0

সম্পাদকীয়

Posted in





শেষ হলো ৪৫তম কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা। একবছর বিরতির পর। প্রাক বৈশাখের নিদারুণ দাবদাহ মাথায় নিয়ে। সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্ককে স্থায়ী বইমেলা প্রাঙ্গণরূপে ঘোষণা করা হলো। সাধুবাদ। একই সঙ্গে উঠে এল অনেক প্রশ্ন। এই অসময়ের মেলার সাফল্য নিয়ে যে ঢক্কানিনাদ, তার সারবত্তা সঙ্গত কারণেই বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে নাগরিকমহলে। অনেক প্রকাশকের মেলা পরবর্তী প্রতিক্রিয়াই তার প্রমাণ। তবু আমাদের আশা এই মিলনক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হোক। মানুষ বই পড়ুন আরও। কাগজ, কালি আর নতুন বইয়ের গন্ধে আমরা নিমজ্জিত হই ক্রমাগত এবং অনবরত।

ভালো থাকুন। সৃজনে থাকুন। নববর্ষের আগাম শুভেচ্ছা!

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in



অরণ্য-গাথা

এবছর কলকাতা বই মেলায় যাই নি। না, কোন তৃতীয় হাতের গল্প নেই। যদিও গত বছর এই মেলা করা সম্ভব হয়নি মারণ ভাইরাসের চোখ রাঙানির জন্য। মনে দুঃখ পেলেও আতঙ্ক ঘেরা ছিল মাঘের সকালের কুয়াশার মত। ন’ দিনের জন্য চলে গেছিলাম জঙ্গলে। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সে। হিমালয় যেখানে মাটির স্পর্শ পায়, চিনে নেয় তার উত্থানের তল, অনর্গল ধৌত করে শিয়রের বরফ গলা জল আর পাথর ভাঙা মাটি দিয়ে, অঞ্জলি দেয় নিরন্তর শীতল বাতাস, নত হয়ে চুমে তার ছায়া দিনের শুরু আর শেষে, চুঁয়ে পড়ে জোছনা ঢাল বেয়ে, নক্ষত্রেরা মিটিমিটি চোখে তাকায় বন্য প্রাণিদের চোখে চোখ রেখে, রাতের শেষে পাখিরা জাগিয়ে তোলে গাছের ঘুম আবার দিনের শেষে সেই গাছই আশ্রয় হয় তাদের, নিরাপত্তার বেড়াজাল বিছিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমায় তারা। গেছিলাম সেরকমই একটা অঞ্চলে। জঙ্গলে। নানা নামে ডাকে তারা। নানা প্রশ্ন শুধায় লোকে। অরণ্যই কি সেই সব প্রশ্নের উত্তর জানে? সে কি জানে কোথায় তার কি নাম, কেমন তার পরিচয়, চরিত্রই বা কেমনতর। বুদ্ধিমান মানুষ সব জানে। তৈরি করে দিয়েছে অরণ্যের সীমানা। পরিচিতি পেয়েছে তারা নামে নামে যেমন প্রতিটা মানুষের নাম পরিচয় আছে। মানুষের আবার পরিচিতির শেষ নেই, শুধু নামেই ক্ষান্ত নয়, সংখ্যা দিয়ে তার নানা পরিচয়, আইডেন্টিটি। গাছ, সে হোক স্থানিক অথবা আঞ্চলিক, আমার কাছে সকলই অরণ্যানী, সকলই শোভন। তৃণকে যখন শুধাই তোমার পরিচয় কি, কোন কাজটা কর তুমি তো সে বলবে মাটি শক্ত করে ধরে রাখা, তার বাঁধনহারা স্বভাব বেঁধে রাখাই তার কাজ। একটা ঘাস ছিঁড়তে যত শক্তি লাগে তাতে তার এই অহঙ্কার বেশ উপভোগ্য। বৃক্ষকে জিগ্যেস করলে বলে আমার কাজ খুব সোজা, রোদ্দুরে যাতে সব পুড়ে ছাই না হয় তাই আমি ছায়া দিয়ে শীতল রাখি। বনের পথে যেতে মাটিতে রোদ্দুর-ছায়ার যে আলিম্পন দেখি, যে শীতলতা অনুভব করি তা অস্বীকার করি কি করে। কিছু গাছ ফুলের বর্ণে, সৌরভে মনে পুলক জাগায়, কিছু গাছ শস্য-শ্যামল হয়ে আমাদের প্রাণধারণ করে, ক্ষুধ মেটায়। আরও অনেক গাছ আছে যারা তাদের কর্তব্য নিয়মিত করে চলেছে মানুষের অগোচরে; হয়তো মানুষের কাজে আসে না বলে মানুষ অগ্রাহ্য করে কারণ সেটাই তার স্বভাব, যেটা নিজের অপ্রয়োজনীয় মনে হয় তাকে সমূলে উৎপাটিত করা তার চরিত্র কিন্তু সেইসব গাছ এই পৃথিবীর কোটি কোটি প্রাণির কারোর না কারোর উপকার করেই চলেছে। সেই সব প্রাণী চিরতরে কৃতজ্ঞ। তাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা ভিন্ন, আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

ভরা ফাগুনে বসন্তের চিরাচরিত চরিত্র গায়ে মাথায় নিয়েই চলে গেলাম জঙ্গলে। দুপুরে মাথার ওপর চাঁদিফাটা রোদ্দুর আবার দিনমণি যেই পশ্চিম দিগন্তের সাথে তিরিশ ডিগ্রি কোণে অবস্থানে গেলেন পুরো বদলে গেল সব। সেই সূর্য যে রূপালী তরবারি ঘোরাচ্ছিল এতক্ষণ যেন জানেই না এসব কিছু, মুহূর্তে ভেল্কিবাজি বন্ধ রেখে বোবা বুদ্ধ হয়ে গচ্ছামি। পাহাড়ের মাথায় মাথায় বরফের কারখানা থেকে ঠাণ্ডা বাতাস এসে যেন মুড়ে দিল ধরাতল। অনেককেই বলতে শুনেছি জঙ্গল থেকে ফিরে এলে জিগ্যেস করতে কি দেখলাম। আমি অবাক হয়ে যাই। জঙ্গলটাই তো দেখার। সত্যি বলতে কি কোনো নির্দিষ্ট কিছু দেখার জন্যে যাই, তেমন বাসনাও ছিল না। যেমন বন্য জন্তু জানোয়ার। চেয়েছিলাম শুধু একটু নির্ভেজাল মুক্তি। দীর্ঘ, আমার কাছে সু-দীর্ঘ, একটা সময়, প্রায় দু বছর, প্রায় নির্জন নিরালায়, প্রায় সঙ্গীহীন, প্রায় ঝুরি নামা বটের মাটির নিচে গভীর শেকড়ের মত, প্রায় গজাল পোঁতা লোহার শেকলে বাঁধা হাতির পায়ের মত, প্রায় নোঙর ফেলা বাহির সমুদ্রে দাঁড়িয়ে থাকা স্থানু জাহাজের মত মনে হচ্ছিল নিজেকে। চুরি করে দু-একবার যে এক-দু দিনের জন্যে বেরোই নি তা নয়, ওই ভেন্টিলেটর থেকে যেমন মাঝেমধ্যে বের করে বাতাস থেকে অক্সিজেন নেওয়ায় হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগীকে। চুরি? কার থেকে? অনর্গল মৃত্যুর আতঙ্ক থেকে জীবন চুরি। নিঃসঙ্গ জীবন থেকে বেরিয়ে সঙ্গ চুরি। শব্দহীন কবরের কফিন বাক্স থেকে বাইরে এসে কথা বলা ও শোনা; বলা কম, শোনা বেশি। রাস্তায় গাড়ির আওয়াজ, কোলাহল ছাড়া কলরব। দেখতে দেখতে দুটো বসন্ত চলে গেল, তৃতীয় বসন্তে আবার বেরোনো গেল, কয়েকদিনের জন্যে, কয়েকসঙ্গীর সাথে। হোক না তারা অচেনা, অজানা। চেনা-জানা ব্যাপার তো নিমেষে হয়ে যায়। আর হোলও তাই।

ঠিক দু বছর আগে এমনই এক ফাগুনে দুপুরের আগুন আর রাতের হিম শীতল আবহাওয়ার মাঝে গেছিলাম উত্তর আফ্রিকার নীল নদের উপত্যকার মিশরে। ততদিনে কোভিড সারা ইয়োরোপে তার থাবা বসিয়েছে। আরও কয়েকটা দেশে তার উপস্থিতি জানান দিয়েছে। তাই জেনেই বেরনো। ভেতরে একটা আতঙ্ক চোরা স্রোতের মত কাজ তো করছিলই যার জন্যে ভ্রমণ উপভোগ্য হয়নি। মনোনদীর তলায় তীব্র আনন্দের স্রোতে হৃদিমাটি চিড়ে কোন স্রোত বয়ে যায় নি, হয়তো মাটিটা যত নরম হওয়ার তত নরম ছিল না, অর্থাৎ যতটা নরম হলে আনন্দের স্রোত তাতে আঁচড় কাটতে পারবে সহজে ততটা নয়; ভয় তাকে শক্ত করে দিয়েছিল যেমন শিশুরা ভয় পেলে মায়ের কাপড় আঁকড়ে ধরে শক্ত করে। যেমন আঘাতে মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়। বরং ভারত মহাসাগরের নীচ দিয়ে যে দক্ষিণমেরুবরফ গলা শীতল জলের স্রোত বয়ে যায় সেরকম একটা স্রোত টের পাচ্ছিলাম। সবই ছিল, যা যা জানা, বইয়ের পাতায় অথবা অন্য লেখায়, ছবিতে কিন্তু ছিল না বিস্ময়, জানার মাঝে অজানাকে দেখার আনন্দ। কান পেতে কিছু অচেনা শব্দ শোনার আনন্দ। ঘাসে, মাটিতে, জলে, জাহাজে, প্রত্নসম্পদে পা ফেলেছি, সাহারা ভেদ করে ছুটেছি, নীলের পথ ধরে গেছি কিন্তু কোথায় সেই চমক? মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে চেষ্টা করেছি প্রাণ ঢালার কিন্তু তার হৃদস্পন্দন শুনতে ব্যর্থ হয়েছি। একটা কৃত্রিম ভালোলাগা জোর করে পোষার চেষ্টা। সেটাকে কিছুটা অক্সিজেন দিয়েছে বৃষ্টি। তুমুল বর্ষণ। প্রায় একটানা চব্বিশ ঘণ্টা। সে রাতে ছিলাম ক্লিয়োপেট্রার আলেক্সান্দ্রিয়ায়। ভূমধ্যসাগর তীরে রাজপ্রাসাদ। তারই একটা অংশ পর্যটকদের উপহার স্বরূপ থাকার আস্তানা। অপূর্ব সেই জায়গা। ঘর লাগোয়া ব্যালকনি। ব্যালকনি ছাপিয়ে কিছু গাছ, তার অচেনা পাতা ও ফুল নিঃসৃত মনমাতানো সুগন্ধ। তার আঘ্রাণের সাথে সিঙ্গল মল্টের স্বাদ, যেন নিখিল ব্যানার্জীর সেতার আর আমজাদের সরোদের যুগলবন্দি, সঙ্গতে জাকির হোসেনের তবলা। সেই হাওয়া মাখানো বৃষ্টি চলল তার পরের দিন, সারা দিন, সারা সাহারা জুড়ে। শিহরণ জাগানো সেই সাহারার মরুভূমির চেহারা যা কচিৎ কদাচিৎ দেখা যায়।

