প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধএই আন্তর্জাতিক মানবতার যুগে দাঁড়িয়ে কোনও জাতিগত গৌরবের কথা বলাটা একটু কম আধুনিক। তবু হালখাতা প্রসঙ্গে যে কটা কথা বলতেই হয়, তার মধ্যে বাঙালীর কিছু গৌরবের ইতিহাস লুকিয়ে আছে। ইতিহাস জানে, কতটা পথ চললে কোনও জাতি তার সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক চেতনায় পৌঁছতে পারে। হালখাতা উৎসব আদতে বাঙালীর নিজস্ব একটি পালন। যেকালে সাধারণ মানুষ তার জমিতে ফসল ফলিয়ে খাজনা দিতে যেত জমিদারকে, সম্বৎসরের দেয় খাজনা মিটিয়ে জমিদার বা ছোটখাট রাজার বাড়িতে বসে নিমন্ত্রন খেয়ে আসত, পরনে থাকত ভালো জামা, সেইকাল থেকে হালখাতার শুরু। এখন সেই বিশেষ দিনটি কিভাবে চিহ্নিত করি?
ইতিহাস বলছে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক ৫৯৪ খৃষ্টাব্দের ১২ই এপ্রিল, সোমবার, প্রথম বৈশাখ বঙ্গাব্দের সুচনা করেন (বঙ্গাব্দের উৎস কথা - শ্রী সুনীল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)। আমরা জানি শশাঙ্কপূর্ববর্তী সময়ে গৌড়ের তেমন কোনও ইতিহাস নেই। শশাঙ্কই প্রথম, যিনি গৌড়কে, তথা তাবৎ বাঙালীকে মর্যাদা দিলেন। সেসময় ভারতে নানা সনের প্রচলন ছিল। শকাব্দ, বিক্রম সংবৎ, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রান্তরাজ্য গৌড়ও নিশ্চয় এমনই কোনও সন তারিখ মেনে ব্যবসাসংক্রান্ত কাজকর্মগুলো করত। শশাঙ্ক প্রথম গৌড়ের জন্য একটি পৃথক বঙ্গাব্দ প্রচলন করলেন। কিন্তু সংশয় তো জাগেই! বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করলেও, এর আগে যে বাংলায় মাসের নাম প্রচলিত ছিলনা তা মনে করা হয়না। যাই হোক, বৈশাখের পয়লা তারিখ শুরু হয় নতুন বছরের। এরপর বৌদ্ধ রাজাদের সময় শশাঙ্কের এই সনের হিসেব যায় হারিয়ে। পালরাজাদের নতুন হিসেবে বঙ্গাব্দের প্রচলন দেখতে পাইনা। যদিও লক্ষনাব্দ শুরু হয়েছিল, তবু অনেকেই মনে করেন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ আবার বঙ্গাব্দ ফিরিয়ে আনেন। তাঁর মৃত্যুর একশো বছর পরে সম্রাট আকবর ৯৯২ হিজরীতে, ইংরাজি ১৫৮৪ সালে আবার বঙ্গাব্দ ফিরিয়ে আনেন। যদিও কর্ণসুবর্ণে শশাঙ্কর রাজধানীপ্রতিষ্ঠার দিনটি এই বছর শুরুর দিন বলে যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন তবু ধারাবাহিকভাবে বঙ্গাব্দ সেই সময় থেকে প্রচলিত হতে পারেনি। ছেদ অবশ্যই পড়েছিল।
