। এদিকে বাইরে বেশ গুঁড়ি গুঁড়ি তুষারপাত হচ্ছে, চল্লিশ মিনিট পর আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল। একটু নামার পর হঠাৎ একটা বাঁকের কাছে গিয়ে গাড়ি টার্ন নিতে পারছে না, দেখি চাকা স্কিড করছে বরফের জন্য।ডানদিকে খাদ, খাদ যদিও গভীর নয়, তবুও গাড়ি উলটে পড়লে আর রক্ষে নেই। আমাদের ড্রাইভার, পেম্পা, খুব দক্ষতার সাথে বাঁক কাটিয়ে নীচে নামার চেষ্টা করছে, পারছে না। আমরা গাড়িতে বসে থাকার রিস্ক না নিয়ে নেমে যাই, আর দুই বন্ধু মিলে গাড়িটা পেছন দিকে ঠেলতে থাকি।বাইরে নেমে বুঝতে পারি কি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, বাইরে এভাবে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা বা হাঁটা সম্ভব না। যাই হোক, শেষ অবধি ওই বিপজ্জনক বাঁক কাটিয়ে পেম্পা আমাদের গাড়িতে উঠতে বলে, আশ্বাস দেয় আর কোনো ভয় নেই। আমরা গাড়িতে উঠি, রাস্তায় যদিও আর বরফ ছিল না, তবে ঘন কুয়াশা আর মেঘে গাড়ির সামনে বিশেষ কিছু দেখা যাচ্ছিল না, বাঁকগুলোতো বোঝাই যাচ্ছিল না; পেম্পা কিন্তু দক্ষতার সাথে সব বাধা কাটিয়ে ঠিক আমাদের নিয়ে আসে। সেদিন বুঝতে পারি, ‘বিশ্বাস’ শব্দটার গভীরতা। কুয়াশায় চারিদিক ঢাকা, তাও যে গাড়িতে নিশ্চিন্তে বসে এলাম, সেভাবে কোনো ভয় লাগেনি, কারণ দৃঢ় বিশ্বাস ছিল পেম্পা ঠিক গাড়ি চালিয়ে নিয়ে আসবে, ওরা এরকম পাহাড়ি কুয়াশায় গাড়ি চালিয়ে অভ্যস্ত। এই যে পেম্পার ওপর আমরা চারটে মানুষ সেদিন নিজেদের জীবন-মরণ সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলাম, সেটায় বিশ্বাস শব্দটা সম্বন্ধে নতুন করে উপলব্ধি জাগায়।
আমরা আমাদের হোম স্টেতে ফিরে আসি দুপুর ৩টে নাগাদ। গরম গরম লাঞ্চ খাই ডাল-ভাত, বাঁধাকপি-আলুর তরকারি, ডিমের কারি দিয়ে। খিদে পেটে মনে হয় যেন অমৃত খাচ্ছি। এরপর একটু বিশ্রাম নিই; সন্ধ্যে হয়ে যায়, চা-পকোড়া খাই, রুমে বসে সবাই আড্ডা মারি, গল্প-গুজব করি। সুস্বাদু চিকেনের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে ডিনার সেরে সাড়ে নটা নাগাদ শুয়ে পড়ি। পরদিন আবার ফেরার পালা।
চতুর্থ দিন: পরদিন সকালে ব্রেক ফাস্ট সেরে জুলুককে টাটা করে গাড়িতে উঠি প্রায় ১০ টা নাগাদ। মাঝে ২টো নাগাদ এক জায়গায় লাঞ্চ সারি, প্রায় ৫ টা নাগাদ শিলিগুড়ি পৌঁছাই। গাড়ি এন জি পি অবধি যাবে না, কারণ সিকিমের গাড়ির পারমিট থাকে না। তাই নেমে একটা অটো রিজার্ভ করে পেম্পাকে বিদায় জানিয়ে এন জি পি স্টেশন এলাম। রাত ৯ টায় ট্রেন, পদাতিক এক্সপ্রেস। ট্রেনে ওঠার আগে স্টেশনের কাছে এক দোকান থেকে ডিনার সেরে ট্রেনে উঠি। পরদিন সকাল আটটায় শিয়ালদহ পৌঁছে যাই। বন্ধুরা সব একে অপরকে বিদায় জানিয়ে যে যার বাড়ি ফিরে আসি.........।
ফিরে আসি একমুঠো তাজা শ্বাস নিয়ে, নতুন উদ্দীপনা নিয়ে……সত্যি! কটা দিন কী ভালই না কাটল, কাজের চাপ নেই, টেনশন নেই। চারিদিকে পাহাড়ের নৈসর্গিক শোভা আর পাহাড়ি মানুষগুলোর অকৃত্রিম সরলতা, তাদের আতিথেয়তা সত্যি মুগ্ধ করার মত……
“Travel is more than the seeing of sights; it is a change that goes on, deep and permanent, in the ideas of Living.” — Miriam Beard