কোথা থেকে কোথায় চলে যায় ভাবনা, তাকে আগল দিয়ে রাখা আমার সাধ্যের বাইরে। ছিলাম উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে, চলে গেলাম সাহারায়, নীল নদে ভাসতে। ফিরে আসি জঙ্গলে। মুক্তির স্বাদ সবাই পেতে চায়, মানুষ তো বটেই কিন্তু সে-ই বড় অসহায়। পায়ে পায়ে তার বেড়ি পরানো। নিজেরই তৈরি করা নিয়মের বেড়ি। বিনা বাধায় ঘুরে বেরানোয় তার হাজারো বাধা। হাজারো নিয়মের শৃঙ্খল তাকে বেঁধে রেখেছে। কোভিড এসে যিশুর মত ক্রুশের কাঠে তার পায়ে পেরেক ঠুকে দিয়েছে। তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ আসে, একটার পর একটা কোভিড ঢেউ আছড়ে পড়েছে আর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়েছে মানবসভ্যতা, স্তব্ধ হয়ে গেছে সভ্যতার অগ্রগতি। ভেঙে গেছে সঙ্ঘবদ্ধ জীবনের সমাজ। প্রতিটা বাড়ি যেন একেকটা দ্বীপ। যে বাড়িতে ভাইরাস ঢুকেছে সেখানে প্রত্যেকটা মানুষ তার দ্বীপে অন্তরীন। হারিয়ে গেছে বিশ্বাস। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যে দোলাচলে কাটছে জীবন। অন্তরালে চলে গেছে মিলনের অভ্যাস। এই সমস্যা অন্য কোন প্রাণির ক্ষেত্রে হয়নি। তাই বহুদিন পর মানুষ যখন গেছে জঙ্গলে গাছেরা পুলকিত, আনন্দে তাদের সেই উদবাহু নৃত্য যে না দেখেছে তার জীবন পূর্ণ হল না। মানুষ দেখে ময়ূরের সে কী পেখম তুলে নাচ। আসলে সবাই তো চায় তার সৌন্দর্য দেখাতে। গাছে গাছে আমের বোল কী অমৃত সৌরভ ছড়াচ্ছে। চায়ের পাতার রঙ যেন আরও বেশি উজ্জ্বল। হরিণী রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে তার সঙ্গীকে ডাকছে। মানুষ যে তার নাগালের মধ্যে ভ্রূক্ষেপই নেই। দুলকি চালে চলেছে হস্তি-হস্তিনী তাদের সন্তান-সন্ততি নিয়ে। যাতে মানুষে আরও ভাল দেখতে পায় তাই পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে রাস্তার ধারে। এবার কিন্তু মানুষের ভয় পাওয়ার পালা। সে মারে দৌড়, আর হাতিরা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে, শূঁড় তুলে আনন্দের হুঙ্কার ছাড়ে। বাইসনের দল তাদের মাজাঘষা চকচকে শরীর নিয়ে ফটোপোজ দেয়। বৈকালিক বিশ্রামে শারীরিক প্রয়োজনে লবণের স্বাদ নেয় গণ্ডার আপন মনে, পাত্তাই দেয় না মানুষকে। এগুলো তো উপরি পাওনা। দেখতে গেছিলাম গরুমারা, জলদাপাড়া আর চিলাপাতা জঙ্গল, পেরিয়ে গেলাম বক্সা সমেত আরও কয়েকটা বড় জঙ্গল। হাজার হাজার গাছ। আসলে তো জঙ্গল একটাই। ওই যে বলেছিলাম মানুষের স্বভাব নামকরণ, তাই ওদের এলাকাভিত্তিক এত নাম। তাতে কী এসে যায় গাছেদের? পাখিদের কলতানে আর ওড়াউড়িতে? পশুদের শিকারের জন্যেই হোক বা আনন্দভ্রমণে? ময়ূর-ময়ূরীর সম্মিলিত নাচে? প্রজাপতি আর অসংখ্য পোকামাকড়ের নেচে নেচে বেড়ানোয়, ফুলে ফুলে নানা স্বাদের মধুর আস্বাদ নিতে? রাতের ঘন অন্ধকারে আলো জ্বালায় থোকা থোকা জোনাকি। কত বছর পর দেখলাম। রাতের নিস্তব্ধতাকে তীক্ষ্ণ স্বরে কাটছে ময়ূরের স্বর। মাঝে মাঝে ভেসে আসে দূর থেকে কোনো পশুর আওয়াজ। এর জন্যেই তো অরণ্য। চেনার মাঝে হঠাৎ করে অচেনা কিছু যে-কোন ইন্দ্রিয়কে চমকে দিতে পারে। রাতের কৃষ্ণাকাশে তারারা যে চিত্র বানায় তা কখনও কালপুরুষ, কখনও প্রশ্নবোধক চিহ্ন নেয়। শহরের আলোকময় রাত এইসব নৈসর্গিক দৃশ্য ঢেকে রাখে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে যে সব পোকারা বাসা বাঁধে তাদের বিচিত্র ধ্বনি কানের আরাম, শহুরে গাড়ির হর্ন আর অহেতুক বিভিন্ন যান্ত্রিক স্বরের বাহুলতা শরীর ক্লান্ত করে তোলে। পাখিদের পাখায় পাখায় রঙের বৈচিত্রে দর্শনেন্দ্রিয় উৎফুল্ল হয়, ডালে ডালে শাখায় শাখায় তাদের আদর মনে কোন এক ইচ্ছে উদ্রেক করে। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত আমরা বলি বটে এখনও কিন্তু সে তো আর সত্যি হয় না। এই ধারনা চুকে গেছে অনেক বছর আগে যখন পৃথিবীর চেহারা গোল চাকতি থেকে বলের মতো প্রমাণ হয়েছে, যখন থেকে জানা গেছে সূর্য স্থির আর গ্রহেরা তার চারিদিকে ঘুরছে, গ্রহেরা আবার যে যার নিজের অক্ষের চারিদিকে বোঁ বোঁ করে ঘুরে যাচ্ছে। কিন্তু তবু মানুষের মন কবিত্বের ভাবে বিভোর হয়ে যেতে ভাল লাগে, সূর্যের উদয় আর অস্ত নিয়ে আজও কাব্যের শেষ নেই। আসলে এভাবেই ভাবতে ভাল লাগে। সত্যিটা বড় নীরস। সূর্যের প্রতিফলিত আলোয় পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদকে ভাবে যতটা মায়াময় লাগে বাস্তবে তার মাটিতে নামলে কি লাগে? দিনের প্রথম আলো আর সূর্যের প্রকাশ আকাশচুম্বী গাছের ফাঁকে যতটা রঙিন, মায়াময় আর বিস্ময়ের তার অন্তিম লগ্নটাও ততোধিক সুন্দর, মনে হয় রোজ নতুনভাবে তার প্রকাশ। ফাগুনের আকাশে আকাশে সেই রঙের ছটার সাথে লাল আর হলুদ শিমুলের রঙ লেগে যায় যখন তখনই তো মনেও রঙ লাগে, রাধা-কৃষ্ণের পরস্পরকে রাঙিয়ে দেবার এই মুহূর্তই তো দোলের ফাগুন অথবা ফাগুনের দোল।

ফিরে এসেছি শহরের দৈনন্দিন ব্যস্ততার বাস্তব জগতে। ফিরতেই হয়। সবাই ফেরে। ফেরা আছে বলেই যাওয়ার সার্থকতা। যখন ফিরেছি তখন বইমেলা শেষ লগ্নে। নিজের মনের সাথে এবার যুদ্ধ। যাব কি ওই লক্ষ লোকের কোটি বইয়ের মেলায় দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ মাথায় নিয়ে? যেতেই পারতাম। কিন্তু বাধ সাধল সেই জঙ্গল। যে জঙ্গল ছেড়ে শহরে এসেছি শরীরে, সেই জঙ্গলটাকে মনে বয়ে বেড়াচ্ছি আজও। থাক না আরও কিছু দিন, এই শান্ত শীতল আরণ্যক। ফাগুনের রঙটাকে এখনই হারিয়ে ফেলতে চাই না।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in





দেহপিঞ্জরে বন্দী শুক, কমলকুমারের আত্মানুসন্ধান

কমলকুমার মজুমদারের একটি নিজস্ব ভাষা ছিল। যে ভাষায় তিনি তাঁর উপন্যাস লিখেছেন সেই ভাষা তাঁর গল্পের ভাষা নয়। উপন্যাসের ভাষা ও তার দুর্বোধ্যতা নিয়ে পাঠককুলের সমস্যা চিরকালীন। কেউ কেউ মনে করেন তাঁর এই আপাতদুর্বোধ্য ভাষা একরকমের অহংকারের ভাষা। কেউ আবার ভাবেন তাঁর ভাষার এই দুর্বোধ্যতা আসলে সাধারণ মজারু ও বিনোদনপিয়াসী পাঠককে দূরে সরিয়ে রাখার প্রয়াস। এরকম মনে করার বিশেষ কারণ আছে। তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন শোনা যায় যে, তাঁর লেখার মাত্র পঁচিশটি পাঠক হলেই যথেষ্ট। অর্থাৎ তাঁর সংশয় বা প্রতীতি যাই বলি না কেন, সেটি যথার্থ। তবু কোনো কারণে তাঁর একটি উপন্যাস পাঠ করা হয় এবং অনুভব হয়, তাঁর লেখা পড়ার জন্য একটি অবস্থাকে স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। তা হল, জীবনের বহিরঙ্গের সুখবিলাস ও তৎসম্পর্কিত ধর্মীয় আচারের ভণ্ডামি থেকে নিজেকেও চাবুক মেরে জাগিয়ে দিতে হবে। নিজের সেই সব আসক্তি সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞাত থাকতে হবে। সেই উপন্যাসটি, যা কমলকুমারের ভাষার আড়ালে তাঁর গভীর জীবন দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে ছিল, তার নাম ‘অন্তর্জলী যাত্রা’। বহিরঙ্গে কুৎসিত সামাজিক ব্যাধি ও পুরুষতান্ত্রিকতার আড়ালে যা আসলে আধ্যাত্মিক জগতের গূঢ় রহস্যের কথা বলে।

এরপর গোলাপসুন্দরী ও শ্যামনৌকা তাঁর সেই দর্শনেরই পুনঃনির্মাণ। বলা উচিত সচেতন নির্মাণ। কারণ বাস্তবে এমন বহু চরিত্রই আমাদের অদেখা। যা শুধু তাঁর দর্শনের মূল কথাটি বলতেই নির্মিত হয়েছে। ‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক’ আরও দুর্বোধ্য বলে জানা ছিল, যা নাকি হৃদয়ঙ্গম করা অসাধ্য, তবু আকর্ষণ বড় ভয়ানক। তাঁর বর্মের মতো কঠিন ভাষা যেন লোহার অঙ্গরক্ষা। সে ভাষাকে ভেদ করা দুরূহ। যেন শব্দের অতীত এক অনুভূতি তিনি বারবার প্রকাশ করতে চেয়েছেন। বাস্তবের পটভূমিতে এক অবাস্তব কথামালা। হয়তো তিনি ইচ্ছে করেই একটি নিজস্ব সাহিত্যভাষা সৃষ্টি করেছিলেন এবং জনপ্রিয় সাহিত্যিকের মতো অজস্র গুণমুগ্ধ চাননি। যা চেয়েছেন তা হল, তাঁর অন্তর্জগতে উদ্ভাসিত এক অপূর্ব উপলব্ধির প্রকাশ।

প্রথম কথাটি, তিনি উপন্যাসে যে মায়ের মতো নারীচরিত্রটি এঁকেছেন তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সহধর্মিণী শ্রীমা সারদার মন্ত্রশিষ্যা। সেই সময়ের নিরিখে তিনি এবং তাঁর স্বামী সংস্কারমুক্ত। একটি ডোমের ছেলে (ডোম চরিত্র কমল কুমারের অতি প্রিয়, সম্ভবত তাদের পবিত্র কাজের কথা ভেবেই তিনি তাদের প্রতি এত আকৃষ্ট, কারণ মৃতদেহ সৎকারের চেয়ে বেশি পুণ্যকাজ আর কিইবা আছে!) সুঘরাইকে তিনি দেওঘরে বৈদ্যনাথ দর্শনে এনেছেন। বালক ভোজনের সময়ে সুঘরাই তার পাতে নিজের পোষা পাখিটিকে নিয়ে বসে। সম্ভবত পাখিটি তিতির। এই দৃশ্যে সেই রমণী যারপরনাই পুলকিত। মনে পড়ে ভারতবর্ষের অন্যতম আধ্যাত্মিক সম্পদ উপনিষদে বর্ণিত পাখিটির কথা। তৈত্তিরীয় উপনিষদে এমনই দুটি পাখির কথা আছে। একটি স্থির অপরটি চঞ্চল। স্থির পাখিটি পরমাত্মা, চঞ্চলটি জীবাত্মা। সুঘরাই যেন তার দেহপিঞ্জর থেকে মুক্ত করে আনে আত্মাকে। তারপর প্রসাদ গ্রহণ করে। এ দেহখাঁচায় সুঘরাই যেন নিজেই শুক। তার আত্মার মুক্তি কখনোই তার বাহ্যিক জগতের পরিচয়ের ওপরে নির্ভর করে না। অথচ কাহিনী যতই এগিয়েছে লক্ষ করা যায় যে সুঘরাই আধুনিক জগতের আবর্তে যেন ডুবতে থাকা একটি মানুষের মতো এই পরিবেশ থেকে মুক্তি চাইছে। কমল কুমারও কি তাইই চেয়েছেন? একথা ভুললে চলবে না যে সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টার মনস্তত্ত্বকেই খুঁজে পাওয়া যায়। যে কারণে তাঁর উপন্যাস শুরু হয় একটি প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে -জয় মাধব, তারা ব্রহ্মময়ী, মাগো—জয় রামকৃষ্ণ। মাত্র দশ বছরের এক বালকের অনুভূতিকে তিনি হঠাৎ কাহিনীরূপ দিলেন কেন? এ প্রশ্ন মনে জাগতেই বোঝা গেল তাঁর মনের সেই গতি। তিনি আদতে শ্রীরামকৃষ্ণের সেই চিরকালীন বালকভাবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বালক, যে কিনা ইন্দ্রিয়ের দাস নয়। ভোগ যাকে বিচলিত করে না। সেই বালক সুঘরাই একটি পবিত্র পরিচয় বহন করে। সমাজ তাকে যতই অন্ত্যজ করে রাখুক। সে ডোম। আর সে একটি পোষা পাখিকে খাঁচায় নিয়ে ঘোরে। সেটি তার প্রিয়জন। কমল কুমারের এই রূপকের আড়ালে কি সেই চিরন্তন সত্যটি দেখতে পাওয়া যায়না? এই দেহ, যা মানুষের অতি প্রিয়, যা জগতে নানা ভোগের আয়োজনে মত্ত থাকে তা আসলে হাড়মাসের খাঁচাটি। অন্তরাত্মা বন্দী থাকে সেখানে। সেই অচিন পাখিটিকে চিনতে পারলে মনোবেড়ি তার পায়ে পরানো সোজা।

একটি বিশেষ মুহূর্তে সুঘরাই দেখতে পায় বৈদ্যনাথ ধামে শিবের সঙ্গে বিবাহ দেবার জন্য পরমাসুন্দরী গৌরী সালংকারা কন্যাকে শোভাযাত্রা করে আনা হচ্ছে। কন্যাটি শিবের পরিণীতা হতে চলেছে। এই অলৌকিক পরিণয় প্রকৃতপক্ষে দুটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তৎকালীন সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় কুসংস্কার এবং পাণ্ডারাজের ভোগের বিকট আয়োজন। আর একটি মর্মার্থ পাওয়া যায়। অলৌকিক এই শোভাযাত্রায় যে অনাঘ্রাতা নির্মল কুমারীটি ঈশ্বরকে স্বামীত্বে বরণ করতে চলেছে সে প্রকৃতপক্ষে জাগতিক নয়। তার অস্তিত্ব জাগতিক নয়। আত্মিক। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন -তাঁকে লাভ করতে গেলে একটি প্রেমের শরীর চাই। এই শরীর নয়। কিন্তু এই অন্নময় শরীরের অন্তরে আর একটি শরীর আছে। তাকে বলে ভাগবতী তনু বা কারণ শরীর। এই শরীরে ঈশ্বরীয় আনন্দের আস্বাদন হয়। সে আনন্দ রমণানন্দের চেয়ে কোটিগুণ বেশি। এই অলৌকিক পরিণয় তাই চিরন্তন, যা কমল কুমারের আধ্যাত্মিক দর্শনের নির্যাস।