এসব তো হোল আমাদের বাংলা বছরের শুরুর ইতিহাস। যা নিয়ে পণ্ডিতমহলে বিস্তর মতের অমিল আছে। কিন্তু হালখাতা নিয়ে আমরা নিঃসন্দেহ। আগেকার দিনে চাষাভুষো মানুষ তাদের জমিদারের খাজনা মেটাত চৈত্রের শেষে। আর তাই জমিদার বাড়িতে পাত পেড়ে খাওয়ার নিমন্ত্রণ পেত। জমিদার বাড়ি বলে কথা। যেটুকু ভালো কাপড়চোপড় থাকত তাইই পরে যেত তারা। নেমন্তন্নয় যেত পুরুষ ও বাচ্চারা। বাড়ির মেয়েরা নয়। এরপর জমিদারি গেলো বণিকের হাতে। বেণের পো জমিদারের চেয়ে বুদ্ধি ধরে বেশি। তারা খাতকদের যা ধারকজ্জ দিতো সেসব উশুল করত সারাবছর ধরেই। যে ধার রয়ে যেত, জমিদারের দেখাদেখি সেটুকু উদ্ধারের জন্য তারা প্রচলন করল হালখাতার। অর্থাৎ, সারাবছর যে দেনদার ধারে মালপত্র নেবে, বছর শুরুর এই দিনে সে গত বছরের সব দেনা সুদে আসলে মিটিয়ে দেবে।
এই প্রথা আমরা বাল্যেও দেখেছি। আমাদের ছোটবেলায়, দোকানে ধার থাকুক বা না থাকুক, পয়লা বৈশাখ, কিংবা অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে নির্দিষ্ট দোকানে গিয়ে আমরা ক্যালেন্ডার ও মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসতাম। সেসব নেহাতই ছোটখাট দোকান। আমাদের পাড়ার বইখাতার দোকান বা ষ্টেশনারী, মুদিখানা পর্যন্ত গতি। এছাড়া কাপড়ের দোকান বা সোনার দোকানে গতি ছিল বাবার। সেখান থেকে বচ্ছরকার দিনে মায়ের একটা শাড়ি বা ছোট দুল আসত মিষ্টির প্যাকেটের সঙ্গে। আমরা অবাক হতাম। কই, আমাদের তো নতুন একটা বইও দিলনা পরিমলকাকু? মা বলেছিল, ওটা কথা নয়। কথা হোল, বাবা আগের বছরের খাতা বন্ধ করে নতুন খাতা খুলে এসেছে। সেখানে বাবার নামে আবার এই বছরের হিসেব শুরু হবে। এই যে বাবা সোনার দুল কিনে আনল, এতে সোনার দোকানের মালিক, সুবোধকাকুর ভালো হবে। ব্যবসায়ে উন্নতি হবে। আর তাই, খুশি হয়ে দোকানের মালিক বাবাকে মজুরীতে ছাড় দেবে। নতুন কাপড়েও ছাড় দেয়।
এই ব্যবসাপদ্ধতি এখন অবশ্য সারাবছর জুড়ে চলছে। নতুন বছরের শুরুতে লাল শালুতে মোড়া লম্বা হিসেবের খাতার প্রথম পাতায় সিঁদুরে ডোবানো কয়েনের ছাপ দিয়ে সিদ্ধিদাতা গনেশ ও মা লক্ষ্মীকে স্মরণ করে সেই যে হালখাতার উৎসব, সেসব এখন খানিক রঙ হারিয়েছে। আছে এখনও, মিষ্টির বদলে কেউ কেউ বিরিয়ানির প্যাকেটও দেন দেখতে পাই, কিন্তু সেভাবে আর নেই। এখন সাধারণ মধ্যবিত্ত ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন। দোকানে গিয়ে ধার করেননা। কার্ডের মাধ্যমে ধার হয় সরাসরি ব্যাংকে। দোকানদার আর ক্রেতার মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে ব্যাংক। ফলে যে ছাড় ক্রেতা পেতেন সেই লাভের অংশ, কি তার চেয়েও বেশি, ঢোকে ব্যাংকে। ক্রেতা বুঝতেই পারেননা আসলে জিনিসটার লিখিত দামের চেয়েও বেশি মূল্যে তিনি কিনছেন। একটা দেখনদারিতে ঠেকেছে আমাদের কেনাকাটা থুড়ি শপিং। আমরা মোবাইল খুললেই দেখতে পাই শপিংমলে সেল চলছে। অনলাইন পোর্টালে সেল চলছে। কোথাও বিশেষ বিশেষ উৎসবের