স্বল্প পরিসরে আর একটি বিশেষ দিক প্রকট হয়। সুঘরাই কিন্তু এই অন্নময় শরীর নিয়েই জগতে বিচরণ করে। সে তার খাঁচাটিকে নানা ভূষণে সাজাতে চায়। কারণ, এই শরীরখাঁচা বিনা সে যে কোনো আনন্দই উপভোগ করতে পারবে না! তাই খাঁচাটি প্রতিনিয়ত সাজাতে চায়। রিখিয়ায় উপস্থিত সেকালের সব চেঞ্জারবাবুরা ইন্দ্রিয় চরিতার্থ করার সব উপকরণ নিয়ে হাজির। অথচ সুঘরাই ব্যতিক্রম। তার পাখিটিকে মুক্ত করতে পারল কিনা স্পষ্ট বোঝা যায়না। পারা সম্ভবও নয়, কারণ সে পাখি মুক্ত হলে আকাশে বিচরণ করবে। মাটির পৃথিবী তার দেখা পায় না।

কমলকুমার তাঁর এই সমৃদ্ধ অন্তর্দৃষ্টি দিয়েই তাই আমাদের ভাষাকে পরিত্যাগ করেন। তাঁর শব্দ শুধুই আধ্যাত্মিক উপলব্ধির বাহক।

[অপ্রকাশিত]

0 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in



না অচেনার দেলাচলে জীবনসন্ধানী মনস্তাত্ত্বিক কথাশিল্পী নরেন্দ্রনাথ মিত্র


বাংলা গল্প উপন্যাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথা সাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯১৬--১৯৭৫) বাংলা সাহিত্য জগতে প্রায় বিস্মৃত প্রায়। অথচ তিনি তাঁর গল্প উপন্যাসে পরিচিতদেরেকে সুপরিচিত করে তুলেছেন আঁর মানসলোকের স্মৃতি থেকে নিজস্ব ঘরাণায়।

নরেন্দ্র মিত্র ‘চাঁদমিঞা’, ‘কাঠগোলাপ’, ‘চোর’, ‘রস’, ‘হেডমাস্টার’, ‘পালঙ্ক’, ‘ভুবন ডাক্তার’, ‘সোহাগিনী’, ‘আবরণ’, ‘সুহাসিনী তরল আলতা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য গল্পের স্রষ্টা । তাঁর প্রায় পাঁচ শত গল্পে অর্থনৈতিক,সামাজিক,মানসিক টানাপড়েন থাকলেও এক পর্যায়ে গল্পগুলো হয়ে উঠেছে মানব মানবীর জীবনের গল্প।

নরেন্দ্রনাথ মিত্র তার গল্পে দেশবিভাগ-দাঙ্গা-মন্বন্তর-যুদ্ধোত্তর বিপর্যস্ত অর্থনীতির টানাপেড়েনে মানুষের দু:খ কষ্টের মাঝেও কখন কখন সুখের আভাসও উঠে এসেছে। তাঁর গল্পের জমিনে ফুটে উঠেছে কষ্টের সাতকাহন। দুঃখের বিদীর্ণ প্রান্তরই যেন তাঁর গল্পের জমিন।
সত্যি কথা বলতে বাংলা ছোটপল্পের সার্থক রূপকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র অনেকটাই আজ অনালোচিত-অনালোকিত। অথচ তাঁর গল্পের বিষয় ও কাঠামোগত বিন্যাস বাংলা ছোটগল্পসহ বিশ্বছোটগল্পের সার্থক একজন প্রতিনিধি। পাঠককে নিমগ্নচিত্তে গল্পপাঠে মুগ্ধতার সাথে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে তাঁর লেখনী। জীবনের অতিসাধারণ তুচ্ছ বিষয়ও যে অসাধারণ গল্পের বিষয় হওয়া সম্ভব, তা তাঁর রচনা পাঠেই বোঝা সম্ভব।

নরেন্দ্রনাথ মিত্র ১৯১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি, বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ভাঙ্গা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আই.এ.এবং কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ-বিভাগের সময় তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় চলে গেলেও কিন্ত তাঁর মনে গেঁথে ছিল তার পূর্ববঙ্গের স্মৃতি ও ভালবাসা।
শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনের প্রারম্ভে দেখা পূর্ববঙ্গের খাল-বিল-নদী এবং গ্রামের প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবনের সুখ-দু:খ, প্রেম-ভালবাসা, বিরহ-বেদনার চিত্র বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে গভীর মমতায় তুলে ধরেছেন তার গল্প - উপন্যাসে। তার লেখালেখির সূত্রপাত বাল্যকাল থেকেই। অনেকে সাহিত্যিকের মতো নরেন্দ্র মিত্র কবিতা দিয়ে লেখালেখির সূত্রপাত করেন। কিন্তু‘ শেষ পর্যন্ত তিনি গল্প ও উপন্যাস সাহিত্যের সার্থক একজন গল্পকার হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তুলতে সক্ষম হন।।

তাঁর প্রথম মুদ্রিত কবিতা 'মূক', প্রথম মুদ্রিত গল্প 'মৃত্যু ও জীবন' দুটোই 'দেশ' পত্রিকায় ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়। বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে একত্রে প্রথম কাব্যগ্রন্থ’ 'জোনাকি' (১৩৪৫ বঙ্গাব্দ)। প্রথম গল্প-সংগ্রহ 'অসমতল' (১৩৫২ বঙ্গাব্দ)। প্রথম উপন্যাস 'হরিবংশ'। চার দশক ধরে তিনি প্রায় পাঁচশো গল্প লিখেছেন। সেই সব গল্পগুলো প্রায় পঞ্চাশটি গল্পগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। তাঁর লেখা গল্প সংকলনগুলো হল ‘অসমতল’,‘হলদে বাঢ়ি’,‘চডাই- উৎরাই’,‘বিদ্যুতলতা’,‘সেতার’,‘ উল্টোরথ’,‘পতাকা’ ইত্যাদি, যা চার দশক ধরে লিখেছেন।

অন্যদিকে তাঁর লেখা উপন্যাসগুলো হচ্ছে ‘রূপমঞ্জরী’,‘অক্ষরে অক্ষরে’ ‘দেহমন’,‘দূরভাষিণী’,‘সঙ্গিনী’,‘অনুরাগিণী’,‘সহৃদয়া’ ‘গোধুলি’,‘শুল্কপক্ষ’,‘চোরাবালি’, ‘পরস্পর ‘,জলপ্রপাত’,‘কণ্যাকুমারী’,‘সুখ দুঃখের ঢেউ’,‘প্রথম তোরণ’,‘তার এক পৃথিবী’,‘সেই পথটুকু’,‘নীড়ের কথা’,‘নতুন ভূবন’,‘জলমাটিরগন্ধ’,‘শিখা’,‘অনাত্মীয়া’‘নতুন তোরণ’, ‘সূর্যমুখী,‘সিঁদূরে মেঘ নির্বাস ‘ ইত্যাদি। উপন্যাসের মধ্যে 'দীপপুঞ্জ', 'চেনামহল', 'তিন দিন তিন রাত্রি' ও 'সূর্যসাক্ষী', দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশকাল থেকেই কিশেষ ভাবে সমাদৃত। তিনি ছোটগল্পকার হিসাবে বাংলা গল্প সাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন সেটাই বক্ষ্যমান নিবন্ধে তাঁর লেখা মাত্র একটি গল্পের উপর আলোচনা করে বুঝবার চেষ্টা করবে। এক্ষেত্রে মিত্রের ছোটগল্পগুলোর মাঝ থেকে সর্বাপেক্ষা পাঠকপ্রিয় ছোটগল্প ‘ রস’ এর উপর স্বল্প পরিসরে আলোকপাত করতে পারি।

‘রস’ তাঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি। গল্পটি নিয়ে বহু নাটক, টিভি সিরিয়াল ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। হিন্দি চলচ্চিত্র ‘সওদাগর’-এ দুনিয়াখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন অভিনয় করেছেন।
নরেন্দ্র মিত্রে নিজের কথা থেকেই উপলব্ধি করা যায় তিনি তাঁর নিজের দেখা ঘটনাপ্রবাহকে গল্পের আকারে তুলে এনেছেন। তিনি তাঁর পরিচিতদেরেকে সুপরিচিত করে তুলেছেন সে কথা তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘ রস’ এর ভুমিকা থেকে আমরা জানতে পারি।।
নরেন্দ্র মিত্র বলেছেন রস গল্পের ভূমিকায় বলেছেন , ‘ এ গল্পের যে পটভূমি তা আমার খুবই পরিচিত। পূর্ববঙ্গে আমাদের গ্রামের বাড়িতে পূর্বদিকে ছিল একটি পুকুর। সেই পুকুরের চারধারে ছিল অজস্র খেজুর গাছ। ছেলেবেলা থেকে দেখতাম আমাদের প্রতিবেশী কিষাণকে সে সব খেজুর গাছের মাথা চেঁছে মাটির হাঁড়ি বেঁধে রাখত। বাঁশের নল বেয়ে সেই হাঁড়িতে সারারাত ধরে ঝির ঝির করে রস পড়ত। সেই রস কড়াইতে করে, বড় বড় মাটির হাঁড়িতে করে জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করতেন আমাদের মা-জেঠীমারা। শীতের দিনে রস থেকে গুড় তৈরির এই প্রক্রিয়া মায়ের পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে রোজ দেখতাম। আমাদের চিরচেনা এই পরিবেশ থেকে ‘রস’ গল্পটি বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু রসের যে কাহিনীর অংশ; মোতালেফ, মাজু খাতুন আর ফুলবানুকে নিয়ে যে হৃদয়দ্বন্দ্ব, খেজুর রসকে ঘিরে রূপাসক্তির সঙ্গে যে জীবিকার সংঘাত তা কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আসেনি। সেই কাহিনী আমি দেখিওনি, শুনিওনি। তা মনের মধ্যে যেন আপনা থেকেই বানিয়ে বানিয়ে উঠেছে।’

গল্পকার তার গ্রামে দেখা একটা সাধারণ ঘটনাকে অবলম্বন করে উঁচুদরের শিল্পোত্তীর্ণ, রস সমৃদ্ধ ‘রস’ গল্পটি রচনা করেছেন। এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আছে মোতালেফ গাছি। সে নারী বিলাসী প্রেমিক পুরুষ হলেও জীবন ও যৌবনের চাহিদা মেটানোর জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করতে সে কসুর করেনি।

আমরা তার রস গল্পের সারাংশ তুলে ধরে মূল গল্প থেকে আংশিক উদ্ধৃতি দিতে পারি নরেন্দ্র মিত্রে সৃজনশীলতা ও পরিচিত গল্পকে সুপরিচিত আঙ্গিকে রূপদানের ক্ষমতাকে বুঝানোর জন্যে। তাঁর ‘রস’ গল্পের শুরুটা এমন:

‘ কার্তিকের মাঝামাঝি চৌধুরীদের খেজুরগাছ ঝুড়তে শুরু করল মোতালেফ। তারপর দিন পনেরো যেতে না যেতেই নিকা করে নিয়ে এল পাশের বাড়ির রাজেক মৃধার বিধবা স্ত্রী মাজু খাতুনকে। পাড়াপড়শি সবাই অবাক। এই অবশ্য প্রথম সংসার নয় মোতালেফের। এর আগের বউ বছরখানেক আগে মারা গেছে। তবু পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের জোয়ান পুরুষ মোতালেফ। আর মাজু খাতুন ত্রিশে না পৌঁছলেও তার কাছাকাছি গোছে। ছেলেপুলের ঝামেলা অবশ্য মাজু খাতুনের নেই। মেয়ে ছিল একটি, কাটিখালির সেখেদের ঘরে বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ঝামেলা যেমন নেই, তেমনি মাজু খাতুনের আছেই-বা কী? বাক্স সিন্দুক ভরে যেন কত সোনাদানা রেখে গেছে রাজেক মৃধা, মাঠ ভরে যেন কত ক্ষেতখামার রেখে গেছে যে তার ওয়ারিশি পাবে মাজু খাতুন। ভাগের ভাগ ভিটার পেয়েছে কাঠাখানেক, আর আছে একখানি পড়ো পড়ো শণের কুঁড়ে। এই তো বিষয়-সম্পত্তি, তারপর দেখতেই-বা এমন কী একখানা ডানা-কাটা হুরির মতো চেহারা। দজ্জাল মেয়েমানুষের আঁটসাঁট শক্ত গড়নটুকু ছাড়া কী আছে মাজু খাতুনের যা দেখে ভোলে পুরুষেরা, মন তাদের মুগ্ধ হয়।’

মাজু খাতুনকে বিয়ে করার পাড়া প্রতিবেশী মহিলারা মোটেই খুশি নয় । তারা মনে করে দজ্জাল স্বভাবের মাজু তুকতাক করে মোতালেফ গাছিকে বশ করেছে। মোতোলেফের ইচ্ছে ছিল কম বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করার, সে চেষ্টাও কিন্তু কম করেনি। কিন্তু অল্প বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করতে অনেক পয়সা করি দরকার। চরকান্দার এলেম শেখের আঠার-উনিশ বছরের মেয়ে ফুলবানুকে মোতালেফ এর বেশি মনে ধরেছিল।কিন্তু ফুলবানুকে পাওয়ার জন্য তার বাবাকে অনেক টাকা দেওয়া লাগবে, তার সে কোথায় পাবে! তবুও ফুলবানুকে পাওয়ার জন্য সে কম চেষ্টা করেনি।আমরা আবার নরেন্দ্র গল্প থেকে উদ্ধৃত দিতে পারি।

‘ ইতোমধ্যে অবশ্য এক হাত ঘুরে এসেছে ফুলবানু। খেতে-পরতে কষ্ট দেয়, মারধর করে এসব অজুহাতে তালাক নিয়ে এসেছে কইডুবির গফুর সিকদারের কাছ থেকে। আসলে বয়স বেশি আর চেহারা সুন্দর নয় বলে গফুরকে পছন্দ হয়নি ফুলবানুর। তালাক নেয়া হলেও চেকনাই ও জেল্লাই দেহ আর রসের ঢেউ খেলা মন মোতালেফকে টেনেছে বিশেষভাবে; ‘ফরসা ছিপছিপে চেহারা’ আর ‘ঢেউ খেলানো টেরিকাটা বাবরিওয়ালা’ খেজুর রসের কারবারি মোতালেফকেও চোখে ধরেছে ফুলবানুর ।’

ফুলবানুকে বউ হিসাবে পাওয়ার জন্য টাকা দিতে না পেরে মন:ক্ষুন্ন হয়ে মোতালেফ ফুলবানুর বাবার কাছ থেকে বাড়ি ফেরার সময় পথে জঙ্গলের ধারে মুখোমুখি হয় ফুলবানুর । ফুলবানু মোতালেফকে বলে- ‘কী মেঞা, গোসা কইরা ফিরা চললা নাকি?... পছন্দসই জিনিস নেবা, বাজানের গুনা, তার দাম দেবা না?... শোনো, বাজানের মাইয়া টাকা চায় না, সোনাদানাও চায় না, কেবল মান রাখতে চায় মনের মাইনষের। মাইনষের ত্যাজ দেখতে চায়, বুঝছ ?’ ’ মোতালেফ ফুলবানুকে ঘরে তোলার জন্য ব্যাকুল। জানায় : ‘শীতের কয়ডা মাস যাউক, ত্যাজও দেখাব, মানও দেখাব। কিন্তু‘ বিবিজানের সবুর থাকবেনি দেখবার ?’

ফুলবানুর কথা শোনার পর থেকে মোতালেফ মরিয়া হয়ে ওঠে ধারকর্জ করে টাকা জোগাড় করতে। কিন্তু ধারকর্জ সে পায় না। কিন্তু সে ফুলবানুকে পাওয়ার জন্য হাল ছাড়ে না। মোতালেফ গাছির প্রত্যাশা পূরণের জন্যই যেন খেজুর গাছগুলো উন্মুখ হয়ে উঠে। যুবতী নারী লোভী রস আহোরণকারী মোতালেফের ভাগ্যে যেন সুদিন আসার আভাস দেখা দেওয়ার কথা নরেন্দ্র মিত্রের কলমে কীভাবে উঠে এসে আমরা দেখতে পারি।

‘কিন্তু নগদ টাকা ধার না-পেলেও শীতের সূচনাতেই পাড়ার চার-পাঁচ কুড়ি খেজুরগাছের বন্দোবস্ত পেল মোতালেফ। গত বছর থেকেই গাছের সংখ্যা বাড়ছিল, এবার চৌধুরীদের বাগানের, অর্ধেক তার। মেহনত কম নয়, এক একটি করে এতগুলো গাছের শুকনো মরা ডালগুলো বেছে-বেছে আগে কেটে ফেলতে হবে। বালিকাচার ধার তুলেতুলে জুতসই করে নিতে হবে ছ্যান। তারপর সেই ধারালো ছ্যানে গাছের আগা চেঁছে চেঁছে তার মধ্যে নল পুঁততে হবে সরু কঞ্চি ফেড়ে। সেই নলের মুখে লাগসই করে বাঁধতে হবে মেটে হাঁড়ি। তবে তো দেড়কুড়ি গাছ বেশি হল। গাছ কেটে হাঁড়ি পেতে রস নামিয়ে দিতে হবে। অর্ধেক রস মালিকের রাতভরে টুপটুপ করে রস পড়বে সেই হাঁড়িতে। অনেক খাটুনি, অনেক খেজমৎ। শুকনো শক্ত খেজুরগাছ থেকে রস বের করতে হলে আগে ঘাম বের করতে হয় গায়ের। এ তো আর মা’র দুধ নয়, গাইয়ের দুধ নয় যে বোঁটায় বানে মুখ দিলেই হল।’

কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্র মিত্র তার চিরচেনা দৃশ্যপট থেকে আহরিত অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তার রস গল্পে নারীর মন ও শরীর থেকে পুরুষের রস সংগ্রহের কলাকৌসল তুলে ধরেছেন। একজন গাছিকে খেজুর গাছের শক্ত মাথা থেকে রস সংগ্রহ করতে পরিশ্রান্ত হতে হয়। নিয়মকানুন মেনে খেজুর গাছের মাথায় বাঁধা হাড়িতে সারারাত টুপটাপ শব্দ করে রস পড়ে হাড়ি রসে পূর্ণ হয়।

খেজুর রসের কারবারি মোতালেফের ওস্তাদ রাজেক মৃধা। মোতালেফ রাজেক মৃধার কাছ থেকে খেজুর গাছের শুকনো মাথা ‘ ছ্যানদা ‘ দিয়ে কেটে রস বের করার দক্ষতা অর্জন লাভ করে। রাজেকের কয়েকজন শাগরেদের মধ্যে মোতালেফই পাকা সফল গাছি হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে। রাজেক মরার পর তার স্ত্রীকে ঘরের বউ করে আনার পেছনে একটা বড়সড় কারণ ছিল। খেজুর গাছ কেটে রস জোগাড় করলেই তো গুড়, পাটালি তৈরি হয় না। মোতালেফে মা মরেছে তার দু’বছর বয়সের সময়। বউটাও অকালে, এখন কে রস জ্বাল দিয়ে গুড় পাটালি বানাবে?

মোতালেফের রস জ্বাল দেওয়ার জন্য মাঝ বয়সী বিধবা মাজু খাতুনকে পেয়ে পয়সার বিনিময়ে রস জ্বাল দেওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু রস বা গুড় সামান্য হলেও চুরি করার সন্দেহে তাকে দিয়ে পুরোটা শীতকাল কাজ করায় না। তারপরও সে মজুরি হাঁকে প্রায় দ্বিগুণ। এবার মোতালেফের ভিন্ন ফঁন্দি আটে। ভণিতা না করেই মোতালেফ সরাসরি মাজুকে বলে সে মজুরি প্রদান নয়, ষোলআনা লাভের মালিক বানাতে চায়; বিয়ে করে ঘরের বউ করে নিয়ে যেতে চায়। সামনে রসের সময় আসছে। মাজুর মতো আঁটসাঁট মেয়েমানুষ তার প্রয়োজন। তা না হলে এত গাছের এত এত রস সামাল দেবে কে? তবে, মাজুর সামান্য আপত্তি এ জন্য যে, জগতে যুবতী মেয়ে থাকতে মধ্যবয়সী মাজুকে তার কী দরকার? এমন প্রশ্নের জবাবে মোতালেফ বলে :
‘কমবয়সী মাইয়া-পোলা অনেক পাওয়া যায়। কিন্তু শত হইলেও তারা কাঁচা রসের হাঁড়ি।... তুমি হইলা নেশার কালে তাড়ি আর নাস্তার কালে গুড়, তোমার সাথে তাগো তুলনা?’ নারী-ভুলানো কৌশল আর নারীর মাদকতা ও মিষ্টত্ব বিষয়ে সতর্ক মানুষ মোতালেফ। এমন ‘খাপসুরৎ’ আর ‘মানানসই কথা’র লোক — রসিক-সমর্থ পুর“ষ মানুষ, তাকে অগ্রাহ্য করে কী করে মাঝবয়সী মাজু? কাজেই শুর“ হলো নতুন এক ‘ভাঙাচোরা-জোড়াতালি-দেওয়া’ সংসার! — যেখানে ঝানু খেলোয়াড় মোতালেফ ‘সঙ’ আর পুর“ষের আশ্রয়প্রত্যাশী চিরায়ত বাঙালি নারী মাজু হলো ‘সার’। এখন রস-আসবার কাল। শীতের প্রহর। রাতে শরীরের গন্ধ ও উষ্ণতা নেয়ার সময়! খেজুর গাছ আর রস; রস আর মেয়েমানুষ — সব মিলিয়ে শীতের প্রহরই বটে! ব্যস্ত মোতালেফ। দিনে-রাতে মাজু বিবির কোনো অবসর নেই। ‘এর-ওর বাগান থেকে, জঙ্গল থেকে, শুকনো পাতা ঝাঁট দিয়ে আনে ঝাঁকা ভরে ভরে, পলো ভরে ভরে, বিকেলে বসে বসে দা দিয়ে টুকরো টুকরো করে শুকনো ডাল কাটে জ্বালানির জন্যে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, খাটুনি গায়ে লাগে না, অনেকদিন পরে মনের মতো কাজ পেয়েছে মাজুবানু, মনের মতো মানুষ পেয়েছে ঘরে।’‘

মোতালেফ তার কারবারের জন্য মাঝ বয়সী মাজুকে বিয়ে করলেও তার মনের মতো বউ না পেয়ে মোতালেফ কিন্তু খুশি নয়। কারণ, তার মন জুড়ে ছিল যুবতী নারী ফুলবানু।তাকে বিয়ে করার জন্য দরকার টাকা, আর সেই টাকা জোগাড় করার জন্যই খেজুর রস থেকে গুড় বানানোর জন্যই সে আপাতত মাঝবয়সী মাজুকে বিয়ে করেছে।
তার প্রয়োজন ‘রসের মানুষ’ যুবতী নারী! মাঝবয়সী শাশুড়ি হয়ে-যাওয়া মাজুকে দিয়ে তার বেশিদিন চলে কি? এক সময় গুড় বিক্রি টাকা থেকে ফুলবানুকে বিয়ে করার জন্য তার বাবা এলেমের হাতে অগ্রিম পঞ্চাশ টাকা গুঁজে দেয় মোতালেফ। তবে, মাজুকে বিয়ে করে ফেলায় এলেমের আপত্তি। কিন্তু মোতালেফ জানায় : ‘তার জন্যে ভাবেন ক্যান্ মেঞাসাব। গাছে রস যদ্দিন আছে, গায়ে শীত যদ্দিন আছে মাজু খাতুনও তদ্দিন আছে আমার ঘরে। দক্ষিণা বাতাস খেললেই সব সাফ হইয়া যাবে উইড়া।’ ফুলবানুর বাবা খুশি হয়; ফুলবানুও। তবে, ‘রসে ভরপুর’ নারী ফুলবানু খানিক গোসা করার ভান করে বলে : ‘বেসবুর কেডা হইল মেঞা? এদিকে আমি রইলাম পথ চাইয়া আর তুমি ঘরে নিয়া ঢুকাইলা আর-একজনারে।’

মাসদুয়েকের মধ্যেই ফুলবানু মোতালেফ নতুন বউ মাজুবানুর গন্ধ এবং তার পুরনো স্বামীর গায়ের গন্ধ ভুলে গিয়ে নতুন রসের সন্ধানে মিলিত হলো। মাজুবিবির স্বভাব-চরিত্র ভার না এই অভিযোগে তাকে তালাক দিয়ে মোতালেফ ফুলবানুকে ঘরে তুলল। মিথ্যা অপবাদ নিয়ে মোতালেফের ঘর ছেড়ে যাওয়ার আগে মাজু বলল: ‘তোমার গতরই কেবল সোন্দর মোতি মেঞা, ভিতর সোন্দর না। এত শয়তানি, এত ছলচাতুরী তোমার মনে! গুড়ের সময় পিঁপড়ার মতো লাইগা ছিলা, আর যেই গুড় ফুরাইল অমনি দূর দূর।’

রসের কারবারী মোতালেফ যৌবনবতী ফুলবানুকে বিয়ে করে ঘরে তুলে দু’দিক থেকেই লাভবান। ফুলবানুর পূণর্ যৌবনের রস ও খেজুর গাছের রস উপভোগ করে মোতালেফের অবস্থা রমরমা। জৈবিক চাহিদা পুরণের জন্য মোতালেফ মাজু বিবির সঙ্গে প্রতারণা করে ফুলবানুকে লাভ করলেও তার নতুন বউ ফুলবানুর কাছ থেকে কাম রস আহরণ করতে পারলেও দিনের আলোয় রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানানোর বিষয়ে ফুলবানুর অভিজ্ঞ না থাকায় এদিক থেকে তেমন সুবিধা পায় না ফুলবানু থেকে। নারী ও রসের বিষয়ে মোতালেফের চোখ প্রখর হলেও ভালো সংসারী যে সে নয়, তার খানিকটা পরিচয় আমরা পাই গল্পকারের কহিনিতে। শুধুমাত্র শরীর দিয়ে সংসার চলে না তাতে সোহাগের দরকার পড়ে সত্যি, কিন্তু তাই বলে ঘর সংসারকে সাজিয়ে তোলার জন্য উভয়কেই একজোট হয়ে কাজ করতে হয়।

এদিকে মোতালেফের কাছ থেকে তালাক পেয়ে মাজু কিন্তু নিরাশ্রয় ভাবে থাকতে পারে না, তারও একটা আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়। মাজু পুনরায় বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চায়, তবে এবার সোয়মী নির্বাচনে সে সতর্ক। রসের সঙ্গে কিছুমাত্র যার সম্পর্ক নেই, শীতকালের খেজুরগাছের ধারেকাছেও যে যায় না, নিকা যদি বসে মাজু খাতুন তার সঙ্গেই বসবে। রসের ব্যাপারে মাজু খাতুনের ঘেন্না ধরে গেছে। সে কম বয়সী পুরুষকে আর বিশ্বাস করতে পারে না, বিশ্বাস নেই যৌবনকে। শেষমেশ সে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক মাঝবুড়োকে বিয়ে করে ।

মাজুর মতো অনাথা মেয়েমানুষ বিপদের সময় মোতালেফের পাশে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু সুসময়ে তাকে তাড়িয়ে দেওয়ায় বিধাতা যেন মোতালেফের প্রতারণাকে মেনে নিতে পারেননি। যৌবনের তাড়নায় মোতালেফ রসে ভরা যুবতী ফুলবানুকে বিয়ে করার পর মোতালেফ গাছির ঘরে কিন্তু শাস্তি যেন আসেনি। এক সময় তার খেজুর গুড়ের কারবার লাটে ওঠে। সৌখিন শাড়ি পরা যুবতী ফূলবানু রসের সৌয়ামীর অপেক্ষায় প্রহর গোণে সেই ফুলবানুকে দিয়ে রস থেকে বাজাওে চলা গুড় বানানো হয়ে ওঠে কী করে! এ কারণেই গুড়ের ব্যবসা, বছর ঘুরতেই লাটে ওঠে মোতালেফের। সংসারে শুরু হয় অশান্তির যা শেষমেশ মারামারি-গালাগালিতে পৌঁছে।