মরশুমে। কোথাও সপ্তাহান্তিক সেল। বাই টু গেট ওয়ান ফ্রির ছড়াছড়ি। সাবেক পাড়ার দোকানী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছেন। তাঁর দোকানে অমন চাকচিক্য কই? চীনে জিনিসের মতন অমন রঙিন অথচ পলকা বস্তুতে বাজিমাত করার শিক্ষা তো তাঁর নেই। তিনি তো জানেন অটুট মজবুত জিনিসের বেচাকেনা। অটুট সম্পর্কের মতোই। যা ইউজ এন্ড থ্রো’র যুগে অচল। তাঁর তো ধরা খদ্দের! এ পাড়ার হলদে তেতলা বাড়ি থেকে শুরু করে ও পাড়ার সবুজ একতলা পর্যন্ত। তিনি তো জানেন কোন বাড়ির লোকেরা কোন কোন জিনিস নেন। সেইমত মালপত্র তোলেন। হঠাৎ পরিবর্তনে তিনিও দিশেহারা। তাঁর ছেলেরা হয় অন্য কাজে যুক্ত, দোকান ধুঁকছে, নয়ত এই দোকানকে আধুনিক করে তুলতে বদ্ধপরিকর। তাঁর যুক্তি খাটেনা। ক্রমে আমাদের একান্ত নিজস্ব সৌহার্দ্যের উৎসবরীতি পর্যবসিত হয়েছে বছরজোড়া কেনাকাটায়। তার স্বাদ হারিয়েছে অসময়ের ফলের মতো। হালখাতার যে ভিত্তি, পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা, সেটির আর প্রয়োজন নেই এখন। মানুষের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছাড়াও যে ব্যক্তিগত সৌহার্দ্যের সম্পর্ক ছিল সেটি এখন অনুপস্থিত।
একান্ত বাঙালী এই উৎসবরীতি কিভাবে স্বর্গে পৌঁছেছে তাই নিয়ে খুব ভাবি। যমের রাজ্যে চিত্রগুপ্ত কেরানি। কেমন করে তিনি আমাদের কৃতকর্মের হিসেব রাখেন? যেমন দেখেছি আশৈশব, তেমনই একটা লাল খাতা কি তাঁর হিসেবের খাতা? কিন্তু অনন্ত কালের অসংখ্য মানুষের কর্মফলের হিসেব রাখা তো চাট্টিখানি কথা নয়! গল্পকথা, কিন্তু তার শেকড় জল মাটি পায় বাস্তব থেকেই। নিশ্চয় চিত্রগুপ্ত বাঙালী। তাঁর শিক্ষাদীক্ষা বাংলায়। নইলে এই বুদ্ধি তাঁর মাথায় আসলো কি করে?
আমজনতা তাহলে এইসব ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের বাইরে? প্রশ্ন থেকে যায়। লাল শালুতে মোড়া একটা হিসেবের খাতা আমরা কি নিজেরাও রেখে দিইনা? সেখানে শুরু থেকে লিখতে থাকি নানা দেনাপাওনার কথা? সেসব দেনাপাওনা অবিশ্যি স্থুল চোখে তেমন ধরা পরেনা। কখনও কখনও মনের সিন্দুকে সেই খাতাটা ধুলো ঝেড়ে উঠতে চায়। আমরা গোপনে খুলি। হিসেব মেলাতে হবে। কাকে দিতে হবে ছাড়? যে অনুজ তার বাল্যে আমাকে না জেনে আঘাত দিয়েছে, ছাড় তার প্রাপ্য। যে অগ্রজ আমাকে জীবনের পাঠ দিতে গিয়ে অকারণ নিষ্ঠুর হয়েছে, তাকে ছাড়। না, সুদ কেন, আসলটুকুও ছেড়ে দিতে হবে। হিসেব মিলবেনা নইলে। আমারও যে দেনা মেটাবার থাকে! কিন্তু পাওনাদার হয়ত তার লাল খাতাখানা হারিয়ে ফেলেছে। কিংবা হয়ত না ফেরার দেশে সেখানা আর বয়ে নিয়ে যায়নি। তাই আমিও চেষ্টা করি।
[যুগশঙ্খ নববর্ষ ক্রোড়পত্র ২০১৯]