এক সময় মোতালেফের মন খারাপ হয়। সে নিজের ভুল বুঝতে পারে।মাজুর জন্য যেন তার মন কাঁদে।,তার মন চায় মাজুর কাছে ছুটে যেতে। তাই সে একদিন মাজুর নতুন স্বামী নাদির মিঞার বাড়িতে ছুটে যায়। সঙ্গে নিয়ে রসের হাঁড়ি তাকে খাওয়ানোর জন্য নয়।মাজু রস জ্বাল দিয়ে খানিকটা গুড় তৈরি করে দিক, সে গুড় অজানা হাটে অচেনা খদ্দেরের কাছে বিক্রি করে মোতালেফ তার হারানো গুড়ের সুনাম ফেরাতে চায় ।অতিথি হিসেবে নাদিরের কাছে মোতালেফ সমাদর পায় , কিন্তু ক্ষোভে লজ্জায় অপমান করতে উদ্যত হয় মাজু। তারপরও কথা থাকে। প্রকৃতির নিয়ম বড় বিচিত্র! ভেতরে ভেতরে বোধ করি মোতালেফের জন্য মাজুরও মন কাঁদে। ভালবাসা মরে না তাই নরেন্দ্রনাথ মিত্র তার ‘রস’ গল্পটির কাহিনী শেষ করছেন এভাবে :
‘গলাটা যেন ধরে এল মোতালেফের। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আরো কী বলতে যাচ্ছিল, বাখারির বেড়ার ফাঁকে চোখে পড়ল কালো বড় বড় আর দুটি চোখ ছলছল করে উঠেছে। চুপ করে তাকিয়ে রইল মোতালেফ আর কিছু বলা হল না। হঠাৎ যেন হুঁশ হল নাদির শেখের ডাকে, ‘ও কী মেঞা, হুঁকাই যে কেবল ধইরা রইলেন হাতে, তামাক খাইলেন না, আগুন যে নিবা গেল কইলকার।’ হুঁকোতে মুখ দিতে দিতে মোতালেফ বলল, ‘না মেঞাভাই, নেবে নাই’।’
কথাশিল্পী নরেন্দ্র মিত্র ‘রস’ গল্প ছাড়াও আরো গল্পে বাংলার পরিচিত কাহিনিকে সুপরিচিত করে তুলেছেন।

গল্পের সার্থক রূপকারের মাঝেই 'দীপপুঞ্জ', 'চেনামহল', 'তিন দিন তিন রাত্রি' ও '‘সূর্যসাক্ষী'’ ইত্যাদির মতো উপন্যাসের ঔপন্যাসিক হওয়ার যোগ্যতা আছে। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর লোকান্তরিত হলেও আজ এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় নরেন্দ্রনাথ মিত্র মানব মানবীর অন্তর্লোকের অনুসন্ধানী গল্পকার।.

0 comments:

0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in



টোটো কোম্পানি


পম্পা ও বিরূপাক্ষ


“দক্ষিণ ভারতে বাক্য প্রচলিত আছে : গঙ্গার জলে স্নান, তুঙ্গার জল পান। অর্থাৎ গঙ্গার জলে স্নান করিলে যে পুণ্য হয়, তুঙ্গার জল পান করিলেও সেই পুণ্য। তুঙ্গার জল পীযূষতুল্য, মৃত-সঞ্জীবন।

কোনো এক স্তব্ধ সন্ধ্যায়, আকাশে সূর্য যখন অস্ত গিয়াছে কিন্তু নক্ষত্র পরিস্ফুট হয় নাই, সেই সন্ধিক্ষণে কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রার সঙ্গমস্থলে ত্রিকোণ ভূমির উপর দাঁড়াও। কান পাতিয়া শোনো, শুনিতে পাইবে তুঙ্গভদ্রা কৃষ্ণার কানে কানে কথা বলিতেছে;

নিজের অতীত সৌভাগ্যের দিনের গল্প বলিতেছে। কত নাম—হরিহর বুক কুমার কম্পন দেবরায় মল্লিকার্জুন—তোমার কানে আসিবে। কত কুটিল রহস্য, কত বীরত্বের কাহিনী, কত কৃতঘ্নতা, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রেম বিদ্বেষ কৌতুক কুতূহল, জন্মমৃত্যুর বৃত্তান্ত শুনিতে পাইবে।


তুঙ্গভদ্রার এই ঊর্মিমর্মর ইতিহাস নয়, স্মৃতিকথা। কিন্তু সকল ইতিহাসের পিছনেই স্মৃতিকথা লুকাইয়া আছে। যেখানে স্মৃতি নাই সেখানে ইতিহাস নাই। আমরা আজ তুঙ্গভদ্রার স্মৃতিপ্রবাহ হইতে এক গণ্ডূষ তুলিয়া লইয়া পান করিব।“

(তুঙ্গভদ্রার তীরে- শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়)

এ চত্বরের পায়ে পায়ে ইতিহাস ঘুরে বেড়ায়। মন্দিরে পাওয়া শিলালিপিগুলি যদি সন্ধান

করা হয় তবে পাওয়া যাবে এর শুরু সেই সাত শতকে। নয়-দশ শতকে প্রথমে চালুক্য, তার পর হোয়সল রাজত্বের আমল থেকে এই দেবস্থানের বাড়-বাড়ন্ত শুরু হয়। তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণ পাড়ের এই বিপুল মন্দির স্থাপত্য গৌরবের শীর্ষে পৌঁছোয় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের কালে। বর্তমান মন্দিরটি গড়ার কাজ শুরু হয় দ্বিতীয় দেবরায়ের সময়। সম্পূর্ণ হয় সেকালের 'মহারাজাধিরাজ' কৃষ্ণদেব রায়ের আনুকূল্যে। মন্দিরটির প্রচলিত নাম বিরূপাক্ষ মন্দির। অন্য নাম পম্পাপতি মন্দির। 'পম্পাদেবী' নদীরূপা এক স্থানিক জনপ্রিয় দেবী। তাঁর সঙ্গে শৈব সংস্কৃতির সংযোগ ঘটানো হয়। 'বিরূপাক্ষ' শিবের অন্যতম বিভূতি। পম্পাদেবী তাঁর সহচরী হয়ে ওঠেন।

এই দেবালয়ে বিরূপাক্ষ শিবের মন্দিরটি মুখ্য হলেও পম্পাদেবীর আলাদা মন্দির রয়েছে। তুঙ্গভদ্রা নদী ও বিরূপাক্ষ মন্দির হয়ে উঠেছিলো বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রধান ধর্মীয় কেন্দ্র।

এককালের একটি গৌণ দেবালয় থেকে সাত-আট শতকের মধ্যে দেশের
একটি মুখ্য ধর্মীয় কেন্দ্র হয়ে ওঠার পিছনে শুধু ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক কারণও ছিলো। আট শতকের চালুক্য রাজা বিক্রমাদিত্যের মহারানি লোকমহাদেবী ছিলেন এক উচ্চাকাঙ্খী রাজমহিষী। তিনি চেয়েছিলেন পম্পাপতি মন্দিরের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের পিছনে তাঁদের রাজকীয় প্রতাপের চিহ্ন যেন আঁকা থাকে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রথম থেকেই মধ্য পুরাণযুগে রাজাকে দেবতার প্রতিচ্ছবি করে লোকমনে বিশ্বাস সৃষ্টি করার প্রয়াস শুরু হয়। এই চালুক্য রানি দাক্ষিণাত্যে সেই পথটিই অনুসরণ করেছিলেন। মন্দিরের ভাস্কর্যের কল্পনা ও নির্মাণ
আপাতভাবে রামায়ণ, মহাভারত বা কৃষ্ণলীলায় বর্ণিত দেবতাদের প্রতিফলন হলেও গূঢ়তঃ তারা ছিলো রাজকীয় মহিমার প্রতিভূ। পরবর্তীকালের রাজারাও সেই ঐতিহ্যই বজায় রেখেছিলেন।

মূল মন্দির ছাড়াও এই প্রকল্পের অন্যান্য নির্মাণগুলি, যেমন গোপুরম, রঙ্গমণ্ডপ, নান্দী, স্তম্ভসারি, প্রদক্ষিণ ইত্যাদি জুড়ে ছড়িয়ে আছে রাজকীয় জাঁক ও দাপের অবিরল প্রতীকগুলি। ১৫৬৫ সালে বিজয়নগর সাম্রাজ্য ও হাম্পির গৌরব অস্তমিত হলেও লোকবিশ্বাসে বিরূপাক্ষ-পম্পার গরিমা ম্লান হয়নি। নিঃসন্দেহে এই মন্দিরটি এদেশের একটি দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন পূজাস্থল।

রামায়ণের কালে তুঙ্গভদ্রার নাম ছিলো পম্পা নদী। এর তীরেই অঞ্জানেয় পর্বতে মহাবীর হনুমানের জন্ম। মায়ের নাম অঞ্জনা। বিরূপাক্ষ মন্দিরে এই নদী দেবীর মর্যাদায় পূজিতা হ'ন। অসংখ্য হিন্দু তীর্থভূমি এখনও দাঁড়িয়ে আছে এর দু’তীরে। শৈবমতের প্রধান কেন্দ্র যেমন, শৃঙ্গেরি সারদাপীঠমে ছিলো আদি শঙ্করের মূল অধিষ্ঠান। রয়েছে মন্ত্রালয়ম শ্রী রাঘবেন্দ্রস্বামী মঠ, কুর্নুল আর আলমপুরে। মহবুবনগরে যোগালম্ব মন্দিরের খ্যাতি দক্ষিণকাশী হিসেবে। অন্ধ্র, কর্ণাটক আর তেলেঙ্গানা

রাজ্যের এইসব তীর্থ আর সীমানা ছুঁয়ে বয়ে গিয়েছে রূপসী নদীটি। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের গরিমাময় অতীতকে ধারণ করে রয়েছে বিরূপাক্ষ মন্দির ও তুঙ্গভদ্রার রোমান্টিক আবহ। বাঙালির হৃদয়ের কাছে এই মন্দির তুঙ্গভদ্রা নদী'কে প্রথম নিয়ে এসেছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্ভবত তার পর থেকে বাঙালি পাঠকের, বৃহত্তর অর্থে বাঙালিমননে এই স্থানখণ্ডটির একটি স্থায়ী জায়গা হয়ে গেছে।

হাম্পির প্রত্ন অবশেষের তীর ধরে, বিরূপাক্ষ মন্দিরের ঘাট ছুঁয়ে, এই মায়াবী কল্পকথার জগৎটি বোধ হয় শেষ হয় না।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



কানাইদা ডেকেছেন!
কানাইদা, মানে যিনি এখন বড় মহারাজ হয়েছেন। মোটাসোটা মাঝবয়েসী চশমা চোখে, একটু টাকমাথা, গেরুয়া পাঞ্জাবীর নীচে একটা মোটা বেল্ট দিয়ে ভুঁড়িটাকে একটু তুলে বেঁধে রাখেন। ওঁর পোশাকী নাম স্বামী শান্তিময়ানন্দ।
তবে আমাদের সবাইকে উনি চুম্বকের মত টানেন। আমরা সবাই ওঁর ভক্ত, ওঁর ফ্যান।
উনি সাত্ত্বিক কম, রাজসিক বেশি। ওঁর ঘরের খাটে ফিনফিনে মশারিটি বেশ দামী; সিলিং ফ্যান ছাড়াও পাশের টুলে রয়েছে সিনি টেবিল ফ্যান, একটি ট্রানজিস্টর রেডিও; আর ছোট আলমারিতে বাংলা সাহিত্যের ভাল ভাল বই।
ওনার বাংলা, ইংরেজি ও সংস্কৃতে সমান দখল। রোজ রাত্তিরে খাওয়া দাওয়ার পরে কিছু ছেলে যায় ওঁর ঘরে। তাদের উনি অনেক গল্প শোনান। ঘরে সব আলো নিভে গিয়ে নীল আলো জ্বলে।
আস্তে আস্তে ওনার চোখে ঘুম নেমে আসে। কিছু বাচ্চাও হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে। বাকিরা সবাইকে তুলে ঘরে ফিরিয়ে আনে।
উনি আমাদের আশ্রমের ব্যান্ড পার্টি গড়ে দিয়েছেন। অনেকটা ইন্ডিয়ান নেভির মত ইউনিফর্ম স্কার্ফ ও টুপি পড়ে আমরা ড্রাম, কেটল ও বিউগল বাজাই। আমিও শিখেছি কেটল ড্রাম বাজাতে। ১লা বৈশাখে, ১৫ অগাস্টে, ২৬ জানুয়ারিতে আমাদের ব্যান্ড বাঁকুড়া মিউনিসিপ্যালিটির মাঠে পুলিশ ব্যান্ডের সঙ্গে পাল্লা দিত।
উনি ক্রিকেট ম্যাচে কখনও সখনও আম্পায়ারিং করতেন। এল বি ডব্লিউয়ের নতুন নিয়ম উনি জানেন। প্রত্যেক বার আমাদের নাটকে উনি মিউজিক দিতেন। তার কিছু গান হিট হত; পরের দুয়েক বছরও সবাই সেগুলো গুনগুন করত। যেমন কুশধ্বজ নাটকে বলি চড়বার আগে মেমারি থেকে আসা ফুটফুটে ছেলেটি গাইল-- "পায়ের ধূলো, দাও গো দাদা! সময় যে আর নাই-ই-ই; এবার আ-আমি যাই।" গান এমন হিট হল যে ছেলেটির আসল নাম হারিয়ে গিয়ে নতুন নাম হল --কুশে!


ভর্তির সময়ই আমাদের হাতে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল একটি নীল রঙের পাতলা বই--সংগীত সংকলন, সম্পাদনা--স্বামী শান্তিময়ানন্দ।
তাতে রামকৃষ্ণ আরাত্রিক থেকে শুরু করে প্রচুর গান-- সব গুলোর ওপরে রাগ ও তাল লিখে দেওয়া; পরিশিষ্টে মূল কয়েকটি তালের ঠেকার বোল ও মাত্রা এবং প্রধান রাগগুলোর ঠাট , জাতি, আরোহ, অবরোহ ও পকড় লিখে দেওয়া।
সপ্তাহে কয়েকদিন সন্ধ্যেয় ওঁর ঘরে তানপুরা নিয়ে আসর বসত। আসতেন বাঁকুড়া শহরের স্থানীয় মার্গসংগীতের গায়কেরা। আমি টিউটোরিয়াল থেকে পালিয়ে সেখানে চুপচাপ বসে থেকে শুনতাম , কখনও কেউ ধমক দেয় নি।
সেবার পুরুলিয়া মিশনের প্রোগ্রামে ওঁর সঙ্গে গেছি, স্টেজে জনৈক গায়ক গাইছেন অতি পরিচিত শ্যামাসংগীত--" গয়া -গঙ্গা -প্রভাসাদি, কাশী- কাঞ্চী কে বা চায়; কালী কালী কালী বলে অজপা যদি না ফুরায়"।
কানাইদার চোখ বড় বড়। গায়ক গান শেষ করে স্টেজ থেকে নামলে উনি তাঁকে কাছে ডেকে হাতে তাল দিয়ে দিয়ে দেখালেন যে গানটি ঝাঁপতালে, মানে ৫x ২ মাত্রায়, গায়কের দম ছাড়ার ভুলে সেটা হয়ে যাচ্ছে তেওড়া , মানে ৭x২ মাত্রা।
কানাইদার ঘরে আসেন বিষ্ণুপুরের ধ্রুপদ গায়ক শ্যাম বাঁড়ুজ্জে । আর আসেন চশমা চোখে এক জন মহিলা বেশ পরিশীলিত চেহারা, সবাই বলে বিল্টুদি। ওঁকে নিয়ে কিছু হাসাহাসি কিছু রসালো মন্তব্য কানে আসে। কিন্তু আমি জানি ওসব বেয়াড়া সিনিয়র ছেলেদের বিকৃত রুচির ফল। সবকিছুতেই দাল মে কুছ কালা দেখার অভ্যেস। বিল্টুদি আমাদের একজন প্রাক্তন সিনিয়র শিক্ষকের মেয়ে। ওঁর ভাই ধ্রুপদ ও রবীন্দ্র সংগীত দুটোই গাইতে পারেন, শেখানও। বাজে কথা বল্লে হবে।।
আমরা তিনজন বিকেলে কানাইদার অফিসে গেলাম। টাইপিস্ট মানিদা বসে বসে একটা চিঠি টাইপ করছিলেন। বল্লেন--তোরা একটু অপেক্ষা কর। মহারাজ একটা জরুরী ফোনে আছেন, বেলুড়ের সঙ্গে। তারপরেই আসছেন।
অমিয়দা চুপচাপ থাকতে পারে না। বলে ওঠে -- মানিদার গাঁট্টা, পয়সায় আটটা!
মানিদা হেসে ফেলেন।
-- তোর কিসস্যু হবে না। সিনিয়র হয়েছিস, সেই চ্যাংড়া কে চ্যাংড়াই রয়ে গেলি! আর গাঁট্টা মারা কবেই ছেড়ে দিয়েছি, দীক্ষা নিয়েছি যে!

অমিয়দা বলতে যাচ্ছিল যে গাঁট্টার সাপ্লাই কমে দাম বেড়ে গেছে। এখন পয়্সায় একটার বেশি হবে না, তক্ষুণি কানাই মহারাজ ঢুকলেন।
কোন কারণে বেশ রেগে আছেন।
-- তোরা এসব কী শুরু করেছিস? হয়েছেটা কী?
আমরা চুপ। আমি টেবিল টপের সবুজ ভেলভেটের নকশা খুব মন দিয়ে দেখছি।
-- কী রে প্রদ্যুম্ন? তোর কি মাথাটাথা একেবারেই গেছে? আর অমিয়, তুই বোধহয় পালের গোদা? রাত জেগে পাহারা দেওয়া? তাহলে পড়াশুনো কখন হবে? বাবা-মা কি এইজন্যে এখানে পাঠিয়েছে?
কোন উত্তর নেই। শুধু মানিদার আঙুল টাইপরাইটারে দ্রুত চলছে।
এবার ওনার সুর একটু নরম হল।
--দেখ, একটা মাত্র ঘটনা ঘটেছে যেটা না ঘটলেই ভালো হত। আমার কাছে কমপ্লেন আসতেই কড়া স্টেপ নিয়েছি; ভবিষ্যতেও নেব--সে যেই হোক। তো? তোদের প্রবলেমটা কী?খামোখা স্টর্ম ইন এ টি -কাপ! এতে আশ্রমের বদনাম হবে না? তোরা সিনিয়র। তোদের থেকে আরও দায়িত্বপূর্ণ ব্যবহার আশা করেছিলাম। এবার যা! কোন কিছু ঘটলে সোজা আমার কাছে আসবি।

আমরা পেছন ফিরতেই উনি আবার ডাকলেন।
-- প্রদ্যুম্ন, শোন। আগামী মাসেই উৎসব ও সাধুসেবা। প্রথম দিন পথের পাঁচালী সিনেমা দেখানো হবে, তারপরে পাপেট শো। পরের দিন ভক্তিগীতি-- রামকুমার চট্টোপধ্যায় বলে ভদ্রলোক আর পূর্ণদাস বাউল; তার পরে যাত্রাপালা কংসবধ।
শেষদিন তোদের-- ছাত্রদের। এবার কী নাটক করছিস? কর্ণার্জুন?
-- না কানাইদা। ওটা গত বছর হয়ে গেছে। এবার আলেকজান্ডার-পুরু নিয়ে, নামটা মনে নেই। রিহার্সাল শুরু হয়ে গেছে।
-- গানগুলো?
আমি হেসে ফেলি।
--দেখুন না; রিহার্সাল রোজ রাতে সুনীলদা দেখছেন। একটা সীনে যুদ্ধবিজয়ের পর রাত্তিরে গ্রীকসৈন্যরা উৎসবে মেতেছে, গান গাইছে। কিন্তু সুনীলদা বলছেন গানটা হবে "জয় রামকৃষ্ণ রামকৃষ্ণ বলরে আমার মন"!
উনি হেসে ফেলেন। না;, সুনীলকে নিয়ে আর পারা গেল না। পুরু-আলেকজান্ডার তো বিসি জমানায়; তখন রামকৃষ্ণ? আর গ্রীকসৈন্যরা হল যবন। ওরা এসব গাইবে? ঠিক আছে, বইয়ে কোন গান আছে?
-- হ্যাঁ, মহারাজ। "কাতারে কাতারে মোরা চলি সেনানী"।
-- ঠিক আছে, বইটার একটা বাড়তি কপি সন্ধ্যেবেলা প্রেয়ারের পরে আমার কাছে দিয়ে যা। তিনদিনে সুর করে দেব।
আর অমিয়, তুমি সবার সঙ্গে কথা বলে আমাকে উৎসবের জন্যে ষোলজন ভলান্টিয়রের নাম ঠিক করে কালকে লিস্টি দিয়ে যাবে। তুমিই কম্যান্ডার, বুঝলে!



বার্ষিক উৎসব ও সাধূসেবা।
প্রতিবছরই হয়; এবার যেন একটু অন্যরকম। আমরা ভলান্টিয়ার যে! ভলান্টিয়র মানে অন্যদের ওপর মাতব্বরি করার সুযোগ। খেলার মাঠ জুড়ে প্যান্ডাল বাঁধা হচ্ছে; কিছু কিছু ঘুগনি-চপ-ফুলুরির দোকান বসে গেছে। চারদিকে বেশ একটা ছুটি ছুটি ভাব; দিনের বেলায় ক্লাসে না গেলেও চলে, সন্ধ্যের থেকে উৎসব!
হেড মাস্টার বা অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার যাই বলুন-- আমাদের ব্যাজ আছে। ডে-স্কলার ছেলেগুলো হিংসেয় জ্বলে মরে। বেশ কিছু স্কুলের বন্ধু একদিনে অপরিচিত হয়ে যায়।

সাধুসেবার দিন নানান প্রান্ত থেকে মিশনের সাধুরা আসছেন, কেউ কেউ হিন্দিটানে বাংলা বলেন। বেশির ভাগই আমাদের পাত্তা না দিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও গানগল্পে মেতে থাকেন। আমরা নানারকম ফাই ফরমাস খাটি।
ব্যতিক্রমী একজন -দেওঘরের মহারাজ-- আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন। তোদের হইল কী রে! ই'রকম নিমপাতা মুখ কেন? শোন শোন, একটা ছেইলে নিমপাতা হাতে নিয়ে আসিতেছিল তো ওর নাম হইল নিমাই! যদি জামপাতা নিয়ে আসে তো কী নাম হইবে?
আমরা ইচ্ছে করে প্রত্যাশিত উত্তরটি না দিয়ে ভ্যাবাচাকা মুখ করি।
-- পারলি না তো?- জামাই--হা-হা-হা-হা!
আমরাও হেসে উঠি।
তারপর ওঁদের পাত পেড়ে খাওয়াতে লেগে যাই। কোমরে প্যান্টের ওপর সেই বাঁদিপোতার গামছা বেঁধে বালতি, পেতলের গামলা ও হাতা।
সে কী খাওয়া! বড় বড় মাছভাজা, ডিম সেদ্ধ, মাংসের ঝোল, চাটনি, ছানার পায়েস ও সন্দেশ; আর বেশ বড় বড় ফজলি আম।
কিন্তু কী আশ্চর্য! এসব সাধূদের জন্যে; আমাদের বাচ্চা ধাড়ি কারও জন্যে নয়। মনটা বিদ্রোহ করে ওঠে।
যে একান্নবর্তী পরিবার থেকে এসেছি সেখানে খাওয়াদাওয়ায় বাচ্চাদের অগ্রাধিকার। আর কাজের লোক ? ওরাও একই খাবার পাবে; হয়ত মাছের পিস শুধু একটা, তবুও পাবে তো! এখানে দেখছি আমরা যা পরিবেশন করছি তা পাব না! আমাদের কপালে সেই কারি পাউডার দিয়ে রাঁধা আধসেদ্ধ ঝোল। দুস্‌ শালা; আমাদের নজর লেগে ঠিক মহারাজদের পেট খারাপ হবে।
বিপ্লবকে বলি--একচোখোমিটা দেখলি?
ও হাসে। আরে, ওঁরা সন্ন্যাসী, সংসার ছেড়ে এসেছেন। ত্যাগ করেছেন। একদিন একটু ভাল- মন্দ খাবেন, তাতেও তোর ইল্লি!
--- হুঁঃ, অমন খাওয়া দাওয়া পেলে আমিও সন্ন্যাসী হব। সে ওরা খান, তাতে কিছু না। কিন্তু আমরা কেন পাব না? আমরা তো ফ্রি তে থাকছি না। আমাদের বাবা কাকারা রীতিমত হোস্টেলের চার্জ পে করছেন।
বিকেল তিনটে।
ডাইনিং হল খালি। শুধু আমরা যারা পরিবেশন করেছিলাম সেই চোদ্দজনের খেতে বসা বাকি। আমার কিছু ভাল লাগছে না। বলি--খেতে ইচ্ছে করছে না। রুমে যাচ্ছি।
বিপ্লব বলে-- ঠিক আছে, তোর খাবার আমি ঢাকা দিয়ে রুমে রেখে নেব। যখন খিদে পাবে খেয়ে নিবি।
দোতলায় উঠে নিজের রুমে শুতে যাব , কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বিরক্ত হয়ে খটখট করি, কোন সাড়া নেই। এবার দরজায় তিন লাথি! খোল শালা!
-- কে?
আরে ! এ যে আমার গুরু অমিয়দার গলা। খোল গুরু! কী ইয়ার্কি হচ্ছে?
-- তুই একা?
-- না, বরযাত্রী নিয়ে এসেছি। খোল বলছি।
দরজা খুলে যায় আর আমি ঢোকা মাত্র বন্ধ হয়।
আমার চোখ ছানাবড়া! ঘরের মধ্যে অন্ততঃ দশজন। তিনটে বালতি ভর্তি ফিশ ফ্রাই, ফজলি আম আর সন্দেশ! সবার মুখ ভর্তি। প্রাণপণে সাঁটাচ্ছে!
গুরুর মুখে লজ্জা লজ্জা হাসি।
-- এটা কী হল গুরু? এতবড় অপারেশন! তোমার ডানহাতও আছে, অন্য ছেলেরাও আছে। শুধু বাঁহাত আমিই বাদ? আমাকে বিশ্বাস কর না?
ডানহাত প্রশান্ত ফুট কাটে-- খাওয়াটা তো ডানহাতেরই ব্যাপার, বাঁ-হাত তো শুধু পোঁদ ধুতে কাজে লাগে। তখন তোকে খবর করা হবে।
বড় কিছু হবার আগেই গুরু মাঝখানে এসে দাঁড়ায়।
--ব্যস্‌ ব্যস্‌। খেতে শুরু কর। তুই রাগ করে খাস নি, খবর পেয়েছি। সবাই মিলে হাত চালা। কিছু বাঁচানো যাবে না। তারপরে খালি বালতিগুলো কায়দা করে ফেরত দিয়ে আসতে হবে।
খেয়ে দেয়ে জমপেশ ঘুম।
সন্ধ্যেয় স্নানটান সেজেগুজে প্যান্ডেলে। মেয়েদের লাইনে ভলান্টিইয়রি করা নিয়ে কম্পিটিশন আছে যে! আজ পথের পাঁচালি দেখানো হবে। বইটা পড়েছি। সিনেমাটার এত নাম! দেখতেই হবে।
কিন্তু তখন মুখের স্বাদ তেতো হয়ে গেল ।


সন্ধ্যের আলো-ঝলমল মঞ্চ এখন অন্ধকার।অতিথি শিল্পীরা তাঁদের কাজ করে ভূরিভোজ খেয়ে বিদায় নিয়েছেন। এখন সিনেমা দেখানো হবে। তাই অধিকাংশ আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমরা ভলান্টিয়াররা ফুরসত পেয়েছি; ঢের হল। আমাদের খাওয়া জুটবে সিনেমা শেষ হলে। অস্থায়ী মঞ্চের পাশে স্কুল বিল্ডিংয়ের লাগোয়া চারটে থাম দিয়ে তৈরি স্থায়ী সিমেন্টের স্টেজ। এখানেই যাত্রা হয়, নাটক হয়।
সেখানেই টাঙানো হয়েছে একটি সাদা পর্দা। ওদিকে আশ্রমের কর্মী গৌরদা ১৬ মিলিমিটারের প্রোজেক্টর নিয়ে পজিশন নিয়েছেন; স্পুল লাগানো হয়ে গেছে। ওঁর একটিই হাত, আরেকটি কব্জি থেকে নেই। কুলোকে বলে বোমা বাঁধতে গিয়ে এই হাল। তা উনি এক হাতেই ভলিবল ম্যাচে নেটের সামনে লাফিয়ে উঠে স্ম্যাশ করেন। সেই হাতেই সিনেমার প্রোজেক্টর অপারেট করেন। পান ভরা গালে স্মিত চেহারায় এমন একটা ভাব যেন দুনিয়ার কাছে ওঁর কিছু চাইবার নেই।
সিনেমা শুরু হল। সাদা কালো।
কিন্তু খানিকক্ষণ পরেই খেই হারিয়ে ফেললাম। ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু। জোর করে তাকিয়ে দেখতে গিয়ে একবার ইন্দির ঠাকরুণের গাছের তলায় শুয়ে পড়া আর ঘটি গড়িয়ে যাওয়া চোখে পড়ল।
পাশের থেকে বিপ্লব গুঁতো মারল।
--কী হচ্ছে কী?
-- লাকি, সিনেমা দেখবি না গেঁয়ো ভূতের মত ঢুলে পড়বি?
-- ঘুম পাচ্ছে রে! ঘরের চাবিটা দে তো, আমি যাচ্ছি। খাবার ঘন্টা পড়লে ডেকে দিস।
উঠে রওনা দিলাম। কিন্তু ঘর যে অনেক দূর! আর ঘুটঘুটে অন্ধকারে এই নিস্তরঙ্গ জনসমুদ্রের মধ্যে থেকে ঘুম চোখে সাঁতরে বেরোনো?
বুদ্ধি খেলল।উল্টো দিকে হাঁটি। পর্দাটার কাছে। ওখানে অন্ধকারে থামে হেলান দিয়ে চমৎকার ঘুম দেব। কেউ দেখতে পারবে না, টেরও পাবে না। কাউকে ডিস্টার্ব না করে ভদ্রলোকের মত , জম্পেশ হবে।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। বাঁদিকের থামটায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। আমার ডান দিকে হাত পাঁচ দূরে লোহার চাকাওয়ালা ফ্রেমে সাদা পর্দায় অপূ দূর্গা হরিহর কি সব বলাবলি করছে। ওদের চেহারা দেখতে পারছি না; কথা কানে আসতে আসতে অস্পষ্ট হয়ে ভ্রমরগুঞ্জন।
আঃ, কোথায় শোনা একটা হিন্দিগানের কলি মাথার ভেতরে গুনগুন করছে-- আরাম বড়ী চিজ হ্যায় মুহ্‌ ঢাককে সোইয়ে!
কিন্তু মিনিট বিশেক পরে ঘুম ভেঙে গেল। একটা রীল শেষ হয়েছে। হাত কুড়ি দূরে একটা লাইট জ্বালিয়ে গৌরদা পরের রীলটা স্পুলে লাগাচ্ছেন। লোকজন কথাবার্তা শুরু করেছে। আর তক্ষুণি টের পেলাম পর্দার কাছে আমি একা নই।
ডানদিকের থামের গায়ে সিঁটিয়ে বসে আছে দুটো ছায়ামূর্তি, কিন্তু ঠিক বসে নেই। একজন আর একজনের কোলে।
দূর থেকে এসে পড়া হালকা আলোয় ওদের চিনতে পারছি। বড় ছেলেটা ইলেভেনের বিমলদা , বর্দ্ধমানের কোন ক্লাবের বক্সিং চ্যাম্পিয়ন। দু'বার ফেল মেরে এই থার্ড অ্যাটেম্প্ট। বয়সে বেশ বড়। কিন্তু আমরা সবাই ভয় পাই। ও নাকি কানাইদার স্পাই। ও আমাদের ঠ্যাঙালে নালিশ করা যায় না। সবাই জানে।
কিন্তু ওর কোলে ঢলে পড়ছে যে ছেলেটা ? ও তো টেন কমার্সের ফার্স্ট বয়! বুক কীপিংয়ে ওর একটা নম্বরও কাটা যায় না। হাফ ইয়ার্লিতে একশ তে আটানব্বই দেওয়ায় স্যারের সঙ্গে ঝগড়া করতে গেছল। সন্দীপদার বাবার কোলকাতা শহরের গড়িয়াহাটে রেডিমেড জামাকাপড়ের বড় দোকান। মাসে একবার সপরিবারে গাড়ি চড়ে আসেন ছেলেকে দেখে যেতে। তেল চুকচুকে কালো সন্দীপদার কোঁকড়ানো চুল, দুবেলা রেক্সোনা সাবান মেখে চান করে। স্টেনলেস স্টিলের থালাবাটিতে খায়। প্রেয়ার হলে পেছনের দিকে বসে অর্গান বাজায়। ওটা আশ্রমে আর কেউ পারে না। ওকে স্বামীজিরাও খুব পছন্দ করেন।
ওরাও যেন এখনই আমাকে খেয়াল করল, কিন্তু না দেখার ভান করে রইল। আমি অন্যদিকে তাকাচ্ছি, ঘুম মাথায় উঠেছে।বিমলদা উঠে কোথায় যেন গেল। সন্দীপদা অন্য সময় আমাকে পাত্তা দেয় না। এখন আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।

বিমলদা ফিরে এসেছে , সঙ্গে কাগজের ঠোঙায় কয়েকটা সিঙারা। আমাকে একটা দিতে গেল, আমি না করলাম।
সিনেমা আবার শুরু হয়েছে।
এবার ওরা আর আমার পরোয়া করছে না। বিমলদা প্রাণপণে চটকাচ্ছে সন্দীপদাকে, চুমো খাচ্ছে। বিমলদাটা ওরকমই , কেমন গুন্ডামত। কিন্তু সন্দীপদা? আশ্রমে প্রেয়ার হলে অর্গান বাজানো বিরল প্রতিভা ? ও কেন অমন করছে? ও যে কী আনন্দ পাচ্ছে কে জানে! দেখে মনে পড়ছে শস্তা নভেলের সেই বস্তাপচা লাইন-- চরম সুখে ঢলিয়া পড়িল!
আমি যেন চুইংগাম দিয়ে সেঁটে গেছি। অন্ধকারে একাগ্র চোখে দুই ছায়ামূর্তির দিকে তাকিয়ে আছি।
কতক্ষণ? মিনিট পনের। হটাৎ দেখি দুজন নয়, ওরা এখন তিনজন, আরও কেউ এসে জুটেছে। ওরা ফিসফিস করছে। প্রোজেক্টর এর ঘরঘরানিতে কিছু শোনা যাচ্ছে না।
কিন্তু এ কী?
তিননম্বর যে নীচু হয়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে পর্দার পেছন দিয়ে আমার দিকেই আসছে। মারবে নাকি? বিমলদা আমাকে পেটাতে চাইছে? আমি তো কিছু করি নি! বাগড়া দিই নি। আমাকে কি চলে যেতে বলবে? ভাগ শালা! কেন যাব? আমি কি বিমলের বাবার চাকর? একবার গায়ে হাত তুলে দেখুক তো? এমন হল্লা মচাব! আমাদের পুরো ক্লাসে খুব ইউনিটি, কেউ সহজে ঘাঁটায় না। কিন্তু ছেলেটা কে?
তিন নম্বর এসে আমার পাশে বসে ফিসফিসিয়ে বলে- প্রদ্যুম্নদা, আমি তোমার কাছে একটু বসব।
আমি কিছু বলতে পারি না। এ যে ক্লাস সেভেনের অনিকেত। দু'বছর আগে আশ্রমে এসেছিল। এর মধ্যেই পেকে ঝানু হয়ে গেছে। ও নাকি বড়দের গোপন রেজিস্টারে হস্টেলের নগরবধূ! ওর জন্যে দু-তিনজন সিনিয়রদের মধ্যে মারপিট হয়ে গেছে।
আমাদের গ্রুপটা এদের এড়িয়ে চলে, বাইরে থেকে দেখলে এই ছটফটে বাচ্চাটাকে ভালই লাগে। ওর সম্বন্ধে চালু গল্পগুলোর একটাও বিশ্বাস করি না।
আমি মন দিয়ে সিনেমার ডায়লগ শোনার ভান করি। ও আমার হাতে হাত জড়িয়ে রাখে।
আমি কান পেতে শুনি-- অপু! দূর্গা! এরা সব গেল কোথায়?
আচমকা সব কথাবার্তা বন্ধ। কঁকিয়ে উঠেছে সেতার ও তারসানাই।
অনিকেত কখন সহজ সরল ভাবে আমার কোলেউঠে বসেছে। আমার ওকে এক্ষুণি নামিয়ে দেওয়া উচিত। জোর করে? হ্যাঁ, জোর করে।
কিন্তু আমার সব জোর কোথায় গেল! ও আমার গালে গাল ঘষছে। আমি কাঠ হয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকি। এবার কী হবে? কিছু একটা হতে চলেছে। না; কিছু হবে টবে না। একটা ছোট বাচ্চা কোলে এসে বসেছে তা নিয়ে এত কথা কিসের অ্যাঁ?
ও আস্তে আস্তে গালে গাল ঘষছে। আমি অসাড়; নাকে আসছে একটা গন্ধ, তেলের ও অন্যরকম।
লাইট জ্বলে উঠল, সিনেমা শেষ। আমরা দুই জোড়া একে অন্যকে দেখি।
বিমলদা ও সন্দীপদা আমার দিকে তাকিয়ে বুঝদারের মত হাসে। আমি তাকাতে পারি না।

ভীড় এবার যে যার ঘরমুখো হবে। আমার পকেটেই রুমের চাবি। পা চালাই। কিন্তু এই ঘটনাটা কাকে বলব? মিতাকে বলা কি ঠিক হবে? ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি অবাক কান্ড; তালা খোলা কিন্তু আলো নেভানো, আর সমস্ত বিছানায় মশারি টাঙিয়ে ভালো করে গোঁজা। আমার বিছানায় মশারি কে টাঙিয়েছে?
কাছে গিয়ে দেখি ভেতরে কেউ শুয়ে রয়েছে। রাগে পিত্তি জ্বলে গেল। আমার বিছানায় কেউ আয়েস করে ঘুমুচ্ছে কিন্তু আমিই জানি না! এ তো সেই ট্রেসপাস না কি যেন বলে! আবার ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে!
--অ্যাই কে রে! কোন শালা ঢুকেছিস ? বেরিয়ে আয়!
প্রথমে কোন সাড়া নেই। কিন্তু নাক ডাকার শব্দ থেমে গেল। কী ব্যাপার?
লাইটের সুইচ টিপে দিই, আরও চড়া গলায় বলি-- বেরিয়ে আয় বলছি। ন্যাকামি হচ্ছে?
এবার ঘোঁৎ করে শব্দ করে মশারির কোনা তুলে বেরিয়ে এল এক মাঝবয়েসি মুশকো জোয়ান--বেশ মহিষাসুর মহিষাসুর চেহারা। আদুল গা, লুঙ্গির ঢিলে কষি বাঁধতে বাঁধতে কাঁচাঘুম ভাঙা রক্তচোখে তাকিয়ে বলল--কে র‌্যা? বাপের বয়সি লুককে তুই-তোকারি করছ, শালা -সুমুন্দি বলছ? এক চড়ে তোমার---!
ওরে বাবারে! পুরো বাক্য শোনার আগেই টেনে ছুট লাগাই। এক শ্বাসে সোজা ডাইনিং হল। পরিবেশন শুরু হয়েছে। একটা পিঁড়িতে বসে পড়েছি। আজ আর থালা ধোয়ার ঝামেলা নেই। এই কদিনের জন্যে বেশ কিছু শালপাতা আনানো হয়েছে, একটা টেনে নিলেই হল।
আজকে খিচুড়ি আর আলুভাজা। গোগ্রাসে খাই। তারপর হাতটাত ধুয়ে বন্ধুদের খোঁজ।
--উঃ, যা ভয় পেয়েছি না! ঘর খুলেছে কে? আর ওই সব মহিষাসুর লোকজন? আমি আর আজ রাত্তিরে আমার ঘরে যাচ্ছি না।
সবাই হেসে ওঠে। প্রশান্ত খ্যা-খ্যা করে হাসে। বলে--পোদো নিঘ্‌ঘাৎ মহিষবাথানের কোন মোষকে খেপিয়েছে।
-- মানে?
--শোন, ওরা হল আমাদের ক্লাসের গোলকপতির বাবা-কাকা- মা-কাকিমার দল । কোলকাতার কাছেই মহিষবাথান বলে একটা গাঁ থেকে এসেছে। ওদের মাছের ভেড়ি।
-- তা আমাদের বিছানায় ঢুকেছে কেন? আর তালা খুলল কী করে? আমাদের না জানিয়ে?
-- সবটা শোন না! ওরা ঠিক করেছেন যে রাত্তিরটা এখানেই থাকবেন, সকালে ফিরে যাবেন। তাই গোলক অমিয়দাকে ধরল। তুই আগে চাবি নিয়ে গেলি। কিন্তু ঘরে ফিরিস নি। তখন আমরা অমিয়দাকে দিয়ে অফিস থেকে ডুপ্লিকেট চাবি আনিয়ে ঘর খুলেছি। পর পর দুটো ঘর ছেড়েছি। একটায় গোলকের বাবা-কাকারা , আর অন্যটায় মা--কাকিমারা।
আমার রাগ যায় না। এসব কে ঠিক করেছে?
আমাদের গুরু অমিয়দা হেসে বলে-- আমি। রাগিস না, মাত্তর একটা রাত্তির।
--আর আমরা কি সারারাত্তির নিল-ডাউন হয়ে থাকব , না মুরগী হয়ে?
আবার একপ্রস্থ হাসি।
বিপ্লব বলে-- গুরুর উপর ভরসা রাখ তবে তো ভবদরিয়া পার হবে। আরে গুরু কানাই মহারাজকে বলে আজকের জন্যে স্পেশাল পারমিশন আদায় করেছে--আমরা ছোট ছাদে শোব।
মনটা খুশি খুশি হয়ে যায়। ছোট ছাদ? মানে আমাদের লুকিয়ে সিগ্রেট খাওয়ার ঠেক? নাঃ গুরুর প্রতিভা আছে।
আমরা বেশির ভাগ নতুন ধোঁয়া খাওয়া শিখেছি। মিন্ট দেওয়া 'কুল' দিয়ে শুরু করে পেয়ারা পাতা চিবিয়ে ধরা পরার ভয় কাটিয়ে পাসিং শো, রেড অ্যান্ড হোয়াইট, লেক্স, সিজার পেরিয়ে এখন পানামায় স্থিতু হয়েছি। গুরু ও প্রশান্ত চার্মিনারে। ঘরে পাখা নেই, তাই একটা গুমোট থাকে।
ছাদে অনেক জায়গা। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বা পাশাপাশি চাদর পেতে শুয়েছি আমরা দশজন। আমি ও বিপ্লব একটু কোণার দিকে। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। সবার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একজন দুজন এখনও সিগ্রেটের শেষ টানগুলো দিচ্ছে। কেউ কেশে উঠল।
বিপ্লব আমার দিকে গড়িয়ে আসে।
--তুই তখন চাবি নিয়ে ঘরে যাবি বলে উঠে গেলি। কিন্তু ঘরে যাস নি। কোথায় গেছলি?
--- স্ক্রীনের কাছে থামের আড়ালে হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছিলাম।
--তো আমাকে বলে যাস নি কেন? তুই তো বললি ঘরে যাবি।
-- আগে ভাবি নি তো! এমন ঘুম পেয়ে গেল যে--।
-- হটাৎ করে ঘুম পেয়ে গেল? তাই আর ঘরে গেলি না?
--এমন করে পুলিশি জেরা করছিস কেন মিতা?
-- আমি পুলিশের কুকুর বলে।
-- সে তো আমিও।
-- না লাকি; তুই আর সেই লাকি নেই।
--মানে?
--মানে পরিষ্কার। লাকি সত্যি কথা বলছে না। মিতার থেকে সত্যিটা লুকোচ্ছে।
-- কী বলতে চাস তুই?
-- ভাল করেই জানিস কী বলতে চাই। তুই ওই ছেনাল মাগী অনিকেতের সঙ্গে সাঁট করে ওখানে গেছলি। ঘুমুচ্ছিলি না; ওকে কোলে বসিয়ে চুমু খাচ্ছিলি।
-- মিথ্যে কথা!
-- আমি নিজের চোখে দেখেছি। অমিয়দা চাবির জন্যে তোকে খুঁজতে আমাকে পাঠাল। আমি একে তাকে জিগ্যেস করতে করতে স্ক্রীনের কাছে গিয়ে তোদের থেকে ফিরে এসে অমিয়দাকে বললাম ওকে কোথাও দেখছি না। আমি তোকে ধোঁকা দিই নি। কিন্তু তুই--?
--বিশ্বাস কর; আমি সত্যি কথা বলছি। ও এসে আমার কোলে বসেছিল। আর আমি চুমো খাইনি।
ও হিসহিসিয়ে ওঠে।
-- আচ্ছা? অনিকেত জানত যে প্রদ্যুম্নদা কোথায় কোন যমুনাতীরে কোন কদম্বগাছের নীচে হেলান দিয়ে বসে আছেন?
আমি চুপ করে যাই। কী বলব? কেমন করে সত্যিটা বোঝাব? পাশ ফিরে একটা পানামা ধরাই।
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। গোটা ছাদ নিস্তব্ধ। কারো কারো মৃদু নাকডাকার আওয়াজ। আকাশে চাঁদ অনেক নীচে নেমে এসেছে। কোথাও একটা দুটো পাখি চাপাস্বরে ডেকে উঠছে। আমার ঘুম আসছে না, কিন্তু চোখ জ্বালা করছে।
বিপ্লব পাশ ফিরে কনুইয়ের উপর ভর করে আমার বুকের উপর ঝুঁকে পড়ে।
--- তোর এত চুমু খাওয়ার শখ তো আমাকে বলিস নি কেন লাকি? কেন ওই ঘেয়ো কুকুরটার জন্যে ছোঁক ছোঁক করছিস?
কিছু বোঝার আগেই ওর ঠোঁট আমার ঠোঁটে চেপে বসে। সিগ্রেটের তিক্ত কষায় স্বাদ আর একটা অন্যরকম গন্ধ মুখের লালা মিলে মিশে যায়। একটু পরে আমাকে ছেড়ে দেয়।
-- আর কাউকে যদি কখনও চুমো খেয়েছিস তো তোর একদিন কি আমার একদিন। যা , এবার ঘুমো। কাল প্রেয়ারে যাব না।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in

১২

কথায় বলে না ভালোলোকের শত্রুর অভাব নেই।সুমন নানারকম অসুবিধা থাকলেও এদল ওদল করে না। টাকার লোভ তার নেই।আর এইসব গান বাজনার লাইনে রাজনীতি খুব বেশি।অনেকে ভালো শিল্পীকে নিয়ে টানাটানি করে।সুমন আর রূপসী বড় শিল্পী।তবু তারা মুরারী অপেরা ছাড়ে নি।মুরারী এখন ভালো ব্যবহার করে।আলকাপের দল খোলার পর থেকে লাভের অঙ্কটা হু হু করে বেড়ে চলেছে।তাই সে খুব খুশি।

সুমন এবার নেশা ধরেছে মদের।বাড়ির কথা মনে পড়ে তার।কিন্তু দল ছেড়ে সে থাকতে পারে না। তারপর বাড়িতে বাঁশি বাজাতে দেখলেই তার বৌ খেপে যায়।তাই অশান্তি করতে তার ভালো লাগে না। একবার তার বৌ বাঁশি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো।সেবার সুমন বৌকে একচড় মেরেছিলো ছেলের সামনে।মন খারাপ হয়েছিলো তারভাগীদার গণেশ হাজরা বলেছিলো,কাজটা আপনি ঠিক করেন নাই দাদাবাবু। সেবার গণেশকে বলে পালিয়ে এসেছিলো সুমন। এখন বাড়ি কম যায়।মাঝে মাঝে টাকা পাঠিয়ে দেয়।

 

দলে একটা নতুন মেয়ে এসেছে বিজয়া।মুরারীর সঙ্গে খুব মাখামাখি।একবার পুকুরে চান করতে গিয়ে বিজয়া সুমনকে চুমু খেয়েছিলো।বলেছিলো,কি গো নাগর। রূপসী ছাড়া আর কাউকে ভালো লাগে না। তোমার রস একদিন আমাকে খাওয়াও।সুমন এসব পছন্দ করে না। সে বললো,আর কোনোদিন আমাকে এসব বলবে না। রূপসীও আমাকে বিরক্ত করে না।

বকুনি শুনে ভিজে কাপড়ে পালিয়েছিলো বিজয়া।      তারপর অনেক দিন পরে একটা যাত্রার পালা করতে সুমনরা গেলো কোপা গ্রামে।সেখানে মেনকার বাড়ি।মেনকা বাড়ি এসেছে কয়েকদিনের জন্য।আর বন্ধুরা সবাই মিলে আয়োজন করেছে এই অনুষ্ঠানে। ঠিক রাত দশটায় কনসার্ট বেজে উঠলো।সুমনের বাঁশির সুরে মাতোয়ারা    হয়ে গেলো গ্রাম।

পালাশেষে  মেনকা সুমনের সঙ্গে আলাপ করলো। সে বললো,আমার এখন গবেষণার বিষয় এই, আড় বাঁশি।সুমন বললো,অনেক বড় হও মা। আমার তো বয়স হয়েছে।রূপসীও নেই।মরে গেছে।

মেনকা বল, কে এই রূপসী।

-----আমার ঘর বাঁধার স্বপ্নের পাখি।সে আমার সঙ্গে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলো।আমি পারি নি।

----কেন,পারেননি কেন?

----আমার বৌ বাচ্চা আছে তাই।

----ও বুঝেছি

----এই আড়  বাঁশির আড়ালে অনেক কান্ড ঘটে গেছে মা।

-----আপনি ঠিকানাটা দিন। একদিন আপনার বাড়ি যাবো। প্রণাম নেবেন।

তারপর সুমন কোপা ছেড়ে চলে এলো নিজের গ্রামে।এখন সবাই নতুন নায়ক নায়িকা। পুরোনো কেউ নেই।দল ছেড়ে এসে সে বাড়িতে বাঁশি বাজানোর শিক্ষা দিতে শুরু করলো।বহুদূর থেকে ছাত্র ছাত্রী এলো।  সুমন তার স্কুলের নাম রাখলো, মধুবনি 

শত শত শিক্ষার্থী এই মধুবনি থেকে বাঁশি বাজানোর শিক্ষা গ্রহণ করতে লাগলো।একদিন মেনকা এলো তার গবেষণার কারণে।এসেই খেনীদেবীর নজরে পড়লো সে।

তিনি বললেন,মা তোমার কোথায় বাড়ি।

----কোপা।

----তোমার বাবার নাম কি? 

-----কার্তিক মাঝি।

----ও তাহলে তুমি আমার পিসির গ্রামের দাদার মেয়ে।কোপার কার্তিক মাঝিকে আমি দাদা বলতাম ।যাওয়া আসা না থাকলে আপনজনও পর হয়ে যায় মা। এসো ঘরে এসো।

তারপর সুমন এসে তার জীবনের সমস্ত কথা বললো।মধুবনির স্বপ্নের কথা বললো।মেনকা বললো,আমি আপনার কাছে।

সুমন বললো,তোমার যতদিন খুশি থাকো।আমার মধুবনিকে দেখো।আরও অনেক তথ্য পাবে।

সুমনবাবুর ছেলে কালো, মেনকাকে দেখেই ভালোবেসে ফেলেছে।কিন্তু বলতে পারছে না।সুযোগ এসে গেলো।সুমনবাবু বললেন,কালো একবার মেনকাকে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাও।গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে কালোর সঙ্গে মেনকার পরিচয় হলো।মেনকা জিজ্ঞেস করলো,তুমি বাঁশি বাজানো শিখেছো।কালো বললো,বাবা আমাকে মায়ের আড়ালে সুর শিখিয়েছেন

-----কই বাজাও দেখি।

কালো বাঁশি বাজালো।এযেনো রাধার পোড়া বাঁশির সুর।মেনকা সুরের প্রেমে ধরা দিলো।সে বললো,আমিও এই সুর শিখবো,বাজাবো।

----নিশ্চয় শিখবে।বাজাবে।

তারা দুজনে বাড়ি ফিরে দেখে প্রচুর ভিড় মধুবনি স্কুলে।ছুটে গিয়ে তারা দেখলো, সুমনবাবুর ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ।কে বা কারা মাঠে তাকে মেরে পালিয়েছে।তিনি মাঠে যেতেন বাঁশি বাজাতে।বাঁশিটাও ভেঙ্গে দিয়েছে।মেনকা সুমনবাবুর কাছে শুনেছেন কে বা কারা যেনো তাকে মারার চক্রান্ত করছে।তার মধুবনি ধ্বংস করতে চাইছে।

পুলিশ এলো।তারা তদন্তের ভার নিলেন। 

সুমনবাবুর ছাত্র ছাত্রী সকলে কাঁধে করে শবদাহ করতে শ্মশানে গেলো।আগুনে বিলীন হলো নশ্বর দেহ। কিন্তু তার স্বপ্ন সফল করবে শত শত মধুবনির ছাত্র   ছাত্রীরা।

এমন একটা অঘটন ঘটে যাওয়ার জন্য মেনকা কালোর কাছে থাকলো অনেকদিন।এই বড় শোকে যে পাশে থাকে সেইতো আসল বন্ধু।কালোর মা বললেন,মেনকা তোমার মত একটা মেয়ে পেলে আমার জীবনে বাঁচার ইচ্ছাটা থাকবে।মেনকা বললো,একবার আমার বাবার সঙ্গে কথা বলবেন।তিনি বললেন,আমরা তোমাদের বাড়ি যাবো।

মেনকা আর কালো দুজনে      ঠিক করলো তারাই এই মধুবনির অপূর্ণ সাধ পূরণ করবে শত বাধা অতিক্রম করে।কালো বাঁশি বাজানো শেখাবে।আর মেনকা একটা গবেষণার গ্রন্থ প্রকাশ করবে।তার নাম দেবে,আড় বাঁশির আড়ালে।মেনকার গবেষণা তিন বছরে পড়েছে।আর এক বছরের মধ্যে পেয়ে গেলো পি এইচ ডি ডিগ্রি।এখন তার নামের আগে লেখে ডঃ,মেনকা বোস।

সুমনবাবুর মৃত্যুর দুবছর পরে কালো আর মেনকা বিবাহ  বন্ধনে আবদ্ধ হলো। ভালোাসার জয় হলো।কালো এখন একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক

ধীরে ধীরে মধুবনি সুরের আকাশে নক্ষত্রের জায়গা নিলো।    

0 comments: